ভালোবাসার শহরে,পর্ব:৮

#ভালোবাসার_শহরে ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২৩>

ছোটু তার পরেরদিন নিজের কথা রেখেছিলো | ও দ্বায়িত্ব নিয়ে অনির্বাণকে টিউটোরিয়াল হোম এ নিয়ে এসেছিলো | একটা ছোট বারান্দা | আর সেটা পেরিয়ে ক্লাসরুম | অনির্বাণ আস্তে পায়ে এই দূরত্ব টুকু অতিক্রম করে হাজির হয়েছিল পরিণীতার সামনে | পরিণীতা সেই সময় বোর্ডে কিসব অঙ্ক করাচ্ছিল | উল্টোদিকে সব ক্লাস ফাইভ সিক্স এর বাচ্চারা বসে | তার মধ্যেই ছোটু হঠাৎ ওর কাছে এসে বলেছিলো ,

———— ” দিদি , এই দ্যাখো কাকে নিয়ে এসেছি ! ওই স্যারটা ! যাকে কাল খাবার পৌঁছে দিতে গেছিলাম |”

পরিণীতা কথাটা শুনে অংক ভুলে গিয়ে কিরকম যেন স্থির হয়ে গেছিলো হঠাৎ | তারপর দরজার দিকে তাকাতে দেখেছিলো অনির্বাণ ওর সামনে দাঁড়িয়ে ! সে ও স্থিরভাবে ওরই দিকে তাকিয়ে | কি বলবে ঠিক এই মুহূর্তে পরিণীতা বুঝতে পারছিলো না | কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজের এই এলোমেলোভাবটাকে সামলে নিয়েছিল ও | তারপর একটু দৃঢ় হয়ে বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলো পরিণীতা | আজ আর ও অনির্বাণকে এড়িয়ে যাবে না | কথাটা ভেবে ও সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিল , ———— ” কি দরকার এখানে ? কেন এসেছো ?”

অনির্বাণ এর উত্তরে একটু অবাক হয়ে বলেছিলো , ———— ” আমরা একই জায়গায় আছি | আর এটা জেনেও আমি যোগাযোগ করবো না ! ভাবলে কি করে ?”

পরিণীতা এটা শুনে কিছুটা স্থির গলায় বলেছিলো , ————- ” যোগাযোগ রাখার মতন সম্পর্কে তো আমরা নেই | অনেকদিন আগেই সেসব শেষ | ”

কথাটায় অনির্বাণ আর নিজেকে আটকাতে পারলো না | পরিণীতার কাছে কয়েক পা এগিয়ে এসে বললো , ————– ” এতো সহজে সব শেষ হয় না ! আমি কত খুঁজেছি তোমাকে এই পাঁচ বছরে ! আমি জানি মা তোমাকে খুব বাজেভাবে ইনসাল্ট করেছিল | তাই তুমি কলেজ ছেড়ে !”

না , অনির্বাণকে আর কথা বাড়াতে দিলো না পরিণীতা এই মুহূর্তে | মাঝখানে থামিয়েই বললো , ————- ” তোমার মার্ কথাগুলো আমার মনে আছে | খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে | তাই আলাদা করে আর বলার দরকার নেই | আর তুমি রিলেশন রাখতে চাওনি , সেটা নিজের মুখেই আমাকে বলতে পারতে ! তোমার মা কে পাঠানোর দরকার ছিল না | ”

অনির্বাণ এর উত্তরে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলো না | তাও পরিণীতাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলে উঠেছিল , ———— ” তুমি ভুল ভাবছো ! তুমি মিসআন্ডারস্ট্যান্ড করছো আমাকে | আমি কেন আমার মা কে পাঠাতে যাবো !”

পরিণীতা এই কথাটায় একটু অধৈর্য্য হয়েই বলেছিলো , ————- ” এই পাঁচ বছরে আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি | আর সত্যি তোমার সঙ্গে আমার অনেক পার্থক্য | তোমার মা ঠিকই বলেছিলো | আমাদের ক্লাস , স্ট্যাটাস , স্ট্যান্ডার্ড কিছু মেলে না | তাই আমি আর নতুন করে কিছু বুঝতে চাই না | আর এই পাঁচ বছরে আমরা দুজনেই তো দুজনের লাইফে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি | তাই পুরোনো কথা আলোচনা করে কোনো লাভ নেই | প্লিজ তুমি এসো | ”

কথাটা শেষ করে পরিণীতা সেদিন চলে যেতে যাচ্ছিলো | কিন্তু অনির্বাণ হঠাৎ ওর হাতটা ধরেছিলো খুব শক্তভাবে | তারপর কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো যেন ! কিন্তু কথাটা শুরুর আগেই ওই শূন্য বারান্দায় আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছিল | ‘পরিণীতা’ বলে ডেকে উঠতে অনির্বাণ খেয়াল করেছিল ছেলেটাকে | হালকা দাঁড়ি , চশমা চোখে , ছাই রঙা একটা পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা | পরিণীতা এই মুহূর্তে নিজের হাতটা অনির্বাণ এর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস্তে গলায় বলেছিলো , ——– ” প্লিজ , তুমি যাও | আমাদের আর কোনো কথা নেই | ”

কথাটা শেষ করেই ও এগিয়ে গিয়েছিলো সেই নাম না জানা ছেলেটার দিকে | তারপর হাসি মুখে ছেলেটার হাতটা হঠাৎ ধরে বলে উঠেছিল , ———- ” সৌম্য , তুমি এসে গেছো ! বাচ্চাদের বইগুলো এনেছো ?”

