ভালোবাসার শহরে,পর্ব:৫

#ভালোবাসার_শহরে ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৩>

আজ সপ্তমী | ঘুমটা ভেঙেছিল পরিণীতার সেই প্রত্যেকবারের মতন , ঢাকের আওয়াজে | সোনাঝুরি আর কলকাতা দুটো জায়গায় সব আলাদা হলেও এই শরতের সকালগুলো খুব এক | কথাটা ঘুম ভাঙতেই মনে হলো হঠাৎ | আর মনে হলো বাবার কথা | এই পুজোর দিনগুলোতে বাবাই তো আগে আদর করে ঘুম থেকে তুলতো ওকে | তারপর রেডি হয়ে একসঙ্গে মণ্ডপে যেত | কত অন্যরকম ছিল দিনগুলো ! এখন ভাবলে মনে হয় একটা রঙিন পৃথিবী | যাইহোক , তবে আজ অনির্বাণের সাথে বেরোনোর কথা আছে |তাই স্নান করে রেডি হয়ে আর মণ্ডপে গেলো না | রাসবিহারীর মোড়ের দিকেই পা বাড়ালো | আজ একটা লাল রঙের চুড়িদার পড়েছে ও | মা যতই টানাটানি থাক , পুজোতে ওকে ঠিক একটা শাড়ি , একটা চুড়িদার দেবেই ! তবে এবার পরিণীতাও দিয়েছে মা কে , একটা নতুন শাড়ি | টিউশনির টাকা জমিয়ে | শাড়িটা পেয়ে মায়ের মুখের হাসিটা ওর সারা জীবন মনে থাকবে ! যদিও এমন কিছু দামি শাড়ি না | তবে মা এমনভাবে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো যে মনে হচ্ছিলো যেন বিশাল দামি কোনো জিনিস গিফ্ট করেছে ! এইসব ভাবনার ভিড়েই হারিয়ে ছিল সেদিন, তখনই আকাশী পাঞ্জাবিতে অনির্বাণ ওর সামনে এসে দাঁড়ালো ভিড়ের মধ্যে থেকে | পরিণীতার কাছে হাসি মুখে এসেই বললো ও ,

——— ” হাই কতক্ষণ এলে ? রাস্তায় এতো জ্যাম ছিল বলে দেরি হয়ে গেলো আমার | সরি ..”

পরিণীতা এর উত্তরে ঘাড় দুলিয়েই বললো ,

——— ” না না , বেশিক্ষণ হয়নি এসেছি | সরির কিছু নেই !”

অনির্বাণ কথাটা শুনে অন্য একটা কথা বলে উঠলো ওকে ,

———– ” নতুন চুড়িদার ? খুব সুন্দর দেখতে |”

কথাটায় পরিণীতার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এখন যেন | ও বেশ উচ্ছসিত হয়েই বললো ,

———– ” তাই ! এটা আমার মা দিয়েছে আমাকে | নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে | ”

অনির্বাণও এটা শুনে একটু তাল দিয়ে বললো , ———– ” ওই জন্যই ! মায়ের পছন্দ তো | সব সময় বেস্টই হয় |”

কথাগুলোতে পরিণীতার মুখে হাসি | ওর হঠাৎ খুব অন্যরকম লাগছিলো অনির্বাণকে | সবার থেকে আলাদা | আসলে আজ যখন সকালে বেরোচ্ছিল , মামী রান্নাঘর থেকে বলে উঠেছিল চুড়িদারটা দেখে , ” কত দাম হবে ! দেখে তো মনে হচ্ছে না ভালো কাপড় | কোনো ছোটোখাটো দোকান থেকেই কিনেছে মনে হয় তোর মা !”

কথাটায় পরিণীতার মুখটা অন্ধকার হয়ে এসেছিলো সেই সময়ে | ভাগ্গিস মা ছিল না সামনে | তাহলে খুব কষ্ট হতো মায়ের | আসলে মামা মামী এরা এরকমই | কথায় কথায় ওদের ছোট করা , ওদের নিজের অবস্থাটা বুঝিয়ে দেয়া . এগুলো ওদের স্বভাব | তাই অনির্বাণকে চোখে লাগছিলো খুব | মনে হচ্ছিলো এইসব তো অনির্বাণের না বললেও চলতো ! ওর এই সাধারণ ড্রেসটা নোটিশ করার মতন তো ছিল না ! তাও অনির্বাণ এইসব বলে বুঝিয়ে দিলো কারণ ছাড়াই কাউকে ভালো ফিল করানো যায় | যেটা সবাই পারে না !

