বাইজি কন্যা পর্ব ১১+১২

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_১১
[১৭]
অতি আদরে শাহিনুর’কে নিজ বক্ষে চেপে ধরলো প্রণয়৷ দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে হাঁটা ধরলো নির্দিষ্ট একটি স্থানের উদ্দেশ্যে। কোয়াটার থেকে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় বিরতিহীন চলছে সে। নিস্তব্ধ রাত, চারদিকের স্বল্প আলোয় বিশাল দেহের অধিকারী মানুষ’টা কোলে এক ছোট্ট কিশোরী’কে নিয়ে আপনমনে হেঁটে চলেছে। অধরে তার কুটিল হাসি,সুক্ষ্ম দৃষ্টি’জোড়ায় আকাশসম রহস্য। পরিবেশে গা থমথমে এক ভাব। দু’টো মানুষের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ, একজোড়া সুক্ষ্ম পদধ্বনি ব্যতিত আর কোন শব্দের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না৷ নিস্তব্ধ রাস্তায় গুরুগম্ভীর পদধ্বনি,ক্রমশ দু’টো মানব-মানবীর নিঃশ্বাসের উত্থান-পতন পরিবেশটা’কে দ্বিগুণ থমথমে করে তুললো। নিবিড় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন শাহিনুর এসবের কিছুই টের পেলো না৷ পেলে হয়তো ঐ অবস্থাতেই মূর্ছা ধরতো। তার সে মূর্ছনায় বিরক্ত হয়ে হয়তো চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলতো প্রণয়। কিন্তু সেটুকু টের পেতোনা শাহিনুর। সে যে কিছুই টের পায় না৷ বিশাল পৃথিবী’তে বিশাল অনুভূতি’তে আচ্ছন্ন এই কিশোরী কবে টের পাবে সবটা?

প্রণয়ের বিশ্বস্ত ড্রাইভার কোয়াটার থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রণয় সেখানে উপস্থিত হতেই ড্রাইভার মেরাজুল হক মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেলো। প্রণয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে শাহিনুর’কে পাশের সিটে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। আর নিজে বসে পড়লো ড্রাইভিং সিটে। শীতার্ত রজনী, পাশে অতি সুদর্শনীয়,মনোহারিণী এক কিশোরী,বক্ষঃস্থলে নিদারুণ এক যন্ত্রণা, সবমিলিয়ে এমন অনুভূতি তৈরি হয়েছে যা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এমন’ই অনুভূতি’তে সিক্ত প্রণয়। বেশ ধীরগতিতেই ড্রাইভ করতে শুরু করলো সে। অকস্মাৎ মাঝপথে থেমে থেমে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেও শাহিনুরকে। গভীর রজনী, অন্ধকারাচ্ছন্ন ফাঁকা একটি রাস্তা, পাশে অল্পবয়সী অতি সুদর্শনীয় এক কিশোরী। ভাবতেই আনমনে হেসে ওঠলো প্রণয় চৌধুরী। আজ যদি রঙ্গন শাহিনুর’কে এভাবে তার কাছে না নিয়ে আসতো, আর সে যদি কুটিলতা না করতো এই মূহুর্ত’টা কি উপভোগ করতে পারতো? যতোই সে ব্যতিক্রম স্বভাবের হোক জমিদারের রক্ত বইছে তার শরীরে। আর সকলে যেমন কুটিল বুদ্ধি দিয়ে বহু নারী’র সংস্পর্শ লাভ করে তেমনি কুটিল বুদ্ধি দিয়ে সে এই এক নারী’র সংস্পর্শই লাভ করবে।
কিন্তু ভাই’টা কি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে? নারী লোভ যে বড়ো ভয়ংকর লোভ। আর এই নারী’তে শুধু তার এক ভাই নয় অঙ্গন বাদে সব ভাই’ই আকৃষ্ট!

