ভালোবাসার উষ্ণতা পর্ব ১

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#সূচনা_পর্ব

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে মেয়েটি। শাড়ির আঁচলের ধার দিয়ে ক্ষত স্থান গুলো আবছা দেখা যাচ্ছে। শাড়ির আঁচলটা ফেলে দিলেই তার ক্ষত স্থানগুলো সেই বিভৎস রাতের স্মৃতিগুলোর প্রমাণ দিবে। গলার নিচ থেকে কোমড় অবধি ক্ষত স্থান শুকিয়ে গেলেও রেশ রয়ে গেছে। অনেক কষ্টে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো সে। পুরোনো বাড়িটি এই একটি রুম সাক্ষী হয়ে রয়েছে তার কান্না, আর্তনাদ, মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কষ্টের। একজন বলেছিলো, ভালোবাসা জিনিসটা কারো কারো কাছে অমৃত তো কারো কারো কাছে বিষ। মেয়েটির ক্ষেত্রে ভালোবাসা নামক জিনিসটা বিষে পরিণত হয়েছে। একটা নামী পরিবারের অন্তরালের দাবা খেলা গুটি ছিলো সে। চার মাস পরেও কথাগুলো মনে পড়লে চোখের নোনা পানিধারা বাধ মানতে চায় না। পেটের দিকে নজর পড়তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। আজ আটগারো সপ্তাহ চলতো যদি বাচ্চাটিকে বাঁচানো যেত। বাঁচার আশাটুকুও শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু অয়ন সিকিদারের মুখোমুখি হবার পালা। চোখ মুছে নিজেকে নিজে শান্ত করতে বলে উঠে,
– মৃত ব্যক্তি ফিরে আসে না, প্রাপ্তিও আর ফিরে যাবে না সিকদার ভিলাতে। প্রাপ্তি সেই রাতে মারা গিয়েছে। জন্ম নিয়েছে খুশবু। খুশবু কাঁদবে না, তাকে যে ফিরতে হবে সিকদার ভিলায়। এতোদিন যেই অয়ন সিকদার তার জীবন নিয়ে খেলেছে তাকে এখন শাস্তি দেবার পালা।

অপরদিকে,
সন্ধ্যা ৭ টা,
বউয়ের মতো সাজানো হয়েছে সিকদার ভিলাকে, এনগেজমেন্ট বলে কথা। শহরের সবথেকে জাকজমক সাজসজ্জা করা হয়েছে আজ ভিলা। নামীদামী সকল লোকেরা জমা হবে আজ এখানে। মহীমা সিকদার নিজে সব তদারকি করছেন। সিকদার কোম্পানির উত্তরাধিকারের আজ এনগেজমেন্ট বলে কথা, তাও আবার শহরের টপ ফাইভ বিজনেসম্যানদের একজন, হেলাল খানের একমাত্র মেয়ের সাথে। এতোদিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চললো মহীমা সিকদারের।

অন্ধকার রুমের এক কোনায় প্রাপ্তির একটি ছবি হাতে বসে রয়েছে অয়ন। বাহিরের সাজসজ্জা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। চারটা মাস পাগলের মতো খুঁজেছে প্রাপ্তিকে কিন্তু তার ছায়াকেও খুঁজে পায় নি সে। এক পাশে কিছু মদের বোতল আরেক পাশে প্রাপ্তির ছবি, তার লেখা শেষ নোটটি, তার প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট আর মাঝে অয়ন। সবাই মেনে নিলেও এখনো প্রাপ্তির মৃত্যুটুকু মেনে নেয় নি অয়ন। তার বিশ্বাস পৃথিবীর কোনো এক কোনে প্রাপ্তি লুকিয়ে আছে। যেদিন তার রাগ ভেঙে যাবে সেদিন ঠিক ফিরে আসবে সে। দরজার কড়া নাড়ায় বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠে অয়ন,
– আমার ঘরে কেউ ঢুকবে না, মানা করেছি তো একবার। কেনো আসো তোমরা? আজ তোমাদের জন্য আমার মায়াবতী আমার কাছে নেই। আমার বাচ্চার বেড়ে উঠা আমি দেখতে পাচ্ছি না। আর কি চাই তোমাদের? সব ফেরত দিয়ে দিয়েছি তো! কি চাই?
– অয়ন, আমি আবরার। আমাকে অন্তত আসতে দে।
– কি দেখতে এসেছো?
– আজ আমার এনগেজমেন্ট অয়ন। প্লিজ, আজ অন্তত পাগলামি করিস না।
-…..

