ব্লাক ডায়মন্ড পর্ব ৪

#ডার্ক ডায়মন্ড
#আফরিন ইভা
#পর্ব-০৪

_________________

“মীরা বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে এটাই ঠিক করলো সে রুদ্র ভাইয়ের চেম্বারে যাবে আজ এবং এখুনি, এবং এটাও ভেবে নিলো, রুদ্র ভাই কে সবটা খুলে বলবে।
রুদ্র ভাই নিশ্চয়ই ব্যাপারটা নিয়ে আশাতীত কোনো মন্তব্য জানাবেন।
মীরার মনটা এতোক্ষণ বেশ খারাপ ছিলো, কিন্তু রুদ্র ভাইকে বিষয়টা জানিয়ে কোনো একটা সমাধান পাবে ভেবে বেশ ভালো লাগছে।”

মীরা চট করে ফ্রেশ হয়ে বাসন্তী রঙের সোনালী পাড়ের একটা শাড়ী পরে নিলো।
নিজেকে আয়নায় দেখতে লাগলো, চোখে মোটা করে কাজল রেখা টানলো, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে,চুলগুলো হাত খোঁপা করে সাজটা পরিপূর্ণ করলো।

-নিজের কাছে আজ নিজেকে কেমন বউ বউ লাগছে, আয়নার সামনে থেকে সরবার আগে কামড়ের দাগটা আরো একবার গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করলো, কামড় টা একদম কালচে লাল হয়ে আছে, মীরা দাগটা কাপড় দিয়ে ঢাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আঁচল টাকে ঘাড়ের উপর এমনভাবে জড়িয়ে নিলো যাতে দাগটা দেখা না যায়।

– বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মীরার আম্মাকে বলে গিয়েছে বান্ধবী তুলির বাসায় যাচ্ছে।
ইরা কিন্তু মীরার কথা খুব একটা বিশ্বাস করেনি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু মীরাও হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়।
মীরাও ইরা কে যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়ে বের হলো।
বাহিরে প্রচন্ড রোদের ত্যাজ, আজকের রোদ টা মীরার কাছে অন্যরকম লাগছে, যেনো গা একদম পুড়ে যাচ্ছে, রোদের জায়গাটা বহুকষ্টে হেঁটে গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ালো।
চারদিকে তাকিয়ে দেখলো রাস্তাটা আজ একদম নিস্তব্ধ, একজন লোক কেও দেখতে পাচ্ছে না।

-দূর থেকে কেউ একজন মীরা কে চোখে চোখে রাখছে আর পৈশাচিক হাসি হাসছে।

” চারদিকে তাকিয়ে মীরা একটা রিকশা খুঁজে পেলো, দাম কশাকশি না করে মীরা রিকশায় করে রুদ্রের হসপিটালে এসে নামলো।
বুক টা কেমন যেনো ধুকপুক করছে মীরার।
মাত্রই তো হসপিটালের সামনে এসেছে, আর রুদ্র ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, না- জানি কি হয় মীরা ভেবে পাচ্ছে না।
ধুকপুক বুক নিয়ে ক্যাবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। পিয়ন কে ডেকে রুদ্রের কাছে মীরার কথা জানাতে বললো।

মিনিট পাঁচেক পর পিয়ন এসে জানালো পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে রুদ্র কাজে ব্যাস্ত। মীরা চাপা কষ্ট নিয়ে পিয়ন কে জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি কি আমার নামটা জানাওনি তোমার স্যার কে।

পিয়ন মাথাটা নিচু করে জবাব দিলো, আপা স্যার বলেছে মীরা, লীরা যে-ই আসক পাঁচ মিনিটের আগে যেনো আমার ক্যাবিনে না ঢুকে।

-মীরা পিয়নের কথা শুনে লজ্জিত মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিয়ন কে যেতে বললো, মনে মনে খুব কষ্ট পেলো। তবুও নিজের দুর্দিন ভেবে উড়িয়ে দিলো।

– মীরা ঘড়ির কাঁটা’র দিকে তাকিয়ে আছে, কখন পাঁচ মিনিট হবে, আজ ঘড়ির কাটাটাও যেনো ঘুরছে না, মনে মনে এটাই মনে হলো মীরার, যেমন রুদ্র ভাই তেমন তাঁর ঘড়ি।

-পাঁচ মিনিট পর পিয়ন এসে মীরা কে বললো, আপা এবার আপনি যেতে পারেন। স্যার এখন ফ্রী আছেন।

” পিয়নের কথা শুনে মীরা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে রুদ্রের ক্যাবিনে ঢুকলো।”

-মীরা ক্যাবিনে ঢুকে দেখলো রুদ্র ল্যাপটপে বসে কাজ করছে।
এমন মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে রুমে কেউ যে প্রবেশ করেছে যেনো রুদ্র তা দেখেইনি।

-মীরা রুদ্রের দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলো, রুদ্র শুভ্র শার্ট তার উপর ব্লু ব্লেজার পড়ে চুল গুলো স্পাইক করে এক ঠোঁট দিয়ে আরেক ঠোঁট চেপে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে।

“মীরার দিকে না তাকিয়ে ল্যাপটপে চোখ রেখে মীরা কে বসতে বললো।

– মীরাও বাধ্য মেয়ের মতো বসে পরলো।

– রুদ্র ল্যাপটপে চোখ রেখেই বললো কেনো এসেছিস?

– মীরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলো কাজে।

– রুদ্র চোখ দু’টো বন্ধ করে, জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করে মীরার দিকে তাকালো।
মীরার দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বললো, কাজ মানে, তোর কাছে কি আমাকে শুধু কাজের লোকই মনে হয়, আর তুই মহারানীর মতো হুকুল চালবি?
তুই কি ভুলে যাচ্ছিস আমি একজন ডক্টর, আমার অনেক ব্যাস্ততা ফেলে তোর অকাজ গুলো করবার জন্য চাকর হয়ে তোর পেছন পেছন ঘুরবো?

” রুদ্রের কথা শুনে মীরা বাকরুদ্ধ, মীরা কিছুতেই কিছু বুঝতে পারছেনা, রুদ্র ভাই সবসময় আমার কথাগুলো এমন নেগেটিভ মাইন্ডে নেয় কেনো।
মীরার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ কষ্ট, ইচ্ছে হচ্ছে এখুনি ছোটে চলে যেতে।”

” রুদ্র দাঁত কটমট করে মীরাকে ডেকে উঠলো, তুই শাড়ি পড়ে সাজগোছ করে আমার চেম্বারে পেত্নী সেজে এসেছিস পেশেন্ট গুলোকে ভয় পাওয়াতে?
হায় আল্লাহ আমি তো তোকে একটা গাধী ভাবতাম এখন তো দেখছি তুই পুরস্কৃত গাধীর উপাধি পেয়ে বসে আছিস।

– মীরা কোনো রকম চোখের জল আঁটকে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস নিলো, যেনো মীরার দম আঁটকে আসছে, নিশ্বাস টা নিয়ে দমটা ঠিক করলো।
মীরা আসবার সময় আগেই ভেবে রেখেছে, রুদ্র ভাই আজ যতোই অপমান করুক তবুও সব আজ জানিয়ে যাবেই….
মীরা আর কথা না বাড়িয়ে ডিরেক্ট বলে দিলো, আপনি বিশ্বাস করেন আর না করেন, প্রতিরাতে আমার সাথে কোনো এক অদৃশ্য অবয়ব দেখা করতে আসে….

– কথা শুনে রুদ্র মীরার দিকে নিরব হয়ে তাকিয়ে আছে, চোখের পলক যেনো ফেলছে না।

– মীরা মনে মনে বেশ খুশি হলো এটা ভেবে রুদ্র ভাই এই প্রথম মীরার কোনো কথা বিশ্বাস করেছে ও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালো।

– তুই আমাকে বলছিস এগুলো বিশ্বাস করতে, আমি কি ছোট বাচ্চা যে, এসব কল্পকাহিনির দেশে হারিয়ে যাবো?
এগুলো কি কখনো হয় এই আপডেট যুগে?
কয়েকদিন পর বাচ্চা নিয়ে এসে বলবি রুদ্র ভাই দেখেন আমার বাচ্চা, আমার আর অদৃশ্য অবয়বের বাচ্চা।

তুই তখন এগুলোও বিশ্বাস করাতে আসবি?
দেখা যাবে একসময় আমি পাগল হয়ে রাস্তায় নেমে গেছি।

রুদ্র ভাইয়ের কথাগুলো শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, চোখে জল এসে ভিড়ে যাচ্ছে, একটা কথার বিনিময়ে রুদ্র ভাই অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিলো।
মীরা মনে মনে বললো, আমার কোনো কথা বিশ্বাস করে আপনাকে পাগল হতে হবে না রুদ্র ভাই, আপনি ভালো থাকেন সেটাই আমি চাই, সবসময়ই চাই।

মীরা রুদ্রের দিকে ছলনাময়ী হাসি ফুটিয়ে বললো, আসি… বাসায় কাজ আছে।
মুখে হাসি ফুটালেও ভেতরে ভেতরে ঠিক পুড়ে যাচ্ছে মীরা, বুক ফেটে কান্না আসছে, মন খুলে বলতে ইচ্ছে করছে মীরার, রুদ্র ভাই এমন টা আপনি করতে পারেন না, আমি যে চাই খুব করে চাই আপনাকে আমার পাশে পেতে, আমার উত্তপ্ত হৃদয়ের শীতল পরশ রূপে স্পর্শ করতে, কিন্তু আপনি আমাকে প্রতিনিয়ত লাঞ্চনা, আর অবজ্ঞা করা ছাড়া ক্ষান্ত হচ্ছেন না।

