ভালোবাসার শহরে,পর্ব:১

#ভালোবাসার_শহরে
#ঈপ্সিতা_মিত্র

<১>
পরিণীতা আজ তাড়াহুড়ো করেই পা চালাচ্ছিল কলেজ শেষে | লাইব্রেরি থেকে বেশ কয়েকটা রেফারেন্স বই নিয়েছিল ও | সেগুলোই ফেরত দিতে যাচ্ছে | কিন্তু এখন আর সেই বইগুলো ব্যাগে ঢোকানোর মতনও টাইম নেই | অলরেডি চারটে বাজে | সাড়ে চারটে থেকে পড়ানো আছে পাশের বাড়িতে | আজ থেকেই এই নতুন টিউশনটার শুরু | তাই প্রথম দিন দেরি করতে পারবে না | এইসব ভেবেই বেশ জোরে পা চালাচ্ছিল করিডোর দিয়ে | একটু যেন নিজের মনেই চলছিল পরিণীতা | তাই উল্টো দিক থেকে আসা ছেলেটার দিকে বিশেষ খেয়াল করেনি | সেই ছেলেটাও অবশ্য পরের ক্লাসের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনেই এগিয়ে যাচ্ছিলো করিডোর দিয়ে ! আর তখনই ধাক্কাটা লাগলো পরিণীতার সঙ্গে | পরিণীতার হাতে ধরা বইগুলো চোখের পলকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চারিদিকে | পরিণীতা তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিরকম থতমত হয়ে গেছিলো এলোমেলো বই এর দিকে তাকিয়ে | তারপর হঠাৎ খেয়াল হলো সাড়ে চারটে থেকে পড়ানো ! তাই আর থমকে না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি মেঝে থেকে বইগুলো তুলতে শুরু করলো হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে | তবে উল্টোদিকের ছেলেটাও চলে না গিয়ে ওর বইগুলো গোছানোর জন্য এগিয়ে এলো | তারপর তিনটে বই তুলে ওর হাতে দিতেই পরিণীতা প্রথম খেয়াল করলো ছেলেটাকে | হালকা দাড়ি , চোখে চশমা , মুখটা বেশ সুন্দর ! মানে একবার দেখলে দু চার সেকেন্ড তাকিয়ে থাকতেই হবে এরকম চেহারা ! কথাটা মনে আসতেই আবার খেয়াল হলো সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছতে হবে | আর এটাও মনে হলো ও একটা মেয়ে হয়ে এরকম একজন ছেলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে খারাপ দেখায় | তাই তাড়াতাড়ি একটু জোর করেই চোখটা সরিয়ে নিয়ে বইগুলো সমেত উঠে দাঁড়ালো | তারপর একটু আস্তে গলায় বলে উঠলো ,

———– ” সরি , আমি আসলে খেয়াল করিনি | তাই ঐভাবে ধাক্কা লাগলো |”

কথাটা শুনে ছেলেটা আলতো হেসে বললো ,

———— ” নো ইট’স ওকে … আমিও বেখেয়ালে হাঁটছিলাম | এনিওয়েজ আসি …”

কথাটা শেষ করেই আর ও অপেক্ষা না করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো পরিণীতার | কিন্তু এই মুহূর্তে একটা হালকা চন্দনের পারফিউমের গন্ধ যেন ওর নাকে এসে মিলিয়ে গেলো হঠাৎ | পরিণীতা এর মাঝে চাইলেও না থমকে থাকতে পারলো না ! একবার পেছন ঘুরে ওকে তাকাতেই হলো ফাঁকা করিডোরে হাঁটতে থাকা ছেলেটার দিকে | মনে হলো ‘ইশ , নামটাই তো জিজ্ঞাসা করা হলো না !’ তবে ও যা লাজুক , নাম জিজ্ঞাসা করার কথা মনে আসলেও মুখে কিছু বলতে পারতো না ! কথাটা ভাবতেই হঠাৎ অর্না ওর পাশে এসে প্রায় লাফাতে লাফাতে বলে উঠলো ,

————– ” উফ কি করেছিস রে তুই ! খেলি তো খেলি অনির্বানদার সঙ্গেই ধাক্কা খেলি ! পুরো কলেজের ক্রাশ ! কি দেখতে না ? আর পড়াশোনাতেও বিশাল হাইফাই শুনেছি | ”

