বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি পর্ব ২০+২১+২২

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২০

বাহিরে ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ ।সোনালী আলো গুলো তির তির করে অন্ধকার ঘরটায় আলো ছড়াচ্ছে ।এসির পাওয়ার তখনো ষোলতে।পুরো ঘর হিমাগারের মত ঠাণ্ডা।আরহাম মাথা চেপে বিছানায় উঠে বসে।মাথাটা চিনচিনিয়ে ব্যথা করছে।সেহেরকে পাশে না পেয়ে পুরো রুমে চোখ বুলাল।কোথাও নেই! ঘড়িতে সবে সাতটা দশ।এতো সকাল সকাল সেহের কোথায় যেতে পারে? আরহাম ভাবল!
খানিকক্ষণ বিছানায় বসে নিদ্রালস ভাব কাটিয়ে ফ্রেশ হতে উঠে পড়ে।ব্রেকফাস্টের পূর্বে সেহেরের দেখা মিলল না।অফিসের জন্য রেডি হয়ে নিচে নামতে সেহেরের দেখা মিলল।দাদী মায়ের সাথে টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে।পরনে সুনীল রাঙা কুর্তি।রক্তিম লাল ওরনাটা একদিকে ঝুলছে ।এলোমেলো শিশির ভেজা চুল গুলো চুয়ে চুয়ে পানি ঝরছে।ঠিক যেন স্নিগ্ধতায় মোড়ানো অপরাজিতা!
আরহাম সিড়ি বেয়ে নামার সময় পলকহীন ভাবে সেহেরের দিকে তাকিয়ে রইলো।মুহূর্তে সব খারাপ লাগা মাথা ব্যথা কোথাও মাথা গুজল।অদ্ভুত এক ভালো লাগা অন্তর ছুঁয়ে গেল। প্রতিটা সকাল এমন সুন্দর স্নিগ্ধকর হলে আর কি চাই? এমন সকাল হাজারবার চাই ,অন্তত কাল চাই!
আরহাম টেবিলে এসে বসতেই সেহের দাদীমায়ের আড়ালে যায়।দুজনের চোখাচোখি হতেই সেহের লাজুক হাসে। জুস আনার বাহানায় কিচেনের দিকে পা বাড়ায় । সকাল থেকে এ পর্যন্ত সেহেরের কাছে কয়েকবার ডাক পাঠিয়েছে। কিন্তু সে আসেনি । প্রত্যেকবার বাহানায় এড়িয়ে গেছে। আরহাম স্পষ্ট বুঝল সেহের তাকে ইগ্নোর করছে।কিন্তু কেন? রাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কি?

সবাই একত্রে নাস্তা করছে। সেহের আরহাম থেকে বেশ দূরত্ব রেখে দূরে এক চেয়ারে বসেছে।লজ্জা মিশ্রিত ভীতু চোখে আড়ে আড়ে বার বার আরহামের দিকে তাকাচ্ছে।মুখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে আরহাম ব্রেকফাস্ট করছে।সেহের কোনরকম নাস্তা সেড়ে নিজের রুমে চলে যায়।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যেই বাড়ির বাহিরে পা দিবে এমন সময় মালিহা খানমের ডাক পড়ে।সেহের থেমে যায়।মালিহা খানম ভারী স্বরে জিগ্যেস করে,”কোথায় যাওয়া হচ্ছে? ”
সেহের মুচকি হেসে উত্তর দিল,”ভার্সিটিতে ”
“একাই যাচ্ছ? লিয়া যাচ্ছে না! ”
“নাহ,লিয়ার ওয়াহিদ ভাইয়ার সাথে বের হবে।”
মালিহা খানম কিছু একটা ভেবে বলল,”একা যেতে হবে না। আরহাম ভার্সিটিতে ছেড়ে আসবে ”
মালিহা খানমের কথায় সেহের চমকায়।বড় বড় চোখ করে ততক্ষণাত বলল,”না দাদীমা ,তার দরকার নেই। আমি যেতে পারবো।শুধু শুধু উনার কষ্ট হবে! ”
“বাড়ির বউ একা বের হবে? তাছাড়া সেফটিরও একটা ব্যাপার আছে। ”
“কিছু হবে না ,আমি ম্যানেজ করতে পারবো !”
“আরহাম ছেড়ে আসবে ,আর কোন কথা না ”
“কিন্তু…”
সেহের সুর টেনে এতোটুকু বলতেই মালিহা খানম থামিয়ে দিলো।ভারী গলায় বলল ,”আরহামের যাচ্ছ,ব্যস! কোন কথা শুনতে চাই না! ”
সেহের মায়া মায়া পিটপিট চোখে মালিহা দিকে তাকায়।আরহাম পাশে ছিল।সেহের মালিহার পুরো কথোপকথন শুনছিল কিন্তু এমন ভাব করল যেন কিছুই শুনেনি।
সেহের কোন উপায় না পেয়ে রাগে গাল ফুলিয়ে গাড়িতে আরহামের পাশের সিটটায় বসল।আরহাম সেহেরকে এভাবে জব্দ হতে দেখে মুচকি হেসে গাড়ী স্টার্ড করল। মালিহা দূর থেকে তাদের দেখে মুচকি হাসল।আরহাম সেহেরের সম্পর্ক অনেকটা আগুন পানির মত।একজন জ্বলন্ত আগুন হলে অন্যজন সচ্ছ সরল জল।আরহামকে ক্ষান্ত রাখার জন্য সেহেরকে প্রয়োজন।সেহেরের প্রতি আরহামের ভালোবাসা আকাশ চুম্বী।আরহামের ভালো থাকার জন্য সেহেরের ভালোবাসাটাও প্রয়োজন!

