ভালোবাসার রাত ২ পর্ব ১৭+১৮

#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

#পর্ব (১৭+১৮)

তিয়ামতীর ডাকে রিদ ব্লেন্ডারের শব্দ বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকনা খুলে একটা গ্লাস নিয়ে তাতে তরল কিছু ঢাললো। তিয়ামতী কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললো,,

“” তুমি কি করছো?””

রিদের ব্যস্ত গলার উত্তর,,

“”সরবত বানাচ্ছি।””
“” সরবত?””
“” হুম,তোর ফেলে দেওয়া ঔষধের সরবত!””

রিদের কথায় তিয়ামতী হতবাক। চোখদুটো রসগোল্লার মতো ভীতিরসে ডুব দিয়ে রয়েছে। চোখের দৃষ্টি পিছুঘুরে থাকা রিদের পিঠের উপর। হাতের নাড়াচাড়ার জন্য কাধ একবার এদিক ওদিক কাত হয়ে যাচ্ছে রিদের। সেই নড়ে উঠা পিঠটা ভেদ করে তিয়ামতী রিদের সব কার্যক্রম দেখতে পারছে এমনভাবেই দৃষ্টি স্থির।

রিদ নিজের কাজ সম্পন্ন করে ডানপাশটা দিয়ে ঘুরে দাড়িয়েছে। ঠোঁটে হাসির রেখা,চোখে দুষ্টু চাহনি। রিদ পা চালিয়ে তিয়ামতীর দিকে এগিয়ে আসছে। তিয়ামতীর স্থির দৃষ্টি এবার চঞ্চলতায় রুপ নিয়েছে। একবার রিদের দিকে তো আরেকবার রিদের হাতের মধ্যে বন্দী গ্লাসটার দিকে পড়ছে। তিয়ামতী কম্পিত গলায় বললো,,

“” লিদ ভাইয়া!””

তিয়ামতী তার পেটের ভেতর চাপা পড়ে থাকা শব্দভান্ডার থেকে আর একটা শব্দও বের করতে পারেনি। আঁখিদুটো নিমীলিত করে নিয়েছে। দুহাতে মুখটাও বন্ধ করে এক চাপা ভয়ে নাকটাও বন্ধ করে নেওয়ার চেষ্টায় আছে।

“” বিয়ে করা স্বামীকে ভাইয়া বলিস? তোর কি লজ্জা সরম কিছু নেই রে তিল?? দুদিন পর ছেলের বউ আসবে। শেষে দেখা যাবে সে শ্বশুড়আব্বা না ডেকে শ্বশুড়মামা ডাকা শুরু করে দিয়েছে।””
“” আপনি তো শ্বশুল হওয়াল আগে মামা হয়েই বসে আছেন। আমাল ডাকেল তোয়াক্কা কলবে কে?””

তিয়ামতী কথা শেষ করতেই রিদ ওর মুখে সরবতের গ্লাসটা চেপে ধরলো।

রিদের জোরের সাথে পেরে না উঠে তিয়ামতী ঢকঢক করে সরবত খাচ্ছে,আর রিদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

“” কি হয় না হয় সেটা পরের ব্যাপার। তুই যদি আমাকে আরেকবার ভাইয়া বলিস তো,আমি ও তোকে বোন বলে ডাকবো। তোর লজ্জা সরম না থাকলেও আমার আছে। আমি বানাবো বউ আর তুই বানিবি ভাই? কেমন খাপছাড়া সম্পর্ক মনে হচ্ছে না?? তার থেকে ভালো তুই আমাকে ভাই আর আমি তোকে বোন ডাকবো। আহা! ভাইবোনের সংসার! বেশ মিলমিশ লাগবে!

রিদের তাচ্ছিল্যকথনকে পাত্তা না দিয়েই তিয়ামতীও বলে উঠলো,,

“” ছোটবেলা থেকে বলে আসছি,হুট কলে কিভাবে চেন্জ কলবো?? একটা অভ্যাস থেকে আলেকটা অভ্যাসে তো লাফিয়ে যাওয়া যায়না। সময়েলও একটা ব্যাপাল আছে।””
“” আর কত সময় নিবি হ্যা? ছুরি থেকে বুড়ি হয়ে গিয়েছিস, কাঁচা চুলে পাকার রঙ লাগিয়েছিস তাও তোর সময় হয়নি??””
“” না হয়নি,এতোটা বছল ভাইয়া হিসেবেই তো ছিলেন,ভাইয়া থেকে স্বামী হতে না হতেই দুল দুল কলে তালিয়ে দিলেন,আপনি আমাল স্বামী সেটা ফিল কলাল সময়টুকুও পায়নি,তাহলে ভাইয়াটা কাটবো কিভাবে??””

তিয়ামতীর যুক্তিতে রিদ বিভ্রান্ত। কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে প্রসঙ্গ পাল্টালো,,

“” আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন?? ওর কথা কি একটু শুনতে পারিস না? কাল সকালে নিজে থেকে ওকে গিয়ে বলবি,তুই চিকিৎসা করাবি। আর সেটা ইউকেতেই।””
“” না। আমি ওখানে যাবোনা।””
“”কেন?””
“” যেখানে আপনি আছেন,সেখানে আপনাকে ছালা আমি নিশ্বাস নিতে পালবোনা। দম আটকে মলে যাবো।””

তিয়ামতীর উত্তরে রিদ কিছু বললো না৷ কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আবার বললো,,

“” তাহলে অন্য কোথাও থেকে কর। বাংলাদেশের বাহিরে এখন অনেক উন্নত দেশ রয়েছে,যেখানে এইডসের বেশ ভালো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।””

তিয়ামতীর চটপট উত্তর,,

“” যেখানে আপনার কোনো স্পর্শ নেই,যেখানকার অক্সিজেনে আপনার কোনো গন্ধ নেই সেখানকাল নিশ্বাসও আমি নিতে পালবোনা। দম আটকে মলে যাবো।””

রিদ এবার কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বললো,,

“” ওকে,তোর এখানে ওখানে যেহেতু এতো সমস্যা তাহলে নিজের দেশের চিকিৎসাটা তো ঠিকমতো নিবি। সেটা কেন নিচ্ছিসনা? ঔষধ কেন খাচ্ছিসনা? বাংলাদেশে হয়তো অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসা পাবিনা তবুও ডঃসীমা তোকে যেভাবে আগলে রেখে স্পেশালিভাবে ট্রিট করছে,শুধু ডক্টরি নয় উনিতো আবেগ দিয়েও তোকে যথেষ্ট বুঝিয়েছে তবুও কেন তুই এমন বাচ্চাদের মতো করছিস??

