বিধুর রজনী পর্ব -০১

১.
” শুনলাম আমাদের শেহজাদীর নাকি দুই সতিন আছে।বড় সতিনের ঘরে ফুটফুটে এক রাজপুত্রের জন্ম।মার্জনা করবেন শেহজাদী এই বিবাহে আপনার মতামত আশা করা যায় না।”
খাসদাসী লতার মুখের কথাটি হৃদয়ে কাপন ধরাল শেহজাদী আরওয়া’র।চোখে মুখে বিস্ময় কাটিয়ে ছেঁয়ে গেল ক্রোধে।

” লতা কি বলছো তুমি?তোমার সংবাদ যদি মিথ্যা হয় তবে তোমার সাথে কি হবে সেটা আর সরাসরি বলতে হবে না আশা করি!”

নতজানু হয়ে মস্তক নাড়ালো লতা।চোখে মুখে ভীতিকর ভাব ধারণ করলেও সত্যতে অটুট রইলো সে।

” মার্জনা করবেন সংবাদটি মিথ্যা নয়।আমাদের সম্রাট এমনকি আপনার বড় সহোদর এই কথা জানেন।বেগম সাহেবা অনেক বুঝিয়েছেন সম্রাটকে এমন ঘরে কিছুতেই কন্যা দান করবেন না তিনি।কিন্তু সম্রাট শুনলেন না।বরং বেগম সাহেবাকে কক্ষে বন্দী করেছেন।”

শেহজাদী আরওয়া পালঙ্কে গিয়ে বসলেন।আশেপাশে বেশ কয়েকজন দাসী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এরা সবাই শেহজাদীর ব্যক্তিগত দাসী।শেহজাদীর সকল কাজকর্মের সাহায্যকারী এরা প্রত্যকেই।

” আমার পিতা আমার কাছে এত বড় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ কেন গোপন করেছে লতা?আমি তো তার পালিত মেয়ে নই,আমি তার নিজের মেয়ে।সতীনের সঙ্গে ঘর কিছুতেই আমি করতে পারিনা।”

খাসদাসী লতা চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন শেহজাদীর পানে।হাসিখুশি মেয়েটা যেন চোখের পলকে নুইয়ে গেছে।

” শেহজাদী আপনি এবার কি করবেন?ক্ষণিক বাদে কাজী সাহেব আসবেন।ইতোমধ্যে পাত্রপক্ষ চলে এসেছে মহলে।”

” আমি কি করবো আর করতে পারি এই মহলের সবার জানা।”

শেষ কথাটি বলে হাসলেন শেহজাদী আরওয়া।বাগান থেকে তুলে আনা যে তাজা গোলাপগুলো খোপায় গুজে দেওয়া হয়েছে চোখের পলকে সেই খোপায় থাকা সমস্ত গোলাপগুলো মুষড়ে ধরলেন বাম হাতের সাহায্য।ফলে প্রতিটি ফুলের পাপড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে মেঝেতে আনাদর অবস্থায় পড়লো।শেহজাদীর কান্ডে দাসীরা প্রত্যকে চোখ ইশারায় একজন আরেকজনকে কি বুঝালো কে জানে!

২.
রাজমহলের একটি সুসজ্জিত কক্ষে উপস্থিত উদয় নগররের সম্রাট ওয়াহাব এবং তার একমাত্র রাজপুত্র মেসবাহ।আজকের এই আনন্দপূর্ণ দিনে মেসবাহ এবং অলকপুরী রাজ্যর রাজকন্যা ‘আরওয়া নূরে’র সঙ্গে তার বিবাহ সম্পূর্ণ হবে।কক্ষে উপস্থিত ছিলেন কাজী সাহেব এবং রাজকন্যার দুই সহোদর। ফটকের দু’প্রান্তে দুজন দৌবারিকের অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে।

” সম্রাট আপনার কন্যাকে ডেকে পাঠান সময় হয়ে এসেছে।শুভ কাজে এত দেরি করতে নেই।আমি আমার মহলের লক্ষিকে অতিদ্রুত মহলে তুলতে চাই”

