বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি পর্ব ৩৫+৩৬+৩৭

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৫

পরদিন মিহির বের হবার পর সেহের তার রুমে ঢুলে।পুরো রুম জুড়ে নিখুঁত তদন্ত করে কিন্তু কোন প্রকার প্রমাণ মিলে না। হতাশ হয়ে বড় এক নিশ্বাস ছাড়ে,আরহামকে তাদের অ্যাফেয়ারের কথা জিগ্যেস করে জোরগলায় না করবে। উল্টো বাড়ির সবার সামনে সেহেরের অভার থিংকিং বলে উড়িয়ে দেবে।এখান থেকে যেতে হলে সেহেরের শক্ত প্রমাণ চাই। তখনি সেহেরের চোখ আটকায় সামনের কাবার্ডের দিকে।সেহের দ্রুত পায়ে সেদিকে অগ্রসর হয়।কাবার্ড খুলে তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করে। হ্ঠাৎ- ই চোখ আটকায় নীল ফাইলে।উপরের কালো কলমে গোটাগোটা অক্ষরে ‘আর্বিন্দ’ লিখা ।নামটা সেহেরের খুব পরিচিত।এর আগেও কোথাও শুনেছে । কিন্তু কোথা শুনেছে তা মনে পড়ছে না। দূর থেকে এক অস্পষ্ট আওয়াজ মাথায় বাড়ি খাচ্ছে । চোখের সামনে কিছু আবছা আবছা ভেসে উঠছে। মাথার পেছন দিকে এক অসহ্য যন্ত্রণা কিলবিল করছে। সেহের মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠল।দ্রুত হাতে ফাইল খুলল।কোন এক বিষয়ের উপর ডকুমেন্টারি। উপরে গাঢ় কালিতে লিখা ‘multiple personality disorder’।রোগীর নাম আর্বিন্দ ।রোগীর লক্ষণ সমূহ :

1/ ব্যক্তিগত তথ্য ভুলে যাওয়া।
2/:-স্বাভাবিক বিষয়গুলো ভুলে যাবার প্রবণতা বেড়ে যায়। সম্পর্ক, মানসিক বা পেশাদারি চাপ সামলাতে অক্ষম হয়ে পড়া।তার মাঝে প্রচুর পরিমাণে হতাশা দেখা দেয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।
3/বার বার হ্যালুসিনেশন হতে থাকে । ভয়ানক স্মৃতি গুলো তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘুমের সমস্যা হয় প্রায়শই দুঃস্বপ্ন , ইনসমনিয়া , দেখা দেওয়া।
4/ অস্থিরতা প্যানিক এটাক বিভিন্ন রকম ফোবিয়া ।

সেহেরের বিষয় গুলো পড়ে ভীষণরকম অদ্ভুত লাগল।ভ্রু কুঁচকিয়ে নিলো। এমন অদ্ভুত রোগও হয় কি? মিহি কি আর্বিন্দ নামক রোগী উপর রিসার্চ করছে? নাকি তার ট্রিটমেন্ট করছে? এসব ভাবতে ভাবতে সেহের পেজ উল্টায় এমন সময় বাহির থেকে লিয়ার ডাক পড়ে। বাকি পৃষ্ঠা গুলো আর পড়া হয় না। তড়িঘড়ি করে ফাইলটা কাবার্ডে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

আরহামের ঘুম ভাঙার আগেই সেহের ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।সেদিন থেকে আরহামকে কড়াকড়ি ভাবে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।দুজনের মধ্যে হাসবেন্ড ওয়াইফের সম্পর্ক না থাকলেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিলো।কিন্তু আজকাল সেই সম্পর্কটাও ফাটল ধরেছে। দুজনের মাঝে তেমন কথাবার্তা হয় না।বেশ সকালে আরহাম জাগার আগেই সেহের ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়।ক্লাসের শেষে দুটো টিউশন নিচ্ছে। আজকাল নিজেকে যথাসাধ্য ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে।এর মাঝেই এক্সামের টেনশন সব মিলিয়ে সেহেরের দিনও বেশ ব্যস্ত কাটছে। অল্পস্বল্প যেই সময় পায় সেই সময়টা বারান্দায় দাড়িয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে পাড় করে ।সেহেরের এমন হ্ঠাৎ পরিবর্তন আরহামের চোখে পড়ে। বেশ কয়েকবার এ নিয়ে সেহেরের সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু সেহের প্রত্যেবারই ব্যস্ততার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে আরো কিছুদিন কেটে যায়।আজ নির্বাচনের দিন। পুরো শহরবাসীর মনে এক অদম্য উত্তেজনা ।সকাল থেকে পুরো পরিবার টেনশনে হাতপা কচলাচ্ছে ।আরহাম ও তার পার্টির লোক জায়গা জায়গায় প্রতিটা কেন্দ্রে রাউন্ড দিচ্ছে ।গোপন তথ্য জানা গেছে বিরোধী দল ভয়ানক কোন ষড়যন্ত্র করছে।জোরদার লড়াইয়ের পর জনগণের অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে বিপুল ভোটে আরহামের দাদাজান আবারো জয় লাভ করেন।তৃতীয় বারের মত মন্ত্রী হন।পুরো শহর জুড়ে বিজয়ের উৎসব ।বাড়িতে খুশির আমেজ । শুধু মাত্র সেহের গোমড়া মুখে।মন থেকে খুশি হলেও এই খুশি তার কঠিন সিদ্ধান্তের উপর কোন প্রভাব ফেলছে । এই তো আর একটা রাত তারপর এ বাড়ি এশহর সব ছেড়ে অনেক দূর পাড়ি জমাবে!