গাড়ী তার নিজ গতিতে চলছে।সচ্ছ আকাশে রক্তিম সূর্য চিকচিক করে আলো ছড়াচ্ছে ।বাহিরের ভাপসা গরম হাওয়া গাড়ীর স্প্রিডের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরেধীরে শীতল হচ্ছে। সেহের মুখের সামনে উল্টো বই ধরে আরহামের থেকে লুকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।গায়ে জড়ানো রক্তিম ওরনাটা সামান্য জানালা মাড়িয়ে হাওয়ায় দুলছে।আরহাম সেহেরকে ওরনা গোছাতে বলল ।সেহের না শোনার মত করে চুপি হাতে ওড়না টেনে আবার মুখের সামনে বই ধরল। আরহাম পুরো ঘটনাটা লক্ষ করে মিটমিট করে হাসল।
আরহাম গাড়ী চালাতে চালাতে স্বাভাবিক স্বরে বলল,”সকাল সকাল গোসল করার লজিকটা ঠিক বুঝলাম না। আমার যতটুকু মনে পড়ে গতরাতে আমাদের মাঝে কিছু হয়নি! সত্যি বলতো তুমি কি আমার ঘুমানো সুযোগ নিয়েছ? মানে ঐসব আরকি ……”
আরহামের কথা শুনে সেহেরের হাত থেকে ঠাস করে বইটা পড়ে ।সেহের তড়াক করে ঘাড় ঘুরিয়ে বড়বড় বিস্মিত চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহামের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি।সেহের তখনো থমকে।আরহাম সেহেরের অবাক হওয়া দেখে বলল,”এতো হাইপার হচ্ছ কেন? ইট’স নরমাল। সুযোগ নিলে নিতেও পারো । এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে তোমার পাশে শুয়ে ।তুমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।এতো কাছাকাছি কিছু একটা ঘটতেই পারে।আগুন আর বারুদ পাশাপাশি সর্বনাশ হবে না,তা কি হয়? ”
সেহের রাগে জিদে কথা বলতে ভুলে গেছে।এই মুহূর্তে আরহামের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।বেশ কিছুক্ষণ রাগে ফোঁসফোঁস করে।রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে কিন্তু কোনভাবেই হচ্ছে না।নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে চেঁচিয়ে বলে,”আমি আপনার সুযোগ নিবো? আমি? দরকার হলে সারাজীবন সন্ন্যাসিনী হয়ে কাটাবো তবুও আপনার সাথে ঐসব …….মানে ….মানে…”
“আমার কাছে আসবেনা না তাই তো! ”
আরহাম কথা কেটে বলল।সেহের সাই দিয়ে উঁচু গলায় বলল,”হ্যাঁ তাই! আপনার কাছে আসবো না।হুহ! ”
আরহাম মুচকি হেসে উত্তর বলল,”কত দিন দূরে পালাবে? ঘুরেফিরে আমার বক্ষ নীড়েই তোমায় ধরা দিতে হবে।”
সেহের ভেংচি কেটে মুখ বাঁকা করে উত্তর দেয়,”হুহ ,এমন কোন দিন হবে নাহ! ”
আরহাম বাঁকা হেসে ড্রাইভিং এ মন দিলো।গাড়ীতে পিনপতন নীরবতা।অনেকটা সময় কাটল।অনেকক্ষণ ধরে সেহেরের মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করছে।জিগ্যেস করবে কিনা না নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।মনকে বুঝাতে না পেড়ে নীরবতা ভেঙে বলল,”একটা কথা জিগ্যেস করবো? ”
“হুহ ”
“গতরাতে কি ঘটেছিল?স্বপ্নে এমন কি দেখেছেন যে এতোটা ভয় পেয়ে গেলেন! ”
আরহাম হুট করে গাড়ী ব্রেক কোষল ।অপ্রস্তুত ভাবে সেহের সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।পেছনের চুল মুখের উপর এসে পড়ে।সেহের চুল গোছাতে গোছাতে ভীতু চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম থরথর কাঁপছে।চেহারায় ভয়ের ছাপ।খানিক পূর্ব অবধি সব ঠিক ছিল ,হুট করে আরহামের এভাবে ভয় পেয়ে যাওয়া বেশ চমকায়।আরহাম সিটে গা এলিয়ে চোখ বুঝে বসে আছে। কিছু জিগ্যেস করতে যেয়ে সেহের থেমে যায়।আরহাম নিজ থেকে ভারী স্বরে বলল,”জানি না কি ছিলো।চারদিকে অনেক আগুন কয়েকটা অচেনা মুখ।তারপর …….উফফ ভাবতে পারছিনা।মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ”
আরহাম শেষের কথা গুলো কাতর স্বরে বলল।সেহের আরহামের যন্ত্রণা দেখে আর কিছু বলল না।বুকের কোথাও ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।চুপচাপ ব্যথাতুর চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল।আরহাম অনেকটা সময় নিয়ে স্বাভাবিক হলো। সোজাসুজি উঠে বসে গাড়ি স্টার্ড দিলো ।সেহের তখনো আগের দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকিয়ে।আরহাম গাড়ি চালাতে চালাতে বেখেয়ালি স্বরে বলল,”কিছু বলবে? ”
সেহের কাচুমাচু স্বরে বলল,”আজ বাড়ী থেকে না বের হলেই বোধহয় ভালো হতো।আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। ”
“উহু আমি ঠিক আছি! ”
“তবুও…”
সেহের সুর টেনে এতোটুকু বলল।আরহাম প্রত্যুত্তরে কিছু চুপ রইল।গাড়ী ভার্সিটির সামনে থামতে সেহের নামতে চাইলে ।আরহাম হাত টেনে কাছে আনল।কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে বলল,”ক্লাস শেষে অপেক্ষা করো ,নিতে আসবো! ”
সেহের নত মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়াল।লাজুক স্বরে বলল,”আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন”
আরহাম আরেকবার কপাল ছুঁয়ে মুচকি হাসল।সেহের ধীরেধীরে গাড়ি থেকে নেমে ভার্সিটির গেটে দিকে পা বাড়াল । আরহাম সিটে হেলান দিয়ে মুচকি হেসে আদুরে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল!

