ভালোবাসার শহরে,পর্ব:৩+৪

#ভালোবাসার_শহরে ( তৃতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র

<৬>

সেই সূর্যাস্তের পর একটা সপ্তাহ কেটে গেছে শহরে । পরিণীতা আজ ক্লাস শেষ করে সবে বাস স্টপে এসে দাঁড়িয়েছিল । আজ অর্না আসেনি কলেজ । বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন আছে না কি ! কথাটা ভেবে একটা আলগা মন খারাপ এসে জমা হলো এখন । আসলে এই অর্না না আসলে একা একা ক্লাস করতে মোটেও ভালো লাগে না পরিণীতার । আর নিজে একটু শান্ত স্বভাবের চুপচাপ বলে খুব সহজে বন্ধুত্ত্ব ও করে উঠতে পারে না নতুন কারোর সাথে । তাই অর্না না আসলে খুব খালি খালি লাগে ওর । সেই স্কুল লাইফের বন্ধু তো ! সোনাঝুড়ি থেকে যখন মাধ্যমিক পাশ করে প্রথম এসেছিল কলকাতায় , ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিল নতুন স্কুলে , সেই তখন থেকে অর্না বন্ধু ওর ।

বেশ অন্যমনস্ক হয়ে এইসবই ভাবছিল পরিণীতা একা দাঁড়িয়ে সেদিন । তবে হঠাৎ এই একাকীত্বের ভিড়ে সেই চেনা গলার আওয়াজটা এসে হাজির ওর কাছে ।

অনির্বাণ আজ কলেজ থেকে বেরিয়েই খেয়াল করেছিল পরিণীতাকে । তাই একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওর পাশে এসে বলে উঠেছিল নিজে থেকে , ——— ” হাই , কেমন আছো ? ক্লাস শেষ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে যেন সেদিন নিজের ভাববার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা অবাক হয়েই গেছিল অনির্বাণ কে দেখে । কলেজে কদিন আগে শুনেছিল একজনের মুখে , খুব বড়োলোকের ছেলে না কি অনির্বাণ ! তার ওপরে সিনিয়র ! তাই সে নিজে থেকে কথা বলতে আসবে , এটা ঠিক এক্সপেক্ট করেনি । হ্যাঁ , যদিও অনির্বাণ ওকে স্টেজে গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল । কিন্তু সেসব টুকটাক সমাজ সেবামূলক কাজ তো অনেকেই নিজের মর্জি মতন করে । ভেবেছিল অনির্বাণ ও সেরকমই । তারপর হয়ত আর মনেও রাখবে না ! কিন্তু ভাবনাটা এবারও ঠিক মিললো না পরিণীতার ।যাইহোক, কথাটা ভাবতে ভাবতে একটু সময় নিয়ে অল্প হেসে উত্তর দিল ও,

———- ” হ্যাঁ ভালো আছি । ক্লাস শেষ । বাড়ি ফিরছি ।”

এই উত্তরে অনির্বাণ আর একটা নতুন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে উঠলো আবার ওকে ,

———- ” তোমার কি সাবজেক্ট ? কোন ডিপার্টমেন্ট তোমার ?”

এর উত্তরে পরিণীতা এক কথায়ই বললো,

————- ” বাংলায় অনার্স । ফার্স্ট ইয়ার ।”

অনির্বাণ কথাটা শুনে চোখটা একটু বড় করেই বললো , ———–” ওরে বাবা ! বাংলা অনার্স ! মানে বঙ্কিমচন্দ্র ! স্কুললাইফে পড়েছিলাম একবার , সাগর সঙ্গমে নবকুমার ! মাথাটা ঘুরতো মাঝে মাঝে ওনার শক্ত শক্ত বাংলা পড়ে ! তুমি এইসব মনে রাখো কি করে ?”

