বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব -০২

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ) ❌ ১৮+ এলার্ট
#মম_সাহা

পর্বঃ ২

সারা দুপুর অবিরাম বৃষ্টির পর প্রকৃতি শীতল কিন্তু গগন মশাই কি যেন একটা কারণে নিরেট মন খারাপ নিয়ে চুপটি করে আঁধার করে রেখেছে ধরার বক্ষ। বাতাসের বেগ প্রখর, সেই বেগের সাথে মাঝে মধ্যেই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির ছাঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে জনজীবনকে।

রূপমাধুরীর ঘরের জানালা খোলা কিন্তু ঘরের অভ্যন্তরীণ আলো নেভানো। বাহিরের সুদূরের ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোর অস্বচ্ছতা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তার ঘরের মেঝেতে। তাদের পল্লীটা বেশ বিরাট প্রাচীর ঘেরা এক আলিশান বাড়ি নিয়ে তৈরী। এই প্রাচীরটা পেরিয়ে গেলেই পুরো পৃথিবীটা। এই পল্লীটুকু পৃথিবীর বাহিরের কোনো নরককুণ্ড বলা যায়। যাকে দিনের বেলা ঘৃণা করে সমাজের বড়সড় ব্যক্তিবর্গ। অথচ রাতের আঁধারে এই ব্যক্তিবর্গের সুখ, শান্তি এখানেই। তাদের উৎসাহেই তো তৈরী এই নিষিদ্ধ নারীদের জীবন৷ তাদের জন্য ই তো তৈরী অলিতে গলিতে এই দোযখ। রূপমাধুরী দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে। জীবনটা এমন হওয়ার কথা ছিলো না, বিশ্বাস ভাঙার কথা ছিলো, প্রেমিকের হাত ধরে এই আঁধারে প্রবেশ করারও কথা ছিলো না। কিন্তু আজ না হওয়া জিনিস গুলোই ঘটছে। তাদের বিশাল উঁচু প্রাচীর ঘেঁষেই রাস্তা। রাস্তার বিপরীত পাশে একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা চা বিক্রি করেন, নাম আলী চাচা। খুব কমই আলী চাচার সাথে রূপমাধুরীর দেখা হয়েছে, কারণ একটাই, এই প্রাচীর দু’টো পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। ঐ পৃথিবী শুদ্ধতম আর এই পৃথিবী নোংরামো তে ভরা। এই পৃথিবীর মানুষদের, দিনের বেলায় ঐ পৃথিবী গ্রহণ করে না তবে রাত হলে এই পৃথিবীর নারীর পায়ের কাছে শুদ্ধতম পৃথিবীর পুরুষ বিড়ালের ন্যায়। রূপমাধুরী হাসলো, প্রথম প্রথম যখন এসেছিল এখানে, ভীষণ ছটফট করেছে ছাড়া পাওয়ার আশায়। মৃত্যু সন্নিকটে এলে যেমন করে একটা প্রাণী কাতরায়, ঠিক তেমন ভাবে কাতরিয়ে ছিল। ছুটে যেতে চেয়েছিল বহুদূর। কিন্তু পারে নি৷ তারপর কেটে গেলো বহুদিন। এখন আর সে ছটফট করে না, এখান থেকে ছুটেও যেতে চায় না, কারণ মৃত ব্যাক্তিদের যে এসব করার আর কোনো পথ থাকে না। আজ চাইলেই সে চলে যেতে পারে, কোনো বাঁধা নেই। ধরতে গেলে এই সাম্রাজ্যের রাণী তিনি। তাকে আটকে রাখার সাধ্যি কারো নেই। অথচ ভাগ্য তাকে আটকে ফেলেছে। তার শিকড় মাটির নিচে বহু পথ বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে। চাইলেও সে আর শুদ্ধতম পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না। তা অসম্ভব, তা অবাঞ্ছনীয়।

“আসবো, আপ্পা?”

বিজলির কথায় ধ্যান ভাঙলো রূপমাধুরীর। জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তা দরজার উপর স্থাপন করলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“কী কাজ?”

