বিরহ শ্রাবণ ২ পর্ব – ৩৭

#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_৩৭
#লেখিকা_সারা মেহেক

অভ্র ভাইয়ের কথায় আমি থম মে’রে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। অতঃপর বললাম,
“ আবেগ দিয়ে জীবন চলে না অভ্র ভাই। ”

অভ্র ভাই স্মিত হাসলেন। বললেন,
“ আমার এটা যে আবেগ নয়, ভালোবাসা। এটা কবে বুঝবে চন্দ্রিমা?”

“ এ ভালোবাসায় কি লাভ বলুন তো? শুধু কষ্ট পাচ্ছেন। এ ছাড়া আর কিছু পেলেন?”

“ আমি এতো লোভী না চন্দ্রিমা। তোমায় ভালোবাসার বিনিময়ে কিছু না পেলেও চলবে। ”

এবার আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম। খানিক চটে গিয়ে বললাম,
“ অভ্র ভাই, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে আমি এখন বিবাহিত। একটা বিবাহিত মেয়ের প্রতি এমন ভালোবাসা মানায় না৷ ”

“ আমি তো তোমাকে বিয়ের পর ভালোবাসিনি চন্দ্রিমা। তোমার বিয়ের আগে থেকেই ভালোবাসি৷ আশা করি, এর বিপক্ষে কোনো যুক্তি তুমি দিতে পারবে না৷ ”

অভ্র ভাইয়ের সাথে ত’র্ক বি’র্ত’ক করে ভীষণ বিরক্ত হলাম। সাথে মেজাজও খারাপ হলো। আমি চট করে উঠে দাঁড়ালাম। কড়া গলায় বললাম,
“ আপনাকে একটু বুঝাতে এসেছিলাম আমি৷ কিন্তু আপনি যে এতোটা নাছোরবান্দা তা বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম আপনাকে হয়তো বুঝিয়ে বললে আপনি বিয়েতে রাজি হবেন। এতে খোদেজা মামির মাথা থেকে আপনার জন্য দুশ্চিন্তার ভূ’ত একেবারে নেমে যাবে৷ কিন্তু আপনি তো জেদি ছেলেদের মতো নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন। থাকুন এভাবে। আর কিছু বলার নেই আমার। যে বুঝতে চায় না তাকে হাজার যুক্তি দিয়ে বুঝালেও সে কখনো বুঝবে না। ”
এই বলেই আমি চলে যেতে নিলাম। কিন্তু কয়েক কদম এগুতেই পিছন হতে অভ্র ভাই ডাকলেন। আমি ফিরে তাকাতেই উনি বললেন,
“ চন্দ্রিমা, একটা প্রশ্ন করবো তোমাকে। আচ্ছা? এখন তোমাকে যদি বলি তুমি প্রোজ্জ্বলকে ভুলে যাও। পারবে ভুলে যেতে?”

আমার রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে ক্রোধান্বিত গলায় বললাম,
“ আপনি এমন প্রশ্ন করলেন কি চিন্তা করে! প্রোজ্জ্বলের সাথে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক। আমি ওকে ভালোবাসি। ওকে ভুলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই তৈরী হয় না। ”

অভ্র ভাই আমার কথায় তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিলেন। বললেন,
“ তুমি এক বছরের ভালোবাসা ভুলতে পারো না… আর আমার কাছ থেকে কি করে আশা করো যে আমি এতো বছরের ভালোবাসা ভুলে যাবো!”
এই বলে উনি পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখলেন৷ পুনরায় তা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন,
“ এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার কোনো শখ বা ইচ্ছে ছিলো না আমার। তুমিই ব্যাপারটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলে। আমি তো সব লুকিয়ে নিজের মতো সুখী ছিলাম। তুমিই মাটি খুঁড়ে আবার সব বের করে নিয়ে এলে। কিন্তু যাই হোক, তোমায় যদি কথার মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে মাফ করে দিও। ”
বলেই উনি আর দেরি না করে চলে গেলেন। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথাও না কোথাও আজও মনে হয়, আমিই সব সমস্যার মূল। মাঝে মাঝে মন বলে, এ সব থেকে দূরে চলে যাই। এতে যদি সবার জীবনে সমস্যা কমে!