এই প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দেবে পরিণীতা ঠিক বুঝতে পারেনি প্রথমে । তাই অল্প সময় নিয়ে আলতো হেসে বলেছিল সেই এক কথায় ,

———- ” জানি না ! অভ্যাস হয়ে গেছে ।”

তবে সেদিন এই কথার ভিড়েই ওদের সামনে স্নেহার গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ । পরিণীতা একটু হকচকিয়ে খেয়াল করেছিল লাল রঙের মার্সিডিজ গাড়ির জানলার কাঁচ খুলে বেশ সুন্দর একটা মেয়ের মুখ বেরিয়ে এলো সামনে । সে বেশ আন্তরিক ভাবেই এবার অনির্বাণ কে বলে উঠলো নিজে থেকে ,

———- ” তুই স্যারের ব্যাচে যাচ্ছিস তো ? আমিও যাচ্ছি । চল একসঙ্গেই গাড়িতে যাই আজ । আর কিছু নোটস বোঝারও আছে তোর থেকে । গাড়িতেই বুঝে নেব সেসব । কতক্ষণ আর এই গরমে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবি বাসের অপেক্ষায় ! আর তুই তো কলেজে নিজের গাড়িটা নিয়েই আসতে পারিস রে । এইসব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যাবহার করার দরকার কি অন্যদের মতন ! বুঝি না !”

অনেকগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে গেল সেদিন স্নেহা । আর পরিণীতা খেয়াল করলো এতক্ষণ অনির্বাণের মুখটা যেরকম হাসি খুশি ছিল , সেখানে হঠাৎ অল্প গাম্ভীর্য এসে জড়ো হয়েছে কেমন । আর সেই গাম্ভীর্য নিয়েই অনির্বাণ বলে উঠলো একটু আস্তে গলায় ,

———– ” তুই একটু ভুল বলছিস । ওটা আমার গাড়ি না । আমার বাবার গাড়ি । আমি এখনও কিছু ইনকাম করি না যে নিজের একটা গাড়ি কিনবো ! তাই আমার জন্য বাস অটোই ঠিক আছে । যাইহোক , তোর যা নোটস বোঝার , আমি স্যারের ব্যাচে গিয়েই বুঝিয়ে দেবো । আর ব্যাচ অব্দি আমি বাসেই যাবো । কারোর গাড়িতে না।”

কথাটা বেশ দৃঢ় ভাবেই বললো অনির্বাণ এই মুহূর্তে । তাই স্নেহাও আর কথা বাড়ানোর মতন কিছু খুঁজে পেল না যেন । একটু থতমত ভাবেই অনির্বাণ কে বললো ,

———– ” ঠিক আছে, আমি আসছি । ব্যাচে দেখা হবে ।”

তারপর এক পলক পরিণীতাকে দেখে গাড়ির কাঁচটা তুলে নিল নিজের । হারিয়ে গেল দুর রাস্তার ভিড়ে ।

তবে এইসবের মধ্যে পরিণীতাও কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো আনমনে অনির্বাণের দিকে । বেশ অন্যরকম লাগলো হঠাৎ ছেলেটাকে যেন ! হালকা দাঁড়ি , শান্ত চোখের আড়ালে একটা দৃঢ় ছেলে মনে হল অনির্বাণকে কেমন।

<৭>

সেদিন বাসে এরপর অনির্বাণই আবার কথা শুরু করেছিল নিজে । আসলে পরিণীতার বাড়ি আর অনির্বাণের পড়ার ব্যাচ দুটোই এক জায়গায় । সেই জন্য একই বাসে ওঠা । তবে সেদিন পরিণীতা নিজের টিকিটের দাম দিতে গিয়ে থমকে গেলো অনির্বাণের কথায় | অনির্বাণ ওর পাশের সিটেই বসেছিল | পরিণীতাকে টিকিটের ভাড়া দিতে দেখে বেশ গম্ভীর হওয়ার মতন গলা করেই বলেছিলো ও , —————- ” এসব কি করছো ? জানো না , সিনিয়র সামনে থাকলে এইভাবে নিজের টিকিটের দাম দিতে নেই ! আর এরকম কখনো করবে না |”

কথাটা বলেই ও কন্ডাক্টারকে একটু দৃঢ় গলায় টাকাটা বার করে বলে উঠলো , ———- ” দুটো রাসবিহারী কাটুন |”

পরিণীতা তবে একটু ইতঃস্তত হওয়া ছাড়া সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি তারপর | কিন্তু অনির্বাণ চুপ না থেকে বলে উঠেছিল ,

————— ” তোমার গানের কিন্তু সবাই ফ্যান হয়ে গেছে কলেজে | পরেরদিন আমাদের ক্লাসের অনেকে তোমার কথা বলছিলো ! বলছিলো এরপর কলেজ সোশ্যালেও তোমাকে দিয়ে গান গাওয়াবে না কি |”

কথাটা শুনে পরিণীতা চোখ দুটো কিছুটা বড়ো করেই বলেছিলো , ———– ” কি ! কলেজ সোশ্যাল এ আবার গাইতে হবে ! কিন্তু এসবের তো কোনো দরকার ছিল না | মানে !”