বিজয়ের উৎসব,বিজয় মিছিল শেষ করে আরহাম দাদাজানের সাথে বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে। আগামীকাল পার্টির সকল আয়োজন শেষ ।বাড়িতে খুশিখুশি মুখ নিয়ে প্রবেশ করতে দেখে পরিবারের সবাই হল ঘরে উপস্থিত।সবাই অভিনন্দন জানানোর জন্য আরহাম আর দাদাজানের অপেক্ষা করছিল।আরহাম সেহেরের দিকে তাকাল ।উদাসীন দাঁড়িয়ে । দুজনের চোখাচোখি হল।সেহের বেশিক্ষণ আরহামের দিকে তাকাল না চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।আরহামের খটকা লাগল কিন্তু পরিবারের সবাই সাথে থাকায় কিছু বলল না।কিছুক্ষণ পর অসুস্থতার বাহানা করে সেহের উপরে চলে যায়।আরহামও তার পিছু পিছু যায়।সেহের ওয়াশরুমে ।আরহাম চেঞ্জ করে বিছানায় সেহেরের অপেক্ষা করে। অনেকটা সময় নিয়ে সেহের বের হয় ।চোখ মুখ ফুলে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে ।সেহেরকে দেখে আরহাম বলল,”শরীর কি খুব বেশি অসুস্থ? চলো ডক্টরের কাছে যাই”
সেহের মুখ মুছতে মুছতে না সূচক মাথা নাড়াল।ভারী স্বরে বলল,”আপনার সব দরকারী জিনিসপত্র কাবার্ডে রাখা।কাবার্ডের নিচের পার্ট গুলোর চাবি বিছানার পাশের টেবিলটায় রাখা।”
সেহেরের হঠাৎ এমন কথায় আরহাম চমকাল।তখনি চোখ পড়ল লাগেজ গুলোর উপর।আরহাম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,”কোথাও যাচ্ছ? ”
“হ্যাঁ ,বাবার কাছে চিটাগাং । ”
“আগে বললে না যে! ”
“এইযে এখন বললাম আগে প্রয়োজনবোধ করিনি তাই বলিনি ।”
সেহেরের এমন নিরস উত্তরে আরহাম কিছু মনে করল না। আজকাল সেহের আরহামের সাথে টোনেই কথা বলে।প্রত্যুত্তরে বলল,”পুরো সাপ্তাহ একটু ব্যস্ত আছি । আগামী সাপ্তাহে আমি নিজে সাথে গিয়ে তিনচারদিন থাকবো কেমন? ”
“এখানে আপনার যাওয়ার কথা কোথা থেকে আসছে? আমি একা যাচ্ছি তাও সারাজীবনের জন্য। ”
সেহেরের বাজখাঁই গলায় এমন কথা শুনে আরহাম বেশ চমকাল।বিছানা ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে বলল,”সারাজীবনের জন্য মানে? কি বলতে চাইছ? ”
“এই নামমাত্র সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই আমার! ডিভোর্স পেপার সাইন করা আছে ।আপনি সাইন করে দিবেন প্লিজ ”
সেহেরের কথায় আরহামের রাগ আকাশ চুম্বী।সেহেরের বাহু চেপে ক্রুদ্ধ গলায় বলল,”হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? তোমার ডিভোর্স চাই?
“কেন শুনে খুশি হননি? এমনটাই তো চেয়েছিলেন।আমার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলেই আপনি মুক্ত লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রেন্ডশিপের নাম করে অ্যাফেয়ার চালাতে হবে না।মিহিকে নিজের করতে পারবেন ।শুধু নির্বাচন শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি চাইনা আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে শহর জুড়ে মাতামাতি হোক। এই বাড়ির সম্মান নষ্ট হোক!

“সেহের আমি এর আগেও বহু বার তোমাকে বলেছি আমাদের মাঝে ফ্রেন্ডশিপ ছাড়া অন্যকোন সম্পর্ক নেই ।তুমি কেন বুঝো না? ”
সেহের তাচ্ছিল্য হেসে বলে ,”আচ্ছা তাই ,রাতবিরাতে রিফ্রেশমেন্টের নাম করে তার সাথে সময় কাটানো এটা এমন ফ্রেন্ডশিপ? আমি এতোটাও বোকা নই যে আপনি যা বলবেনামি তা মানবো। আপনি চরিত্রহীন! ”
সেহের বেয়াদবিতে আরহাম চুপ থাকতে পারল না । থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত উঁচু করতে গিয়ে থেমে গেল।সেহের আরহামের এমন ব্যবহারে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল।টলটল চোখ থেকে ঝরঝর করে গাল বেয়ে পানি পড়ল।আরহাম দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে নিজের রাগকে দমিয়ে শন্ত স্বরে বলল,”এসব চিন্তাভাবনা কবে থেকে তোমার মাথায় ঘুরছে? ”
“যেদিন রাতে আপনি মিহির সাথে ড্রাংক হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন! ”
আরহামেত বুঝতে বাকি রইল না সেহের কোন দিনের কথা বলছে।আরহাম সেহের কাছে এগিয়ে তাকে সবটা বুঝাতে চেষ্টা করল।কিন্তু সেহের নাছোড়বান্দা শুনতে নারাজ । আরহামকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,”ব্যস ,অনেক হয়েছে। আমার আপনার থেকে মুক্তি চাই! ”
আরহামের মাথা বিগড়ে গেল। সেহেত পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে । আরহাম আটকে নেয়।কোলে তুলে বিছানায় ফেলে শক্ত গলায় বলে,”তুমি চাও আর না চাও ,তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে! ”
সেহের বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইল। কিন্তু পাড়ল না পেছন থেকে আরহাম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ।
গভীর রাতে আরহাম ঘুমিয়ে পড়তেই বিছানার পাশে ডিভোর্স পেপার রেখে। সেহের আলতো পায়ে লাগেজ নিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ে।
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৬

মন্ত্রিবাড়িতে সকাল থেকে হৈ চৈ লেগে। বিষাদময় পরিস্থিতি। কিসের বিজয় উল্লাস ,কিসের পার্টি কিসের কি ,সবাই বাড়ির বউ খুঁজতে ব্যস্ত ।শহরের বুকে গার্ড ছড়িয়ে দিয়েছে।সব গার্ডদের কড়াকড়ি আদেশ সেহেরকে দেখা মাত্রই বন্দি করা।সেহেরের নিখোঁজের খবর মিলতেই বাড়ির দারোয়ানদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে!
