বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি পর্ব ২৬+২৭+২৮

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২৬

নতুন এক দিনের সূচনা ।সোনালি রোদ গুলো জানালার মোটা কাঁচ ভেদ করে সুড়সুড় করে অন্ধকার ঘরে আলো ছড়াচ্ছে।দূর কোথাও ঘাসের উপর শিশির কণা ঝলঝল করছে। ঘুমন্ত শহর অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ছাড়ছে।সেহেরের মাত্র ঘুম ভাঙল।পাশ ফিরে ঘুম ঘুম চোখে আরহামকে দেখল।বিছানার মাথার সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে ,এক হাত সেহেরের চুলের ভাঁজে।নিশ্চিত সারারাত জেগে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল!
সেহেরের জ্বর এখন পুরোপুরি ছেড়েছে।গতরাতে গা পোড়া জ্বর ছিল।আরহাম সারারাত সেহেরের পাশে ছিল।জল পট্টি থেকে শুরু করে গা মুছে দেওয়া অবধি সব করেছে।সেহের অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিলো ,এসব কিছুর কোনটাই তার স্বরণে নেই।
সেহের আরহামকে কোনরকম বিছানায় শুয়িয়ে দেয়।আরহামের দাড়িতে আদুরে হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বিছানা ছাড়ে।আরহামের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে।চোখ খুলতে সামনের সব কিছু ঘোলা হয়ে যায়।শুধু কারো প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভাসে।সেহের মাত্র শাওয়ার নিয়েছে।ভেজা চুলে পিঠ ভিজে।লাল কামিজে সাদা পিঠ স্পষ্ট ফুটে।সেহের তয়লা ঝেড়ে চুলের পানি ছাড়াতে ব্যস্ত।জানালার স্বর্ণে মোড়ানো সোনালি রোদটা ড্রেসিংটেবিল ছুঁয়ে সেহেরের মুখের উপর পড়ছে।ঠিক যেন স্নিগ্ধতায় জড়ানো শিশিরস্নাত রক্তিম গোলাপ । আরহাম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।বিছানা ছেড়ে যন্ত্রের মত সেহেরের দিকে ধাবিত হচ্ছে।সে যেন নিজের বসে নেই।মনের কোণ থেকে গভীর এক আদেশ ,সেই আদেশে- ই যেন সে চলছে!
বেখেয়ালি সেহেরের তখনো চুলের পানি ঝাড়তে ব্যস্ত। আরহামের উপস্থিতি বিন্দু মাত্র টের পায়নি।হুট করে পেছন থেকে কেউ কোমড় চেপে ধরতে সেহেরের টনক নড়ে।চমকালেও বিন্দু মাত্র ভয় পেল না।মুচকি হাসল ,চোখ তুলে আয়নায় তাকাল।আরহাম সেহেরের ভেজা চুলে মিষ্টি ঘ্রাণে মজে।সেহের আয়নায় চোখে রেখে ,হালকা স্বরে বলল,
“ঘুম ভাঙল তবে! ”
পেছন থেকে কোন উত্তর এলো না।সেহের প্রশ্ন করল,”অফিসে যাবেন না? ”
এবারো কোন উত্তর মিলল না।সেহের কিছুটা সরে আরেকবার বলল,”আমি কিছু জিগ্যেস করছি”
এবার আরহাম মাথা তুলল।বিরক্তি ভরা পিটপিট চোখে আয়নায় সেহেরের দিকে তাকাল।যেন তার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজে সেহের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সেহের এক চিলতে হাসল।আরহাম ঘুমঘুম ক্লান্তি মাখা স্বরে বলল,”ভীষণ ক্লান্ত ,আজ নো অফিস ,আর তুমিও ক্লাসে যাচ্ছ না ।”
সেহের বলল,”আপনি অফিস যাবেন না তা না হয় বুঝলাম।কিন্তু আমি কেন ক্লাস মিস করবো? ”
” কারণ তুমি অসুস্থ ”
“আমি মোটেও অসুস্থ না,আমি একদম ফিট এন্ড ফাইন! ”
“তা যাই হোক তুমি ক্লাসে যাচ্ছ না ”
“কিন্তুইইই….”
“কোন কিন্তু না।আমি বলেছি তুমি যাচ্ছ না মানে তুমি যাচ্ছ নাহ! আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
আরহাম ধমকের স্বরে বলল। সেহের ধীরগতিতে মাথা নাড়ল।আরহাম দ্বিতীয় কোন কথা না বাড়িয়ে ধপধপ পা ফেলে ওয়াশরুমের চলে গেল।সেহের থম মেরে রইল।আরহামের হুট করে এমন রেগে যাওয়ার কারণ সে খুঁজে পেল না।আরহামের রেগে যাওয়াটা তার কাছে ভীষণ অযৌক্তিক মনে হলো ।খানিক পূর্বেই তো সব ঠিক ছিল।মুহূর্তে এমন কি ঘটল?
কফি নিয়ে রুমে আসতেই আরহাম ওয়াশরুম থেকে বের হলো।সেহের আরহামের হাতে কফির মগ দিয়ে চলে যেতেই আরহাম পেছন থেকে হাত টানল।সেহের থামল।আরহাম লক্ষ করল সেহের মন মরা হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে।সেহেরের মুখ তুলে কপালে গাঢ় এক চুমু এঁকে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে আলতো স্বরে বলল ,”আ’ম সরি,আমার ঐভাবে উঁচু গলায় কথা বলা উচিত হয়নি।”
সেহের চুপ।আরহাম ধপ করে সেহেরকে কোলে তুলে নিলো বিছানায় বসিয়ে । দুগালে হাত ছুঁয়ে বলল,”সম্পূর্ন বেড রেস্ট নিবে।বিছানা থেকে একপাও নিচে ফেলবে না ।কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে।তোমার সুস্থ থাকাটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট ”
সেহের “হ্যাঁ “সূচক মাথা নাড়ল।আরহাম মুচকি হেসে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,”গুড ,দ্যাটস মাই গার্ল! ”
সেহের গভীর চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল।এই আরহাম খানিক পূর্বের আরহামের মাঝে আসমান জমিন তফাৎ । আরহামের চোখে অন্যরকম এক আসক্তি অন্যরকম এক মায়া।যার অর্থ সেহের ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

