ভাগ্যের সীমারেখা পর্ব -০৩

#ভাগ্যের_সীমারেখা [০৩]
#ফারজানা_আক্তার

এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে বুকে শিহরণ জাগলো। স্পন্দন নড়ে উঠলো। ঠোঁট ক্ষেপে উঠলো। চোখের পলক থেমে গেলো। জানিস দোস্ত? মেয়েটা আমার থেকে যেনো আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো আমি আর আমাতে নেই রে দোস্ত।”

কথাগুলো বলেই বুকে হাত রেখে একটা জাম গাছের উপর ঢলে পরলো শাহিন। হ্যাঁ এই সেই ছেলেটা যে কিনা ইনাইয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো সেদিন। কয়েকদিন কে’টে গেলো কিন্তু এখনো শাহিনের ঘোর কা’ট’লো না। শাহিন বাড়িওয়ালার ছেলে। চারতলা বিশিষ্ট বিল্ডিং টা পুরো ভাড়া দিয়ে তিনতলায় স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে সংসার সাজিয়েছেন হাশেম আলি। হাশেম আলির বর্তমানে কোনো ব্যাবসা বা কাজ নেই ইনকামের, একমাত্র বাড়ি ভাড়া দিয়ে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে চলে যাচ্ছে দিন তার। শাহিন হাশেম আলির মেঝো ছেলে। দুই ছেলে এক মেয়ে সন্তান তার।
শাহিন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। খুব ফর্সা এবং মায়াবী চেহারার অধিকারী সে। যেকোনো মেয়ে দেখলেই ক্রাশ খাই তাকে। শান্তা বর্ণা রিহা ওরা শাহিনকে দেখে কিছুটা সময় থমকে গিয়েছিলো। এতো সুন্দর পুরুষ মানুষ হয়? আর অন্যদিকে ইনাইয়া ভাবতে থাকে এই রুপের পেছনের পুরুষটা সুন্দর মনের অধিকারীনি হবে কী? এই যুগে কী ছেলেরা সুন্দর মনের তাজমহল গড়তে পারে বাস্তবতা ঠেলে?

এই কয়েকদিনের মধ্যে ইনাইয়াকে চারটা টিউশনি যোগাড় করে দেয় বর্ণা আর রিহা মিলে। বর্ণা আর রিহা দুজনে মোট ৮টা টিউশনি করে একজনে ৪টা করে। তিনটা টিউশনি অনেক আগে থেকেই ওদের হাতে ছিলো কিন্তু সময়ের অভাবে পারছিলোনা তাই এই তিনটা টিউশনি ইনাইয়াকে দিয়ে দেয় ওরা, আর একটা টিউশনি পেয়েছে বাড়িওয়ালার মেয়েকে।
বাড়িওয়ালা নিজেই ওদেরকে বলেছিলো একজন টিউটর খোঁজে দিতে তাই বর্ণা বললো এই সুযোগ হাতছাড়া না করে ইনাইয়াকে পড়াতে যেতে। ইনাইয়া শুরুতে আপত্তি করেছিলো শাহিনের অদ্ভুত চাহনির জন্য কিন্তু পরে নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে যায়।
এই বাসায় উঠেছে ওরা ১৫দিনের মতো হতে চললো। ১০দিন ধরে সন্ধ্যার দিকে সময় বের করে বাড়িওয়ালার মেয়ে সীমাকে পড়াতে যায় আর সাথে নিজের বইও নিয়ে যায়, নিজের পড়াটাও কমপ্লিট হয়ে যায় এক ফাঁকে।
এই ১০দিনে শাহিন ইনাইয়ার সাথে অনেক চেষ্টা করেছে কথা বলার কিন্তু সাহস পাইনি আর ইনাইয়াও এড়িয়ে চলে শাহিনকে সবসময়ই। ইনাইয়া সবসময়ই নিজের যোগ্যতার কথা আগে মাথায় রাখে, বড়লোক ছেলের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার মতো মেয়ে ইনাইয়া না। সে তার সব ধ্যান পড়ালেখায় আর নিজের ভবিষ্যতে দিতে চাই। সে জানে প্রেম ভালোবাসা এসব সাময়িক সুখ হলেও এসবে একটা সুন্দর জীবন ধ্বং’স হতে বেশি সময় লাগেনা।
এভাবেই কা’ট’তে লাগলো সময়। কে’টে গেলো আরো দুই মাস। ইনাইয়া চারটা টিউশন করে মাসে ইনকাম করে ৮হাজার টাকা। একটা ক্লাস এইট আর দুইটা ক্লাস নাইনের মেয়ে পড়িয়ে মাসে ৫হাজার টাকা পাই আর বাড়িওয়ালার মেয়েটা ক্লাস টেনের ছাত্রী, তাকে পড়িয়ে পাই ৩হাজার টাকা। সাইন্সের মেয়েকে পড়াতে ভীষণ কষ্ট হয় ইনাইয়ার তবুও সে হার মানেনা। জীবন যু’দ্ধ যে বড় ভ’য়ং’ক’র। আব্রাহাম প্রতি মাসে ইনাইয়ার বিকাশে ৩হাজার করে পাঠাই, ইনাইয়া বারবার বলে ওর লাগবেনা তবুও আব্রাহাম পাঠাই। ইনাইয়া বেশি কিছু বলেনা যদি র দুলাভাই রাগ করে সে ভয়ে।