আরহাম হিংস্র সিংহের মত রাগে গজগজ করছে ।সকল বাসস্টপ ,স্টেশন সব জায়গায় খবর নেওয়া হয়েছে। কোথাও সেহেরের খোঁজ মিলেনি।বাড়ির কেউ তার সামনে দাড়ানোর সাহস করতে পারছেনা । কে চাইবে এমন ঘায়েল সিংহের মুখোমুখি হয়ে নিজের বিপদ ঢাকতে?
এর মাঝে দিশা মালিহা একদফা আরহামের ক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছে। আরহামের স্পষ্ট ধারণা বাড়ির কেউ সেহেরকে পালাতে সাহায্য করেছে।আর সন্দেহের শীর্ষস্থানে মালিহা খানম ,দিশা।উনারাই সেহেরের একান্ত ঘনিষ্ঠ । মালিহা খানম তো এর পূর্বেও সেহেরকে বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছে!
পুরোদিন ক্লান্তি ভরা দুশ্চিন্তায় কাটে।বেডরুমের সব কিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে রক্তচক্ষু করে আরহাম বসে।এমুহূর্তে তার ইচ্ছে করে পুরো দুনিয়ায় আগুন ধরিয়ে দিতে । সবকিছু জ্বালাতে আরহামের ভেতরের আগুন যথেষ্ট! এই মুহূর্তে সেহেরকে সামনে পেলে কষে দুগালে দুই থাপ্পড় লাগাত । ফাজিল মেয়ে ,বাড়ি ছাড়ার সাহস হয় কি করে? বুকে কি ডর ভয় নাই? আরহাম আনমনে বিরবির করছে। এমন সময় ফোন বেজে উঠে।রিসিভ করে কানে তুলতে অপর পাশ থেকে কিছু একটা শুনে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।
দিন শেষ অনেকটা সময়।বিকেল থেকেই কুয়াশা জমছে । চারদিকে ঘন আঁধার নেমে এসেছে।কুয়াশা ভেদ করে গাড়ি দুরন্ত চলছে। কুয়াশায় খানিক সামনের পথও দেখা যাচ্ছেনা ।গাড়ির লাইটের আলোয় সড়ক কোনরকম দেখা যাচ্ছে ।শহুরে পথ মাড়িয়ে গাড়ি গ্রামের এলোমেলো মেঠো পথে নেমেছে ।নির্জন আঁধার কালো ভয়ানক পরিবেশ শীতল বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ।ঘন্টা খানিকের ভেতর আরহাম শান্তির নীড়ে পৌঁছায়।কোনরকম গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে ভিতরের দিকে যায়।সদর দরজায় খালা অপেক্ষা করছিল।আরহামকে দেখে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। আরহাম অস্থির স্বরে জিগ্যেস করে,”সেহের কোথায়? ”
“পুকুর পাড়ে। এখানে আহার পর লাগিস রাইখা পুকুর পাড়ে বইয়া আছে। দুপুরের খাবারো মুখে তুলেনাই । সারাদিন না খাওয়া । কড়া কইরা কইয়া দিছে কেউ যেন পুকুর পাড়ে না যায়।বউ মা একা থাকবার চায় ”
“এখানে কখন এসেছে? ”
“বারটার দিকে এক পুলিশে নামায় দিয়া গেছে ,কইলো বউমার ভাই লাগে ”
আরহাম ছোট এক নিশ্বাস ছাড়ল।বলল,”কাউকে দিয়ে সেহেরের লাগেজ গাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করুন ”
“আইচ্ছা ”
খালা ভেতরে চলে যায়।এমন সময় পানি কিছু পরার সজোরে আওয়াজ হয় । আরহাম পুকুর পাড়ের দিকে ছুটে যায়।বাঁশের সাঁকোর সামনে দাঁড়ায়। অনেকটা হাঁপিয়ে গেছে। এই গা কাঁপা শীতে আরহাম থর থর ঘামছে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। শীতকাল হওয়ায় পুকুরের পানি অনেকটাই নিচে।কুয়াশায় কালো অন্ধকারে ঢাকা। সামান্য দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছেনা।গাছপালায় ঘেরা চারিদিক। দূর অজানা থেকে বেনামী পাখির কুহু ডাক ভেসে আসছে। আরহাম সামনের দিকে ছুটে যায়। সাঁকোর মাথায় সেহেরের ওড়না মিলল।আরহামের ভয় আরো বাড়ল।তবে কি সেহের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে? সেহের তো সাঁতার জানে না! আরহাম প্রাণহীন হয়ে থপ করে সাঁকোতে বসে পড়ে।আশেপাশের কোন শব্দ তার কান অবধি পৌঁছায় না। সেহেরের উড়না বুকে জড়িয়ে অনুভূতিহীন নিষ্প্রাণ বসে থাকে।মাথা পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।হ্ঠাৎ কিছু মনে পড়তে জোরে সেহের বলে চিৎকার দিয়ে উঠে।নির্জন শব্দহীন পুকুরপাড় হুড়মুড় কেঁপে উঠে। আরহাম চল জলদি উঠে সেহেরকে খোঁজতে পুকুরে ঝাঁপ দেয়।হিম শীতল ঠান্ডা পানিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগে। কোথাও সেহের নেই!