এর উত্তরে ওই সৌম্য নামের ছেলেটা হেসেই বলেছিলো , ———– ” তোমার আদেশ , আজ বই লাগবে | আমি না এনে পারি ! ভেতরে ক্লাসে চলো | বই দেব সবাইকে | বাই দ্যা ওয়ে , উনি কে ?”

শেষ কথাটা অনির্বাণের দিকে তাকিয়েই বলেছিলো ছেলেটা | পরিণীতা এর উত্তরে কঠিন গলায় বলেছিলো শুধু , ——— ” কাস্টমার | খাবার নেয় আমাদের কাছ থেকে | কিছু দরকার ছিল , তাই এসেছিলো | যাইহোক, আমাদের কথা শেষ | উনি চলে যাবেন এখনই | তুমি ভেতরে ক্লাসে এসো |”

কথাটা বলতে সৌম্য আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ক্লাসের ভেতরে চলে গিয়েছিলো | তবে পরিণীতা তখনও খেয়াল করেছিল অনির্বাণ কিরকম থমকে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে | এই মুহূর্তে ও জানে , ও যেটা অনির্বাণকে বোঝাতে চেয়েছে , ঠিক সেইভাবেই অনির্বাণ ভেবেছে সবটা | আসলে পরিণীতার মনে একটা অভিমান অনেকদিন ধরে জমে ছিল ! মাঝে মাঝে মনে হতো , যদি কোনোদিন ভুল করেও অনির্বাণের সাথে দেখা হয়ে যায় ওর , তাহলে ও কখনোই ভাঙবে না | বুঝতে দেবে না যে সেই পুরোনো ফিলিংসগুলোকে নিয়েই ও আজও বেঁচে আছে | যদি অনির্বাণ স্নেহাকে বিয়ে করার ডিসিশন নিতে পারে ওর মা বাবার কথা শুনে , তাহলে পরিণীতাও এই মিথ্যে গল্পটা সাজাতে পারে অনির্বাণের সামনে | ওকে দেখিয়ে দিতে পারে , আজ ওর জীবনে অনির্বাণ এর জায়গায় অন্য একজন আছে | সৌম্য ছোটবেলার বন্ধু হলেও অনির্বাণ তো সেটা জানে না | ও হয়তো ভাববে নতুন কোনো মানুষ পরিণীতার জীবনে | কথাগুলো ভেবেই পরিণীতা ওর সামনে এসে আস্তে গলায় বলেছিলো , ———— ” কিছুক্ষণ আগে যেই এগিয়ে যাওয়ার কথাটা বলছিলাম , আশা করি তুমি সেটা বুঝতে পেরেছো | পাঁচ বছর অনেকটা সময় ! তোমার জন্যেও , আমার জন্যেও | ভালো থেকো | আর প্লিজ কখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা কোরো না | ”

কথাটা শেষ করেই ও বারান্দাটাকে একেবারে খালি করে চলে গিয়েছিলো ভেতরে , ক্লাসরুমে | কিন্তু অনির্বাণ কিরকম স্তব্ধ হয়ে গেছিলো যেন | অনেক কষ্টে ও কয়েক পা এগিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো টিউটোরিয়াল হোম থেকে | মনে হচ্ছিলো এই পাঁচ বছরের দূরত্বটা তো কিছুই ছিল না ! আজ সামনাসামনি আসার পর বুঝলো , শেষ হওয়া কাকে বলে ! দূরত্ব আসলে কি !

আজ পরিণীতা খুব ভালো করে ওকে বুঝিয়ে দিলো যে আর কোনো গল্প নেই ওদের | আর কিছু ফেরত পাওয়ার নেই অনির্বাণের | এই পাঁচ বছর বাদে , আবার দেখা হয়েও অনির্বাণের হাতটা একদম খালি , একদম শূন্য ওর চারিদিকটা |
<২৪>

সেদিনের পর অনির্বাণের ভেতরে কিছু একটা যেন ভেঙে গেছিলো | কাউকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছেটা শেষ হয়ে গেছিলো | পরিণীতা অন্য একজনের সঙ্গে আছে | আজ আর ওর জীবনে অনির্বাণের কোনো আলাদা জায়গা নেই ! কথাটা যতবার মনে হচ্ছে , ততবার পরিণীতার অন্যের হাত ধরা , ফিরে না তাকানো , স্থির ভাবলেশহীন গলার আওয়াজটা কানে বাজছে | অনির্বাণ যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে ভেবে এসব | এতদিন যখন এই মেয়েটার সঙ্গে চোখে না দেখা দূরত্ব ছিল , তখন অনেক পুরোনো স্মৃতির ভিড় ছিল শুধু | কিন্তু এই দম চাপা কষ্টটা ছিল না ওর | কাউকে চোখের সামনে দেখেও তাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা ছিল না মনে | আর এর মধ্যে ও নিজে না চাইলেও অনেক সময় সোনাঝুরির রাস্তায় দেখা হয়েছে ওর পরিণীতার সঙ্গে | কখনো একা , কখনো ওই সৌম্যর সাথে দেখেছে পরিণীতাকে অনির্বাণ | হয়তো আনমনে ছেলেটার সঙ্গে হাসতে হাসতে দূরে হেঁটে গেছে ও ! অথবা ছেলেটার স্কুটিতে বসে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেছে পরিণীতা , অনির্বাণকে অদেখা করে | আবার কখনো সোনাঝুরি হাঁটে ঘুরতে ঘুরতে আনমনে চোখাচোখি হয়ে গেছে দুজনের | তবে প্রত্যেকবারই পরিণীতা অনির্বাণকে দেখে এক পা ও নিজে এগিয়ে আসেনি | কখনো কথা বলেনি নিজে থেকে | অচেনা হয়েই থেকেছে ওর সামনে | অনির্বাণের এই সময়গুলোতে কিরকম চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে এসেছে যেন | মনে হয়েছে , পাঁচ বছর সত্যি বড্ডো বেশি সময় হয়তো ! একজনের জীবন থেকে পুরোপুরি মুছে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ! শুধু অনির্বাণই যা পারলো না ! পুরোনো সময় , পুরোনো মানুষটাকে ভুলে এগিয়ে যেতে |