আজ ইনাইয়াকে বেশ মনম’রা দেখাচ্ছে। রাতের খাবার খেতে বসেছে সবাই।
আজ সাদা ভাতের সাথে বেগুন ভর্তা সীম ভর্তা মসুর ডাল ভর্তা আর বুটের ডাল দিয়ে তৃপ্তিতে খাচ্ছে সবাই। কিন্তু শান্তার কষ্ট হচ্ছে কিছুটা কারণ ওর এসব খাবারের অভ্যাস নাই, দুই মাসেও সে এখনো অভ্যাস্ত হতে পারেনি। এতে তার নিজের কাছেই খারাপ লাগে।
ইনাইয়ার মন খারাপ দেখে সীম ভর্তা দিয়ে ভাত মুখে ভরে চিবুতে চিবুতে বর্ণা বলে “কিরে ইনু পাখি তোর কী হলো রে? মন খারাপ করে রেখেছিস কেনো?”

“তোদের কে কিছু বলবো।”

“বল শুনি।”

“বাড়িওয়ালার ছেলে শাহিন ভাইয়া আজ সীমাকে পড়িয়ে আসার সময় আমার পথ আঁটকেছিলো মাঝ সিঁড়িতে। ”

“কী বলিস? তারপর? তারপর? ”
শান্তা বর্ণা রিহা একসাথে বলে উঠে কথাটি।

“উনি আমাকে বলেছেন উনার সাথে দেখা করার জন্য তাও আজ রাত ১০টাই ছাঁদে। যখন পৃথিবী নীরব নিস্তব্ধ, নিশি প্রহর।”

বর্ণা বললো “তুই কি বলেছিস?”

“বলেছি আমার পক্ষে সম্ভব নাহ। আর আমার দিকে যেনো কখনোই অদ্ভুত দৃষ্টিতে না তাকায়। আমার অস্বস্তি লাগে।”

রিহা বললো “শাহিন ভাই আমাদের ইনু পাখিকে পছন্দ করেন। আমি নিশ্চিত। ”

বর্ণা বললো “মাথা ঠিক আছে? কী বলছিস তুই? হ্যাঁ আমি মানি ছেলাটা দেখতে সুদর্শন আর যে কোনো মেয়েই আমাদের মতো ফিদা হয় শাহিন ভাইকে দেখে কিন্তু এতো সাদা বিড়ালদের চরিত্র তেমন একটা ভালো হয়না। বুঝলি?”