যাইহোক , সেদিন ওরা এরপর বেশ কয়েকটা ঠাকুর দেখেছিলো | তবে এই ঠাকুর দেখার মুহূর্তে অনির্বাণ যখন ভিড়ের মধ্যে বা , রাস্তা পার হওয়ার সময় আনমনে ওর হাত ধরছিল , অকারণে ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করছিলো , তখন পরিণীতা কিরকম থমকে যাচ্ছিলো হঠাৎ | অনির্বাণের স্পর্শটা আজ প্রথম পেয়ে ও যেন স্থির হয়ে যাচ্ছিলো মনে মনে | তবে এইসবই হয়তো শুধুই বন্ধুত্ব | তাই নিজের ভাবনাগুলোকে বাড়াচ্ছিল না বেশি ও | মুহূর্তগুলোর মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলেও মনকে বার বার বোঝাচ্ছিলো , যে ওদের গল্পটা সম্ভব নয় | কখনো সম্ভব নয় |

কিন্তু সেই সপ্তমীর সন্ধ্যেতে একটা ঘটনা ঘটেছিলো এরপর | অনির্বাণ সেদিন ঠাকুর দেখার পর একটা শাড়ির দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল হঠাৎ | পরিণীতা এটা দেখে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অনির্বাণ বলেছিলো , ———– ” তুমি একটু বাইরে ওয়েট করবে প্লিজ | আমার একটা জিনিস কেনার আছে | একজনকে দেব |”

পরিণীতা কথাটা শুনে কোনো আপত্তি না করে সহজ ভাবেই বলেছিলো , ———- ” হ্যাঁ , ঠিক আছে | আমি দাঁড়াচ্ছি | তুমি কিনে এস |”

এরপর অনির্বাণ দশ মিনিট পার করে আবার ফিরে এসেছিলো পরিণীতার কাছে, একটা প্যাকেট হাতে | পরিণীতা তখন ঘড়ি দেখে বলে উঠেছিল ,

————– ” আমাদের মনে হয় এবার বাড়ি ফেরা উচিত | মাকে বলেছিলাম সন্ধ্যের মধ্যে চলে আসবো |”

কথাটা শুনে অনির্বাণ কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে একটু যেন কিছু নিজের মনেই ভেবে বলেছিলো ওকে ,

————– ” হ্যাঁ , ঠিক আছে | আমি তোমাকে রাসবিহারীর মোর এ ছেড়ে দিচ্ছি , চলো |”

কিন্তু পরিণীতা এরপর খেয়াল করেছিল ছেলেটা হঠাৎ যেন কিরকম চুপ হয়ে গেছে | নিজের মনে কিছু একটা ভেবে চলেছে সারা রাস্তায় | দুটো অটো চেঞ্জ করে ওরা রাসবিহারী অব্দি আসা পর্যন্ত অনির্বাণ কিছুই বলেনি বিশেষ ! পরিণীতা কি হলো হঠাৎ বুঝতে পারলো না ঠিক | তারপর রাসবিহারীর নেমে পরিণীতা আস্তে গলায় বললো আলতো হেসে ,

———– ” আসলাম তাহলে | তুমি সাবধানে বাড়ি ফিরো |”

কথাটা বলেই ও যেতে যাচ্ছিলো , কিন্তু থমকে গেলো অনির্বাণের কথায় | সপ্তমীর সন্ধ্যের আলো , ভিড় , মাইকে ঢাকের আওয়াজ , সপ্তমীপুজোর মন্ত্রোচ্চারণের শব্দের মাঝেই অনির্বাণ বলে উঠলো , ————- ” এই শাড়িটা তোমার জন্য | আমি কিনেছি , আমার নিজের ইনকাম থেকে | আসলে আমি ফ্রিল্যান্সিং করি মাঝে মাঝে | নিউজপেপার , ওয়েবসাইট এইসবে আর্টিক্যাল লেখার কাজ | মা বাবার ওপর নিজের খরচের জন্য ডিপেন্ড করতে ভালো লাগে না ঠিক ! তাই | এইসব কেউ জানে না কলেজে | শুধু তোমাকে বললাম | আর তুমি যদি কাল এই শাড়িটা পরো , আমার ভালো লাগবে | আমি কাল অপেক্ষা করবো এখানে বিকেলে | তোমাকে এই শাড়িটা পরে দেখার জন্য | আসলাম |”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে অনির্বাণ আর এরপর অপেক্ষা করলো না | শাড়ির প্যাকেটটা পরিণীতার হাতে ধরিয়ে হারিয়ে গেলো হঠাৎ , ওই আলো আর ভিড়ের মাঝে | তবে পরিণীতা এই মুহূর্তে যেন নিঃস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো শুধু ওর দিকে ! অনির্বাণের চলে যাওয়াটা কিরকম পলকহীনভাবে দেখলো শুধু | বুঝতে পারলো না যে অনির্বাণ কেন এইসব করলো ! কেন যেটা সম্ভব না , সেরকম একটা গল্পের শুরু করে দিয়ে গেলো আজ ! ওদের মাঝের পার্থক্যটা যে অনেক | সব শেষে লোকজন তো শুধু টাকার অঙ্ক দিয়েই সম্পর্কগুলোকে মাপে | কেন বুঝলো না এটা অনির্বাণ !

