বাইজি কন্যা পর্ব ১৩+১৪

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_১৩
বাইজি শারমিন শায়লা নিজ কন্যা’কে বাইজি গৃহ থেকে সরানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জমিদার অলিওর চৌধুরী’র সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, অতি শিঘ্রই সব ব্যবস্থা করবে। কিন্তু শর্ত একটাই, শাহিনুর’কে একাই ত্যাগ করতে হবে এই গৃহ। শারমিন কোনদিন এক মূহুর্তের জন্যও মেয়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করতে পারবেনা। বড়োজোর চিঠি আদান-প্রদান হতে পারে এর বেশী কিছু নয়। শাহিনুর তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেবল শারমিনের মেয়ে বলে একটু দয়া করছে অলিওর চৌধুরী। তাই বলে শারমিন’কে সে মুক্তি দেবেনা। মৃত্যুর আগ মূহুর্ত অবদি শারমিন’কে নিজের বন্দিনী হিসেবেই দেখতে চায় সে। কতোটুকু পেয়েছে সেই হিসাব সে করতে চায় না শুধু জানে শারমিন তার অধিন্যস্ত। অলিওরের বক্তব্য শুনে হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠেছিলো শারমিনের। কলিজা যেনো ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে তখন থেকেই। কি করে থাকবে সে? কি করে থাকবে তার মেয়েটা? একটা সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় এতো বড়ো ত্যাগ যে মা, মেয়ে’কে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু শাহিনুর ভুল বুঝবে না তো তাকে? শাহিনুর সহ্য করতে পারবে তো মায়ের থেকে তার বিচ্ছেদ’টাকে। সহ্য করতে পারবে তার জীবনের সত্যি’টাকে? সকাল থেকেই বেশ মনমরা হয়ে ঘরে বসে আছে শারমিন। মান্নাত এসে দেখলো খাটে আধশোয়া হয়ে বসে এক ধ্যানে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে শারমিন। গতকাল রাতে অলিওর চৌধুরী এসেছিলো। সবসময় অলিওরের সঙ্গে শারমিনের সাক্ষাৎ হওয়ার পর মূহুর্তে শারমিন’কে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নারী মনে হয়। তার চাহনি, তার কন্ঠস্বর, সবকিছুতেই যেনো অদৃশ্য এক শক্তির আভাস পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মান্নাতের ভয় হয়। কে জানে শারমিনের এই শক্তির পিছনে গভীর দূর্বলতা’কে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে কিনা! কিন্তু আজ যেনো সবটাই ব্যতিক্রম। আজ শক্তিশালী কোন নারী নয় বরং ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড দুর্বল, অসহায় এক মা’কে দেখতে পাচ্ছে মান্নাত। ধীরপায়ে শারমিনের দিকে এগিয়ে গেলো সে। কাছে গিয়ে বসে কাঁধে ভরসার হাত রাখলো৷ বললো,
-‘ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে ওঠে দাঁড়াতে হয় সখী। আমরা শুধু পড়তেই জানি ওঠতে জানি না তাইনা। ‘
মান্নাতের দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালো শারমিন। মান্নাত শারমিনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে ভরসার সুরে বললো,
-‘ আজ আমি আর কোন প্রশ্ন করবোন না। শুধু বলবো তুমি ভেঙে পড়োনা, তুমি ভেঙে পড়লে আমাদের কি হবে বলোতো? সবচেয়ে বড়ো কথা নুরের কি হবে? ‘
অশ্রুসিক্ত নয়নে মান্নাতের মাথায় হাত রাখলো শারমিন। বললো,
-‘ কিন্তু আজ তুই সব উত্তর পাবি মান্নাত। ‘
মান্নাতের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো শারমিন। মান্নাত অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শারমিনের দিকে। আর শারমিন নিজের মানসিক শক্তি সঞ্চয় করার জন্য দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ রেখে বারকয়েক ঘনঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বাইজি গৃহের এই একটা মেয়ে ‘মান্নাত’ যে কিনা সব সময় তাকে বোঝার চেষ্টা করে। হাজারোবার প্রশ্ন করে উৎসুক হয়ে জানতে চায় তাকে, বুঝতে চায়। অথচ কোন প্রশ্নের উত্তর পায় না,কোন কিছুই জানতে পারে না,বুঝতে পারে না। তবুও বিনা স্বার্থে সারাক্ষণ পাশে থাকে। নিজের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাগুলো’কে বিনা দ্বিধায় ব্যক্ত করে। কি অদ্ভুত সম্পর্ক তার মেয়েটার সঙ্গে। দুঃখের গল্প দিয়েই শুরু হয়েছিল তাদের সম্পর্ক। মেয়েটি বলেছিলো জমিদার অলিওর চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। তারপর থেকেই মেয়েটির দুঃখের সঙ্গী সে। নিজের দুর্বলতাগুলো’কে কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেনি শারমিন। কিন্তু মান্নাত, বয়সে মেয়েটা অনেক ছোট হলেও তার মতোই বিশাল দুঃখ লালন করছে বুকে। দু’টো দুঃখী বুক সখী’তে রূপ নিয়েছে বহু আগেই। মান্নাতের জীবনের আগাগোড়া শারমিন জানলেও শারমিনের জীবনের কোন কিছুই জানেনা মান্নাত। কিন্তু আজ আর শারমিন সহ্য করতে পারছেনা। পুরোনো ক্ষতগুলোয় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তার বক্ষঃস্থলের হাহাকার গুলোকে বিন্দু স্বান্তনা দেওয়ার জন্য মান্নাত ছাড়া আর কাউকেই খুঁজে পেলো না। তাই বললো,
-‘ মান্নাত’রে পৃথিবী’টা যতোটা সুন্দর পৃথিবীর মানুষগুলো ঠিক ততোটাই কুৎসিত। ‘
কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠলো শারমিনের। বক্ষঃস্থল মুচড়ে গেলো মান্নাতের। শারমিনের দু’টো হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-‘ বলো সখী বলো তুমি, থেমো না আজ তুমি, থেমো না। তোমার সত্যিটা আমাকে জানাও। ‘
অতীতঃ
-‘ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলাম আমি। আব্বা পাটের ব্যবসা করতেন। আব্বার স্বপ্ন ছিলো আমাদের দু’ভাই বোন’কে অনেক পড়াশোনা করাবে। ভাই চাকুরি করবে। আমি শিক্ষিত হলে মস্ত বড়ো এক ডাক্তার পাত্র জোগাড় করে আমার বিয়ে দেবে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। দেখতে সুন্দরী ছিলাম বলে গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বারের বখাটে ছেলেরা বিয়ে করার জন্য ওঠে পড়ে লাগে৷ কিন্তু আব্বা কোনমতেই আমাকে বখাটে ছেলের কাছে বিয়ে দেবে না৷ সে বছর নির্বাচনের সময় চেয়ারম্যানের সকল আত্মীয় স্বজনরাই গ্রামে আসে। সে আত্মীয়দের মাঝে চেয়ারম্যানের বড়ো বোনের ছেলে অলিওর আর ছোট বোনের ছেলে শাহিনের নজরে পড়ে যাই আমি। দু’দিনের ভিতরে আব্বার কাছে প্রস্তাব আসে। চেয়ারম্যানের ছোট বোনের ছেলে ডাক্তার শাহিন আহমেদ আমাকে বিয়ে করতে চায়। ছেলে যেহেতু ডাক্তার সেহেতু বউ’কেও পড়াশোনা করাবে। ডাক্তার পাত্র কোনমতেই হাতছাড়া করতে চায়নি আব্বা তাই প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করে নেন। সেদিনই নাকফুল পড়িয়ে বিয়ের পাকা কথা হয়ে যায়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে পরেরদিন সকালবেলা। কারণ চেয়ারম্যানের বড়ো বোনের একমাত্র ছেলে অলিওরও নাকি আমাকে বিয়ে করতে চায়। এই নিয়ে তাদের ভাই,বোনদের মাঝে বেশ ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলা হয়েছে অলিওর এবং শাহিন আহমেদের মাঝেও। সব ঝামেলা’কে একদিকে ঠেলে রেখে অলিওর তার মা’কে নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের বাড়িতে। জমিদার গিন্নি হওয়াতে বেশ দাপুটে ভণিতায়ই আমার আব্বা’কে প্রস্তাব দেন অলিওরের মা। কিন্তু আব্বা রাজি হননি। এর পিছনে বড়ো দু’টো কারণ হিসেবে আব্বা উল্লেখ করেছিলেন, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং আব্বা তার মেয়ে’কে সতীনের ঘরে দিতে ইচ্ছুক নয়। আব্বার এহেন জবাবে জমিদার গিন্নি বেশ অপমান বোধ করে। ধন,সম্পদ এবং ক্ষমতায় ছোট বোনের থেকে তার ঢের বেশী তবুও কেন আব্বা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো? এই আক্রোশ মনে পুষেই সেদিন ছেলে’কে নিয়ে বেরিয়ে যায় সে। আমার আব্বা বেশ বিব্রত হয়ে পড়ে। নানারকম দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়। আমাকে বিয়ে করার জন্য ভাই,বোনের সম্পর্ক খারাপ হলো। বোনে, বোনে,ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা তৈরি হলো। এমন পরিস্থিতে বিয়ে দিলে আমি সুখী হবো তো? ভবিষ্যৎে সকলের আক্রোশের স্বীকার হবোনা তো? সকল দ্বিধা কাটিয়ে নিজের কথা রক্ষার্থে আব্বা শাহিন আহমেদের হাতে তুলে দেন আমাকে। বিয়ে হয়ে যায় আমার এবং শাহিনের। আমি হয়ে যাই কারো ঘরনি, কারো অর্ধাঙ্গিনী। বিয়ের অনুষ্ঠানে অলিওরের পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি। কিন্তু বউ ভাতের অনুষ্ঠানে অলিওর আসে আমার শ্বশুর বাড়িতে। শাহিনের সামনে আমাকে উঁচু গলায় বলে,
-‘ আমি আমার পাঁচ পুত্রের মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি তোমাকে আমার করবোই। আমি আমার পাঁচ পুত্রের কসম করে বলছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার পুত্রগণের মা’য়ের থেকেও অধিক ভালোবাসি তোমাকে। ‘
ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম সেদিন আমি৷ সারারাত যে মানুষটার ভালোবাসায় সিক্ত ছিলাম, সারারাত যার বক্ষঃস্থলে মাথা রেখে অজস্র স্বপ্ন বুনেছি, সে মানুষটার সম্মুখে একজন পরপুরুষ এসে ভালোবাসার কথা বলছে আমাকে! আমার ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে অলিওর পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিলো। ঠিক সে মূহুর্তেই শাহিন চোখ, মুখ শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে। আমার কম্পিত হাতে শাহিনের ভরসার হাত মিলিত হতেই অলিওর বিদ্রুপের সুরে বলে,
-‘ আজ এখানে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করছি ঐ মিলিত হাত দু’টো আমি আলাদা করবোই। ‘
সেদিন থেকেই আমার জীবন’টা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম আমি৷ শাহিন’কে ছাড়া এক মূহুর্তও থাকতে পারতাম না৷ আমার অবস্থা দেখে শাহিন আমাকে শহরে নিজের কাছে নিয়ে যায়৷ সেখানে আমরা দু’বছর সংসার করি। তিনবছরের মাথায় আমার গর্ভে আসে নুর। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন আমি। হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজন বলে মাঝরাতেই বেরিয়ে যায় শাহিন। সকালবেলা দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় আমার। শাহিন এসেছে ভেবে দ্রুত ওঠে দরজা খুলে দেই কিন্তু দেখতে পাই অলিওর চৌধুরী’কে। আমি ভীতিগ্রস্ত হয়ে দরজা আঁটকে দিতে চেয়েও পারিনা। তার পূর্বেই অলিওর বলে,
-‘ শারমিন তাড়াতাড়ি চলো আমাদের থানায় যেতে হবে। ‘
আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অলিওর আবার বলে,
-‘ শাহিন ওর হাসপাতালের এক রোগির সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ধরা পড়েছে। হাসপাতাল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে ওকে। ও এখন থানায় পুলিশের হেফাজতে আছে। ‘
অকস্মাৎ কেঁপে ওঠি আমি৷ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাই অলিওরের দিকে৷ কম্পিত কন্ঠে বলি,
-‘ আপনি মিথ্যা বলছেন, উনার খবর আপনি পাবেন কোথায়? ‘
-‘ শারমিন তুমি বিশ্বাস করো। থানার ওসি নিজে আমার বাড়িতে গিয়ে সবটা জানিয়েছে। শাহিন আমার বাবা,মায়ের পরিচয় দেওয়াতে ওসি নিজে এসে সবটা জানিয়েছে। ‘
অলিওরের কথা শেষ হতেই ধপ করে বসে পড়ি আমি। পুরো শরীর অদ্ভুত ভাবে কাঁপতে থাকে আমার। অলিওর তখন আমার কাঁধে হাত রাখে। ভরসা দিয়ে বলে,
-‘ কিছু হবে না আমি আছিতো। ‘
সেদিন সত্যি অলিওর শাহিন’কে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে৷ ফিরিয়ে নিয়ে আসে শাহিন’কে। কিন্তু পূর্বের শাহিন, আমার স্বামী শাহিন আহমেদ আর সেদিনের শাহিন আহমেদের মাঝে ছিলো বিস্তর ফারাক। সে যেমন তার পেশা হারিয়েছে তেমনি হারিয়েছে নিজের সম্মান। আশ্চর্য হলেও সত্যি আমি নিজে থানার ওসি’কে কথা দিয়েছিলাম শাহিনের সঙ্গে তার সেই রোগির অর্থাৎ ‘লতার’ বিয়ে দেবো। শাহিন তাকে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবে। বিয়ে দেওয়ার শর্ত দিয়েই শাহিন’কে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷ আমিও আমার কথা রাখি। নিজের স্বামী’কে তুলে দেই অন্য একটি নারী’র হাতে। একটা মেয়ের জীবনে কতোটুকু যন্ত্রণাদায়ক এটা শুধু একটা মেয়েই জানে৷ পাঁচ মাসের পেট নিয়ে সারাদিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের স্বামী’কে বাসরে ঢুকিয়ে দিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি আমি। ফিরে যাই আব্বা, আম্মার কাছে। গর্ভবতী অবস্থায় আমার সাথে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনী শুনে সেই রাতেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায় আব্বা। পরেরদিন মা মুখ ফিরিয়ে নেয় আমার থেকে। ভাইও আব্বার মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করে। একুল, ওকুল দুকুলই হারাই আমি। গ্রামের মানুষ ছিঃ ছিঃ করে৷ কেউ একটু ঠাঁই দেয়নি সেদিন আমাকে। স্কুলের বারান্দায় বসে আব্বার খাটিয়া নিয়ে যেতে দেখি। আব্বা’কে কবর দেওয়া হয়। আমার বুকের ভিতর ছটফট করতে থাকে,পেটে ব্যথায় অসহ্য লাগতে শুরু করে। চিৎকার করে বলতে থাকি, আব্বা তুমি আমাকে ছেড়ে কেন গেলা। আমার যে কেউ রইলো না। আব্বা গো কোন অভিশপ্ত জীবনে রেখে গেলা আমাকে। ও আব্বা কোন দোষে তোমার খুনি করলা আমারে,কোন দোষে মা,ভাইয়ের চোখের বিষ বানাইলা আমারে। কাঁদতে কাঁদতে আধমরা হয়ে পড়ে থাকি চেয়ে থাকি আব্বার কবরের দিকে। স্বামী’র বিশ্বাসঘাতকতায়,আব্বার মৃত্যু’তে আমি ভুলেই যাই আমার নুরের কথা। আমার ভিতর ছোট্ট একটি অংশ বেড়ে ওঠার কথা।অকস্মাৎ ক্ষিদের জ্বালায় পেটে ব্যথায় ছটফট করতে করতে মনে পড়ে যায় কোন এক বিশ্বাসঘাতকের কথা। মনে পড়ে যায় কারো ছলনায় আমার নিষ্পাপ ভালোবাসা মেশানোর কথা। পাগলের মতো স্কুলের টিউবওয়েলের কাছে ছুটে গিয়ে প্রাণভরে পানি পান করি। পেটে ব্যথায় গা গুলিয়ে বমি পায়,বমি করতে করতো কখন যে জ্ঞান হারাই নিজেও টের পাইনা৷ যখন জ্ঞান ফেরে তখন পাশে পাই অলিওর চৌধুরী’কে। আশেপাশে চেয়ে দেখি আমি হাসপাতালে ভর্তি। তিনদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর চতুর্থ দিন অলিওর আমাকে বুঝিয়ে, আমার বাচ্চা’কে বাঁচানোর লোভ দেখিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। নিরুপায় আমি সকল লজ্জা ত্যাগ করে, আত্মসম্মান সব বিসর্জন দিয়ে অলিওরের সঙ্গে যাই। এ’কদিনে এটাও জানতে পারি শাহিন আমাকে বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজ পাঠিয়েছে। কিন্তু ভয়ে সেই কাগজ দেখার বা স্পর্শ করার সাহস পাইনি তখন৷ সবদিক দিয়ে যখন শূন্য হয়ে গেলাম তখন বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে অলিওর’কে বললাম, আমাকে যেনো তার বাড়িতে কাজের লোক করে রাখে। কিন্তু অলিওর তাতে নারাজ সে আমাকে বিয়ে করবে৷ সেই সিদ্ধান্ত জানিয়েই আমাকে হাজির করে তার মায়ের সামনে। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে অলিওরের মা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে বললেন,
