ভালোবাসি নিরালায় পর্ব -০১

“আমরা কি পালিয়ে বিয়ে করতে পারিনা সায়ান?”

কান্নায় কথাগুলো জড়িয়ে গেলো ফারিয়ার, গড়িয়ে পড়া চোখের জল গাল বেয়ে পড়লেও তা না মুছেই সায়ানকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললো

“আর দুঘণ্টা পর আমার বিয়ে, এখনো সময় আছে! তুমি আমাকে এসে নিয়ে যাও প্লিজ”

সায়ান মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনলো। নিজের ভালোবাসার মানুষকে লাল বেনারসিতে দেখতে চাওয়াটা প্রত্যেক ছেলের স্বপ্ন থাকে কিন্তু সেই স্বপ্নই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। যে মানুষটাকে নিয়ে ও ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলো আজ যে তার বিয়ে, কোন অন্য পুরুষের সাথে। ভিডিও কলের ওপাশে ফারিয়া অঝোর ধারায় কান্না করছে আর সায়ান এপাশে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে। হাল্কা কাশি দিয়ে বললো

“বিয়ের সাজে সুন্দর লাগছে তোমায়”

ফারিয়ার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো, হিচকি নিতে নিতে বললো

“আমরা কি সত্যিই বিয়ে করতে পারিনা সায়ান? এভাবে আমাদের সম্পর্কের উপর গিভ আপ করে দিবে তুমি?”

সায়ান কিছু বললো না, দুবছরের সম্পর্কে ফারিয়াকে কখনো এতোটা ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি। সর্বদা উচ্ছল মেয়েটা কেমন নুইয়ে আছে ভালোবাসা হারানোর ভয়ে, সায়ান পা*ষাণহৃদয় নিয়ে তাকিয়েই রইলো। ফারিয়া আবারো ব্যস্ত হয়ে বললো

“প্লিজ চলোনা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি! একবার বিয়ে হয়ে গেলে বাবা ঠিক মেনে নিবে। এখন বিয়েটা হওয়ার পরেই তারা আমাকে ফ্রান্সে নিয়ে যাবে, তোমায় কি আমি আর কখনোই দেখতে পারবো না সায়ান। আমি তো ভাবতেই পারছিনা বিষয়টা, তুমি কিভাবে এতো চুপ করে আছো?”

সায়ান ধীর কন্ঠে বললো

“পালিয়ে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমাদের পুর্বেও এই নিয়ে কথা হয়েছিলো। এটাই আমাদের শেষ কথা, কয়েকমাস পর হয়তো তুমি নিজেই আর আমার কথা ভাবতে চাইবে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, মানুষ একটা সময় মুভ অন করে ফেলে। তুমিও নতুন জীবনে ভালো থাকবে।”

ফারিয়া ওর দিকে চোখ তুলে তাকালো, সেই তাকানোতে বুঝালো অনেক কথা বলার আছে তার কিন্তু অভিমানে একটি শব্দও করলো না। দরজার কাছ থেকে ওর ছোট বোন যখন বললো ‘মা আসছে’ ঠিক তখনই ফারিয়া কলটি কে*টে দিলো, শেষবারের মতো সায়ানের দিকে ফিরেও তাকালো না। হয়তো অভিমানে অথবা ব্যর্থতায়…

সায়ান হাতে থাকা ফোন পকেটে পুরে মাঠের ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো। গত দুবছরের সকল স্মৃতি মাথায় এসে জড়োশড় হলো, ওদের কতো ভালো মুহুর্ত ছিলো, সকালে অফিস আছে জেনেও রাত জেগে কথা বলার বদঅভ্যেস। ফারিয়া ওকে দামী দামী গিফট দিতো কিন্তু ওর সেভাবে ফারিয়াকে কিছু দেয়া হয়নি। কয়েকটা কমদামী শাড়ি, কিছু চুড়ি কিনে দিতেই মেয়েটার খুশি আকাশচুম্বী হতো। ফারিয়ার বড়োলোক বাবা ওদের সম্পর্ক কখনোই মেনে নিবে না জেনেও ও সম্পর্ক ছিলো এতোকাল, হয়তো আশায় যে মেয়ের খুশি কোন বাবা না চায় কিন্তু জীবন তো সিনেমা নয় যে চৌধুরী সাহেবকে ভালোবাসার গুন পড়ালেই তিনি রাজি হয়ে যাবেন। বাস্তবতা বড্ড কঠিন সত্য, পরিণতি জেনেও সায়ান স্রোতের জোয়ারে গা ভাসিয়েছিলো। হঠাৎ স্রোত থেমে যাওয়াতে জলের গভীরতায় ত*লিয়ে যেতে দেখলো নিজেকে!