সেই শনিবার এইসব ভাবনার ভিড়েই অনির্বাণ কলেজ শেষ করে দাঁড়িয়ে ছিল কিছু দূরের বাস স্ট্যান্ডে | আজ বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে খুব | তবে অনির্বাণের ফাঁকা টিচার্স রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না ঠিক | কাল রবিবার , তাই অনেকেই ডে অফ নিয়ে বাড়ি গেছে | কথাটা ভেবে খারাপ লাগছিলো খুব ওর | মনে হচ্ছিলো এই এতো বড়ো পৃথিবীতে একটা বাড়ি হলো না ওর ! একজন কেউ নিজের হলো না ! মা বাবা , তারা নিজেদের অহংকারে এতোই মত্ত যে ওর দিকটা ভাবলোই না কোনোদিন ! নিজেদের অহংকারে ওর জীবনটা শেষ করে দিলো ! ও ভালোবাসতো পরিণীতাকে | ঠাম্মা মারা যাওয়ার পর প্রথম এমন একজনকে পেয়েছিলো , যার সাথে মন খুলে হাসতে পারতো ! নিজের ভালো খারাপ গুলোকে শেয়ার করতে পারতো ! মা জেনে বুঝে সেটাকে শেষ করে দিলো ! আর বাবা সব শুনে মা কে সাপোর্ট করলো ! আর পরিণীতা ! পরিণীতাও পাঁচ বছর পর অনির্বাণকে একটা সুযোগ দিলো না নিজের কথাটা বলার ! সব কিছু ঠিক করার ! ওকে কিরকম দূরে সরিয়ে রাখলো একজন অচেনা মানুষের মতন ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন বাস স্টপে এসে যখন পৌঁছেছিল তখন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল সোনাঝুরিতে | চারিদিকটা আবছা হয়ে গেছিলো ওর | কিন্তু কিছু সময় কোনো কিছু থেকেই আর নিজেকে বাঁচাতে ইচ্ছে করে না | এই বৃষ্টিতে মুছে যেতে ইচ্ছে হয় । এমনিও জীবনটা এখন অনির্বাণের বৃষ্টি ভেজা ঘষা কাঁচের মতনই লাগে ! যেখানে চারিদিকটা ভীষণ আবছা । নিজের লোকগুলো খুব অস্পষ্ট । তবে এই আবছা জলছবির মধ্যেই সেই শনিবার অনির্বাণের সাথে আবার দেখা হয়েছিল পরিণীতার । পরিণীতাও একটু দূরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল ছাতা হাতে । প্রথমে অনির্বাণ খেয়াল না করলেও একটু পরে চোখ চলে গেছিল ওর । দেখেছিল পরিণীতাও ওর দিকেই তাকিয়ে ! তবে চোখাচোখি হতেই চোখটা সরিয়ে নিল পরিণীতা সেই মুহূর্তে । কিন্তু অনির্বাণ ওর দিকেই কিরকম থমকে তাকিয়ে রইলো ! বৃষ্টির জল ততক্ষণে অনির্বাণকে পুরোই ভিজিয়ে দিয়েছে । পরিণীতা খেয়াল করেছিল সেটা দূরে দাঁড়িয়েও । কিন্তু সেই কলেজের দিনটার মতন আজ আর নিজের ছাতা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি ও ছেলেটার কাছে । বৃষ্টি থেকে অনির্বাণ কে আড়াল করার কোন চেষ্টা করেনি পরিণীতা । যদিও ও হাজার কঠিন হওয়ার চেষ্টা করলেও মাঝে মাঝে অনির্বাণের দিকে চোখ পরে যাচ্ছিল । দেখছিল অনির্বাণের থমকে থাকা দৃষ্টি ! কাকভেজা শরীরটাকে । কিন্তু এরপরও কিছুতেই এগোতে পারেনি আর ছেলেটার দিকে । মনে হয়েছে স্নেহা আছে । এই সোনাঝুরি তে না থাকলেও কলকাতায় তো আছে । অনির্বাণের কাছে যাওয়ার আর তাই কোন মানে নেই ওর । তবে শুধু একটা কথাই ওর মাথায় আসছে না ! যখন নিজের মা কে দিয়ে অপমান করিয়ে পরিণীতার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙলোই অনির্বাণ স্নেহার জন্য ! তাহলে কেন আবার পাঁচ বছর বাদে দেখা হওয়ার পর টিউটোরিয়াল হোম এ এলো ছেলেটা নিজে থেকে ! কথা বলার চেষ্টা করলো ওর সঙ্গে ! না কি এখানে ওর ফ্যামিলি মানে মা বাবা স্নেহা কেউ নেই বলেই এসব করলো ! আসলে কলেজের পুরনো প্রেম তো । তাই নস্টালজিক হয়ে গেছিল হয়ত দেখে ! অকারণে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছিল নিজেকে । আর ঠিকই তো ! অনির্বাণ তো ওর সঙ্গে প্রেমই করেছে । ভালোবাসেনি । ভালোবাসলে মা বাবার কথায় আজ স্নেহার সঙ্গে থাকতো না ! কথাগুলো নিজের মনকেই বলছিল পরিণীতা সেইদিন । বা হয়ত জোর করে এইসব ভেবে নিজের ভেতরে একটা রাগ তৈরি করার চেষ্টা করছিল পরিণীতা ! যাতে ও কোনোভাবেই অনির্বাণের কাছে এগিয়ে না যায় । ওকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেও পরিণীতা নরম না হয়ে যায় সব ভূলে ! আর এই ছেলেটার সঙ্গে যে সত্যি ওর কিছু মেলে না ! একবার এই অসম সম্পর্কটায় জরিয়ে যেই অপমানটা পেয়েছে , আবার সেই অপমানের কাছে ফেরৎ যেতে পারে না পরিণীতা । আর ঠিকই তো ! সেদিন অনির্বাণের মা ঠিক কথাই তো বলেছিল । অনির্বাণের মতন ছেলের জন্য স্নেহার মতন মেয়েই একেবারে পারফেক্ট । পরিণীতার যে কোনদিন কেউ দাম দেবে না ! এটাই স্বাভাবিক । কথাগুলো ভেবেই ও মুখ ঘুরিয়ে ওই ফাঁকা রাস্তাটায় দাঁড়িয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ । বৃষ্টির জন্য বাস অটো কিছুই আসছিল না প্রায় ! চোখের পলকে কেটে যাচ্ছিল সময় । দুজন প্রাক্তনের একটা বৃষ্টি ভেজা বিকেলে একটা কাঁচের দেয়ালের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ! তারপর প্রায় আধ ঘন্টা বাদে একটা অটো আসায় পরিণীতা আর কিছু না ভেবে উঠে পড়েছিল অটোটাতে । এই মুহূর্তে অনির্বাণের সামনে থেকে চলে যেতে পারলেই বোধ হয় শান্তি ।