সময় গতিশীল।নদীর মত নিজ গতিতে চলে।নভেম্বরের মাঝামাঝি । শীতের প্রবণতা তিরতির করে বাড়ছে।চারদিকে ঠান্ডার আমেজ ছড়াচ্ছে।সময়ের সাথে পাল্লা ধরে আরহাম সেহেরের সম্পর্কের গভীরতাও বাড়ছে।আজকাল সেহেরের মনের উপর কোন জোর খাটে না।হুটহাট আরহামের কাছে আসাতে আর আগের মত খারাপ লাগাটা কাজ করে না।বন্দি মনের জানালায় প্রণয়ময় দমকা হাওয়া ঝড় তুলছে ।অদৃশ্য দেয়ালটা ধীরে ধীরে মাটিতে মিশছে। সেই প্রথম দিকের সেই আবেগটা আবারো নতুন আবেশ ছোঁয়াচ্ছে।আস্তে আস্তে আরহামের প্রেমের হাঁটু গেড়ে বস হচ্ছে। আরহামের বুকে মাথা রেখে রাতের পর রাত কাটাতেও মন্দ লাগেনা।বরং এক অজানা ভালো লাগা কাজ করে।অপ্রকাশিত ভালোবাসাটা সেহেরকে আঁকড়ে নিয়েছে।

শহরের নামকরা এক নেতার বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ এসেছে।ছেলের বিয়ে।ঘটা করে আয়োজন করা হয়েছে।শহরে নামিদামি সব লোকেদের সেখানে আগমন।সেহের বারবার মানা করার সত্বেও তাকে আসতে হয়েছে।প্রত্যেকবারের মত আরহামের জেদের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। এতো মানুষের ভিড়ে সেহের ভীষণ অস্বস্তিকর অনুভব করছে।ভীতু মুখ করে এক কিনারায় দাড়িয়ে ।এসব পার্টিতে সে মোটেও অভ্যস্ত নয়।দূর থেকে আরহামকে দেখছে সবার সাথে কি সুন্দর ইজিলি কথা বলছে।এসব পার্টি অকেশন যেন তার জন্যই।সেহেরের এসবে কাজ কি? সেহেরের মাঝে মাঝে মনে হয় সে আরহামের যোগ্য নয়।যেমন সুন্দর সে দেখতে তেমন তার চলনবলন।প্রত্যেক কাজে বিশেষরকম এক এডিটিউড যা তাকে অন্যসবার চেয়ে বিশেষ বানায়। এই যে আজ চকলেট স্যুট পড়েছে কি দারুণ লাগছে। একদম চোখে লাগার মত । প্রত্যেকের চোখ ঘুরেফিরে আরহামে দিকে,এতো সুদর্শনের পাশে সেহেরকে কি মানায়? মনে এক কঠিন প্রশ্ন জাগল।এসব নিয়ে ভাবছে হঠাৎ পেছন থেকে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে তাকায়।উল্লাসিত স্বরে বলে উঠে,”তফির ভাই তুমি? ”
তফির এক গাল হাসল।মাথা দুলিয়ে বলল ,”হ্যাঁ আমি,কেমন আছিস তুই ”
“ভালো । তুমি কেমন আছ? আর ফুপি,অর্থি কেমন আছে? ”
“সবাই ভালো আছে।এবার বল তুই ঢাকায় কি করে? নিশ্চয় মামার সাথে । ঢাকা এসেছিস এবার জানালি না! ”
সেহের কিঞ্চিৎ হাসলো।তফিরের উত্তরে বলল,”বাবার সাথে আসিনি। ”
“এখানে কার সাথে এসেছিস? মামীর সাথে? ”
“না, আমার হাসবেন্ডের সাথে ”
“হাসবেন্ড ” কথাটা শুনে তফিরের মুখ চুপসে গেল।হাসি উজ্জ্বল মুখটা বুজে গেল।বলল,”হাসবেন্ড? তুই মজা করছিস তাই না? ”
“মজা করবো কেন।সত্যি ,হাসবেন্ডের সাথে এসেছি”
তফির থতমত গলায় বলল,”তুই সত্যি বিয়ে করে নিয়েছিস? ”
সেহের আমতা আমতা গলায় বলল,”সে অনেক কাহিনী । কিছু মনমালিন্য কারণে কাউকে জানানো হয়নি। ”
তফির অন্যদিকে তাকিয়ে ছোট এক নিশ্বাস ফিলল।বুকের কোথাও চিনচিন ব্যথায় হাহাকার করছে।জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,”অভিনন্দন ”
সেহের মুচকি হেসে উত্তর দিলো ,”ধন্যবাদ! এবার বল তুমি এখানে কি করে? এতোদিন কোথায় ছিলে? ”
“পুলিশের চাকরি কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই।এখানে ফ্রেন্ডের বিয়ে এটেন্ড করতে এসেছি। বর আমার স্কুল ফ্রেন্ড !”
“ওহ ,আচ্ছা তাই বলো”
সেহের তফির গল্প করছে যা আরহামের চোখ এড়ায়নি।দূর থেকে হিংস্র চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।তফিরের সাথে সেহেরের গল্প করাটা হয়তো আরহামের ভেতর সত্তার পছন্দ হয়নি।সেহেরের পাশে এসে দাড়িয়ে বাহু ধরে সেহেরকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।সেহের মাথা উঁচু করে এক চিলতে হেসে তফিরের সাথে আরহামের পরিচয় করিয়ে বলে,” ভাইয়া মিট মাই হাসবেন্ড আরহাম খাঁন , আরহাম উনি হচ্ছে তফির ভাইয়া আমার কাজিন”
আরহাম হ্যান্ড শেক করে।তফির মুখে কৃত্রিম হাসি রেখে বলে,”উনাকে কে না চেনেন,আরহাম খাঁন শহরের নামকরা পলিটিশিয়ানদের একজন ”
আরহাম কিঞ্চিৎ হাসলো।আরহাম সেহেরকে একত্রে দেখে তফিরের ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে।তফির তাড়া দিয়ে বলল,”অনেক রাত হয়েছে মা বাড়িতে একা আমার এখন বের হতে হবে ।আবার দেখা হবে আজ আসি ”
আরহাম বাঁকা হেসে গম্ভীর স্বরে বলল,”অবশ্যই,দেখা হবে! ”

ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলছে।আরহাম ড্রাইভ করছে। সেহের আরহামের কাঁধে মাথা হেলিয়ে আছে।গাড়িতে পিনপতন নীরবতা।আরহামকে চুপচাপ দেখে নীরবতা ভেঙে সেহের বলল,”আজ আমাকে কেমন লাগছে? ”
আরহাম চুপ।সেহের আবার বলল,” কি হলো? ”
আরহামের টনক নড়ে।চিন্তাজগত থেকে ফিরে সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলে,”কিছু বললে! ”
“এই ডিপ গ্রিন শাড়ীতে কেমন লাগছে? ”
আরহাম মুচকি হেসে বলল,”সবসময়ের মত , এঞ্জেল ।কিন্তু এই সৌন্দর্য শুধু আমার জন্য! আমি অবধি যেন সীমাবদ্ধ থাকে! ”
সেহের কথার গভীরতা না বুঝে এক চিলতে হেসে আরহামের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝে নিল।আরহাম হিংস্র ভাবে সামনে তাকিয়ে হাসে হয়তো কারো মৃত্যুর ছককাটা শেষ!

দুদিন পর সেহের হুট করে একদিন অর্থিকে ফোন করে।অর্থি থেকে জানতে পারে তফির হসপিটালে ভর্তি।গত রাতে গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে।প্রাণ না গেলেও ভীষণরকম আহত! হাত পায়ে বেশ চোট লেগেছে।
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২৭