বাইজি গৃহের সামনে গাড়ি থামালো প্রণয়৷ চোখজোড়া বন্ধ করে বার কয়েক নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তারপর আচমকাই চোখ খুললো। তাকালো শাহিনুরের মুখপানে। শাহিনুরের ঢেউ খেলানো চুলগুলো অর্ধেক শরীর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কপালজুড়ে লেপ্টে রয়েছে ছোট ছোট ঢেউ খেলানো চুল। প্রণয় হাত বাড়িয়ে আলতো ছুঁয়ে দিলো কপালের লেপ্টে থাকা চুলগুলোতে। খানিকটা ঝুঁকে শাহিনুরের পুরো মুখশ্রী’তে অদ্ভুত চাহনি নিক্ষেপ করলো৷ দু’চোখের ঘনপাপড়ি,তড়তড়া নাক,কোমল মসৃন ওষ্ঠজোড়ায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসলো। সব শেষে থুতনির মঝের গর্তটায় বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বেশ শব্দ করেই হাসলো। বিরবির করে বললো,
-‘ চারদিকে অগণিত অপবিত্র স্পর্শ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য নুর, সেই অপবিত্র স্পর্শগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলে আমার স্পর্শ তোমায় হাসিমুখে বরণ করতে হবে। কিন্তু সেটা পবিত্রভাবে নাকি অপবিত্রভাবে এটা পুরোপুরিই তোমার ওপর নির্ভর করবে। ‘
গাড়ির দরজা খুলে নামতে যেয়েও থেমে গেলো প্রণয়। আবার পিছু ঘুরে শাহিনুরে’র দিকে ঝুঁকে বিরবির করেই বললো,
-‘ এটা’কে কি বলে আখ্যা দেবে নুর ? তুমি খুব বোকা, আমি ভালোবাসার মতো ভালোবাসা দেবো। বোকাপ্রাণী’রা ভালোবাসা বুঝেনা। তুমিও বুঝবে না,বাট আই ডোন্ট কেয়ার। তোমার এই অতিশয় সৌন্দর্যের ভাগ আমি কাউকে দেবো না। রূপবতী নারী’দের জীবনসঙ্গী, শয্যাসঙ্গী আমার মতোন ইতর হবে এটাই স্বাভাবিক। তোমার জন্য আমি এক ইতর প্রাণী আমার জন্য তুমি এক বোকাপ্রাণী।
কথাগুলো বলে বাঁকা হাসলো প্রণয়। শাহিনুরের গালে আলতো ছুঁয়ে আবার বললো,
-‘ বোকা মেয়ে। রঙ্গন নয় প্রণয় তোমার ভবিতব্য! তাই রঙ্গন’কে নয় প্রণয়’কে ভরসা করতে শেখো। আজ বেরিয়েছো ওর হাত ধরে আর ফিরেছো আমার বক্ষেচেপে। এখানেই প্রমাণিত হাতে নয় বুকে থাকতে হবে তোমায় মিস শাহিনুর শায়লা…’

রাতের শেষ ভাগ ঘরের এক কোণে হারিকেনের আলো জ্বলছে। দরজার কাছে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে মান্নাত। শাহিনুর’কে না পেয়ে দিশেহারা সে। দরজার বাইরে উন্মুখ হয়ে বসে আছে শারমিন। অনেকটা সময় ধরে সে শারমিন’কে বোঝাচ্ছে শাহিনুর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। সে যেনো ফিরে যায়৷ কিন্তু শারমিন ফিরে যায়নি। বার বার দরজা খুলতে বলছে। শারমিন যতোবার দরজা খুলতে বলছে ততোবার মান্নাত ভীতি স্বরে বলছে,
-‘ সখী নুর ঘুমাই গেছে তুমিও ঘুমাও গিয়ে। ‘