<১৪>

সেদিনের পর অষ্টমীর সকাল পরিণীতার মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে এল ! কি করবে ও এই শাড়িটার ! ছেলেটা নিজের হাতে ওকে দিল কাল। মুখটা সেই সময় কিরকম মায়ায় ভরা ছিল যেন । যেন কত আর্জি , কত দ্বিধা , কত আড়াল ভাঙার চেষ্টা নিয়ে অনির্বাণ এসেছিল ওর কাছে ! কিভাবে ফিরিয়ে দেবে এরপর ছেলেটাকে ! কিন্তু না ফিরিয়েও কি উপায় আছে ! অনির্বাণ অতো বড় বিজনেস ম্যানের ছেলে । অনির্বাণের সাথে ওর কোন গল্প কি মানায় ! আর পরিণীতা যদি একবার জড়িয়ে যায় এই ফিলিংসগুলোর সঙ্গে , অনির্বাণের সঙ্গে , তাহলে কি খুব সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে ! পরিণীতা তো টাইমপাস করার মতন মেয়ে না । ও ভালোবাসলে সেটা সারা জীবনের জন্য হবে । কিন্তু তারপর যখন বাস্তবটা এসে ধাক্কা দেবে জীবনে ! ওর মধ্যবিত্ত পৃথিবীটা যখন অনির্বাণের বাড়ির লোক , কলেজের বন্ধুরা সবাই জানতে পারবে ! শুনবে যে অতো বড়লোক বিজনেসম্যান এর ছেলে ওর মতন সাধারণ একটা মেয়ের সঙ্গে রিলেশনে আছে ! তখন কি থাকতে দেবে সবাই পরিণীতাকে অনির্বাণের সাথে ! আর অনির্বাণ ই বা কেন সারা পৃথিবীর বিপরীতে গিয়ে ওর জন্য থাকবে ! কি আছে ওর মধ্যে ! তখন নিজেই হয়ত বলবে পরিণীতা কে চলে যেতে , দূরে থাকতে নিজের থেকে ! তখন পরিণীতা কি করবে ! কিভাবে ভুলবে এই শান্ত চোখ , আলতো হাসির ছেলেটাকে ! কিভাবে ওকে মনে না করে বেঁচে থাকবে নিজে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন দিনের শেষে বিকেল হয়েছিল ।

অনির্বাণ সেই অষ্টমীর বিকেলে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল পরিণীতার । এই প্রথম ও কাউকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে নিজের ফিলিংস । বোঝানোর চেষ্টা করেছে পরিণীতা আলাদা । সবার থেকে আলাদা অনির্বাণের কাছে । না,

‘ ভালোবাসি ‘ এটা বলতে পারেনি ও যদিও । কারণ অনির্বাণ ঠিক শব্দে বিশ্বাস করে না । আর এই ‘ভালোবাসতে ‘ গেলে কি কি ক্রাইটেরিয়া পূরণ করার দরকার হয়, সেটাও ঠিক জানে না ।

শুধু জানে পরিণীতাকে ওর ভালো লাগে । ইচ্ছে করে ওর কথা শুনতে । ওকে নিজের কাছে রাখতে । ওর বড় বড় দুটো চোখ তুলে অনির্বাণের দিকে তাকানোটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে । অনির্বাণ চোখ বন্ধ করলে যখন তখন দেখতে পায় সেই চাহুনি । দেখতে পায় পরিণীতা কে । আর এই মেয়ে টা চলে গেলে চারিদিকটা খুব ফাঁকা হয়ে যায় ওর । কিরকম স্থির হয়ে যায় অনির্বাণ সেই সময় ভিড় রাস্তায় । এগোতে পারে না কিছুতেই কয়েক মূহুর্ত ।

এইসবই ভালোবাসা কি না অনির্বাণ জানে না । কিন্তু এই সমস্ত ফিলিংস গুলো যে খুব দামী , এটা অনির্বাণ বোঝে । আর এই সব ফিলিংস গুলোকে আর নিজের মনে জমিয়ে না রেখে পরিণীতার সাথে শেয়ার করা উচিৎ বলেই ওর মনে হয়েছিল ! কিন্তু এখন খুব টেনশন হচ্ছে । যত ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে , ততই অনির্বাণ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আজ । মনে হচ্ছে তাহলে কি পরিণীতা ওর দেয়া শাড়িটা পরবে না ! তাই আসছে না এখানে ! পরিণীতা কি তাহলে একসেপ্ট করলো না ওকে ! ফিরিয়ে দিল আজ খালি হাতে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই এক ঘন্টা কেটে গেল । এখন সন্ধ্যে ছ টা । তবে এই সময়ে অনির্বাণের চারিদিকটা স্থির হয়ে গেল হঠাৎ । ভিড় রাস্তা , মণ্ডপের মাইকের আওয়াজ , ঢাকের শব্দ , সব যেন কিরকম থমকে গেল মুহূর্তে । অনির্বাণ দেখলো উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে ওর দেয়া আশমানি রঙের শাড়িটা পরে পরিণীতা আসছে ধীর পায়ে , অনির্বাণের কাছে ।

কিছুক্ষণের জন্য অনির্বাণ এই দৃশ্যটা দেখে ভীষণ খুশী হলেও পরিণীতার কথাগুলো শুনে ওর হাসিটা মিলিয়ে গেছিল সেদিন একটু পরেই । পরিণীতা আসলে নিজেকে খুব শক্ত করেই বলে উঠেছিল ,