-‘ যে মেয়ের বাবা আমাকে,এই জমিদার গিন্নি’কে অপমান করে, জমিদার গিন্নির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সেই মেয়ে’কে আমি পেটসহ পুত্রবধূ করবো! অসম্ভব। ‘
অলিওর মায়ের সঙ্গে ঘোর বিরোধিতা করলেন,
-‘ না আম্মা না আপনি এমন কথা বলবেন না। আমি শারমিন’কে ভালোবাসি হোক সে গর্ভবতী, করুক তার বাবা আমাকে প্রত্যাখ্যান তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। আর সেই ভালোবাসার টানেই আমি তাকে আজ এ মূহুর্তে বিয়ে করবো। ‘
মা,ছেলের মাঝে আমি বলি,
-‘ আমাকে মাফ করবেন। আমি এসবের কিছুই চাইনা শুধু একটু ঠাঁই চাই। আমাকে আপনাদের বাড়ির কাজের লোক করে রেখে দিন৷ ‘
জমিদার গিন্নি আমার চুল মুড়িয়ে ধরে তার পায়ের নিচে ফেলে বলেন,
-‘ ওরে সর্বনাশী কাজের লোক হয়েও আমার ঘরে থাকতে রাজি। অলিওর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই সর্বনাশী’কে বের কর।’
অলিওর মা’য়ের থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিজ বুকে চেপে ধরে। ঘৃণায় মূর্ছিত হয়ে যাই আমি। অলিওর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-‘ আম্মা এই সর্বানাশী’কে না পেলে আপনার ছেলের সর্বনাশ ঘটে যাবে। কারণ এই সর্বনাশী’কে আমি খুব ভালোবাসি। ‘
জমিদার গিন্নি ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। চিৎকার করে বলে,
-‘ তুই যদি এই কালনাগিনী’কে বিয়ে করিস আমার মরা মুখ দেখবি। তোকে তোর মৃত বাবার কসম আর কোন পত্নী গ্রহণ করবি না তুই এটা তোর মায়ের আদেশ তোর বাবার কসম। ‘
মায়ের এমন আদেশে অলিওর চৌধুরী নিভে যায়। মর্মাহত হয়ে মা’কে প্রশ্ন করে,
-‘ আপনি কেমন মা যে ছেলের ব্যথা বুঝেন না? ‘
জমিদার গিন্নি যেনো বুকে আঘাত পায়৷ ছেলের অসহায় চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে। তারপর কুটিল হেসে বলে,
-‘ আমি আমার আব্বাসোনা’কে এতো কষ্ট দিতে পারি না৷ তাই এই মেয়ে’কে তোর অধিনে রাখার অনুমতি দিলাম। এই মেয়ে’কে আজীবনের জন্য বাইজি গৃহে বন্দি করে রাখার অনুমতি দিলাম। আমাকে করা অপমানের চরম জবাব দিলাম। তোর কামনা,বাসনাও পূরণ করলাম। এবার খুশিতো? ‘
-‘ আম্মা!’
অলিওর চৌধুরী কম্পিত গলায় মা’কে ডাকতেই জমিদার গিন্নি ধমকের সুরে বলেন,
-‘ চুপপ একদম চুপপ। তুই জমিদারের পুত্র। তোকে ভালোবাসা মানায় না৷ তোকে যা মানায় ঠিক তারই অনুমতি দিলাম। ভালোবাসার জন্য তোর দুটো স্ত্রী রয়েছে এই সর্বনাশী না হয় তোর ভোগের সামগ্রী হয়েই থাকবে। আর হ্যাঁ এই চারদেয়ালে হওয়া কথোপকথন একটা কাক পক্ষীও যেনো টের না পায়। ‘
সেদিন মায়ের আদেশে অলিওর চৌধুরী আমাকে বাইজি গৃহে বন্দি করতে বাধ্য হয়। ভাগ্যের নির্মমতায় আমি হয়ে যাই বাইজি গৃহের প্রধান বাইজি। জমিদার গিন্নির চরম প্রতিশোধের স্বীকার হই আমি। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি জমিদার অলিওর চৌধুরী আজ অবদি আমার শরীর স্পর্শ করেনি। আমাকে দিয়ে মনের খোরাক মেটানোর চেষ্টা করলেও কখনো দেহের খোরাক মেটানোর চেষ্টা করেনি৷ আজ অবদি অলিওর চৌধুরী একটা জায়গাতেই ভীষণ দুর্বল তা হলো বাইজি শারমিন শায়লা। ভালোবাসা এবং মায়ের আদেশ এই দুটো জিনিস আজো পুড়ায় তাকে,খুব পুড়ায়।
বর্তমানঃ
ক্রন্দনরত কন্ঠে মান্নাত বললো,
-‘ সখী নুরের বাবা কেন করলো এটা? ‘
-‘ সেই উত্তর আজো পাইনি। মানুষটা মরে গেলো, বলে গেলো না আমাকে জীবিত মেরে ফেলার কারণ। ‘
শারমিন’কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো মান্নাত। মৃদু হেসে শারমিন মান্নাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ ইশ তুই’ই এতোটা আহত হলি? তাহলে এসব নুর কি করে সহ্য করবে বলতো? ওকে তো জানতে হবে সবটা। মায়ের ক্ষত সম্পর্কে সবটা না জানলে মেয়েটা আমার শক্ত হবে কি করে? ‘#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_১৪

(প্রথমাংশ)

[১৯]
শিশুকালে সন্তান যখন প্রাকৃতিকভাবে জামাকাপড় নোংরা করে মা বিনা দ্বিধায় তা পরিষ্কার করে। নিজ সন্তান’কে সকল নোংরা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। তেমনি সন্তান যতোই বড়ো হোক মা সব সময় নিজ সন্তান’কে পৃথিবীর সকল নোংরা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। শারমিন বাইজিও এর বাইরে নয়। সেও তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে শাহিনুর’কে সকল নোংরা মানুষ’জন থেকে মুক্ত রাখতে। একদিকে মা চাচ্ছে মেয়ে’কে নোংরা জল যেনো স্পর্শ করতে না পারে। অপরদিকে সেই নোংরা জল পান করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে মেয়ে। একজন সন্তানের পক্ষে মায়ের মন’কে ফাঁকি দেওয়া খুবই কঠিন। শারমিন ইদানীং বেশ লক্ষ করছে শাহিনুর’কে। তাছাড়া মান্নাতও কিছু একটার আভাস দিয়েছে। যতোদ্রুত সম্ভব শাহিনুর’কে এখান থেকে দূরে পাঠাতে বলেছে। শারমিনের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক পুরোটা ধরতে না পারলেও খানিকটা আঁচ পেয়েছে। কিন্তু বিপরীতে কে আছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু শারমিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাহিনুরের গোপন কক্ষটি পরিবর্তন করবে৷ শুক্রবার থাকাতে আজো অলিওর চৌধুরী, পল্লব চৌধুরী, পলাশ চৌধুরী বাইজি গৃহে এসেছে। বাইজি গৃহের সর্বোচ্চ বৃহৎ কক্ষের রঙ্গমঞ্চে নৃত্য প্রদর্শন করছে বাইজি’রা৷ দু’ভাই ডিভানে আধশোয়া হয়ে প্রমত্তকর রস পান করছে। তাদের কামনীয় দৃষ্টিজোড়া নিবদ্ধ বাইজি’দের উন্মুক্ত কোমড়ের ভাঁজে ভাঁজে। পলাশ চৌধুরী’র আদেশে আজ নর্তকী’র বেশে তার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে মান্নাত বাইজিও। কিন্তু মান্নাত বাইজি সকলের সামনে উপস্থিত হওয়ার মিনিট, দুয়েক পরেই পলাশ চৌধুরী ওঠে দাঁড়ালো। গণ্ডস্থলের কিঞ্চিৎ নিচে পাঞ্জাবির পরপর তিনটে বোতাম খোলা পলাশের। শ্যামবর্ণ গলায় স্বর্ণের চিকন হার চকচক করছে। পুরুষ’দের স্বর্ণ পরতে নেই। তাদের জন্য এটা হারাম। হারাম জিনিসগুলোই নিজেদের মধ্যে ধারণ করা যেনো নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে জমিদার পুত্রদের। এক পা, দু’পা করে এগুতে এগুতে একদম মান্নাতের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো পলাশ। আচমকাই চরণদ্বয় থেমে গেলো মান্নাতের , থেমে গেলো ঘুঙুরের আওয়াজও। বক্ষঃস্থলে শুরু হলো তাণ্ডব। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আবারো নৃত্য শুরু করতে উদ্যত হলো মান্নাত কিন্তু পলাশের স্পর্শে থেমে গেলো সে। পলাশের কন্ঠস্বরে রুদ্ধ হয়ে আসলো তার শ্বাসনালী।
-‘ তোমাকে এভাবে আমার ঠিক পুষায় না মান্নাত। ‘
বিকৃত সুরে হেসে ওঠলো পল্লব চৌধুরী। হেসে ওঠলো উপস্থিত বাকি সকলেই, নিঃশব্দে কেঁদে ওঠলো মান্নাত৷ কারণ সে জানে আজ আবার পলাশ চৌধুরী’র কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হবে । হে সৃষ্টিকর্তা কাউ’কে ভালোবাসার শাস্তি এতো প্রখর হয় কেন?