আরহাম নিজে মধ্যে নেই। পাগল পাগল হয়ে সেহেরকে খোঁজছে । জোর গলায় চিৎকার করছে আর সেহেরকে ঢাকছে।
“এই রাতে গোসল করতে পুকুরে নেমেছেন? পানি প্রচণ্ড ঠান্ডা সর্দি লেগে যাবে। ”
হ্ঠাৎ- ই পেছন থেকে আলতো মিষ্টি স্বর ভেসে আসে।চিরচেনা সেই আওয়াজে আরহাম তড়িৎ বেগে ঘাড় ফিরে তাকায়। সেহের সাঁকোর মাথায় দাঁড়িয়ে ।আরহাম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে।ঘোর কাটতেই দেরী না করে উপরে উঠে আসে।হুট করে সেহেরকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়।বুকের ভেতর জ্বলন্ত আগুন নিভল ।এক চিলতে হিম শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেল।অনেকটা সময় ভেজা শরীরে আরহাম সেহেরকে বুকে জড়িয়ে রাখল।সেহের নড়চড় করল না।চুপ থাকল।হ্ঠাৎ আরহামের কিছু একটা মনে পড়তে সেহেরের বাহু ধরে সামনে দাঁড় করাল। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,”এইসব কি ঢং শুরু করেছ বাড়ি ছাড়ছ ,ডিভোর্স নিচ্ছ! কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরোনোর সাহস পাও কি করে ?পাখা গজিয়েছে? উড়তে চাও? সকাল থেকে কুকুরের মত শহতের এক কোণা থেকে অন্যকোনা অবধি ছুটে বেড়াচ্ছি।তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছি ।এসব গায়ে লাগে না? সবাইকে এমন হয়রানি করে বেশ আনন্দ লাগছে? ”
সেহের চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা নত করে ঠক ঠক কাঁপছে।আরহাম হাত টেনে সামনের দিকে এগোতে এগোতে ভারী স্বরে বলে,”বাড়ি চলো ”
সেহের থেমে যায়।হাত ছাড়িয়ে আগের মত মাথা নত করে আমতা স্বরে উত্তর দেয়,” আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল । ঐ বাড়িতে যাবো না ,আপনার সাথে থাকবো না। আজই চিটাগাং ফিরে যেতাম কিন্তু সকালে জানতে পারি বাবা দেশের বাহিরে ফিরতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে তাই যাওয়া হয়নি! ”
সেহেরের কথায় আরহামের আবার মাথা বিগড়ে গেল।সব কিছু শান্ত ভাবে সামলাতে চেয়েছে । কিন্তু সেহের মাটি কামড়ে জিদ ধরেছে সে আরহামের কোন কথাই মানবে না। আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”ভালোয় ভালোয় বলছি বাড়ি চলো”
সেহের দু কদম পিছিয়ে ঝাঁড়ি দিয়ে বলে,”বলেছি ত যাবো না।কেন যাবো আপনাদের প্রেমলীলা দেখতে? আমাকে আমার মত থাকতে দিন এখান থেকে যান প্লিজ! ”
কথা শেষ করে আরহামের দিকে তাকাতে সেহের কেঁপে উঠে।অদ্ভুত হিংস্র চাহনি।এমন হিংস্র চাহনি সেহের বিয়ের পরদিন বিকালে দেখেছিল ।তবে কি আরহামের মাঝে দ্বিতীয় সত্তা জেগেছে? সেহের আরহামের এমন ভয়ংকর রূপ দেখে কেঁপে উঠে। ভয়ে ঢোক গিলে।আস্তে আস্তে পিছনের দিকে পিছাতে লাগে। আরহামও সেহেরের দিকে হিংস্র চাহনি নিয়ে এগিয়ে আসছে।পিছতে পিছাতে সেহের সাঁকোর মাথায় দাঁড়িয়ে। আরহামও তার মুখোমুখি আরেক কদম পিছনে বাড়ায় ঝোঁক সামলাতে না পেরে পিছনের দিকে পরে যেতে নেয় ।সাপোর্টের জন্য আরহামের কুর্তি ধরে ফলস্বরুপ আরহাম সহ পুকুরে পরে।হিম শীতল বরফ ঠান্ডা পানিতে সেহের হাবুডুবু খাচ্ছে আরহাম স্থির চোখে তাকিয়ে । সেহের সাহায্যের জন্য সজোরে আরহামের নাম ধরে ডাকে। মুহূর্তে আরহামের জ্ঞান ফিরে দ্রুত সেহেরের দিকে এগিয়ে যায়।
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৬

মন্ত্রিবাড়িতে সকাল থেকে হৈ চৈ লেগে। বিষাদময় পরিস্থিতি। কিসের বিজয় উল্লাস ,কিসের পার্টি কিসের কি ,সবাই বাড়ির বউ খুঁজতে ব্যস্ত ।শহরের বুকে গার্ড ছড়িয়ে দিয়েছে।সব গার্ডদের কড়াকড়ি আদেশ সেহেরকে দেখা মাত্রই বন্দি করা।সেহেরের নিখোঁজের খবর মিলতেই বাড়ির দারোয়ানদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে!
আরহাম হিংস্র সিংহের মত রাগে গজগজ করছে ।সকল বাসস্টপ ,স্টেশন সব জায়গায় খবর নেওয়া হয়েছে। কোথাও সেহেরের খোঁজ মিলেনি।বাড়ির কেউ তার সামনে দাড়ানোর সাহস করতে পারছেনা । কে চাইবে এমন ঘায়েল সিংহের মুখোমুখি হয়ে নিজের বিপদ ঢাকতে?