——— ” তুমি শাড়িটা কাল এত মন থেকে দিয়েছ, যে সেটা ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই । তোমাকে কোনদিন আমি আসলে হার্ট করতে পারবো না ! কিন্তু আমাদের মধ্যে কিছু হওয়া সম্ভব না , এটাও সত্যি । আমি খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে অনির্বাণদা । তোমাদের মতন নই । আর তোমার সঙ্গে আমাকে এর থেকে বেশী মানায় না । আমরা শুধু পরিচিত হতে পারি ; বন্ধু হতে পারি । কিন্তু বাকিটা সম্ভব না ।

আসলাম । তুমিও বাড়ি যাও ।”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে পরিণীতা চলে যেতে যাচ্ছিল , কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়লো আবার কালকের ওই স্পর্শটা পেয়ে। অনির্বাণ ওর হাতটা সেই মুহূর্তে শক্ত করে ধরে ফেললো । তারপর বেশ দৃঢ় গলায় বললো ,

———- ” আমিও সাধারণ ছেলেই ! নিজের বলতে আমার একটা চাকরি অব্দি নেই এখন । আর বাবার বিজনেস , বাবার টাকা , এইসব কে আমি নিজের ভাবি না । ভাবলে অটো বাসে যাতায়াত করতাম না | ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের হাতখরচ এর টাকা ইনকাম করতাম না ! যেকদিন তুমি আমাকে দেখেছো , তাতে এইটুকু তো বোঝার কথা ছিল !”

কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করলো অনির্বাণ পরিণীতাকে | কিন্তু পরিণীতা এর ঠিক কোনো উত্তর দিয়ে উঠতে পারলো না এরপরও | অনির্বাণের সঙ্গে নিজের তফাৎটা ভুলতে পারলো না কিছুতেই | তবে ওর হাতটা ছাড়িয়েই নিতে পারলো না নিজের কাছ থেকে | আসলে এইভাবে এই প্রথম ওকে কেউ এতটা জোর দিয়ে নিজের কাছে রাখতে চায় | পরিণীতা তাই থমকে ছিল কেমন ! তখন অনির্বাণই আবার বলে উঠলো , ———— ” টাকা দিয়ে আমাকে জাজ কোরো না | মানুষ হিসেবে করো | তখনও যদি মনে হয় আমি ঠিক না , তাহলে তুমি যেতে পারো | আমি কখনো আটকাবো না | কিন্তু প্লিজ , এই স্ট্যাটাস , ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড , এইসব দিয়ে জাজ কোরো না | প্লিজ !”

কথাগুলো শেষ করে ও বেশ অসহায়ভাবেই তাকালো পরিণীতার দিকে , আর খেয়াল করলো পরিণীতার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে | পরিণীতা কিছু না বলেই এবার শুধু তাকালো ওর দিকে | অনির্বাণ বুঝলো , শব্দহীনভাবেই পরিণীতা থেকে গেলো আজ , শুধু ওর জন্য | পারলো না আর হিসেব মিলিয়ে চলতে | কে কি বলবে , কে কি ভাববে সেই চিন্তা করে দূরে থাকতে |

তবে অনির্বাণ এই মুহূর্তে একটা অন্য কথা বলে উঠলো | একটু হালকা গলায়ই ও বললো , ———– ” তোমাকে এই শাড়ীটাতে কিন্তু খুব ভালো লাগছে | এতো চিন্তা করে আমাকে ‘না’ বলতে এসেও এই একটা কাজ তুমি ঠিক করেছো | শাড়িটা পরে মানিয়েছে |”

পরিণীতা এবার ভিজে চোখেই আলতো হেসে ফেললো হঠাৎ | আজ তো আয়নার সামনে সাজার সময় এই ছেলেটারই মুখ ভাসছিলো চোখে | ভাবেনি , এইভাবে সেই পুরো কলেজের ক্রাশকে নিজের করে পাবে ! তাই এই প্রথম একটা ভালো লাগা এসে ভিড় করলো পরিণীতার মনে |
<১৫ >

এরপরের দিনগুলো কিরকম স্বপ্নের মতন ছিল পরিণীতার কাছে । যার সাথে এতদিন একটা মাপা দূরত্ব ছিল সে যে হঠাৎ দূরত্ব কাটিয়ে নিজেই ওর দিকে এগিয়ে আসবে , আসলে ভাবেনি সেটা । আর এরপর অনির্বাণ কে যত চিনেছে , যত কথা বলেছে , ছেলেটাকে সত্যি অন্য রকম লেগেছে ভীষণ ! এই যেমন ওর লোকজনকে হেল্প করার নেচার টা ! অনির্বাণ যে কত নোটস নিজের জুনিয়ারদের শেয়ার করে তার হিসেব নেই ! মাঝে মাঝেই তারা নোটস চাইতে অনির্বাণের কাছে হাজির হয় । তবে পরিণীতা খেয়াল করেছে , এসবে অনির্বাণ এর কোন বিরক্তি নেই । হাসি মুখেই সবার সাথে কথা বলে । খুব সহজভাবে মিশে যায় যেন। আর এত নোটস দিয়ে হেল্প করেও ভাবটা এমন দেখায় যেন কিছুই করেনি !