কথাটা শুনে পরিণীতা একটু এলোমেলো হয়ে বললো , ———— ” কি যে বলিস না ! তুই কোথা থেকে এলি ? আমি তো ভাবলাম বাড়ি চলে গেছিস |”

এটার উত্তরে অর্না বেশ অভিমানী সুরেই বলে উঠলো , ———— ” তোকে ছেড়ে কখনো গেছি বাড়ি ! আমি তো একটু ক্যান্টিন থেকে ঘুরে এলাম | একটা চিকেন পকোড়া না খেলে হচ্ছিলো না ! পেটটা কিরকম খালি খালি লাগছিলো |”

কথাটায় পরিণীতা এবার হেসে উঠলো অর্নার দিকে তাকিয়ে | তারপর ওর হাতে দুটো বই ধরিয়ে দিয়ে বললো , ———- ” বুঝলাম | চল এবার লাইব্রেরি তে | বইগুলো ফেরত দিতে হবে |”

কথাটা বলেই আর দাঁড়ালো না | পা চালালো বেশ জোরে | তবে অর্নাকে কিছু না বললেও মনে মনে নামটা জেনে বেশ খুশিই হলো | অনির্বান ! ওর ক্লাসের মেয়েদের মুখে শুনেছে অনেকবার নামটা ! এম.এস.সি সেকেন্ড সেম এর স্টুডেন্ট না কি | ফিজিক্স নিয়ে | সবাই আলাপ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকে এর সঙ্গে | কেউ কেউ তো যেচে পরে কথাও বলে আসে অনির্বান এর সঙ্গে | তবে শুধু পড়াশোনাই না , ডিবেট কম্পিটিশন , কুইজ এসবেও ছেলেটার বেশ নাম আছে | প্রফেসরদের কাছেও অনির্বানের কথা শুনেছে বেশ কয়েকবার | এই যেমন জে.ডি স্যার পরশুদিনই তো বলছিলো ক্লাসে পড়ানোর মধ্যে , ——— ” ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট এর অনির্বান ইন্টার কলেজ ডিবেট কম্পিটিশন জিতে এসেছে | ব্রিলিয়ান্ট ছেলে |”

তবে এতো নাম ডাক থাকলেও তাকে দেখা হয়নি পরিণীতার এই দু মাসে | এমনিতেই ফার্স্ট ইয়ার , তার ওপরে ইন্ট্রোভার্ট লাজুক স্বভাব | তাই মনে মনে একটা কৌতুহল থাকলেও সেটা মেটানোর চেষ্টা ও করেনি একেবারেই | তবে আজ আচমকা অনির্বান দর্শন হয়ে এক পলক ভালো লাগা এসে ভিড় করলো পরিণীতার চারিদিকে যেন | কয়েক মুহূর্তেই |

<২>

“‘ক্যান্টিনোলজি’ বলে যদি কোনো সাবজেক্ট থাকতো , আমি সেটাতেই অনার্স করতাম জানিস !”, ————- ভিড়ে ঠাসা ক্যান্টিনে ঢুকে পরিণীতার হঠাৎ অর্নার কথাটা মনে পরে গেলো যেন | আজ মেয়েটা আসেনি কলেজে | তাই একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেমন পরিণীতার | আসলে বন্ধু বলতে ওই একজন | বাকি সবাই শুধু ক্লাসমেট | পরিণীতা আসলে নিজে গিয়ে খুব আলাপ জমাতে পারে না তো ! আর বেশি কথা বলার মতন কিছু খুঁজেও পায় না নতুন কারোর সঙ্গে , তাই এই স্কুল থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা অর্না ছাড়া আর কোনো বন্ধু নেই ওর | তবে এই একটা বন্ধুই দশজনের সমান | ওই ক্লাস ফাইভ থেকে বেঞ্চে ওর পাশে বসতো | সেই থেকে আজ অব্দি অর্না রণে বনে জলে জঙ্গলে সব জায়গায় পরিণীতাকে কোম্পানি দিতে হাজির | কখনো অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে ওকে হাসায় , তো কখনো নোটস দিয়ে , বই দিয়ে হেল্প করে , অর্না সব সময় ওকে আগলে রাখে যেন | তবে মেয়েটার হাসি মুখের আড়ালেও একটা দুঃখ অপমান আছে সারাক্ষণ | এটা শুধু পরিণীতা জানে | অর্না আসলে ছোট থেকেই বেশ মোটা | খেতেও ভালোবাসে খুব | সেই জন্য সেই স্কুল থেকে কলেজ অব্দি , সব জায়গায় লোকজন এতো টিজ করে ! অনেকে তো নামটা বলেও ডাকে না ক্লাসে ! ‘মুটকি’ , ‘গোলু’ এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত নাম দিয়ে দেয় ওর | তাই অর্নাও খুব বেশি বন্ধু করে না নিজের | তবে পরিণীতাকে ও বলে মাঝে মাঝে , ———–” এই জন্য তোকে আমার সবার থেকে খুব আলাদা লাগে জানিস পরি ! তুই আমার নামটা ভুলিসনি কখনো ? আমার নামটা আমার খুব প্রিয় জানিস ! কিন্তু সেটা যেন আমার চেহারার মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেছে !”