——————-

একটা সুন্দর গুছানো সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে মানুষ কি করে?সায়ান নিজেকে প্রশ্ন করলো। সি*গারেট খায়? ম*দ খেয়ে মাতাল হয়ে কোথাও একটা পড়ে থাকে? কয়েকমাস নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে? ডিপ্রে*শনের বাহানায় পুরো ঘর অগোছালো করে রাখে? কিন্তু সায়ান তার কিছুই করলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে কল দিলো। ওপাশ থেকে মায়ের উচ্ছাসিত কন্ঠ শুনে স্বস্তি পেলো, ওপাশ থেকে মা খুশি মনে বললো

“আজ হাসের মাংস রান্না করেছি বাবা, তুই থাকলে কতোই না ভালো হতো। তোর খালা আসবে কাল, তার জন্যও কিছু মাংস তুলে রেখেছি। পরের বাড়ি এলে আগে থেকেই বলবি, তোর জন্যও রান্না করবো”

সায়ান মায়ের মুখে পাড়াপড়শির কথা শুনলো, নিজের ভাই বোনের কথা শুনলো। কখন চল্লিশ মিনিট কেটে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি। কল কেটে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো, এতোক্ষনে ফারিয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। তাতে ওর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? হয়তো না। ম্যাচিউর হওয়ার হয়তো এটাই সমস্যা, মানুষ সবকিছু সহজে মেনে নেয়। খুব বেশি ক*ষ্ট না হলেও কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে নিজেকে, দোকান থেকে তিনটে বি*য়ার কিনে একটা খেতে খেতে বাড়ি ফিরলো। দুবছরের সম্পর্কে এতোটুকু ক*ষ্ট পাওয়া সমীচীন নাহয় প্রাক্তনের প্রতি সম্মান রইলো কই?

প্রাক্তন, ফারিয়াকে প্রাক্তন ভাবতেই হাসি পেলো ওর। সম্পর্ক কতো সহজে বদলায়! ওর মতো লু*জারকে ছেড়ে দিয়ে ফারিয়া ভালো থাকবে, বহুবছর পর হয়তো ওদের আবার দেখা হবে তখন ফারিয়া নামের মেয়েটি ওকে ধন্যবাদ দিবে আজকের এই সিদ্ধান্তের জন্য, তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। বিয়ের পর সে ফ্রান্সে থাকবে, তার সুখী পরিবার হবে, ওর মতো লু*জার যার কিনা তাকে কক্সবাজার ঘুরিয়ে নিয়ে আসারও সামর্থ্য নেই তাকে কি আর মনে রাখবে?

দুটো বি*য়ার শেষ করতেই নিজেকে হাল্কা হাল্কা মনে হলো, চারদিকটা হাল্কা ঝাপসা হয়ে এলো। গালে হাত দিয়ে দেখলো ও কাঁদছে, চোখ মুছতে মুছতে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো ও।

‘আমি আর কখনোই বিয়ে করবো না’

কথাটা মাথায় আসতেই ও জোরে হেসে উঠলো, আইডিয়া খারাপ না। হৃদয় ভাঙ্গার কষ্টে বিয়ে না করে তো থাকাই যায়!নিজের সিদ্ধান্তকে নিজেই হেসে উড়িয়ে দিলো একপ্রকার। তৃতীয় বি*য়ার অর্ধেক শেষ হতেই চোখ জুড়ে ঘুম চেপে এলো, খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুইয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো।

কিন্তু বলা হয় না হৃদয়ে শান্তি না থাকলে সবকিছুই যেনো খারাপ যায়, সায়ানের সাথেও তাই হলো। মাঝরাতে মৃদু কান্না আর নাক টানার শব্দে ঘুম ভে*ঙ্গে গেলো ওর, ঝাপসা চোখে তাকাতেই লালশাড়ি পড়া এক নারীকে দেখলো, দূরে দাঁড়িয়ে আছে স্থীর হয়ে কিন্তু কান্নার কারণে মৃদু শরীর কাঁপছে। সায়ান আঙুল দিয়ে ইশারা করলে বললো

“তুমি আমাকে বিদায় জানাতে এসেছো ফারিয়া? আমি তোমার শো*কে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমি খুশি হয়েছো?”

সেই নারীমূর্তি দু কদম সামনে এলেও তিনকদম পিছিয়ে নিলো। অভিমানী কন্ঠে বললো

“আমি ফারিয়া না”

সায়ান চট করে শোয়া থেকে বসে পড়লো, চোখ ডলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। ভালো করে ঠাওর করতে না পারলেও সামনের মেয়েটা যে ফারিয়া না তা ঠিকই বুঝতে পারলো। ভুলভাল দেখছে ভেবে মাথা কয়েকবার ঝাঁকাল, নাহ ঠিকই দেখছে। লাল শাড়ি পরা একটি মেয়ে অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি নিজের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ পেয়ে চোখ মুছে বললো,

“ঘরে নিজের বউ ফেলে অন্য নারীর নাম কেনো মুখে নিচ্ছো বারবার? আমাকে কি তোমার আর এখন ভালো লাগে না?”

