ভালোবাসার শহরে,পর্ব:৬

#ভালোবাসার_শহরে ( ষষ্ঠ পর্ব )
ঈপ্সিতা মিত্র
<১৭>
ভালোবাসায় হিসেবে মেলানো খুব সহজ কাজ নয় | যেভাবে মন ভাবে , যেভাবে সে গল্প লেখে , সেটা অনেক সময়ই এলোমেলো হয়ে যায় | খুব সুন্দর সাজানো একটা ছবিও ভেঙে যায় আচমকা | অনির্বাণ পরিণীতার সাথেও ঠিক তাই হয়েছিল | অনির্বাণের নিউ ইয়র্ক চলে যাওয়ার পরেই সবটা অগোছালো হয়ে গেছিলো ওদের | আসলে কিছু ঘটনা , কিছু মানুষ থাকে জীবনে , যে দুজনের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারে | আলাদা করে দিতে পারে দুটো কাছের মানুষকে | আর অনির্বাণ আর পরিণীতার জীবনে সেই তৃতীয় মানুষটা ছিল স্নেহা |

অনির্বাণ এর যাওয়ার আগেরদিন মেয়েটা এসেছিলো ওর কাছে | তবে সেইদিন ও একা ছিল না | সঙ্গে বাবা মা ও ছিল স্নেহার | ওরা স্নেহার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলো অনির্বানদের বাড়িতে | ড্রইং রুমে বসে বেশ হাসি মুখেই কথাটা বলেছিলো স্নেহার বাবা অনির্বাণের বাবাকে |

———- ” ছেলে মেয়ে দুটো তো ছোট থেকেই দুজনে দুজনকে চেনে | আর অনির্বাণ আর কদিন বাদেই সেটেলড হয়ে যাবে | তাই কথাটা বলতে আর দেরি করলাম না | আমার মনে হয় স্নেহার জন্য অনির্বাণের থেকে বেশি ভালো ছেলে আর আমরা কোথাও ঠিক খুঁজলে পাবো না | এছাড়া বিজনেস রিলেশন এর জন্য তোমাদের ফ্যামিলিটাকেও আমরা এতদিন ধরে চিনি | তাই এই কথাগুলো বলতেই তোমাদের বাড়িতে আসা | রাজি তো তোমরা ?”

শেষ কথাটা অনির্বাণের বাবা মা দুজনের দিকে তাকিয়েই বলেছিলো স্নেহার বাবা | অনির্বাণের বাবা তো খুশি তে হ্যাঁ বলতেই যাবে তৎক্ষণাৎ , কিন্তু পারলো না ! নিজের ছেলেই বেঁকে বসলো সবার মাঝে | অনির্বাণ তো হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে কিরকম আকাশ থেকেই পড়েছিল যেন ! তাই আর দেরি না করেই বলে উঠেছিল খুব দৃঢ় গলায় ,

———– ” সরি আঙ্কেল , কিন্তু আমি স্নেহার সাথে বিয়ে করতে পারবো না | আমি ওকে কখনো ঐভাবে দেখিনি | ইনফ্যাক্ট আমরা ভালো বন্ধুও নোই | জাস্ট চিনি একে অপরকে অনেকদিন ধরে , ঐটুকুই | কথাটা মুখের ওপর বললাম বলে মাইন্ড করবেন না | কিন্তু এটা সম্ভব নয় |”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে অনির্বাণ বলে ড্রইং রুমটা খালি করে দিয়ে চলে গেছিলো সেদিন | স্নেহা তো সেই মুহূর্তে পাথরের মতন স্থির হয়ে গেছিলো যেন | ভেবেছিলো বাবা এসে কথা বললে অনির্বাণ একসেপ্ট করবে সব কিছু | কিন্তু ও যে এইভাবে ‘না’ বলে চলে যাবে , ভাবেনি | আর একজনও অবশ্য অনির্বাণের এই ব্যবহারে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলো | সে হলো অনির্বাণের মা , মিসেস অন্তরা সেনগুপ্ত | স্নেহা যখন ছোট ছিল , তখন থেকেই ওনার স্নেহাকে নিজের ছেলের জন্য ভীষণ পছন্দ ছিল | আর সব থেকে ভালো লাগতো স্নেহার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড | ওদের মতন আপার ক্লাস ফ্যামিলি , তার ওপরে বিজনেস পার্টনারও | বিয়ের মতন পার্সোনাল কনেকশন তৈরী হলে ব্যবসায় ওদের শেয়ার বাড়ারও তো স্কোপ ছিল একটা | কিন্তু অনির্বাণ মাঝখান থেকে সব কিছুতেই কিরকম জল ঢেলে দিয়ে চলে গেলো ! ভেবেই ভীষণ রাগ হচ্ছিলো হঠাৎ , অনির্বাণের ঠাকুমার ওপর | আসলে ওই মহিলার কাছে থেকে বড়ো হয়েই ছেলেটা এরকম তৈরী হয়েছে | ইমোশনাল ফুল যাকে বলে! জীবনের সূক্ষ হিসেবগুলো করতেই শিখলো না !