কথাটাকে ঠিক আর ও শেষ করতে পারলো না যেন | নিজের মনেই একটু মুষড়ে পড়লো নিজে | ব্যাপারটা দেখে অনির্বাণ অবাক হয়েই বলে উঠলো ,

————— ” তুমি এটা শুনে খুশি না ? কলেজে তুমি ফেমাস হয়ে যাচ্ছ ! সবাই তোমার গান শুনতে চায় | আর সোশ্যাল এ বাইরের আর্টিস্টরাও পারফর্ম করতে আসবে | তাদের সঙ্গে তুমিও স্টেজ শেয়ার করবে | এটা শুনে তো যে কেউ খুশি হয়ে যাবে !”

এক নিঃশ্বাসেই বলে গেলো অনির্বাণ কথাগুলো | কিন্তু খেয়াল করলো পরিণীতার এসব শুনে কোনো আনন্দ নেই মনে | বরং ও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে একটু অন্য কথা বলে উঠলো | আস্তে গলায় চোখ নামিয়ে কিছুটা যেন নিজের মনেই বললো , ————- ” আমি তো ভিড় থেকে আলাদা হতে চাই না ! আমি ভিড়ের মধ্যেই থাকতে চাই | আর গানটা আসলে আমার খুব নিজের | সেটা কাউকে শুনতেই হবে এরকম কোনো ব্যাপার নেই | সেদিন কলেজের ফাউন্ডেশন ডে তে ও , আমি নিজে নাম দিইনি | অর্না দিয়েছিলো আমার হয়ে | ও খুব চাইছিলো আমি গান গাই | আগেরদিন রিহার্সেলেও আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো | ”

কথাগুলো শেষ হতেই তারপর ও খেয়াল করেছিল বাসটা রাসবিহারীর আগের স্টপেজ ক্রস করে গেছে | তাই সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল আনমনে ,

————– ” আমাদের মনে হয় ওঠা উচিত | চলে আসবে এরপর রাসবিহারী |”

কথাটা বলেই পরিণীতা উঠে দাঁড়িয়েছিল এরপর | কিন্তু অনির্বাণ এক দু সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে গেছিলো যেন | আসলে খুব অদ্ভুত লাগছিলো ওর পরিণীতাকে হঠাৎ | আজকালকার দিনে কে এইভাবে বলে যে সে ভিড় এর মধ্যে থাকতে চায় ! সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবাই তো শুধু এটেনশন পেতে চায় | লোকের নজরে আসতে চায় | আর সেখানে পরিণীতা এতটা অন্য রকম কি করে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই সেদিন বাস থেকে নেমেছিল ও | তারপর পরিণীতা ওর দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলেছিলো , ———- ” আসছি | আপনি ! মানে সরি ! তুমি, সাবধানে যেও |”

কথাটা শুনে অনির্বাণ এবার হেসে ফেলেছিলো নিজে | তারপর অল্প কথায় বলে উঠেছিল , ———– ” হ্যাঁ , তুমিও | কলেজে দেখা হবে | আর থ্যাংকস , তুমি করে বলার জন্য |”

পরিণীতা এই শেষ কথাটার আর কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি ঠিক | তাই আলতো হেসেই নিজের বাড়ির রাস্তায় পা বাড়িয়েছিল | তবে অনির্বাণ এই প্রথম কারোর চলে যাওয়াটা দেখেছিলো শেষ পর্যন্ত | গোধূলি বিকেল ছিল তখন চারিদিকে | অদ্ভুত একটা লালচে রঙের শহর মুড়িয়ে ছিল ওকে ঘিরে | তার মধ্যে এই প্রথম কারোর চলে যাওয়াতে ও স্থির হয়ে গেলো | মনে মনে আপনাআপনিই হেসে ফেললো ! পরিণীতার আপনি থেকে তুমি বলার চেষ্টার কথাটা কেন জানে না একটা নতুন ভালো লাগা নিয়ে এলো অনির্বাণের মনে | যেই ভালো লাগাটা একদম অচেনা | খুব নিজের |

