বেলা_শেষে_ফেরা পর্ব ৮+৯

#বেলা_শেষে_ফেরা

#পর্ব_৮

#লেখনীতে_Suchona_Islam

বাসায় আসতে’ই তন্ময় আর তূর্জয় হাসতে হাসতে ড্রয়িংরুমে বসে গল্পে মেতে উঠেছে। তা দেখে তো তাদের দাদী বিস্ময় হয়ে বসে আছে। তবে তন্ময় একটু নরম স্বভাবের হওয়ায়, তার দাদীর খুব পছন্দের নাতি সে। দু’জনে একসাথে বাসায় প্রবেশ করছে বলে আমেনা বিনতে অবাক হয়ে গিয়েছে। যেখানে দু’ভাই সারাক্ষণ দু’জনের পিছু’লই লেগে থাকে আর আজ কিনা সুরে সুরে তাল মিলিয়ে গান’ই হয়ে গেলো একেবারে।

“বউমা। আইজকা সূর্য্যি কোনদিক থাইকা উঠেছে একটু কও দেহি!” আমেনা বিনতে গ্রাম্য মানুষ। শহরে ভাষা নাকি তার পোষায় না, এটা তার ভাবনা। আফরোজা জান্নাত তখন রান্না ঘরে পাক করছিলেন। তাই সে শাশুড়ির কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কাজ করতে করতে’ই জবাব দিলেন, “আম্মা! আজকে তো সূর্য পূর্ব দিক থেকে’ই উঠেছে। এ আর নতুন কি।”
“না বউমা, তুমি ভালা মতো দেইখা আমারে কও কতা’খান।”
শাশুড়ির কথা’র আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে, সে রান্নাঘর থেকে শাশুড়ির কাছে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলে সে’ও বিস্ময় হয়ে যায়। দু’ভাই গল্পে মাতিয়া হয়ে আছে। আশেপাশের কথা তারা শুনছে না বরঞ্চ কোনো এক বিষয় নিয়ে দু’জনেই অট্ট হাসিতে ফেটে পরছে। তা দেখে আফরোজা জান্নাত একবার তার ছেলেদের দিকে তো, একবার শাশুড়ির দিকে বিস্ময় চোখে তাকাচ্ছে। শাশুড়ি এবার ইশারায় বললো শান্ত হতে সে ব্যপারটা সামলে নিচ্ছে। আফরোজা জান্নাত চুলায় রান্না বসিয়ে রেখেছে তাই সে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

এবার আমেনা বিনতে তন্ময়কে প্রশ্ন ছুড়ে বসলো।
“তা নাতিগণ! আমারে কেউ কি কইবা, যে আইজ সূর্য্যি কোনদিক থাইকা উঠছে। বউমা’রেও জিগাইসিলাম। কিন্তু সে কোনো উত্তর দিবার পারে নাই। তাই তুমাগোরে জিগাইলাম।” মোটা ফ্রেমের চশমাটা আঁচলে মুছতে মুছতে দু’জনকেই প্রশ্ন ছুড়লো তিনি।
তন্ময় ও তূর্জয় মজা করে’ই বললো, “দাদী! আইজ সূর্য কিন্তু পশ্চাৎ দিক থাইকা উঠছে।” এ বলে দু’জনেই হাসিতে মশগুল। আমেনা বিনতের সাথে তারিকুল চৌধুরীর তিন সন্তান’কেই তার মত করে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতে হবে। এ নিয়ম মেনে না চললে এক সপ্তাহ তিনি কারো সাথে’ই কথা বলবেন না। তার ছেলে আর ছেলের বউ তার সাথে ইংরেজীতে কথা বললে’ও তার মাথা ব্যথা নেই। সে মনে করে শহরে এসে তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের সামজে চলার জন্যে এই পরিস্থিতি হয়েছে।

আমেনা বিনতে এবার চশমাটা চোখে পড়ে নিলো। তারপর বললো, “তা তো ঠেশ দেখবার পারছি। তয় কি এমন গপ্পো করতাছো তুমরা আর এতো হাসতাছো যে, তা আমিও শুনি। তুমাগো হাসি দেইখা মনে অনুভূতি জাগলো।”
তখন তন্ময় ও তূর্জয় তাদের ঝগড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে হাসছিলো। তবে দাদীর কথার মানে এবার বেশ বুঝতে পেরেছে, কেনো তাদের দাদী তাদেরকে এভাবে প্রশ্ন ছুড়লো। দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে থেকে লজ্জায় মাথা নিচু করে মাথা চুলকাচ্ছে। তা দেখে আমেনা বিনতে এবার ফিক করে হেসে দিলো।