অয়নের জবাব না পেয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে আবরার। ঘরে একটা উটকো গন্ধ যেন ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। লাইট টা অন করতেই অয়নের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে। অন্ধকার যার চিরসঙ্গী, তার কি আলো পছন্দ হবে! চোখ কুচকে মুখ খিঁচে জিজ্ঞেস করে,
– কি চাই তোমার এখানে?
– দাদীজান অপেক্ষা করছে, তারা চলে এসেছে।
– একটা কথা বলবো ভাই? তোমার থেকে দূর্ভাগা আমি আমার লাইফে এ দেখি নি। অবশ্য আমিও যে কম তা নয়। দেখো না, আমি আমার পুরো পরিবার পাওয়া সত্ত্বেও একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য হারিয়ে ফেলেছি। তবে আমি জানতামই না আমার একটা অংশ প্রাপ্তির মাঝে রয়েছে,জানলে আমি তাকে মাথায় করে রাখতাম। নিজ থেকে আলাদা হতে দিতাম না। অথচ তুমি, সব জেনে বুঝে নিজের পরিবারটা হারিয়ে ফেলছো। তোমার একটা ভুল এখন একটি রক্ত মাংসের মানুষ। তুমি জানো তোমার একটি ছেলে আছে, অথচ তুমি কখনো তার মুখে বাবা ডাকটি শুনবে না।
– আমি কি যায় নি রাইসার কাছে? আমি কি চাই নি আমার পরিবারটা থাকুক। কিন্তু পেলাম কোথায়? হারিয়ে গেলো রাইসা আমার ছেলেটিকে নিয়ে।
– সত্যি বলো তো, তুমি কি রাইসা আপুর জন্য তার কাছে গিয়েছিলে? উহু, তুমি মহীমা সিকদারের কথায় ছেলেটিকে ছিনিয়ে নিতে গিয়েছিলে। আচ্ছা, এই পাওয়ার, প্রতিপত্তির জন্য তুমি ওই নিশি মেয়েটিকে বিয়ে তো করবে কিন্তু ভালোবাসতে পারবে তো? তুমি নিজেও জানো রাইসা আপুর মতো ভালো তোমাকে কেউ বাসতে পারবে না। আমরা হয়তো ভালোবাসার যোগ্য নই। তাইতো ভালোবাসার উষ্ণতা পেয়েও আমরা দুজন হারিয়ে ফেলেছি। তুমি জেনে বুঝে হারিয়েছো আমি না জেনে। হাহাহা। যাও আজ তোমার বিশেষ দিন বলে কথা,, আমাকে এর মধ্যে টেনো না। আমি আমার প্রাপ্তিকে নিয়ে ভালো আছি।

আবরারের মুখে কথা নেই, অয়ন তো ভুল কিছু বলে নি। সব পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে সে। রাইসাকে এতোটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে যে এখন তার ক্ষমা পাবে কিনা তাও জানে না। যখন আবরারকে অয়ন তার ছেলে এবং রাইসার কথা বলেছিলো তখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে নি সে, নিজের ছেলেকে দেখার আকুলতায় ভুল করে ফেলেছে সে। মহীমা সিকদারকে ফোন করে সাথে সাথে জানায় এই খুশির খবর। কিন্তু মহীমা সিকদার এতোটা স্বার্থপর হবে এটা কল্পনাতেও আনে নি আবরার। অয়নের সব কিছু ছেড়ে দেবার পর, মহীমা সিকদার আবরারকে পুনরায় সিকদার কোম্পানির দায়িত্ব সপে দেন। যার জন্য আবরারকে সোজা সাপটা জানিয়ে দেন,
– তুমি যদি চাও বাচ্চাটিকে আমাদের পরিবারে নিয়ে আসতে পারো, কিন্তু রাইসা নামক মেয়েটিকে যদি বিয়ে করতে চাও তবে তোমাকে সিকদার পরিবার ছাড়তে হবে। আমি চাই না ওই মেয়ে আমার পরিবারের বউ হয়ে আসুক। অয়নকে নিয়ে আমার কোনো কালে মাথা ব্যাথা ছিলো না, কিন্তু এখানে তোমার ব্যাপার। আমার আপন নাতীর বউ একজন চরিত্রহীন মেয়ে, যে কিনা বিয়ের আগে মা হয়ে যায় এমন মেয়ে হবে এটা আমি মানবো না। এখন তুমি ভেবে নেও কি করবে।
– কিন্তু আমিও তো একই ভুল করেছি দাদীজান।
– ছেলেরা টুকটাক ভুল করেই থাকে এটা এতো বড় ব্যাপার না। আর আমার মতে ছেলেটাকে তোমার কাছে আনাই ভালো, তাহলে তোমার ডিভোর্সের নাটকটা আরো শক্তপুক্ত হবে। রাইসা মেয়েটিকে কিছু টাকা দিয়ে দাও তাহলেই তো হবে।
– কিন্তু…
– আমি বুড়ো হয়েছি, এতো চাপ আমি নিতে পারবো না। ভেবে দেখো তুমি।