<৮>

এই অচেনা ভালো লাগার বিকেলটা পেরিয়ে এরপর কটা দিন কেটে গেছে কলকাতায় | এর মাঝে অনির্বাণ নিজের অজান্তেই কলেজের ক্যান্টিনে , তো কখনো ফাঁকা করিডোরে , অথবা বাস স্ট্যান্ডের ভিড়ে , পরিণীতাকে আনমনে খুঁজেছে মাঝে মাঝে | আসলে ঠিক প্ল্যান করে দেখা করবে মেয়েটার সঙ্গে , এটা ঠিক ওর মনে হয়নি কখনো | তবে ক্লাস করতে করতে , কখনো লাইব্রেরীতে বসে বই এর পাতা ওল্টানোর সময় , অথবা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে দুটো কেমিক্যালের রিয়াক্সন দেখার সময় , অনির্বাণের অকারণে মনে হয়েছে পরিণীতাকে | মনে হয়েছে , এরপর কলেজ শেষে বাইরে বেরিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে , যদি আরেকবার পরিণীতার সঙ্গে দেখা হয় , তাহলে মন্দ হবে না ! ওই আস্তে কথা , আলতো হাসি , নিজের মনে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেখে অনির্বাণ খুশিই হয়ে যাবে মনে মনে |

তবে এরপর এক সপ্তাহ কাটিয়ে শেষে কলেজের ক্যান্টিনে দেখা হয়েই গেছিলো অনির্বাণের পরিণীতার সঙ্গে , একদম হঠাৎ করে | পরিণীতা যদিও খেয়াল করেনি ! ও এক মন দিয়ে কিছু খাতা চেক করছিলো স্টুডেন্টসদের | তখনই আচমকা অনির্বাণ ওর কাছে এসে বলে উঠেছিল , ————- ” হাই , কি খবর ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে চোখ তুলতেই খেয়াল করেছিল কলেজের সার্বজনীন ক্রাশ ওর দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে | পরিণীতা এই মুহূর্তে না চাইতেও নোটিশ করেছিল অনির্বাণের শান্ত চোখ দুটো | চশমার আড়ালে থাকা এই চোখ দুটো আগেও ওর নজর কেড়েছে ! অজান্তে মনে দাগ কেটেছে | কথাটা ভাবতেই নিজেকে সামলে নিলো পরিণীতা | তারপর একটু সাজিয়ে বললো , ———– ” এই তো ক্লাস করে এলাম | তোমার কখন ক্লাস ? ”

এর উত্তরে অনির্বাণ ওর উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসে বললো , ———— ” এখন দুটো অফ | তারপর আছে একটা ক্লাস | কিন্তু তুমি এটা কি করছো ? কিসের খাতা এগুলো ?”

কথাটা বলতে বলতেই ও আনমনে একটা খাতা তুলে নিয়েছিল নিজের হাতে | তারপর বেশ অবাক হয়ে বলেছিলো , ————- ” এইগুলো তো বাচ্চাদের অংক খাতা ! এগুলো তুমি চেক করছো !”

এর উত্তরে পরিণীতা একটু আস্তে গলায় বলে উঠলো ———– ” আসলে আমি টিউশন পড়াই | এগুলো আমার স্টুডেন্টসদের খাতা | ”

কথাটা শুনে অনির্বাণ এক সেকেন্ড চুপ করে কিছুটা ভেবে বললো , ———- ” এতো পড়াশোনার চাপে টিউশন পড়ানোর টাইম পাও ? মানে এমনিই অনার্সের এতো চাপ , তারপর !”

এর উত্তরে পরিণীতা আলতো গলায় বলে উঠলো , ———- ” আমার বাবা নেই | ক্লাস ইলেভেনে যখন পড়তাম , মারা গেছে | তারপর আমরা কলকাতায় মামার বাড়িতে এসে থাকি | মানে আমি আর মা | মামা আমাদের খাওয়ার খরচাটা দিলেও পড়াশোনার জন্য আলাদা করে কখনো কিছু দেয় না | তাই আমি ক্লাস টুয়েলভ থেকেই টিউশন পড়াই | এতে যা ইনকাম হয় , তাতে আমার বই খাতা , টিউশনের টাকা উঠে যায় |”