এর মাঝে দিশা মালিহা একদফা আরহামের ক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছে। আরহামের স্পষ্ট ধারণা বাড়ির কেউ সেহেরকে পালাতে সাহায্য করেছে।আর সন্দেহের শীর্ষস্থানে মালিহা খানম ,দিশা।উনারাই সেহেরের একান্ত ঘনিষ্ঠ । মালিহা খানম তো এর পূর্বেও সেহেরকে বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছে!
পুরোদিন ক্লান্তি ভরা দুশ্চিন্তায় কাটে।বেডরুমের সব কিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে রক্তচক্ষু করে আরহাম বসে।এমুহূর্তে তার ইচ্ছে করে পুরো দুনিয়ায় আগুন ধরিয়ে দিতে । সবকিছু জ্বালাতে আরহামের ভেতরের আগুন যথেষ্ট! এই মুহূর্তে সেহেরকে সামনে পেলে কষে দুগালে দুই থাপ্পড় লাগাত । ফাজিল মেয়ে ,বাড়ি ছাড়ার সাহস হয় কি করে? বুকে কি ডর ভয় নাই? আরহাম আনমনে বিরবির করছে। এমন সময় ফোন বেজে উঠে।রিসিভ করে কানে তুলতে অপর পাশ থেকে কিছু একটা শুনে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।
দিন শেষ অনেকটা সময়।বিকেল থেকেই কুয়াশা জমছে । চারদিকে ঘন আঁধার নেমে এসেছে।কুয়াশা ভেদ করে গাড়ি দুরন্ত চলছে। কুয়াশায় খানিক সামনের পথও দেখা যাচ্ছেনা ।গাড়ির লাইটের আলোয় সড়ক কোনরকম দেখা যাচ্ছে ।শহুরে পথ মাড়িয়ে গাড়ি গ্রামের এলোমেলো মেঠো পথে নেমেছে ।নির্জন আঁধার কালো ভয়ানক পরিবেশ শীতল বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ।ঘন্টা খানিকের ভেতর আরহাম শান্তির নীড়ে পৌঁছায়।কোনরকম গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে ভিতরের দিকে যায়।সদর দরজায় খালা অপেক্ষা করছিল।আরহামকে দেখে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। আরহাম অস্থির স্বরে জিগ্যেস করে,”সেহের কোথায়? ”
“পুকুর পাড়ে। এখানে আহার পর লাগিস রাইখা পুকুর পাড়ে বইয়া আছে। দুপুরের খাবারো মুখে তুলেনাই । সারাদিন না খাওয়া । কড়া কইরা কইয়া দিছে কেউ যেন পুকুর পাড়ে না যায়।বউ মা একা থাকবার চায় ”
“এখানে কখন এসেছে? ”
“বারটার দিকে এক পুলিশে নামায় দিয়া গেছে ,কইলো বউমার ভাই লাগে ”
আরহাম ছোট এক নিশ্বাস ছাড়ল।বলল,”কাউকে দিয়ে সেহেরের লাগেজ গাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করুন ”
“আইচ্ছা ”
খালা ভেতরে চলে যায়।এমন সময় পানি কিছু পরার সজোরে আওয়াজ হয় । আরহাম পুকুর পাড়ের দিকে ছুটে যায়।বাঁশের সাঁকোর সামনে দাঁড়ায়। অনেকটা হাঁপিয়ে গেছে। এই গা কাঁপা শীতে আরহাম থর থর ঘামছে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। শীতকাল হওয়ায় পুকুরের পানি অনেকটাই নিচে।কুয়াশায় কালো অন্ধকারে ঢাকা। সামান্য দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছেনা।গাছপালায় ঘেরা চারিদিক। দূর অজানা থেকে বেনামী পাখির কুহু ডাক ভেসে আসছে। আরহাম সামনের দিকে ছুটে যায়। সাঁকোর মাথায় সেহেরের ওড়না মিলল।আরহামের ভয় আরো বাড়ল।তবে কি সেহের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে? সেহের তো সাঁতার জানে না! আরহাম প্রাণহীন হয়ে থপ করে সাঁকোতে বসে পড়ে।আশেপাশের কোন শব্দ তার কান অবধি পৌঁছায় না। সেহেরের উড়না বুকে জড়িয়ে অনুভূতিহীন নিষ্প্রাণ বসে থাকে।মাথা পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।হ্ঠাৎ কিছু মনে পড়তে জোরে সেহের বলে চিৎকার দিয়ে উঠে।নির্জন শব্দহীন পুকুরপাড় হুড়মুড় কেঁপে উঠে। আরহাম চল জলদি উঠে সেহেরকে খোঁজতে পুকুরে ঝাঁপ দেয়।হিম শীতল ঠান্ডা পানিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগে। কোথাও সেহের নেই!