কিন্তু অনির্বাণ এরপরেও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টির মধ্যে । বুঝতে পারছিল না পরিণীতা ওকে ঠিক কি অপরাধের শাস্তি দিচ্ছে এইভাবে ! ওর মায়ের অপমানটাই ওর কাছে বড় হলো ! আর অনির্বাণের এতদিনের ভালোবাসা ! এত অপেক্ষা ! সেগুলোর কোন মূল্য নেই ! কোন গুরুত্ব নেই পরিণীতার কাছে ! না কি ওই নতুন মানুষটা পরিণীতার মনে এতটাই জায়গা করে নিয়েছে এই পাঁচ বছরে যে অনির্বাণ ওর কাছে একটা আবছা স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই না ! যার সঙ্গে শুধু দূরত্ব টুকুই রাখা যায় ! কথাগুলো ভেবে সেদিন অনির্বাণের চারিদিকে কালো মেঘ জমে ছিল খুব । আকাশের থেকেও ঘন কালো মেঘ । মনে হচ্ছিল শরীরটাও আস্তে আস্তে কেমন হালকা হয়ে আসছে । প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগছে ওর । মাথাটাও যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে । কিন্তু তা ও এক পা এগোনোর মতন জোর পাচ্ছে না ।
মনের সঙ্গে শরীরও যেন ভেঙে পড়ছে আজ । আসলে এই একা জীবনটার ধকল আর নিতে পারছে না অনির্বাণ । আর পারছে না পরিণীতার সামনে অচেনা হয়ে বাঁচতে !
<২৫>
তবে সেদিন রাতে একটা ঘটনা ঘটেছিল , যেটা পরিণীতা কে নিজের আড়াল ভাঙতে বাধ্য করেছিল যেন । আসলে সেই রাতে ছোটু অনির্বাণের বাড়িতে খাবার ডেলিভারি দিয়ে আসার পর আনমনে পরিণীতাকে বলে উঠেছিল ,
————— ” ওই যে সেদিন টিউটোরিয়াল হোম এ যেই দাদাটাকে নিয়ে এসেছিলাম ! ওর শরীর খুব খারাপ জানো দিদি । ভীষণ জ্বর । খাবার দিতে গিয়ে দেখলাম , ঠিক মতন দাঁড়াতে অব্দি পারছে না ! বললাম বাড়ির লোকের যদি কোন নাম্বার থাকে তাহলে দিতে ! ফোন করে জানাবো । কিন্তু কি বললো জানো ! বললো ওর নিজের কোন লোক নেই ! কাউকে জানানোর মতন নেই না কি ! দাদাটা অনেক বছর ধরে একাই থাকে ! বুঝতে পারলাম না কিছু ! দেখে তো ভালো বাড়ির ছেলে বলেই মনে হয় । কি হয়েছে কে জানে ! ”
কথাগুলো শুনে পরিণীতার যেন কেমন ধাক্কা লাগলো হঠাৎ ! নিজের কেউ নেই মানে ! মা বাবা স্নেহা সবাই তো আছে অনির্বাণের ! তাহলে এরকম কেন বললো ! না কি পরিণীতার হিসেব এ কিছু ভুল হচ্ছে বুঝতে ! এই পাঁচ বছরে অনির্বাণের জীবনে কিছু কি বদলে গেছে ! যেটা পরিণীতা জানে না । কথাগুলো ভাবতেই খেয়াল হলো অনির্বাণের খুব জ্বর বললো না ছোটু ! কিন্তু আজ বিকেলে তো দেখা হয়েছিল । কলেজ মোড়ে । তখন তো খুব বৃষ্টি পড়ছিল ! তাহলে কি বৃষ্টিতে ভিজেই জ্বর এলো ছেলেটার ! কথাটা ভাবতেই মনে পরে গেল সেই পুরনো দিনের একটা ঘটনা । কলেজ থেকে ফেরার সময় সেদিনও তো খুব বৃষ্টি নেমেছিল । পরিণীতা দূর থেকে দেখেছিল অনির্বাণকে । ছেলেটা হাত দিয়ে নিজের মাথাটাকে বৃষ্টির জল থেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল বাস স্টপের দিকে । পরিণীতা তখনই জোরে পা চালিয়ে ওর কাছে গিয়ে ছাতাটা ধরেছিল অনির্বাণের মাথায় । সেদিনও বাসে উঠে অনির্বাণ কাশতে শুরু করেছিল না ! ওইটুকু বৃষ্টির জল লেগেই ছেলেটার সর্দি কাশি হয়ে গিয়েছিল ! পরিণীতা তো তাই বাস থেকে নেমে ছাতাটা ও দিয়ে দিয়েছিল নিজের । তাহলে কি আজও সেরকম কিছু হলো ! কিন্তু আজ তো অনির্বাণ অনেক বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়েছিল বৃষ্টির মধ্যে । পুরো ভিজে গেছিল ও । পরিণীতা তো দূর থেকে দাঁড়িয়ে খেয়াল করেছিল , অনির্বাণ কাঁপছে ঠান্ডায় । কিন্তু সেই কলেজের দিনটার মতন আজ এগিয়ে যেতে পারেনি শুধু । আসলে একটা না দেখা কাঁচের দেয়াল আছে ওদের মাঝে । সেটা পার করতে পারেনি পরিণীতা । সেই জন্যই কি এতটা জ্বর এলো অনির্বাণের ! কথাগুলো ভেবে ও আর স্থির থাকতে পারলো না যেন ! কিছুতেই ছেলেটার কাছে না গিয়ে থাকতে পারলো না নিজে ! এতটা শরীর খারাপের মধ্যে একা আছে অনির্বাণ । ছোটু বাইরের লোক বলে হয়ত বাড়ির কারোর নাম্বার দেয়নি । পরিণীতা গিয়ে জোর করলে অনির্বাণ বাড়িতে খবর দেবেই নিজের । কথাটা ভাবতে ভাবতেই পরিণীতা প্রায় রাত ৯ টার সময় এসে হাজির হলো অনির্বাণের বাড়িতে । তারপর মনের সব দ্বিধা গুলোকে দূরে সরিয়ে এত বছরের তৈরি কাঁচের শক্ত দেয়ালটাকে ভেঙে কলিং বেল বাজালো পরিণীতা , অনির্বাণের দরজার ।
সেদিন তিন চারবার কলিং বেল বাজানোর পর অনির্বাণ ধীরে ধীরে এসে দরজা খুলেছিল ওকে । বুঝতে পারছিল না কে এলো এখন ! এই সময় তো কারোর আসার কথা নয় ! এসব ভাবনার ভিড়েই গায়ে চাদরটাকে ভালোভাবে জড়িয়ে আলতো পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলো | কিন্তু দরজা খুলতেই ও স্তব্ধ হয়ে গেলো কিরকম | পরিণীতা ওর সামনে দাঁড়িয়ে | এতো রাতে ! পরিণীতাও অনির্বাণকে দেখে স্থির হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড | অনির্বাণের মুখটা ভীষণ ফ্যাকাসে লাগছে এখন | পরিণীতা এটা দেখে চুপ থাকতে পারলো না আর ! ও নিজে থেকেই বলে উঠলো ,