তিয়ামতী এবার রিদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। ফুপিয়ে উঠে বললো,,

“” আমাল আপনাকে ছালা আল বাঁচতে ইচ্ছে কলেনা লিদ ভাইয়া,আপনাকে ছালা একএকটা সেকেন্ড আমাল কাছে যুগ যুগ মনে হয়। এতো বেঁচে থেকে কি হবে? আমি মলে যেতে চাই,আপনাল কাছে যেতে চাই। আপনাল স্পল্সে ডুবে থাকতে চাই,একাকিত্ব আমাকে মেলে ফেলছে,নিশীলাতেল কালো অন্ধকাল আমাকে খেয়ে ফেলতে চায়,আমাল যে খুব ভয় লাগে লিদ ভাইয়া,ভয়ে থলথল কলে যখন কেঁপে উঠি তখন আপনাল বুকটাকে আমি খুব মিস কলি!””

রিদ তিয়ামতীকে নিজের বুক থেকে আলগা করলো। ওর চিবুক চেপে ধরে আছে,ওর চোখে সরল চাহনি নিয়ে ধীর গলায় বললো,,

“” তাহলে পড়ে আছিস কেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে?? চলে আয় আমার কাছে!””

তিয়ামতী সাথে সাথে ছিটকে সরে গেলো। কাঠগলায় বললো,,

“” পালবোনা। আমি চলে গেলে যে আমাল ছেলেটা একা হয়ে যাবে। খুব একা! যাকে পৃথিবীতে আনাল জন্য আপনাল সাথে যুদ্ধ কলে মিলিত হয়েছিলাম আজ তাকে ফেলে দিয়ে আমি কি কলে আপনাল কাছে যাবো? এতোটা স্বাল্থপল আমি হতে পালবোনা,লিদ ভাইয়া!””

তিয়ামতীর গালটা আবার চেপে ধরে আছে রিদ। তবে আগেরবারের মতো এবার নরম ছোয়ায় নয়,শক্ত ছোয়ায়। চোখে ফুটে উঠেছে আগুনের ঝলকানি,হাতের চাপটা আরেকটু গাঢ় করে কঠিন গলায় বললো,,

“” এতোই যখন ভালোবাসা,এতোই যখন মায়া,এতোই যখন দরদ তাহলে সে ছেলের গালে দাগ বসালি কি করে? বল কেন মেরেছিস ওকে? তুই জানিস না এতে শুধু ও না ওর বাবাও কষ্ট পাবে? তবুও কেন মেরেছিস?? তোর এই চড়টা ওর গালের দাগটা এতোটাই গভীর করেছে যে ওর হৃদয়ও ক্ষত হয়েছে।””
“” বেশ কলেছি,ও আপনাকে নিয়ে এমন বলবে কেন? বাবাকে ভালোবাসা আল ছেলেকে ভালোবাসা কি এক হলো? দুটো ভিন্ন লকম ভালোবাসাকে সে এক কাঠগলায় দালালো কেন?””

তিয়ামতীর উত্তরে রিদ আরো বেশি গর্জে উঠেছে। রাগে মুখটা কেঁপেকেঁপে উঠছে। তিয়ামতীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। পাশেই অবস্থান করা ফ্রিজের দিকে নজর পড়েছে তার।

তিয়ামতী রিদের ধাক্কা সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে হালকা ধাক্কা খেয়েছে। নিজেকে সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই ওর হাতদুটো টেনে নিলো রিদ। তিয়ামতী কিছু বুঝার আগেই বরফের টুকরো দিয়ে দুহাতভর্তি করে দিয়েছে। রিদের দিকে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে ও।

“” একটু অপেক্ষা কর সব বুঝে যাবি।””

সময় যখন সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিটে চলছে তখনি তিয়ামতীর হাতের অবস্থা কাহিল। বরফ গলা পানি নিচে পড়লেও বরফ শেষ হচ্ছেনা বরংচ বরফের পাহাড়টা বেড়েই যাচ্ছে। এদিকে অতিরিক্ত ঠান্ডা বহনে তিয়ামতীর হাত অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। হাতের শীতল ঠান্ডাটা রক্তের সাথে মিশে গিয়ে পুরো শরীরে বয়ে যাচ্ছে।

অতি গরমে হাতে ফোস্কা পড়ে জানতো সে কিন্তু অতি ঠান্ডাতেও যে পড়ে সেটা সে এখন টের পাচ্ছে। চোখ বেয়ে নোনাপানির স্রোত চলছে তিয়ামতীর। অসহায় চাহনি নিয়ে রিদের দিকে তাকাতেই দেখে সেখানটা অন্ধকার জায়গা করে নিয়েছে। কালো অন্ধকারেও সে আবছা ভেসে উঠা তার রিদ ভাইয়াকে চারপাশে কোথাও পাচ্ছেনা। ব্যাকুল হয়ে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে খুজছে। রান্নাঘর ছেড়ে পুরোবাড়ি তল্লাসী নিলো। কোথায়ও তার ছায়া না পেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,,,

“” লিদ ভাইয়া!””

অন্ধকার রুমে আলো জ্বলে উঠেছে। তিয়ামতী চোখ মেলতেই সামনে রাতকে দেখতে পেলো। এমন মাঝরাতে স্বপ্ন দেখে প্রায় তার বুক শুকিয়ে আসে। আজও হয়েছে। শুকনো বুকটা কাতর হয়ে গলাকে জানান দিচ্ছে তার পিপাসা পেয়েছে। গলায় হাত পড়তেই রাত পানিভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলো মায়ের দিকে।

তিয়ামতী নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে গ্লাসটা ফেরত দিতে দিতে বললো,,

“” তুই এতোরাতে এখানে?””

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে রাত কিছু বললোনা। মাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে কম্বলটা চাপিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে।

“” তোর মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন রে,বাপ?””