তবে এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি যার মন ভেঙেছিল , সে ছিল স্নেহা | ও তবে বেশিক্ষণ ড্রইং রুমে বসেনি | সোজা এসে হাজির হয়েছিল অনির্বাণের ঘরে | অনির্বাণ তখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল , তাই দরজার দিকে খেয়াল করেনি | তবে স্নেহা আর অনির্বাণের খেয়ালের অপেক্ষা না করেই ওর কাছে এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল | ভীষণভাবে ওকে আঁকড়ে ধরে হিংস্র গলায় বলে উঠেছিল ,

———— ” কার জন্য আমার মতন মেয়েকে রিফিউজ করলে তুমি ? ওই ছোটোলোক ক্লাসলেস পরিণীতার জন্য ? বাড়িতে বলতে পারবে ওর নাম কখনো ? নিজের সোসাইটিতে ওকে নিয়ে চলতে পারবে ? ওর তো নয় জ্যাকপট লেগে যাবে , তোমার মতন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে ! কিন্তু তোমার ? তোমার তো পুরো লাইফটা শেষ হয়ে যাবে ওরকম একটা লো স্ট্যান্ডার্ড মেয়ের সঙ্গে থাকলে ! ”

কথাগুলো কিরকম ঘোরের মধ্যে বলে গেছিলো স্নেহা | তবে অনির্বাণ এইসব শুনে আর নিজের ধৈর্যটাকে ঠিক ধরে রাখতে পারেনি নিজের মধ্যে | ও এক ধাক্কায় স্নেহাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে ভীষণ রেগেই বলে উঠেছিল , ————– ” তোমার সাহস কি করে হলো পরিণীতার ব্যাপারে এইসব বলার ? তাও আমার কাছে ! আমি ওকে ভালোবাসি | আমাদের মধ্যে একটা স্টেবল রিলেশনশিপ আছে , আর থাকবে | তুমি কে সেটা নিয়ে কমেন্ট করার ! পরিণীতা নিজে টিউশন পড়িয়ে টাকা রোজগার করে এই বয়সে নিজের পড়াশোনার খরচ চালায় | তোমার মতন না ! যে নিজের বাবার টাকা উড়িয়ে ফেক ক্লাস দেখায় লোকজনকে | আর পরিণীতার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হয় , আমি ভীষণ প্রাউডলি সবার কাছে ওর পরিচয় দিতে পারবো | ওর মতন মেয়েকে নিজের জীবনে পেলে আমার থেকে লাকি আর কেউ হবে না | বুঝেছো ? নাও গেট আউট … এই ঘরটা আমার | এখানে এরপর আসলে দরজায় নক করে আমার পারমিশন নিয়ে আসবে | কথাটা মাথায় রেখো |”

রাগে মুখটা লাল করে কথাগুলো বলে গেলো অনির্বাণ | কিন্তু স্নেহা যেন অপমানে পাথরের মতন দাঁড়িয়ে রইলো ওর সামনে | ওর চোখে এই মুহূর্তে শুধু পরিণীতার মুখটা ভাসছে | ওই মেয়েটার জন্য আজ অনির্বাণ ওকে রিফিউজ করলো ! এটা ভেবে যেন সারা শরীরে আগুন জ্বলে যাচ্ছে ওর | তবে অনির্বাণ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না | ও স্নেহার হাতটা ধরেই এবার ওকে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো | তারপর ওর মুখের ওপর বেশ আওয়াজ করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো নিজের | স্নেহার যেন ভেতরটা শেষ হয়ে এলো এবার | তবে ওই আগুনের জ্বালাটা এখন দ্বিগুন হয়ে গেলো ওর ভেতরে | স্নেহা বুঝতে পারলো , যতক্ষণ না ও অনির্বাণের সঙ্গে পরিণীতার সম্পর্কটা শেষ করবে, ততক্ষণ ও জ্বলবে নিজের মধ্যে এইভাবেই | তাই সেইদিনের পর সাতদিন কাটিয়ে স্নেহা ফিরে এসেছিলো আবার অনির্বাণদের বাড়িতে | আসলে ও অপেক্ষায় ছিল , অনির্বাণের চলে যাওয়ার | যাতে ওর মিসেস সেনগুপ্তকে নিজের কথাগুলো বোঝাতে কোনো অসুবিধা না হয় | সেদিন তাই সবটা আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিলো স্নেহা | সেই মতন অনির্বাণের মা কে পেয়ে সবটা উগরে দিয়েছিলো এক নিঃশ্বাসে | এতদিনের ওর জ্বালা যন্ত্রণা , অনির্বাণের দিনের পর দিন ওকে ইগনোর করা , দেখেও না দেখা , সবটার রিভেঞ্জ নিয়ে নিয়েছিল যেন একদিনে | বেশ করুণ গলায়ই বলেছিলো স্নেহা ,