কথাগুলো বলে কয়েক মুহূর্ত যেন একটু স্থির হয়ে গিয়েছিলো পরিণীতা নিজের খেয়ালে | অনির্বাণ খেয়াল করেছিল ওর মুখটা এক পলকে অন্ধকার হয়ে গেছে অল্প | তবে এটাও বুঝেছিলো পরের মুহূর্তে নিজের অন্ধকারটাকে ঢাকার জন্য পরিণীতা একটা মিথ্যে ভদ্রতার হাসি হেসে আবার খাতার দিকে চোখ দিয়েছিলো | তবে অনির্বাণ যেন এরপরও ঠিক পরিণীতার থেকে চোখ সরাতে পারছিলো না নিজের | আসলে পরিণীতার কথা বার্তা , সাজ পোশাক , কিছুতেই কোনো নজর কারবার মতন কিছু নেই ! সবার মাঝে ও সত্যি খুব সাধারণ , চুপ করে থাকা মেয়ে , যে কেউ না জিজ্ঞেস করলে কখনো কারোর সঙ্গে কথা বাড়াতে যায় না ! নিজের কথা বলতে যায় না | তবে এতটা সাধারণ বলেই হয়তো অনির্বাণের খুব আলাদা লাগছে পরিণীতাকে ! এতো মেকিনেসের পৃথিবীতে সহজ লাগছে ওকে | ওর সাধারণ হয়াটাকেই খুব অসাধারণ বলে মনে হচ্ছে অনির্বাণের ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই অনির্বাণ হঠাৎ পরিণীতার কাছ থেকে তিনটে খাতা নিয়ে নিলো নিজে | পরিণীতা ঠিক কি হলো বুঝতে না পেরে প্রশ্ন চোখে তাকালো তাই ওর দিকে ! তখন অনির্বাণ অল্প হেসে বললো ,

———— ” এ কটা খাতা আমি চেক করে দিচ্ছি | তুমি বাকিগুলো করো | তাড়াতাড়ি হবে | আর ডোন্ট ওরি .. আমি পড়াশোনায় ভালোই | ভুল কিছু চেক করবো না |”

কথাটা বলেই পরিণীতার ‘না’ এর অপেক্ষা না করেই অনির্বাণ খাতা করেকশনে মন দিলো | পরিণীতাও ঠিক আপত্তি করে উঠতে পারলো না যেন অনির্বাণকে | একে তো কলেজের সিনিয়র , তার ওপরে অদ্ভুত পার্সোনালিটি , তাই মুখের ওপর ঠিক কিছুই বলা যায় না ! তবে একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছিলো একটু পরিণীতা যদিও | শুনেছে অনির্বাণ না কি ইন্ট্রোভার্ট | নিজের ব্যাচেই খুব কম বন্ধু ওর | সেখানে পরিণীতা তো ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট ! অনির্বাণ কেন তারপরেও ওর সঙ্গে এতটা সহজভাবে কথা বলতে আসে নিজে থেকে ! প্রশ্নটা কিরকম আনমনেই উঁকি দিলো পরিণীতার মনে | অবশ্য শুধু পরিণীতা না , ক্যান্টিনের দূরের টেবিলে বসা অনির্বাণের কিছু ব্যাচ মেট আর স্নেহাও ব্যাপারটা খেয়াল করলো সেদিন | সবাই বেশ সারপ্রাইজড ছিল পুরো দৃশ্যটা দেখে | আর অনির্বাণ যে ওদের কাউকে ক্যান্টিনে খেয়ালই করেনি এসে থেকে , শুধু এই মেয়েটার সঙ্গেই কথা বলে গেলো ! এই ঘটনাটাও খুব অদ্ভুত লাগলো প্রত্যেকের | একজন তো বলেই ফেললো সবটা দেখে সোজাসুজি , ———— ” বাবা ! অনির্বাণকে এতটা কারোর সঙ্গে ইনভল্ব হতে দেখিনি তো আগে ! কি হলো হঠাৎ ছেলেটার ! প্রেমে টেমে পড়লো না কি !”

কথাটা শুনে স্নেহা যেন জ্বলে গেলো ভেতরে | ও গলাটাকে খুব কঠিন করেই বললো এবার , ————- ” থামবি তুই | অনির্বাণ এরকম লো স্ট্যান্ডার্ডের কারোর সঙ্গেই ইনভল্ব হবে না কখনো | শুধুমাত্র আমার মতন মেয়েকেই ওর সঙ্গে মানায় | কারণ আমাদের স্ট্যাটাস ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড , সবটাই সেম | আর অনির্বাণও এই কথাটা খুব ভালো করেই জানে |”