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২১

সেহের ক্লাস থেকে ফিরেছে অনেকক্ষণ।বিকাল মাড়িয়ে সন্ধ্যা হলো বলে।খানিক পূর্বে দিশা বাড়ি ফিরেছে।সেহের তখন দোতালার বারান্দায়।গাড়ীর শব্দ পেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকাল।দিশাকে নামতে দেখে এক চিলতে হেসে নিচ তালার সিড়ির দিকে পা বাড়ায়।এতোটা সময় মায়ের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। আজ অনেকদিন মায়ের সাথে ঠিকঠাক কথা হয়না।বিয়ের কথা চলাকালীন সময় থেকে সম্পর্কে একটা গ্যাপ চলে এসেছে। মাও আগের মত তেমন কথাবার্তা বলেন না।যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন। হয়তো সেহেরের উপর রেগে আছেন।হওয়াটাই স্বাভাবিক ।সেহের না বুঝে না জেনে মাকে অনেক আজেবাজে বলে দিয়েছে।সব কিছুর জন্য উনাকে দায়ী করে গেছে।নিজের ভুল গুলোর জন্য সেহের ভেতরে ভেতরে ভীষণ অনুতপ্ত।তাই আজ মায়ের কাছে সেদিনের করা খারাপ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইবে।এসব ভাবতে ভাবতে সেহেরের দিশার রুমের সামনে যেয়ে দাড়ায়।দরজা ভিড়ানো ।দুবার নক করে ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসছে না।সেহের ছয়নয় না ভেবে ভেতরে ডুকে পড়ে।বারান্দায় দিশার ছায়া দেখা যাচ্ছে।সেহের ভাবল মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চমকে দিবে।আলতো পায়ে চুপিসারে বারান্দার দিকে পা বাড়ায় ।বারান্দার চৌকাঠে পা রাখতে সেহের থমকে যায়।

“হ্যাঁ ,হ্যাঁ আমি মানছি আমিই তোমাকে আরহাম আর সেহেরের ভিডিও ভাইরাল করতে বলেছি।এর বিনিময়ে যত টাকা চেয়েছ, দিয়েছি। এরপরও কেন বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করছ?
প্রাণের ভয় কি তোমার নেই? ভুলে যাচ্ছ কার সাথে কথা বলছ? ”

…………………………………

“মূর্খ, তুই আমাকে আরহামের ভয় দেখাচ্ছিস? আরহাম বিয়ের আগেই সব জেনে গেছে।এর পর আমাকে ফোন করলে সোজা জেলে ঢুকাব। এমন অবস্থা করবো প্রাণ ভিক্ষা চাইবি! ”

দিশা ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে বলল।অপর পাশে ব্যক্তিটা হয়তো ভয় পেল।দিশা ফোন কেটে রাগে গরগর করতে করতে পিছন ফিরে চাইল।সেহেরকে দেখে ছিটকে গেল।সেহের দিশার দিকে ঘৃণা মিশ্রিত অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে।দিশা সেহেরের দিকে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ভীতু স্বরে বলল ,

“সেহের মা ,আমার কথাটা শুনো …আ..আমি ….

