বসন্ত এসে গেছে পর্ব ২৯

#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ২৯
,

,
মধ্যরাতে একা একা রাস্তায় হাটতে একটুও ভালো লাগছেনা নোমানের।
আশেপাশে মানুষের আনাগোনা একেবারেই কম।
গাড়ি চলছে দু একটা।ফুটপাতে কিছু পথশিশু ছেড়া কাথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে।
চারদিকে কেমন শুনশান নিরবতা।
শুধু নোমানের মনের ভেতর চলছে প্রলয়ংকারী ঝড়।
এ ঝড়ে উল্টে পাল্টে যাচ্ছে তার ভেতরটা।
হ্রদয়টা চুর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।
অপুর সাথে রাগ করে সেই যে সাত সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো তার পর আর বাড়িমুখো হয়নি নোমান।
রাগের মাথায় গাড়ি নিয়েও বেরোয়নি।
সারাদিন একটা পার্কে বসে ছিলো।
সবুজ মনোরম পরিবেশে বসে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় ছিলো।

আশেপাশে শতো শতো কপোত-কপোতীকে দেখতে দেখতে অপুর কথা ভেবেছিলো।

নোমান যে বেঞ্চে বসে ছিলো তার সামনে এক বৃদ্ধ জুটিকে দেখেছিলো মন ভরে।
সেই বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার খুনশুটিময় ভালবাসা দেখেছিলো,তাদের রুগ্ন রুক্ষ হাতে হাত ধরে মুখে তৃপ্তির হাসি দেখেছিলো।

ভিতরের তোলপাড়টা তখন আরও প্রকট আকার ধারন করেছিলো।
সেও তো অপুর সাথেই এমন সারাটিজিবন কাটাতে চায়।অপুর হাতে হাত রেখে জিবনের বাকী পথগুলো চলতে চায়।
তবে সে কেনো অপুকে অবিশ্বাস করলো।
একটা সম্পর্কের ভিত্তি তো বিশ্বাস। আর নোমান কিনা সেই ভিত্তি টাকেই নড়বড়ে করে দিলো?

নোমান রাস্তার পাশের ফুটপাতে বসে পরলো।হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার।
কখনো এভাবে হাটা হয়নি রাস্তায়। সচরাচর এসি গাড়ি করেই চলাচল করে সে।
নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে খুব।
অপুর সাথে ওমন ব্যবহার করেছে ভাবলেই কেমন দম আটকে আসছে।
নিজের গালে নিজের চড় বসাতে ইচ্ছে করছে।
নিজের এই অত্যাধিক মাত্রার রাগকে কেনো কন্ট্রোল করতে পারেনা সে?
কেনো হুট করে এতোটা চেচামেচি করে?কেনো সামনের মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলে নোমান?

নিজের চুল হাত দিয়ে টেনে ধরে।
মাথা ব্যথা করছে খুব।অত্যাধিক চিন্তায় মাথা ধরে গেছে।
নোমান নিজের এই রাগী ভাবটাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনা।
রাগের বশে সামনে দাড়ানো মানুষটাকে উল্টোপাল্টা বলে বসে সে।
কিন্তু রাগ কমলেই অনুসূচনার আগুনে দগ্ধ হয়।
এখন তার প্রচুর অনুসূচনা হচ্ছে।
কেনো বলতে গেলো অপুকে ওমন ভাবে?কেনো কষ্ট দিলো সে অপুকে?
অপুর কাছে ভালোমতো জিজ্ঞেস ও তো করতে পারতো সে?
অপুকি সবটা বলতো না?
এতোটা দিন ধরে অপুকে যতটুকু চিনিছে নোমান তাতেও কি অপুর উপর এতোটুকু বিশ্বাস করা উচিৎ ছিলো না নোমানের?

কিন্তু কি করতো নোমান?
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই রুবেল কল দিয়ে যে বললো,অপু রায়হানের সাথে কথা বলেছে,একসাথে দুজনে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরেছে।
নোমান নিষেধ করার পরও অপুর এ সিদ্ধান্ত যে মেনে নিতে পারেনি নোমান।
তার কথার অমান্য করা যে সে পছন্দ করেনা।
এতোকাল এমনটাই তো করে এসেছে নোমান।
কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করেও তো অনূসুচনা হয়নি নোমানের।
উহু,বিন্দুমাত্রও হয়নি।
তবে আজ কেনো হচ্ছে?
অপুর জন্য?
বুকের ভেতরের এই তীব্র যন্ত্রনার কারনটা কি অপু?
তাকে কষ্ট দেওয়ার ফলে কি নিজের বুকের ভেতরটাও কষ্ট পাচ্ছে?