উদয় নগরের সম্রাট ওয়াহাবের কথায় মাথা দুলালেন রাজকন্যার পিতা সম্রাট আব্বাস রাশীদ।কক্ষে থাকা কয়েকজন দাসীকে নির্দেশ দিলেন রাজকন্যাকে নিয়ে আসতে।আদেশ পেয়ে দাসীরা ছুটলো রাজকন্যার কাছে।

লাল টুকটুকে শাড়িতে সজ্জিত শেহজাদী আরওয়া।মাথায় ঢেকে আছে লাল ওড়না দিয়ে।পাতলা কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে মুখকমল।সবার সামনে প্রদর্শিত হচ্ছে মোহিত দুই নয়ন।তার দু’পাশে উপস্থিত দুজন দাসী।তার মাঝে একজন লতা।
শেহজাদী আরওয়া পুরো কক্ষে একবার পর্যবেক্ষণ করলেন।সম্রাট আব্বাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কড়া স্বরে বললেন,

” পিতা অনুমতি দিলে আমার কিছু কথা বলার ছিল।”

” কথা তুমি পরেও বলতে পারবে মা,আগে বিবাহ কার্য সম্পূর্ণ হোক।”

“মার্জনা করবেন পিতা আমার কথাগুলো এক্ষুনি বলতে হবে।আমি আমার ভাবী পতি’র সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”

শেহজাদী আরওয়া’র কথায় নড়েচড়ে বসলেন সম্রাট আব্বাস এবং তার বড় পুত্র ইবনুল রাশীদ।তাদের সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে শেহজাদী আরওয়া ভাবী পতি মেসবাহ’র মুখোমুখি বসলেন।

” শাহজাদা মেসবাহ আপনার সঙ্গে আমার আগেই ব্যক্তিগত ভাবে আলাপ করার কথা ছিল কিন্তু করতে পারিনি।আর আমি করতে চাইলেও সু্যোগ দেওয়া হয়নি।আমাকে আপনার স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করার কারণ কী?আশা করি এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাব।”

শেহজাদীর কড়া সুরের কথায় উপস্থিত সবাই অবাক হলেন।যদিও সকলের অজানা নয় অলকপুরীর শেহজাদী সবচেয়ে ব-র্বর এবং পা-ষাণ প্রকৃতির।তার মনে নেই কোন ভালোবাসা দয়ামায়া।অনন্য রাজ্যের শেহজাদীরা কোমল,দয়াবান,হলেও অলকপুরীর শেহজাদী তার ব্যাতিক্রম।রাজপুত্র মেসবাহ খানিকটা হাসলেন,

” আপনাকে আমার পছন্দ বছর খানেক আগে।কেন পছন্দ তা আমি নিজেও জানি না।আমার স্ত্রী হিসেবে আপনি যোগ্য এবং উত্তম বলেই আমি আপনাকে বিবাহ করতে চাই শেহজাদী আরওয়া।”

মেসবাহ’র কথায় তাচ্ছিল্য হাসলেন শেহজাদী।অবাক দৃষ্টি রেখে ব্যঙ্গ সুরে বলেন,

” তাই বুঝি?তা আগের দুই স্ত্রীকেও যোগ্য ভেবে বিবাহ করেছিলেন এরপর ভোগ করে ছুড়ে ফেলে আরেক বিবাহ করতে এসেছেন?আমাকে ভোগ করে যে চতুর্থ বিবাহ করবেন না তার নিশ্চয়তা কী?”

মেসবাহ’র বিবাহের বিষয়টি সবাই শেহজাদীর কাছে গোপন রাখলেও ভরা মজলিশে শেহজাদীর এমন কথায় ঘাবড়ে যায় সকলে।সম্রাট আব্বাসের ছোট পুত্র ইদ্রীসের কাছে বিষটি ছিল অজানা।আদরের ছোট বোনের এমন একজন ব্যক্তির সাথে বিবাহ হবে ভাবতেই মাথায় র-ক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটছে।বড় ভ্রাতার চোখের দিকে তাকিয়ে কড়া সুর বলে,

” ছিহহ আদরের বোনকে এমন একজন মানুষের হাতে কেন তুলে দিতে চাইছো তোমরা?আবার কোন স্বার্থের লোভ তোমাদের ঘিরে ধরেছে?”

