বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব -০৯

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী

আফরোজা নাজনীন ভেতর বাড়িতে আসলে কুহু জানায় তাহমিদ ফোন দিয়েছিল। আফরোজা নাজনীন ঘরে এস ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন আননোন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল । আফরোজা নাজনীন কল ব্যাক করলেন৷
” আসসালামু আলাইকুম বড়মা। বাবার বাড়িতে যেয়ে আমাকে ভুলে গেছ। ফোন করেও তোমাকে পাওয়া যায়না। ” মন খারাপের ভান ধরে তাহমিদ।
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি কাউকেই ভুলিনি বাপ। একটু ব্যস্ত ছিলাম। ফোন সাথে ছিলনা তাই রিসিভ করতে পারিনি। নাস্তা করেছিস? তুই কখন বেরোবি? মনযোগ দিয়ে পরিক্ষা দিবি। পরিক্ষার পর আমাকে ফোন করে জানাবি কেমন হয়েছে। ” একনাগারে কথাগুলো বলে থামলেন আফরোজা নাজনীন।
” আমি রাস্তায় আছি বড়মা। মা খাইয়ে দিয়েছে। তুমি চিন্তা করোনা। বেশি করে দোয়া করো। পরিক্ষা শেষ করে বেরিয়েই তোমাকে জানাব। ”
” সাবধানে থাকবি বাপ। একদম টেনশন করবিনা। ”
আরও কিছু উপদেশ দিয়ে ফোন রাখেন আফরোজা নাজনীন।

সকালে খাবার পর আফরোজা নাজনীন দুই বোনকে নিয়ে শিউলি আক্তারকে কাজে সাহায্য করছেন। কায়েস বাজার থেকে খাসির মাংস, বড় তিনটা কাতলা মাছ, গলদা চিংড়ি কিনে পাঠিয়েছে। ওরা সবাই মিলে সেগুলোই কাটছে। একে একে সব কেটে, বেছে রান্নাঘরে নিয়ে যায়। কয়েক পদ রান্না হবে আজকে।
ছেলে-মেয়েরা এদিক-সেদিক ঘুরছে। কিন্তু কুহুর মন পরে আছে বাড়িতে ফুপুদের কাছে। তাই।মাইশাকে বলে ও বাড়িতে চলে আসে। উঠানে পা রেখেই বুঝতে পারল ফুপুরা রান্নাঘরে আছেন। কুহু এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায়।
” কি রে কুহুতান, তুই একা কেন? আরগুলো কই? ” নাজমা পারভিন মাছ ভাজতে ভাজতে কুহুকে জিজ্ঞেস করলেন।
” ওরা সবাই মাঠে আছে। আমার ভালো লাগছিলনা তাই চলে আসলাম। ” কুহু একটা পিড়িতে বসে জবাব দেয়।
আরেকটা চুলায় আফরোজা নাজনীন মাংস কষাচ্ছেন। শিউলি আক্তার তাদের পাশে বসে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।
শাহনাজ সুলতানা বসে বসে তাদের কাজ দেখছে। কুহু ছোট ফুপুর পাশে বসে তাদের কাজকর্ম দেখতে থাকে।
” কুহুতান, তুই তো বললিনা তোর গালে কি হয়েছে? এভাবে ফুলে, কালচে হয়েছে কেন গালগুলো? ” নাজমা পারভিনের প্রশ্ন শুনে শিউলির মুখ শুকিয়ে যায়। যদি কুহু সত্যি বলে দেয় তবে ওকে ননদরা আস্ত রাখবেনা।
” এ্যালার্জির জন্য এমন হয়েছে ফুপু। তুমি তো জানোই আমার এ্যালার্জি আছে। ” আমতা আমতা করে জবাব দেয় ফুপু।
” এ্যালার্জি থাকলে কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে ভালোই ধারনা আছে আমার। তাই আমি চাইবনা আমার সাথে তুই মিথ্যা বলিস। সে হিসেবে এখন ধরে নিলাম তুই মিথ্যা বলছিসনা। কিন্তু পরে যদি এই মিথ্যার আড়ালের সত্য আমার কানে আসে তবে আমি যে কি করতে পারি সেটা ভুলে যাসনা। ” নাজমা পারভিনের হু’ম’কি শুনে কুহু মাথা নিচু করে থাকে।
আর শিউলিতো রীতিমত ঘামছে। তবে কি ওর ননদেরা জানতে পেরেছে!
একে একে রান্না শেষ করে ওরা গোসল সেরে নেয়। ছেলে-মেয়েরাও গোসল সেরে বারান্দায় বিছানো মাদুরে গিয়ে বসে। আজ সবকিছু রান্না করে সেগুলো নিজ তত্বাবধানে রেখেছেন নাজমা পারভিন। কারন তিনি গতরাতেই বুঝেছেন শিউলি মাংসের তরকারি সরিয়ে রেখেছিল। তাই আজ তিনি শিউলিকে সেই সুযোগ দেননি। নিজের হাতে সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছেন।
নাজমা পারভিন নিজ হাতে সবাইকে খেতে দেন। সুন্দরমত একে একে মাছ, মাংস দিয়ে খাওয়ান। তবে ওদেরকে খেতে দেয়ার আগে কায়েসের জন্য সব আইটেম তুলে রেখেছেন।
আফরোজা নাজনীন কুহুকে নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন। তা দেখে শিউলি ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।