প্রধান বাইজি কক্ষের ডিভানে বসে আছে অলিওর চৌধুরী। প্রধান বাইজি শারমিন তার সম্মুখেই মেঝেতে হাঁটু মুড়িয়ে বসে আছে। অলিওর চৌধুরী একধ্যানে তাকিয়ে দেখছে শারমিন’কে। শারমিনও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া নিক্ষেপ করে ঠাঁই বসে আছে। অনুমান করা যায় অলিওর চৌধুরী’র বয়স ষাট ছুঁয়েছে তবুও মনে রঙ কমেনি। এই যে বিশাল সাম্রাজ্য,দুই পত্মী,পাঁচ পুত্রদের একদিকে ঠেলে নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে বাইজি গৃহে আসে,শারমিন’কে আত্মাভরে দেখে, একটু ভালোবাসা ভিক্ষা চায়, এই বয়সে এসে জমিদারের কি এসব মানায়? বেহায়া,নির্লজ্জ জমিদার তবুও থামে না, ক্লান্ত হয় না, মানে লাগেনা একটুও। শারমিন বরাবরের মতোই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া দিয়ে শাসিয়ে যাচ্ছে অলিওর’কে। অলিওর তা সাদরে গ্রহণ করেও নিচ্ছে। যা তার মুচকি হাসিতেই টের পাচ্ছে শারমিন৷ কিন্তু অলিওরের এই হাসিটুকু বেশীক্ষণ টিকতে দিলো না৷ বললো,
-‘ ছোট ভাই’য়ের বউ’কে এভাবে আর কতো দেখবেন জমিদার সাহেব। ‘
আকস্মাৎ কেঁপে ওঠলো অলিওর চৌধুরী। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ক্রুদ্ধ সুরে বললো,
-‘ নিজেকে ঐ বিশ্বাসঘাতকের বউ বলতে কষ্ট হয় না,ঘৃণা লাগে না ? আমার তো শুনতেই কষ্ট হয়, খুব ঘৃণা লাগে। ‘
বুকের ভিতর পাথরচাপা দিয়ে কথাগুলো হজম করলো শারমিন। অলিওরের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-‘ বিশ্বাস করো জমিদার, খুব কষ্ট হয় কিন্তু ঘৃণা হয় হয় না। কারণ মানুষ’টা আমার সন্তানের জন্মদাতা।
এটাও বিশ্বাস করো যদি কোন দিন জানতে পারি আমার সন্তানের বাবা নিরপরাধ ছিলো,আমার সন্তানের বাবা কোন ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছিল সেদিন তুমি বুঝবে এই শারমিন বাইজি কতোটা নৃশংস। ‘
-‘ শারমিন!’
অলিওর চৌধুরী’র মৃদু ধমকে তাচ্ছিল্য হেসে শারমিন বললো,
-‘ তখন খুব ছোট ছিলাম জমিদার, এতো জটিলতা বুঝতাম না। বড়ো আফসোস হয় তখন যদি আজকের আমিটা থাকতাম। ‘
-‘ শেষকালে এসে এটুকুই আমার প্রাপ্য? ‘
-‘ জমিদার সাহেব, নুরের বাবার দেওয়া বিবাহবিচ্ছেদ পত্র তুমি এখনো আমায় দেখাওনি। তখনকার শারমিন আর এখানকার শারমিনের মাঝে বিস্তর ফারাক। তাই ঐ কাগজখানা তুমি আমাকে দেখার সুযোগ করে দাও। কথা দিচ্ছি ভালোবাসতে না পারি আজীবন আমার অন্তরে তোমার জন্য সম্মানীয় স্থান বরাদ্দ থাকবে। ‘
শারমিনের জালে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে ওঠে দাঁড়ালো অলিওর৷ দু’হাত শক্ত মুঠ করে কঠিন কন্ঠে জবাব দিলো,
-‘ তোমার মনে সন্দেহ ঢুকেছে শারমিন এই সন্দেহটুকু দূর করো অপরাধী’কে অপরাধী হিসেবেই বিশ্বাস করো তবেই মঙ্গল। ‘
অলিওরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো শারমিন। অলিওরের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-‘ যদি সে অপরাধী হয় তার অপরাধ গুলো আমি আবার ঘেটে দেখতে চাই। তোমার সমস্যা কি জমিদার? ‘
-‘ কারণ আমি চাইনা আমি ব্যতিত তুমি অন্য কোন পুরুষ’কে নিয়ে ব্যস্ত থাকো। ‘
-‘ হাসালে জমিদার। ‘
এটুকু বলে আচমকাই অলিওরের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো শারমিন। রণমুর্তি ধারন করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ পাপ বাপ’কেও ছাড়ে না জমিদার! তুমি যদি পাপ করে থাকো শাস্তি তুমিও পাবে। ‘
মুচকি হাসলো অলিওর শারমিনের একটি হাতে নিজের হাত স্পর্শ করে বললো,
-‘ এতোগুলো বছরে না তোমার রূপ কমেছে আর না কমেছে ত্যাজ। ‘
রাগে ফুঁসতে শুরু করলো শারমিন৷ অলিওরের কলার ছেড়ে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো৷ অলিওর পাশে দাঁড়িয়ে একহাত শারমিনের মাথায় রেখে মৃদু কন্ঠে বললো,
-‘ শান্ত হও শারমিন। ভুলার চেষ্টা করো অতীত’টাকে। মনে রেখো তোমার কোন অতীত নেই কিন্তু বর্তমান আছে, ভবিষ্যৎ আছে। তোমার বর্তমানও আমি ভবিষ্যৎও আমি। তোমার ভালোবাসা এখন আর চাইনা কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মূহুর্তে তোমাকে পাশে চাই। ‘
নিজের বক্তব্য শেষ করে কক্ষ ত্যাগ করলো অলিওর৷ মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো শারমিন৷ কি করে অতীত ভুলবে সে? কি করে? অতীত ভুলতে গেলে যে নুরের অস্তিত্বটুকুও বিলীন করতে হবে! বক্ষঃস্থলে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে শারমিনের। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মানুষ টা যদি আজ দুনিয়া’তে থাকতো ঠিক সত্যির নাগাল পেতো সে। কিন্তু মানুষ টা যে নেই। কি ঘটেছিলো সেদিন। পুরো দুনিয়া সেদিন শাহিনের বিপক্ষে ছিলো, শাহিন কি নিজের পাশে শারমিন’কে আশা করেছিলো? সেদিনের ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা হাজারোবার স্মরণ করলো শারমিন৷ সেসবে খুঁজে পেলো অসংখ্য সন্দেহজনক ঘটনা৷ কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় শাহিন কেন শারমিন’কে মুখ ফুটে একটি বার বলেনি সে নিরপরাধ। তার কোন দোষ নেই। কেন বললো না? নাকি সে শারমিনের চোখে অবিশ্বাসের ছাপ দেখেছিলো? এটুকু ভাবতেই দু’হাতে মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করলো শারমিন। যদি তার দ্বারা সত্যি ভুল হয়ে যায় কোন দিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না৷ এক মন বলছে হোক প্রমাণ শাহিন নির্দোষ। আরেক মন বলছে শাহিন নির্দোষ প্রমাণিত হলে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না তার। কারণ শাহিনুর কোনদিন ক্ষমা করবে না তাকে৷ আবার ভাবলো,
নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শাহিনুরের বাবাকে নিরপরাধ হিসেবে জানা। বহুবছর আগের সেই ঘটনা,পর্দার আড়ালে থাকা সেই সত্যি এক অলিওর ছাড়া কেউ জানেনা। এটা শারমিনের দৃঢ় বিশ্বাস৷ এতোগুলো বছরে অলিওর সম্পর্কে, জমিদার বাড়ি সম্পর্কে বেশ সুক্ষ্ম ধারণা তৈরি হয়েছে, সেই ধারণা থেকেই অনুসন্ধান করবে শারমিন৷ আফসোস একটাই যাকে ঘিরে এই অনুসন্ধান সে মানুষ’টাই আর পৃথিবীতে নেই। আচ্ছা মানুষ’টা কি অভিমানেই ফুরিয়ে গেলো!#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_১৪

( শেষাংশ )

[২০]
পাঁচফোড়ন গৃহঃ
ঠিক দুপুর বারোটায় রোমানা আর অঙ্গন ফিরলো পাঁচফোড়ন গৃহে। সমবয়সী হওয়ার কারণে দু’জন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে পড়াশোনা করছে। রোমানার বয়স যখন সাত বছর তখন রোমানার মা অর্থাৎ প্রেরণার বড়ো বোনের রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এক বছর চিকিৎসা চলাকালীনই মৃত্যু ঘটে তার। খালাতো বোনের মেয়ে হওয়ায় ভালোবাসা, স্নেহ, দায়িত্ববোধ সবদিক থেকে বাঁধা পড়ে রোমানা’কে নিজেদের কাছে রেখে দেয় অলিওর এবং প্রেরণা। রোমানার বাবা প্রবাসী, স্ত্রী’র মৃত্যুর পর মেয়ে’কে অলিওর এবং প্রেরণার হাতে তুলে দিয়ে সেই যে চলে গেছেন আর দেশমুখী হননি। রোমানা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। ছুটির দিনগুলোতে অঙ্গনই বেশীর ভাগ বাড়ি নিয়ে আসে তাকে। মায়ের আদেশে কখনো কখনো প্রণয়ও আনতে যায়। ওরা ফিরতেই প্রেরণা দুজন’কে গোসল সেরে খেতে আসতে বললো। রোমানা চুপচাপ চলে গেলো গোসলে। খালামুনির সঙ্গে তেমন কোন কথা বললো না, আর না স্বভাবসুলভ তার ওষ্ঠাধরে হাসিটির দেখা মিললো। বিচলিত হয়ে প্রেরণা অঙ্গনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো, বললো,
-‘ কি হয়েছে ওর? ‘
অঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-‘ আম্মা আপনি এবার ভাইয়ার সঙ্গে ওর বিয়েটা দিয়ে দিন। আপনিতো জানেন রোমানা ভাইয়া’কে পাগলের মতো ভালোবাসে অথচ ভাইয়া রোমানার ব্যাপারে খুব উদাসীন, বিয়েটা হয়ে গেলে দু’জন একসাথে থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আশা করি আপনি আব্বার সাথে আজই কথা বলবেন। ‘
কথাগুলো বলেই মায়ের সামনে থেকে চলে গেলো অঙ্গন। দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লো প্রেরণা। আজ বৃহস্পতিবার প্রণয় আসবে তাই সিদ্ধান্ত নিলো আর দেরি নয় এবার দুটো’কে এক করেই ছাড়বে। দুপুরে আহার শেষে জমিদার অলিওর এবং পল্লব চৌধুরী’র সঙ্গে অরুণা, প্রেরণা দু’জনই প্রণয়ের সঙ্গে রোমানার বিয়ের কথাবার্তা তুললো। দুই পত্নীর মতামত শুনে দুই পত্রের দিকে তাকালো অলিওর। পূর্বে কথাবার্তা হলেও আজ চূড়ান্ত আলোচনায় বসেছে সকলে। বংশের রীতি অনুযায়ী ছেলে,মেয়েদের বিয়ের পূর্বে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতামত’কেই অধিক গুরুত্ব দেয় অলিওর চৌধুরী। সে এবং তার পত্নী’রা রাজি এবার বড়ো দুই পুত্র এবং পুত্রবধুদের সম্মতি পেলেই আগামীকাল বাগ্দান সেরে ফেলবে। পরিবারের সকলেরই সম্মতি মিললো। কেবল রোমানা আর প্রণয়ের সঙ্গেই কোন কথা হয়নি অলিওরের। এ পর্যায়ে রোমানার তরফের সকল কথাই অঙ্গন এবং প্রেরণা ব্যক্ত করলো। সবশেষে অপেক্ষায় রইলো প্রণয়ের ফেরার। পাঁচফোড়ন গৃহের পরিবেশটাই বদলে গেলো। রোমানার বক্ষঃস্থলে যেনো জলের মতোন ছলাৎছলাৎ শব্দ করছে। একদিকে আনন্দ অপরদিকে লজ্জা আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে তাকে। সকল বিষণ্নতা দূর হয়ে মনে এবার কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে। নিজ কক্ষে চুপটি করে বসে অপেক্ষা করছে প্রণয়ের৷ সে আসবে, আগামীকাল তাদের বাগ্দান হবে তারপর, তারপর তাদের বিয়ে। সবটা ভাবতেই কেমন এলোমেলো লাগছে রোমানার। খুশিতে বোধহয় সে আজ পাগলই হয়ে যাবে। এমন মূহুর্তে কক্ষে শাড়ি গহনা নিয়ে হাজির হলো শবনম আর মুনতাহা। রোমানার দু’পাশ থেকে দুজন উঁকি দিলো তারপর শবনম মুনতাহা’কে বললো,
-‘ মুন, রোমানা তো এখনি লজ্জায় শেষ। ‘
মুনতাহা রসিকতার সুরে বললো,
-‘ হ্যাঁ গো ভাবি তাই তো দেখছি এবার কি হবে? ‘
-‘ কি আর হবে বাসর রাতে বউয়ের লজ্জা দেখে দেবর সাহেব ভাবি’দের কাছে এসে কাঁদবে। ‘
খিলখিল করে হেসে ওঠলো দু’জনই। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে রোমানা বললো,
-‘ ধ্যাত তোমরা চুপ করবে…’
ঢং করে শবনম বললো,
-‘ এই চুপ করো চুপ করো ননদিনী’কে শাড়ি গহনা দেখানোতে মনোযোগ দাও। ‘
কথাটা শেষ করে আবারো হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো শবনম। মুনতাহা মুচকি মুচকি হেসে শবনম’কে ধরে বললো,
-‘ ভাবি থামো এবার ওকে শাড়ি গহনা দেখাও। রোমানা আপা দেখোতো এখান থেকে কাল কোন শাড়ি আর কোন গয়না গুলো পরবে? ‘
শবনম বললো,
-‘ কিসের আপা ফুপাতো বোন সম্পর্ক বাদ। ননদ আর দেবরের বউয়ের খাতিরে যতো পারো রসিকতা করো। ‘
রোমানা মুনতাহা’কে চোখ রাঙালো। মুনতাহা মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। বললো,
-‘ আচ্ছা আচ্ছা আমি আর একটা কথাও বলবো না। তাও রাগ করোনা তুমি শাড়ি গয়না পছন্দ করো। ‘