শারমিন, মান্নাতের এমন কার্যক্রমের মধ্যেই অতি সতর্কতা অবলম্বন করে মই বেয়ে জানালা টপকে ঘরে প্রবেশ করলো প্রণয়। নিঃশব্দে শাহিনুর’কে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে চলে আসার জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু অন্তঃকোণে গভীর পীড়া শুরু হয়ে গেলো। হতবুদ্ধি হয়ে অকস্মাৎ আক্রমণ করলো শাহিনুর’কে। আক্রমণটি এমনই যে একটা নয় দু’টো নয় নিজের সুঠাম,শক্তিশালী হস্তদ্বারা শাহিনুরের কেশগুচ্ছ থেকে তিনটা চুল ছিঁড়ে ফেললো। যদিও বুঝে, শুনে গণনা করে এই কার্য সে সম্পাদন করেনি। তবুও পৈশাচিক আনন্দ পেলো সে। ব্যথা পেয়ে ঘুমের ঘোরেই ‘ওহ’ সূচক শব্দ করলো শাহিনুর। চমকে গেলো মান্নাত! ভূত ভূত বলে চেঁচিয়েও ওঠলো। প্রণয় আর অপেক্ষা করলো না ত্বরিতগতিতে জানালা থেকে এক লাফে নিচে নেমে পড়লো। মূহুর্তেই কি ঘটে গেলো কিছুই বুঝতে পারলো না মান্নাত৷ তবে কোন কিছুই যে স্বাভাবিক নেই খুব টের পেলো। তবে যাই ঘটুক না কেন আগে নিজে বুঝবে এবং পরে শারমিন’কে অবগত করবে এটুকুন ভেবে
শঙ্কিত হয়ে দরজা খুলে দিলো। শারমিন ধাতস্থ হয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো পুরো শরীরে শাড়ি পেঁচিয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে শাহিনুর৷ শারমিন ভীতিগ্রস্ত মান্নাত’কে বললো,
-‘ মাথা কি গেছে তোর ভূত ভূত করছিস কেন? আর ওকে ওষুধ লাগিয়ে শাড়িটা ঠিকভাবেও পরাসনি। তুই এতোক্ষণ কি করলি তাহলে। কোন জগতে ছিলি বলবি? ‘
প্রচন্ড রেগে গিয়ে শাহিনুর’কে শাড়ি পরিয়ে দিতে দিতে বললো শারমিন। মান্নাত এক ঢোক গিলে ওষুধের বাটিটা আড়াল করলো। জোর পূর্বক হেসে শাহিনুরের দিকে গভীরভাবে চোখ বুলিয়ে বললো,
-‘ আসলে আমার খুব ঘুম পাইছে। তুমিতো জানো অতিরিক্ত ঘুম পেলে আমি এমন আবল তাবল বকি।’
শারমিন চিন্তিত স্বরে বললো,
-‘ ওহ তুই তাহলে যা আমি ওর কাছে আছি,ঘুমা গিয়ে। ‘
পরেরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো শাহিনুরের৷ মায়ের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। কারণ সে ঘুম থেকে ওঠার পূর্বেই চলে গেছে শারমিন। কিন্তু শাহিনুর ভাবছে সে কি করে বাইজি গৃহে এলো? সে বাঁশিওয়ালার সাথে খরখরে স্বভাবের মানুষ’টার কাছে গিয়েছিলো। তারপর তারপর কি হলো? একমনে গতরাতের কথা স্মরণ করতে শুরু করলো শাহিনুর৷ কিন্তু কিছুই বোধগম্য হলো না তার। তাহলে কি এটা তার স্বপ্ন ছিলো! জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘন বনের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। এমন সময় ঘরে এলো মান্নাত। বললো,
-‘ নুর কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলি তুই? ‘
কেঁপে ওঠলো শাহিনুর। সমানতালে ঢোক গিলতে গিলতে বললো,
-‘ কই কোথাও না তো, বুবু তুমি আম্মা’কে কিছু বলোনা পায়ে পড়ি তোমার। ‘
কেঁদে ফেললো শাহিনুর। মান্নাত আশ্চর্য হয়ে শাহিনুরের দু’কাঁধ চেপে ধরলো। বললো,
-‘ নুর কি হয়েছে? ঐ লোকটা কে ছিলো? তোকে ঘুমন্ত অবস্থায় কে দিয়ে গেলো কাল? কোথায় ছিলি তুই? ‘