শেষ কথাগুলো ও যেন বেশ জোর দিয়ে বলে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করলো | মনে এই মুহূর্তে রাগের সাথে যন্ত্রণাটাও চেপে ধরেছে ওকে | অনির্বাণকে সেই স্কুল লাইফ থেকে পছন্দ স্নেহার | আর অনির্বাণ নিজে থেকে ওর কাছে আসে না বলেই হয়তো কখন এই ভালো লাগাটা একটা জেদ হয়ে গেছে স্নেহার , ও বোঝেনি ! তবে আজ অনির্বাণকে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে বসে থাকতে দেখে স্নেহা বুঝতে পারলো , ভালো লাগার মধ্যেও একটা জ্বালা আছে ! একটা বিষ আছে কেমন | যেটা হয়তো বেশিদিন স্নেহা নিজের মধ্যে রাখবে না ! অনির্বাণ যদি সহজভাবে ওর না হয় , তাহলে হয়তো এই বিষটাকেই ও ছড়িয়ে দেবে চারিদিকে | শেষ করে দেবে সব কিছু | কথাটা আজ না চাইতেও মনে হলো স্নেহার , আর চোখটা হঠাৎ কড়কড় করে জ্বলে উঠলো যেন ,দু ফোঁটা জল এসে জমলো সেখানে |

<৯>

তবে এরপর মাঝে মাঝেই কলেজে কখনো করিডোরে , কখনো ক্যান্টিনে , অথবা কখনো এমনি রাস্তায় , দেখা হয়েই যেত অনির্বাণের সাথে পরিণীতার | টুকটাক কথাও হতো মাঝেমধ্যে | খুচরো আলাপ জমতো দুজনের | এই যেমন সেদিন ছিল আগস্টের শেষ সপ্তাহ | শহর জুড়ে বৃষ্টি , আর কালো মেঘ | সব সময় আকাশের মুখ অন্ধকার | তার মধ্যেই অনির্বাণ নিজের ছাতাটা বাসের মধ্যে হারিয়ে এসেছিলো একদম | আসলে আসার সময় এতো তাড়া ছিল ! এমনিতেই উঠতে দেরি হয়ে গেছিলো ঘুম থেকে | তাই মনের ভুলে ছাতাটা বাসের সিটে ফেলেই নেমে পড়েছিল কলেজের গেটে | আর মনে পড়লো যখন , তখন বাসটা কলেজ ছাড়িয়ে অনেক দূর রাস্তায় হারিয়ে গেছে | তাই পুরোই কেস হয়ে গেছিলো ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর | আবার পাঁচটা থেকে ব্যাচে পড়তে যাওয়া আছে ওর | তাই আর বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করার উপায় ছিল না ওর | ভিজতে ভিজতেই বাস স্টপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ও | কিন্তু সেদিন বেশিক্ষণ এইভাবে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হয়নি ওকে ! হঠাৎ একটা ছাতা সমেত পরিণীতা এসে হাজির হয়েছিল কাছে | অনির্বাণ তো এরকম হঠাৎ পরিণীতা দর্শনে একটু অবাকই হয়েছিল কয়েক সেকেন্ড | তখন পরিণীতা বলে উঠেছিল ওর ঘোর কাটিয়ে ,

———— ” কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লে কেন ? চলো ! ”

কথাটা শুনে অনির্বাণের যেন সম্ভিত ফিরেছিল | তবে তার মধ্যেই ও খেয়াল করেছিল বৃষ্টির ছাঁট লেগে পরিণীতার কপালে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে | তার মধ্যে ওর বড়ো বড়ো চোখ দুটো খুব গভীর লাগলো যেন | একদম আকাশের জমা মেঘেদের মতন |

যাইহোক , এরপর ওরা বৃষ্টির ছাঁট মেখে বাস স্টপে এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিন | কিন্তু বাসের অপেক্ষা করতে হয়নি বেশিক্ষণ | তবে বাসে উঠে দু মিনিট বসতে না বসতেই পরিণীতা খেয়াল করেছিল অনির্বাণ নাক টানছে | চোখগুলো লাল হয়ে এসেছে ওর | দু একবার হাঁচ্ছো হাঁচ্ছো ও করলো ছেলেটা ! পরিণীতা তো এইসব দেখে জিজ্ঞাসা করেই উঠলো ,

———— ” কি হয়েছে তোমার ? এমন কিছু তো বৃষ্টিতে ভেজোনি ! তাতেই সর্দি হয়ে গেলো ?”