———– ” তুমি ঠিক আছো ? তোমার খুব জ্বর হয়েছে শুনলাম !”

কথাটায় অনির্বাণ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো একটু নিস্তেজ গলায় , ———– ” ঠিক আছি আমি | কিছু হয়নি |”

কিন্তু কথাটা বলেই ওর মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেলো কেমন | অনির্বাণ ঠিক টাল রাখতে পারলো না নিজের | পরিণীতা ব্যাপারটা খেয়াল করেই ওর হাতটা ধরে নিলো এই মুহূর্তে শক্ত করে , আর অনুভব করলো অনির্বাণের শরীরের উত্তাপটা | পরিণীতা এবার বেশ জোরেই বলে উঠলো , ———– ” তোমার তো সত্যি খুব জ্বর ! ঠিক আছো মানে ! ভেতরে চলো |”

কথাটা বলে অনির্বাণকে ভেতরের ঘরে নিয়ে এলো ও একটু জোর খাটিয়েই | অনির্বাণ যদিও সেই সময়ে পরিণীতাকে বার বার বলছিলো চলে যেতে | আসলে এতদিন যখন সোনাঝুরি তে আসার পরেও পরিণীতা ওকে চিনেও চেনেনি , একবারও নিজে থেকে ওর সঙ্গে কথা অব্দি বলেনি ! তখন আজ ওর জ্বরের সময় পরিণীতার কনসার্ন কেয়ার অনির্বাণ আর চায় না | কথাটা ভেবেই ওকে সেদিন চলে যেতে বলেছিলো ছেলেটা | কিন্তু পরিণীতা সেই সবে কান না দিয়েই অনির্বাণকে ধরে সাপোর্ট দিয়ে ঘর অব্দি নিয়ে এসেছিল । তারপর ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে উঠেছিল ,