– রুদ্র মীরার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

– মীরা বুক ফাটা আর্তনাদ নিয়ে রুদ্রের দিকে একনজর তাকিয়ে, দু’ফোটা চোখের জল মুছে ক্যাবিন থেকে বের হয়ে গেলো।
রুদ্রের দেওয়া ব্যাথায় আজ ভিতরটা বড্ড পুড়ে যাচ্ছে, দু-চোখ যেনো মিছেমিছি বাহানা খুঁজে চোখের জলের স্রোত বয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
মীরার শাড়ির আঁচলটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে দিকে কোনো খেয়াল নেই , হৃদয়টা আজ প্রিয় মানুষটা ক্ষতবিক্ষত করে দূর্বল করে দিয়েছে।
মীরা মাঝরাস্তা দিয়ে বেখেয়ালি মনে হেঁটে যাচ্ছে, কোথায়, কিভাবে যাচ্ছে কিছুই খেয়াল করছে না।
অভিমানী মনে আজ সব এলোমেলো লাগছে, পৃথিবীটাকে আজ বিষাদময় মনে হচ্ছে।
মীরা চোখের জল মুছছে আর রুদ্রের হেয়ালিপনা মনে করছে, হঠাৎ তীব্র বেগে একটা গাড়ি এসে মীরার সামনে সজোরে থেমে গেল।

মীরার এবার হুঁশ হলো।
ভয়ে মীরা চোখ বন্ধ করে ফেললো।

– কেউ বিকট শব্দে বলে উঠলো, হেই ম্যাম আর ইউ ক্রেজি?
রাস্তায় হাঁটার সময় কি চোখ ব্যাগে রেখে হাঁটেন?

– কথা শুনে মীরা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো।তাকিয়ে দেখলো ব্ল্যাক ব্লেজার, মায়াবী চোখ বিশিষ্ট কেউ একজন ব্ল্যাক গাড়ির সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে।

– মীরা কে কিছু বলতে না দেখে ছেলেটা নিজ থেকেই বললো, মা’ই নেম ইজ ক্যাবিন ক্রুজ, আমার দেশ ইংল্যান্ডে, এই দেশে আমি প্রায়ই আসি , এদেশে আমি মেহমান বলতে পারেন। আসলে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম আপনাকে এলোমেলো ভাবে চলতে দেখে খুব রাগ মাথায় চেপে বসলো।

– মীরা ছেলেটার কথা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছেনা এই ছেলে বাংলা কথা কিভাবে এতটা ক্লিয়ার করে বলতে পারছে?

– ছেলেটা মীরার কৌতূহল চোখের চাহনি দেখে বললো, এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই, বাংলাদেশে আমার রিলেটিভ আছে ওদের থেকেই আমার বাংলা শেখা।

” ক্রুজেট কথা শুনে মীরার কৌতূহলটা একটু কমেছে।”

– ক্রুজ ছেলেটা মীরাকে বললো, চলুন আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।

– মীরাও আর না করেনি, ক্রোজ কে বাসার এড্রেস বলে দিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে ক্রুজ মীরার বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো।

” মীরা ধন্যবাদ দিতে গেলে, ক্রুজ পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো।

– মীরাও কোন দিক বিবেচনা না করে কার্ডটি নিজের ব্যাগে পুড়ে নিলো।

মীরা বিদায় জানিয়ে বাসায় চলে আসলো।

” ক্রুজ মীরার ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।

_____________

মীরা বাসায় এসে কারো সাথে আর একটা কথাও বলেনি, সোজা নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ফেললো।
রুদ্র ভাইয়ের দেওয়া কষ্টে ভেতরটা নির্বিঘ্নে জ্বলে যাচ্ছে মীরার। কষ্টগুলোর কথা মনে করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে একসময় ঘুমিয়ে পরলো

ঘুমের মধ্যে কেউ এসে মীরার গলা চেপে ধরেছে, মীরার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে, চোখ খুলতে গিয়েও খুলতে পারছে না মীরা।
মীরা হাত দিয়ে খামচাচ্ছে, তবুও ছাড়ছে না, হঠাৎ কিছু একটা বিকট শব্দে হুংকার ছেড়ে, জিহ্বা বের করে লালা ফেলছে।
হিংস্রতায় মীরার গলায় নখ বসিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেললো।

বহুকষ্টে মীরা চোখ খুলে তাকালো, তাকিয়ে দেখলো কুকুরের মতো কিছু একটা লাল লাল চোখে মীরার দিকে হিংস্রভাবে তাকিয়ে আছে।
ভয়ে মীরা চোখ বন্ধ করে ফেললো, ঠিক তখুনি এটা পালিয়ে গেলো।

চলবে———

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here