আর একটা জিনিস অনির্বাণ প্রত্যেক দু মাসে নিয়ম মেনে করে । সেটা হচ্ছে ব্লাড ডোনেশন । এটা অবশ্য ওর বাড়ির লোক ও না কি জানে না ! পরিণীতা ও সেই না জানার দলেই ছিল প্রথমে । কিন্তু সেই নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে অনির্বাণ যখন কলেজে এসেছিল , ওকে একটু উইক লাগছিল যেন পরিণীতার । বাস স্টপে দাঁড়িয়ে তো মাথাটাও ঘুরে গেছিল ছেলেটার । এইসব দেখে পরিণীতা তো বেশ টেনশনে পরে গেছিল । ওর হাত ধরে জোর করে ওকে ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল । বুঝতে পারছিল না কি হলো হঠাৎ করে ! কাল অব্দি তো সুস্থই ছিল ; তাহলে আজ এরকম উইক হয়ে গেল কি করে ছেলেটা ! তখন অনির্বাণ বাধ্য হয়ে ই ওকে ব্লাড ডোনেট করার কথাটা বলেছিল । আসলে এক বোতল ব্লাড দিয়েই ও কলেজে চলে এসেছে । ইম্পর্টেন্ট ক্লাস ছিল একটা । তাই আর কিছু খাওয়া হয়নি । একটু রেস্ট ও হয়নি ওর । তাই এরকম উইক লাগছে । আর কিছুই না !

কথাগুলো শুনে সেদিন অবাক হয়েই তাকিয়েছিল পরিণীতা ওর দিকে ! মেলাতে পারছিল না এখনকার হিসাবী লোকেদের ভীড় এ এই বেহিসাবি ছেলেটাকে । চোখ সরাতে পারছিল না ঠিক ওর ক্লান্ত মুখটা থেকে । মনে হচ্ছিল এই বাস স্টপে ই অনির্বাণকে একবার জরিয়ে ধরতে । ওকে ভীষণভাবে আগলে রাখতে । কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন ওর চোখে হঠাৎ জল এসে ভিড় করেছিল ।

তবে পরিণীতা এরপর অনির্বাণ কে জোর করে ধরে বেঁধে ক্যান্টিনে নিয়ে এসেছিল । তারপর মুখে রুচি না থাকা সত্ত্বেও অনেক বুঝিয়ে বুঝিয়ে খাইয়েছিল । এমনকি জেদ করে অনির্বাণের বাড়ির গলি অব্দি ছেড়ে দিয়েছিল । অনির্বাণ সেদিন তবে ওকে অনেক করে বাড়ি আসার কথা বলেছিল নিজের । কিন্তু পরিণীতা টিউশন পড়ানো আছে , এইসব অজুহাত দিয়ে চলে এসেছিল ।

আসলে কিছু একটা আজও আটকায় ওকে । ভয় হয় অপমানের । অনির্বাণের বাড়িতে এইভাবে হঠাৎ করে গেলে যদি ওর বাড়ির লোক কিছু মনে করে পরিণীতাকে দেখে ! পরিণীতার সাধারণ চুড়িদার , ওর রং ওঠা গলার পুরনো চেনটা দেখে যদি চোখে লাগে ওদের ! তাহলে পরিণীতা ও আর সহজভাবে মিশতে পারবে না অনির্বাণের সঙ্গে । ওর বড় বাড়ি , ওয়েল ফার্ণিশড রুম , গাড়ির কলেকশন দেখে কুঁকরে যাবে নিজের মধ্যে । ওই সাধারণ ছেলের আড়াল টা ভেঙে যাবে হঠাৎ। তফাৎটা আরো স্পষ্ট বোঝা যাবে দু জনের । তাই এর থেকে দূরে থাকাই ভালো । কথাগুলো ভেবেই সেদিন ফিরে এসেছিল মামাবাড়িতে, নিজের সিঁড়ির নিচের ছোট্ট এক চিলতে ঘরটায় ।

তবে এরপর অনির্বাণের জন্মদিনে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যে পরিণীতা বাধ্য হলো নিজের চিন্তাগুলোকে থামাতে । মনের দূরত্ব টা কে কমিয়ে আনতে ।

আসলে সেদিন ও অল্প পায়েস বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অনির্বাণের জন্য কলেজে । গিফ্ট দেবার মতন সত্যি কিছু ভেবে পায়নি পরিণীতা কিছুতেই । আর অনির্বাণের বাবার যা অবস্থা , ও নিশ্চই ব্র্যান্ডেড জিনিস ইউজ করে , যেটা দেবার ক্ষমতা ওর নেই । তাই পায়েস ই ভরসা । এইসব এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই এসেছিল ক্যান্টিনে । কিন্তু দরজার কাছে এসেই পা থমকে গিয়েছিল পরিণীতার । ওটা স্নেহা না ! অনির্বাণের সঙ্গেই পড়ে । শুনেছে ওরা ফ্যামিলি ফ্রেন্ডস । কথাগুলো ভাবতেই দেখেছিল স্নেহা আর অনির্বাণ কে ঘিরে বেশ ভিড় অনেক জনের ।আর তাদের মাঝেই স্নেহা অনির্বাণ কে ‘ হ্যাপি বার্থডে ‘ বলে জড়িয়ে ধরলো হঠাৎ । তারপর সবার সামনেই ওকে একটা রিং এর কৌটো দিয়ে বললো ,

——– ” দিস ইজ ফর ইউ .. আমি নিজে আজ সকালে এই প্ল্যাটিনাম রিংটা পছন্দ করে কিনেছি। দ্যাখো পছন্দ হয় কি না ?”