আজও কিরকম কথাটা মনে পরে গেলো পরিণীতার ক্যান্টিনে খাবার নেয়ার লাইনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে | সত্যি , বড্ডো মিস করছে আজ মেয়েটাকে ও | নইলে কথায় কথায় শুধু অর্নার কথা ভাবছে কেন ! তবে এবার ভাবনার সঙ্গে রাগটাও হলো একটু | কালই তো রবিবার | কলেজ ছুটি | কালই একেবারে যেতে পারতো মামার বাড়ি | আজ থেকে গিয়ে বসে থাকার কি মানে ! যাইহোক , এইসব এলোমেলো চিন্তার মাঝেই ক্যান্টিনের সত্যেন কাকু চেঁচিয়ে বলে উঠলো , ————- ” বলো কি খাবে তুমি ?”

পরিণীতার যেন সম্ভিত ফিরলো কথাটায় | ও এক সেকেন্ড ভেবে বলে উঠলো , ————- ” ওই তো , পরোটা আর ঘুগনি |”

কথাটা বলেই ও পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে দিলো সামনে | কিন্তু সত্যেন কাকু হঠাৎ পঞ্চাশ টাকার নোটটা দেখে খিটখিটে গলায় বলে উঠলো ,

————— ” খুচরো দিতে পারবো না এখন | ভিড় আছে অনেক | আঠেরো টাকা এমনি দাও |”

কথাটা শুনে পরিণীতা একটু থতমত গলায় বললো , ————- ” কিন্তু আমার কাছে তো এখন খুচরো কিছুই নেই | দাও না একটু ম্যানেজ করে |”

এর উত্তরে সত্যেন কাকু বেশ ঝাঁঝিয়েই বললো , ————- ” বললাম তো হবে না ! দেখছো না ভিড় কত ! খুচরো থাকলে দাও , নইলে সরো | ”

কথাটা বলেই উনি লাইনে পরিণীতার পরের জনকে বলতে শুরু করলেন ‘কি খাবে বলো !’

না , পরিণীতা এরপর আর বিশেষ কিছু বলতে পারলো না ! সত্যেন কাকু সব সময়ই এরকম খিটখিটে মেজাজ করে কথা বলে | অনেকের সঙ্গে সেই জন্য ঝগড়াও লাগে | তবে পরিণীতার সেই ক্ষমতা নেই | তাই মুখটা অন্ধকার করে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিলো লাইন থেকে ! আর হবে না খাওয়া ! আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই ক্লাস | তারপর তো টিউশনি আছে | সোজা চলে যেতে হবে | বাইরে বেরিয়ে যে কিছু খাবে , তারও সময় নেই ! কথাগুলো ভেবে ও গোমড়া মুখেই এক পা এগিয়েছিল , কিন্তু থেমে গেলো একটা গলার স্বরে | পাশ থেকে এসে হঠাৎ ওই সেইদিনের দেখা ছেলেটা , মানে অনির্বান বেশ দৃঢ় গলায় সত্যেন কাকুকে কুড়ি টাকা ধরিয়ে বলে উঠলো , —————- ” দাও ওকে পরোটা টা | আর এইভাবে কথা বলো কেন তুমি ? একটা বেসিক কার্টেসি দেখিয়ে কথা বলতে পারো না একটা মেয়ের সঙ্গে ? অদ্ভুত !”