তাহমিদ পরিক্ষা শেষ করে বাসায় এসেছে। খুবই ভালো হয়েছে ওর পরিক্ষা। রুমে ঢুকেই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরে। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে বড়মার নম্বরে সংযোগ করে। মনে মনে চাইছে সকালের এবারও কুহু রিসিভ করুক। কিন্তু ওর মন খারাপ করে দিয়ে আফরোজা নাজনীন কথা বলেন। তাহমিদ জানায় ওর পরিক্ষা খুব ভালো হয়েছে। এতে ওর বড়মা খুব খুশি হন। তাহমিদ ক্ষুধার্ত থাকায় বেশিক্ষণ কথা বলা হয়না। ফোন রেখে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে খেতে। খাওয়া শেষ করে রুমে এসে একটা লম্বা ঘুম দেয়। একঘুমে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। তাহমিদ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। এরপর উঠে ফ্রেশ হয়ে সোজা ছাদে আসে। আজও সেই হাসনাহেনা গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। তাহমিদ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে যায় গাছের দিকে। আঙ্গুল দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয় ফুলগুলো। আজকাল এই ফুলগুলোর মাঝেই কুহুকে খুঁজে পায় তাহমিদ। শুধু কুহু এই গাছটা লাগিয়েছে বলেই এক অজানা আকর্ষনে বারবার ছুটে আসে ছাদের এই গাছের নিকট। যে মেয়েকে একটা সময় বিরক্ত লাগতো অথচ আজ সেই মেয়েকে নিয়েই ভাবতে ভিষণ ভালো লাগে। সেই ভীরু চাহনি, অকারণেই ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, লম্বা চুলের বেনী এমনকি তার সবকিছুই এখন মনে পরলে তাহমিদের বুকে শিহরণ জাগায়। এগুলো কি প্রেমে পরার লক্ষণ? তাহমিদ মনে মনে ভাবে, তবে কি ও প্রেমে পরেছে! এভাবেও কি প্রেম হয়! না-কি কুহুর সাথে হওয়া অ’ত্যা’চা’রে’র কথা শুনে ওর প্রতি সহানুভূতি জন্মেছে? কিন্তু যদি এটা শুধু সহানুভূতিই হবে, তবে কেন তাকে নিয়ে ভাবতে এত ভালো লাগে? কিংবা তাকে দেখার জন্য, তার গলার আওয়াজ শোনার জন্য মনটা এত আকুলিবিকুলি করে? আজ সকালেই যেমন ওর গলার আওয়াজ পেয়ে তাহমিদের ধরনী আনন্দে দুলে উঠেছিল। পিপাসায় ওর বুক শুকিয়ে গিয়েছিল যেন সাতসমুদ্রের পানিতেও সেই পিপাসা মিটবেনা। এগুলোও কি সহানুভূতি? তাহমিদ ধপ করে বসে পরে ছাদে। নিজের সাথে কঠিন বোঝাপড়া করা প্রয়োজন। ওর প্রথমে বুঝতে হবে কুহুর প্রতি ওর আকর্ষনটা কিসের। সহানুভূতি নাকি প্রেম।