কথাটা শুনে পরিণীতা যেন থমকে গেল ভেতরে ভেতরে । মনে হলো এই সময়ে এখানে ও ভীষণ বেমানান , তাই চলে যেতে যাচ্ছিল নিজের মনে,কিন্তু তখনই অনির্বাণ এর গলার আওয়াজ কানে এলো , আর ও দাঁড়িয়ে পড়লো মুহূর্তের জন্য ।

অনির্বাণ সেই সময় বেশ দৃঢ় গলায়ই স্নেহা কে বললো , ———– ” এত দামী গিফ্ট আমার জন্য ! সরি স্নেহা , কিন্তু আমি এটা একসেপ্ট করতে পারবো না । তুমি উইশ করেছ , সেটাই এনাফ । এন্ড থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্যাট .. কিন্তু এইসব গিফ্ট এর কোন দরকার নেই ।”

কথাটায় পরিণীতা দূর থেকেই খেয়াল করলো স্নেহার মুখটা কিরকম শুকিয়ে কঠিন হয়ে এসেছে যেন । ও একটু জোর দিয়েই বললো ,

——— ” কেন নেবে না আমার গিফ্ট ? প্রবলেম টা কি তোমার ?”

এই মুহূর্তে স্নেহার পাশে দাঁড়ানো একটা মেয়েও বলে উঠলো, ——– ” সত্যি অনির্বাণ ! তুই কিন্তু গিফ্ট টা না নিলে খুব বড় একটা জিনিস মিস করবি । রিংটার ডিজাইন টা ভীষণ সুন্দর । একবার দ্যাখ শুধু । তোর পছন্দ হবেই ।”

অনির্বাণ এই কথাগুলো শুনে এক সেকেন্ড চুপ থেকে সেই পুরনো দৃঢ়তা নিয়েই বললো ,

——— ” আমি খুব সাধারণ একটা স্টুডেন্ট এখন । ফ্রিল্যান্সিং করে সামান্য কিছু রোজগার করি । আমার এরকম এক্সপেনসিভ গিফ্ট নেয়ার বা দেয়ার , দুটোরই এখনও যোগ্যতা হয়নি । আর মেটিয়ারিলিস্টিক কোন জিনিস এ আমি বিশ্বাস ও করি না । তাই সরি স্নেহা , আমি এই গিফ্ট টা একসেপ্ট করতে পারবো না ।”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে অনির্বাণ থেমেছিল। কিন্তু তখনই ওর চোখ ক্যান্টিনের গেটে নিস্পলকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পরিণীতার দিকে পড়েছিল । আর এক সেকেন্ডেই ও যেন ওর আসে পাশের সবার অস্তিত্ব ভুলে হাসি মুখে পরিণীতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল । তারপর নিজে থেকেই বলে উঠেছিল , ——- ” হাই … কখন এলে ? ক্লাস শেষ তো ? তাহলে একটা জায়গায় যাবো আমরা ।”

পরিণীতা তখন আলতো হেসে শুধু বলে উঠেছিল ,

——— ” হ্যাঁ , শেষ ক্লাস । তোমাকে খুঁজতেই এসেছিলাম এখানে ।”

কথাটার উত্তরে অনির্বাণ ক্যান্টিনে সবার সামনেই পরিণীতার হাত ধরে বলেছিল ,

——–” ঠিক আছে, চলো তাহলে ।”

তারপর সবার ভিড় কাটিয়ে ওরা বেরিয়ে গেছিলো কলেজ থেকে | কিন্তু স্নেহা কিরকম স্থির হয়ে গেছিলো যেন এইসব দেখে | এর মধ্যে অনির্বাণের যে সব বন্ধুরা ছিল ক্যান্টিনে , তারা তো বলা শুরুই করে দিয়েছিলো , “অনির্বাণের সঙ্গে কিছু চলছে না কি মেয়েটার ? যেভাবে একসঙ্গে বেরিয়ে গেলো ! কিছু সিন্ আছে বলে মনে হচ্ছে |”

কথাগুলো খুব লেগেছিলো স্নেহার মনে | কিরকম হাত থেকে বালি ফস্কে যাওয়ার মতন লাগছিলো যেন ওর | অনির্বাণ আর এই মেয়েটা ভালো বন্ধু , এইটুকু জানতো স্নেহা | তবে ওদের রিলেশন আছে এটা ঠিক ভাবতে পারছিলো না | আর অনির্বাণ ওরকম একটা লো স্ট্যান্ডার্ড মেয়ের জন্য ওকে অদেখা করে চলে গেলো ! এমন কি সবার সামনে স্নেহার গিফ্টটা পর্যন্ত একসেপ্ট করলো না ! ঘটনাটা যেন কিরকম ছুঁচ বেঁধার মতন বিঁধছিলো ওকে | চারিদিকটা ঝাপসা হয়ে আসছিলো হঠাৎ | একটা না পাওয়ার জ্বালা এসে জমছিল ওর ভেতরে | ভীষণভাবে |

<১৬>

সেদিন অনির্বাণ আর পরিণীতা কলেজ থেকে বেরিয়ে প্রিন্সেপ ঘাটে গেছিলো এরপর | পরিণীতা তখনও অব্দি পায়েস করে নিয়ে আসার কথাটা বলেনি অনির্বাণকে | আসলে প্রথমবার কারোর জন্য করছে এইসব | কিভাবে বলবে তাই বুঝতে পারছিলো না ! তাই একটু অন্য কথাই বলে উঠেছিল ও | কথার ছলে বলেছিলো ,

———— ” আচ্ছা , জন্মদিনে কোন জিনিসটা পেলে তুমি সব থেকে বেশি খুশি হবে ? মানে কোন গিফ্টটা ?”