সেই রাতের পর অনেক দিন কেটে গেলো।নভেম্বরের শেষদিক।শীতের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সন্ধ্যা নামতেই চারদিক ঘন কুয়াশায় ঘিরে যায়।এমনি এক রক্তিম বিকালে সেহের বারান্দায় দাড়িয়ে। সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেকটা সময়।নীল দিগন্তে রক্তিম সূর্যের উষ্ণ ছোঁয়া কমল আলো ছড়াচ্ছে।মৃদু ঠান্ডার আমেজ।সেহের মোটা শালটা আলতো ভাবে গায়ে জড়িয়ে রেখেছে।বারান্দা ফুল গাছ গুলো শীতল বাতাসে দুলছে।শীতের প্রবণতা গাছ গুলোকেও ছাড় দেয়নি । সোনালি খাঁচার বন্দি পায়রা গুলো কিচিরমিচির আওয়াজ তুলছে।সেহের মৃদু হেসে পায়রার সাথে খেলছে।এই কয়েকদিনে পায়রা দুটোর উপর ভীষণ মায়া জন্মেছে।এদের আহ্লাদী নামও দিয়েছে একটার নাম চন্দ্র, অন্যটা সূর্য।যা নিয়ে আরহাম সহ দাদীও বেশ হাসাহাসি করেছেন। আজকাল এদের সাথে সময় না কাটালে মন কেমন জানো অস্থির অস্থির থাকে।মনের অস্থিরতা মিটাতে দিনে অন্তত একবার হলেও এদের সাথে সময় কাটায়।পায়রা গুলোর নিষ্পাপ চোখ সেহেরকে কিছু একটা যেন বলতে চায়।তাইতো এতো বেশি ছটফটানি!
গতানুগতিক অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশ ছটফট করছে। পিঞ্জিরা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে।হয়তো বোবা প্রাণী মনে গগনপ্রান্তে ডানা ঝাপটানোর স্বাদ জেগেছে । পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সেহের মুচকি হাসলো।আগের মত সামনের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলল,”এসেছেন? দিন কেমন কাটল! ”
আরহাম কিঞ্চিৎ হেসে পেছন থেকে সেহেরের কোমড় চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো । সেহেরের মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,”ভীষণ ক্লান্ত ,রেস্ট করতে চাই ”
“হুম করুন ,ধরে রেখেছে কে? ”
“আমার সব রোগের ভেষজ যে তুমি,তোমাতেই আমার সব স্বস্তি! ”
সেহের আগের ভঙ্গিতে আরহামের বুকে গা হেলিয়ে মুচকি হাসে।আরহাম মাথায় চুমু দিয়ে শান্তস্বরে বলল,”মাথা ম্যাসেজ করে দিবে , রুমে চলো । ”
সেহের সোজাসুজি দাড়িয়ে যায়। আরহামের দিকে ফিরে ভেংচি কেটে বলে ,”উহু একদম না ,আমি জানি এখন রুমে গেলে আপনি দুষ্টুমি শুরু করবেন।তাছাড়া আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত।চন্দ্র সূর্যকে খাবার দিবো তাদের সাথে গল্প করবো! ”
আরহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”পায়রা গুলো আমার থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট? ”
সেহের আরহামকে রাগাতে মজার ছলে বলল,”হুম ,একদম”
কথাটা শুনা মাত্র আরহাম ভীষণ তেতে গেল।সেহেরের বাহু টেনে নিজের সামনে আনল ধমকের স্বরে শক্ত গলায় বলল,”তোমার জীবনে আমার থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট কিছু থাকতে পারবে না! নেভার এভার । ”
আরহামের রক্তিম চোখের ক্রুদ্ধ চাহনিতে সেহের কেঁপে উঠে।শুকনো ঢোক গিলে ছলছল চোখে আরহাম দিকে তাকায়।সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা আরহাম নয় ।যেন আরহাম রূপে অন্যকেউ!

দুদিন পর।ঠিক দিনের মাঝামাঝি।সেহের মাত্র ক্লাস থেকে ফিরেছে।মন বেশ ফুরফুরে । লাস্ট এক্সামের রেজাল্ট দিয়েছে।ভীষণ ভালো রেজাল্ট হয়েছে। সবাই যার যার ঘরে। আরহাম সেহেরের সাথে বেরিয়েছে।অফিস থেকে এখনো ফিরেনি।জানিয়েছে বাড়ি ফিরতে দেরী হবে।সেহের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।রুমের সামনে যেতে- ই উৎফুল্ল মনটা বুজে যায়।অজানা এক ভয় হানা দেয়।ভীতু পায়ে সেহের ভিতরের দিকে পা বাড়ায়।ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো । অগোছালো ঘরটায় থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে।নীরবতা ভেঙে বারান্দার সামনে ঝুলন্ত স্টিলের ওয়াল হ্যাংগিং টুংটাং শব্দ করে উঠে।আচমকা শব্দে সেহের কেঁপে উঠে।বুকের কাছে হাত রেখে সামনের ছোট নিশ্বাস ছেড়ে সারা রুমে চোখ বুলায়।রুমের বেহাল দশা।দেখে মনে হচ্ছে রুমের উপর দিয়ে ছোট খাটো ঝড় গেছে।সেহের চিন্তিত মুখ করে আছে।বিছানায় ব্যাগ রাখতে গিয়ে সেহের থেমে যায়।বারান্দা দিকে কুঞ্চিত ভ্রু করে তাকিয়ে থাকে। পায়রার কিচিরমিচির শব্দ মিলছে না। মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জাগে।সেহের তড়িঘড়ি করে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। দরজার সীমানায় দাড়াতে সেহের আঁতকে উঠে। চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়ে। রক্ত ভেজা নিথর পায়রা জোড়া মাটিতে পড়ে আছে।পায়রার রক্তে সারা ফ্লোর মেখে ।সোনালি পিঞ্জিরাটার দ্বার খোলা ।সেহের মাটিতে বসে চিৎকার করে কান্না করছে।নিজেকে কোনভাবে ঠিক রাখতে পারছে না।সেহেরের চিৎকারে পুরো বাড়ীর লোক জড় হয়ে গেছে।সেহের এক সময় নিজের জ্ঞান হারায়।

