ভালোবাসি নিরালয় পর্ব -শেষ

#ভালোবাসি_নিরালায় | শেষ পর্ব |
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan

‘চাঁদে গ্রহন কখন ঘটে কেউ রাখে না খোঁজ
মনের গ্রহন ভাবায় কাদায় সকাল দুপুর রোজ’
(মেঘের দোষ)

কিছু মানুষ বিরোহে বলে নারীর নে*শা বড্ড খারাপ, সায়ান তাদের দোষ দেয়না। ওর মতে পৃথিবীতে দু ধরনের মানুষ থাকে, একদল যারা প্রচণ্ড ডেস্পারেট হয়ে মুভ অন করতে চায় আর আরেকদল যারা মুভ করতে চায়না বলে জোর করে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে থাকে। সায়ান তাদের একজন, প্রাক্তনের কথা ইচ্ছে করে ভেবে নিজেকে কষ্ট দেয়ার প্রচেষ্টায় বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজকাল ওর অতীত ওকে ভাবায় না, ফারিয়ার কথা ভেবে ওর ক*ষ্ট হয়না বরং নিজেকে প্রজাপতি ইচ্ছে হয়, নতুন ফুলের খোঁজে পথ চলতে মন সুধায়। বাস্তববাদী মানুষরা কি তবে খুব সহজেই মায়া ত্যাগ করতে পারে!?

রুশানির এখানে থাকার কিছুদিন বাদেই একদিন হুট করে সে প্রশ্ন করে বসলো

“আপনি আমায় পছন্দ করেন?”

সায়ান কয়েক সেকেন্ডের জন্য তব্দা খেয়ে বসে রইলো, থতমত খেয়ে বললো

” আমার ব্রেক আপ হয়েছে কয়েক সপ্তাহের বেশি হয়নি, গত হওয়া প্রেমিকাকে প্রাক্তন ভাববার সাহসই পাচ্ছিনা এখনো। কি করে ভাবলেন আপনার প্রেমে পড়বো আমি?”

সায়ান ভেবেছিলো ওর উত্তর শুনে রুশি কষ্ট পাবে কিংবা একটু হলেও নিরাশা প্রকাশ করবে কিন্তু রুশানি কয়েক মুহুর্ত ওকে দেখে কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলো।সেই প্রশ্ন সায়ানের মাথায় এখনো ঘুরপাক খায়, তবে কি সেদিন মিথ্যে বলেছিলো ও?

কোন এক মহান ব্যক্তি বলেছিলেন “পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর তা হয়তো দামী নাহয় অন্য কারো” সায়ানের কথাটি আংশিক সত্য মনে হলো। কেউ একজন তোমার না হওয়ার জন্য অন্যকারো হওয়ার প্রয়োজন নেই, সে প্রচুর দামী হবে তা ভাবারও কারণ নেই! কেই একজন তোমার ধরা ছোঁয়ার কাছে হলেও সে মানুষটি ঠিক তোমার নাই হতে পারে! সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে তুমি সেই মানুষটিকে নিজের করে কতোটুকু চাও? প্রশ্নের জবাব সায়ানের কাছে নেই।

রুশি নামক মেয়েটা ওর ফ্লাটে বসবাস করে দুমাস হলো অথচ তাদের দেখা হয়না বললেই চলে। কদাচিৎ চোখের সামনে এলে এক দু নজর তাকিয়ে দুজন দুদিকে চলে যায়। সায়ানের জীবনে বিশেষ কোন পরিবর্তন আসেনি, অফিস টু বাড়ি পর্যন্তই ওর জীবনের দৌড় কিন্তু রাত আটটায় বাড়ি ফিরেও রুশানির দেখা পায়না ও। মেয়েটি অদ্ভুতভাবে সবসময় তাকে দেয়া কামরায় বন্দী থাকে, সায়ানকে এভয়েড করতে নাকি স্বভাবগতভাবেই মেয়েটি এমন সায়ান জানেনা। তবে আজকাল মেয়েটিকে নিয়ে প্রায়শই ভাবে, অজান্তেই! সকালে চা বানাতে গিয়ে আনমনেই মেয়েটার ভাগের কাপ বানিয়ে রাখে, সারাদিন মেয়েটা খেলো কিনা তা নিয়ে ওর বেশ চিন্তা হয়। এই চিন্তার কারণ খুঁজে পায়না ও, এতোদিন ধরে মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখছে কেনো তাও ওর জানা নেই। অদ্ভুতভাবে রুশিকে নিয়ে কেউ ওকে প্রশ্ন করে না, ওর ফ্লাটে জলজ্যান্ত নারী বাস করে ভেবে আঁৎকে উঠে না কেউ! যেনো মেয়েটি ওর কল্পনার জগতে এক টুকরো বাস্তব!

