বসন্ত এসে গেছে পর্ব ৯

#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ৯

,

,

অপুর এমন সাহসীকতায় নোমান অবাক হয়,কিন্তু সেটা কিছু সময়ের জন্যই।পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নেয়।
নরম সুরে বলে,

—তুমি বানিয়েছো?

অপু অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।নোমানের এমন নরম সুর শুনে ভয় পায়।ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজায়।এমন নিস্তব্ধতা যে ঝড়ের পূর্বলক্ষন সেটা উপলব্ধি করে।

নোমান এবার চিৎকার করে বলে,

—স্পিক আপ।

অপু দ্রুততার সাথে মাথা নাড়ে।ভয়ে এতো জোরে মাথা নাড়ে যেনো মাথা খুলে এক্ষুনি পরে যাবে।

নোমান মাথা নাড়ানো দেখে এগিয়ে আসে।
আরো জোরে চিৎকার করে বলে,

—কেনো বানিয়েছো আমার কফি?কেনো বানিয়েছো?
বউ সাজতে গেছিলে?আমার বউ সাজতে চাও?ছোটলোকের মেয়ে হয়ে এতোবড় স্পর্ধা?আরে বাবা না বললে তো তোমাকে বিয়ে করা দুর তোমার মতো মেয়ের দিকে আমি নোমান খান ফিরেও তাকাইনা।

বাবাকে পটিয়ে আমার গলায় ঝুলেছো তুমি,সেকথা আমি জানিনা ভেবেছো?
কি ভেবেছোটা কি?আমি তোমাকে,তোমার মতো থার্ড ক্লাস মেয়েকে মেনে নেবো?নেভার।

অপু স্তব্ধ হয়,বাকরুদ্ধ হয়ে পাশের সোফায় ঠাস করে বসে পরে।
তার হাত পা কাপে।লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চায়।
চারদেয়ালের মাঝে এসব বললে যতোটুকু না খারাপ লাগতো তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগে রুজি আর নয়নার সামনে বলায়।
যদিও ব্যাপারটা খারাপ লাগা না,ব্যাপারটা হচ্ছে আত্মসম্মানের।
অপু কাঠ হয়ে নিচের দিকে চোখ রেখে বসে থাকে।চোখ থেকে ফোটায় ফোটায় অশ্রুবিন্দু ঝরে পরে।

নোমান সেদিকে তাকায়না।গটগট করে হেটে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।রুজি আর নয়না তাড়াহুড়ো করে ফ্লোর থেকে কাঁচের টুকরো তুলে পরিস্কার করে।
অপুকে নিজের মতো একা থাকতে দিয়ে তারাও বেরিয়ে যায়।

অপু নির্বাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে।
পরক্ষনে কান্নায় ভেঙে পরে।
কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে যায়।
অপু জানতো তার ভাগ্যটা খারাপ,তার সাথে এযাবত কোন ভাল ঘটনা ঘটে না।
খারাপ ভাগ্যটাকে মেনেও নিয়েছিলো অপু।তাই বলে এতোটা খারাপ ভাগ্য তার সেটা অপু বুঝতে পারেনি।

নোমানের কান্ডকালাপ শুনে আরমান খান অপুর রুমে আসেন।অপুকে এমনভাবে কাঁদতে দেখে তার খারাপ লাগে।
ভাবে মেয়েটার জিবন তিনি নিজে হাতে নষ্ট করছেন নাতো?কিন্তু নোমান?সেতো খারাপ না?উপরে খারাপ হওয়ার এক খোলস লাগিয়ে ঘোরে সে।কিন্তু ভেতরটা?ভেতরের মনটা যে তার নরম।
ছেলেটা ছোটবেলা থেকে ভালবাসাহীন থেকে থেকে এরকম রুক্ষ, শক্ত তৈরি হয়েছে।
আবার নতুন করে কেউ ভালবেসে তাকে আপন করলে সে কি ঠিক হবেনা?অপু কি পারবেনা নোমানের রাগী,রুক্ষ খোলসটাকে ভেঙে গুঁড়ো গুড়ো করতে?
নাকি নিজেই ভেঙে যাবে?