“দূরে যাও ,তোমার এই নোংরা হাতে আমাকে ছুঁবে নাহ! ”

সেহের একপা একপা করে পিছনের দিকে পিছচ্ছে।দিশা কান্নারত স্বরে বলল,
“প্লিজ শান্ত হও! আমার কথাটা একবার শুনো।আমাকে বলার সুযোগ দেও ”
সেহের দিশার হাত ঝাড়ি দিয়ে চিৎকার করে বলে ,
“কি শুনবো আমি? কি? তোমাকে দেখলে আমার ঘৃণা হয় ,জাস্ট ঘৃণা! নিজের লাভের উদ্দেশ্য সবার সামনে নিজের মেয়ের মান ইজ্জত এভাবে টেনে খুললে! এসব করার আগে একবার তোমার বুক কাঁপল না? ছিঃ এতো নিকৃষ্ট তুমি।”
এতোটুকু বলেই সেহের কান্নায় ভেঙে পড়ে।অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বলল,
“ছোট থেকে তোমার অবহেলা পেয়ে বড় হয়েছি। জন্মের পর বাবা হাতে তুলে চলে এসেছ।তোমার নতুন জীবন গুছিয়েছ ।অবহেলা অনাদরে বড় হয়েছি।মায়ের একটু খানি ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বেহায়ার মত তোমাকে ফোন করেছি। বহুবার কান্নায় ভেঙেছি ,কিন্তু আমার কান্না শোনার মত তোমার সময় হয়নি।বরাবরের মতই আমাকে ইগনোর করে গেছ।কেন আমার প্রতি তোমার এতো ঘৃণা । কি দোষ ছিল আমার? কেন আমার জীবনটা এমন রংহীন হলো! বলতে পারো? …….তোমার জন্য।সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। ক্লাস এইটে যখন তোমার কাছে আসলাম নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল আমি তোমার সাজানো গোছানো সংসারে বেহায়ার মত চলে এসেছি । লিয়াকে দেখে প্রচণ্ড হিংসে হত।কারণ বাবা মায়ের শতভাগ ভালোবাসা ও পাচ্ছিল।কিন্তু আমি? আমি সর্বদা একা ছিলাম।না আমার সাথে বাবা, ছিল না মা।
কারো কোন আদর আহ্লাদ ছাড়া একা বেড়ে উঠেছি।জীবনের কঠিন সময় পাড় করেছি।যখন বিপদে পরে তোমার কাছে ঠাই নিলাম ,তুমি আমার সাথে এই করলে? আমার জীবনটা এভাবে শেষ করে দিলে? নিজ স্বর্থে আমাকে ব্যাবহার করলে! ছিঃ পুরো শহরের সামনে এভাবে আমার মান ইজ্জত নষ্ট করলে! এর বরং আমাকে মেরে ফেলতে।”
সেহের মাটিতে হাঁটু গেড়ে কান্না করছে।দিশা সেহেরের সামনে বসে কান্না করতে করতে বলে,”হ্যা আমি তোমাকে একা ছেড়ে এসেছি।তোমাকে এড়িয়ে চলেছি এর কারণ শুধুমাত্র তোমার বাবা। তোমাকে দেখলে বুকের গাঁ গুলো জেগে উঠত। আমাকে তিলেতিলে শেষ করত।তাই বলে আমি তোমাকে কখনো ঘৃণা করিনি।শুধু মানুষিক প্রশান্তির জন্য তোমার থেকে পালিয়ে বেঁচেছি ।কিন্তু ভেতরে ক্ষণে ক্ষণে আমিও অনুতাপের আগুনে পুড়েছি ।আমি যা করেছি তোমার ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য করেছি। চাকচিক্য সুন্দর জীবন তুমি ডিজার্ভ করো।সীমাহীন সুখ ডিজার্ভ করো।আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না।প্লিজ আমাকে বুঝার চেষ্টা করো । ”
সেহের অশ্রুঝরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল।বলল,”কেন এমন মিথ্যা বাহানা দিচ্ছ? আমি জানি তুমি এসব কেন করেছ।আমার এসব চাকচিক্য কৃত্রিম সুখ চাই না।শুধু ভালোবাসা চাই।যা তুমি কোন দিন বুঝবে না। তুমি আমার মা নও।একজন ক্ষমতা লোভী নেত্রী মাত্র । ক্ষমতার লোভে তুমি সব সীমানা ভাঙতে পারো ।প্রথমে নিজেকে বিক্রি করেছ এবার আমাকে করলে। হেইট ইউ ।…. আই হেইট হউ! ”
সেহের কান্না করতে করতে দিশার রুম ছেড়ে বের হয়ে যায়।সেহেরের যাওয়ার দিকে দিশা নিরাশ পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল।সন্তানের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার মত বেদনা দায়ক অন্যকিছুতে নেই ।