“পুনমের সাথে তো দেখা করতে চেয়ে ছিলেন তখন, ডেকে নিয়ে আসবো?”

“না। আমি যাচ্ছি। ও এখানে আছে, সেটা যেন কাক পক্ষীও টের না পায়। বুঝেছিস?”

বিজলি দৃষ্টি নত রেখেই ঘাঁড় নাড়লো। রূপমাধুরী আঁচলটা টেনে নিলেন পিঠ জুড়ে, ব্যস্ত পায়ে হেঁটে গেলেন পুনমের থাকা ঘরটার দিকে। এই পল্লীতে অনেক মানুষের শোরগোল থাকলেও কারো ব্যাপারে কারো ব্যস্ততা নেই। প্রতিটা মেয়ের ব্যস্ততা কেবল চওড়া দামে কাস্টমার হাতিয়ে নেওয়ার মাঝেই। তাই এখানে কাউকে মে রে পুঁতে ফেললেও কারো তাতে বিশেষ হেলদোল নেই। তাই পুনম নামের মেয়েটার খবর খুব সাধারণ ভাবেই লুকিয়ে রাখতে পেরেছে রূপমাধুরী।

বাড়ির একেবারের পেছনের দিকের লোহার দরজা বিশিষ্ট একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালে মাধুরী। দরজা টা বাহির থেকে আটকানো। ঘরটা বেশ পুরেনো আর অযত্নের। এদিকে দুই তিনটে ঘর রাখাই হয়েছে এমন অযত্নে। কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা প্রথম প্রথম এখানে এলে থাকতে চায় না, তখন তাদের এ ঘর গুলোতে আটকে রাখতে হয় এবং বিভিন্ন ভাবে মেয়েদের রাজি করানোর প্রক্রিয়া চলে। তাই এই রুম গুলো বিশেষ যত্ন করার প্রয়োজন পড়ে না।

রূপমাধুরী দাঁড়াতেই বিজলি ছুটে এলো। বেশ ধীরে দরজা টা খুললো। বাহিরে ততক্ষণে মুশলধারা বৃষ্টি ঝড়ছে। কোণায় কোণায় জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম আলোর ঝলক। কেবল আলো নেই ঘরটাতে। তুমুল আঁধারে ছেয়ে আছে চারপাশ। রহস্য যেন কাব্য লিখছে সেই আঁধারে বসে। বিজলি রূপমাধুরী কে পাশ কেটে ঘরে প্রবেশ করলো। আঁধার হাতরে কোনো মতে ঘরে বাতি জ্বালালো। মুহূর্তেই হলুদ রঙের নিভু নিভু বাতি কেমন ঝিলিক দিয়ে হাসলো ঘরটায়। নিভু নিভু আলোয় স্বচ্ছ হলো ঘরের ডান দিকের মেঝেতে বসা, সাদা পোশাকে আবৃত, শ্যামলা গড়নের একটি ছিমছাম মেয়ে হাঁটুর মাঝে মুখ ডুবিয়ে থাকা অবস্থায়। ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে সে নারীদেহ। হয়তো কাঁদছে। রূপমাধুরী নিজের উপস্থিতি জানান দিতে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই শব্দ করে রুমে প্রবেশ করলো। সে এমনই, যেখানে থাকে, সেখানে সবার দৃষ্টি তার উপর থাকতে হবে। চেহারা দেখে বয়স গননা করার উপায় নেই। দেহ একটু স্থুলকার হলেও চোখ মুখে যেন সদ্য যৌবনার ভাব। ঠোঁটে, মুখে সেই কী আকর্ষণীয়তা! মনে হয় হিন্দি কিংবা ইংরেজি সিনেমার কোনো চিত্রনায়িকা।

বিজলি ভরাট কণ্ঠে মেয়েটাকে ডাক দিলো,
“পুনম, আপ্পা আসছে তোর সাথে কথা বলতে। উঠ।”

