বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব -১০

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। রুহানীর কলেজে ভর্তি কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। এইতো রবিবার থেকেই ক্লাস শুরু করবে। আজ শুক্রবার। রহমত শেখ গতকালকেই ঢাকা গিয়েছেন। আরও আগে যাওয়ার কথা থাকলেও রিহার শ্বশুরবাড়িতে একটা ছোটো রিসেপশন পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট ছিল এবং যার পরেরদিনই রিহা তার স্বামীর সাথে লন্ডনে চলে যাবে। পার্টিটা ঝামেলাহীন ভাবেই কে*টে গেছে।

রুহানী ড্রাইভারকে বইয়ের লিস্ট দেখে বই কিনতে দিয়ে এখন বাগানের পেছন দিকটায় হাঁটতে গিয়েছে। সকাল এগারোটা বাজে। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। তপ্ত গরমে নাভিশ্বাস উঠার দশা। রুহানী যেখানে গিয়েছে সেখানে গাছের ছায়ায় কিছুটা শীতলতা। হঠাৎ দেয়াল টপকিয়ে একটা ঢি*ল রুহানীর পাশে এসে পরল। আচানক এমনটা হওয়ায় রুহানী বেশ চমকে গিয়েছে। ঢি*লটা কাগজে মোড়ানো। রুহানী সেটা হাতে তুলে নিয়ে খুলে দেখল। কাগজটাতে লেখা,

“সাবধান!”

লেখটা দেখে কিয়ৎ মুহূর্ত রুহানী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। কে তাকে সাবধান করতে চাইছে আর কী-সের জন্যই বা সাবধান করতে চাইছে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার দরুণ পরে থাকা শুকনো সুঁ*চালো ডালের খোঁ*চায় পায়ের একটু চামড়া একটু ছিঁ*লে গেছে। জ্বা*লাপো*ড়ার উদ্রেক হলে জায়গাতেই বসে হাতের কাছে পাওয়া দূর্বাঘাস কঁচলে নিয়ে ক্ষত স্থানে লাগায়। বেশ সামান্যই ছিঁ*লেছে। কিছুক্ষণ যত্রই বসে থেকে উঠে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

_______

শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে আরহান। এই কয়েকদিন সিলেটেই আসতে পারেনি। আজ এসেই দাদীর সাথে কিছুক্ষণ খু*নশুঁটি করে নিজের ঘরে চলে গেছে। লন্ডন থেকে ঢাকার ফ্লাইটে ফিরে আবার অন্য এক দেশের ফ্লাইটেও গিয়েছিল। লম্বা ঘুম ছাড়া ক্লান্তি কমবে না। ঘুমানোর আগে দাদী আরেকবার রুমে এসে বলে,

“না খেয়ে ঘুমাবি না। প্রতিবার এমন করিস। আমাকে এসে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়! এখনও কি বাচ্চা তুই?”

আরহান দাদীকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,
“তুমি খাইয়ে দিলে আমার খিদে না পেলেও খেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় খাবারের স্বাদটাই বেড়ে গেছে।”

নাতির কথা শুনে আয়েশা খানম হেসে নাতির হাতে আলতো চ*ড় দিয়ে বলেন,
“যাহ্‌ পা*গল! কয়দিন পর ঘরে বউ এলে এই অভ্যাস বদলাতে হবে তো। বউয়ের সামনে দাদীর হাতে খাবি নাকি!”

“বউয়ের সামনে খাব কী! বউকে সাথে নিয়ে খাব। তখন তোমার ডিউটি ডাবল হবে। তারপর বাচ্চা হলে বাচ্চাকেও সাথে নিয়ে খাব। বুঝলে?”