————- ” আন্টি , আমাদের বিয়েতে অনির্বাণ এর না বলার কারণ ওই পরিণীতা | আমাদের কলেজের জুনিয়র | ও ই ব্রেন ওয়াশ করেছে ছেলেটার | আসলে পরিণীতাদের অবস্থা ভীষণ খারাপ | ওর বাবা নেই শুনেছি | নিজে কিছু টিউশন পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ চালায় | সেই জন্যই অনির্বাণের মতন ছেলেকে যখন সামনে দেখেছে , একদম ঝুলে পড়েছে ওর ওপর | এরা তো বাংলা সিরিয়াল খুব দেখে | এইসব দেখেই মনে হয় ভালো মানুষির এক্টিং শিখে অনির্বাণকে ইমপ্রেস করেছে | কারণ জানে এরকম ছেলে লাইফে এলে তো আর কোনো চিন্তাই থাকবে না ! আর অনির্বাণও ইনোসেন্ট | ও ফেঁসে গেলো এই মেয়েটার কথায় | নইলে আমার আর অনির্বাণের তো ভীষণ ভালো বন্ডিং ছিল প্রথম থেকে ! কিন্তু মাঝখানে এই মেয়েটা এসে সব শেষ করে দিলো | ”

কথাগুলো প্রায় চোখে জল নিয়েই বলেছিলো স্নেহা মিসেস অন্তরা সেনগুপ্তকে | তবে অনির্বাণের মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল এই কথাগুলো শুনে | উনি তো প্রায় আঁতকে উঠে বলেছিলো , ———— ” কি ! কি বলছো তুমি এইসব ! আমার ছেলে লাস্ট এ এরকম একটা মেয়ের চক্করে পড়লো ! আর ইউ সিওর ? তাহলে তো আমি আজই অনির্বাণের সঙ্গে কথা বলবো এই নিয়ে | সব কিছু আউট অফ কন্ট্রোল হওয়ার আগে আই হ্যাভ টু স্পিক্ উইথ হিম …”

কথাগুলো শুনে স্নেহা সঙ্গে সঙ্গেই অনির্বাণের মা কে থামিয়ে বললো , ———– ” না না আন্টি | তুমি এই ভুলটা কখনো করতে যেও না আমার মতন ! আমি অনির্বাণকে পরিণীতার ব্যাপারে আগে বোঝাতে গেছিলাম | তাতে আমিই ওর কাছে খারাপ হয়ে গেছি | এরপর যদি তুমি ওকে এই নিয়ে কিছু বলতে যাও , তাহলে ও এই মেয়েটার জন্য নিজের ফ্যামিলির এগেনস্ট এ যেতেও এক সেকেন্ড ভাববে না ! এতটাই ব্রেণ ওয়াশ করেছে মেয়েটা | তোমার যদি কিছু বলার হয় , তাহলে আই সাজেস্ট তুমি ওই মেয়েটাকে বলো | ওকে বুঝিয়ে দাও নিজের স্ট্যান্ডার্ডটা | থ্রেট করো , যে ও যদি অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে তাহলে তুমি আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালকে বলে ওকে সাসপেন্ড করে দেবে | আর প্রিন্সিপাল তো তোমার বন্ধু | যদি মেয়েটা তোমার কথা না শোনে , তাহলে তো তুমি ইজিলি ওর এগেনস্ট এ স্টেপ নিতে পারো | আর অনির্বাণ এখন বাইরে | মেয়েটা চাইলেও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো অশান্তি করতে পারবে না | ও বাধ্য হবে সরে আসতে |”