বাগানের পাশে ছাইরঙা ঘরটায় মালিহা খানম প্রবেশ করে। কয়েক পা যেতেই একটা রুমের সামনে দাঁড়ায়।দরজা মেলতে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরটার মেঝেতে লম্বালম্বি আলোর রেখা পড়ে।ভেতর থেকে কারো ভারী আর্তনাদ ভেসে আসে।মালিহা খানম ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে। আলো জ্বালাতে আরহাম চিৎকার করে উঠে ।
“আলো বন্ধ করো,বন্ধ করো এই অসহ্য আলো !এই আলো আমাকে পীড়া দিচ্ছে।ভীষণরকম যন্ত্রণা! ”
আরহামের এলোমেলো কথা গুলো গুলিয়ে যাচ্ছে।অসহ্য চিৎকারে পুরো ঘর থমথম করছে।আরহামের ব্যথাতুর স্বরে মালিহা দ্রুত লাইট বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বালায়।আরহামকে জড়িয়ে ধরে আরহাম চাপা চিৎকারে বলে,”বিশ্বাস করো দাদীমা আমি ইচ্ছে করে পায়রা গুলোকে খুন করিনি।কি থেকে কি হয়েছে আমি কিছু জানিনা! যখন আমার জ্ঞান ফিরে নিজেকে রক্তমাখা হাতে বিছানায় পাই।কি হয়েছে আমি কিছু জানিনা! আমার…..”
আরহাম আর বলতে পারছে না কথা গুলো আটকে আসছে। মালিহার কোলে মাথা রেখে আধো আধো স্বরে বলে,”আমি নিষ্পাপ জীবের প্রাণ কেড়েছি।বিশ্বাস করো আমি এমনটা চাই নি।আমি চাইনি সেহেরকে কষ্ট দিতে।নিজের আয়ত্বে আমি ছিলাম না। কি হয়েছে কোন কিছুই আমার স্মৃতিতে নেই।এ কেমন রোগ যা আমাকে দিয়ে নিষ্পাপ জীবের প্রাণ হরণ করে? সেহের আমার অসুস্থতার কথা জানতে পারলে ছেড়ে চলে যাবে।চলে যাবে আমাকে ছেড়ে! ”
আরহামের অসহায় আকুতি।মালিহা নাতির এমন অসহায়ত্ব সহ্য করতে পারছে না।চোখ জলে চিকচিক করছে। কোনরকম ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বলে,”এমন কিছু হবে না।সেহের কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাবে না। সে ঠিক তোমাকে বুঝবে। ”
আরহাম জানে তার দাদীমা তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে।আরহাম খাটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে রক্তমাখা হাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,”তুমিও জানো আমিও জানি এটা শুধু মিথ্যা সান্ত্বনা । আমি কোনদিন সুস্থ হবো না। আর এমন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের সাথে সেহের মোটেও থাকতে চাইবে না।আমার জীবন বরাবরই আমার কাছে এক অমীমাংসিয় রহস্য।জীবনের প্রতিটি পাতাই এলোমেলো।ছন্নছাড়া এক জীবন।স্মৃতি থেকে অনেকটা বছর পুরোপুরি মুছে গেছে। যা আছে তাতেও সব অগোছালো ।
ভালো হতো পাঁচ বছর আগে চিটাগাং সেই অনুষ্ঠানে তাকে না দেখতাম।তার প্রণয়ের আগুনে এভাবে না পোড়তাম।তার নিষ্পাপ সেই হাসি আমাকে মুগ্ধ না করতো তবে আজ হয়তো গল্পটা অন্য হতো।না এভাবে বিষাক্ত প্রণয় দহনে পুড়ে ছারখার হতাম।সেহের আমার নেশা ,আমার আসক্তি আমার আত্মার সাথে সে মিশে।প্রাণ থাকতে কোনদিন তাকে ছাড়তে পারবো না।তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব!
না সেহের কে পুরোপুরি নিজের করতে পারছি না তাকে ছাড়তে পারছি।ভয় হয় ভেতরের হিংস্রতা যদি কাবু করে সেহেরকে আঘাত করি?অজান্তে আমার সেহেরকে যদি চোট দিয়ে বসি? আজকাল সেহেরের আশেপাশে থাকতে আমার ভয় হয়।না জানি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কখন কি করে বসি ।সে আমার তবুও তাকে ছুঁয়ে দেখতে ভীষণ ভয় হয়। এই অসহ্য যন্ত্রণায় ক্ষণে ক্ষণে পুড়চ্ছি।আমার মুক্তি চাই । মুক্তি চাই! ”
আরহাম অস্থির স্বরে শেষের কথা গুলো বলছে।মালিহা আরহামকে জড়িয়ে ধরে কোনরকম শান্ত করে ।আরহামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”কিছু হবে না।সেহের কোথাও যাবেনা ।সব ঠিক হবে। তুমি সুস্থ হবে। ”