“দাদী! এইডা কোনো কতা হইলো কও। আরে সূর্য্যি তো সব সময় পূর্ব দিক থাইকা’ই উঠে। তায় এতো পশ্ন তোমার করতে হইবো কিল্লাই কও দেহি!” তূর্জয় বাচ্চাদের মতো হাত ছুড়ে ছুড়ে দাদীর সাথে কথা বলছে। আমেনা বিনতে এবার’ও হেসে দিলেন।
“পুলা মাইনষের মন বুজা সত্যই মুশকিল। আমি কইসি এক আর তারা কয় আরেক। ওই ছেমড়া গুলান! আমার কতা কি তুরা একবার’ও ভাবছোত। আমার লিগা কি তুরা নাত বউ আনবি না। হ্যা রে বড় নাতি! ছুডু নাতি না হয় ছুডু মানুষ। ও তোর লাগান তো এত বড় হয় নাই। তাই বইলা কি তুই’ও আমার কষ্ট হান বুঝস না। আমার কত শখ আছিলো, মরণের আগে দুই নাতির নাত বউ দু’চোখ ভইরা দেখমু। তা আর কবে যে পূরণ হইবো আল্লাহ’ই জানে। হায় রে কপাল আমার!” বড় আফসোসের সাথে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আমেনা বিনতে। তার মনের ইচ্ছা পূরণ সত্যিই কি হবে নাকি তা ভেবে।

………………………

“দাদী হুনো, আইজ কিন্তু ভাই’য়ে ছক্কা মাইরা দিছে। আরে ও তো….!” তন্ময় তূর্জয়ের মুখ চেপে ধরলো দাদীর সামনে। আমেনা বিনতে এর কিছুই বুঝতে পারছেন না।
“ওই ছেমড়া! ওর মুখ এমন কইরা ধইরা রাখছোস ক্যান। ও কি জানি কইবা লাগছিলো, তুই বইলে ছক্কা মারছোস। তা ওরে কতা’খান সম্পূন্ন কইবার তো দিবি নাকি?”
“আরে দাদী, ও কি কইতে চায় তা আমি তোমারে কইতাসি। আজকে এক রিক্সাচালক’রে আমি ৫০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা দিয়া, তার পরিবারের জন্যে মহৎ কাম করসি। সে আমাগো দুই জন’রে জড়ায় ধইরা এমন কান্দুন যে কানলো না। তার লিগা মায়া লাগতাসিলো বইলা অয় হেই কতা’রেই ছক্কা মারার কতা কইছে বুঝলা!” তূর্জয়ের মুখ চেপে ধরেই দাদী’কে উক্তিগুলো দিচ্ছিলো তন্ময়। সবটা বললে’ও তূর্ণার কথা বলেনি তন্ময়।