আরহাম নিজে মধ্যে নেই। পাগল পাগল হয়ে সেহেরকে খোঁজছে । জোর গলায় চিৎকার করছে আর সেহেরকে ঢাকছে।
“এই রাতে গোসল করতে পুকুরে নেমেছেন? পানি প্রচণ্ড ঠান্ডা সর্দি লেগে যাবে। ”
হ্ঠাৎ- ই পেছন থেকে আলতো মিষ্টি স্বর ভেসে আসে।চিরচেনা সেই আওয়াজে আরহাম তড়িৎ বেগে ঘাড় ফিরে তাকায়। সেহের সাঁকোর মাথায় দাঁড়িয়ে ।আরহাম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে।ঘোর কাটতেই দেরী না করে উপরে উঠে আসে।হুট করে সেহেরকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়।বুকের ভেতর জ্বলন্ত আগুন নিভল ।এক চিলতে হিম শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেল।অনেকটা সময় ভেজা শরীরে আরহাম সেহেরকে বুকে জড়িয়ে রাখল।সেহের নড়চড় করল না।চুপ থাকল।হ্ঠাৎ আরহামের কিছু একটা মনে পড়তে সেহেরের বাহু ধরে সামনে দাঁড় করাল। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,”এইসব কি ঢং শুরু করেছ বাড়ি ছাড়ছ ,ডিভোর্স নিচ্ছ! কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরোনোর সাহস পাও কি করে ?পাখা গজিয়েছে? উড়তে চাও? সকাল থেকে কুকুরের মত শহতের এক কোণা থেকে অন্যকোনা অবধি ছুটে বেড়াচ্ছি।তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছি ।এসব গায়ে লাগে না? সবাইকে এমন হয়রানি করে বেশ আনন্দ লাগছে? ”
সেহের চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা নত করে ঠক ঠক কাঁপছে।আরহাম হাত টেনে সামনের দিকে এগোতে এগোতে ভারী স্বরে বলে,”বাড়ি চলো ”
সেহের থেমে যায়।হাত ছাড়িয়ে আগের মত মাথা নত করে আমতা স্বরে উত্তর দেয়,” আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল । ঐ বাড়িতে যাবো না ,আপনার সাথে থাকবো না। আজই চিটাগাং ফিরে যেতাম কিন্তু সকালে জানতে পারি বাবা দেশের বাহিরে ফিরতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে তাই যাওয়া হয়নি! ”
সেহেরের কথায় আরহামের আবার মাথা বিগড়ে গেল।সব কিছু শান্ত ভাবে সামলাতে চেয়েছে । কিন্তু সেহের মাটি কামড়ে জিদ ধরেছে সে আরহামের কোন কথাই মানবে না। আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”ভালোয় ভালোয় বলছি বাড়ি চলো”
সেহের দু কদম পিছিয়ে ঝাঁড়ি দিয়ে বলে,”বলেছি ত যাবো না।কেন যাবো আপনাদের প্রেমলীলা দেখতে? আমাকে আমার মত থাকতে দিন এখান থেকে যান প্লিজ! ”
কথা শেষ করে আরহামের দিকে তাকাতে সেহের কেঁপে উঠে।অদ্ভুত হিংস্র চাহনি।এমন হিংস্র চাহনি সেহের বিয়ের পরদিন বিকালে দেখেছিল ।তবে কি আরহামের মাঝে দ্বিতীয় সত্তা জেগেছে? সেহের আরহামের এমন ভয়ংকর রূপ দেখে কেঁপে উঠে। ভয়ে ঢোক গিলে।আস্তে আস্তে পিছনের দিকে পিছাতে লাগে। আরহামও সেহেরের দিকে হিংস্র চাহনি নিয়ে এগিয়ে আসছে।পিছতে পিছাতে সেহের সাঁকোর মাথায় দাঁড়িয়ে। আরহামও তার মুখোমুখি আরেক কদম পিছনে বাড়ায় ঝোঁক সামলাতে না পেরে পিছনের দিকে পরে যেতে নেয় ।সাপোর্টের জন্য আরহামের কুর্তি ধরে ফলস্বরুপ আরহাম সহ পুকুরে পরে।হিম শীতল বরফ ঠান্ডা পানিতে সেহের হাবুডুবু খাচ্ছে আরহাম স্থির চোখে তাকিয়ে । সেহের সাহায্যের জন্য সজোরে আরহামের নাম ধরে ডাকে। মুহূর্তে আরহামের জ্ঞান ফিরে দ্রুত সেহেরের দিকে এগিয়ে যায়।
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৭

কনকনে শীতের রাতে ঘন কালো কুয়াশা চারদিকে ঘেরা।পুকুর পাড়ে বড় গাছটার নিচে আরহাম সেহের শুয়ে। বরফ শীতল পানিতে ভিতে গায়ের কাপড় শরীরের সাথে ল্যাপটানো ।শীতে দুজনের বেহাল অবস্থা । সেহেরের একটু বেশিই।চোখ মুখ সাদা হয়ে আছে। শরীর বরফ টুকরোর মত ঠান্ডা।শীতের প্রবলতায় দাঁতের সাথে দাঁত বাড়ি খেয়ে কটকট শব্দ হচ্ছে।দুজন ভারী নিশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে । সেহেরের বুকটা ধুকধুক করছে।আজ মরতে মরতে বেঁচেছে । সাঁতার না জানায় পানিতে তার ভীষণ ভয় ছোট থেকে কোন দিন পানিতে নামার সাহস করেনি ।আরহাম না থাকলে আজ নির্ঘাত পুকুরে ডুবে মরণ হতো ।আটলান্টিক মহাসাগরের পানি থেকেও বেশি ঠান্ডা এই পুকুরের পানি ,এখন বুঝছে টাইটানিকে থাকা মানুষ গুলোর কতটা যন্ত্রণা দায়ক ভয়ংকর মৃত্যু হয়েছিলো। সেহের ঘাড়ের উপর শুয়েই হাত মুখে লেগে থাকা কাদা ঝাড়তে শুরু করে।আরহাম সেহেরের দিকে শুয়ে তিরস্কার স্বরে বলল,”আমাকে ছাড়া ঠিক ভাবে এক কদম চলার মুরদ নাই ,সে নাকি আবার আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে! ”