মেয়েটির কথা শুনে সায়ান আবারো হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো, মাথা তুলে মেয়েটিকে একই স্থানে দেখে মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললো,ও সত্যিই বি*য়ার খেয়ে ভুলভাল দেখছে। একটা ভালো ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।নিজের ভাবনায় মশগুল থাকা সায়ান খেয়ালই করলো না কখন সামনে থাকা মেয়েটি চুপিচুপি এসে ওর পাশে বসলো!

🌸🌸🌸

চকবাজারে তখন সকাল ছটা বাজে, কিছু মানুষ মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে স্বাস্থ্য ধরে রাখতে। কেউ আবার অফিসে যাওয়ার জন্য ছুটছে। ইনান দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের পাশ দিয়ে ঘুরবে ঠিক তখনই কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলো, নিজের গতি থামিয়ে পিছু ফিরে দেখলো একটা পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা নিচে পড়ে কান্না করছে। ইনান অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছে না, এদিকে প্রায় কিছু মানুষ এসে জড়ো হয়ে যেতেই ইনান বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো। সামান্য ধা*ক্কায় বাচ্চাটির বেশি ক্ষ*তি না হলেও কেঁদে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে সে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বাচ্চাটি ওকে ঝাপটে ধরে রাখতেই ভীড় ঠেলে একজন বোরখা পরা মহিলা আসলেন এগিয়ে। চিৎ*কার করে বলতে লাগলেন

“আম্নে আমার পোলার লগে কি করসেন? কই নিয়া যান ওরে? একে তো ফালাইয়া অর আড্ডিগুড্ডি ভা*ইঙ্গা লাইসেন তার উফর আবার কিড*নাপ কইত্তে আসেন অরে?”

বাচ্চাটি আরো জোরে কা*ন্না করতেই ভয় পেয়ে গেলো ও, পাবলিক বেশ চ*টে গেলো ওর উপর। কয়েকজন কলার চে*পে ধরতেই সামনের মহিলা ব্যস্ত হয়ে বললো

“থাইক ওনারে মার*নের দরকার নাই, আমরাই যাইতাসিগা। এই দেশে গরীব মাইনশের ভাত আসে নাহি?”

নিজের বাচ্চাকে হাতে নিয়ে মহিলা ভীড়ে মিলিয়ে গেলো আর লোকজন ওকে কিছুটা শাঁ*সিয়ে চলে গেলো যে যার পথে। ইনান দীর্ঘনিঃশ্বা*স ফেলে সামনে হেঁটে চায়ের দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসলো, সামান্য সাহায্য করতে চাওয়াতে এতো কিছু হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। দুনিয়ায় ভালো মানুষের আসলেই ভাত নেই!

টিশার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে এক কাপ চা অর্ডার দিলো, বিস্কুট দিয়ে খেতে খেতে দেখলো ঘড়ির কাঁ*টা সাতটা ছুঁই ছুঁই। ও উঠে ওয়ালেট বের করতে গিয়ে বুঝতে পারলো পকেট ফাঁ*কা, চোখ বড় বড় করে পুর্বের স্থানে তাকালো।
তবে কি সবকিছু সাজানো ছিলো? এইটুকুন বাচ্চা ওর টাকা পয়সা ছিন*তাই করে নিয়ে গেলো? বাচ্চা নাহয় ছোট কিন্তু মা এসব কাজে সাহায্য করছে?সাংঘা*তিক তো বিষয়টা!

ও চা ওয়ালা মামার দিকে কাছুমাছু হয়ে তাকিয়ে বললো

“মামা ওয়ালেট আনতে ভুলে গিয়েছি, তোমার বিকাশ নাম্বার দাও আমি টাকা পাঠিয়ে দেই।”

চায়ের বিল পরিশোধ করতে করতে ভাবলো মহিলাটি কাজ করে খেলেই তো পারে, চু*রি করার কি দরকার? আরেকবার এই মা-ছেলের জুটিকে পেলে ঠিক পুলি*শে ধরিয়ে দিবে, এসব লোকদের একদম ছাড় দিতে নেই।

#ভালোবাসি_নিরালায় |১|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan

(বিঃদ্রঃ এই গল্পে সায়ানের চরিত্র অভারথিংকার টাইপের, সবকিছু নিয়ে বেশি ভাবে আর নিজের মাথায় সবকিছুর পরিণতি নির্ধারণ করে ফেলে যা বাস্তবে নাও হতে পারে। তাই হয়তো জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিবে। গল্পটি ম্যাচিউর ধরনের, আমি আমার যথেষ্ট গুছিয়ে লিখার চেষ্টা করবো।অনেক দিন পর লিখার চেষ্টা করছি আবার, আশা করি পাশে থাকবেন আপনারা। উৎসাহ পেলে পরের পর্ব লিখবো ইনশাআল্লাহ 💜)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here