মান্নাতের কথা শুনে শাহিনুর ভাবলো কাল সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর বাঁশিওয়ালা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এখানে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। তাই কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-‘ জমিদার পুত্র বাঁশিওয়ালা। ‘
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো মান্নাতের৷ শাহিনুরের দিকে বড়ো বড়ো করে চেয়ে বললো,
-‘ কি বলছিস এসব! ‘
শাহিনুর’কে চাপ দিয়ে সমস্ত কথাই শুনলো মান্নাত। সবটা শুনে থমকে গেলো সে। তার মতোই ভুলপথে পা বাড়াচ্ছে শাহিনুর। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অভিশপ্ত গৃহ থেকে বের করতে হবে নুর’কে। শারমিন’কে এসব জানালে নিজ হাতে খুন করবে মেয়ে’কে। তাই সবটা চেপে গিয়ে নুর’কে এখান থেকে দূরে সরানোর জন্য শারমিন’কে আশকারা দিতে হবে। ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো মান্নাত৷ আচমকাই শাহিনুর’কে জড়িয়ে ধরে কম্পিত কন্ঠে বললো,
-‘ নুর, বাঘ কখনো বাঘ মারে না, কুকুর কখনো কুকুর মারে না কিন্তু মানুষ, মানুষ মারে। ‘
কিছুই বুঝলো না শাহিনুর। বললো,
-‘ এই কথার মানে কি বুবু? ‘
এমন সময় ঘরে ঢুকলো শারমিন। তার বলা কথাগুলোই মান্নাত নুর’কে বলছে। কিন্তু নুর’তো এতো কঠিন কথা বুঝবে না। তাকে সহজ ভাবে বোঝাতে হবে। তাই মুচকি হেসে সে বললো,
-‘ নুর মনে আছে সেদিন বললাম, ঢাকা শহরের এক পরিবারে ছেলের হাতে বাবা খুন হয়েছে। এমনই অনেক মানুষই মানুষ খুন করে। কিন্তু ভেবে দেখো একটি কুকুর আরেকটা কুকুর’কে খুন করতে পারেনা। একটি বাঘও আরেকটি বাঘ’কে খুন করে না৷ পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও শুনতে পাওয়া যায়নি একই জাতির পশুদের মধ্যে রক্তারক্তি ঘটনা ঘটেছে বা এক প্রাণী দ্বারা একই শ্রেণীর অপর প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে। বাঘ কখনো বাঘ’কে মারে না। কুকুর কখনো কুকুর’কে মারে না। কিন্তু মানুষ, মানুষ’কে মারে। মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটি,খুনাখুনি হয়। পৃথিবী’টা বড়োই অদ্ভুত’রে মা। এখানে বোধ প্রাণী’রাই নির্বোধ। নির্বোধ প্রাণীরাই দারুণ বোধ শক্তির অধিকারী। ‘
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_১২
মা’য়ের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহিনুর। শারমিনের মুখে মুচকি হাসি থাকলেও কাজল কালো টানা টানা চোখদুটোতে রয়েছে প্রবল দৃঢ়তা। তার চোখের দৃঢ়তা,ওষ্ঠকোণে ফুটে ওঠা আশ্বস্ত হাসি,কণ্ঠধ্বনির সীমাহীন ক্রোধ’ই বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মূহুর্তে বলা কথাগুলোতে ঠিক কতোখানি ক্ষোভ মেশানো রয়েছে। কি অদ্ভুত রূপ শারমিন বাইজির৷ শাহিনুরের এক অদ্ভুত সুন্দরী মা। এতো ত্যাজ,এতো ক্রোধের অধিকারিনী’কে কি আদেও বাইজি গৃহে মানায়? এ পৃথিবীতে সঠিক জিনিসের সঠিক স্থান দেওয়া হয় না। তাই তো আজ শারমিনের স্থান বাইজি গৃহে। লম্বা, ফর্সা, মাঝারি গড়নের শারমিন’কে এক নজরে দেখে অপছন্দ করার জো নেই। অত্যাধিক সুন্দরী মেয়ে’দের কপাল এতো মন্দ হয় কেন কে জানে।