শাড়ি, গয়না পছন্দ করে তিনজন মিলে হাসাহাসি, রসিকতা করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। অবশেষে রোমানা প্রণয়ের বউ হতে যাচ্ছে। মায়ের থেকে সুখবরটি শুনে রোমানার সঙ্গে দেখা করতে এলো রঙ্গন। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় মুনতাহা তড়িঘড়ি করে রোমানার রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিলো। কিন্তু রঙ্গনের মুখোমুখি হয়ে গেলো। মুনতাহার হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী’তে দৃষ্টি পড়তেই অবাক হলো রঙ্গন। কতোদিন পর এই হাসিমুখটার দেখা মিলছে মনে পড়লো না তার। তবে বুকের ভিতর প্রশান্তি ঠেকলো খুব। পলকহীন চোখে চেয়েই রইলো মুনতাহার দিকে৷ কিন্তু মুনতাহা ভীষণ বিব্রতবোধ করলো। অকস্মাৎ ভয়ে চোখমুখ শুষ্ক হয়ে ওঠলো তার। মুখোভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো রঙ্গনেরও। তৎপর হয়ে সে বললো,
-‘ আমি রোমানা আপার সাথে দেখা করতে এসেছি। তোমার প্রয়োজন শেষ হলে চলে যাও তবুও ভয় পেও না। ‘
এটুকু বলে থামতেই তড়িৎগতিতে মুনতাহা কক্ষ ত্যাগ করলো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রঙ্গন তাকালো কক্ষের ভিতরে। শবনম,রোমানা দু’জনই করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক ঢোক গিলে দীর্ঘ একটি শ্বাস ছেড়ে ধীরপায়ে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করলো রঙ্গন। শবনমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
-‘ তোমারও কি তাড়া আছে ভাবি? ‘
শবনম জোরপূর্বক হেসে এগিয়ে এলো। রঙ্গনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ না ভাই তুমি বসো কিছুক্ষণ গল্প করি। ‘
রঙ্গন নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে রোমানার পাশে বসলো। বিছানায় থাকা শাড়ি,গহনাগুলো দেখে বললো,
-‘ ভালোবাসার মানুষ’কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে, তুমি খুব খুশি তাইনা আপা? ‘
রোমানা ইতস্ততভাবে বললো,
-‘ আমি অনেক খুশিরে রঙ্গন। ‘
-‘ অভিনন্দন আপা। আশা করি নিজেদেরটা সেরে দেবর’টাকে নিয়ে একটু ভাববে। বাকিরা তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। ‘
শবনমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কথাটা বলতেই শবনম রঙ্গনকে কানমলা দিয়ে বললো,
-‘ ওরে দুষ্টু খোঁচা মারা হচ্ছে তাইনা। কি ভেবেছো আমি কিছুই জানিনা সব খবর আমার কাছে আসে।’
রঙ্গন জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো,
-‘ নাউজুবিল্লাহ আপা ভাবি এগুলা কি বলে? ‘
-‘ তোমাদের মুখে নাউজুবিল্লাহ শুনলে শয়তানও লজ্জা পাবে। ঢং বাদ দিয়ে ঝেড়ে কাশো বাছা। ‘
রোমানা অবুঝ চোখে দু’জনের দিকে তাকাতেই রঙ্গন বললো,
-‘ আপা তুমি বিশ্বাস করো ভাবি আমাকে ফাঁসাচ্ছে। ‘
-‘ আমি ফাঁসাচ্ছি নাকি কারো রূপের জাদুতে তুমি ফেঁসে গেছো আর বাঁশির সুরে তাকে ফাঁসাচ্ছো? ‘
ধরা পড়ে গিয়ে চুপসে গেলো রঙ্গন। রোমানা ছোট ছোট চোখ করে বললো,
-‘ নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবছিস ভালো কথা তাই বলে এভাবে গোপনে! ছিঃ ভাই। ‘
মহাবিপদে পড়ে গেলো রঙ্গন। শবনমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ আপনার কয়টা কান, কয়টা চোখ বলবেন ভাবি। এই খবরটাও আপনি জেনে গেলেন ? ‘
-‘ জানবো না? দেবরের মনে রঙ লেগেছে আর ভাবি জানবে না তা কখনো হয়? ‘
এক কথা দুই কথায় রোমানার কাছে প্রকাশ পেলো রঙ্গন শাহিনুরের প্রেমে পড়েছে। ওপাশ থেকে সাড়াও কমতি নেই। মেয়েটা নেহাতই বাচ্চা কিনা.. আবেগটা বড্ড বেশীই। কিন্তু বাঁধ সাধলো রোমানা। রঙ্গনের দিকে কড়া চাহনি ছুঁড়ে বললো,
-‘ রঙ্গন তুই এটা ঠিক করছিস না। একটা মেয়ের সরলতার সুযোগ নিচ্ছিস তুই। ‘
শবনম বললো,
-‘ এটাতো ওর দোষ না রোমানা, ওদের রক্তের দোষ।’
কথাটা কেমন একটা লাগলো রোমানার বুকের ভিতর কেমন একটা ভয় কাজ করলো। সে ভয়টুকু’কে বাড়তে না দিয়ে রঙ্গনকে বললো,
-‘ রঙ্গন নুর মেয়েটা খুব ভালো ওর সঙ্গে তুই এসব করিস না। মেয়েটা খুব ভালোরে অমন নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে তো শয়তানও ফেরেশতা হয়ে যাবে। আর তুই কিনা…’
-‘ উফ আপা কি সব বলছো? তোমরা নিজেদের মতো করে ধারণা করে এসব বলছো। ‘
-‘ তাহলে সত্যি’টা কি বল? ‘
-‘ সত্যি এটাই নুর’কে আমি বিয়ে করতে চাই। একটা বাইজির মেয়ে’কে বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবন উপহার দেবো এটুকুই কি বেশী নয়? ‘
শবনম বললো,
-‘ যতোদূর জানি পলাশ চৌধুরী’র নজর পড়েছে এর ওপর। ওর সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে? ‘
-‘ ভাবি নুর আমাকে ভালোবাসে আমি নুর’কে পছন্দ করি। বিয়ে আমাদের হবেই জমিদারের এক পুত্র না হয় পরিবারের অসমর্থনেই বিয়ে করলো। আর রইলো পলাশ চৌধুরী’কে টেক্কা দেওয়া, এবার তার হারার পালা। ‘
রোমানা বললো,
-‘ তোদের হার জিতে ঐ মেয়েটা’কে কেন ভোগাবি রঙ্গন? ‘
রোমানার দিকে শান্ত চোখে তাকালো রঙ্গন। মুচকি হেসে বললো,
-‘ নুরের কিছু হবে না আপা, একটা স্বাভাবিক জীবন পেয়েই সে ভীষণ খুশি হবে। ওর খুশি হতে, ভালো থাকতে বেশী কিছু লাগে না আপা। ও আমাকে ভালোবেসেই ভীষণ খুশি, ভীষণ আনন্দিত। ওর এই আনন্দ, এই খুশিটুকু আজীবন অটুট থাকুক এই প্রার্থনা করো। ‘
-‘ তোদের বোঝা খুব মুশকিল। ‘
রোমানার কথার প্রেক্ষিতে শবনম বললো,