আয়েশা খানম হেসে আরহানের হাত ছাড়িয়ে ওকে সামনে এনে বলেন,
“হ্যাঁ বুঝেছি। এখন নিচে আয়। খেয়ে ঘুমা।”

“আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।”

আয়েশা খানম চলে গেলে হাত-মুখ ধুঁয়ে নিচে আসে।

________

পরেরদিন সকালে নাস্তার পর রুহানী তার চাচিকে ও একজন সার্ভেন্ট নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। জাহানারা শেখ রুহানীকে বলেন,
“জানিস? আপুরও চা বাগান অনেক পছন্দের ছিল। তোর জন্মের আগে যখন আপু নিঃসঙ্গ অনুভব করত তখন ভাইয়া আপুকে নিয়ে এখানে চলে আসতেন। এই বাংলোটাও ভাইয়া আপুর জন্য বানিয়েছিলেন। এমনকি আপুর প্রেগনেন্সির সময় আমরা সবাই এই বাংলোতেই ছিলাম।”

রুহানী তার চাচির কথা শুনতে শুনতে মুচকি হাসে। পথে চা শ্রমিকদের সাথে হাসি বিনিময় করছে। তখনি একটু দূরে হট্টগোলের শব্দ রুহানী সেদিকে এগিয়ে যেতে ধরলে জাহানারা শেখ ডেকে ওঠেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”

রুহানী ইশারায় দেখালে তিনিও সঙ্গে চলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন এক বৃদ্ধ চা শ্রমিক মাটিতে বসে আছেন। এইটুকু সময়ে সে যতোটা কুঁড়ি সংগ্রহ করেছিল সব ছড়িয়ে গেছে। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত কষ্ট করে সে বেশ অনেকটাই পাতা সংগ্রহ করেছিলেন। রুহানী বৃদ্ধ লোকটাকে কাঁদতে দেখে পাশে গিয়ে বসেন। ইশারায় বৃদ্ধ লোকটিকে কাঁদতে মানা করে। বৃদ্ধ লোকটি দুঃখ করে বলে(সিলেটি ভাষাকে বুঝিয়ে লিখা),

“মা রে, আমার এতোক্ষণের সব কষ্ট শেষ হয়ে গেল। এহন পাতা সংগ্রহ শুরু করলেও এক ঝুড়ির টাকা কম হবে।”

বৃদ্ধ লোকটির ভাষা রুহানীর বোধগম্য হতে খানিক সময় লাগে। কিছুটা বুঝলেও বাকিটা ভেবে নিয়েছে। রুহানী বৃদ্ধ লোকটিতে থামতে বলে মাটি থেকে যেটুকু পেরেছে পাতা উঠাতে থাকে। জাহানারা শেখ অন্য শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনারা যার যার কাজে যান।”

সবাই চলে গেলে রুহানী সার্ভেন্টকেও ইশারায় ডেকে পাতা তুলতে বলে। সার্ভেন্টটা কাজে হাত লাগানোর পর রুহানী হঠাৎ আরও এক জোড়া হাত লক্ষ্য করে সেই হাতের মালিকের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে যায়। আরহান! আরহান রুহানীকে মৃদু হাসি উপহার দিয়ে পাতা তুলতে থাকে। তারপর বৃদ্ধ লোকটার কাছে গিয়ে বলে,

“দাদু, আজকে আপনি রেস্ট করেন। আমি আজ আপনার জন্য পাতা তুলে দিব। আজ আমার কোনো কাজ নাই।”

বৃদ্ধ লোকটি (সিলেটি ভাষায়) বলল,
“না বাবা, তুমি কেন কষ্ট করবা। আমিই যতোটুকু পারব করে নিব।”

“উহুঁ। আপনি বসেন। আমি হেল্প করব। আপনার শরীর ক্লান্ত বলেই পরে গেছেন। একটু রেস্ট করেন।”

রুহানী, আরহান ও বৃদ্ধ লোকটার কথা শুনছে। আরহানের কথা বুঝতে পারছে বলেই বৃদ্ধ লোকটি কী বলেছে তা ধরে নিতে পেরেছে। আরহান কাঁধে একটা ঝুড়ি উঠিয়ে পাতা সংগ্রহ করতে যেতে নিলে রুহানী তার হাত ধরে বসে।
আরহান তাতে অবাক হয় না, বরং চোখে হেসে বলে,
“কী? হঠাৎ হাত ধরলেন যে?”