শাহিনুর চেয়ে আছে মা’য়ের দিকে। মা’য়ের মুখ দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায় তার। বক্ষঃস্থলে প্রশান্তি লাগে খুব৷ কিন্তু তেজস্বী মায়ের ত্যাজি রূপ দেখলেই ভয়ে মুখটা চুপসে যায়৷ এ মূহুর্তে শারমিন’কে দেখে মিশ্রিত অনুভূতি হচ্ছে শাহিনুরের। তাই কিছুটা ভীতিগ্রস্থ হয়ে পড়লো সে। মাথা নিচু করে বারকয়েক ঢোকও গিললো। কিন্তু শারমিন মনস্থির করেছে এবার সে শাহিনুর’কে কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞাত করবে। আর বেশী সময় নেই। মেয়ে’কে নিজের কাছ ছাড়া করার পূর্বে এই কঠিন দুনিয়ার কাঠিন্যতা,নির্মম দুনিয়ার নির্মমতা, মানুষ তকমা পাওয়া অমানুষগুলো সম্পর্কে পুরোপুরিই জ্ঞান দান করতে হবে। কথিত আছে যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ। আজ সে শাহিনুর’কে নিরাপত্তা দিতে পারছে। কারণ আজ সে জীবিত রয়েছে। পরিচয় এক বাইজি হলেও জমিদার অলিওর চৌধুরী’কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু কাল যদি তার মৃত্যু ঘটে তার এই ফুলের মতোন মেয়েটার কি হবে? আজ জমিদার অলিওর চৌধুরী শারমিন শায়লা’কে কিছুটা হলেও মান্য করে৷ কিন্তু কাল যদি শারমিনের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়? তখন অলিওর চৌধুরী নিজেই শাহিনুর শায়লা’কে ভোগের সামগ্রী বানাবে না তার নিশ্চয়তা কি? মানুষ মরণশীল। এই কঠিন সত্য জমিদার’রা ভুলে গেলেও সে তো ভুলে যায়নি। তাই আজ বেঁচে থাকা অবস্থায় আগামী ৫০ বছর শাহিনুর যেনো সঠিক ভাবে বাঁচতে পারে,সঠিক পথে চলতে পারে সেই পরিকল্পনা করে শাহিনুর’কে দীক্ষা দেবে। এই পরিকল্পনা যদি সফল না হয় তবে চারদিকের সব নরপশু’রা, হায়েনার দলেরা খুবলে খাবে তাকে। নরক বানিয়ে দেবে তার এক এক’টা রাত এক এক’টা দিন’কে। আর ভাবতে পারলো না শারমিন। বক্ষে যেনো আকস্মাৎ অগ্নি জ্বলতে শুরু করলো তার৷ মান্নাতের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। মান্নাত মাথা নিচু করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে দ্বারে খিল দিলো শারমিন। তারপর মেয়ের কাছে এসে হাত ধরে মেঝেতে পাড়া বিছানায় গিয়ে বসলো। যে যে জায়গায় আঘাত করেছিলো গতকাল প্রতিটি জায়গায় দৃষ্টি বুলিয়ে বললো,
-‘ ব্যথা আছে? ‘
শাহিনুর আবেগান্বিত হয়ে মা’য়ের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললো। ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,
-‘ আম্মা তুমি আমাকে মাফ করে দাও। ‘