কথাটা শুনে সত্যেন কাকু অনেক কিছু বলবে ভেবেও কিছু ঠিক না বলতে পেরে কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে পরোটা আর ঘুগনীর প্লেটটা এগিয়ে দিলো পরিণীতার সামনে | পরিণীতা কিছু অবাক হয়েই প্লেটটা নিলো এবার | তারপর বেরিয়ে এলো ভিড়ে ঠাসা লাইন থেকে বাইরে | ও এরপর একটু ইতঃস্তত করে সামনে এগিয়ে যাওয়া অনির্বানকে ডেকে বলে উঠলো ,

———- ” আপনি টাকাটা রাখুন প্লিজ ! ওই পরোটার দামটা !”

কথাটা শুনে অনির্বান এক সেকেন্ড থমকে গিয়ে পিছনে ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো , ——— ” আপনি ! তুমি এই যুগে আপনি করে বলো ? আর সিনিয়রকে টাকা অফার করতে নেই এইভাবে জানো না ? খেয়ে নাও বসে | আর পারলে এরপর যদি কখনো দেখা হয় , তুমি করে বোলো | বেটার …”

কথাটা শেষ করেই অনির্বান পরিণীতার চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলো কয়েক পলকে | তবে পরিণীতা যেন থতমত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারলো না ঠিক এখনও ! কখন যে লাইনের মধ্যে অনির্বান ওকে দেখেছে , খেয়াল করেছে , ও বোঝেইনি ! কিন্তু একটা কথা না ভেবে পারলো না | ছেলেটা আজ টাকাটা নিজে থেকে এগিয়ে এসে দিলো বলেই ও এখন খেতে পারবে ! কজন করে এইভাবে যেচে পরে কারোর হেল্প ! কথাটা মনে হতেই আবার এই ভিড়ের মাঝে ওর সেই হালকা চন্দনের পারফিউমের গন্ধটা যেন মনে এলো হঠাৎ , আর বিনা কারণেই একটা আলতো হাসি এসে জড়ো হলো ঠোঁটে |

<৩>

এরপর দুটো সপ্তাহ কেটে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে | অর্না চলে এসেছে মামারবাড়ির ছুটি কাটিয়ে এর মধ্যে | আর এসেই একটা কান্ড করেছে মেয়েটা | কলেজের নোটিশ বোর্ডে বড়ো বড়ো অক্ষরে কিছুদিন ধরে একটা পেপার ঝোলানো ছিল | সামনেই কলেজের ফাউন্ডেশন ডে তে যেই সব ছেলে মেয়েরা গান , নাচ , নাটক , যে কোনো ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড তারা কালচারাল প্রোগ্রাম এ পার্টিসিপেট করতে চাইলে নিজের নাম কালচারাল কমিটির কাছে দিতে পারে | এই খবরটা পড়েই অর্না দ্বায়িত্ব নিয়ে পরিণীতার নামটা দিয়ে এসেছে কমিটির কাছে , ওকে না জানিয়েই | যদিও এইসব জায়গায় কনেকশন না থাকলে পারফর্ম করা যায় না | মানে থার্ড ইয়ারের যারা কমিটিতে আছে , তারা নিজেদেরই চেনা পরিচিতদের নিচ্ছে , বা কলেজে যারা একটু ফেমাস | আর জুনিয়রদের চান্স নেই বললেই চলে | সেকেন্ড ইয়ার , থার্ড ইয়ারের ছেলে মেয়েরাই বেশি পারফর্ম করবে | তার মধ্যেও ফার্স্ট ইয়ারের অনেক স্টুডেন্ট আছে , যারা নিজেদের এপিয়ারেন্স এর জন্য চান্স পাচ্ছে | মানে স্মার্ট , মর্ডার্ন পোশাক আশাক এরকম | বাকিদের নাম নেয়া হলেও স্টেজ পাবে কি না সেটা ফাউন্ডেশন ডের দিনই জানা যাবে ! সেই দলে পরিণীতাও আছে | ও তো সেদিন প্রথম কথাটা শুনে বেশ রেগেই বলেছিলো অর্নাকে , —————- ” তোর কি দরকার ছিল এইভাবে গিয়ে আমার নামটা দিয়ে দেয়ার ? এমনিতেই আমার স্টেজে উঠলে ভয় লাগে !”