সায়ান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বি*য়ার পান করেছিলো, প্রায়শ ওকে এখন বি*য়ার হাতে দেখা যায়। কোন এক অদ্ভুত কারণে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে গত দুমাসে, মাথা হাল্কা আঁটসাঁট না হলে চোখ জুড়ে ঘুম আসেনা। এটা ইনসমনিয়া নাকি অভারথিংকিং এর পরিণতি ওর জানা নেই, তবে কিছু বদভ্যাস প্রশান্তি বয়ে আনলে ক্ষ*তি কি? সায়ান আকাশের চাঁদের দিকে নিজের বন্ধুর কথা ভাবলো। আজ সকালেই রাতুলের সাথে দেখা হয়েছিলো ওর, বাল্যকালের বন্ধু ভেবে অকপটে মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলো শেয়ার করে বসলো কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। সায়ান কতোটা ভুল আর তার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো কতোটা নির্জীব তা নিয়ে ঘন্টাখানেকের লেকচার শুনে বাড়ি ফিরলো, মাঝে মাঝে হয়তো কি করতে হবে লাইফে কিংবা আমরা কতোটা ভুল সেটা আমাদের শুনতে ইচ্ছে হয়না বরং কেউ কাঁধে হাত রেখে বলবে ‘যাইহোক না কেনো আমি আছি তোর পাশে’ এমন একটা মানুষের খুব প্রয়োজন হয় আমাদের!

মাথা কিছুটা হাল্কা হতে সায়ান বেশ রা*গ হলো, আকার ইঙ্গিতে রাতুল ওর চরিত্র নিয়েয়ে হেয় বাক্য বলেছিলো তা বুঝতে সমস্যা হয়নি। তখন কথাগুলো ওতো বেশি গায়ে মাখানোর মতো না মনে হলেও যতো বেশি ভাবছে সায়ানের ততোই রাগ ঝমছে। ক্রোধের বশে বাচ্চামো করে বসলো কিছুটা, হাতের বি*য়ারের বোতল বেশ শব্দ করে ফেলে ঘরে গিয়ে বসলো।
শয়নকক্ষে সব অগোছালো অবস্থায় পড়ে আছে, বিছানার চাদর মুষ্টিবদ্ধ করে দূরে ছুড়ে মারলো সায়ান।বিছানার চাদর ফেলে দেয়ার পরও রা*গ না কমায় বালিশগুলোও নিচে ছুঁড়ে মা*রলো! মনে হলো রাতুলের তো অধিকার নেই ওকে এভাবে তুচ্ছ করার, মাথার চুলগুলো শক্তকরে চেপে ধরে খাঁটের ঠিক মাঝখানটায় বসে রইলো। সামনে নারীমূর্তির ছায়া দেখে চোখ তুলে তাকালো, রুশানি তখন ঘরের অবস্থা দেখতে ব্যস্ত। সায়ান অভিযোগ করে বললো

“রাতুল আমাকে বলেছে আমি ডি*প্রেশনে আছি, ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আর ভুলভাল বকছি। ও আমাকে এমন কথা কি করে বললো? কতোটা ভাবনার পর আমি কথাগুলো বলেছি ও জানে?”