পুনমের নড়চড় হলো না। রূপমাধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পুনমের দিকে। তা দেখে বিজলি আরও দ্বিগুণ সাহস পেলো,
পুনমকে টেনে তুলে সশব্দে চ/ড় বসিয়ে দিলো মেয়েটার গোলগাল গালে। শ্যামলা বা চাপা গায়ের রঙ দেখে চড়ের ভয়াবহতা বোঝা না গেলেও শব্দটা শুনে আঁচ করা যাচ্ছে ঠিক কতটা শক্তিশালী ছিলো সেটা। মেয়েটা তবুও হেলদোল দেখালো না। কেমন যেন একটা কাঠিন্য ভাব তার চোখ মুখে। বিজলি মেয়েটার ঘন, লম্বা চুল টেনে ধরলো, হিংস্র কণ্ঠে বললো,
“কিরে খা**, মা*, নাটকই যদি করবি তবে এসেছিস কেন এখানে? তোরে কী সাজিয়ে রাখার জন্য আমরা রাখছি এখানে? উঠ বলছি।”

ব্যাথাড মুখটা কালচে রঙ ধারণ করেছে। যন্ত্রণার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দু-চোখ ভরে। কিন্তু মেয়েটা চিৎকার দিলো না, হৈচৈ করলো না, ক্ষীণ স্বরে কেবল বললো,
“আপনি কী আমার একটু কথা শুনবেন?”

কথাটা সে রূপমাধুরীর উদ্দেশ্য করেই বললো। রূপমাধুরী ভ্রু কুঁচকালো, কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললো,
“বল, কী বলতে চাস?”

মেয়েটা শ্বাস ফেললো। তার চোখে মুখে ব্যাথার ছাপ গাঢ় হলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আপনি তো জানেন আমার প্রেগন্যান্সির তিন মাস চলছে। এই মুহূর্তে আমি এসবে কী করে যাবো বলেন?”

বিজলি জোরে ধাক্কা দিতে গিয়েও দিলো না। প্রেগন্যান্সির কথা মাথায় আসতেই সে চুল ছেঁড়ে দিলো। রূপমাধুরী চুপ থেকে বললো,
“কী করতে রাখবি এটা বল! ফেলে দে। মাস কয়েক হলো এসেছিস এখানে, তোর ভুলের জন্য এখন বাচ্চা টা তোর পেটে। এটার প্রয়োজন নেই আমাদের।”

“কিন্তু আমি চাচ্ছি রাখতে।”

মুখের উপর শক্ত জবাব দেওয়ার ফলে রেগে গেলো রূপমাধুরী। ভীষণ জোরে দু’টো চ/ড় বসালো মেয়েটার দু গালে। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“অত আহ্লাদীপনা দেখাতে হবে না। তোর এই পেটের খবর কেউ জানেনা, কাক পঙ্খী জানার আগে এটার ব্যবস্থা নিতে হবে।”

মেয়েটা ছুটে এসে পায়ে পড়লো রূপমাধুরীর। এতক্ষণে তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো অসহায়ত্ব। হয়তো সন্তানের জন্য ই সে অসহায়ত্ব। একজন মা পারে না এমন কিছু আছে? সন্তানের জন্য সে অগ্নি হতে রাজি, সন্তানের জন্য সে জলও হতে পারে। মেয়েটা রূপমাধুরীর পা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,
“অত পাষাণ হবেন না আপনি। আমি সন্তানটাকে চাই। আমি ওরে নিয়ে খুব দূরে চলে যাবো। আপনি আমায় দয়া করুন।”

রূপমাধুরী বিরক্ত হলো, যেই না লাথি দেওয়ার উদ্দেশ্যে পা তুললো, বিজলি সাবধানী কণ্ঠে থামিয়ে দিলো রূপমাধুরীকে৷ আমতা-আমতা করে বললো,
“আপ্পা, পেটে বাচ্চা আছে। ভুল জায়গায় লাথি পড়লে ও মা-রা যাবে।”

রূপমাধুরী পা থামিয়ে দিলো। পুনমের চোখে-মুখে একবার দৃষ্টি দিয়ে মুহূর্তেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বিজলিও ছুটলো পিছু পিছু। পুনম চোখ মুছলো। পেটে হাত রেখে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আপনি চলে আসুন না, আমরা অনেকদূর চলে যাবো। আপনি চলে আসুন।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here