———- ” তোমার বাড়ির নাম্বার দাও | তোমার মা কে ফোন করে জানাই | এতো জ্বরের মধ্যে এখানে পরে আছো একা একা ! এটা ঠিক না |”

কথাটা বলে পরিণীতা খেয়াল করেছিল অনির্বাণ যেন কিরকম নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে | কথাগুলো জড়িয়ে আসছে ওর | চোখ দুটো বুঁজে আসছে জ্বরের ঘোরে | তার মধ্যেই অনির্বাণ আস্তে গলায় বলে উঠলো , ————— ” কেউ নেই জানানোর মতন ! আমি পাঁচ বছর ধরে একা থাকি | মা বাবাকে আমার কোনো ব্যাপারে জড়ানোর দরকার নেই | ওরা ওদের মতন ভালোই আছে | ”

কথাটা শুনতেই পরিণীতার কিরকম ধাক্কা লাগলো যেন | কি বলছে এইসব অনির্বাণ ! একা থাকে মানে ! তবে ও এবার একটু ভেবে বলে উঠলো ,

————— ” তাহলে স্নেহার নম্বর দাও | ও আজ জানলে কাল ঠিক চলে আসবে তোমার কাছে ! ”

এই কথাটায় অনির্বাণ জ্বরের ঘোরের মধ্যেও শক পেলো একটা | ও অবাক হয়েই বললো , ———– ” স্নেহা ! স্নেহা কেন আসবে আমার কাছে ! কে ও ! আর আমার জ্বর তো ওর কি ?”

পরিণীতা কথাটায় কিরকম আকাশ থেকে পড়লো ! ও নিজেও অবাক হয়ে বললো , ————- ” তোমার বিয়ে হয়নি স্নেহার সঙ্গে ? তোমার মা যে বলেছিলো তুমি নিউইয়র্ক থেকে ফিরলেই তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেবে ! ”

কথাটায় অনির্বাণ এবার কিরকম ক্লান্ত স্বরে বললো , ————- ” মা বললো ! আর তুমিও বিশ্বাস করলে ? আমাকে একবারও জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না কিছু ! ”

তবে না | কথাটা শেষ করে অনির্বাণ আর কিছু এক্সপ্লেন করতে পারলো না পরিণীতাকে | ওর শরীরের সব শক্তি যেন শেষ বলে মনে হচ্ছে ! অনির্বাণ এর এতো ক্লান্ত লাগছে যে চারিদিকটা ঝাপসা হয়ে এলো ওর | কালো অন্ধকার জমে উঠলো চোখের সামনে হঠাৎ | পরিণীতা এবার খেয়াল করলো অনির্বাণের আর কোনো সেন্স নেই | তবে পরিণীতারও ঠিক মাথা কাজ করছে না এখন ! অনির্বাণ যা বললো সেটা কি ঠিক ! তাহলে কি ওর বিয়ে হয়নি স্নেহার সঙ্গে ! পরিণীতা অনির্বাণকে ভুল বুঝেছে এতদিন ধরে ! আর মা বাবার ব্যাপারে কি বললো ! যোগাযোগ নেই কোনো পাঁচ বছর ধরে ! কথাগুলো জানার পর পরিণীতা কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারলো না | নিজের ওপরই ভীষণ রাগ হলো হঠাৎ | এতদিন হলো ছেলেটা সোনাঝুরিতে আছে , কিন্তু পরিণীতা একবারও ভালো করে কথা অব্দি বললো না ! এমন কি আজ এই বৃষ্টির দিনে যখন দেখলো যে অনির্বাণ ঐভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে , তখনও এগিয়ে গেলো না ! অনির্বাণ তো কিরকম থমকেই তাকিয়ে ছিল ওর দিকে | কিন্তু পরিণীতা সেই দৃষ্টিটা দেখেও অদেখা করে দিলো ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই ওর অনির্বাণের নিস্তেজ শরীরটার দিকে চোখ চলে গেলো | ছেলেটার ফ্যাকাসে মুখ পরিণীতাকে আরোও থমকে দিলো কেমন ! ও এবার অনির্বাণের হাতটা ধরেই ডাক্তারকে কল করলো | তারপর সেই সারা রাতটাই রইলো অনির্বাণের বাড়িতে | ওষুধ কিনে আনার ব্যবস্থা করা থেকে ওর মাথায় জল পট্টি দিয়ে জ্বর কমানোর চেষ্টা , সবই করলো পরিণীতা রাত জেগে | ছোটুকে এর মধ্যে ডেকে নিয়েছিল যদিও | রাতে যদি কোনো দরকার লাগে ! কিন্তু ছোটু অনির্বাণের কাছে থাকবে , এটা বলার পরও পরিণীতা ওর পাশ ছেড়ে ওঠেনি | সব সময় অনির্বাণের হাত ধরে বসেই ছিল কেমন | আসলে কিরকম কষ্ট হচ্ছিলো পরিণীতার আজ ছেলেটার জন্য | বার বার মনে পরে যাচ্ছিলো ওর অসহায় দৃষ্টিটা ! যেন কত কি বলার ছিল পরিণীতাকে অনির্বাণের ! কিন্তু পরিণীতা ওকে কোনো সুযোগই দিল না | একবারও অনির্বাণের দিকটা শোনার চেষ্টা করলো না কখনো | আজ অনির্বাণকে এরকম নিস্তেজ অবস্থায় পরে থাকতে দেখে ওর খুব মনে হচ্ছে , একবার যদি ছেলেটা ওর সঙ্গে কথা বলে ! একবার যদি ওর দিকে তাকায় ! ওর কাছে আসে ! তাহলে পরিণীতা আর কখনো হয়তো যেতে দেবে না অনির্বাণকে | কখনো ওকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে না | সেই রাতে সারাক্ষণ পরিণীতা এইসবই ভেবে গেছিলো এক মনে | তারপর ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটেছিলো সোনাঝুরিতে | অনির্বাণের জ্বরটাও নেমে এসেছিলো অবশেষে | তবে সেদিন চোখ খুলে পরিণীতাকে দেখে অনির্বাণ সত্যি চমকে গেছিলো | কিন্তু ও পরিণীতাকে কিছু বলার আগেই পরিণীতা বলে উঠেছিল , ———- ” শরীর কেমন লাগছে ? জ্বর নেই তো ?”