“ও আইচ্ছা বুঝলাম। তা কাম তো ভালা কাম’ই করসো দাদাভাইরা।” একটু খুশি হয়ে নিয়ে দু’জনকে কথাগুলো বললেন তন্ময়ের দাদী। কিন্তু বেশিক্ষণ তার মুখে হাসি রইলো না, লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন। আর তন্ময় ও তূর্জয়কে বলতে লাগলেন, “জানস দাদাভাইরা। তোর বাপে একা’ই। তোর বাপের আগে আমার একখান মাইয়া হইসিলো। কিন্তু মাইয়াডা পানিতে ডুইবা মইরা গেছে। আমি যে কত কানছি আল্লাহ’র কাছে। তোর দাদা কিন্তু খুব’ই ভালা মানুষ আছিলো রে। হে’ই যে আমার স্বওয়ামী হইসে, তাতে আমি ধইন্য। তোর বাপ ঠিক ৬ বছর পরে আমার কুলে আহে। গেরামের মাইনষেরা যে কত কিছু কইছে আমারে। কেউ কইছে কলঙ্কী, কেউ কইছে মুখপুড়ী, কেউ কইছে রাক্ষসী, তো আবার কেউ কইছে অলক্ষী। এমন কত কতা যে শুনছি আমি। আর আল্লাহ’র কাছে চাইতাম একখান জানি বাচ্চা অয় আমার। কিন্তু বাচ্চা হইতাসিলো না বইলা তারা আমারে ‘পেটবাঁধইন্না’ কইতো সবাই। কি যে কান্দুন’ডা কানতাম। কিন্তু বুজার মতো তোর দাদা ছাড়া আর কেউ’ই আছিলো না। পরে আমার কুল জুইরা তোর বাপে আইলো। কিন্তু ‘শই মা’ (আগেকার সময়ে যে বাচ্চা জন্মের ডক্টর ছিল) নামে যে বেডি আছিলো, হে’ই কয় আমি আর পুলাপাইন নিতে পারমু না। তহন মনে বড় কষ্ট হইছিলো রে। তবে তোর বাপেরে আমি পাইসি বইলা খুশি’ও হইসি। এক সময় তোরা’ও হইলি, আমি যে আল্লাহ’র কাছে কতো দুয়া করতাম। আমার কুলে এতো সন্তান আহে নাই তো কি হইসে। তোগো মা তো ঠিক’ই আমারে তিনডা সোনার টুকরা দিছে। আল্লাহ’য় তোগোরে বাচায় রাউক দাদাভাই।” অশ্রুশিক্ত নয়নে আমেনা বিনতে কথা গুলো বলে দুই নাতি’কে জড়িয়ে ধরলেন। তন্ময় ও তূর্জয়ের চোখ’ও অশ্রুশিক্ত। এ যে খুশির অশ্রু।

……………………

“তখন তুই আমায় থামালি কেনো?”
“এই তোর কি মাথা খারাপ। যে মেয়েকে এখনো প্রপোজ’ই করলাম না সেখানে বাসার সবাই’কে ঢোল পিটিয়ে জানাচ্ছিস, বলদ।”
“কিসের ঢোল পেটানোর কথা বলছো ভাইয়া, আমাকে’ও বলো। আমি’ও শুনবো তোমাদের থেকে!” পিছনে যে তানিয়া দাড়িয়ে ছিলো ওরা টের পায় নি। তবে তানিয়া ওদের সম্পূর্ণ কথা যে শুনে নি এটা বেশ বুঝেছে তারা।

তন্ময় ও তূর্জয় ছাদে উঠেছিলো রাতের খাবার খেয়ে। পিছন পিছন যে তানিয়া’ও আসবে তারা সেটা’র আঁচ করতে পারে নি। তানিয়া আসায় দু’জনেই একটু থতমত খেয়ে যায়।

“ও কিছু না তানু। তবে তুই এতো রাতে ছাদে কেনো?” তন্ময় কথাটি এড়িয়ে নিতে লাগলো।
“জানো ভাইয়া, ক্লাসের একটা বাজে ছেলে আজকে আবার আমাকে ডিস্টার্ব করেছে। আমি তাকে তোমাদের কথা বলে ভয়’ও দেখিয়েছি। সে উল্টো আমায় বলে, তার গ্যাং আছে।”
“ওই তো সেই ছেলেটা না যে তোকে চিঠি দিয়েছিলো একবার?” তূর্জয় প্রশ্নটা করলো তানিয়াকে।
“হ্যা! ও-ই।”
“আজকে এতো রাতে তো টাইট দেওয়া যাবে না কাল দিবো নে।” তূর্জয় তানিয়া শান্ত্বনা দিলো একটা। তানিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে চলে গেলো ছাদ থেকে।
তানিয়া এবার দশম শ্রেণির ছাত্রী। সে দেখতে মাশা-আল্লাহ সুন্দরী বলে’ই স্কুলের অনেক ছেলেরা তাকে পছন্দ করে। তবে তানিয়া তূর্জয়কে খুব ভয় পায়। তন্ময় কিছু না বললে’ও তূর্জয় যে তাকে ছাড়বে না সেটা সে ভাল মতোই জানে।