খটখট আওয়াজে গভীর রাতে সেহেরের ঘুম ভাঙে।অন্ধকার রুম জুড়ে আবছা নীল আলো।ভারী মাথা নিয়ে সেহের উঠে বসে। নিভু নিভ্য চোখে সামনের তাকিয়ে দেখে কাবার্ডের পাশে কারো প্রতিচ্ছায়া।বিছানার পাশে ল্যাম্পটা জ্বালাতে উজ্জ্বল রশ্মিতে ঘরটা ফুটে উঠে।আরহামকে প্যাকিং করতে দেখে সেহের আলতো স্বরে প্রশ্ন করে,”
কোথাও যাচ্ছেন? ”
আরহাম ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত স্বরে বলে,”হ্যাঁ কানাডা ।দুপুরে ফ্লাইট।সকালে বের হবো অফিসের কাজ সেরে সোজা এয়ারপোর্ট।”
আরহামের কথায় সেহেরের বুকে ভারী এক কষ্ট নাড়া দিয়ে উঠল।কেমন জানো এক অজানা ব্যথা। আজকে এতো বড় এক ঘটনা ঘটে গেলো আরহামের মাঝে এ নিয়ে কোন অনুভূতি নেই? সেহেরকে এমন অসুস্থ ফেলে আরহাম কি করে কানাডা যেতে পারে? সেহের গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল,”কত দিনের জন্য যাচ্ছেন? ”
“এখনো ঠিক হয়নি,কাজ শেষ হতে যতটা সময় লাগে । আরহামের আগের মত উত্তর ।
সেহের ছোট করে “ওহহ “বলল।আরহাম প্যাকিং শেষ করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সেহের ঠাই বিছানায় বসে।আরহামের এভাবে কানাডা যাওয়াটা সেহের কিছুতে মেনে নিতে পারছে না।বারবার চোখ ছলছল করে উঠছে।বেশ কিছুক্ষণ পর আরহাম ফিরে আসে।বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে,”অনেক রাত হয়েছে তোমার ঘুমানো উচিত! ”
বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বুজলো।সেহের আরহামের ব্যবহারে শকড ।বাড়ি ফেরার পর থেকে একবার ও সেহেরের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না।এড়িয়ে চলছে।কেন এমন করছে সে কি কোন ভুল করেছে? এসব ভাবতে ভাবতে আরহামকে পেছন থেকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে।পিঠের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কান্না ভেজা স্বরে বলে,”কেন এমন করছেন? কানাডায় কয়েকদিন পর গেলে কি হয়না! আমার আপনাকে প্রয়োজন ।খুব করে প্রয়োজন।প্লিজ যাবেন না! ”
আরহাম সেহেরের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,” আমাকে কাল- ই যেতে হবে।অনেক রাত হয়েছে ,এখন ঘুমানোর প্রয়োজন ।নয়তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
আরহামের কথায় সেহের দূরে সরে আসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাতভর অশ্রুবিসর্জন দেয়।
বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২৮

(পর্বটা ছোট হয়েছে ,সরি । গত রাতে ফ্যানের সাথে বাড়ি খেয়ে এক হাতের বেহাল দশা।হাত নাড়াতে পারছিনা । ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন )

প্রেম আর বিচ্ছেদ এর মাঝে সুক্ষ্ম এক তারের সংযোগ।আমরা তখনি কাউকে মিস করি যখন তাদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে।সে মানুষটা আমাদের জীবনে কতটা স্থান জুড়ে ছিল তা অনুভব করি।মনের গহীনে সস্নেহ স্থানে শক্ত ভাবে তাদের উপস্থিতি টের পাই।তখন ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যেকার তফাৎ স্বচ্ছ পানির মত চোখে সামনে ঝলমল করে উঠে। মনের আয়নায় সেই মানুষটার প্রতিচ্ছবি ঝলঝল করে কিছু একটা বলে বেড়ায়।
সেহেরের সাথেও তা হচ্ছে আরহামের গরহাজিরা মনের ভেতর খাঁই খাঁই করে পোড়াচ্ছে।প্রতিটি মুহূর্ত বছর সমান মনে হচ্ছে।এক সেকেন্ডের জন্যও আরহাম ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছেনা । জেগে ঘুমিয়ে শুধু আরহামকে ভেবে যাচ্ছে।ঘণ্টার পর ঘণ্টা আরহামের শার্ট জড়িয়ে কাটাচ্ছে ।খাওয়া দাওয়ায় ভীষণরকম অনিয়ম।নির্ঘুম রাত কাটচ্ছে। আজকাল আরহামের রুমটাও অস্বস্তিকর লাগছে।গুমোট এক অস্থির অনুভূতি।স্মৃতির দেয়াল গুলো যেন নিশ্বাস চেপে ধরেছে।চারদির আরহামের স্মৃতিতে পরিপূর্ন।এই বিছানা ,ড্রেসিং টেবিল,কাবার্ড সবকিছু ।মনের স্বস্তির জন্য সেহের রুম পাল্টেছে।দাদীমাকে বলে তার পুরাতন রুমে ফিরে গেছে।দিনরাত নিজেকে ব্যস্ত রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে।দিনটা কোনরকম ব্যস্ততার মাঝে কেটে গেলেও রাতটা ভীষণ দীর্ঘ হয়।অপেক্ষার অপ্রিয় রাত গুলো বুঝি এমনি অস্বস্তিকর হয়?