কথাটা বলেই ওর মাথায় হাত দিয়েছিলো নিজে থেকে | তখন অনির্বাণ ওর হাতটা সরিয়ে বলেছিলো একটু কঠিন গলায় ,

———— ” তুমি কি পাগল হয়ে গেছো ? সারা রাত আমার বাড়িতে এসে থাকলে ? ওই ছেলেটা জানলে কি হবে ! তোমাদের তো মনে হয় বিয়েরও ঠিক | আমার মতন একটা ভ্যালুলেস মানুষের জন্য কেউ এইসব করে না কি !”

শেষ কথাগুলো যে অনির্বাণ একটা চাপা রাগ থেকে বলছে , এটা পরিণীতা বুঝেছিলো | কিন্তু ও আর চুপ না থেকে আস্তে গলায় বলেছিলো ,

———— ” সৌম্য আমার শুধু ভালো বন্ধু হয় | আমাদের মধ্যে কিছু নেই | সেদিন আমি যা বলেছিলাম বানিয়ে বলেছিলাম | আসলে আমি ভেবেছিলাম তোমার আর স্নেহার রিলেশন আছে ! তোমার মা আমাকে এটাই বলেছিলো যে তোমাদের না কি বিয়ের ঠিক | তোমার নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার পরই বিয়েটা হয়ে যাবে | তাই আমিও বানিয়ে ঐসব !”

ওর কথাটা এবার মাঝ পথেই থামিয়ে দিলো অনির্বাণ | ও একটু উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে বললো ,

————– ” মা তোমাকে এইসব বলেছিলো ! আর তুমি কি সেই জন্য আমার সঙ্গে আর কোনো কন্ট্যাক্ট করোনি ! সেই জন্য সোনাঝুরিতে দেখা হওয়ার পরেও কথা বলোনি একবারও ?”

কথাগুলো বলতে বলতে অনির্বাণ কিরকম নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো কিছুক্ষণ | আসলে ও আজ বুঝলো এই পাঁচ বছরের নিঃস্তব্ধতার কারণটা ! পরিণীতার ফিরে না তাকানোর কারণটা | পরিণীতা তখন আস্তে গলায় বলে উঠলো , ———— ” সেদিন তোমার মা এমন কিছু কথা বলেছিলো আমাকে যে আমি তারপর আর কোনো কিছু যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারিনি | নিজের গাড়িতে বসিয়ে আমাকে এই কথাটাও বলেছিলো যে আমি আর আমার মা না কি ছেলেদের ফাঁসিয়ে টাকা রোজগার করি ! সেদিনের সেই অপমানটার পর আমার আর কিছু ভাবার অবস্থা ছিল না ! আর বাড়ি ফিরে দেখেছিলাম মামাও মার্ গায়ে হাত তুলেছে | রক্ত পড়ছিলো কপালটা কেটে গিয়ে | সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল কলকাতা আমাদের জায়গা নয় | ওই শহরে কেউ নেই যে নিজের | তাই আমি আর মা সোনাঝুরি ফিরে এসেছিলাম | তবে আজ , এই পাঁচ বছর বাদে মনে হচ্ছে , একবার তোমার সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল ! একবার তোমাকে সত্যিটা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল আমার !”

কথাগুলো কেটে কেটে বলেছিলো পরিণীতা | তখন থমকে থাকা গলায় ভীষণ ক্লান্ত ভাবে উত্তর দিয়েছিলো অনির্বাণ | একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বলেছিলো ,

————- ” তোমাকে ফোন এ না পেয়ে , মেল্ করে যোগাযোগ করতে না পেরে আমি দু মাস বাদেই নিউইয়র্ক থেকে কলকাতা ফিরে এসেছিলাম | কিন্তু ততদিনে তুমি কলকাতা ছেড়ে দিয়েছিলে ! আমি কলেজে গিয়ে অর্নার কাছে শুনেছিলাম সব | আমি সত্যি জানতাম না মা তোমাকে ঠিক কি কি বলেছে | তবে মায়ের সাথে কথা বলে বুঝেছিলাম যে মা কতটা খারাপ কথা বলতে পারে একজনকে , শুধুমাত্র তার ক্লাস , তার স্ট্যাটাস আলাদা বলে ! আমি সেইদিনই ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম | মা বাবা তারপর অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে আমার সঙ্গে ! কিন্তু আমি কখনো ফিরে যাইনি | ”

কথাটা বলে অনির্বাণ থেমেছিল একটু । পরিণীতার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কোন অর্ধেক পড়া বই এর গল্প শুনছে যেন। যেই বই এর একটা দিকই শুধুমাত্র পড়েছে পরিণীতা । বিপরীত দিকটা তো অজানাই । কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও অনির্বাণ কে জিজ্ঞেস করে উঠলো ,

————– ” আর নিউইয়র্ক ? ওখানে যাওনি আর ! আর তোমার পড়াশোনা , পিএইচডি ?”