দিনের আলো ফুরিয়ে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসছে।চারদিকে অন্ধকার নেমে।আরহাম বাড়ী ফিরল বরাবর নয়টায়।চেহারায় একরাশ ক্লান্তি আর রাগ নিয়ে।আজ সারাদিন কাজের চাপ ছিল প্রচুর।এতো ব্যস্ততার মাঝে সেহেরকে ফোন করেছে কিন্তু সেহের একবারের জন্য রিসিভ করেনি।উল্টো সন্ধ্যার পর থেকে ফোন সুইচঅফ।আরহামের মাথা পুরোপুরি ভাবে বিগড়ে । মেয়েটা এতো কেয়ারলেস কেন? কেন এমন অবুঝের মত আচরণ করে! আরহাম দাদীমা মায়ের সাথে দেখা করে নিজের রুমের দিকে বড় বড় পা ফেলে।ঘরে ঢুকতে আরহাম চমকে যায়। পুরো রুম অন্ধকারে ঘিরে আছে। আরহাম সেহেরকে কয়েকবার ডাকে কিন্তু প্রত্যুত্তরে কোন সাড়াশব্দ নেই।সেহেরের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আরহাম ঘাবড়ায়। তড়বড়ে সুইচ অন করে। পুরো রুমে চোখ বুলায় কোথাও সেহের নেই।আরহামের ভয় বাড়ে।রুমে ডিভানের পাশে যেতে নিভৃত কান্নার স্বর ভেসে আসে।আরহাম দ্রুত পায়ে ডিভানের পিছনে যেতেই থমকে যায়।সেহের মাটিতে বসে হাঁটুতে মাথা গুজে ডুকরে কাঁদছে।আরহাম কাঁপা কাঁপা হাত সেহেরের কাঁধে রাখতে সেহের ভয়ে ছিটকে উঠে।চোখ মুখ ফুলে রক্তিম হয়ে আছে।গাল এখনো অশ্রজলে ভিজে।আরহাম কিছু জিগ্যেস করবে তার পূর্বেই সেহের আরহামের বুকে আঁচড়ে পড়ে।বুক ফাটা চিৎকারে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আরহাম শক্ত ভাবে সেহেরকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে? এভাবে কান্না করছ কেন! ”
সেহের ধ্যান ফিরতেই আরহাম থেকে হুট করে দূরে সরে যায়। কান্না জড়িত গলায় বলে,”আপনিও আমাকে ছুঁবেন না। আপনারা সবাই এক । ঠক মিথ্যুক মুখোশ ধারী! ”
আরহাম বিস্মিত স্বরে জিগ্যেস করে,”আমি কি জানতাম? তুমি এসব কি বলছ? ”
“আর কত অভিনয় করবেন? আর কত? কেন আপনি জানতেন না ভিডিও দিশা খানম ভাইরাল করেছে? সব জেনে শুনে আমার জীবন কেন নষ্ট করলেন??আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি! কেন এমনটা করলেন! ”
“সেহের তুমি ভুল বুঝচ্ছ।আমি এসব কিছু….”
আরহামকে থামিয়ে সেহের ভারী গলায় বলল,”আর কত মিথ্যা বলবেন? এবার অন্তত এসব বন্ধ করুন।আমি আপনাদের এই মরিচীকাপূর্ণ চাকচিক্যময় পরিবারের অংশ হতে চাইনি।আমাকে কেন ব্যবহার করলেন? আমার এসব থেকে রেহাই চাই। প্লিজ আমাকে মুক্তি দিন। প্লিজ! ”
সেহের মাটি থেকে উঠে ব্যাগ গোছাচ্ছে । পাগলের মত আচরণ করছে। এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর পড়ছে। যেন সে নিজের মাঝে নেই।আরহাম সেহেরকে বোঝানো চেষ্টা করে । কিন্তু সেহের কোন কথা শুনতে নারাজ।আরহাম সেহেরের হাত ধরে আটকায়। সেহের হাত ছাড়িয়ে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বিরবির করে বলে ,”যেখানে মিথ্যা,বেইমানীর বসবাস সেখানে আমি এক মুহূর্ত থাকব না।আমার হাত ছাড়ুন ।ছাড়ুন বলছি! ”
আরহাম সেহেরের কথায় ভীষণ রেগে যায়। শক্ত করে হাত টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে ভারী স্বরে বলে,”আই কান্ট! আই কান্ট লিভ উইথ আউট ইউ । ”
সেহের মাথা তুলে ড্যাবড্যাব চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে।আরহামের ক্রুদ্ধতায় ভরা রক্তিম চোখ।সেহের বিরবির করে বলে ,”আই হেইট ইউ ,হেইট ইউ”
আরহাম সেহেরের কথায় তোয়াক্কা না করে। শক্তভাবে বুকের সাথে জড়িয়ে চোখ বুঝে মাথায় চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,”বাট আই লাভ ইউ ”
কথাটা কি সেহেরের কান অবধি পৌঁছায়? হয়তো শুনেছে ! হয়তো না । বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২২