কথাটায় অর্না ওকে পাত্তা না দিয়েই বলেছিলো , ———— ” তুই এতো ভালো গাস ! কি হয়েছে নাম দিয়েছি তো ! জানি চান্স পাওয়ার চান্সটা কম | ফাউন্ডেশন ডে তে স্টেজ পেতে গেলে অনেক কনেকশন লাগে শুনেছি ফার্স্ট ইয়ারদের | যেটা তোর আর আমার নেই | কিন্তু তাও , যদি কোনোভাবে পেয়ে যাস চান্স , তাহলে ভাবতে পারছিস কি হবে ! পুরো কলেজ তোর গান শুনবে |”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেছিলো অর্না | পরিণীতা এটা শুনেও একটু নির্লিপ্তের মতন হয়ে উত্তর দিয়েছিলো ,

————– ” না শুনলেই বা কি ! সবাইকে ভিড় থেকে আলাদা হতেই হবে ? কেউ কেউ ভিড়ের মধ্যেই থাকে সারা জীবন | ”

এর উত্তরে অর্না সেদিন কোনো প্রত্যুত্তর না করলেও লাভ হয়নি বিশেষ তারপরেও পরিণীতার | ঠিক ফাউন্ডেশন ডের আগেরদিন অর্না কলেজ শেষে ওকে নিয়ে হাজির হয়েছিল রিহার্সাল রুমের কাছে | যদি বাই চান্স কোনোভাবে কাল স্টেজটা পেয়ে যায় পরিণীতা , তার আগে একটা তো স্টেজ রিহার্সাল দরকার | এই আশাতেই এসেছিলো অর্না ওকে নিয়ে | কিন্তু প্রায় তিন ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছিল এরপর | সিনিয়ারদের নাটক , নাচের রিহার্সাল সব শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছিলো | কলেজ আর পনেরো কুড়ি মিনিট বাদেই বন্ধ হয়ে যাবে | তবে অর্না ছাড়ার পাত্রী নয় | অতক্ষণ যখন বসে থেকেইছে তখন রিহার্সাল পরিণীতাকে দিয়ে না করিয়ে যাবে না | এইসব ভেবেই পুরো অডিটোরিয়াম খালি হয়ে যাওয়ার পরও সব শেষে পরিণীতাকে স্টেজে উঠতেই হলো | যদিও জানে কাল আসল অনুষ্ঠানে ও স্টেজ পাবে না ! তবে এইসব কথা অর্নাকে কে বোঝায় ! ওই মেয়েটা ওর জন্য আশা করেই যায় | তাই এতো সত্যি ওকে না বলে আজ শুধু ফাঁকা অডিয়েন্সের চেয়ারে বসে থাকার অর্নার জন্য ও মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে গান ধরলো , ‘ তাকে যত তারাই দূরে দূরে , তবু সে আসে মেঘলা চোখে ঘুরে ফিরে…’