শারমিন শাহিনুরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-‘ আমি তোমাকে মাফ করে দিছি গো আম্মা। তুমি কেঁদো না। ‘
শাহিনুরের মাথায় হাত বুলিয়ে কথাটা বলে শেষ করতেই আবার বললো,
-‘ ইশ চুলগুলোর কি অবস্থা দেখি চিরুনি দাও আঁচড়ে বেনুনি গেঁথে দেই। ‘
শাহিনুরের কপোলদ্বয় মুছে ললাটে গাঢ় চুমু খেলো শারমিন৷ মায়ের স্নেহে সিক্ত হয়ে থেমে গেলো শাহিনুর৷ লক্ষ্মী মেয়ের মতোন তেল,চিরুনি, চুলবাঁধার ফিতা এনে দিলো মা’কে। তারপর মায়ের সামনে বসে পড়লো। শারমিন মুচকি হেসে চুলে বিলি কেটে তেল দিতে শুরু করলো। বললো,
-‘ তোমার কোন প্রশ্ন আছে নুর? থাকলে নির্দ্বিধায় করতে পারো। ‘
স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো শাহিনুর। কারণ সত্যি অনেক প্রশ্ন আছে তার। তার মনের কথা বুঝেই শারমিন অনুমতি দিয়েছে ভাবতেই প্রশান্তি লাগলো খুব। তাই চটপটে গলায় বলে ওঠলো,
-‘ আম্মা মানুষ কেন মানুষ’কে খুন করে? প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মালিক তো আল্লাহ। এই অধিকার তো মানুষের নেই। ‘
-‘ অনধিকার চর্চা করা মনুষ্য জাতির স্বভাব নুর৷ আর নাম মাত্র মানুষ’রাই তো অপর মানুষ’কে হত্যা করে। এদের মানুষ নয় অমানুষ বলা হয়। ‘
-‘ অমানুষ কি আম্মা? ‘
-‘ মানুষ হয়েও যারা অমানুষের মতো কাজ করে তারাই অমানুষ। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে নুর, যিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটায়,যিনি মানুষ’কে বাঁচতে সাহায্য করে তিনিই মানুষ। আর যিনি মানুষ’কে কাঁদায়,নিজ কর্মের দ্বারা অগণিত মানুষের হৃদয়ে হাহাকার সৃষ্টি করে, অপরের প্রাণ কেড়ে নেয় তিনিই অমানুষ। ‘
-‘ আম্মা তাহলে জমিদারের সেই পুত্রও তো অমানুষ। মান্নাত বুবু’কে কাঁদায় যে!’
পলাশ’কে ইঙ্গিত করতেই চুপ থাকলো শারমিন। কিছু একটা ভেবে স্মিত হেসে বললো,
-‘ আমার মেয়ে তুমি নুর। আমার চেয়েও অধিক শক্তিশালী হতে হবে তোমায়। মানুষ পড়তে হবে তোমাকে। যেদিন তুমি মানুষ পড়তে জানবে সেদিনই তোমার মা নিশ্চিন্ত হতে পারবে। নয়তো মরেও শান্তি পাবে না তোমার আম্মা। ‘
আচমকাই শারমিনের দিকে ঘুরে শারমিন’কে জড়িয়ে ধরলো শাহিনুর। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বললো,
-‘ অমন কথা বলো না আম্মা তুমি অমন কথা বলো না। তোমার কিছু হবেনা তুমি কোথাও যাবে না। আমাকে ছেড়ে তুমি মরতেও পারবেনা৷ বাঁচলে আমাকে নিয়ে বাঁচবে মরলেও আমাকে নিয়ে মরবে। তুমি কিন্তু আম্মা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। ‘
দু’চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করলো মা, মেয়ের। অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠলো শারমিনের। হায় হায়! এই মেয়ে’কে কি করে দূরে পাঠাবে সে? কি করে থাকবে তার বাচ্চা’টা?