আজ এক সপ্তাহ আরহাম কানাডায় গিয়েছে।এই এক সাপ্তাহে হাতে গুনা দুইতিন দিন আরহাম সেহেরের খোঁজ নিয়েছে।তবুও যেন দায়ের পড়ে।আরহামের সাথে কথা বলার সময় বারবার সেহেরের গলার স্বর ভারী হয়ে এসেছে ।চোখ জোড়া বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় ভরে এসেছে।তা কি আরহাম টের পেয়েছে? হয়তো পেয়েছে! হয়তো বা নাহ। গত দুদিন আরহামের সাথে সেহেরের কথা হয়নি।সেহেরও জেদ করে ফোন দেয়নি ।আরহামের সাথে কথা না হলেও দাদীমা থেকে ঠিক খোঁজখবর নিচ্ছে।শুনেছে বেশ ভালো আছে তিনি। মিটিং,কাজে ব্যস্ত থাকায় ঠিকঠাক যোগাযোগ করতে পারছে না।সেহেরও আর কথা বাড়ায় নি।ভারী অভিমানে মুখ ভার করে রেখেছে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আগবাড়িয়ে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বেশি দূর টিকল না।গত রাতে কুস্বপ্ন দেখেছে ।তখন থেকে মন কু ডাকছে । আরহামের সাথে কথা বলতে ভীষণতর মন চাইছে ।ভোর সকালে ঘুম ভেঙেছে ।কুয়াশার চাদর কাটিয়ে এক ফালি আদুরে রোদ বারান্দার রেলিং মাড়িয়ে মেঝেতে উপচে পড়ছে।হাতে ধোঁয়া উড়া কফির কাপ নিয়ে সেহের বারান্দায় দাড়িয়ে।কানে ফোনটা টিংটিং রিং করছে।দুবার বাজতেই তৃতীয় বারের বেলায় ফোন ধরে।সেহের ‘হ্যালো ‘ বলার পূর্বে অপর পাশ থেকে কমল মেয়েলী স্বর ভেসে আসে।সেহের খানিকক্ষণ স্থির হয়ে থাকে।ঘোর কাটিয়ে শক্ত গলায় বলে,”আপনি কে? আরহাম কোথায়? উনার কাছে দিন! ”
অপর পাশের মেয়েটি মিষ্টি স্বরে বলল,”জি আমি মিহি ,আরহামের ফ্রেন্ড।আরহাম ঘুমাচ্ছে।ঘুম কাটলে আপনার ফোনের কথা জানাবো ।আপনি কে? ”
সেহের মেয়েটার কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না।হাতের ঘড়ির দিক চোখ বুলালো।সকাল সাতটা।বাংলাদেশের সাথে কানাডার সময়ের দশ ঘন্টা ব্যবধান।বাংলাদেশ থেকে দশ ঘণ্টা পিছিয়ে । তার মানে কানাডায় এখন রাত নয়টা।আরহাম এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে? আর এই মিহি মেয়েটাই বা কে? কই এর আগে কোন দিন মিহি নামক কোন ফ্রেন্ডের কথা তো আরহামের মুখে শুনেনি।ফোনের অপর পাশে মিহির ডাকে সেহেরের ঘোর কাটে।অপর পাশ থেকে মিহি বলে,”এক্সকিউজ মি! আপনি কে? ”
সেহের থমথমে আওয়াজে বলল,”সেহের ,উনার ওয়াইফ ”
মিহিকে দ্বিতীয় কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কাটল।সকাল পেড়িয়ে দুপুর ,দিন পেড়িয়ে রাতে পৌঁছায় আরহামের নাম্বার থেকে কোন ফোন আসলো না।আরো এক অপ্রিয় অপেক্ষার রাত কাটল।সেহের রাগ অভিমানে নিজেকে গুছিয়ে নিলো।মনে মনে অটল সিদ্ধান্ত নিলো আরহামের সাথে আর যোগাযোগ করবে না।মনে এক শক্ত অভিমান জমে। অভিমানটা ঠিক কিসের উপর তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। আরহাম ফোন না করায়? নাকি এতো রাতে আরহামের ফোন মিহি নামক মেয়েটার কাছে থাকায়!

ফিরা আইসা দেখবা তুমি
চইলা গেছি জগত ছাড়ি
পাইবা শুধু আমায় স্বপনে
চার বেহারার পালকি কইরা
যখন গেলা সামনে দিয়া
শেষ দেখাও দিলা না আমারে
ফিরা আইসা দেখবা তুমি
চইলা গেছি জগত ছাড়ি
পাইবা শুধু আমায় স্বপনে
তুমি কান্দিয়া ডাকিবা কভু না পাইবা
কান্দিয়া ডাকিবা আমারে
তুমি কান্দিয়া ডাকিবা কভু না পাইবা
কান্দিয়া ডাকিবা আমারে
লাল শাড়ি পরিয়া কন্যা
রক্ত আলতা পায়
আমার চোখের জল মিশাইলা
নিলানা বিদায়