মায়ের এমন মমতাময় প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে পারছেনা রাত। মাঝপথেই দাড়িয়ে রইলো। বাহিরে যাওয়া দরজা আর মায়ের ঠিক মাঝ বরাবর স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। একমন চাইছে অভিমান নিয়ে ছুটে বাইরে চলে যেতে তো আরেকমন চাইছে সকল অভিমান ভুলে গিয়ে মায়ের বাহুবন্ধনে আটকে যেতে। বুকের ভেতর চলা হঠাৎ ঝড়েরবেগটা দমাতে হলে এই মুহুর্তে তার মায়ের বাহুবন্ধনটাই যথেষ্ট।

“” কিরে,এভাবে পাহাড়ের ন্যায় থমকে গেলি কেন? রাগ করেছিস?””

রাতের চোখ ভিজে উঠছে,কিন্তু কেন? মায়ের উপর অভিমানের জন্য নাকি সন্ধ্যার উপর সুপ্ত অভিমানের জন্য?? একি সাথে দুটো অভিমানের পাহাড় সে একা কি করে বইবে?? মানুষ দুটোই যে তার শরীরের অভ্যন্তরে বসবাস করা এক কলিজার এপারওপার!

রাত আর স্থির থাকতে পারছেনা। চোখের নোনাস্রোতের চলনগতি থামাতে হলে তার পায়ের চলনগতির প্রয়োজন। চোখটা বন্ধ করে দরজার দিকেই অগ্রসর হলো সে।

~~

ভোরের কাঁচারোদের গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে সন্ধ্যার। হিমেল বাতাসটাকে তাড়িয়ে একটা ভাপসা গরম জায়গা করে নিচ্ছে ওর শরীরে। সারারাতে ব্যস্তগতিতে চলতে থাকা চলমান ফ্যানটা শীতল বাতাস দিতে ব্যর্থ হচ্ছে,তার ফলস্বরূপই যেন সন্ধ্যার কপালপার্শ্বতে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা জমে উঠেছে। সন্ধ্যা গায়ে জড়ানো পাতলা কালো কাঁথাটা সরিয়ে দিয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিলো,ঠিক তখনি কানে বাজছে নানারকম শব্দ। ছোটবাচ্চার কান্না,দু/তিনজনের হাসির শব্দ আবার নানা কথার ধ্বনি। সন্ধ্যা চট করে উঠে বসলো। বিরক্ত নিয়ে কানখাড়া করে আছে,এ বাড়িতে হচ্ছেটা কি??

এমন মিশ্রশব্দ সন্ধ্যার মেজাজে বিরক্ত চেপে বসেছে। বিছানা ছেড়ে বাইরে পা পড়তে ওর কপাল ভ্রূযুগলসহ কুঁচকে উঠলো।

“” রাত ভাইয়া,উঠো বলছি!””

ভোরের আযান শুনে সবেই বিছানায় কাত হয়েছিলো রাত। সারাটারাত চোখের দুপাতা একপাতাতে আনতে পারেনি সে।

সন্ধ্যার এমন শক্তডাকে ঘুমকাতুরে কন্ঠে বললো,,

“” একটু ঘুমুতে দেনা। খুব ক্লান্ত লাগছে।””

সন্ধ্যা আর ডাকার প্রয়োজন মনে করলোনা। সোজা ওর পেটের দুদিকে দুপা ভর দিয়ে রাতের দিকে ঝুকে দাড়িয়েছে। বিছানার সাথে অসার হয়ে পড়ে থাকা হাতদুটো ধরে সন্ধ্যা টেনে রাতকে বসিয়ে দিলো। গরম মেজাজে বললো,,

“” একরাতের মধ্যে শুনশান বাড়ীটাকে পার্ক বানিয়ে ফেলেছো,ক্লান্ত তো হওয়ারই কথা। কে বলেছে এগুলো করতে?””

সন্ধ্যার বচনভঙ্গিটা গোগ্রাসে গিলছে রাত। আধবোজা চোখ দিয়ে অপলকে চেয়ে আছে।

“” কিছু বলবে নাকি তোমাকে পানিতে চুবাবো?””
“” রাগলে তোকে বউবউ লাগে!””

রাতের ভারীকন্ঠে সন্ধ্যার রাগ সব পানি। মনে হচ্ছে রাতের মাথায় ঢালতে চাওয়া সবটা পানি নিজের মধ্যে পড়েছে।

“” এতো রাগার কি আছে? এ বাড়ির মেয়ের বিয়ে একটু খাওয়া-দাওয়া হবেনা?? হাতের কাছে যাদের পেয়েছি তাদেরকে ধরে এনেছি। তোর তো অন্যের বউ সাজার খুব তাড়া!””

সন্ধ্যা ভ্রূ উচিয়ে তাকাতেই রাত বিড়বিড় করে বললো,,

“” ঐতো সায়নের বউ হওয়ার তাড়া তাই তো বললাম।””

সন্ধ্যা বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে বললো,,

“” আমার এসব আদিখ্যেতা চাইনা। তুমি কাজী ডাকো,আমি কবুল বলে বাপের বাড়ি ছাড়বো।””

রাত সন্ধ্যার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললো,,

“”তোর এতো তাড়া কিসের রে? আমি কি তোর চাওয়া অপুর্ণ রাখছি? তুই যা চাচ্ছিস তাই তো হচ্ছে,শুধু একটু গুছিয়ে দিচ্ছি! একটু সবুর করনা রে,আজকে হলুদের ছোয়া লাগা কাল নাহয় কবুল বলিস!””
“” এতো সাজের দরকার নাই। আমি আজকেই….””
“” প্লিজ! শেষবেলায় আমার ইচ্ছেটা রাখ!””

সন্ধ্যা কিছু বলতে চেয়েও বললোনা। চোখ পাকিয়ে বেড়িয়ে এলো। সন্ধ্যার চলতিপথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রাত,অন্তর্মনের অন্তর্কন্ঠে চাপা অভিমানের সুর,,,

চাইছি তোকে, খুব করে,,,,,,
বেসে যাব ভালো,চুপ করে,,,,,,

~~

দলে দলে মেহমান এসে হাজির হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে। চারপাশে হলুদের মেলা। বাচ্চা থেকে শুরু করে মাঝবয়সীর মায়েরাও হলুদসাজে সজ্জিত করে নিয়েছে নিজেকে। চারপাশে কাঁচা হলুদ আর বাঁটা মেহেদীর গন্ধ মইমই করছে।

রাত সন্ধ্যার হলুদসন্ধ্যা সাজাতে ব্যস্ত। পেছন থেকে তিয়ামতীর ভারীকন্ঠ,,,

“” কি হচ্ছে এসব? রাত তুই কি এবার সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেলি?””