” খামোশ ভুলে যাবে না আমি তোমার বড় ভাই।কথা বলতে বুঝে শুনে বলবে।বোনের জন্য ভালো পাত্র নির্বাচন করেছি আমরা।এর থেকে ভালো পাত্র ওর কপালে জুটবেও না।”

শাহজাদা ইবনুলের ধমকে চুপসে যায় ছোট শাহজাদা ইদ্রীস তবুও চোখে মুখে রাগী ভাবটা কাটলো না তার।ইতোমধ্যে মেসবাহ উত্তেজিত হয়ে পড়লো যে করে হোক এই মেয়ে তার চাই প্রয়োজনে আজ এখানে যু-দ্ধ ঘোষণা হবে কিন্তু তার আগে যে ছলেবলে কৌশলে রাজকন্যাকে মানাতে হবে।

” আমি আগে যে দুই বিবাহ সম্পূর্ণ করেছি সেই দুই স্ত্রীর সঙ্গে আপনার তুলনা হয় না শেহজাদী ওরা কোন রাজ্যর রাজকন্যা নয়।বরং অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে।তাছাড়া এখন আর আমার ওদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।”

” কেন ফুলের মধু এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেছে নাকি?তাই অন্য ফুলে এসেছেন?”

শেহজাদীর লাগামহীন কথায় মাথা নিচু করে নেয় প্রত্যকে।ঘোমটার আড়ালে খাসদাসী লতা মিটেমিটে হাসছে।

“এভাবে বলবেন না শেহজাদী আরওয়া।একবার আমার স্ত্রী হয়ে দেখুন সকল সুখ আপনার পায়ে এনে ফেলবো।”

” বেশ আমি আপনাকে বিবাহ করতে রাজি আছি।তবে আমার কাছে আপনাকে পরীক্ষা দিতে হবে।যদি আপনি পরীক্ষায় জয় লাভ করেন তবেই বিবাহ করতে আমি প্রস্তুত।

” কিসের পরীক্ষা?”

শেহজাদী ঘুরে তাকালেন খাসদাসী লতার দিকে।চোখ ইশারায় কিছু বোঝাতে লতা ছুটে গেলো কক্ষের বাইরে।তার পিছু নিলো কয়েকজন দাসী।কিছুক্ষণের মাঝে কয়েকজন দাস এলো হাতে তাদের জ্বলন্ত কয়লা অন্যজনের হাতে ভাঙ্গা কাঁচ।সবাই মিলে একটি পাটাতনে কয়লা রাখলো এবং এর উপর কাঁচের টুকরো বিছিয়ে দিল।সবাই দাস-দাসীর কাজ অবাক হয়ে দেখছে।কাজ শেষে দাস-দাসী রুম।থেকে বেরিয়ে যায়।শেহজাদী আরওয়া আবার ফিরে তাকায় মেসবাহ’র দিকে।

” আপনার পরীক্ষা হলো এই যে, কয়লার পথ দেখছেন এখানে হেটে যাবেন আবার ফিরে আসবেন।”

শেহজাদীর এমন কথায় অবাক হয় সকলে।তবে শাহজাদা ইদ্রীস হাসছিলেন থুতনিতে হাত রেখে।বোনের কর্মকান্ডে সে যেন বেশ খুশি।

” আপনি কি আমার সঙ্গে মশকরা করছেন শেহজাদী?”
” আপনার সঙ্গে আমার মশকরা করার সম্পর্ক নেই শাহজাদা।”

শেহজাদীর কান্ডে এতক্ষণ চুপ ছিলেন সম্রাট আব্বাস।এবার রাগান্বিত হলেন তিনি।

” আরওয়া তুমি এসব কি করছো?রাজপুত্রকে অপমানিত করার সাহস তোমায় কে দিয়েছে?”