অপরদিকে, তূর্ণা একমনে ভেবে চলেছে সে কি আজ ঠিক করলো তন্ময়ের সাথে। হঠাৎ এমনভাবে রিয়েক্ট করার কোনো মানে’ই হয় না। কারণ তন্ময় তার দুই দিনের বন্ধু তারপর’ও এমন বিহেভ করার কারণ’টা সে খুঁজে পাচ্ছে না। মনে মনে বলছে কাল সে তন্ময়কে সরি বলবেই।

……………………….
ভার্সিটি শেষে তন্ময়ের দেখা মিললে না তূর্ণার। অপরাধবোধ কাজ করছে তার। তাই তো ভার্সিটি শেষ হবার পরে’ও সেখানে তন্ময়ের অপেক্ষা করছে তূর্ণা। যে মেয়ে কি না স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি শেষ হওয়ার পরে’ও দরকার ছাড়া কোনোদিন সে সেখানে মজুদ থাকেনি। আর আজ কি না তার উল্টো’ই হলো। মুনিয়াকে সে বাড়ি যেতে বলেছে। যদি’ও তার মনের মাঝে ভয় কাজ করছে। তবে জীবনে চলার পথে একা একবার চলে’ই দেখুক এই অভিজ্ঞতায়। কিন্তু তারপরে’ও ভয় কমছে না।

তাদের পাড়ার ‘মিন্টু’ নামের এক বখাটে ছেলে আছে। মুনিয়াদের বাড়ির রাস্তাতে’ই থাকে, আড্ডাবাজ নিয়ে। মুনিয়ার বাবা একালার একটু সুনামধন্য লোক হওয়ায় কেউ মুনিয়াকে কিছু বললে পুলিশে খবর দিলে, এই ভয়ে কেউ কোনোদিন তাদের কিছু বলে নি। কিন্তু আজ তো সে একা। কি করবে এবার। ভয়ে মাথা’টাও কাজ করছে না তূর্ণার।

তন্ময় সামনে’ই তূর্ণাকে দেখতে পেয়ে সে তূর্ণার কাছে যায়। তবে যাওয়া আগে চোখ পরে বাগানের গোলাপফুল গাছটা’র দিকে। ফুলগুলো কি সুন্দর ফুটে আছে। সেখানে গিয়ে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিলো তূর্ণার জন্যে। তূর্না তো গভীর ভাবনায় বিমূঢ়। সে তন্ময়কে খেয়াল করেনি।
আজ তূর্ণা কাঠের একটি চুলকাঠি দিয়ে খোঁপা করে এসেছে এবং মেরুন কালারের একটি ড্রেস পরেছে, চোখে গাঢ় কাজল দিয়েছে। গলায় একটি চেইন আছে তা’ও ২০ টাকার কেনা। তাতে’ও তূর্ণাকে অপ্সরী লাগছে তন্ময়ের কাছে। তন্ময় ভাবলো সে যদি গোলাপ’টা তূর্ণার মাথায় গুঁজে দিয়ে তাকে সারপ্রাইজড করে দেয় তাহলে কেমন হয়!

যেই ভাবা সেই কাজ। তন্ময় তূর্ণার খোঁপায় ফুলটা গুঁজচ্ছে। মাথায় হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে তূর্ণা তার হাত সামনে এনে পরোক্ষ করে। কিন্তু হাতটি পুরুষালো হাত হওয়ায় তূর্ণা এতোক্ষন মিন্টুর কথা ভেবে প্রচুর ভয়ে আছে। তাই সে ভেবেছে কল্পনার থেকে মিন্টু বোধহয় তার সাথে খারাপ কিছু করবে। তূর্ণা কিছু না ভেবেই সেই হাতে ইচ্ছে মতো খামছে চামড়া তুলে ফেলে, রক্ত বের করে দিচ্ছে। পিছনের সেই ব্যক্তি দিয়েছে এক চিৎকার। তূর্ণার মনে হলো কন্ঠ’টা তার পরিচিতি। তাই সে পিছনে ঘুরতে’ই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো।
একি করে বসলো তূর্ণা!!!
#বেলা_শেষে_ফেরা