আবরারকে এই কঠিন সিদ্ধান্তটি স্বার্থপরের মতো নিতে হয়। যখন রাইসাকে এ ব্যাপারে সে জানায়, তখন থেকে রাইসা আব্রাহামকে নিয়ে পালিয়ে যায় শহর থেকে। অনেক খুঁজাখুঁজির পর ও তাকে এই শহরে পায় নি আবরার। আজও খুঁজে যাচ্ছে রাইসাকে, একটা শেষ জায়গা আছে কিন্তু সেখানে রাইসাকে পাবার পসিবিলিটি না এর সমান। আবরার আজ নিজের সাথে চোখ মেলাতে পারছে না। আজ যদি অয়নের মতো বুকের পাটা থাকতো তবে সব ছেড়ে ছুটে চলে যেতো রাইসার কাছে। কিন্তু সেটা তার নেই, সে দাদীজানের হাতের পুতুল মাত্র। রাইসাকে তার জীবনে ফেরাতে হলে নিজের জায়গা শক্ত করতে হবে। দাদীজানের হাত থেকে পুতুল নাচের দড়ি কেড়ে নিতে হলে নিজেকে লোহার মত শক্ত করতে হবে যাতে ভারের টানে দড়ি ছিড়ে যায়। এখন এই এনগেজমেন্টের মিথ্যে নাটকটা তাকে চালিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু বিয়ে অবধি এই নাটক গড়াতে দিবে না সে। তার জীবনে যদি কোনো নারী আসে সেটা রাইসা ব্যাতীত আর কেউ হবে না। এখন অনেক কাজ বাকি, রাইসাকে পাওয়া বাকি, নিজের পজিশন, প্রতিপত্তি বাড়ানো বাকি। আচ্ছা রাইসা যদি জানে এই এনগেজমেন্টের কথা তবে কি ও আরো বুঝবে আবরারকে!!

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, নিশি আর আবরার মুখোমুখি দাঁড়ানো। মহীমা সিকদারের মুখে হাসি ধরছে না। নিশি মেয়েটা যথেষ্ট আধুনিক একটা মেয়ে। লেখাপড়া শেষে বাবার ব্যবসায় জয়েন করেছে। এমন একটি মেয়েই তো চায় নিজের নাতবউ হিসেবে মহীমা সিকদার। আবরার যেন কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার কোনো আগ্রহ নেই এই মিথ্যে অনুষ্ঠানে। নিশির বান্ধবীরা রিং নিয়ে আসলে রিং সেরেমনি শুরু করেন মহীমা সিকদার। প্রথমে আবরারের হাতে রিং পড়িয়ে দেয় নিশি। এবার আবরারের পালা, যেই না আবরার রিং পড়াতে যাবে অমনি ফোনটা বেজে উঠে। রিং রেখে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবরার। নিশির ব্যাপারটা একদম ভালো লাগে নি। এদিকে ফোন রিসিভ করে যা শুনে তাতে আবরারের মাথা এক মূহুর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অপরপাশ থেকে আবরারের এসিস্ট্যান্ট জিহান বলে,
– স্যার, রাইসা ম্যামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here