শান্তা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো “ছেলেটা যেমনই হোক নাহ কেনো। আগে আমাদের জানতে হবে আসলেই কী ছেলেটার মনে আমাদের ইনু পাখির জন্য সত্যিকার অনুভূতি আছে নাকি।”

বর্ণা বললো “কিন্তু কিভাবে জানবো এটা? আমরা তো আর মনোবিজ্ঞানী না যে শাহিন ভাইয়ের মনের কথা জেনে যাবো চাইলেই।”

“কি বলছিস কী তোরা এসব। তোরা ভালো করেই জানিস আমার পক্ষে এসব সম্ভব না। আমার আপুর অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। আমি পড়ালেখা করে একটা ভালো জব করবো তারপর সেই টাকায় আমার আপুকে পুরো শহর ঘুরাবো, আমার একটা নিজের বুকশপ গঠন করবো নিজের পায়ে দাঁড়াবো।
প্লিজ আমাকে এসব সম্পর্কে কিছু বলতে আসিস না। আমি সাধারণ মেয়ে। আমার জীবনটা অন্যরকম। আব্বু আম্মুর পর বড় বোনকে মায়ের রুপে পেয়েছি। এসবে জড়িয়ে বোনকে কষ্ট দিতে কিছুতেই পারবোনা আমি।
************
ছয় মাসের ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরেছে আজ ইহান। হাশেম আলির বড় ছেলে ইহান। দেখতে শাহিনের মতো নজর কারা না হলেও মায়াবী ভাবটা তার মাঝে বিধ্যমান। জোর ব্রু, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ঝড়ঝড়া মাথার চুল, লোমে ঢাকা শরীরের অধিকারী ইহান। ইহান একটা কোম্পানিতে ম্যানাজার হিসেবে যোগ দিয়েছিলো সাতমাস আগে। একমাস কাজ করার পরই ইহানকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা। অনেক কাজ শেখা বাকি ছিলো ওর, সেসব কাজ শিখে একদম পরিপাটি হয়ে ফিরে এসেছে ইহান। ছোট বোন সীমার জন্য আসার সময় এক জোড়া রুয়ের নুপুর এনেছে। সীমা তো নুপুর জোড়া পেয়েই খুশিতে পাগল প্রায়ই। মা বাবার জন্য শাড়ি লুঙ্গি আর শাহিনের জন্য একটা ঘড়ি এনেছে।

দুপুর দেড়টা। ইহান খেতে বসেছে সবার সাথে টেবিলে। সীমা একটা বাক্স ইহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে “ভাইয়া এই সবজিটা খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে। লইট্টা শুঁটকি দিয়ে রান্না করা হয়েছে। ”

ইহান টেস্ট করার জন্য এক চামচ সবজি নিয়ে ভাত মেখে মুখে দিলো। ইহানের মনে হলো যেনো সে অমৃত খাচ্ছে। সব সবজি ইহান একা খেয়ে পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সীমাকে বলে “আমার ছোট্ট পরীটা তো দেখি অনেক ভালো রান্না শিখেছে? আম্মুর থেকে শিখেছিস নাকি।”

“নাহ ভাইয়া, এটা আমার রান্না নাহ। এটা রান্না করেছে আমার টিউটর ম্যাডাম। আমার ম্যাডাম অনেক ভালো রান্না পারে জানো। ম্যাডাম নাকি উনার আপুর থেকে শিখেছেন এমন রান্না। আমিও ভাবছি ম্যাডামকে এক্সট্রা বেতন দিয়ে শিখবো রান্না।”

“শিখ যত টাকা লাগে আমি দিবো। আর আর হ্যাঁ তোর ম্যাডামকে আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ দিতে ভুলিসনা।”

