বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব -০৩

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৩

শ্রাবণ মাসে প্রকৃতি আঁধার করে বৃষ্টি থাকাটাই বোধহয় স্বাভাবিক। বেলা গড়ানোর আগেই মনে হবে সূর্য ডুবে গেছে। চারদিক ভিজে চুপচপে থাকবে। পাতার কোণা গড়িয়ে শিশিরের ন্যায় জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়বে। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে, সময়টা ব্যস্ত শহরের রাত আটটা কিংবা নয়টা হবে। নতুন কিছু মেয়ে এসেছে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে। তাদেরই ভাগবাটোয়ারা চলছে। কে, কোথায়, কতক্ষণের জন্য থাকবে, কি করবে এসবই। তার মাঝে একজনকে নিজ দায়িত্ব তৈরী করাচ্ছে রূপমাধুরী।

সামনের মেয়েটির শরীরে সুগন্ধী মাখানোর ইশারা করে মুখের মাঝে আরেক খিলি পান গুঁজে নিলেন রূপমাধুরী। তার গোলগাল শরীরটা আরামে বিছিয়ে বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই নগরীতে এলি কীভাবে? কে তোর সর্বনাশের কারণ?”

মেয়েটি কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো রূপমাধুরীর দিকে। দৃষ্টি তার ভীত। কণ্ঠ দিয়ে বেরুচ্ছে না কোনো শব্দ। তা দেখে রূপমাধুরী খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,
“নাম কী তোর?”

“অঙ্গনা”

“আজ থেকে অঙ্গনা বাদ। তুই বারাঙ্গনা, কেমন? পুরুষদের মনোরঞ্জন করা হলো তোর কাজ, মাথায় থাকবে?”

মেয়েটা কেঁদে উঠলো। রূপমাধুরীর হাত-পা ধরে মিনতির স্বরে বললো,
“আমাকে যেতে দেন না মেডাম। আমার কী দোষ ছিলো বলুন?”
“ভালোবাসা। ভুল মানুষকে ভালোবাসা তোর ভুল। যার জন্য আজ ঠাঁই হয়েছে হেতায়। কেন যে মেয়ে মানুষ তোরা এত বোকা!”

মেয়েটা আরও কান্না বাড়ানোর আগেই তাকে রুম থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো। রূপমাধুরী তার মসৃণ শরীরটার দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ হেসে নিলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। অতঃপর উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ালো। ঝিমিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলো তখন আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো রূপমাধুরীর চোখ-মুখ। রূপমাধুরী চোখ বন্ধ করলো। উপলব্ধি করলো সেই মিঠে আদর। তারপর হুট করে গড়িয়ে পড়লো তার চোখ বেয়ে দু’ফোটা নোনাজল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার লোহার শিক গুলো আঁকড়ে ধরে অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আপনারে ভালোবেসে আজ সূর্যের জায়গায় চাঁদ হয়েছি। আলোর পৃথিবী ছেড়ে আবদ্ধ হয়েছি অন্ধকারে। প্রেম মোর পাপ হয়ে রইলো।”

দূর থেকে তখন চায়ের টং দোকানটাতে গান বাজছে। হাজারও বীরাঙ্গনাকে সাবধান করে গেয়ে উঠেছে গায়ক,
“বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিও না এমন জনকে,
যে ফুলে ফুলে উড়ে মধু পান করে অবশেষে ভাঙে মনকে।”

রূপমাধুরী হাসলো, খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো অনির্দিষ্ট সীমানার আকাশের দিকে। পেছন থেকে বিজলি মেয়েটা দরজায় টোকা দিলো, ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আসবো, আপ্পা?”

রূপমাধুরীর ধ্যান ভাঙলো, কোমল হেসে বললো, “আয়।”

রূপমাধুরীকে সচারাচর হাসতে দেখা যায় না। খুব কমই হাসে বা বলা যায়, হাসেনই না। রূপমাধুরীর হাসিটা বেশ প্রিয় বিজলির। বিজলি কোনো কারণ বশত একটু বেশিই পছন্দ করে এই রূপমাধুরীকে। মানুষটা বড্ড রাগী, ধমক দিলে অন্তর আত্মা শুকিয়ে যায়। কিন্তু তবুও বিজলির এই মানুষটাকে প্রিয়। খুব ছোটো থেকে মানুষটাকে দেখেছে তো, তাই হয়তো এতো প্রিয়।

“কিরে, তোরে আসতে বললাম আর তুই এক জায়গাতেই থম মেরে আছিস, ব্যাপার কী?”