[১৮]
পুরো একটা রাত,পুরো একটা দিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটলো রঙ্গনের। দিনশেষে কোয়াটারে ফিরে প্রণয় দেখলো রঙ্গন গোসল সেরে তয়ালে গলায় ঝুলিয়ে রুমজুড়ে পায়চারি করছে। প্রণয় ঘরে ঢোকা মাত্রই রঙ্গন প্রশস্ত হেসে বললো,
-‘ ভাই তুমি এসেছো? তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ‘
-‘ তাই নাকি তা বাঁশিওয়ালা হঠাৎ আমার অপেক্ষা’তে যে! ‘
প্রণয়ের ব্যঙ্গাত্মক বাক্যটি শুনে ভীমড়ি খেয়ে গেলো রঙ্গন। চোখ দু’টো রসগোল্লার মতো গোল গোল করে বললো,
-‘ এ ভাই তুমি নুরের মুখে এই ডাক শুনেছো তাইনা? ‘
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রণয়। কয়েকপল নীরবতা পালন করে ডিভানে গিয়ে বসলো। বললো,
-‘ এক বাইজি কন্যা’কে নিয়ে এতো মাতামাতি কি ঠিক হচ্ছে রঙ্গন? ‘
মাথা চুলকে বিছানায় বসলো রঙ্গন। আমতা আমতা করে বললো,
-‘ মাইয়া বেশ সুন্দরী ভাই। হতে পারে সে বাইজি কন্যা কিন্তু সে বাইজি নয়। এমন রূপবতী দু’একটা জমিদার বাড়ি আসলে ক্ষতি নেই তো…’
-‘ আর ইউ সিরিয়াস? ‘
-‘ ইয়েসস। ‘
-‘ পুরে পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধ করবি? যুদ্ধ করবি পলাশ চৌধুরী’র সঙ্গে? ‘
-‘ না ভাই পরিবারের সঙ্গে নয় তবে পলাশ চৌধুরী’র সঙ্গে যুদ্ধ হবে। সময় এবার আমার। ‘
-‘ তার মানে ভালোবাসা নয় শুধুই প্রতিশোধের জন্য? রঙ্গন চৌধুরী পলাশ চৌধুরী’র ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এক বাইজি কন্যা’কে ব্যবহার করবে! ‘
কিছুটা ঘৃণার সুরে কথাটি বললো প্রণয়। রঙ্গন মুচকি হেসে ওঠে দাঁড়ালো। ঘাড়ে জড়ানো তয়ালেটা দু’কাধ বরাবর নিচ থেকে টেনে ধরে শরীর টান টান করে দাঁড়ালো। বেশ আয়েশি কন্ঠে বললো,
-‘ অমন রূপবতী’কে এতো তুচ্ছ করোনা ভাই৷ অমন জিনিস’কে হেলাফেলা করতে নেই। তাছাড়া ইউ নো হোয়াট? পলাশ চৌধুরী’কে পাটকেল মারার সময় এসে গেছে। ভয় নেই কোন ভাই’কে বিন্দু অসম্মানও করবো না৷ শুধু একটু নিয়ম ভঙ্গ করবো। ‘
-‘ মুনতাহা’র সামনে তুই এটা পারবি? ‘
-‘ যদি মুনতাহা কষ্ট পেতো পারতাম না ভাই। কিন্তু যে আগুনে এতোকাল জ্বলছি আমি সে আগুনে পলাশ চৌধুরী’কে জ্বালিয়ে ছাড়বো। ‘
নিঃশব্দে শ্বাস ছাড়লো প্রণয়। রঙ্গন গিয়ে তার পাশে বসলো। তারপর ধীরসুরে বললো,
-‘ ভাই আঙুর গাছে আঙুর ধরেছিলো। পাকার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু তার আগেই পলাশ চৌধুরী সুযোগ পেয়ে টোপ করে তা খেয়ে নিয়েছে। ঠিক এমনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবার। ‘
দু’হাত শক্ত মুঠ করে ফেললো প্রণয়। রঙ্গন তার কথার ইতি টেনে গতরাতের ঘটনা শুনতে চাইলে প্রণয় অত্যন্ত কৌশলে তাকে বুঝিয়ে বিদায় করলো। রঙ্গন চলে যেতেই ঠাশ করে দরজা আঁটকে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো প্রণয়। শরীর কাঁপিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-‘ তোর উদ্দেশ্য সঠিক হলে আমি চুপ হয়ে যেতাম কিন্তু তোর উদ্দেশ্য সঠিক নয় রঙ্গন। আই এম সরি। ‘