#পর্ব_৮

#লেখনীতে_Suchona_Islam

বাসায় আসতে’ই তন্ময় আর তূর্জয় হাসতে হাসতে ড্রয়িংরুমে বসে গল্পে মেতে উঠেছে। তা দেখে তো তাদের দাদী বিস্ময় হয়ে বসে আছে। তবে তন্ময় একটু নরম স্বভাবের হওয়ায়, তার দাদীর খুব পছন্দের নাতি সে। দু’জনে একসাথে বাসায় প্রবেশ করছে বলে আমেনা বিনতে অবাক হয়ে গিয়েছে। যেখানে দু’ভাই সারাক্ষণ দু’জনের পিছু’লই লেগে থাকে আর আজ কিনা সুরে সুরে তাল মিলিয়ে গান’ই হয়ে গেলো একেবারে।

“বউমা। আইজকা সূর্য্যি কোনদিক থাইকা উঠেছে একটু কও দেহি!” আমেনা বিনতে গ্রাম্য মানুষ। শহরে ভাষা নাকি তার পোষায় না, এটা তার ভাবনা। আফরোজা জান্নাত তখন রান্না ঘরে পাক করছিলেন। তাই সে শাশুড়ির কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কাজ করতে করতে’ই জবাব দিলেন, “আম্মা! আজকে তো সূর্য পূর্ব দিক থেকে’ই উঠেছে। এ আর নতুন কি।”
“না বউমা, তুমি ভালা মতো দেইখা আমারে কও কতা’খান।”
শাশুড়ির কথা’র আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে, সে রান্নাঘর থেকে শাশুড়ির কাছে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলে সে’ও বিস্ময় হয়ে যায়। দু’ভাই গল্পে মাতিয়া হয়ে আছে। আশেপাশের কথা তারা শুনছে না বরঞ্চ কোনো এক বিষয় নিয়ে দু’জনেই অট্ট হাসিতে ফেটে পরছে। তা দেখে আফরোজা জান্নাত একবার তার ছেলেদের দিকে তো, একবার শাশুড়ির দিকে বিস্ময় চোখে তাকাচ্ছে। শাশুড়ি এবার ইশারায় বললো শান্ত হতে সে ব্যপারটা সামলে নিচ্ছে। আফরোজা জান্নাত চুলায় রান্না বসিয়ে রেখেছে তাই সে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

এবার আমেনা বিনতে তন্ময়কে প্রশ্ন ছুড়ে বসলো।
“তা নাতিগণ! আমারে কেউ কি কইবা, যে আইজ সূর্য্যি কোনদিক থাইকা উঠছে। বউমা’রেও জিগাইসিলাম। কিন্তু সে কোনো উত্তর দিবার পারে নাই। তাই তুমাগোরে জিগাইলাম।” মোটা ফ্রেমের চশমাটা আঁচলে মুছতে মুছতে দু’জনকেই প্রশ্ন ছুড়লো তিনি।
তন্ময় ও তূর্জয় মজা করে’ই বললো, “দাদী! আইজ সূর্য কিন্তু পশ্চাৎ দিক থাইকা উঠছে।” এ বলে দু’জনেই হাসিতে মশগুল। আমেনা বিনতের সাথে তারিকুল চৌধুরীর তিন সন্তান’কেই তার মত করে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতে হবে। এ নিয়ম মেনে না চললে এক সপ্তাহ তিনি কারো সাথে’ই কথা বলবেন না। তার ছেলে আর ছেলের বউ তার সাথে ইংরেজীতে কথা বললে’ও তার মাথা ব্যথা নেই। সে মনে করে শহরে এসে তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের সামজে চলার জন্যে এই পরিস্থিতি হয়েছে।

আমেনা বিনতে এবার চশমাটা চোখে পড়ে নিলো। তারপর বললো, “তা তো ঠেশ দেখবার পারছি। তয় কি এমন গপ্পো করতাছো তুমরা আর এতো হাসতাছো যে, তা আমিও শুনি। তুমাগো হাসি দেইখা মনে অনুভূতি জাগলো।”
তখন তন্ময় ও তূর্জয় তাদের ঝগড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে হাসছিলো। তবে দাদীর কথার মানে এবার বেশ বুঝতে পেরেছে, কেনো তাদের দাদী তাদেরকে এভাবে প্রশ্ন ছুড়লো। দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে থেকে লজ্জায় মাথা নিচু করে মাথা চুলকাচ্ছে। তা দেখে আমেনা বিনতে এবার ফিক করে হেসে দিলো।