কথাগুলো ভীষণ জোর দিয়ে বলেছিলো স্নেহা সেদিন | তাই অনির্বাণের মা ও এক মুহূর্তে রাজি হয়ে গেছিলো ওর কথায় | মিসেস অন্তরা সেনগুপ্তর মনেও আসলে এই সময়ে ভীষণ রাগ এসে জড়ো হয়েছিল ওই না দেখা মেয়েটার ওপর | মনে হচ্ছিলো যেভাবেই হোক এই মেয়েটাকে নিজের জায়গাটা বুঝিয়ে দিতেই হবে ওনার | নইলে অনির্বাণ হাতের বাইরে চলে যাবে পুরোপুরিভাবে |

<১৮>
মিসেস অন্তরা সেনগুপ্ত এরপর আর দেরি করেনি | পরেরদিনই গিয়ে হাজির হয়েছিল কলেজ ক্যাম্পাসে | স্নেহা আগেই পরিণীতার ফটো দেখিয়ে চিনিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটা কে ! তাই বাস স্টপ এ পরিণীতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই অনির্বাণের মা গাড়ি নিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল | পরিণীতা আচমকা অনির্বাণের মা কে গাড়ির কাঁচ খুলে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল | অনির্বাণ একবার ওর মা বাবার ফটো দেখিয়েছিল ওকে। তাই মহিলার মুখটা চেনা। পাশে আজ অর্নাও দাঁড়িয়েছিল ওর | পরিণীতা সেই মুহূর্তে ঘাবড়ে গিয়ে এক পলক অর্নার দিকেই তাকিয়েছিলো আনমনে | অর্না অনেকদিন ধরেই ওর আর অনির্বাণের রিলেশনের ব্যাপারে জানে সবটা | আর মিসেস অন্তরা সেনগুপ্তকেও চেনে। একবার একটা শপিং মলে সিনেমা দেখতে গিয়ে অনির্বাণ আর ওর মা কে দেখেছিল একসাথে কেনাকাটি করতে। তাই বুঝতে পারছিলো হঠাৎ করে এইভাবে অনির্বাণের মা কে সামনে দেখে কেন মেয়েটা এরকম ঘাবড়ে গেছে ! কিন্তু সেই সময়ই অনির্বাণের মা বলে উঠেছিল গাড়ির জানলায় মুখ বাড়িয়ে ,

———– ” তুমিই তো পরিণীতা ? তুমি ভেতরে এস | কথা আছে তোমার সাথে |”

কথাটা বলেই গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়েছিলো মিসেস অন্তরা সেনগুপ্ত পরিণীতার সামনে | পরিণীতা একটু সময় নিয়ে এরপর গাড়িতে উঠেছিল বেশ ইতঃস্তত হয়ে | বুঝতে পারছিলো না হঠাৎ অনির্বাণের মা ওর সঙ্গে কথা বলতে চায় কেন ! অনির্বাণ কি ওদের রিলেশনের ব্যাপারে কিছু বলেছে ওর মা কে ! আসলে এই সাতদিনের মধ্যে মাত্র ওই মাঝের একদিনই কথা হয়েছে ওর ছেলেটার সঙ্গে | ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে স্কাইপ এ চ্যাট করেছিল পরিণীতা | কিন্তু সেইদিন তো অনির্বাণ কিছু বলেনি এই নিয়ে ! এইসব কথাগুলোই ভাবছিলো , তখনই অনির্বাণের মা খুব গম্ভীর ভাবে বলে উঠলো , ———– ” কতদিন ধরে চেনো তুমি অনির্বাণকে ? মানে এই প্রেমের ড্রামাটা কতদিন ধরে চালাচ্ছ তুমি আমার ছেলের সঙ্গে ?”

কথাটা যেন কেমন কানে গিয়ে লাগলো এবার পরিণীতার | ও নিজের মনেই বলে উঠলো তাই , ——— ” ড্রামা ! মানে ?”