সেহের মুখ ভেংচি কাটল। আরহাম টান দিয়ে সেহেরকে নিজের কাছে আনে। নিজের সাথে মিশিয়ে শক্ত করে গাল চেপে বলল কাঠখোট্টা স্বরে বকে ,”কি আমাকে ভালোবাসো না? আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে? ”
সেহের কোন প্রত্যুত্তর করল না। টলমল চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ জলে টইটুম্বুর।আরহাম গাল ছেড়ে দিলো ।সোজাসুজি উঠে দাড়িয়ে সেহেরকে কোলে তুলে নিলো। বড় বড় পা ফেলে আশ্রমের দিকে অগ্রসর হলো।

এই তীব্র শীতের রাতে দুজন ভিজে একাকার । রাতও ভীষণ গভীর হয়ে এসেছে। এতো রাতে সেহেরকে নিয়ে এই গ্রাম্য পথে বের হওয়া ঠিক হবে না।তাই আরহাম আজকের রাতটা এখানে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।দোতলা বাড়ির উপরের এক স্টোররুমের পাশের কামরাটা খালি। দুপুরের দিকে সেহেরকে এখানে আসতে দেখে সেহেরের থাকার জন্য খালা ঘরটা আগে থেকেই পরিষ্কার করে রেখেছে।যেন সেহেরেরসামান্যতম অসুবিধে না হয়।আরহাম সেহেরকে নিয়ে সরাসরি ঐ ঘরটায় উঠল।সেহের কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে জড়সড় ভাবে আরহামের সামনে দাড়িয়ে । ঠকঠক করে কাঁপছে। আরহাম সেহেরের কাঁপুনি দেখে গম্ভীর স্বরে বলল,”ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও ,আমি গাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে আসছি ”
আরহাম যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে সেহের পেছন থেকে আরহামের হাত আটকে নেয় করুন স্বরে বলে,” প্লিজ ,আমাকে একা রেখে যাবেন না।জায়গাটা নিরিবিলি ভীষণ ভয় করছে। অন্যকাউকে আনতে বলুন। ”
আরহাম ভ্রু কুঁচকে সেহেরের দিকে তাকাল।হাত ছাড়িয়ে ফোন করে কাউকে লাগেজ নিয়ে আসতে বলল।মিনিট পাঁচেক পর দরজায় নক পড়ল। দারোয়ান লাগেজ নিয়ে এসেছে। সাথে একটা ব্যাগ ।সেহের লাগেজ থেকে কাঁপড় বের করতে করতে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত কতে বলল,” এটায় কি? ”
“আমার কাপড় ”
“বাড়ি থেকে সাথে করে এনে ছিলেন? ”
আরহাম সেহেরের বোকামো কথায় ক্ষীণ চোখে তাকিয়ে থাকে। সামান্যতম কমন সেন্স কি মেয়েটার মাঝে নেই? কাঠ কাঠ স্বরে বলল,” রিয়েলি সেহের? বাড়ি থেকে কাপড় আনতে যাবো কেন ! আমি কি আগের থেকেই জানতাম ,এখানে এসে হাঁড় কাঁপা শীতের রা্তে আমাকে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে নাকানিচুবানি খেতে হবে? এগুলো দারোয়ানকে দিয়ে পাশের গ্রামের বাজার থেকে আনিয়েছি …….কোন রকম বাড়ি অবধি যেতে পারলেই হয়”
আরহাম শেষের কথাটা বিরবির করে বলল।সেহের মুখ কালো করে নিলো । সুন্দর সোজাসুজি উত্তর দিলে কি এমন হয়? কিন্তু সেহেরের বেশ আনন্দ লাগছে। অল্প সময়ের জন্য হলেও আরহামকে বেশ জব্দ করতে পেরেছে ।সেহের কথা না বাড়িয়ে কাপড় গুছিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ।

বিশাল আকাশে ইয়া বড় এক চাঁদ । চাঁদের এক ফালি জ্যোৎস্নায় আলোকিত চারিদিক । কুয়াশা ঘেরা জ্যোৎস্না মাখা রাত। বাড়িটা অনেকটা স্কুল রুমের মত । রুমের সামনে বড় বারান্দা ।চাঁদের চাঁদনিতে পুরো বারান্দা আলোকিত ।পুরানো আমলের কাঠের কারুকাজ করা রেলিং।হালকা ছোঁয়াতে নড়বড় করে । এতো বছরের অনাদরে অযত্নে ঘুণে খেয়েছে।দোতালায় তেমন কেউ নেই। বাচ্চারা সহ বাকিরা সবাই নিচেই থাকে।দোতালার একপাশ থেকে অপরপাশে তাকালে মনে হয় অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।হালকা আওয়াজে ও গাঁ ছমছমে উঠে। বাড়িটায় ভৌতিক ভৌতিক একটা ভাব আছে। সেহের ছোট এক ঢোক গিলে কথা গুলো ভাবল ।ফ্রেশ হয়ে আরহামের অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে।মিনিট দশেক আগে লোডশেডিং হয়েছে।এই অন্ধকারে রুমে একা থাকার মত সাহসী মেয়ে সেহের নয়।লোডশেডিং হতেই সেহের লাফিয়ে বাহিরে চলে এসেছে।আরহাম ওয়াশরুমে ফ্রেশ হচ্ছে। আরহাম বের হয়েছে কি না! সেহের বারবার পিছন ফিরে চাইছে।গায়ে পাতলা শাল জড়ানো , ভেজা চুলের পানিতে পিঠ ভিজে।চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরে গায়ের কামিজটাও ভিজছে।বেখেয়ালি সেহেরের কি সেদিকে খেয়াল আছে? আচমকা পেছন থেকে কারো স্পর্শে সেহের কেঁপে উঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আরহাম তয়াল হাতে দাড়িয়ে। সেহেরের চুল মুছে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে,”কেয়ারলেস ”