কথাটায় অনির্বাণ নাক টানতে টানতেই অল্প হেসে বললো , ———- ” এটা আমার ছোটবেলা থেকেই | বৃষ্টির জল একটু গায়ে লাগলেই এরকম হবে | সর্দি কাশি ! নর্মাল এটা আমার !”

কথাটা বলে অনির্বাণ খেয়াল করলো পরিণীতা যেন অল্প কিছু চিন্তা করলো এইসবের পর | তবে এর মধ্যে ওদের স্টপেজ আসতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি | তখনই পরিণীতা নিজের ছাতাটা অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো , ———— ” এই নাও | তুমি রাখো ছাতাটা | আর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ব্যাচে যেতে হবে না | তাহলে আরো শরীর খারাপ করবে |”

অনির্বাণ তো কথাটা শুনে না না করে উঠলো | ছাতাটা আবার ওকে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বললো , ——— ” এ বাবা ! না না | দরকার নেই আমার ছাতার | আর আমাকে ছাতা দিলে তুমি নিজে তো ভিজে ভিজে বাড়ি যাবে ! তুমি রাখো ছাতাটা |”

এই কথায় পরিণীতা আবার অনির্বাণের হাতেই ছাতাটা ধরিয়ে ওকে আশ্বস্ত করে বললো যেন , ————- ” আমার বাড়ি কাছেই | আমি ওড়না মাথায় দিয়ে চলে যাবো | কোনো প্রব্লেম হবে না | কিন্তু তুমি আর বৃষ্টিতে ভিজো না |”

কথাটা বলেই ও অনির্বাণকে কিছু বলার আর সুযোগ না দিয়েই উঠে দাঁড়ালো , কারণ ততক্ষণে রাসবিহারী চলে এসেছে | অনির্বাণও তাই উঠলো এবার | তারপর রাস্তায় নেমেই পরিণীতা নিজের মাথায় ওড়নাটা জড়িয়ে আলতো হেসে বললো , ———– ” আসলাম | আর বাড়ি গিয়ে ওষুধ খেয়ে নিও | তাহলে আর জ্বর হবে না |”

কথাটা বলেই অনির্বাণকে কোনো উত্তরের সময় না দিয়ে পরিণীতা এই বৃষ্টি ভেজা শহরে কেমন আবছা হয়ে গেলো চোখের পলকে | তবে ওর ফুল প্রিন্টের গোলাপি ছাতাটা রয়ে গেলো অনির্বাণের কাছে এই মুহূর্তে | অনির্বাণ তবে থমকে গেলো যেন কিছুক্ষণ | পরিণীতা সামনে না থাকলেও ওর আলতো হাসি , হালকা বৃষ্টি ভেজা এক টুকরো কপাল , ওড়না জড়ানো মিষ্টি মুখটাস্পষ্ট দেখতে পেলো ও হঠাৎ , সাদা হয়ে যাওয়া , বৃষ্টিতে আবছা হয়ে যাওয়া কলকাতায় |

#ভালোবাসার_শহরে ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১০>

সেদিনের পর রবিবার কাটিয়ে সোমবার যেদিন কলেজ খুলেছিলো , অনির্বাণ ক্লাসের মাঝখানে এসে হাজির হয়েছিল পরিণীতার ডিপার্টমেন্টের সামনে | পরিণীতাদের যদিও তখনও ক্লাস চলছিল | তাই অনির্বাণ গোলাপি ছাতা হাতে অপেক্ষা করছিলো করিডোরে | তবে জানে না কেন , একটা অদ্ভুত ভালো লাগা এসে জমছিল ওর মনে এখন | মনে হচ্ছিলো সেদিন ছাতাটা নিয়ে ভালোই হয়েছে | তাই তো আজ ফেরত দিতে আসতে পারলো ! আরেকবার দেখা হয়ে যাবে এর জন্য পরিণীতার সঙ্গে | তবে কথাটা মনে আসতেই অদ্ভুত লাগছে খুব নিজেকে নিয়ে ওর ! আসলে স্কুল লাইফ থেকে এই এম.এস.সি পড়া অব্দি , কম প্রপোজাল পায়নি অনির্বাণ জীবনে ! কিন্তু কোনো মেয়েকেই কখনো আলাদা করে ভালো লাগেনি ঠিক | বন্ধুর থেকে বেশি কিছু মনে হয়নি কখনো | তবে এই প্রথম কাউকে আলাদা করে দেখতে ইচ্ছে করছে , সে না থাকলেও তার ছবি ভাসছে চোখে , নিজে থেকে কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে মেয়েটার সঙ্গে ! এই পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ নতুন অনির্বাণের কাছে | কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও খেয়াল করলো ক্লাস শেষ হয়ে গেছে | আর ক্লাসরুম থেকে ম্যাম বেরোনোর পর বেশ কয়েকজন মেয়েকে পার করে পরিণীতা বেড়োলো শেষে | সাদা চুড়িদার পড়েছে আজ ও | চুলটা আলগা করে বিনুনি বাঁধা | চোখে অল্প কাজল | আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ্ | অনির্বাণ যেন না চাইতেও খেয়াল করলো সবটা | তবে পরিণীতা এই মুহূর্তে ওকে দেখে নিজেই এগিয়ে এলো আজ | সঙ্গে ওর ওই বন্ধুটাও আছে | কি যেন নাম মেয়েটার ! অর্না |কথাটা ভাবতেই পরিণীতা অনির্বাণের কাছে এসে বলে উঠলো , ———– ” কেমন আছো ? শরীর ঠিক আছে তো ?”