মায়ের কন্ঠ কর্নপাত করছেনা রাত। নিজের কাজে গভীর মনোঃনিবেশ সে।

“” তুই চাচ্ছিসটা কি আমাকে একটু বলবি? তোর কর্মকান্ডে তো আমি নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছি।””

রাত এবার মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো। কিন্তু কিছু না বলেই সামনে হাঁটা ধরেছে। তিয়ামতীও নিজের ছেলের পিছ ধরেছে। পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কথার ধোয়া ছাড়ছে,,,

“” কথা বলবি নাতো? না বললি,তাতে আমার কি?;তোর কি মনে হয় আমি তোর সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল? আমি কথার গাছ?””

রাত পথের বাক ঘুরলো তিয়ামতীও ঘুরেছে। রাস্তার পাশে লাইটিং ঠিক আছে নাকি তা পরীক্ষা করছে,,

“” একটু রেগে গিয়ে চড় মেরেছি বলে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস তো, দে। আমি তো তোদের বাপ-ছেলের শাস্তি নেওয়ার জন্যই পৃথিবীতে এসেছিলাম। একজন স্বপ্নে এসে রাগ দেখাচ্ছে তো আরেকজন এখানে।””

রাত মায়ের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। সাথে সাথে তিয়ামতী নিজের দু-হাত ওর দিকে মেলে ধরে বললো,,

“” তোকে মেরেছি বলে তোর বাপ এসে আমার হাতে ফোস্কা ফেলে দিয়ে গিয়েছে। বাপ-ছেলে দুটোই স্বার্থপর,নিজের যা ইচ্ছে তাই করবে। আমার দিকটা ভাবার কোনো সময়ই নেই।এই পৃথিবীতে আমার ব্যথা দেখার কেউ নেই।””

রাত হাতের দিকে নিবিড়ভাবে চেয়ে আছে। সাদা ফকফকা তালুতে আড়াআড়ি ঘনরেখা ছাড়া সে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। তিয়ামতী রাতের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজের হাতদুটো সরিয়ে ন্যাকা কন্ঠের সুর তুললো,,

“”দেখতে পারছিস নাতো? পারবিও না। তোদের তো আমার ব্যথা দেখার সময়, চোখ নেই। বেশ করেছি আমি ঔষধ খাইনি,আর খাবোওনা। তোদের বাপ-ছেলের পাগলামীতে আমি অতিষ্ট। এবার গভীরঘুমে চোখ বুঝে বিদায় নিবো। তাতে যদি তোরা শান্তি পাস!””

তিয়ামতী নিজের কথা শেষ করে সোজা নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরেছে। রাত মায়ের উল্টোরাগ ভাঙাবেনা। উনার না মুখকে হাঁ বানাতে হলে এতোটুকু ধৈর্য্য তাকে ধরতেই হবে!

~~

সন্ধ্যার হলুদসাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। চারপাশের আলোর রশ্মি কমে এসেছে,মানুষের হইহট্টগোল কমে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। সারাসন্ধ্যা হাসি-তামাসা,নাচগান শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কেউ কেউ বাড়ি ফিরেছে কেউ কেউ এ বাড়িতে জায়গা দখলে শুয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা হলুদ ধুয়ে গোসল ছেড়ে পাতলা সুতি শাড়ী পড়ে মায়ের রুম থেকে বেরোলো। পুরোবাড়িতে আনাচ কানাচেও সে রাতকে খুজে পায়নি। সেই যে সকালবেলা তার রুমে কথা হয়েছিলো তারপর আর তার দেখা পায়নি সন্ধ্যা৷ মানুষটা গেলো কই?? নিজেই এতো কিছুর আয়োজন করলো,আবার নিজেই নিজেকে সবকিছু থেকে আড়াল করে রেখেছে। তাহলে কি প্রয়োজন ছিলো এগুলোর?? একটু হলুদ ছোয়াতেও তো আসলোনা! আমি যে তার হলুদের স্পর্শ নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম তা কি সে বুঝেনি??

কপালে নানা চিন্তার ভাজ নিয়েই সিড়িতে পা রেখেছে সন্ধ্যা। বাড়িতেই আছে,ভেতরে নেই মানে ছাদে আছে। ভেজা চুলে মোড়ানো সাদা টাওয়ালটা খুলে নিয়েছে সন্ধ্যা। দু/একটা বারি মেরে সিড়ির ধারে টাওয়ালটা রেখে দিলো। শাড়ীর কুচিতে বারবার পা আটকে যাচ্ছে তার। বিরক্তভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে দুহাতে শাড়ী উচু করে দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছে।

ছাদের একপাশে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা চেচিয়ে উঠলো,,

“” রাত ভাইয়া? তুমি কোনপাশে? এতো অন্ধকার কেন? আজ দেখি আকাশে তারার বদলে মেঘেরা মেলা বসিয়েছে!””

সন্ধ্যা নিজের কথা শেষ করতেই ধপাস শব্দে দরজা লাগার শব্দ। কিছুটা ছিটকে উঠে সন্ধ্যা। ভয় ভয় নিয়ে চারপাশে আরেকবার চোখ বুলালো। রাতের কোনো দেখা না পেয়ে চোখ বন্ধ করে সিড়ির দিকে দৌড় দিতেই ফুলের টবের সাথে পা লেগে গিয়েছে। হুমড়ি খেয়ে একদম রাতের উপর পড়েছে। সন্ধ্যা বন্ধ চোখ মেলে আশ্বাসের সুরে বললো,,

“” আল্লাহ! তুমি? আমিতো ভাবলাম কোনো ভূতের উপর পড়েছি! কোথায় ছিলে তুমি?””

সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তরে রাত কিছু বলছেনা। পুরো দৃষ্টি সন্ধ্যার মুখে। ভেজা চুলগুলো এক ধার দিয়ে ওর গাল,নাক,ঠোঁট এমনকি গলায়ও ল্যাপ্টে আছে। রাত আনমনে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছে,সন্ধ্যার হাত তখনো রাতের টি-শার্টের বুকের দিকটা খামচে ধরে আছে।

সন্ধ্যার গোলাপী আভায় ফুটে থাকা মুখটাতে রাত নিজের হলদে মাখা হাতটা দিয়ে হলদে আভায় মাখিয়ে দিলো। ওর হাতদুটো নিজের বুক থেকে ছাড়িয়ে পিছু ঘুরিয়ে নিয়েছে। পেছনে পড়ে থাকা চুলগুলো সামনে ফেলে দিয়ে ঘাড়েও হলুদ মেখে দিচ্ছে। সন্ধ্যা নিজেকে ঘুটিয়ে নিয়ে সরে যেতে চাইলে ওকে আবার নিজের দিকে ঘুরালো রাত।

সন্ধ্যা নিজের লজ্জাদৃষ্টি রাতের দিকে ফেলতে পারছেনা। মাথাটা কিছুটা সামনে নামিয়ে মেঝেতে দৃষ্টিপাত! নিচুস্বরে রাতকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর কাধে বিছিয়ে থাকা শাড়ীর আঁচলে হাত পড়েছে রাতের। আমচকা টানে শাড়ীর আঁচল নিচে ফেলে দিলো!

সন্ধ্যা অবাক হওয়ার সময়টুকু না নিয়ে নিজের দুহাত বুকের উপর আড়াআড়ি পেতে বললো,,

“” রাত ভাইয়া! কি করলে এটা?””

চলবে

#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৮)

সন্ধ্যা নিজের লজ্জাদৃষ্টি রাতের দিকে ফেলতে পারছেনা। মাথাটা কিছুটা সামনে নামিয়ে মেঝেতে দৃষ্টিপাত! নিচুস্বরে রাতকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর কাধে বিছিয়ে থাকা শাড়ীর আঁচলে হাত পড়েছে রাতের। আমচকা টানে শাড়ীর আঁচল নিচে ফেলে দিলো!

সন্ধ্যা অবাক হওয়ার সময়টুকু না নিয়ে নিজের দুহাত বুকের উপর আড়াআড়ি পেতে বললো,,

“” রাত ভাইয়া! কি করলে এটা?””

সন্ধ্যার নিচুস্বরের প্রশ্ন আগলে রাখেনি রাতের কর্নদ্বয়,বাতাসে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। সন্ধ্যার বুজে আসাদৃষ্টিতে নিজের আনমনা দৃষ্টির ভাব বিনিময় করার মাঝেই নিচু হয়ে বসেছে। বা-হাতে সন্ধ্যার কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো। সন্ধ্যা থমকে থাকা বলপ্রয়োগে বললো,,

“” কি করছো?””

সন্ধ্যার টেনে আসা সুরের প্রশ্নে রাত চুপ। গভীর নয়ন তখন সন্ধ্যার পেটে। হলদে পেটটাতে নিজের ডান হাতের পাঁচআঙুল বিছিয়ে নিয়েছে। হাতে লেগে থাকা সবটা হলুদ মেখে যাচ্ছে। নদীর আঁকাবাকা পানির স্রোতের মতো রাতের হাতও বয়ে যাচ্ছে। ধীরগতিতে পেটের নাভীমূল ছেড়ে গলায় এসে থমকে গেলো।

সন্ধ্যার বন্ধ চোখের পাতা কাঁপছে,নাকের পাতার সাথে শুকনো হলদে ঠোঁটজোড়াও কাঁপছে। গাঢ় টানের ঘন শ্বাস নেওয়াই গলার বিউটি হাড়ের মধ্যবর্তী গভীর গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। এই গভীর গর্ত তো এই ভরা গর্ত। রাত বেশ কিছুক্ষণ গভীর গর্ত আর ভরা গর্ত উপভোগ করলো। রাতের বা-হাতে ভর ছেড়ে দিয়েই সন্ধ্যা অনেকটা ধনুকের ন্যায় পিছনে ঝুকে আছে। বুকের বিস্তৃতি ঢাকার জন্য ব্যবহৃত হাতের আড়াআড়ি বেড়াজাল খসে গিছে অনেক আগেই। দুপাশে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে।

সন্ধ্যাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরতেই ও দুহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো রাতের শরীরটাকে। শক্তবাধনে বেধে নিয়ে হারিয়ে যাওয়ার প্রবল উত্তেজনা!

আমি চাইলেই এখন তোকে নিয়ে হারিয়ে যেতে পারি রাতের উষ্মামহলে। আমাকে বাধা দেওয়ার বিন্দুমাত্র শক্তিটুকুও তোর মধ্যে বেঁচে নেই। কিন্তু তা আমি চাইনা,কখনো চাইনি। যদি চাইতাম তাহলে অনেক আগেই অনেক কিছু হতে পারতো আমাদের মধ্যে। কিন্তু আমার তো ইচ্ছে ছিলো এক পবিত্র চাওয়ার,পবিত্র বন্ধনের। তার অপেক্ষায় আমি প্রহর গুনছিলাম। কিন্তু!

রাতের মনে চলা ভাবনার রাজ্যে বাধা দিতেই সন্ধ্যা ওকে আরো জোরে চেপে ধরলো। এক নতুন অনুভূতির ছোয়া পাওয়ার জন্য ছটফটি নিশ্বাস তার। নিশ্বাসের স্পষ্ট শব্দ রাতের কানে বাজছে।

রাত দুহাতে সন্ধ্যার মাথার দুধারে চুলের উপর চেপে ধরলো। মুখটা বুক থেকে ছাড়িয়ে একটু বাকা করা। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম,আমার ভালোবাসার স্পর্শ তোকে কতটা ঘায়েল করতে পারে। তুইতো পুরোপুরি নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিস স্বপ্নবধু,এর দুটো কারণ হতে পারে। এক. আমার ভালোবাসার স্পর্শ তোর খুব গভীরে গিয়ে ছুয়েছে আর দুই. আমিই প্রথম পুরুষ যে তোকে এভাবে ছুয়েছে!

“” তোর যে শ্বাসকষ্ট আছে,এটাতো আগে চোখে পড়েনি!””