কথাটায় অনির্বাণের মা একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বললো , ———- ” যেটা এতদিন ধরে চালাচ্ছ তার মানে জানো না ? বুঝতে পারছি টাকার খুব দরকার তোমার | তোমার এপিয়ারেন্স দেখেই আমি বুঝেছি ঠিক কি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছো তুমি | ভেবেছো হয়তো যে এরকম বড়োলোক ব্রাইট একটা ছেলেকে ফাঁসালে লাইফ পুরো সেট হয়ে যাবে | আর তার ওপরে আমার ছেলেটা তো আবার খুব ইমোশনাল প্রথম থেকেই | তাই ওকে ট্র্যাপে ফেলা আরও সহজ ! তবে আমার ছেলে একটা ইমোশনাল ফুল হলেও আমি আর ওর বাবা কিন্তু সেরকম নোই | আমরা লোকের আসল ইনটেনশনটা খুব সহজে বুঝে যাই | ”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অনির্বাণের মা | পরিণীতা যেন এই সময় কিরকম বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলো স্থিরভাবে | হাত পা সব অবশ হয়ে আসছিলো ওর | কিন্তু তখনই অনির্বাণের মা একটা প্রশ্ন করে উঠলো ওকে বেশ তির্যকভাবে ———— ” আচ্ছা তোমার বয়স কত ?”

পরিণীতা এই সময় একটু থমকে গিয়েই বললো ——– ” কুড়ি বছর |”

এতে অনির্বাণের মা চোখ দুটো বড়ো বড়ো করেই বললো , ———— ” বাবা ! এই বয়সে এতো ! ছেলেদের এইভাবে ট্র্যাপ করার টেকনিক এতো তাড়াতাড়ি শিখলে কি করে ? মা ও কি এইসব করে না কি ? ফ্যামিলি প্রফেশন ?”

কথাটায় পরিণীতা এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না ! আপনাআপনিই বলে উঠলো ও , ———— ” এইসব কি বলছেন আপনি ? আমার মা কে নিয়ে ! আপনি ভাবলেন কি করে ?”

না , মিসেস অন্তরা সেনগুপ্ত এটা শুনে থামলো না | বরং নিজের তেজ বাড়িয়েই বললো , ————- ” গলা নামিয়ে কথা বলো আমার সঙ্গে | জানি , তোমাদের কালচারে এইসব শেখায়নি , বড়োদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ! তাই বললাম | আর একবার নিজেকে পুরোপুরি আয়নায় গিয়ে দেখে নিও | তোমার আমার ছেলের আশেপাশে ঘোরার মতনও যোগ্যতা নেই | আর অনির্বাণের সঙ্গে আমাদের বিজনেস ফ্রেন্ড আদিত্য বোসের মেয়ে স্নেহার বিয়ে অলরেডি ঠিক হয়ে গেছে | ও নিউইয়র্ক থেকে ফিরলেই ওদের বিয়েটা দিয়ে দেব আমরা | অনির্বাণ কথাটা জানেও | মনে হয় তোমাকে বলার প্রয়োজনবোধ করেনি | যাইহোক , আমি জানিয়ে দিলাম | কথাটা যদি সহজভাবে মাথায় ঢুকে যায় তো ভালো , নইলে প্রিন্সিপালকে বলে তোমাকে সাসপেন্ড করিয়ে দিতে আমার একদিনও সময় লাগবে না | নাও , গেট আউট ফ্রম মাই কার .. আর এরপর যদি কখনো আমার ছেলের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করার কোনো রকম চেষ্টা করো , তাহলে আজ যেই কথাগুলো তোমাকে এই বন্ধ গাড়ির মধ্যে বলেছি , সেগুলো পুরো কলেজের সামনে রাস্তায় , দরকার পড়লে তোমার মায়ের সামনে গিয়ে বলবো | নাও , গেট আউট .. ”