——————-

প্রোজ্জ্বল ক্লিনিক হতে এসে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। মাত্রই বের হলো। ও বের হতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“ অভ্র ভাইয়ের সাথে কথা হয় তোমার? ”

প্রোজ্জ্বল তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে বললেন,
“ ৩/৪ দিন যাবত দেখা হয় না আমাদের। অভ্রও ব্যস্ত থাকে। আমিও ব্যস্ত থাকি। ”

“ অভ্র ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানো?”

“ কি জানবো? ও কি বিয়েতে রাজি হয়েছে?”

ওর প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
“ রাজি হলে তো ভালোই হতো। কিন্তু উনি এখনও রাজি হচ্ছেন না। ”

প্রোজ্জ্বল আমার কথার প্রত্যুত্তর দিলেন না। বরং আমার পাশে এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“ কথা বলেছিস ওর সাথে?”

“ হ্যাঁ। আজ বিকেলে কথা বলেছি। উনাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি এখনও সেই একই কথায় আটকে আছেন…..”

“ ও তোকে এখনও ভালোবাসে। তাই তো?”

প্রোজ্জ্বলের অকপট কথায় আমি খানিক ভড়কে গেলাম। ওর সামনে এ কথাটি সরাসরি বলতে চাইনি। কিন্তু ও যে এভাবে অকপটে বলে ফেলবে সেটাও ভাবিনি।
আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। প্রোজ্জ্বল আমার নীরব জবাবে স্মিত হাসলেন। বললেন,
“ ওর বিয়ে না করতে চাওয়ার কারণ যে এটা তা অনেক আগেই অনুমান করেছিলাম আমি। আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম। ”

আমি দৃষ্টি নত করে বললাম,
“ আমিও এমনটা ভেবেছিলাম।
আচ্ছা? তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?”

” কর। কি প্রশ্ন করবি। ”

“ এই যে অভ্র ভাইয়ের মনে যে এখনও আমায় নিয়ে অনুভূতি আছে, তাতে তোমার কোনো সমস্যা নেই?”

আমার প্রশ্ন শুনে প্রোজ্জ্বল হাসলো। অতঃপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ সমস্যা? শুধু সমস্যা না। বিশাল সমস্যা আছে আমার৷ কিন্তু কি করবো বল। এ বিশাল সমস্যা থাকলেও তো আমার কিছু করার নেই। কারণ অভ্রর শরীরের উপর জোর খাটাতে পারলেও ওর মনের উপর তো জোর খাটানো সম্ভব না তাই না? মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রাগ হয় এ নিয়ে ভাবলে। মন চায় অভ্রর মুখের উপর কয়টা ঘু’ষি মে’রে আসি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, শুধু শুধু মে’রে কি হবে। ও না চাইলে তো কিছুতেই ওর মন থেকে তুই যেতে পারবি না।
আমি নিজেকে বুঝিয়েছি। নিজেকে বলেছি, অভ্র তো আমার কোনো ক্ষতি করছে না৷ তাহলে থাক এসব। যেমন আছে তেমনই চলতে থাকুক। কেউ তো আর রোজ রোজ এ টপিক সামনে আনবে না৷ তাই আমরাও জানি না এমন একটা ভান করবো। আর এমন ভান আমরা রোজই করছি। ওর সাথে আমার দেখা হলেও এমন ভাব ধরি যে, এক বছর আগে কিছুই হয়নি আমাদের তিনজনের মাঝে। ”

প্রোজ্জ্বলের এমন কথায় আমি ভীষণ আবেগী হয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“ আমার উপর কোনো রাগ নেই তোমার? ”

প্রোজ্জ্বল ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,
“ তোর উপর রাগ থাকবে কেনো?”