“দাদী! এইডা কোনো কতা হইলো কও। আরে সূর্য্যি তো সব সময় পূর্ব দিক থাইকা’ই উঠে। তায় এতো পশ্ন তোমার করতে হইবো কিল্লাই কও দেহি!” তূর্জয় বাচ্চাদের মতো হাত ছুড়ে ছুড়ে দাদীর সাথে কথা বলছে। আমেনা বিনতে এবার’ও হেসে দিলেন।
“পুলা মাইনষের মন বুজা সত্যই মুশকিল। আমি কইসি এক আর তারা কয় আরেক। ওই ছেমড়া গুলান! আমার কতা কি তুরা একবার’ও ভাবছোত। আমার লিগা কি তুরা নাত বউ আনবি না। হ্যা রে বড় নাতি! ছুডু নাতি না হয় ছুডু মানুষ। ও তোর লাগান তো এত বড় হয় নাই। তাই বইলা কি তুই’ও আমার কষ্ট হান বুঝস না। আমার কত শখ আছিলো, মরণের আগে দুই নাতির নাত বউ দু’চোখ ভইরা দেখমু। তা আর কবে যে পূরণ হইবো আল্লাহ’ই জানে। হায় রে কপাল আমার!” বড় আফসোসের সাথে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আমেনা বিনতে। তার মনের ইচ্ছা পূরণ সত্যিই কি হবে নাকি তা ভেবে।

………………………

“দাদী হুনো, আইজ কিন্তু ভাই’য়ে ছক্কা মাইরা দিছে। আরে ও তো….!” তন্ময় তূর্জয়ের মুখ চেপে ধরলো দাদীর সামনে। আমেনা বিনতে এর কিছুই বুঝতে পারছেন না।
“ওই ছেমড়া! ওর মুখ এমন কইরা ধইরা রাখছোস ক্যান। ও কি জানি কইবা লাগছিলো, তুই বইলে ছক্কা মারছোস। তা ওরে কতা’খান সম্পূন্ন কইবার তো দিবি নাকি?”
“আরে দাদী, ও কি কইতে চায় তা আমি তোমারে কইতাসি। আজকে এক রিক্সাচালক’রে আমি ৫০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা দিয়া, তার পরিবারের জন্যে মহৎ কাম করসি। সে আমাগো দুই জন’রে জড়ায় ধইরা এমন কান্দুন যে কানলো না। তার লিগা মায়া লাগতাসিলো বইলা অয় হেই কতা’রেই ছক্কা মারার কতা কইছে বুঝলা!” তূর্জয়ের মুখ চেপে ধরেই দাদী’কে উক্তিগুলো দিচ্ছিলো তন্ময়। সবটা বললে’ও তূর্ণার কথা বলেনি তন্ময়।

“ও আইচ্ছা বুঝলাম। তা কাম তো ভালা কাম’ই করসো দাদাভাইরা।” একটু খুশি হয়ে নিয়ে দু’জনকে কথাগুলো বললেন তন্ময়ের দাদী। কিন্তু বেশিক্ষণ তার মুখে হাসি রইলো না, লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন। আর তন্ময় ও তূর্জয়কে বলতে লাগলেন, “জানস দাদাভাইরা। তোর বাপে একা’ই। তোর বাপের আগে আমার একখান মাইয়া হইসিলো। কিন্তু মাইয়াডা পানিতে ডুইবা মইরা গেছে। আমি যে কত কানছি আল্লাহ’র কাছে। তোর দাদা কিন্তু খুব’ই ভালা মানুষ আছিলো রে। হে’ই যে আমার স্বওয়ামী হইসে, তাতে আমি ধইন্য। তোর বাপ ঠিক ৬ বছর পরে আমার কুলে আহে। গেরামের মাইনষেরা যে কত কিছু কইছে আমারে। কেউ কইছে কলঙ্কী, কেউ কইছে মুখপুড়ী, কেউ কইছে রাক্ষসী, তো আবার কেউ কইছে অলক্ষী। এমন কত কতা যে শুনছি আমি। আর আল্লাহ’র কাছে চাইতাম একখান জানি বাচ্চা অয় আমার। কিন্তু বাচ্চা হইতাসিলো না বইলা তারা আমারে ‘পেটবাঁধইন্না’ কইতো সবাই। কি যে কান্দুন’ডা কানতাম। কিন্তু বুজার মতো তোর দাদা ছাড়া আর কেউ’ই আছিলো না। পরে আমার কুল জুইরা তোর বাপে আইলো। কিন্তু ‘শই মা’ (আগেকার সময়ে যে বাচ্চা জন্মের ডক্টর ছিল) নামে যে বেডি আছিলো, হে’ই কয় আমি আর পুলাপাইন নিতে পারমু না। তহন মনে বড় কষ্ট হইছিলো রে। তবে তোর বাপেরে আমি পাইসি বইলা খুশি’ও হইসি। এক সময় তোরা’ও হইলি, আমি যে আল্লাহ’র কাছে কতো দুয়া করতাম। আমার কুলে এতো সন্তান আহে নাই তো কি হইসে। তোগো মা তো ঠিক’ই আমারে তিনডা সোনার টুকরা দিছে। আল্লাহ’য় তোগোরে বাচায় রাউক দাদাভাই।” অশ্রুশিক্ত নয়নে আমেনা বিনতে কথা গুলো বলে দুই নাতি’কে জড়িয়ে ধরলেন। তন্ময় ও তূর্জয়ের চোখ’ও অশ্রুশিক্ত। এ যে খুশির অশ্রু।