কথাটা শেষ করেই অনির্বাণের মা গাড়িটা মাঝ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে নামিয়ে দিলো পরিণীতাকে | তারপর ধুলো উড়িয়ে পরিণীতার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো সাদা মার্সেডিসটা ভিড়ে ভরা শহরে | কিন্তু পরিণীতা কিরকম কাঠের পুতুলের মতন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আজ এক জায়গায় | চলার মতন শক্তি যেন ওর শেষ হয়ে এসেছে হঠাৎ | কেউ যে কোনোদিন এইভাবে অপমান করে যাবে ওকে, ভাবেনি | এতো খারাপ খারাপ কথা বলবে , এটা কল্পনাও করেনি | কিরকম যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো নিজের | চারিদিকটা জলে ঝাপসা হয়ে এলো ওর | আর অনির্বাণ ! ও কি করে এরকম করলো ! ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে কথাটা না বলেই অনির্বাণ নিউইয়র্ক চলে গেলো ! এমন কি সেদিন স্কাইপে কথা বলার সময়ও ওকে কিছু জানালো না ! না কি ও নিজেই ওর মা কে পাঠিয়েছিল আজ ! নিজের মুখে সম্পর্কটা ভাঙতে পারবে না বলে মা কে দিয়ে অপমান করিয়ে সব শেষ করলো ! কথাটা ভেবে হঠাৎ রাগ হলো ভীষণ নিজের ওপর | এতটা নির্বোধের মতন কাজ করলো কি করে ও এতদিন ! নিজেকে এরকম অপমান করার সুযোগটা করে দিলো কেন ও ! পরিণীতা তো জানতো অনির্বাণের সঙ্গে ওর তফাৎটা | বুঝতো সব কিছু যে এই সম্পর্কটা কখনোই বেশি দূর এগোবে না ! ওর মতন বড়োলোকের ছেলে কোনোদিন পরিণীতার মতন মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না | একসেপ্ট করবে না কেউ | একটা অসম দূরত্ব চিরকাল থাকবে ওদের মধ্যে | তাহলে কেন পরিণীতা রাজি হলো ! কেন সেই অষ্টমীর সন্ধ্যেতে ফিরে এলো না নিজের বাড়ি ! তাহলে আজ এই দিনটা দেখতে হতো না ওকে ! এমন কি ওর মা কে নিয়ে এতো খারাপ কথা শুনতে হতো না আজ এইভাবে !

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল ও | কিন্তু ঘরে এসেই থমকে গেছিলো আরেকবার মা কে দেখে | কপাল থেকে রক্ত পড়ছে মায়ের | পরিণীতা দৃশ্যটা দেখেই ছুটে গেছিলো মায়ের কাছে | তারপর প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেছিল , ———— ” কি হয়েছে তোমার ? এইভাবে কেটে গেলো কি করে কপালটা ? কি করে হলো ?”

কথাটার উত্তরে মা একটু থেমে থেমে আস্তে গলায় বলেছিলো , ————- ” তোর মামা ধাক্কা দিয়েছে | আজ রান্না করতে একটু দেরি হয়েছিল তাই তোর মামার অফিস যেতে লেট্ হয়ে গেছে | খুব রেগে ছিল আজ ! ভাতের থালাটা নিয়ে যাওয়ার পরই ! ধাক্কা দিয়ে সব ফেলে দিলো ! আর আমাকেও ; ”

না , কথাটা আর শেষ করতে পারলো না মা | ডুকড়ে কেঁদে উঠলো হঠাৎ | পরিণীতা কে আঁকড়ে ধরলো কেমন শক্ত ভাবে | পরিণীতা জানে , এই বাড়িতে ওর মা কাজের লোকের থেকে কম কিছু না ! ওদের দুজনকে থাকতে দেয় বলে সব কাজ করিয়ে নেয় বাড়ির ! তার ওপরে উঠতে বসতে কথা শোনানো তো রোজকার ঘটনা ছিল | কিন্তু এইভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে ! এতটা ভাবেনি | কথাটা মনে হতেই চোখ থেকে জল বেরিয়ে এলো ওর | কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই মনটাকে হঠাৎ শক্ত করে পরিণীতা বললো ,

————- ” ফিরে চলো মা | সোনাঝুরিতে | আর এখানে থাকা সম্ভব না | আর আমাদের পরীক্ষাও শেষ | আমি কলেজ থেকে টিসি নিয়ে সোনাঝুরি কলেজ এ এডমিশন নেয়ার চেষ্টা করবো | কিন্তু এই কলকাতাতে এইভাবে আর থাকা সম্ভব না আমাদের |”

কথাগুলোতে পরিণীতার মা ঘাবড়ে গিয়ে বললো , ———— ” কি বলছিস তুই ? আমরা একা দুটো মেয়ে ! সোনাঝুরিতে একা একা থাকবো কি করে ! আর কিভাবে চলবে আমাদের ? হ্যাঁ , মানছি একটা বাড়ি আছে | কিন্তু শুধু বাড়ি থাকলেই তো হলো না | সংসার চালাবো কি করে ?”