মহীনের ঘোড়াগুলির এই গানটা ওর সব সময়ই খুব পছন্দের | আজ এই গানটাই ও নিজের মনে গাইছিলো ফাঁকা অডিটোরিয়ামে | তবে বোঝেনি অর্না ছাড়াও সেদিন ওর গান শোনার জন্য আর একজন ছিল কলেজে | ল্যাবে কিছু কাজ করতে করতে আজ দেরি হয়ে গেছিলো অনির্বানের | আবার একটা টিউশন পড়তে যাওয়া আছে ছটা থেকে | নেট এর প্রিপারেশনস নিচ্ছে ও এখন থেকেই | এইসব ভাবতে ভাবতেই অনির্বান আনমনে কলেজের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলা থেকে নেমে আসছিলো নিচে | তবে থমকে গেলো হঠাৎ এই গলার আওয়াজটা শুনে | ‘মহীনের ঘোড়াগুলির’ গান না ! এতো সুন্দরভাবে কে গাইছে ! ‘ থাকি আমি ভয়েই দূরে দূরে , যদি সে গেয়ে ওঠে অন্য কোনো সুরে ‘ , লাইনগুলো একেরপর এক ওর কানের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে এখন | অনির্বান খেয়াল করলো অডিটোরিয়াম রুম থেকেই আওয়াজটা ভেসে আসছে | কাল ফাউন্ডেশন ডে না কলেজে ! তার ফাংশনেরই তো রিহার্সাল চলছে | কিন্তু এতদিন হয়েছে , এতো ভালো গান তো ও শোনেনি আগে এই কলেজে ! কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতেই ও যেন সুর টা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো সেদিন অডিটোরিয়ামের কাছে | মনে হচ্ছিলো এই গলার আওয়াজ যার , তাকে একবার তো দেখতেই হবে চোখে | কিরকম কৌতূহল হচ্ছিলো মনে | আর এইসবের মাঝেই সেদিন ও হাজির হয়েছিল স্টেজের সামনে | ফাঁকা কলেজে তখন শুধু অর্না একা একা দাঁড়িয়ে গান শুনছিলো পরিণীতার | কিন্তু আচমকা কলেজের এই অনির্বানকে দেখে অবাক হয়ে গেলো একটু | পরিণীতা যদিও সেটা দেখেনি | ও চোখ বন্ধ করেই নিজের মনে গেয়ে যাচ্ছিলো গানটা | তবে অর্না খেয়াল করছিলো অনির্বান কিরকম নিস্পলকভাবে তাকিয়ে আছে এই গানটার দিকে , পরিণীতার দিকে ! যেন ও হারিয়ে গেছে ওর গানের সুরে | তারপর একটা সময় পরিণীতা ‘ভর দুপুরে একলা রাতে অন্য মন ‘ লাইনটা গেয়ে গানটা শেষ করে তাকালো ফাঁকা অডিটোরিয়ামে | কিন্তু চোখ খুলেই ও একটু স্থির হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড | গানের শুরুতে তো শুধু অর্না ছিল | অনির্বান কখন এলো ! কথাটা ভাবতেই অনির্বান হাততালি দিয়ে উঠলো নিজের মনে | তারপর আর অপেক্ষা না করে একেবারে স্টেজে উঠে ওর সামনে গিয়েই বললো ,

———- ” হাই … তোমার নাম কি ? তুমি এতো ভালো গান গাও ! সিরিয়াসলি ! কাল গাইবে তুমি ফাংশনে ?”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অনির্বান | তবে পরিণীতা এর কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না ! কারণ কাল ও গাইতে পারবে কি না সেটা তো নিজেই জানে না | তাই দু সেকেন্ড চুপ ছিল | কিন্তু এই নিঃস্তব্ধতার আড়ালেই অর্না ওদের কাছে এসে বলে উঠলো ,

————- ” আসলে কনফার্ম নোই | আমরা তো ফার্স্ট ইয়ার | স্টেজ কাল দেবে কিনা কেউ জানি না | তাই পরিণীতা গাইবে কি না সেটার ঠিক নেই | তবে আমার জোরাজুরিতে অনেকক্ষণ ওয়েট করার পর অবশেষে রিহার্সালের জন্য স্টেজটা পেয়েছে আজ | ”

কথাটা শুনেই অনির্বান এবার নিজে থেকেই বলে উঠলো , ———— ” স্টেজ পাবে না মানে ! এতো ভালো গান গায় ! এরকম ট্যালেন্ট সবার সামনে আসা উচিত | তোমরা চিন্তা করো না , কি যেন নাম বললে , পরিণীতা ! আমি এই নামটা কাল রেকমেন্ড করবো | কমিটিতে আমার সব বন্ধুরাই আছে | শুধু সময় মতন চলে এস কাল তোমরা | বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি |”

কথাটা বলেই আলতো হেসে অনির্বান যেতে যাচ্ছিলো , কিন্তু তারপর কি ভেবে একবার দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে উঠলো পরিণীতার দিকে তাকিয়ে ,

————— ” ওহ , আমি তো আমার নামটাই বলিনি | আমি এম.এস.সি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট এর ,”

————— ” অনির্বান |”

শেষ কথাটা পরিণীতাই মুখ ফস্কে বলে ফেললো হঠাৎ | অনির্বান এতে একটু অবাক হয়েই দু সেকেন্ড থমকে জিজ্ঞেস করলো ,

————- ” তুমি আমার নাম জানো ! চেনো আমাকে ?”