-‘ এরা নিজেদের জেদ পূরণ করতে যা খুশি করতে পারে। তবে ভাই মনে রেখো নুরের সঙ্গে বেইমানি করলে মুনতাহার চোখের বিষ হবে তুমি। ‘
-‘ না ভাবি নুরের সঙ্গে কোন অন্যায় করবো না আমি। ওকে ভালোবাসতে পারবো কিনা জানিনা কিন্তু ওর ভালোবাসাটুকুর যত্ন নেবো। আজীবন আমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে পাশে থাকবো। ‘
[২১]
মানুষ যেমন উদ্যেগ নিয়ে যত্মসহকারে বৃক্ষের আশায়,ফুল,ফলের আশায় বীজ বপন করে বৃক্ষ’কে বড়ো করে তেমন সে বৃক্ষ থেকে ফুল,ফল পায়। যতোটা শ্রম সে দেয় তার অধিকটাই ফেরত পায়৷ কিন্তু মানুষের বুকে প্রেমের বীজ কেউ উদ্যেগ নিয়ে বপন করতে পারেনা। অন্তঃকোণে প্রেমের বীজ আপনাআপনিই ঠাঁই পায়। সে বীজ ধীরে ধীরে বিস্তর রূপ ধারণ করতে থাকে। দু’টো মানুষের হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়, কখনো বা সুখ,দুঃখ মিলিয়ে প্রেমের ভেলায় ভাসায়৷ প্রেম আপনাআপনিই আমাদের কাছে ধরা দেয় বলে একে অবজ্ঞা করতে নেই বরং যত্ন নিতে শিখতে হয়, সম্মান করতে জানতে হয়৷ রঙ্গন সেটুকুরই চেষ্টা করে। এই যেমন গত দু-মাসে রঙ্গন শাহিনুরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে৷ জেনে নিয়েছে শাহিনুরের অন্তঃকোণে থাকা সমস্ত কথোপকথন’কে। তার ইচ্ছা’কে তার চাওয়া,পাওয়া’কে। অবুঝ মেয়েটা’কে যতোটুকু পারে বোঝদান করার চেষ্টা করেছে। মেয়েটার সরলতা কিঞ্চিৎ কমানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। তবুও নিরাশ হয়নি সে কেন জানি এই সরলতাটুকুই তার ভীষণ ভালো লেগেছে। এই সরলতাটুকুই তাদের বন্ধুত্ব গাঢ় করেছে। এই যেমন রঙ্গন যখন শাহিনুরের সাথে তার দুঃখ, কষ্টগুলো ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করলো শাহিনুর তা সাদরে গ্রহণ করে নিলো। রঙ্গন যখন তার হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণাটুকু ব্যক্ত করলো শাহিনুরের দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করলো। সরল মনে ক্রন্দনরত কন্ঠে বোকাপাখিটা বললো,
-‘ তুমি কষ্ট পেওনা বাঁশিওয়ালা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি পরকালে উপরওয়ালার কাছে তোমার ভালোবাসার মানুষ’টাকে চেয়ে নিও। তবুও তুমি মন খারাপ করো না। ‘
সেদিনই রঙ্গন বুঝেছিলো শাহিনুর ঠিক কতোটা সরল৷ মেয়েটা ভালোবাসার মানে বুঝে না তবুও তাকে বলে ভালোবাসি। সে ভালোবাসার মানে বুঝে তাই আজো বলেনি ‘নুর আমি তোমাকে ভালোবাসি’। কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে। তারা একে অপরকে পাশে চায়,তারা একে অপরের সঙ্গ পেলে খুশি থাকে, ভালো থাকে৷ রঙ্গনের খুব ইচ্ছে করে শাহিনুরের ইচ্ছে পূরণ করতে৷ তারপর শাহিনুরের প্রচণ্ড খুশিটুকু উপভোগ করতে৷ একদিন কথার ছলে শাহিনুর বলেছিলো তার খুব ঘুঙুর পরতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে আম্মা,মান্নাত বুবুদের মতো ঘুঙুর পরে নৃত্য করতে৷ বাইজি গৃহের সকলের মতো সাজতে মন চায়,কপালে টিপ পরতে মন চায়। ইশ কতো চাওয়া শাহিনুরের। অথচ এসব কোনটাই পূরণ করতে পারেনা নিজের মায়ের জন্য। শারমিন বাইজি কি জানেনা তার মেয়ে হাসলে পুরো পৃথিবী’টাই হেসে ওঠে৷ তার মেয়ের হাসি আকাশের ঐ এক ফালি চাঁদের আলোর চেয়েও অধিক দীপ্তিমান! শাহিনুরের শখ পূরণ করতেই বাইজি গৃহের কাজের মহিলা রেশমা খাতুন’কে দিয়ে ঘুঙুরের ব্যবস্থা করেছে রঙ্গন৷ বিকালে রোমানার থেকে কিছু গয়নাও নিয়ে এসেছে৷ আজ সে নিজহাতে সাজাবে শাহিনুর’কে। ইচ্ছে পূরণ করবে শাহিনুরের। অবুঝ হৃদয়ে তার জন্য এতোখানি অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিদানে সে এটুকু দেবে না তাই কখনো হয়? বরাবরের মতো আজো রঙ্গন শাহিনুর’কে ফিসফিস করে ডাকলো৷ কারণ সে জানে আজ বাইজি গৃহের সকলে নৃত্য পরিশীলন নিয়ে বেশ ব্যস্ত। তাই শাহিনুর’কে এই কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রঙ্গন কয়েকবার ডাকতেই জানালা খুলে উঁকি দিলো শাহিনুর। প্রশস্ত হেসে হাত বাড়ালো রঙ্গন৷ ভীতিগ্রস্ত হয়ে হাত বাড়ালো শাহিনুরও৷ ধীরে ধীরে মই বেয়ে নেমে পড়লো দু’জনই তারপর কিছুটা দৌড়েই অরণ্যের ভিতর মিলিয়ে গেলো। ওরা যখন বনের ভিতর প্রবেশ করলো প্রণয় তখন বেশ দূরান্ত থেকে নিশানা করলো ওদের৷ বাড়ি ফেরার পর এমন কিছুর সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো সে৷ তাই খুব শান্ত ভঙ্গিতে যথাস্থানে গাড়ি রেখে পাঁচফোড়ন গৃহে প্রবেশ না করে পা বাড়ালো ঘন, বিস্তীর্ণ, নিস্তব্ধ অরণ্যের দিকে। রঙ্গনের কুটিরের সামনে কাঠের সিঁড়িতে অত্যন্ত লাজুক ভঙ্গিতে বসে আছে শাহিনুর। আর রঙ্গন তার পাশে বসে নিজ হাতে একে একে সমস্ত গয়না পরিয়ে কপালে লাল রঙা একটি টিপ পরিয়ে দিলো। সর্বশেষ দু’পায়ে ঘুঙুর পরাতেই আঁতকে ওঠলো শাহিনুর। কিন্তু পরোক্ষণেই ঘুঙুর দেখে দৃষ্টিজোড়া বড়ো বড়ো করে এক হাত মুখে চেপে ধরলো৷ নিচু কন্ঠে বললো,
-‘ ঘুঙুর! তুমি আমার জন্য ঘুঙুর নিয়ে এসেছো? ‘
রঙ্গন মাথা দুলিয়ে হাসলো তারপর শাহিনুরের একটি হাত নিজের হাতের মুঠোবন্দি করে নিয়ে দাঁড় করালো শাহিনুর’কে। বললো,
-‘ নিজ হাতে সব গয়না পরিয়ে দিলাম, হয়ে গেলো আমাদের এনগেজমেন্ট।’
অবুঝ শাহিনুর প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হলো আমাদের? ‘
হেসে ফেললো রঙ্গন সে ভুলেই গিয়েছিলো শাহিনুর ইংরেজি জানে না। তাই বললো,
-‘ এনগেজমেন্ট মানে বিবাহের বাগ্দান। মানে তোমার আমার বিয়ের বাগ্দান। ‘
-‘ ছিঃ বিয়ে!’