পরিণীতা এই কথায় সেই দৃঢ় গলাতেই বললো , ———— ” চলে যাবে সংসার কিছু করে মা ! তুমি তো এখানেও সেলাই এর কাজ করো | সোনাঝুরিতেও করবে | আর আমি যেরকম টিউশন পড়াই কলকাতায় , ওখানে গিয়েও পড়াবো | কিছু একটা করে ঠিক চলে যাবে | আমাদের শুধু সাহসটা দেখাতে হবে | আর আজ মামা একবার গায়ে হাত তুলেছে , এরপর হয়তো রোজ মারবে | দুটো ভাতের জন্য এই মার্ সহ্য করার কোনো দরকার নেই তোমার | ”

কথাগুলো না থেমে বলে গেলো পরিণীতা | কিরকম কঠিন লাগছে এখন ওকে | জলে ঝাপসা চোখ দুটো আজ ওকে দুর্বল করছে না | বরং খুব শক্ত করে নতুনভাবে বাঁচার কথা বলছে | তাই পরিণীতা ওর মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো স্থির গলায় , ————- ” আমরা আর এখানে থাকবো না | আমরা সোনাঝুরি ফিরে যাবো | অনেক হয়েছে ! সব শহর সবার জন্য হয় না | কলকাতাটা আমাদের জন্য না |”

কথাগুলো বলেই সেদিন ও ফার্স্ট এড বক্সটা নিয়ে এসেছিলো ড্রয়ার থেকে | তারপর খুব আলতো করে কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়েছিলো মায়ের কপালের | রক্তগুলোকে তুলো দিয়ে মুছে দিয়েছিলো আস্তে আস্তে | কিন্তু আজ একটা কথা বুঝতে পারছিলো ও ভীষণভাবে ! আজকের দিনটা পরিণীতাকে যেভাবে কাঁটাছেড়া করেছে , অদৃশ্য রক্তে ভরিয়ে দিয়েছে ! সেটা কোনো ওষুধ কোনোদিন মুছতে পারবে না | সেই দাগগুলো রয়ে যাবে ওর মধ্যে | সারা জীবন মনে থেকে যাবে ওর |
<১৯>
সেইদিনের পর পাঁচটা বছর কেটে গেছে চোখের পলকে | কিন্তু পরিণীতা আর কখনো অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি | শহর ছেড়েছে , নিজের ফোন নাম্বার চেঞ্জ করেছে , নিজের চারিদিকের প্রত্যেকটা দরজা ও বন্ধ করে দিয়েছে নিখুঁত ভাবে | যাতে কোনোদিন আর সেই ছেলেটার সঙ্গে মুখোমুখি হতে না হয় | এর মধ্যে সোনাঝুরিতে ওরা একটা হোমসার্ভিস ক্যাটারিং খুলেছিলো কলকাতা থেকে এসে | আসলে শুরুর দিকে মা যতই সেলাই এর কাজ করুক , আর পরিণীতা টিউশন পড়াক , তাতে সংসার চালানোটা মুশকিলই হতো রোজ | তাই পরিণীতাই একদিন এই হোম সার্ভিস এর কথাটা তোলে মায়ের কাছে | ওর মা চিরকালই ভীষণ ভালো রান্না করে | আর পরিণীতাও মায়ের কাছ থেকে শিখেছে ছোট থেকে রান্না | তাই এই বিজনেসের আইডিয়াটা খারাপ না ! এই ভেবেই যতটা যা জমানো ছিল সেই দিয়ে শুরু করেছিল ‘ সোনাঝুরির হেঁসেল’ | প্রথমে নিজের পাড়ায় দুটো বাড়িতে খাবার ডেলিভারি করতো ওরা | তারপর সেই দুটো বাড়ি থেকে চারটে বাড়ি হলো | তারপর নিজের পাড়া থেকে পাশের পাড়া হলো | এইভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো ওদের ব্যবসাটা | রান্না ভালো বলে ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের জন্য ক্যাটারিং এর অর্ডার আসতে শুরু করলো এরপর | আর এখন এই পাঁচ বছর বাদে ‘সোনাঝুরির হেঁসেল’ তো সবার কাছেই পরিচিত একটা নাম | অনেকেই হোম ডেলিভারি নেয় ওদের কাছ থেকে | বিশেষ করে যারা কাজের জন্য এখানে এসে থাকে , তারা অনেকেই রান্নার ঝামেলা না করে ‘সোনাঝুরির হেঁসেল’ কে ভরসা করে | আর এতো অর্ডার আসে বলেই এখন ওদের তিনটে রাঁধুনি রাখতে হয়েছে | দু তিন জন ডেলিভারি বয়ও আছে | কারণ পরিণীতার পক্ষে এতো বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়া আর সম্ভব না | রোজের হিসেব করা , রাঁধুনিদের পেমেন্ট , বাজার করা , দোকান করা , কাস্টমারদের ডিল করা, এতো কাজ থাকে ওর ! এখন রান্নার দিকটা তাই মা ই দেখে | ওর আর সময় হয় না | তবে এই এতো ব্যস্ততার মধ্যে মাঝে মাঝে একটা কথা ভাবলে ভালো লাগে , যে এতো অপমানের পর অবশেষে ওরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে | নিজেদের পা এর মাটিটা শক্ত করতে পেরেছে | কলকাতা ছেড়ে সোনাঝুরি আসার ডিসিশনটা পরিণীতার ভুল ছিল না ! এখানে না আসলে সারা জীবন হয়তো অন্যের পা এর নিচে থাকতে হতো ! দুটো ভাতের জন্য দিন রাত মামা মামীর কথা শুনতে হতো ! এইভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচা সম্ভব হতো না ওদের ! তবে এই পাঁচ বছর বাদে মামার ফোন এসেছিলো কিছুদিন আগে হঠাৎ | শুনেছে না কি ওদের ব্যবসার কথা কোথাও থেকে ! আজ অবস্থা যখন ভালো , তাই নিজে থেকেই যোগাযোগ করতে এসেছে আবার | তবে সেদিন পরিণীতা মামার গলার আওয়াজটা শুনেই খুব কঠিন হয়ে গেছিলো নিজে | ভীষণ বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল ,