……………………

“তখন তুই আমায় থামালি কেনো?”
“এই তোর কি মাথা খারাপ। যে মেয়েকে এখনো প্রপোজ’ই করলাম না সেখানে বাসার সবাই’কে ঢোল পিটিয়ে জানাচ্ছিস, বলদ।”
“কিসের ঢোল পেটানোর কথা বলছো ভাইয়া, আমাকে’ও বলো। আমি’ও শুনবো তোমাদের থেকে!” পিছনে যে তানিয়া দাড়িয়ে ছিলো ওরা টের পায় নি। তবে তানিয়া ওদের সম্পূর্ণ কথা যে শুনে নি এটা বেশ বুঝেছে তারা।

তন্ময় ও তূর্জয় ছাদে উঠেছিলো রাতের খাবার খেয়ে। পিছন পিছন যে তানিয়া’ও আসবে তারা সেটা’র আঁচ করতে পারে নি। তানিয়া আসায় দু’জনেই একটু থতমত খেয়ে যায়।

“ও কিছু না তানু। তবে তুই এতো রাতে ছাদে কেনো?” তন্ময় কথাটি এড়িয়ে নিতে লাগলো।
“জানো ভাইয়া, ক্লাসের একটা বাজে ছেলে আজকে আবার আমাকে ডিস্টার্ব করেছে। আমি তাকে তোমাদের কথা বলে ভয়’ও দেখিয়েছি। সে উল্টো আমায় বলে, তার গ্যাং আছে।”
“ওই তো সেই ছেলেটা না যে তোকে চিঠি দিয়েছিলো একবার?” তূর্জয় প্রশ্নটা করলো তানিয়াকে।
“হ্যা! ও-ই।”
“আজকে এতো রাতে তো টাইট দেওয়া যাবে না কাল দিবো নে।” তূর্জয় তানিয়া শান্ত্বনা দিলো একটা। তানিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে চলে গেলো ছাদ থেকে।
তানিয়া এবার দশম শ্রেণির ছাত্রী। সে দেখতে মাশা-আল্লাহ সুন্দরী বলে’ই স্কুলের অনেক ছেলেরা তাকে পছন্দ করে। তবে তানিয়া তূর্জয়কে খুব ভয় পায়। তন্ময় কিছু না বললে’ও তূর্জয় যে তাকে ছাড়বে না সেটা সে ভাল মতোই জানে।

অপরদিকে, তূর্ণা একমনে ভেবে চলেছে সে কি আজ ঠিক করলো তন্ময়ের সাথে। হঠাৎ এমনভাবে রিয়েক্ট করার কোনো মানে’ই হয় না। কারণ তন্ময় তার দুই দিনের বন্ধু তারপর’ও এমন বিহেভ করার কারণ’টা সে খুঁজে পাচ্ছে না। মনে মনে বলছে কাল সে তন্ময়কে সরি বলবেই।