বিজলি থতমত খেলো, দ্রুত প্রবেশ করলো রূপমাধুরীর ঘরে। এসেই সাবধানী চোখে আশপাশ তাকিয়ে আটকে দিলো দরজা টা। রূপমাধুরীর কপালে ভাঁজ ফেললো, বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“দরজা দিচ্ছিস কেন রে?”

“আপনাকে একটা কথা বলবো, আপ্পা? যদি আপনি অনুমতি দেন।”

বিজলির কণ্ঠ প্রয়োজনের তুলনায় ধীর। রূপমাধুরী জানালার পাশে চেয়ারটাতে বসলো। হাসি হাসি মুখেই বললো,
“আচ্ছা, ঘরের লাইট বন্ধ করে বস। তোর সাথে আজ আমিও কিছু গল্প করবো।”

বিজলি মেয়েটা ভেবেছিল তার আচরণে সামনের কঠিণ নারীটা হয়তো অবাক হবে কিন্তু বিজলিকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সে নারী আরও রহস্যময়ী হয়ে গেলো। বরং বিজলিকে অবাক করে দিলো তার হাসি হাসি মুখ। বিজলি গিয়ে লাইট বন্ধ করলো। মুহূর্তেই ঘরটা কেমন আঁধার হয়ে গেলো। দূরের ক্ষীণ আলো জানালা গলিয়ে আসছে ঘরে। তবে কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না সে আলোতে। গোলকধাঁধা যেন বেঁধে আছে সে ঘরে।

“আয়, জানালার সামনে এসে দাঁড়া।”

বিজলি শুনলো রূপমাধুরীর কথা। জানালা বরাবর এসে দাঁড়ালো। বিজলিকে দাঁড়াতে দেখেই রূপমাধুরী বললো,
“কী বলবি, বল?”

“আপ্পা, পুনমের ব্যাপারে কী ভাবলেন? মেয়েটা কো ক’দিন যাবত খাচ্ছে না, এক রোখা আচরণ করছে। ওর কথা শুনতেই হবে এমন জেদ নিয়ে বসে আছে৷”

“তুই কী বলিস? কী করা উচিৎ?”

বিজলি ভাবতে পারে নি রূপমাধুরী যে সমাধানের জন্য তাকেই জিজ্ঞেস করবে। অন্যান্য সময় হলে তো বলতো চ ড়, থা প্প ড় দিয়ে রাজি করাতে। এবারের বলায় ভিন্নতা কেন!

বিজলি তবুও আমতা-আমতা করে বললো,
“ওর কথা টা রাখেন নাহয়? ওর বাচ্চা টা নাহয় আসুক। আমার মনে হয় ওর বাচ্চা ঐ যে একটা সাহেব আসে না দিলীপ না কি যেন, ঐ লোকটার। লোকটা ঘন ঘন তো পুনমের ঘরে আসতো। আর সবচেয়ে বেশি ও শুয়েছে লোকটার সাথেই। তাই হয়তো দুর্বলতা তৈরী হয়েছে লোকটার প্রতি, যার জন্য ও বাচ্চাটাকে চাচ্ছে।”

ভয়ে ভয়ে কথা টা শেষ করেই স্থির নারী মূর্তিটির দিকে তাকালো বিজলি। ভেবেঠে হুংকার দিয়ে উঠবে মানুষটা কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং আঁধারে থাকা নারীমূর্তি টি একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“তুই কাউকে পছন্দ করিস বা ভালোবাসিস, বিজলি?”

একটা প্রশ্ন থামিয়ে দিলো বিজলিকে। সে প্রায় থমকে গিয়ে বললো,
“আমি, আমি কাকে ভালোবাসবো আপ্পা? আপনি তো জানেন, আমাদের ভালোবাসা নিষিদ্ধ।”

“কিন্তু আমি ভালোবাসতাম, জানিস?”