কথাটায় পরিণীতা ঠিক আর কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না | তার মানে এই ছেলেটা আগের দুটো আলাপ দিব্যি ভুলে গেছে | করিডোরে ধাক্কা , ক্যান্টিনের পরোটা সবটাই এতটা তুচ্ছ যে মনে রাখা যায় না ! কথাটা ভাবতেই অর্না যেন কিরকম নিজের মনেই উত্তরটা দিয়ে দিলো ওকে বিড়বিড় করে ,

———— ” অনির্বান ! পুরো কলেজের ক্রাশ ! কে না চেনে এই নামটাকে !”

কথাটা শুনতেই অনির্বান যেন বিষুম খেলো একটু | পরিণীতাও কিরকম অস্বস্তিতে পরে গেলো হঠাৎ | খুব জোরে একটা চিমটি কেটে উঠলো অর্নার হাতে | এই মেয়েটার যদি কখনো একটু কান্ডজ্ঞান থাকে ! এইভাবে মুখের ওপর কেউ বলে দেয় কথাটা ! এইসব ভেবেই বেশ চোখটা বড়ো করেই ও তাকালো অর্নার দিকে | তবে অনির্বানও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে একটু ইতঃস্তত হয়ে বলে উঠলো , ————– ” ঠিক আছে , আমি আসি তাহলে | কাল দেখা হবে |”

তারপর বেশ তাড়াহুড়ো করেই স্টেজ থেকে নেমে বেরিয়ে গেলো বাইরে |

পরিণীতা এবার বেশ ক্ষেপে গিয়েই বললো , ———– ” কি রে তুই ? এইভাবে মুখের ওপর কেউ বলে ও না কি পুরো কলেজের ক্রাশ ! কি ভাবলো বল তো কথাটা শুনে !”
এর উত্তরে অর্না একটু নির্বিকার হয়েই বললো ,
———— ” কি আবার ভাববে , মনে মনে খুশিই হয়ে গেল শুনে । আর তুইই বা কি ! মুখ ফস্কে বলেই তো ফেললি নামটা । ইন্ট্রো দেয়ার সুযোগটাই দিলি না !”
এটার উত্তরে পরিণীতা এবার চুপই করে গেলো নিজের মনে । সত্যিই তো , কি দরকার ছিল নামটা বলার ! তখন অর্নাই আবার বলে উঠলো ,
————– ” যাইহোক , একটা ব্যাপারে নিশ্চন্ত বাবা ! তোর গানটা কাল গাওয়া হচ্ছে । অনির্বানদা যখন বলেছে , তার মানে তুই কাল কনফার্মড গাইছিস । দায়িত্ব নিয়ে নিলো একেবারে ।”
কথাটায় পরিণীতা এবার আলতো হেসে বেশ দৃঢ় গলায় বলে উঠলো ,
————— ” সেই ! আর কিছু ! ওইসব কথার কথা । আমরা হলাম ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে থাকা লোকজন । আলাদা করে আমাদের মনে রাখা যায় না , বুঝলি । কাল দেখলে তোর ওই কলেজের ক্রাশ হয়ত আর চিনতেও পারবে না আমাদের ! তাই বেশি আশা না করে বাড়ি চল । অনেক দেরী হলো ।”
কথাগুলো নিজের মনে বেশ বিশ্বাস নিয়েই বলে ফাঁকা কলেজকে আরো ফাঁকা করে বেরিয়ে এলো সেদিন পরিণীতা অর্নাকে সঙ্গে করে বাইরে । এখন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে এখানে । রাস্তাঘাট তাই ভিজে । কিরকম যেন জলছবির মতন লাগছে চারিদিকটা এখন । কথাটা ভাবতে ভাবতেই সেদিন হঠাৎ ওই ছেলেটার ছবি যেন আবছা ভাবে ভেসে উঠলো পরিণীতার চোখের সামনে । একটা স্কাই কলরের শার্ট পড়েছিল না আজ ! কথাটা মনে আসতেই মিলিয়ে গেল , উল্টোদিকের বাসটাকে আসতে দেখে । আজ সাড়ে ছটা থেকে টিউশন পড়াতে যাওয়া আছে । এই রিহার্সাল এর জন্য এত দেরি হয়ে গেল ! বাড়ি গিয়েই ছুটতে হবে আজ । কথাটা ভেবেই বাসে উঠে পরলো পরিণীতা । আর দেখতে পেল ধীরে ধীরে উল্টো দিকের রাস্তায় দাঁড় করানো কলেজটা কিরকম ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল হঠাৎ , চোখের পলকে ।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here