” আমার জীবনের সাথে জড়িত এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হেয়ালি করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে পিতা?মার্জনা করবেন আমি এই বিবাহ করতে পারবো না যদি রাজপুত্র এই পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয় তবে আমি ভেবে দেখবো।”

” অসম্ভব আমার পুত্র কিছুতেই এই পরীক্ষা দেবে না।সম্রাট আব্বাস আপনি আমাদের অপমান করেছেন এর হিসাব আমরা নেব।”

উদয় নগরীর সম্রাট ওয়াহাব কথাটি বলে উঠে দাড়ালেন।টেনে ধরলেন রাজপুত্রের হাত।

” চলো তুমি এই বিয়ে করতে হবে না।”

” আমি এই রাজকন্যাকেই বিয়ে করবো পিতা যে করে হোক।”

” এমন বেয়াদব মেয়ে আমি মহলে তুলবো না।আর তুমি চিন্তা করো না,অলকপুরীর এমন অবস্থা করবো শেহজাদী আরওয়া নিজে থেকেই তোমাকে বিবাহ করতে চাইবে সেই দিনের অপেক্ষায় থেকো এখন চলো।”

সম্রাট ওয়াহাব এবং রাজপুত্র মেসবাহ দ্রুত চলে গেলেন রাজমহল ছেড়ে।অন্যদিকে সম্রাট আব্বাস ক্ষুব্ধ হলেন তার কন্যার উপর।

” এ তুমি কি করলে আরওয়া?এর ফল কতটা খারাপ হবে তুমি বুঝতে পারছো?”

” আরে সে বুঝবে কি?পিতা আমাদের রাজ্য বিস্তার আর হলো না এবার তো মনে হচ্ছে উলটো সর্বোনাশ আমাদের পিছু নিয়েছে।”

বড় ভাই ইবনুলের কথায় ক্রুদ্ধ হলেন শেহজাদী আরওয়া,

” শুনে রাখুন, আপনাদের স্বার্থের বলি আপনারা হোন আমি হবো কেন?আর কোনদিন যদি ভুলভাল সিধান্তে আমায় জড়ান তবে এর ফল ভালো হবে না।আপনাদের আমি সম্মান করি আশা করি সম্মানের চোখে থাকবেন।”

শেহজাদী বেরিয়ে গেলেন কক্ষ ছেড়ে তার পিছু নিলো ছোট ভাই ইদ্রীস রাশীদ।

” নূর শোন!”

ভাইয়ের ডাকে ঘুরে তাকালো শেহজাদী।শাহজাদা ইদ্রীস এগিয়ে এসে আদর স্পর্শ এঁকে দিল শেহজাদী আরওয়ার কপালে।

” উত্তম কাজ করেছো বোন।যদি আমি যানতাম মেসবাহ বিবাহিত তবে কোনদিন এই বিবাহে সম্মতি দিতাম না।”

” মাতাকে কক্ষে বন্দী করেছেন পিতা।তুমি তাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো।আমি আমার কক্ষে যাই।”

শেহজাদী নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো তার পেছন পেছন কক্ষে এলো লতা।

” শেহজাদী কি শুনলাম আমি ছিহ ছিহ ছিহ!”

” কেন কি শুনেছো তুমি?”

” রাজপুত্র মেসবাহ সারারাত বাইজিদের সঙ্গে কাটান।মদ্যপানে নিজেকে মত্ত রাখে।কখনো কখনো নিজের কক্ষে রাজ্যের সুন্দরীদের এনে শারীরিক মেলামেশা করেন।আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে দিলেন শেহজাদী।”

” হুম।”

” আপনি মন ভাঙ্গবেন না শেহজাদী।দেখবেন আপনার জন্য উত্তম কাউকে আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

খাসদাসী লতার কথা মনে ধরলো শেহজাদী আরওয়ার।হঠাৎ তার মনটা কেমন আনচান করে উঠলো উদাস চোখে তাকালেন পর্দা গলিয়ে জানলার বাইরে।চোখে মুখে ছেঁয়ে গেলো মন খারাপের আভাস।এতটাই উদাস চোখে শেহজাদী ছিলেন তার চোখের সীমানায় কেউ যে রাজমহলের পাঁচিল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো সেটা সে খেয়ালি করলেন না।কী চলছে শেহজাদী আরওয়ার মনে কে জানে!
#চলবে_____

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here