কথাটার উত্তরে অনির্বাণ আস্তে গলায় বলে উঠলো, ————” যাদবপুর থেকে পি.এইচ.ডি কমপ্লিট করেছি | নিউইয়র্ক আর ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারিনি । কলকাতা আসলে তাও একটা স্মৃতির শহর ।আর স্টাইফেন এর টাকায় চলে যেত আমার ঠিকভাবেই ! কিন্তু এর মধ্যে আমি অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছি তোমাকে | তোমার মামার বাড়িতে গেছিলাম প্রথমে | কিন্তু ওখানে কাউকে পাইনি | ওরা বাড়ি চেঞ্জ করে চলে গেছিলো ততদিনে অন্য জায়গায় | এরপর দু একবার তো সোনাঝুরিতে এসেও এদিক ওদিক ঘুরেছি | যদি কখনো দেখা হয়ে যায় এই ভেবে ! কিন্তু সেই সময় এটা ভাবিনি যে দেখা হলে তুমি আর চিনতে পারবে না আমায় ! কথা বলতে চাইবে না একটুও !”

কথাগুলো বলে আবার থামলো কিছুক্ষণ অনির্বাণ | তারপর নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে বললো ,

———– ” মা তোমাকে আমার আর স্নেহার ব্যাপারে যা বলেছে , সেটা অর্ধেক সত্যি | আসল কথা হলো স্নেহার বাবা মা এসেছিলো আমার নিউইয়র্ক যাওয়ার আগের দিন , সম্বন্ধ নিয়ে | আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে | কিন্তু আমি শুনেই না বলে দিয়েছিলাম | বিয়ের কোনো কথা এগোতেই দিইনি কখনো ! ”

কথাটা শুনে পরিণীতা ঠিক কি বলবে এরপর বুঝতে পারছিলো না | এতো ভুল বুঝেছে ছেলেটাকে ! দিনের পর দিন ওকে নিজের কাছে আসতে দেয়নি ! কোনো যোগাযোগ রাখেনি | আর অনির্বাণ ! অনির্বাণ এরপরেও এই পাঁচ বছরে ওকে এতো খুঁজেছে ! দেখা হওয়ার পর কথা বলার চেষ্টা করেছে | পরিণীতার জন্য এমন কি নিজের মা বাবার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখেনি ছেলেটা ! শুধুমাত্র ওকে ভালোবাসে বলে | কথাগুলো ভেবে হঠাৎ চোখে জল জমলো ওর | বুঝতে পারছিলো না এতো ভুল বোঝার পর কিভাবে ফিরে যাওয়া যায় ! কিভাবে বলা যায় , ‘ভালোবাসি’ |

কিন্তু সেই মুহূর্তে অনির্বাণই বলে উঠেছিল , ———- ” আই এম সরি .. আমার মা যা যা বলেছে , সেই সবের জন্য | আর ভুল কিছুটা আমারও ছিল | আমার নিউইয়র্ক যাওয়ার আগেই আমাদের রিলেশনের ব্যাপারে বলে দেয়া উচিত ছিল | তাহলে যা রিয়্যাক্ট করার , আমার ওপর করতো | তোমাকে এইভাবে একা ডেকে এতো বাজে কথা বলতো না ! ভেবেছিলো আসলে আমি বাইরে আছি | এই সুযোগে তোমাকে ইনসাল্ট করে সম্পর্কটা ভেঙে দেবে আমাদের | আর সেটাই হলো | পাঁচ বছর কিভাবে শেষ হয়ে গেলো আমাদের ! ”

কথাটার উত্তরে পরিণীতা এরপর আর চুপ থাকতে পারলো না | অনির্বাণের হাতটাকে নিজের কাছে শক্ত করে ধরে বললো ,

————- ” আমারও ভুল | আমি সব বিশ্বাস করেছি | কখনো তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি | আমি যদি একবার কথা বলতাম নিজে , তাহলে হয়তো এইভাবে পাঁচ বছর শেষ হতো না আমাদের | ”

কথাটা বলে পরিণীতা কেঁদে ফেললো এবার নিজের মনে | আর পারছে না এই ভেতরের কষ্টটাকে আটকাতে | এতো বছরের জমা দম চাপা যন্ত্রণাটা বেরিয়ে আসছে এবার , চোখ ঝাপসা করে | কিন্তু অনির্বাণ আর ওকে এইভাবে অন্ধকারের মধ্যে থাকতে দিলো না | হঠাৎ আঁকড়ে ধরলো পরিণীতাকে নিজের সমস্তটা দিয়ে | তারপর আস্তে গলায় বললো ,

————– ” পাঁচ বছর শেষ | কিন্তু জীবনটা , এখনো আছে | তাই সময়ও হয়তো আছে | আরেকবার নতুন করে শুরু করার | সোনাঝুরিতে | ”

কথাটায় পরিণীতা আর কিছু বলতে পারলো না এই মুহূর্তে | শুধু নিঃশব্দে ভেজা চোখে জরিয়ে থাকলো অনির্বাণকে | আসলে অনেকদিন বাদে এই স্পর্শটা পেলো ও ! সেই কলেজের ক্রাশ , পুরোনো ক্লাসরুম , বৃষ্টি ভেজা বাস স্টপ পেরিয়ে , অবশেষে সত্যি এই ছেলেটা এলো ওর জীবনে | একটা না হওয়া গল্পকে পূরণ করতে |
——–< সমাপ্ত >———

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here