তবে এ অনূভুতির নামটা কি?
ভালবাসা?
নোমান খানও অবশেষে ভালবাসলো বুঝি?
নোমান নিজের মনেই হাসে।
আবার গম্ভীর হয়।
অপুকে ভুল বোঝা উচিৎ হয়নি তার।
এভাবে কথা বলাটাও উচিৎ হয়নি।
অপু সত্যিই যদি রায়হানকে ভালবাসতো তাহলে কাল রাতে নিজের সমস্ত সত্তা নোমানের হাতে তুলে দিতো না।
আর যাই হোক নিজের সম্ভ্রমের চেয়ে দামী তো আর কিছু নেই।

তাছাড়া অপু সেরকম মেয়েই না।
অপু আলাদা,সবার চেয়ে আলাদা।
নিজের মনে কথাগুলো ভেবে উঠে দাড়ায় নোমান।
বাড়ির পথে হাঁটা দেয় সে।

——

সারাবাড়ি খুজেও কোথাও অপুকে দেখতে পায়না নোমান।
তার বুকটা ধক করে ওঠে।
হাত পা অসাড় হয়ে আসে।
তবে কি অপু নোমানকে ছেড়ে চলে গেলো?এ বাড়ি ছেড়ে,নোমানের জিবন ছেড়ে অভিমান করে চলে গেলো সে?অপুকে হারানোর ভয়টা মনে গ্রাস করে বসে নোমানের।
টেবিলে জোরে আঘাত করে হাত দিয়ে।
সকালের ভাঙা কাঁচের টুকরো পরেছিলো সেখানে হাত লেগে কেটে যায়।সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রক্ষেপ করেনা সে।
তার বুকের ভেতরে বাইরের চেয়ে হাজারগুন বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে যে।

পাগলের মতো এদিকওদিক খোঁজে।
তন্ন তন্ন করে খোঁজে।
দারোয়ানকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে অপুর কথা।দারোয়ান জানায় অপুকে তিনি বাইরে বেরোতে দেখেননি।
নোমান তবুও শান্ত হয়না।
বাড়ির বাইরে যায়নি তাহলে গেলোটা কোথায়?

খুজতে খুজতে ছাদে আসে।
রেলিংয়ের এককোনায় একটা ছায়ামূর্তিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বড় করে হাপ ছাড়ে নোমান।স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
এক নিমিষে চিনে ফেলে সে,ওটা অপরুপা।
ধীর পায়ে অপুর কাছে এগোয়।
পেছনে দাড়াতেই অপুর খোলা চুলের ঝাপটা লাগে তার চোখেমুখে।
মৃদু বাতাসে অপুর খোলাচুলগুলো এদিকওদিক দোল খায়।
নোমান মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরায় না।লম্বা শ্বাস নেয়।
চুলের ঘ্রান শোকে।
মিষ্টি ঘ্রানে বিমোহিত হয়।

অপু পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে চমকে ওঠে।
একটু দুরে সরে পেছন ঘুরে তাকায়।
মৃদু আলাতেও নোমানকে চিনতে পারে।
একপলক নোমানকে দেখে আবার রেলিং ধরে দারায়।
রাতের অন্ধকার দেখায় মন দেয়।

নোমান আমতাআমতা করে।
অপুর এ নিরবতা তার ভালো লাগেনা।
অপু তাকে বকুক,অভিমানে গলা জরিয়ে কাদুক,বলুক আপনি কেনো আমায় ভুল বুঝলেন?এমনটা না করায় নোমান ভয় হয়।অপুকে হারানোর ভয়।

কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা অপুকে।
কেমন গলা ধরে আসে তার।অপরাধবোধে কুঁকড়ে ওঠে সে।
পেছন থেকেই ডেকে ওঠে,

—অপরুপা!

অপু জবাব দেয়না।
আরও কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নোমানকে এড়িয়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে আসে সে।
অভিমান বা রাগ ভাঙানো যায়,কিন্তু আত্মসম্মানে আঘাত দিলে সে ক্ষত কি সহজে শুকানো যায়?

,

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here