পিছন ঘুরে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়ালো শাহিনুর। রঙ্গন ভ্রু কুঁচকে শাহিনুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো বললো,
-‘ আরে আরে ছিঃ কেন? ‘
-‘ আম্মা মেরেই ফেলবে আমাকে। ‘
-‘ আরে বোকা মারবে কেন আমি আছিতো সবটা সামলে নেবো। সামনে আমার ভাইয়ের বিয়ে, বিয়েটা শেষ হোক তোমায় নিয়ে পালাবো আমি। তোমার আম্মা খুশি মনেই তোমাকে আমার হাতে তুলে দেবে।’
কিছু বললো না শাহিনুর শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো রঙ্গনের দিকে। রঙ্গন ওর মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
-‘ এই যে রূপসী কন্যা..আমি যে ঘুঙুর পড়ালাম সেদিকে খেয়াল আছে? ‘
চমকে ওঠে নিজ চরণদ্বয়ে তাকালে শাহিনুর৷ তারপর এপাশ ওপাশ পা নাড়িয়ে ঘুঙুরে শব্দ তুললো। আচমকাই ওষ্ঠাধরে আকর্ষণীয় হাসিটির দেখা মিললো। রঙ্গন মুচকি হেসে বললো,
-‘ তুমি কখনো নাচ শেখোনি অথচ মনে, প্রাণে ঠিক এই নৃত্য’কে লালন করো৷ পরিয়ে দিলাম ঘুঙুর এবার জমিদার পুত্র’কে নেচে দেখাও দেখি। ‘
নিস্তব্ধ, গভীর রজনী’তে ঘন জঙ্গলের ভিতর জোৎস্নার আলোতে গাছের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে এক যুবক। সেই সুরের তালে আপনমনে ঘুঙুরের শব্দ তুলে নৃত্য করছে এক কিশোরী৷ লাল শাড়িতে ঢেউ খেলানো চুলগুলো বেনুনী অবস্থায় হাঁটু ছুঁয়ে দিচ্ছে, গা ভর্তি গহনা, কপালে লাল টিপ,হরিণাক্ষ দৃষ্টিজোড়ায় মোটা করে কাজলের প্রলেপ,ওষ্টজোড়ায় টকটকে লাললিপস্টিক, রাজকুমারী না রাজরানী? নাকি বাইজি গৃহের প্রধান বাইজি কোন উপাধি মানানসই আজ শাহিনুরের জন্য ? ঝোপের আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ একজোড়া দৃষ্টি অকস্মাৎ নিভে গেলো৷ রুদ্ধশ্বাসে সরে গেলো মানুষটা। না পারে নিজ ভাই’কে আজ জ্যান্ত পুঁতে দিতে, না পারে বাইজি কন্যা’কে নিজ হাতে খুন করে নিজের আত্মাটুকু’কে স্বান্তনা দিতে। সবশেষে নিরুপায় হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
-‘ ছিঃ। আমার রুচি এতো জঘন্য! ‘
প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গৃহে ফিরলো প্রণয়। অরুণা,প্রেরণা খাওয়ার জন্য বেশ তোরজোর করলো কিন্তু প্রণয় বললো সে খেয়ে এসেছে কিছু খাবে না৷ নিজ কক্ষে গিয়ে নিজের ক্রোধটুকু নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো খুব কিন্তু কোনোকিছুতেই কাজ হলো না৷ শেষে লম্বা একটা গোসল দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করলো। রুমজুড়ে অনেকটা সময় পায়চারি করার পর খেয়াল করলো দ্বারের বাইরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রোমানা৷ রোমানা’কে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো প্রণয় তবুও ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ ওভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো কেন কিছু বলার থাকলে রুমে এসো। ‘
দুরুদুরু বুকে রুমে প্রবেশ করলো রোমানা৷ কিন্তু যা বলতে এসেছে তার কিছুই বলতে পারলোনা৷ অতিরিক্ত লজ্জাবতী হওয়ার এই জ্বালা৷ যা মনে আসে কিছুই বলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু প্রণয় যা সাংঘাতিক মানুষ কিছু না বললে প্রচণ্ড রেগে যাবে। তাই আমতা আমতা করে এ’কথা সে’কথা বলতে বলতে বিকালে রঙ্গনের সাথে হওয়া সমস্ত কথাই গড়গড় করে বলতে লাগলো। সকল কথা শেষে রোমানা খেয়াল করলো সে ঠিক কি অঘটনটা ঘটিয়েছে। জমিদার বাড়ির এক ছেলে বাইজি কন্যার প্রেমে মজেছে আর সে কিনা আরেক ছেলে’কে তা খুশি মনে জানাচ্ছে! এবার যদি ঝড় ওঠে সামলাবে কে? ভয়ে হাত,পা কাঁপতে শুরু করলো রোমানার৷ রোমানার অকস্মাৎ থেমে যাওয়াতে প্রণয় দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকালো রোমানার দিকে৷ রোমানা তার সে দৃষ্টি দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-‘ বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে কিছু বলিনি। ‘
প্রণয় ধীরপায়ে রোমানার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। গভীর দৃষ্টিতে রোমানার দিকে তাকিয়ে এক হাতে রোমানার গালে আলতো ছুঁয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ ভয় পাচ্ছো? যদি রঙ্গন’কে শাস্তি দেই। আব্বা,আম্মা’কে জানাই বা ঐ বাইজি’কে,বাইজির কন্যা’কে কঠোর শাস্তি দেই? ‘
শুষ্ক গলায় রোমানা বললো,
-‘ এসব করোনা প্রণয় প্লিজ। ‘
-‘ কিচ্ছু করবো না শুধু তুমি রুম থেকে বেরিয়ে যাও।’

নির্ঘুম একটি রাত পার করে সকাল সকাল বাগানে হাঁটতে বের হলো প্রণয়। সারারাত রোমানার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরেছে। দু-চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে রঙ্গন এবং শাহিনুরের হাস্যজ্জ্বল মুখগুলো। মনে প্রশ্ন জেগেছে তারপর কি হলো কতোটুক হলো? এই যে বাগানে পায়চারি করছে কিন্তু মন তার কাল রাত্রিতেই থেমে আছে। শরীরের রক্ত টগবগ করছে। তীব্র অস্বস্তি, ব্যাকুল মনে পায়চারি করা কালীন প্রেরণা এসে সামনে দাঁড়ালো। বললো,
-‘ কাল রাতে কথা বলার সুযোগ দিলে না। পরে বলবে তোমাকে না জানিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মা’য়ের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো প্রণয়। প্রেরণা চটপটে গলায় বললো,
-‘ আমরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজি তোমার আর রোমানার বাগ্দান সেরে ফেলবো। তোমার কোন সমস্যা নেই তো বাবা। ‘
-‘ না নেই আম্মা, এ বিষয়ে আগেই কথা দিয়েছি আপনাকে নতুন করে কিছু বলার নেই। ‘
-‘ তুমি প্রস্তুত জেনে খুশি হলাম। ‘
স্মিথ হাসলো প্রণয় প্রেরণা ঘরে ফিরে গেলো। মা চলে যেতেই প্রণয় একটি গাছের আড়ালে গিয়ে এক হাত মুঠ করে প্রচণ্ড শক্তি খাঁটিয়ে পরপর তিনটে ঘুষি মারলো গাছটিতে।

সন্ধ্যার পর উপস্থিত পরিবারের সকল সদস্য এবং আত্মীয় স্বজন সকলের সম্মুখে রোমানা’কে নিজহাতে নাকফুল পরিয়ে দিলো প্রেরণা। তারপর প্রণয়’কে বললো আংটি পরাতে। প্রণয় মৃদু হেসে রোমানাকে আংটি পরিয়ে দিলো। হয়ে গেলো তাদের বিবাহের বাগ্দান। আবেগে ঘনীভূত হয়ে কেঁদে ফেললো রোমানা। রোমানার মাথায় আলতো হাত চেপে প্রণয় বললো,
-‘ সুখের মূহুর্তে কাঁদতে নেই রোমানা। ‘
এটুকু বলেই ওঠে দাঁড়ালো প্রণয়। কিছুক্ষণ বিরতি প্রয়োজন বলে সকলের থেকে আড়ালে চলে গেলো।
কখনো কখনো একটুখানি চিৎকার করার জন্য হলেও নীরব পরিবেশ প্রয়োজন। প্রণয় সেই পরিবেশের খোঁজ করতে করতে জমিদার বাড়ির খোলা অরণ্যের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছালো। অন্ধকারাচ্ছন্ন সারি সারি সুপারি গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো,
– এই বিস্তীর্ণ, নিস্তব্ধ অরণ্যকে যদি প্রশ্ন করি, ‘জমিদার অলিওর চৌধুরী’র পুত্র হওয়া সত্ত্বেও কেন আমার মনের আরশিতে সুস্পষ্টভাবে এক বাইজি কন্যার মুখচন্দ্রিকা ভেসে ওঠে?’ কী উত্তর দেবে এই নিস্তব্ধ রাত, এই নিস্তব্ধ অরণ্য? যদি বিশাল আকাশে বসবাসরত ঐ চন্দ্র,নক্ষত্রদের প্রশ্ন করি, ‘জমিদার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও কেন আমার হৃদয়ে অতি সাধারণ এক বাইজি কন্যার বাস? ‘ কী উত্তর দেবে এই নিস্তব্ধ শীতল প্রকৃতি’রা…

চলবে…
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here