মেয়েটার যেন আজ অবাক হওয়ার দিন। মুহূর্তেই সে অবাক হচ্ছে। আজ তার আপ্পা অবাক হওয়ার খেলায় মেতেছেন যেন। আজ কিছুটা ভিন্নরকমের আঁচ পাচ্ছে বিজলি। তাদের আপ্পা ভুলবশতও নিজের অতীত নিয়ে কথা বলেন তুলেন নি। নিজেকে সবসময় এতটা গোপনেই রাখতো যে হয়তো মাঝে মাঝে সে নিজেই নিজেকে বুঝতে পারতো না। অথচ আজ সে মানুষটা অতীত বলছে নিজ ইচ্ছায়?

বিজলিকে চুপ থাকতে দেখে রূপমাধুরী নিজেই বললেন,
“জানিস, একটা লোককে ভীষণ ভালোবাসতাম। প্রথম প্রথম তাকে কেবল শ্রদ্ধার নজরে দেখলেও বয়ঃসন্ধির কালে হুট করেই প্রথম আবেগ, প্রথম অনুভূতি তার জন্য ই সৃষ্টি হয়েছিল। তাকেই ভালোবেসে ফেলি। মেলা থেকে সে চুড়ি এনে দিতো, রঙ-বেরঙের চুলের ফিতা এনে দিতো। আমি সেই ফিতা দিয়ে নিজের চুল বাঁধতাম কত-শত ভাবে। কিন্তু আমাদের প্রেম জমে ওঠার আগেই ঘটে গেলো ভয়াবহ বিপর্যয় আমার জীবনে। কিন্তু তখন সেটা বিপর্যয় মনে হয় নি। জীবনের বিপর্যয় বলা যায় না, বলা যায় প্রেমের বিপর্যয়।”

রূপমাধুরীর কথা থামলো। সাথে ভেসে এলো এক দীর্ঘশ্বাস, যেখানে উড়ে গেলো অসহায়ত্ব। বিজলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে। এই মানুষটার গোপনে যে অনেক ভয়ঙ্কর অতীত আছে তা সে প্রায়ই টের পেতো। মানুষের শরীরের কিছু পুগে যাওয়া ক্ষত জানান দিতো সেই গভীর অতীতের কথা।

বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাঁট ছুঁয়ে দিলো বিজলির মুখ-চোখ। হয়তো সামনে বসা রূপমাধুরীর শরীরেও সেই ছাঁট লাগছে! এটা ভেবেই বিজলি তড়িঘড়ি করে যেই না জানালা টা লাগাতে গেলো ঠিক সেই মুহূর্তে বাহিরের ঝাপসা দৃশ্য দেখে সে চমকে উঠলো। রূপমাধুরীর দিকে সেই চমকে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে, উত্তেজিত হয়ে বললো,
“আপ্পা, আপ্পা, দেখুন, ওটা পুনম না? সাদা জামা পড়া? পুনম গেইট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কীভাবে বের হলো ও এখান থেকে?”

বিজলির কথায় যতটা উৎকণ্ঠা দেখা গেলো, তার এক ভাগও দেখা যায় নি রূপমাধুরীর মুখমন্ডলে। বরং সে আরেকটু আয়েশ করে বসলো। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“কীভাবে বের হলো বল তো?”

“আপনার কথা ছাড়া তো এখানের একটা কাক পঙ্খীও নড়ে না, আর আস্ত একটা মানুষ বের হয়ে যাচ্ছে! কীভাবে সম্ভব।”

“এইতো সঠিক পথে এলি, আমার কথা ছাড়া যেহেতু কাকও নড়ে না সেখানে একটা মেয়ে আমার অগোচরে বেরুবে, বল?”

রূপমাধুরীর কণ্ঠে হেয়ালি। বিজলির চোখে বিস্ময়। ততক্ষণে পুনম একটা গাড়িতে উঠে পড়লো এবং খুব দ্রুতই গাড়িটা এই পথ পেরিয়ে দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেলো। বিজলি কেবল ফ্যালফ্যাল করে একবার বাহিরে, আরেকবার রূপমাধুরীর আঁধারের মাঝে থাকা মুখটার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপার টা তার এখনও বোধগম্য হচ্ছে না।

#চলবে

[আমাদের পথচলা খুব শীগ্রই শেষ হবে। ধৈর্য ধরুন। আমরা এসে পরেছি সমাপ্তির পথে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here