কানে হেডফোন গুজে নদীর পাড়ে দাড়িয়ে শান্ত জলরাশিকে দেখছে।চোখ জোড়া জলে পরিপূর্ণ বুকে শত মণ ভারী কোন পাথর চাপা দিয়ে আছে।তিরতির কষ্টে বুকটা চিনচিন করছে।মন খারাপের দিনগুলোতে স্ফট স্যাড সং গুলো নি: সঙ্গতার সঙ্গী ।কোন এক যোগসূত্রে মনের ক্ষণ গুলোকে কিছুটা হলেও নিস্তার দেয়।আরো আটদিন কেটে গেছে ,আরহামের সাথে সেহেরের পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ।
আজকাল ক্লাস শেষে সেহেরের প্রতিটি বিকেল নদীর পাড়ে কাটে। শীতের প্রবণতা এখন আকাশ চুম্বী।কনকনে শীতে প্রকৃতি ঠকঠক কাঁপছে।সেহেরের গায়ে পাতলা শাল।খোলা কোমড় অবধি চুল গুলো হিম শীতল বাতাসে উড়ছে।এ কয়েক দিনে চেহারার চাকচিক্য কোথাও হারিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালি জমেছে।রাত জাগার কারণে হয়তো।ঠোঁট গুলো উষ্কশুষ্ক হয়ে আছে।শীতের এই কঠিনদশা তাকে কাবু করতে পারেনি।বেখেয়ালি ভাবে একাধারে নদীর জলরাশিতে চেয়ে।পেছন থেকে পিয়াল আওয়াজ করে বলল,”সন্ধ্যা নামছে ,বাড়ি ফিরবে না? ”
বেখেয়ালি স্বরে সেহের উত্তর দিলো ,”উহু,আরো কিছুক্ষণ থাকবো,তুমি যাও ।”
পিয়াল নিজের সাথে চলার জন্য সেহেরকে জোর করল।কিন্তু সেহের নাছোড়বান্দা যেতে নারাজ! পরে সেহেরের জেদের কাছে হার মেনে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

সেহের গভীর ভাবনায় ডুবে । আরহাম যে সেহেরকে এড়িয়ে চলছে তা সেহের ঠিক বুঝতে পারছে। ইচ্ছে করে আরহাম সেহের থেকে পালাচ্ছে । সেহেরের জীবনের কঠিন সমীকরণ মিলাতে ব্যস্ত ।কিন্তু কোনভাবে কোন সমাধান মিলছে না।বারবার এক কথায় থেমে যাচ্ছে সেহেরকে আদৌ কি আরহামে ভালোবাসতো? নাকি খানিকের মোহ ছিল। যা নেশা কাটতে- ই কেটে গেছে।আরহাম হয়তো এখনো তার প্রথম ভালোবাসাকে ভুলতে পারেনি।
নিজের উপর সেহেরের ভয়ানক রাগ হচ্ছে। কি দরকার ছিল জেনে শুনে মানুষটার প্রেমে পড়ার।কি দরকার ছিল কারো মায়ায় জড়ানোর! এককী জীবনে তো বেশ ভালো- ই চলছিল।এখন বুকভরা কষ্টের বোজা একা বইতে হচ্ছে।
দূর কোথাও মাগরিবের আজানের আওয়াজে সেহের ভাবনা কাটে।আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার নামছে।কুয়াশায় চারদিক ঘোলাটে হচ্ছে।নদীর পাড়ে খুব একটা লোকজন নেই। দুএকটা ঝালমুড়ি ফুসকা বিক্রেতা ভ্যান নিয়ে বসে। কিভাবে যে এতোটা সময় কেটে গেলো টের পায়নি । সেহের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।সকালেই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো।ইদানীং একা চলতে বেশ ভালো লাগে।
ফুটপাথের পথ ধরে হাঁটছে।শীতের তীব্রতা থেকে রেহাই পেতে লোকজন রাস্তায় আগুন জ্বলে উষ্ণতা লুটছে ।খানিক দূরে বৃদ্ধা বুড়িমা শীতের পিঠা বানাচ্ছে।যার মোহ মোহ ঘ্রাণ কুয়াশার ভাজে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে ।সেহের মিহি হেসে দূর পথ শিশুদের দিকে তাকিয়ে। শীতের দ্রঢ়িমা থেকে বাঁচতে মায়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে।সেহের ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।এদের উদ্দেশ্যহীন দুঃখময় জীবন সেহেরের অনিশ্চিত সুখকর জীবন থেকে অনেক সুন্দর।ভাবনা কাটিয়ে নিশ্বাস ফেলে সামনের দিকে পা বাড়াল ।আশেপাশে কোনো রিকশার দেখা মিলছে না।পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। অন্ধকার ফাঁকা পথ ধরে হাঁটছে আচকা অনুভব করলো কেউ তার পিছু নিচ্ছে । এ প্রথম নয় এর আগেও একই অনুভূতি হয়েছে। সেহের ঘাড় ফিরিয়ে দেখে কালো কাপড় পরা দুজন লোক তার পিছু নিয়েছে । সেহের পায়ের গতি বাড়াল ।বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে আগাচ্ছে ।এমন সময় সামনের থেকে এক প্রাইভেট কার অন্ধকার কুয়াশা বেদ করে সেহেরকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে ফেলে।ইটের সাথে বাড়ি খেয়ে মাথা থেকে গল গল রক্ত ঝরছে।সেহের ধীরেধীরে অচেতন হয়ে পড়ছে।চোখ গুলো নিভে আসছে। নিভু নিভু চোখে দূর থেকে সেই লোক গুলোকে ছুটে আসতে দেখল ।
সেহেরকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি কিছুটা দূরে থামল।হুডি পরা এক ব্যক্তি জানালা দিয়ে ঘাড় বের করে পেছনে চাইল । সেহেরের এ দশায় মুচকি হাসল।

চলবে …..❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here