……………………….
ভার্সিটি শেষে তন্ময়ের দেখা মিললে না তূর্ণার। অপরাধবোধ কাজ করছে তার। তাই তো ভার্সিটি শেষ হবার পরে’ও সেখানে তন্ময়ের অপেক্ষা করছে তূর্ণা। যে মেয়ে কি না স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি শেষ হওয়ার পরে’ও দরকার ছাড়া কোনোদিন সে সেখানে মজুদ থাকেনি। আর আজ কি না তার উল্টো’ই হলো। মুনিয়াকে সে বাড়ি যেতে বলেছে। যদি’ও তার মনের মাঝে ভয় কাজ করছে। তবে জীবনে চলার পথে একা একবার চলে’ই দেখুক এই অভিজ্ঞতায়। কিন্তু তারপরে’ও ভয় কমছে না।

তাদের পাড়ার ‘মিন্টু’ নামের এক বখাটে ছেলে আছে। মুনিয়াদের বাড়ির রাস্তাতে’ই থাকে, আড্ডাবাজ নিয়ে। মুনিয়ার বাবা একালার একটু সুনামধন্য লোক হওয়ায় কেউ মুনিয়াকে কিছু বললে পুলিশে খবর দিলে, এই ভয়ে কেউ কোনোদিন তাদের কিছু বলে নি। কিন্তু আজ তো সে একা। কি করবে এবার। ভয়ে মাথা’টাও কাজ করছে না তূর্ণার।

তন্ময় সামনে’ই তূর্ণাকে দেখতে পেয়ে সে তূর্ণার কাছে যায়। তবে যাওয়া আগে চোখ পরে বাগানের গোলাপফুল গাছটা’র দিকে। ফুলগুলো কি সুন্দর ফুটে আছে। সেখানে গিয়ে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিলো তূর্ণার জন্যে। তূর্না তো গভীর ভাবনায় বিমূঢ়। সে তন্ময়কে খেয়াল করেনি।
আজ তূর্ণা কাঠের একটি চুলকাঠি দিয়ে খোঁপা করে এসেছে এবং মেরুন কালারের একটি ড্রেস পরেছে, চোখে গাঢ় কাজল দিয়েছে। গলায় একটি চেইন আছে তা’ও ২০ টাকার কেনা। তাতে’ও তূর্ণাকে অপ্সরী লাগছে তন্ময়ের কাছে। তন্ময় ভাবলো সে যদি গোলাপ’টা তূর্ণার মাথায় গুঁজে দিয়ে তাকে সারপ্রাইজড করে দেয় তাহলে কেমন হয়!

যেই ভাবা সেই কাজ। তন্ময় তূর্ণার খোঁপায় ফুলটা গুঁজচ্ছে। মাথায় হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে তূর্ণা তার হাত সামনে এনে পরোক্ষ করে। কিন্তু হাতটি পুরুষালো হাত হওয়ায় তূর্ণা এতোক্ষন মিন্টুর কথা ভেবে প্রচুর ভয়ে আছে। তাই সে ভেবেছে কল্পনার থেকে মিন্টু বোধহয় তার সাথে খারাপ কিছু করবে। তূর্ণা কিছু না ভেবেই সেই হাতে ইচ্ছে মতো খামছে চামড়া তুলে ফেলে, রক্ত বের করে দিচ্ছে। পিছনের সেই ব্যক্তি দিয়েছে এক চিৎকার। তূর্ণার মনে হলো কন্ঠ’টা তার পরিচিতি। তাই সে পিছনে ঘুরতে’ই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো।
একি করে বসলো তূর্ণা!!!

#ক্রমশ…

(গল্পটির মতামত জানান।
স্ববিনয়ে পড়ুন এবং ধন্যবাদ সকলকে।)
দুঃখিত গল্প দেরি করে দেওয়ার জন্যে। তবে লোডশেডিং হলে একটু দেরি করেই গল্প পাবেন।
#ক্রমশ…

(গল্পটির মতামত জানান।
স্ববিনয়ে পড়ুন এবং ধন্যবাদ সকলকে।)
দুঃখিত গল্প দেরি করে দেওয়ার জন্যে। তবে লোডশেডিং হলে একটু দেরি করেই গল্প পাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here