এটা বলেই বোনের মাথার উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ায় ইহান। খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাটি না করলে ইহানের একটুও ভালো লাগেনা।
ইহান চলে গেলে একরাশ আফসোসের সাথে শাহিন নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সীমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ নিজের রুমের দিকে চলে যায়। রাগ হচ্ছে সীমার উপর। সবজি সব শেষ হওয়ার আগে বললে কে রান্না করেছে তবে সেও তার প্রেয়সীর হাতের স্বাদ পেতে পারতো। রাগ আর আফসোস দুইটাই খুব জ্বা’লা দিচ্ছে শাহিনকে। শাহিন অনেক চেষ্টা করেও ইনাইয়াকে পারছেনা পটাতে। এই প্রথম কোনো মেয়ে শাহিনকে এড়িয়ে যাচ্ছে আর এটাই যেনো ওর সহ্য হচ্ছে না।
***********
ইনাইয়া ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চুল শুকাচ্ছে রোদে। শীতেকালে রোদের তাপ খুব মিষ্ট হয়। গায়ে লেগেও যেনো লাগেনা। ইনাইয়ার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, চোখগুলো ছোট ছোট, ব্রু গুলো ভীষণ চিকন যেনো ব্রু প্লাগ করেছে অথচ কখনো পার্লারের ধারে কাছেও ঘেঁষেনি সে। একটু গোলাকার চেহারার আকৃতির ইনাইয়াকে দেখলেই যে কারো চক্ষু যেনো শীতল হয়ে যায়। বর্ণা ব্যস্ত তার মেসেঞ্জার গ্রুপে আড্ডায়। শান্তা আছে সারাক্ষণ ফোন নিয়ে। এই ফোন নিয়ে শান্তা সারাক্ষণ কি যে করে তা সবার অজানা। আর রিহা, সে তো আছে সারাক্ষণই পড়া নিয়ে। খুব ভালো স্টুডেন্ট সে। সবাই সবার মতো ব্যস্ত তাই দুপুরের খাওয়া শেষ করে ইনাইয়া ছাঁদে এসে একাকী সময় কাটাচ্ছে। আজ শুক্রবার তাই কলেজ টিউশন কিছুই নেই। এই একটা দিনেই যেনো তিন বান্ধবী একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারে। যখন ইনাইয়া বর্ণা রিহা টিউশনে চলে যায় তখন শান্তার সময় গুলো খুব একাকী কাটে, শান্তার মোটেও ভালো লাগেনা তবুও সময়টুকুতে সে ঘুমিয়ে মোবাইল টিপে কা’টি’য়ে দেয়।

ইনাইয়া আকাশপানে চেয়ে আছে। এই আকাশের বুকে বুঝি তার মা বাবা লুকিয়ে আছে? কেনো সুন্দর জীবনগুলো হুট করে এভাবে এলোমেলো হয়ে যায়? এই নীল রংয়ের অম্ভরের সাথে কথা বলতে সময় কা’টা’তে নিজের ভেতরের সবটুকু শেয়ার করতে ইনাইয়ার বেশ ভালো লাগে। ঝিরিঝিরি বাতাসে ইনাইয়ার চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উড়ছে।
ছাঁদের দরজায় পা রাখতেই ইহানের পা থমকে যায়। এলোকেশী এই রমনী কে? হঠাৎ ইহানের মনে প্রশ্ন জাগলো। পর মুহুর্তেই মনে হলো বাসায় তো অনেক ভাড়াটিয়া আছে হয়তো তাদের মধ্যে কেউ হবে। ইহানের এক হাতে ফোন আর অন্যহাত জিন্সের পকেটে। ছাঁদের একপাশে ইনাইয়াকে দেখে সে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ভাবছিলো ছাঁদের এপাশ থেকে ওপাশ কিছুক্ষণ হাঁটবে কিন্তু ইনাইয়াকে দেখে কেমন জানি অস্বস্তিবোধ হচ্ছে ওর। ইনাইয়া ছাঁদের পূর্ব দিকে আর ইহান দাঁড়িয়ে আছে ছাঁদের দক্ষিণ দিকে দু’জনের মুখ দুই দিকে। কেউ কাউকে দেখছেনা। হঠাৎ ইহানের ফোন কল আসলে রিংটোনের শব্দে ইনাইয়া দক্ষিণ দিকে তাকায়। ইহানকে দেখে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য ভয় পেয়ে যায় ইনাইয়া। ইহানও ফোন রিসিভ না করে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ইনাইয়ার দিকে। যেনো ঘোর লেগে গেছে।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

গল্পটা ভীষণ এলোমেলো হচ্ছে। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। প্লিজ যারা পড়তেছেন গল্পটা সবাই রেসপন্স করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here