———– ” কি দরকার তোমার ? ফোন কেন করেছো ?”

মামা এতে একটু বিগলিতভাবে বলেছিলো , ———– ” এইভাবে কথা বলছিস কেন বল তো ? আমি জানি দিদিকে ঐভাবে ধাক্কা দিয়ে আমি ভুল করেছিলাম | আর এতদিন সেই লজ্জায়ই আর তোদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি | কিন্তু আজ অনেক সাহস নিয়ে ফোনটা করেছি আমি | দিদির কাছে ক্ষমা চাইবো বলে | দরকার হলে তোদের ওখানে গিয়ে আমি !”

না , কথাটাকে আর কমপ্লিট করতে দেয়নি পরিণীতা | মাঝখানে থামিয়েই বলেছিলো , ————– ” কোনো প্রয়োজন নেই | তোমার সাথে আর দেখা না হলে বরঞ্চ আমরা বেশি খুশি হবো | আর আমরা আমাদের অসময়ে বুঝে গিয়েছি যে আমার আর মায়ের নিজের লোক বলতে কেউ নেই ! রইলো তোমার বাড়িতে আমাদের দু বছর থাকতে দেয়ার কথা ! আমার মা তোমাদের বাড়ির সব কাজ করে সেই খাওয়ার টাকাও শোধ করেই দিয়েছিলো | তাই হিসেব মতন তোমার সঙ্গে আমাদের আর কোনো কথা নেই | তাই আর কোনোদিন এই নাম্বারে ফোন করার কথা ভুলেও ভাববে না | রাখছি |”

কথাটা বলেই পরিণীতা মামার মুখের ওপরই ফোনটা কেটে দিয়েছিলো সেদিন | রাগ হচ্ছিলো হঠাৎ ভীষণ ওর | চোখের সামনে মায়ের ওই রক্ত মাখা কপালটা ভেসে উঠছিলো যেন | কতটা লেগেছিলো মায়ের সেই মুহূর্তে ! কথাটা ভেবেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিলো জলে | তবে সেই ঝাপসা চোখেই সেইদিনের আরেকটা অপমানের কথা মনে পরে গেছিলো আরেকবার | অনির্বাণের মায়ের মুখটা এতো বছর বাদেও ভোলেনি ঠিক ও ! সেই ওর দিকে তাকানো তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি , কুঁচকে যাওয়া ভ্রু , আর কেটে কেটে বলা প্রত্যেকটা শব্দ আজও বাজে কানে | আর মনে পরে গেছিলো সেই ছেলেটার মুখটা | ওই সরল হাসি , শান্ত চোখ দুটো | আজ হয়তো বিয়ে হয়ে দু এক বছর কেটেও গেছে অনির্বাণের জীবনে ! ভালোই আছে নিশ্চই স্নেহার সঙ্গে | নিজের স্ট্যান্ডার্ডের মেয়ে বলে কথা ! ভালো তো থাকবেই | কথাগুলো আবার মনে মনে আওড়ে নিলো যেন পরিণীতা | আর প্রত্যেকদিনের মতন আজও ভেতরটা ভাঙলো আরেকবার |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here