সেদিনের পর সেহের পুরোপুরি পাল্টে গেছে।আরহামের জিদের কাছে তাকে নত হতে হয়।এ বাড়ি থেকে আর যাওয়া হল না। মানুসিক অশান্তি নিয়ে উদাসীন দিন পাড় করতে লাগে।একদম ঘরকুনো সেহের বন্ধুবান্ধব ভার্সিটি সকল কিছু থেকে নিজেকে ধীরেধীরে বিচ্ছিন্ন করছে।আজ কাল ঠিক মত ক্লাস এটেন্ড করছে না। আগের মত হাসছে না । কারো সাথে কথা বলছে না। সারাক্ষণ নিজেকে ঘরবন্ধী করে রাখছে।যে যা বলছে শব্দহীন ভাবে সবার সব কথা মানছে ।মানুষ না যেন যন্ত্রচালিত কোন বস্তু।আরহাম সেহেরের মাঝে গড়ে উঠা বন্ধন কোথাও যেন কোন অদৃশ্য দেয়ালে বাঁধা পড়েছে। সেহের বরাবরের মত আরহামেকে এড়িয়ে চলে।আরহাম বার কয়েক বার সেহেরের সাথে কথা বলে আব কিছু সমাধান করতে চেয়েছে ।কিন্তু সেহের কোন কিছু শুনতে নারাজ।আরহামের উপস্থিতি যেন তাকে পীড়া দেয়। সেহেরের এই পরিবর্তনে আরহামের ভীষণ রাগ হয়। এই উদাসীন সেহেরকে তার চাই না। আরহাম তার আগের সেই হাসি উজ্জ্বল প্রাণবন্ত সেহেরকে চাই।
সময় তার তার নিজ গতিতে চলছে ।অনেকটা সময় পাড় হয়েছে।ঋতু তার রঙ পাল্টেছে।প্রকৃতি বর্ষার আগমনে তাথৈ তাথৈ নাচছে।এর মাঝে অনেক মন্ত্রী বাড়ির ফ্যামিলি বিজনেসে অনেক পরিবর্তন এসেছে।কম্পানিতে দিশার শেয়ার গুলো নিয়ে নেওয়া হয়েছে।রাজনৈতিক দিক থেকেও দিশা সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছে।আশরাফ খাঁন কোন প্রকার সহযোগিতা করবেন না। এর পেছনে যে আরহামের হাত রয়েছে তার বুঝতে দিশার খুব একটা সময় লাগেনি।সেহেরেকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি স্বরূপ এসব তার প্রাপ্য তা তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন।সেহের তার মাকে বরাবরের মত এড়িয়ে চলছে। মুখোমুখি হলেও পাশ কাটিয়ে চলে যায় যা দিশাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেয়। সন্তানের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার মত শাস্তি দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই । মালিহা সেহেরের মনে আরহামের প্রতি ভালোবাসা জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রত্যেকবার তা বিফলে যাচ্ছে।সেহের তার মনকে শিলা পাথরের মত শক্ত করে রেখেছে ।