অনির্বাণ এর উত্তরে এক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে বলেছিলো , ———– ” পায়েস | নতুন গুড়ের | আসলে ঠাম্মা যখন বেঁচেছিল করতো প্রত্যেকবার আমার জন্মদিনে | মা তো নিজের ক্লাব , পার্টিস এইসব নিয়ে এতো বিজি থাকে যে এগুলো কখনো মাথাতেই আসে না ! ছোটবেলা থেকেই , আসলে আমি আমার মা বাবার কাছে কম , ঠাম্মার কাছে বেশি মানুষ | ওরা তো সারাক্ষণ এতো ব্যস্ত থাকতো যে আমাকে অতো বেশি টাইম দিতে পারতো না ! ঠাম্মাই সব সময় সঙ্গে থাকতো | তাই অনেকে বলে আমি না কি একদম আমার ঠাম্মার মতন হয়েছি |”

অনেকগুলো কথা সেদিন একসঙ্গে কিরকম বেহিসেবিভাবে বলে দিলো অনির্বাণ | আসলে এই জন্মদিনটায় ওই মানুষটার কথা মনে পরে খুব | ওর সব থেকে কাছের , সব থেকে নিজের মানুষ ছিল ঠাম্মা | মনটা তাই এলোমেলো হয়ে যায় আজ মাঝে মাঝে | এইসবই ভাবছিলো , তখনই পরিণীতা ওর ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটোটা বার করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো ,

————- ” এটা তোমার জন্য | নতুন গুড়ের পায়েস | আজ সকালে করেছি | ”

অনির্বাণ কথাটা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো , ———– ” তুমি রান্না করতে পারো ! সিরিয়াসলি ?”

পরিণীতা এর উত্তরে মুচকি হেসে বললো , ———– ” হ্যাঁ , একটু আধটু পারি | তবে কেমন পারি , সেটা তো তুমি বুঝবে , খেয়ে |”

কথাটায় অনির্বাণ আর অপেক্ষা না করে পায়েসের কৌটোটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খুলেই মুখে পুরলো এক চামচ | তারপর কয়েক সেকেন্ডের ভিড়েই বলে উঠলো আগের মতন অবাক হয়েই ,

———– ” তুমি এতো ভালো রান্না করো ! এই বয়সে ! আমি তো এখনো অব্দি শুধু ম্যাগি করতে পারি ! ”

না , কথার উত্তরে পরিণীতা আর কিছু বলতে পারলো না বিশেষ ওকে | শুধু হেসে ফেললো খুব জোরে | আর অনির্বাণ অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো সেই মুহূর্তে পরিণীতার দিকে | মনে হলো এই সময়টা যদি এইভাবেই থেমে যেত এই শীতের দুপুরে! পরিণীতা যদি এভাবেই ওর সঙ্গে থাকতো সারাক্ষণ ! জড়িয়ে থাকতো মুহূর্তগুলোতে | তাহলে হয়তো সব পেয়েছির দেশে চলে যেত অনির্বাণ | যেখানে শুধু রূপকথা |রুক্ষ শুষ্ক বাস্তবহীন সুন্দর কিছু রূপকথা |

কিন্তু সেদিনের সেই রূপকথার বিকেল পেরিয়ে কয়েক মাস বাদে একটা বাস্তবের বিকেল চলেই এলো জীবনে অনির্বাণের | মাস্টার্স এর মধ্যে কমপ্লিট হয়ে গেছে ওর | ভালোই রেজাল্ট হয়েছে | কিন্তু তাও সেদিন মুখটা অন্ধকারই ছিল অনির্বাণের | পরিণীতা খেয়াল করেছিল এটা শুরু থেকেই | তবে অনির্বাণ নিজের প্রব্লেমের কথা খুব সহজে বলার মতন ছেলে না | তাই অনেক জোরাজুরি করতে হয়েছিল ওকে | তারপর অবশেষে অনির্বাণ একটা দীর্ঘ্য নিঃশ্বাস নিয়ে বলেছিলো ,

———– ” আমার একটা সময়ে খুব ইচ্ছে ছিল নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করবো | মানে আমার পি.এইচ.ডি টা করবো ওখান থেকে | তাই থার্ড সেম চলার সময়ই একটা এডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম | এন্ড আই গট সিলেকটেড … কাল জানতে পেরেছি | কিন্তু আমি এখন যেতে চাই না আর কোথাও | এখানে থেকেই ফারদার স্টাডিজ করতে চাই | কিন্তু বাবা কথাটা জানার পর থেকেই অশান্তি শুরু | আজকে ব্রেকফাস টেবিলেও এই নিয়ে ঝামেলা হয়ে গেলো একটা ! ”

কথাগুলো কোনো পজ না নিয়ে বলে গেলো অনির্বাণ | কিন্তু পরিণীতা কয়েক মিনিট সময় নিয়ে ওকে একটা প্রশ্ন করে উঠলো হঠাৎ ,

———— ” কিন্তু তুমি যেতে চাও না কেন ? একটা সময় তো এটাই তোমার লাইফের এইম ছিল | তাহলে ?”