অন্ধকারে মাথা নিচু করে বসে ছিলো শাহিনুর। আচমকা বাঁশির সুর কানে ভাসতেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো তার। ধড়ফড়িয়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। দ্রুত পায়ে ছুটে গেলো জানালার কাছে। জানালার কাছে আবছা ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়েই মুচকি হাসলো রঙ্গন৷ বাঁশির সুর থামিয়ে এক পা,দু’পা করে এগুতে লাগলো। মাথায় গামছা বেঁধে লুঙ্গির সাথে ঢিলেঢালা ফতুয়া পড়েছে রঙ্গন। হাতে তার বাঁশি। আজ তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে জমিদার পুত্র। এইরূপে আবছাভাবে রঙ্গন’কে দেখে বিস্মিত হলো শাহিনুর। তাকে আরো একটু চমকে দেওয়ার জন্য রঙ্গন তেঁতুল গাছের আড়ালে থাকা মইটা নিয়ে জানালায় ঠেকালো তারপর অর্ধেক মই অবদি ওঠে হাত বাড়িয়ে বললো,
-‘ নুর এসো। ‘
শাহিনুরের সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো। বক্ষঃস্থলে তীব্র কম্পন শুরু হয়ে গেলো। গণ্ডস্থল থেকে বক্ষঃস্থল অবদি শুকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা হলো। কোনক্রমে সে মৃদুসুরে বললো,
-‘ তুমি আমায় ডেকো না বাঁশিওয়ালা। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারবোনা। ‘
রঙ্গন মুচকি হেসে বললো,
-‘ আমার বাঁশির সুরও শুনবে না? ‘
এ প্রশ্নের জবাবে মন খারাপ হয়ে গেলো শাহিনুরের। রঙ্গন বললো,
-‘ এই এই মন খারাপ করছো কেন? তুমি আমার সঙ্গে না গেলেও আমি তোমায় বাঁশির সুর শোনাবো।’
এটুকু বলে এক লাফে নিচে নেমে পড়লো রঙ্গন। আতঁকে ওঠলো শাহিনুর। স্বাভাবিক হলো তখন যখন রঙ্গন তেঁতুল গাছের শেকড়ে বসে বাঁশি বাজাতে লাগলো। শাহিনুর ক্ষণকাল অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো। তারপর ভাবলো মায়ের বলা কথা গুলো। চাঁদের আলোতে যতোটুকু রঙ্গনের হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল মুখটুকু দেখতে পেলো ততোটুকুতেই সে প্রবল বিশ্বাসী হলো। বিরবির করে বললো,
-‘ মানুষ তো এমনই হওয়া উচিৎ। জমিদারের এই পুত্রই কি তবে মানুষ আর বাকিগুলো সব অমানুষ। ‘ সকলের প্রতি একরাশ ঘৃণায় তিক্ত হয়ে ওঠলো শাহিনুর। আবার যখনি কর্ণে বাঁশির সুর ভেসে এলো, চক্ষে রঙ্গনের প্রাণোচ্ছল প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠলো সমস্ত তিক্ততা ভুলে একরাশ ভালোলাগায় সিক্ত হয়ে ওঠলো তার বুক। ইশ পৃথিবী’টা কতো সুন্দর! প্রেমে পড়ার প্রথম ধাপে যদি পৃথিবী’টা সুন্দরই না লাগে সে প্রেমে পড়ে লাভ কী? শাহিনুর প্রেমে পড়েছে। ভীষণ একটা প্রেমের টান অনুভব করছে সে। তাইতো পৃথিবী’টা সুন্দর লাগছে তার৷ এই রাত,এই ক্ষণ,এই মানুষ, ঐ চাঁদ সবটাই আজ ভীষণ সুন্দর।

চলবে..৷
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here