রুহানী ইশারায় বললে আরহান বলে,
“স্বাভাবিক ভাবে বলুন। ইউ নো, আমি লিপরিড করতে পারি।”

রুহানী এবার ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলে,
“আমিও হেল্প করতে চাই।”

“শিউর। তাহলে আরও ভালো হয়।”

রুহানী খুশি হয়ে পাতা সংগ্রহ করা শুরু করে। জাহানারা শেখ তাতে বেশ খুশি হোন। তিনি রুহানীকে বলেন,
“তুই তবে থাক। আমি শেফালীকে রেখে গেলাম। দুপুরের আগেই কিন্তু চলে আসবি।”

রুহানী মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।

________

ঢাকার অফিসে রহমত শেখ ও রিফাত কেবিনে বসে কথা বলছে। রহমত শেখ বলেন,
“তুই পারবি আমার কম্পানিটা সামলাতে। এই কম্পানিতে আমাদের তিন ভাই-বোনের অংশীদার আছে। আর তুই কতো নিঁখুত ভাবে কাজ করিস। জানি বাবা তোর জন্য সময়টা খুব চাপের। কিন্তু রুহানীর জন্য কী করব বল? ঢাকাতে ওর মন না টেকার কারণটাও তুই জানিস।”

“না মামা, আমি পারব। তুমি সিলেটের ব্রাঞ্চটার দায়িত্ব নাও। ওখানে প্রায়ই চু*রির ঘটনা ঘটে। ওটাকে ঠিক করতে পারলে আমাদের কম্পানি আরও শক্তিশালী হবে। আর রুহানী এখানে কম সহ্য করেনি। প্রকৃতির কাছে থাকলে ওরও মন ভালো থাকবে। বড়োমামীর মতো রুহানীও প্রকৃতিপ্রেমী হয়েছে।”

তৎক্ষনাৎ কেবিনের দরজা ঠা*স করে খুলে যায়। প্রবেশ করেন রিফাতের বাবা নজরুল আহমেদ। তিনি রুষ্ট স্বরে বলেন,
“আমার সহজ সরল ছেলেটাকে দিয়ে তো ভালোই কাজ করিয়ে নিচ্ছ। মুখেই বলো কম্পানিতে অংশীদার কিন্তু কাজেকর্মে কর্মচারীর মতো।”

“থামো বাবা। কী-সব বলছ!”

নজরুল শেখের কথা শুনে রিফাত তাকে থামাতে গেলে রহমত শেখ বাধা দেন। তিনি বলেন,
“উনি তো ঠিকই বলেছে রিফাত! তোমার নামে তো আমি কিছুই দেইনি। চারটা ব্রাঞ্চের একটা রিহা দেখে আর বাকি তিনটা আমার কাছে। তোমার কাছে তো কিছুই নেই। আজ থেকে থাকবে। ঢাকার ব্রাঞ্চের সিইউ এখন থেকে তুমি। ওটা নিয়ে কালকে আ*ইনী কাজ হবে।”

এই বলে রহমত শেখ নিজের কেবিনে চলে যান। রিফাত তাকে কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তিনি দাঁড়ালেন না। রহমত শেখ চলে যেতেই নজরুল আহমেদ বাঁকা হাসেন। রিফাত দ্রুত এসে উত্তেজিত হয়ে তার বাবাকে বলে,
“কেন করছ এসব? তুমি কি কিছু জোড়তে জানো না? তোমাকে বলতে বলতে আমি টায়ার্ড। এতোবার নিষেধ করেছিলাম, রিহাকে না জানাতে। তাও তুমি তাই করলে। কেন?”

নজরুল আহমেদ ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“তোমার জন্য মাই সন। তুমি তো নিজের ভালো বুঝো না। তাই বাবা হিসেবে আমাকেই বুঝতে হয়। কয়েকদিন পর তুমিও বাবা হবে, তখন তুমিও বুঝবে।”

এই বলে নজরুল আহমেদ কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। রিফাত কপালে হাত ঘষতে ঘষতে চেয়ারে বসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here