রুশিকে কিছু না বলতে দেখে সায়ান বললো

“মানুষ অদ্ভুতভাবে ভূল বুঝে আমাকে, আমি সবটা উজাড় করে কাছে টেনে চাইলেও দিনশেষে আমি এখানে, একা ফ্লাটে নিজের ভাবনায় মশগুল! এই তোমাকেই দেখো, দুমাসের ফ্লাটমেট আমরা অথচ তোমার নাম ব্যতীত তুমি আমার কাছে অচেনা বস্তু। তুমি থেকেও কেমন যেনো কেনো নেই আমার কাছে? এই থাকার চেয়ে না থাকাই কি ভালো ছিলো না?”

রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো এক পলকে, সায়ান ঠোঁট নাড়িয়ে অনেক কিছু বললেও তা আর কানে নিলো না। হঠাৎ মনে হলো এই মানুষটিকে দেখার অধিকার নেই ওর, ভাবতেই মাথানিচু করে ফেললো, চোখজুড়ে তার অসীম মায়া ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠা সামনের এই মানুষটির জন্য। মনে হলো হাত বাড়ালেই তো তাকে ছোঁয়া যায়, তার গালে হাত রেখে, মাথায় হাত বুলিয়ে তার সকল অস্থিরতা কাটানো যায়। কিন্তু তা সে করবে না, এই দুরত্ব যে খুব প্রয়োজন! এই বেলাকে পিছু ফেলে নতুনত্বে গা ভাসানোর…

রুশানির সেই কঠোর সিদ্ধান্তে সায়ানের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এলো, হুট করে পরদিন সকালে সায়ান বুঝতে পারলো সায়ান তার ফ্লাটে একা। এতোদিন যদিও একাই ছিলো তবুও মনে হতো ও ছাড়াও কেউ একজন থাকে এখানে, ও এই নির্জীব ফ্লাটে একা নয়।এরপর শুরু হলো রুশানি নামক মেয়েটাকে খুঁজে বের করার প্রয়াস কিন্তু ও সফল হয়নি। যেভাবে ঝড়ের মতো মেয়েটি এসেছিলো তত দ্রুততার সাথেই মিলিয়ে গিয়েছিলো। একাকীত্ব সায়ানকে এতোটাই গ্রাস করেছিলো যে শেষমেশ সেই ফ্লাট ছেড়ে দিতে হয়েছিলো, সেই ফ্লাটে দম*বন্ধ হয়ে আসার অনুভুতি কষ্ট*সাধ্য হয়ে পড়েছিলো!

সেই ঘটনার এক বছর হতে চললো, সায়ান এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে। মাঝেমাঝে চায়ের কাপে রুশানিকে মনে পড়ে, মেয়েটা কি নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলো? প্রায়শই মনে সেই সময়টুকু ওর প্রচণ্ড জ্বরে আবোলতাবোল বকার মতো কল্পনা তবে সেই সময়টুকু সুন্দর ছিলো!
সায়ানের মা বিয়ের জন্য ইদানীং বেশ পিড়া দেয় কিন্তু সায়ান তা করতে নারাজ। কে জানতো প্রাক্তনের বিরোহ থেকেও একজন অপরিচিতা ওকে বেশি পোড়াবে?
এক পড়ন্ত বিকেলে সায়ান অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলো, টিপিক্যাল রবিবার বলা চলে। তখনই কেরানি ভদ্রলোক এসে বললেন ওর সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে, কিছু অবাক হলেও প্রশ্ন না করে তাকে অফিসের বাইরে অপেক্ষা করতে বললো। হেড কোয়ার্টার থেকে আধঘণ্টার বিরতি বাইরে এসেই থমকে গেলো, গভীর কল্পনায় মোড়ানো একমুঠো বাস্তবতা ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে।হাল্কা রোদে চোখ ছোট হয়ে এলেও সায়ানের চিনতে অসুবিধা হয়নি। সায়ান মিনিট পাঁচেক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়েও রইলো সামনে, রুশানি ওর অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো তারপর সাবলিলভাবে বললো

“আপনি কি বিবাহিত?”