অনির্বাণ এই কথায় অবাক হয়েই বললো , ————- ” এটা তুমি বলছো ! তুমি জানো না কারণটা ? তোমার সঙ্গে থাকাটা এখন আমার কাছে সব থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট | এই যে রোজ দেখা হয় , টুকরো কিছু কথা হয় , এগুলোর জন্যই তো লাইফটা এতো স্পেশ্যাল লাগে | মনে হয় সব আছে লাইফে | আর রইলো পি.এইচ.ডি ! আমি নেট দেব এই নভেম্বরে | আমি তো খারাপ স্টুডেন্ট নোই ! আমি পেয়ে যাবো চান্স | আর আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর হেড এর সাথেও কথা হয়েছে | নেক্সট উইক থেকে আমি ওনার আন্ডারে ল্যাবে কাজ শুরু করে দেব |”

কথাগুলোয় পরিণীতা আবার একটু সময় নিয়ে অনির্বাণের হাতটা ধরে বলেছিলো ,

————- ” আমি চাই না নিজের লাইফের এইম টা কে বদলে দিয়ে তুমি আমার জন্য এখানে থেকে যাও ! তোমার মা বাবারও তো কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে তোমাকে নিয়ে ! আর আমি তো এই কদিন হলো এসেছি তোমার কাছে | ওরা তো শুরু থেকে ছিল | আর যদি কিছু থাকার হয় , তাহলে সেটা দূরে গেলেও থাকবে | লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ অনেকের জীবনেই কিন্তু আছে ! আর যদি এই নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির কথা আমি ছেড়েই দিই , কিন্তু ইন ফিউচার , তুমি কোনো চাকরি পেলে , কলকাতা থেকে দূরে , স্টেটের বাইরে , তাহলে কি করবে ? তাহলেও ছেড়ে দেবে ! এইভাবে কি সত্যি আমরা একসাথে থাকতে পারবো ? আর শুধু তুমি কেন ! আমি যদি বাইরে কোনো চাকরি পাই ! তুমি যেতে দেবে না ? ছেড়ে দিতে বলবে ? না কি শক্ত করে আমাকে ধরে বোঝাবে যে আমার কাজটা করা উচিত ?

আমি জানি , তুমি আমাকে আটকাবে না | আমি থাকতে চাইলেও তুমি যেতে বলবে | তাই আজ আমিও বলছি , নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে এডমিশনটা নিয়ে নাও | আর অন্য কিছু ভেবো না | আর রইলো আমাদের গল্পটা , সেটা ঠিক থাকবে | যেরকম এখন আছে |”

কথাগুলো ভীষণ জোর দিয়ে বলেছিলো পরিণীতা | অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল ওর শব্দগুলোতে | অনির্বাণও কিরকম থমকে গেছিলো এরপর | কিছুটা সময় লেগেছিলো ওর এই এতো কথার উত্তর দিতে | কিন্তু তারপর নিজের মনকে বুঝিয়ে ও আলতো হেসে বলেছিলো ,

—————- ” বয়সে আমি তোমার থেকে বড়ো ঠিকই | কিন্তু ম্যাচিওরিটিতে তুমি আমার থেকে ওপরে | আর, বাকি সবাইকে না বলতে পারলেও তোমাকে সেটা পারবো না | নেবো এডমিশন নিউইয়র্কে | কিন্তু এটা আমার ডিসিশন না | তোমার ডিসিশন |”

কথাগুলো শেষ করে সেদিন অদ্ভুত একটা নিঃস্তব্ধতায় কেটেছিল বিকেলটা | যেন দুজনেরই আর কিছু বলার ছিল না হঠাৎ ! মনে হচ্ছিলো রূপকথা কাটিয়ে খুব কঠিন কোনো বাস্তব আসতে চলেছে জীবনে ! যেটা ওদের দুজনকেই একসেপ্ট করতে হবে | হাজার খারাপ লাগলেও মেনে নিতে হবে | কলেজের প্রেমটাই তো আসলে জীবন নয় ! সেটা শুরু মাত্র | কিন্তু যেই প্রেমগুলো ভালোবাসা হয় , সেগুলো এই রূপকথার সময়টা কাটিয়েও থেকে যায় | বাস্তবতায় ধাক্কা লেগে ভেঙে যায় না টুকরো হয়ে | আর সেই জন্যই অনির্বাণ আর পরিণীতাকে আলাদা থাকতে হবে | দূরে থেকে বুঝতে হবে , ওদের সম্পর্কটা শুধু প্রেম না ; ভালোবাসা |

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here