“ এই যে এসব সমস্যার মূল যে আমি৷ ”

প্রোজ্জ্বল সশব্দে হেসে উঠলেন। আমায় বাহু দিয়ে জাপটে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলেন। বললেন,
“ তুই একটা পা’গ’ল চন্দ্রিমা৷ এসব কারণে তোর উপর রাগ থাকবে কেনো! এখানে তোর কি দোষ? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তুই এখনও কেনো সেই পুরোনো ঘটনা নিয়ে পরে থাকবি! যে ঘটনার একটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে সে ঘটনা ভুলে যাওয়া ভালো না?”

আমি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। বললাম,
“ ভুলতে চাই। কিন্তু যখনই আমরা তিনজন একসাথে হই তখনই নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়৷ আর আজ তো কথায় কথায় এটা বেরিয়ে গিয়েছে। তবে আমি চেষ্টা করবো ভবিষ্যতে যেনো কিছুতেই এ টপিক সামনে না আসে।”

প্রোজ্জ্বল মৃদু হাসলেন৷ আমার কপালে আলতো অধরের স্পর্শ দিয়ে বললেন,
“ তোকে অনেক ভাগ্য করে পেয়েছি চন্দ্রিমা। আমি চাই না তোকে আর কোনোভাবে হারাতে। মাঝে মাঝে অভ্রর এ ভালোবাসা দেখে ভীষণ হিং’সা হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, ও কি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে তোকে? যদি এটা সত্যি হয় তাহলে আমি কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারবো না৷ ”

প্রোজ্জ্বল শেষোক্ত কথায় খানিক ক্ষো’ভের উপস্থিতি পেলাম বোধহয়। মনে মনে হাসলাম৷ ওর বা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম,
“ কার ভালোবাসা বেশি বা কম তা দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। আমি তোমার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ধন্য৷ তোমার ভালোবাসাই আমার কাছে সব। আর কিছু কি লাগবে?”

প্রোজ্জ্বল বললেন,
“ উঁহু। আর কিছুই লাগবে না। আমরা একে অপরের পরিপূরক, এর চেয়ে বেশি আর কি চাই।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। প্রোজ্জ্বলের কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইলাম৷
জীবন যে কত ধরণের রূপ রঙের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবে তা কেউ অনুমানও করতে পারবে না কখনো। সে রঙ পছন্দ না হলেও আমাদের সে রঙের সাথে পরিচিত হতে হবে। জীবন চালাতে হবে। কিছু জিনিস জেনেও না জানার ভান করতে হবে। কিছু জিনিস দেখেও না দেখার ভান করতে হবে। এভাবেই তো জীবন চলবে।

—————-

দু সপ্তাহের মাঝে অভ্র ভাই বিয়ে করলেন। তবে স্বেচ্ছায় নয়। খোদেজা মামির ম’র’ণা’প’ন্ন অসুস্থতা দেখে বিয়ে করতে বাধ্য হলেন তিনি। উনি যে বাধ্য হয়ে বিয়ে করলেন এটা আমাদের দু পরিবার বাদে বাইরের কোনো মানুষ জানে না৷ এমনকি কনে পক্ষের কেউই জানে না৷

বিয়ে হলো খুবই তাড়াহুড়ো করে। মেয়ে দেখতে গিয়েই বিয়ে করে নিয়ে এলেন অভ্র ভাই। মেয়ের নাম ফারিয়া। দেখতে ভীষণ সুন্দর। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ও আমার চেয়েও অনেক উপরে। ওর সৌন্দর্যের কাছে যেনো আমি কিছুই না৷
ফারিয়া এ বছর মাত্র এইচএসসি দিয়েছে। নতুন করে ভার্সিটিতে ভর্তি হবে।