শ্রাবণ মাস শেষদিকে।বর্ষার হুটহাট বৃষ্টিতে প্রকৃতি মেতে।সেই ভোর সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। শীতল আবহাওয়া।জানালার কাঁচে বৃষ্টির বড়বড় মোহর লেগে। সেহেরের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে।নিদ্রালস ভাব কাটিয়ে তৈরি হয়ে নিচের দিকে পা বাড়ায়।আরহাম অনেক আগেই বেরিয়েছে ।হয়তো অফিসের উদ্দেশ্য রওনা ও হয়ে গেছে।সেহের বাড়ির সাজগোজ দেখে বেশ চমকায়।টেবিলের উপর অনেক গুলো ফুলে বুকে কেক রাখা। অনেকরকম গিফট। বাগানের দিকটায় অনেক ভিড় দেখা যাচ্ছে ।এসব দেখে সেহের বিস্মিত চোখে আশেপাশে তাকায়। বাড়ির সদস্য থেকে শুরু করে কাজের লোক পর্যন্ত সবাই যে যার যার মত ব্যস্ত । শুধু সেহেরই ড্যাবডেবে তাকিয়ে । সবকিছু যেন তার মাথা উপর দিয়ে যাচ্ছে।কি হচ্ছে সেহের ছাড়া বাড়ির সবাই সবটা জানে । সবার মুখ দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে।ঘটনা জানার জন্য সেহের বাড়ির বৃদ্ধা কাজের লোকের কাছে জিগ্যেস করলে।বৃদ্ধা ভূত দেখার মত করে বেশ কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে তাকিয়ে রইল।বিস্মিত ভাব কাটিয়ে লতা খালা বলল,”কি কন আম্মা আফনে জানেন না , কি হইতাছে ? আইজকা আরহাম বাবার জন্মদিবস।”
লতা খালার কথা শুনে সেহের অবাক হলো সেই সাথে লজ্জাও পেল। সত্যি তো এই বাড়ি সদস্য হওয়ায় অন্তত এতটুকু জানাটা আবশ্যক ছিল।নামমাত্রই হোক আরহাম তার স্বামী তো! মনে মনে সেহেরের ভীষণ অনুশোচনা হলো।

দুপুর বারটার দিকে আরহাম প্রেস মিটিং শেষ করে রুমে পৌঁছায় ।সেহের তখন নিজেকে প্রস্তুত করছিল। আরহামকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে বলে।কিন্তু সেই সুযোগ আর মিলল না।আরহাম রুমে প্রবেশ করে সেহেরকে তাড়া দিয়ে বলল,”দ্রুত রেডি হয়ে নেও আমরা বের হবো! ”
সেহের ভ্রু কুঞ্চিত করে আরহামের দিকে চাইল ।আরহাম সেহেরের দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে আবার বলল,”দ্রুত তৈরি হও ,উই আর গেটিং লেট ”
সেহের আরহামকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করল না।বিছানা ছেড়ে কাবার্ড থেকে শাড়ী বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।আরহাম রেডি হয়ে নিচে চলে গেল।সকাল থেকে একটার পর একটা ফোন কল রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত সে।ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে শত শত নোটিফিকেশন ।আরহাম হল রুমের মাঝবরাবর সোফায় সেহেরের অপেক্ষায় বসে।মাথাটা ধরে আসছে।তা কাটানোর জন্য স্ট্রং করে বানানো কফির মগ হাতে ।এতে যদি সামান্য কমে!
কফির মগে চুমুক দিয়ে আনমনে সিড়ির দিকে তাকাতে আরহাম থমকে যায়।চোখ গুলো সিড়ির দিকে আটকে যায়।কালো শাড়ীতে তার হৃদরানী দাড়িয়ে।দুধেআলতা গায়ের রঙের সাথে কালো রঙটা ফুটে আছে।স্মোকি আইজ।গোলাপি ঠোঁট । কোমর পর্যন্ত লতানো চুল গুলো বাতাসে দুলছে । কানে সাদা পাথরের দুলগুলো চিকচিক করছে ।চেহারায় অন্যরকম এক মায়া ।মুহূর্তেই আরহাম অগোছালো হয়ে পড়ে।বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাড়ায়।কফির মগটা অনেক আগেই হাত থেকে ছিটকে পড়েছে। বুকে হাজার দফা ছুরি চলছে ।প্রণয় আঘাতে বারবার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আরহাম।এতোদিন শুনে এসেছে শোকের রঙ কালো ,আজ মনে হচ্ছে প্রেমের রঙটাও কালো হলে মন্দ হয় না!
সেহের আরহামের সামনে দাড়িয়ে নত স্বরে বলল ,”আমি রেডি ”
সেহেরের গলার স্বরে আরহামের ধ্যান ফিরে।ছোট এক নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে বলল,”হুম ,চলো ”

গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে।ইট পাথরের শহর মাড়িয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় নেমেছে ।চারদিকে সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছায়া।দূর থেকে অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। সেহের সিটে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ।পুরোপুরি প্রকৃতির সৌন্দর্যে ডুবে ।আরহাম গাড়ি চালানোর ফাঁকেফাঁকে আড়চোখে সেহেরকে দেখছে ।আজ অনেক দিন পর সেহেরের চেহারায় সেই আগের মত হাসি উজ্জ্বল চমক ।গাড়ি বড় ধবধবে সাদা বাড়ির সামনে থামল।উপরের সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লিখা “শান্তির নীড়”।সেহের ভ্রু কুঁচকে আরহামকে জিগ্যেস করে,”এটা কার বাড়ী? ”
আরহাম সামনের দিকে তাকিয়ে বলল ,”ভেতরে চলো জানতে পারবে ”
গাড়ী গেটের ভেতর ঢুকতে সেহের আরেকটা বড় গাড়ী দেখতে পেল। সেহের অবাক চোখে সবকিছু দেখছে। তাদের গাড়ী থেকে নামতে দেখে এক বয়স্ক জুটি তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো ।আরহামকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল।আরহাম হাসি মুখে ধন্যবাদ জানাল।বৃদ্ধা মহিলা আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,”বাবা বউমা নাকি ?”
আরহাম মুচকি হেসে বলল,”জি খালা”
বৃদ্ধার মুখে হাসি আরো প্রসারিত হলো। প্রফুল্ল স্বরে বলল,”মাশাল্লা মাশাল্লা ,একদম পরীগো লাহান”
সেহের এক চিলতে হাসল।আরহাম ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে জিগ্যেস করল,”বাচ্চারা কোথায়? ”
“পিছনের বাগানে তোমার লাইগা অফেক্ষা করতাছে। ”
আরহাম সেহেরের দিকে তাকিয়ে হালকা আওয়াজে বলল,”চলো ”
সেহের আরহামকে অনুসরণ করে তার পিছু চলল ।পিছনের বাগানে আসলেই দুজন চমকায়।পুরো বাগান রঙিন কাগজে সাজানো।সামনে সাদা কাপড় ফেলান বড় টেবিল টেবিলের উপর স্পঞ্জ কেক রাখা।কেকের উপর চকোচকো দিয়ে “হ্যাপি বার্থডে আরহাম ভাই ” লিখা। কেকটা দেখে মনে হচ্ছে হোম মেইড।হয়তো বাচ্চারা তৈরি করেছে।বাচ্চারা আরহামকে দেখতে জয়ের উল্লাসের আওয়াজ করে তার দিকে ছুটে আসে।আরহাম বাচ্চাদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আরহামের চেহারা খুশিতে চকচক করছে। সেহের দূর থেকে পলকহীন ভাবে আরহামকে দেখছে।বৃদ্ধার আওয়াজে সেহেরের ধ্যান ফিরে।বৃদ্ধা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,”জানি মা তুমি হয়তো ভাবতাছ এরা কে ,কারা! এরা আরহাম বাবার আরেকটা পরিবার। এই শান্তির নীড় আরহাম বাবার তৈরি।এই বাচ্ছা গুলারে দেখতাছ এগো মধ্যে কেউ কেই কোন না কোন রোগে আক্রান্ত । দুই দিনের মেহমান। কেউ কেউ হয়তো কালকের সূর্যটা দেহার নসিব মিলবো না।এরা সবাই পথ শিশু । এই সবাইরে আরহাম বাবা তার এই শান্তির নীড়ে জায়গা দিছে।তাগো ভরন পোষণের দায়িত্ব নিছে।প্রত্যেকেরে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে সব সুযোগ সুবিধা দিছে।আরহাম বাবা প্রায়ই এহানে আসে। নিজের বিশেষ বিশেষ দিন গুলা এই বাচ্চা গুলার সাথে থাকে।প্রতিবছর জন্মদিনে সারাদিন ওগো লগে কাটায়।এই বাচ্চাগো লাইগা আরহাম বাবা মানুষ না ফেরেশতা! ”
সেহের বৃদ্ধা খালার কথা শুনে ছলছল চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।আজ সেহেরের চোখে আরহামের প্রতি সম্মান কয়েক শত গুন বেড়ে গেছে।মনের মাঝে কালো মেঘের ছায়া অনেক আগে কেটে গেছে।নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে।সেহের কোনপ্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে । ছয় নয় না ভেবে আরহামের দিকে ছুটে যায়।হুট করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান্না করতে লাগে।সেহেরের এমন কাজে আরহাম থমকে যায়। সেহের বুকের জমে থাকা সুপ্ত অভিমান গুলো অশ্রুধারা হয়ে গলে পড়ছে। আরহাম বিস্মিত চোখে তাকিয়ে জিগ্যেস করে ,”কি হয়েছে কাঁদছ কেন? এনিথিং রং? ”
সেহের নাক টানতে টানতে না সূচক মাথা নাড়ায়।আরহাম সেহেরের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”তাহলে কাঁদছ কেন? ”
সেহের যথাসাধ্য কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে,”হ্যাপি বার্থডে ”
সেহেরের এমন বোকামিতে আরহাম সহ বাচ্চারা ফিক করে হেসে দেয়।সবাই গাঁ কাঁপিয়ে হাসছে।সেহের লজ্জায় আরহামের বুকে মুখ লুকায়।

চলবে….❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here