রাতের তীক্ষ্ণ কন্ঠে সন্ধ্যা চট করে চোখ মেলে। তার সাথে কি হয়েছে,কি হতে চলেছে,কিই বা হচ্ছে তাই বুঝার চেষ্টা করছে। সন্ধ্যার ফ্যালফ্যাল চাহনি দেখে রাত কিছটাু বিদ্রুপসুরে বললো,,

“” তুই ও কি শ্বাসকষ্টরোগি? এভাবে টেনে টেনে নিশ্বাস নিচ্ছিলি যে?? চারপাশেতো অক্সিজেনের অভাব নেই,তাও তোর এতো কম পড়লো? সবারটা তুই একাই টেনে নিচ্ছিস!””

রাতের কথা সন্ধ্যার মাথায় ঢুকছেনা। মনে হচ্ছে সে মাত্রঘুম থেকে উঠেছে,এক ভয়ংকর স্বপ্নতে ডুবে ছিলো।

“” দেখি শাড়ীটা একটু উপরে তোল তো। তোর পায়ে এখনো হলুদ লাগানো বাকি। শেষেতো আমাকেই দোষ দিয়ে বলবি,রাত ভাইয়া তুমি এতো কিপটে কেন? একটুখানি হলুদ মাখলে,ধোয়ার আগেই শেষ। তোর এইসব কুটনীতিবাদ কথাতে আমি নেই। নে নে শাড়ীটা উপরে তোল!””

রাতের তাড়া দেওয়া কন্ঠে সন্ধ্যার উগ্র চাহনি। মেঝেতে চোখ পড়তেই শাড়ীর আঁচলে আটকে গেলো। আঁচল কাধে না থেকে মাটিতে কি করছে? দ্রুত ভাবনাতে সবটা ঝকঝকা আয়নার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সাথে সাথে লজ্জার আবরণে জড়িয়ে পড়ছে। রাতের দিকে তাকানোর শক্তিটাও সে হারিয়ে ফেলেছে। ইশ! কি লজ্জা! রাত ভাইয়া আমার সব সরম দেখে ফেলেছে নাকি?? আমিও কি মুভির হিরোইনদের মতো শ্বাসকষ্টে ভুগছিলাম?? সন্ধ্যা এই মরণ লজ্জা থেকে বাঁচার উপায় খুজছে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে পেছনঘুরে দৌড় দিতেই রাতের হাতে বাধা পড়লো।

“” হলুদপর্ব শেষ না করেই পালাচ্ছিস?””

সন্ধ্যার গলায় কথা আটকে আছে। ভেতরেও ঢুকছেনা বাইরেও আসছেনা। এ কেমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো সে?? না পারছে চুপ করে থাকতে না পারছে কিছু বলতে! সন্ধ্যা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রাত ওর হাতটা ছেড়ে দিলো। কাছে এগিয়ে এসে আঁচল কুড়িয়ে কাধে রাখতে রাখতে বলছে,,

“” শক্ত হতে শেখ,নিজেকে নিজের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখ । তোর সবটাতে শুধু তোর স্বামীর অধিকার। মনে রাখিস,তোর হাতের নখস্পর্শটাও যেন তোর স্বামীর ছোয়াই হয়। একমাত্র তার ছোয়াতেই লজ্জায় লাল হবি অন্যকারো ছোয়াতে নয়। অন্যদের জন্য লজ্জায় লাল নয়,রাগে লাল হবি। আর সেই অন্যদের মাঝে আমিও পড়ি!””
“” সায়নরা কাল কখন আসবে?””

সন্ধ্যার আকস্মিক প্রশ্নে রাত থমকে গেলো। না রাত নয়,তার আশেপাশের সব প্রাণগুলো থমকে গিয়েছে,শুধু জড়বস্তুগুলো জীবন্ত। যারা তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। রাত থমকে যাওয়াসুরেই বললো,,,

“” জুমু’আর নামাজের পর রওনা দিবে।””
“” ওহ!””

সন্ধ্যা ছোট্ট শব্দটা প্রয়োগ করে পা চালালো সিড়ির দিকে। তার আর হলুদপর্ব শেষ করা হলোনা।

থমকে যাওয়াটা রাত ঠিক বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। মিনিটখানি পার হতেই সে অস্থির হয়ে উঠে,বুকের ভেতরের চাপা ব্যর্থতার আর্তনাদটা প্রবল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই অসহ্য যন্ত্রণা ভেতরে আটকে রাখতে ব্যর্থ সে। দু-হাত দুদিকে ছড়িয়ে দুনিয়া কাঁপানো চিৎকারে ফেটে পড়ে। তার গলা ছাড়া চিৎকারে কি পৃথিবী কেঁপে ভুমিকম্প হয়ে গেলো? সেই কম্পন কি সন্ধ্যাকে নাড়িয়ে দেয়নি?? শুনতে পায়নি সে রাতের ব্যর্থতার আর্তনাদ???

সখী বুঝলিনা তুই,,,,
বুকের ভেতর গেঁথে দিলি যাতনার সুই,,,,

~~

আজকাল সায়ন চোখের পাতা বন্ধ করতে ভয় পায়। কেমন এক ভয়-ভীতি কাজ করে তার মনের ভেতর। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে রাত ওর গলা টিপে ধরেছে,নাহয় নাকে বালিশ চেপে ধরে আছে। সব ভয়-ভাতি পার করে যখন ঘুমিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনি সে ভয়ংকর স্বপ্নে ধরফরিয়ে উঠছে। স্বপ্নেও সে রাতের গন্ধ পায়। এখনো পাচ্ছে। রাতের গন্ধ মানেই তীব্র ভয়ংকর কিছু ঘটা। গন্ধে গভীর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে সায়নের। চোখ বন্ধ করে কানখাড়া করতেই খচখচ শব্দ। সায়ন আর চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে পারছেনা। এদিকে ভয়ে চোখটা মেলতেও পারছেনা। ভয়ে শিউরে উঠছে,চোখ মেললেই যদি পেটে ছুরি চালিয়ে দেয়??

সায়নের মাথায় চলা হাজারও চিন্তাভাবনার রেশ কাটিয়ে হালকা করে চোখ মেলে পাশ ফিরলো।

“” অতিরিক্ত টেনশনে তুই করিস?””

রাতের প্রশ্নে সায়ন পুরো চোখ মেলে থ হয়ে রয়েছে। মুখটা থ হলেও ঘাড়টা হয়নি। রাতের অস্থিরতায় চলতে থাকা পা দুটো রুমের এপাশওপাশ ছুটে বেড়াচ্ছে। সে সাথে সায়নের ঘাড়টাও একবার এপাশ তো আরেকবার অপাশ ঘুরছে। রাত নিজের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আরো দু/এক রাউন্ড পায়চারী পর্ব শেষ করে এসে পুনরায় বললো,,

“” অতিরিক্ত টেনশনে তুই কি করিস?””
“” সিগরেট খাই!””