কথাটা সেহের কান অবধি ঠিক পৌঁছাল।কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া করল না।মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকাল ।আরহাম পেছন থেকে সেহেরের মুখের দিকে তাকাল।মেয়েটাকে ভীষণ মোহিত লাগছে। চোখ ফেরানো কষ্ট সাধ্যি । চন্দ্রকিরণ সৌন্দর্য আরো হাজার গুন বাড়িয়ে দিয়েছে।তীব্র শীতে গাল লাল হয়ে আছে।ভারী ভারী আঁখিপাতা গুলো দূর আকাশের পানে।চোখে মুখে অন্যরকম এক সরলতা। দূর আকাশের চাঁদটা যেন জমিনের চাঁদটাকে হিংসে করছে তাইতো বারবার মেঘের আড়ালে মুখ লুকাতে চাইছে । আরহামের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মোহিত মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে।সেহের হীন এই আরহাম প্রাণহীন।আরহামের অস্তিত্বে প্রত্যেক শিরা শিরা রক্তবিন্দুতে সেহের মিশে।
খানিক বাদে সিড়ি বেয়ে কারো উঠার শব্দ কানে আসতে আরহামের ঘোর কাটে। সেহের আরহাম থেকে দূরে সরে যায়।দুজনের চোখ সিড়ির দিকে। খাবার নিয়ে দারোয়ান এসেছে।নিচে থেকে খালা পাঠিয়েছে । খাবারের ট্রে থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই রান্না করেছে।আরহাম ভেতরে রাখতে বলল।দারোয়ান টেবিলের উপর খাবার রেখে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিচে চলে যায়।আরহাম বলল,”ভিতরে চলো ডিনার করবে ”
সেহের আগের মত সামনের দিকে ফিরে কাঠখোট্টা স্বরে উত্তর দিলো ,”খাব না ,আমার খিদে নেই ”
আরহাম বেশ কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,”জিদ করার পরে করিও ,এখন ভিতরে চলো খাবে। সারাদিন কিছু খাওনি! ”
“আপনার সমস্যা কোথায়? আপনি শুনতে পাননি? বলেছি তো আমি খাবো না ,”
সেহের জোরগলায় বলল। আরহাম কোন কথা না বলে জোর করে সেহেরকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। সেহের নামতে চাইলে আরহাম আরো শক্ত ভাবে চেপে ধরে। রুমে নিয়ে বিছানার উপর ধপ করে ফেলে। সেহের কোমড় ধরে বাঁকিয়ে আহ করে আর্তনাদ করে উঠে।ব্যথাটা বুঝি একটু বেশিই লেগেছে! সেহের ব্যথাতুর আর্তনাদ আরহামের কান অবধি পৌঁছায় না।আরহাম ভয়ংকর রেগে।সেহের কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার পূর্বেই আরহাম চিৎকার করে বলতে শুরু করে,”চুপ একদম চুপ! আর একটাও আওয়াজ নাহ।”
আরহামের হুংকারে সেহের কেঁপে উঠে । জড়সড় ভাবে বসে থাকে।আরহাম খাবার সার্ভ করে খেতে বললে সেহের ত্যাড়ামো করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে।আরহাম বিরক্তি ভারী নিশ্বাস ফেলে সেহের কাছে যেয়ে জোর করে খায়িয়ে দেয়।প্রথমদিকে সেহের মোচড়ামুচড়ি করলেও আরহামের ধমকের প্রকট আওয়াজে ভয়ে খেতে লাগে।অশ্রুভারাক্রান্ত ভারী চোখে সেহের আরহামের দিকে তাকিয়ে । মনে উথালপাতাল ঢেউ ছুটছে । চাপা অভিমান গুলো বুক চিড়ে অশ্রুধারা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেহের কোনরকম নিজেকে চেপে রেখছে। আরহামের সামনে কাঁদবে না।একদম কাঁদবে না! কাঁদবে- ই বা কেন? আরহামকে নিজের মায়ায় জড়াতে? এই মায়ায় জড়িয়ে কি লাভ। আরহামের মন প্রাণ জুড়ে সবটাই তো মিহি । তার সেই বাচ্চা প্রেমিকা । শুধু মাত্র সেহেরের মায়ায় জড়িয়েছে বলেই আরহাম মিহির কাছে যেতে পারছে না। মায়ায় পরে দয়া দেখিয়ে বারবার সেহেরের কাছে আসছে। চাইনা এই ঠুনকো দয়া । অন্যের দয়ায় আর যাই হোক সংসার হয় না। ভালোবাসা হয় না। সেহের উদাসীন মনে কথা গুলো ভাবল ।এসব ভেবে সেহের আরহাম থেকে দূরে সরতে চাইলে। আরহাম কোমড় চেপে সেহেরকে নিজের কাছে আনতে চাইল।কোমড়ে হাত পড়ায় সেহের আবারো ব্যথাতুর স্বরে আর্তনাদ করল।আরহামের সন্দেহ হলো।কোমড়ের চোট দেখতে চাইলে সেহের সরে গেল।মাথা নিচু করে কাঠ কাঠ স্বরে বলল,”আমার কাছে আসবেন না। আপনার স্পর্শ আমার অসহ্য লাগে ”
আবারো আরহামের মাথা বিগড়ে যায় । সেহেরের দিকে রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে ।পাশের বড় মাটির ফুলদানীটা সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।সাথে সাথে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চারদিকে ফুলদানীর অংশগুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।সেহের কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া করে না। আরহাম রাগে বড়বড় পা ফেলে রুমের বাহিরে চলে যায়। বারান্দায় দাড়িয়ে কাঠের রেলিং এ দুই তিন বার লাথি মেরে রাগ দমানোর চেষ্টা করে ।পকেট থেকে সিগারেট বের করে। কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট জ্বালিয়ে দূর আকাশের পানে উদাসীন চোখে তাকিয়ে শূন্যে বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ে।

চলবে…..❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here