অভ্র ভাই ফারিয়াকে বাড়িতে আনার পর বেশ হাসি মুখেই উনার উদ্দেশ্যে বললাম,
“ বউ হিসেবে একদম হিরার টুকরা পেয়েছেন অভ্র ভাই। আমি নিশ্চিত ফারিয়া আপনার জীবনে অনেক খুশি নিয়ে আসবে। ”

অভ্র ভাই আমার কথার প্রত্যুত্তর দিলেন না৷ শুধু তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি হেসে আমার সামনে দিয়ে অন্য রুমে চলে গেলেন৷ উনার এ হাসির অর্থ বুঝতে আমার বেশি সময় লাগলো না। শুধু মনে মনে এই দোয়াই করলাম যেনো উনি ফারিয়াকে নিজের স্ত্রী হিসেবে খুব শীঘ্রই মেনে নেন।

—————-

অনেকদিন যাবত দু পরিবার মিলে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। তাই এক শুক্রবারে দু পরিবার মিলে কাছের একটা রিসোর্টে পিকনিকে গেলাম। পিকনিকে যাওয়ার পথে মামিরা এক গাড়িতে ও আমরা এক গাড়িতে বসলাম৷ প্রোজ্জ্বল ও অভ্র ভাই বসলেন সামনে। আমি বসলাম ফারিয়ার এ পাশে আর অনামিকা বসলো ও পাশে।
যাবার পথে ফারিয়ার সাথে অনেক গল্প হলো। ও আর অভ্র ভাইয়ের বিয়ের প্রায় দু মাস কেটে গিয়েছে। একবার ভাবলাম ওদের সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেই৷ কিন্তু গাড়িতে অভ্র ভাই ও প্রোজ্জ্বল থাকায় তা সম্ভব হলো না।

আমরা আবারও গল্পে মশগুল হলাম গাড়ি থেকে নেমে। পিকনিক স্পটে গিয়ে সবাই সব খাবারদাবার গোছগাছ করতে লাগলো। সেই ফাঁকে ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“ তোমার সংসার জীবন কেমন চলছে ফারিয়া?”

ফারিয়া কাজ করতে করতে থমকে গেলো। আমার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চেয়ে আবার কাজে মশগুল হলো। স্মিত হেসে বললো,
“ যেমনটা চলে আর কি সবার। “

আমি ওর কথায় বেশ স্বস্তি পেলাম। বললাম,
“ আলহামদুলিল্লাহ। তা অভ্র ভাই তোমাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায়নি?”

ফারিয়া এবার কাজ ছেড়ে আমার দিকে ঘুরে বসলো। মলিন হেসে বললো,
“ উনার সময় হয়ে উঠে না। তবে সত্যি বলতে কি ভাবি জানেন, ও আমায় নিয়ে কোথাও যেতে চায় না৷ মূল কথা, উনার মনে এখনও আমি জায়গা করে নিতে পারিনি৷ ”

ফারিয়ার মলিন মুখের কষ্টে জর্জরিত এ কথা শুনে আমার চেহারা হতে হাসি উবে গেলে। তবুও এ ব্যাপারটি বড় কিছু নয় এমন ভান ধরে বললাম,
“ আরে চিন্তা করো না ফারিয়া৷ সময় যেতে যেতে সব হয়ে যাবে৷ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ তো, তাই একটু সময় লাগছে।”

ফারিয়ার ঠোঁটের কোনে এখনও হাসি লেপ্টে আছে। কিন্তু সে হাসি সুখের নয়, কষ্টের। ও বললো,
“ আমাদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ স্বাভাবিক হলে এ কথা মেনে নিতাম ভাবী৷ কিন্তু অভ্রকে এই দু মাসে যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হয় না উনার মনে আমি কখনও নিজের জায়গা করে নিতে পারবো। হয়তো উনার ভালোবাসা পাওয়ার মতো সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাইনি আমি।
এক্ষেত্রে আপনি অনেক ভাগ্যবতী ভাবী৷ কারণ আপনি অভ্রর ভালোবাসা পেয়েছিলেন। আপনি অনেক সৌভাগ্যবতী। ”

#চলবে
®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here