সায়নের দিক থেকে উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে রাত ওর উপর হামলে পড়ে,সায়ন আকুলকন্ঠে লাগাতার বলে যাচ্ছে,,

“” ভাই,আমি এখনি মরতে চাইনা,ছেড়ে দে। আমি ভুলেও তোর বাড়িমুখো হবোনা।””
“” সিগরেট কোথায় রেখেছিস?””

রাতের অশান্ত কন্ঠে সায়ন নিজের ভুল ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিলো। রাততো ওকে মারতে নয়,ওর প্যান্টের পকেট হাতড়াচ্ছিলো সিগরেটের জন্য। সায়ন সহজ গলায় বললো,,

“” আমি সিগরেট বাসায় খাইনা,তুই জানিসনা?””
“” তুই খাসনা সেটা তোর সমস্যা। আমি খাবো। এক্ষুনি ব্যবস্থা কর নাহলে তোর পেছনে আগুন জ্বালিয়ে তোকেই খাওয়া শুরু করবো!””

জ্বলন্ত সিগরেট দুঠোঁটের মাঝে ধরে আছে রাত। ভেতরে ধোয়া টেনে নিতেই শরীর কাঁপিয়ে খকখক করে উঠলো। মুখের সিগরেট নিচে পড়ে গিয়েছে। সায়ন দৌড়ে এসে বললো,,

“” যেটা তোর কর্ম নয়,সেটা না করলেই কি নয়?””
“” তুই কি আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস?””
“” উহু! এমনি বললাম।””
“” তুই আমার সন্ধ্যাকে ছুবি? এটা আমি কি করে সহ্য করবো বলতো?””
“” আচ্ছা ছুবোনা।””

সায়নের দ্রুত উত্তরে রাত ওর গলা টিপে ধরে বললো,,

“” কেন ছুবিনা? ও তোর বউ হবে,তুই ওর বর হবি,তাহলে কেন ছুবিনা?””
“” তুই বাঁচতে দিলে ছুবো!””

রাত গলা ছেড়ে আবার অসহায় গলায় বললো,,

“” আমি ওকে না দেখে কিভাবে বাঁচবো?””
“”তোর যখন দেখতে ইচ্ছে হবে তখনি আমাদের বাসায় চলে আসিস,আমার কোনো আপত্তি নেই!””

রাত অগ্নিনিক্ষেপ করতেই সায়ন আধোভাঙা গলায় বললো,,

“” না মানে,আমার বাসা আর তোর বাসা তো একি জায়গায়,১০ মিনিটের দূরত্ব! তাই মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে।””

রাত পলক ফেলে সায়নের দিকে চেয়ে থাকে। বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাই দীর্ঘশ্বাস! দীর্ঘশ্বাসটা আর আটকে রাখতে পারলোনা,মুক্তবাতাসে ছেড়ে দিয়ে বললো,,

“” সন্ধ্যার স্বামী হিসেবে ওকে ভালোবাসার পুর্ণঅধিকার তুই পাবি,এতে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে হ্যা ব্যথা তো এক জায়গায় আছে সেটা হলো ওর চোখের পানিতে। ওকে কষ্ট দেওয়ার চিমটিখানি অধিকারও তোর নেই,আমি তোকে দিবোনা। আর আমি না দিলে সেটা তুই নিতে পারবিনা এটাও নিশ্চয় তোর জানা আছে?””
“” হুম!””

~~

রাতের দেওয়া বেনারশীটাই পড়েছে সন্ধ্যা। ভালো লাগছে নাকি খারাপ লাগছে বুঝে উঠতে পারছেনা। তবে এক অদ্ভুত মন খারাপে ছেয়ে আছে তার পুরো শরীর। নাকে নোলক,কানে দুল,গলায় গয়না,সিথীতে টিকলি,হাতে ঝনঝন ভারী চুড়ি সাথে ভারী মেকাপ,কোনোকিছুই বাদ নেই। তবুও বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা খালি আছে যার কারণে তাকে বউবউ লাগছেনা৷ মনের এই খুতখুতুনি নিয়ে বারবার আয়নায় নিজেকে পরখ করছে সন্ধ্যা।

“” তোকে তো একদম পুতুলবউ লাগছে রে সন্ধ্যা!””

দিয়ার কন্ঠ পেয়ে সন্ধ্যার মেজাজ চরকগাছ।

“” তুই এখানে?””
“” বারে,তোর বিয়ে আর আমি আসবোনা? তুই বলতে ভুলে গেলে কি হবে? তোর রাত ভাইয়ার তো ঠিক মনে আছে। উনি তো আমাকে কল দিলেন।””
“” রাত ভাইয়া তোকে কল দিয়েছে?””
“” হুম।””

আমি বাড়ি ছাড়া আগেই এসব নষ্টামি শুরু হয়ে গেছে? আমার বান্ধুবীর নাম্বার আমার কাছে নেই অথচ তার কাছে ঠিক আছে?? ছি!

সন্ধ্যা কল্পনায় নাক সিটকাতেই রাতের আগমন,,

“” দিয়া,তুমি কি আমাকে একটু হ্যাল্প করতে পারবে?””

রাতের এমন আবেদনী সুরে সন্ধ্যার গা জ্বলে যাওয়ার অবস্থা। ইচ্ছে করছে গলায় কাঁটাচামচ ঢুকিয়ে দিতে।দিয়ার আহ্লাদী সুর,,

“” কি হ্যাল্প বলুন!””
“” আমার রুমে যেতে হবে।””
“” হ্যা,এক্ষুনি যাচ্ছি!””