তাহমিনা আক্তার ছেলের রুমে এসে ওকে না দেখতে পেয়ে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে ও পাননা। একসময় ছাদে এসে দেখলেন তার ছেলে ছাদে টানটান হয়ে শুয়ে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দু-হাত বালিশের ন্যায় মাথার নিচে দিয়ে রেখেছে। ছেলেকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে প্রায় ছুটে আসেন তিনি৷
” তাহমিদ, তোর কি হয়েছে বাবা? এখানে, এভাবে শুয়ে আছিস কেন? তুই উঠতো বাবা, আমার সাথে নিচে চল। ” তাহমিনা আক্তারের গলায় উদ্বেগ।
মায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকায় তাহমিদ।
মায়ের হাত ধরে টান দিয়ে তাকেও নিচে বসায়। তাহমিনা আক্তার বসলে তার কোলে মাথা রাখে তাহমিদ৷
” একটা প্রশ্ন করি, উত্তর দিবে মা? ”
” মাকে প্রশ্ন করবি তাতে জিজ্ঞেস করার কি হলো পাগল ছেলে। ”
মায়ের সম্মতি পেয়ে মুচকি হাসে তাহমিদ৷
” আচ্ছা মা, সহানুভূতি আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য কি? ”
ছেলের আচমকা এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যান তাহমিনা আক্তার। ছেলেকে দেয়ার জন্য যুৎসই উত্তর খুঁজতে থাকেন। তাহমিদও মাকে গুছিয়ে নেয়ার সময় দিয়ে নীলচে তারা দেখতে থাকে।
প্রায় অনেকক্ষণ পর মুখ খোলেন তাহমিনা আক্তার।
” ভালোবাসা আর সহানুভূতি দুজনের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মালে তার সবকিছুই বড্ড আপন লাগে। তার ছোট ছোট দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও তাকে জয় করতে জীবন বাজি রাখতেও দুবার ভাবতে হয়না। তার হাসি, তার কথা বলা, তার প্রতিটা খুটিনাটি বিষয়ও ভাবতে ভালো লাগে। তাকে প্রতিক্ষণেই দেখতে ইচ্ছে করে, তাকে আলতোকরে ছোঁয়ার সাধ জাগে। তার গলার আওয়াজ শুনলে বুকে হাঁসফাঁস করে। সে সর্বক্ষণ বাস করে বুকের ঘরে। যে জায়গাটা একান্তই তার। সেখানে আর কারো অস্তিত্ব থাকবেনা। যে রাজত্বে একমাত্র সেই রানী।
আর সহানুভূতি হলো কেউ দুঃখী বা কষ্টে আছে তা জানার পর তার বিপদেআপদে ঝাঁপিয়ে পড়া। তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। তার উন্নতির পথে নিজেকে সামিল করা।
তবে মনে রাখিস যার প্রতি তোর সহানুভূতি জন্মাবে তাকে সারাজীবন বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসবি, জীবন সঙ্গী হিসেবে নয়।
আর যেখানে ভালোবাসা জন্মায় সেখানে সহানুভূতির কোন স্থান থাকেনা। ভালোবাসা এবং একমাত্র ভালোবাসা দিয়েই তাকে জয় করতে হয়। সহানুভূতি ভালোবাসার ভেতর ঢুকে পরলে সেটাকে ভালোবাসা বলেনা সেটা স্রেফ দ্বায়িত্বে রুপান্তরিত হয়। ”
তাহমিদ মায়ের ব্যাখ্যা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে।
” থ্যাঙ্কস মা। আমার সকল সংশয় দূর হল ”
” আমি বাবা তোদের মত এত গাদাগাদা বই পড়িনি তাই তোদের মত এত ভাবুক কথাও জানিনা। তোর প্রশ্ন শুনে মনে যা আসল তাই বলে দিলাম। ”
” তুমি যা বলেছ তাতেই আমার সকল সংশয়ের দ্বার খুলে গেছে। এখন নিচে চল আমার ক্ষুধা লেগেছে। ” তাহমিনা আক্তারকে কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিচে নিয়ে আসে তাহমিদ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here