সায়ান ধ্যান থেকে বেরিয়ে আশপাশ তাকালো তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো

” নির্ভর করে আপনি কি চান আমার থেকে”

রুশি সেই দিকে মনোযোগ না দিয়ে বললো

“গার্লফ্রেন্ড আছে? নাকি এখনো এক্সকে নিয়ে ভাবনায় কাতর?”

সায়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো

“জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না, অতীত নিয়ে যতো কম ভাবা যায় বিষয়টা ততোই প্রশান্তির!”

রুশানি মাথা নেড়ে বললো

“এক কাপ কফি খাওয়ার সময় হবে?”

সায়ান মুচকি হেসে বললো

“আপনি কি আমাকে ডেটে ডাকছেন মিস রুশানি?”

রুশি ভ্রু নাচিয়ে বললো

“হয়তো?”

সায়ান পকেটে হাত রেখে একটু ঝুঁকে বললো

“আপনি যাওয়ার এক বছর হতে চললো, সময়ের সাথে কতো কিছু বদলে যায়। আমার ক্ষেত্রেও তো তাই হতে পারতো, হয়তো রিলেশনশিপে থাকতাম কিংবা অলরেডি বিবাহিত?আপনি কি অনেকটা দেরি করব ফেলেননি?”

রুশি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো

“আমি বাংলাদেশে কোন প্রত্যাশা নিয়ে আসিনি, শুধু জলের গভীরতা দেখতে এসেছি। আপনি কোন সম্পর্কে থাকলে আমি এখানে এক মুহুর্তও থাকতাম না, কিন্তু আপনি নেই জেনে বলতে পারেন খুশিই হয়েছি। এখানে আসার পুর্বে আপুকে বলেছি গুরুত্বপূর্ণ একজনের কাছে ফিরে যাচ্ছি, সব ঠিক থাকলে হয়তো আর ইতালিতে ফিরবো না। বলতে পারেন সেই ইচ্ছে নিয়ে এখন বড্ড আশাবাদী আমি!”

সায়ান নিশ্চুপে রুশি দেখলো, গত এক বছরের অস্থিরতা যেনো এক নিমিষে বিলীন হয়ে গেলো। সায়ান চুল পিছনে সরাতে সরাতে ভাবুক হয়ে বললো

“লেট মি গেস! এখন আপনি আমাকে অফিস ডিস দিতে বলবেন? তারপর রোমান্টিক কাপলদের মতো আমার হাত ধরবেন আর বলবেন আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন আর আমাকে বিয়ে করতে চান!”

রুশি চোখ ঘুরিয়ে মুখ বাঁকাল তারপর নিশ্চুপে হাঁটা শুরু করলো, কিছুটা পথ যেতেই কেউ একজন ওর ডান হাত শক্ত করে ধরতেই ও মুচকি হাসলো, বাঁ হাত দিয়ে সেই ও আরো শক্ত করে ধরে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।
সায়ানের মনে অনেক প্রশ্ন, কেনো রুশি সেদিন চলে গিয়েছিলো। এতোদিন কোথায় ছিলো, বাসায় ফিরে যাওয়াতে কি হয়েছিলো। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেলো ওর কৌতুহলী মনে কিন্তু এই মুহুর্তে মনে হলো সকল প্রশ্ন থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এই যে রুশানি ওর পাশে আছে, হাতে হাত রেখে তাল মিলিয়ে হেঁটে চলছে ওরা। কে জানে হয়তো এভাবে বাকিটা জীবন কা*টিয়ে দিলেও মন্দ হবে না…

~~(সমাপ্ত)~~

(ছোট্ট গল্পটির সমাপ্তি এখানেই, বাকিটা আপনাদের কল্পনার জন্য রইলো। সবাই ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ💜)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here