দিয়া দ্রুতপদ ফেলতেই উপুত হয়ে পড়ে গেলো। সন্ধ্যা মুচকি হেঁসে উঠে ওকে টেনে তুলতে তুলতে বললো,,

“” রাত ভাইয়া,ও তো হাঁটতেই শিখেনি,কি করতে হবে আমাকে বলো।””
“” তুই কনে সেজে আমার রুমে যাবি? আমার পান্জাবী ইস্ত্রী করবি? মানুষ কি বলবে? দিয়াই পারবে। দিয়া এসোতো।””

~~

বরযাত্রী এসেছে প্রায় একঘন্টা হতে চলেছে। এখনো বিয়ের কার্যকলাপ শুরু হয়নি। সন্ধ্যার বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। ভারী মেকাপ তার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রুমভর্তি মেয়েরা তাকে ঘেরাও করে রেখেছে। হাসি-ঠাট্টাতে ওর কান ঝালাপালা। সন্ধ্যা মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,বিয়ে মানে কষ্ট কষ্ট আর কষ্ট!

মাগরিবের আযানের পর কাজী সন্ধ্যার কাছে এলো। সাথে রাতও এসেছে। কালো পান্জাবীতে সন্ধ্যার কোমড় ব্যথা গায়েব। গরমও লাগছেনা,পৃথিবীর সবটা অক্সিজেন নিয়েই কি হাজির হয়েছে?? মনটা এতো ভালো লাগছে কেন??

কাজী সাহেব তার সকল বয়ান পেশ করে সন্ধ্যাকে কবুল বলতে বললেন। সন্ধ্যার সেদিকে কোনো হুশ নেই,তার চোখ তখনো রাতের দিকেই আটকে আছে।

রাতও চুপচাপ দাড়িয়ে আছে,হাতদুটো বুকে বাধা,চোখে তীক্ষ্ণদৃষ্টি এমন একটা ভাব যে দেখি তুই আমার সামনে কিভাবে কবুল বলিস!

পাশ থেকে দিয়ার ধাক্কাতে সন্ধ্যার ভ্রম কাটে। আশেপাশের অবস্থা বুঝে উঠে। কাজী সাহেব পুনরায় কবুলের আর্জি তুললেন। সন্ধ্যা একবার রাতের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার কাজীর দিকে। চোখে বন্যা বয়বে বয়বে ভাব। সন্ধ্যা চারপাশে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো। পানি পিপাসা পাচ্ছে। একটু কি পানি চাইবে? যদি সবাই হেঁসে ফেলে??

“”পানি খাবি?””

রাতের সহজ গলার প্রশ্নে সন্ধ্যা মাথা নিচু করে বললো,,

“” হুম!””

রাত পানির উদ্দেশ্যে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ভেতর থেকে চেঁচামেচির শব্দ। বিয়ের কনে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।

সন্ধ্যার মা রিমা কাঁদতে কাঁদতে সন্ধ্যার মুখ ভিজিয়ে ফেলেছেন তবুও তার জ্ঞান ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। এদিকে পুরোবাড়িতে হা-হুতাশ চলছে,বিয়ের কনে কবুল বলার আগেই অজ্ঞান!

সিকান্দার সাহেব মেয়ের এমন গাঢ় অজ্ঞানে অস্থির। ফোনের পর ফোন লাগাচ্ছেন এ্যাম্বুলেন্সের জন্য। অপেক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিবেন তখনি রাতের বাধা।

“” আপনারা সবাই যার যার রুমে যান। বাইরের গরম পরিবেশ ঠান্ডা করুন। ওকে আমি দেখছি।””

সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিলো রাত। গাড়ীর পেছন সিটে শুয়িয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। ইঞ্জিনটা সচল করতে করতে বললো,,,

“” আমি কাউকে কল না দেওয়া পর্যন্ত আমাকে কেউ কল দিবেনা।””

~~

সময় যত গড়াচ্ছে গাড়ীর স্পিড তত বেড়েই বলেছে। চারপাশের কোলাহল কমে গিয়ে নিস্তব্ধতা বাসা বাধছে,ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারপাশ। শুয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যার শরীর কাহিল। জেনেশুনে কারণ ছাড়া এভাবে কতক্ষণ শুয়ে থাকা যায়? গাড়ীতো থামছেইনা। চলন্ত ট্রেনও তো সময় ছেড়ে থেমে আবার চালু হয় কিন্তু এটা কেন হচ্ছেনা? রাত ভাইয়া কি গাড়ী থামাতে পারছেনা? ব্রেক ফেইল করলো নাকি??

সন্ধ্যা শোয়া থেকে উঠে রাতের পেছন থেকে উপুত হয়ে বললো,,

“” আমাকে কি পাঁচার করে দিবে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?””

সন্ধ্যার কন্ঠ পেয়েই রাত আচমকা ব্রেক কষে। সন্ধ্যা তাল সামলাতে না পেরে পিছনে সিটের সাথে ধাক্কা খেলো।

“” ওহ! মাগো মাথাটা বুঝি ফেটেই গেলো।””

রাত সন্ধ্যার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাড়ালো। সন্ধ্যাও নেমেছে। মাথা ঢলতে ঢলতে বললো,,

“” আমাকে হসপিটালে না নিয়ে এটা কোথায় আনলে?””

রাস্তার দুধারে সারিসারি গাছ। চারপাশটা নিরবের হাঁট,সেই হাঁটে জোনাকিপোকারা একটু পরপর উকি দিচ্ছে। মিনিট বাদে বাদে দু একটা গাড়ী ছুটে যাচ্ছে। সন্ধ্যারা এসেছে কোথায় সেটাই বুঝতে পারছেনা। যতদুর চোখ যাচ্ছে আঁকাবাঁকা রাস্তা মিশে যাচ্ছে অন্ধাকারের হা’তে।

“” রাত ভাইয়া,আমরা কোথায় এসেছি? বাংলাদেশে আছিতো?””

সন্ধ্যার কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে রাত রাস্তার কিনার ধরে হাঁটা শুরু করলো।

“” আরে,কোথায় যাচ্ছো?””

সন্ধ্যার কোনো কথার উত্তরই দিচ্ছেনা রাত। দেওয়ার কোনো অঙ্গভঙ্গিও নেই। সে আপনমনে হেঁটেই চলেছে। বরং পায়ের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা দৌড়ে এসে রাতের পথ আটকে দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছে।

“” তুমি দেখতে পারছোনা,হাঁটতে পারছিনা? উফ! আবার মুখেও কুলু পেতেছো। সমস্যা কি?””

রাত সন্ধ্যাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই সন্ধ্যা একদমে বললো,,

“” আমি তোমাকে ভালোবাসি,তোমাকে বিয়ে করবো,কবুল কবুল কবুল!””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here