আরমান খান আর ভাবতে পারেননা।
দরজার কাছ থেকে আবার নিজের রুমে ফিরে আসেন।
অপুর সামনে তার দাঁড়াতে ইচ্ছে করেনা।মেয়েটার এমন অবস্থার কারন হিসেবে নিজেকে দোষী মনে হয় তার।

দুপুর পর্যন্ত নিজের ঘরে থম মেরে বসে থাকে অপু।নোমানও আর রুমে আসেনা।
সকালের নাস্তা করে সে অফিসে চলে যায়।
এদিকে তার উপর অভিমান করে যে একজন না খেয়ে বসে আছে সে দিকে তার কোন হুশ নেই।

নোমানের কথাগুলো খুব আত্মসম্মানে লাগে অপুর।রাগ হয় নোমানের ওপর।
তারচেয়েও বেশি রাগ হয় আরমান খানের ওপর।
উনি কেনো ছেলেকে জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলেন?তাহলে তো এমন পরিস্থিতিতে অপুকে পরতে হতোনা।
ঠিক তখনি খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে রুমে ঢোকেন আরমান খান।
মুখে তার অনুতাপের ছাপ স্পষ্ঠ।
প্লেট টা এগিয়ে এনে অপুর পাশের টেবিলে রাখেন তিনি।নিজে বসেন অপুর পাশে।
মাথা নিচু করে বলেন,

—বুড়ো বাপটার ওপর রাগ করেছিস মা?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি অপুর উত্তরের অপেক্ষা করেন। অপুর উত্তর না পেয়ে বড়সড় নিশ্বাস ছাড়েন।
হাতটা নিয়ে অপুর মাথায় রেখে কন্ঠে আকুলতা মিশিয়ে বলেন,

—আমার ছেলেটা খারাপ নারে মা।ও উপর উপরেই ওমন,কিন্তু ভেতর থেকে খুব নরম মনের মানুষ ও।

অপু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়।আরমান খান সেদিকে দেখে বলেন,

—আমার দোষেই ছেলেটার এমন দষা জানিস মা।ছোটবেলা থেকে অযত্ন, অবহেলায় ধীরে ধীরে ও এমন হয়ে গেছে।
আমার বর্তমান স্ত্রী রিচি একজন বিদেশি মেয়ে।
নোমানের মা বেচে থাকতেই তার সাথে আমি অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছিলাম।
তার জন্য আমি আজও নিজের চোখে নিজেকে অপরাধী ভাবি।
নোমানের মা মারা যাওয়ার পর আমি রিচিকে বিয়ে করি।রিচি তখন নোমানের সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে।
যে বয়সটায় ওর ভালবাসা পেয়ে হেসে খেলে বড় হওয়ার কথা ছিলো,সে বয়সটায় ও পেয়েছে সবার কাছ থেকে তিক্ততা।
কি নিদারুণ স্ট্রাগল করে ও বড় হয়েছে।
আমি বাবা হয়েও ওর পাশে থাকতে পারিনি।
তুই বল মা,নোমানের জায়গা তুই থাকলে কি এমন স্বভাবের তৈরি হতিনা?বল?

অপু মাথা নাড়ে।সত্যি সে এতো কিছু ভাবেনি।
আরমান খান প্লেট হাতে নিয়ে এক লোকমা ভাত অপুর মুখের সামনে আনেন।

—খেয়ে নে তো মা,সারাবেলা না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবি তো।তখন এই বুড়ো বাপকে কে দেখবে?

অপু আরমান খানের কথা শুনে মুচকি হাসে।ঝটপট হা করে।

খাবার খেয়ে অপু নিচে নামে।রুজি খালা আর নয়নার সাথে হাতে হাতে কাজে সাহায্য করে।
কিছুক্ষণ একা একা ঘুরে পুরো বাড়িটা দেখে।
সারাটাদিন এভাবেই পার হয় অপুর।
রাতে সবাই খেয়ে নিলেও অপু খায়না।
সে নোমানের জন্য অপেক্ষা করে।ঘড়ির কাটায় রাত ১১টা বেজে যায়।তবু নোমান আসেনা।
অপু ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে ঘুমে ঢোলে।

কলিং বেলের শব্দে চকিত দৃষ্টিতে তাকায়।
হুড়মুড় করে উঠে দৌড়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়।
নিজের দিকে তাকিয়ে শাড়ি ঠিক করে।
দরজা খুলে দেখে সামনে নোমান দাড়িয়ে আছে।
তার চোখ লাল।
অপু ভেবে পায়না লোকটার চোখ সবসময় লাল থাকে কেনো?
সবসময় রেগে থাকে সেইজন্য? নাকি তার চোখই লাল?

,

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here