প্রশ্নটা শুনে অনির্বাণ অল্প হেসে বললো , ————- ” ভুল কি করে থাকবে ! ছাতাটা সঙ্গে ছিল যে |”

পরিণীতা এই উত্তরে আলতো হাসলেও খেয়াল করলো অর্নার চোখ দুটো এখন বেশ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে বিস্ময়ে | ও যেন অনেক প্রশ্ন নিয়ে পরিণীতার দিকে তাকিয়ে | তবে এই সময়ই অনির্বাণ আবার বলে উঠলো , ————– ” তোমার ছাতাটাই ফেরত দিতে এসেছিলাম | আর থ্যাঙ্ক ইউ .. সেদিন আরো বৃষ্টিতে ভিজলে সত্যি জ্বর হয়ে যেত |”

এই কথায় পরিণীতা ছাতাটা নিয়ে বলে উঠলো , ————- ” একটা ছাতাই তো দিয়েছিলাম , থ্যাঙ্ক ইউ বলার দরকার নেই |”

অনির্বাণ এটা শুনে এক সেকেন্ড চুপ করে অন্য একটা প্রশ্ন করে উঠলো ওকে একটু নরম গলায় , ———– ” ক্লাস নেই আর ? শেষ আজ সব ?”

পরিণীতা এর উত্তরে সঙ্গে সঙ্গেই বললো , ———– ” হ্যাঁ শেষ | তোমার ?”

অনির্বাণ এই কথায় বললো , ————– ” আমার আছে এখনো | চারটের পর শেষ |”

পরিণীতা এবার আর কথা না বাড়িয়ে তাই বলে উঠলো , ——— ” ওহ আচ্ছা | ঠিক আছে , আসি তাহলে | পরে দেখা হবে |”

কথাটা শুনে অনির্বাণ ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড থমকে তাকিয়ে শুধু একটা শব্দেই বললো , —— ” এস |”

পরিণীতা এরপর হালকা হেসে করিডোরের উল্টো দিকে পা বাড়ালো | কিন্তু অনির্বাণ জানে না কেন , সেই আগেরদিনের মতোই পরিণীতার চলে যাওয়াটার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো যেন ! এগোতেই পারলো না কিছুতে , নিজের রাস্তায় | তবে পরিণীতাও আজ একবার চেনা করিডোরে পেছন ফিরে তাকিয়েছিলো আনমনে | অনির্বাণকে দেখার জন্যই হয়তো ! তবে দুজনের আরেকবার চোখাচোখি হতেই পরিণীতার চারিদিকটা স্তব্ধ হয়ে গেলো এক মুহূর্তে | অনির্বাণ স্থিরভাবে ওর দিকেই তাকিয়ে এখন , এটা দেখে পরিণীতার মনে কিছু ভালো লাগা খারাপ লাগা মিশে গেলো আজ | মনে হলো এই থমকে থাকা দৃষ্টিটা ওর জন্য হলেও এই ছেলেটা ওর নয় | দুজনের মধ্যে সাধারণ অসাধারণ এতো বড়ো দেয়াল , যে সেটা ভেদ করে পরিণীতা কখনোই অনির্বাণের কাছে যেতে পারবে না | কথাটা ভেবেই পরিণীতা মনটাকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের | অনির্বাণের বিপরীতে চলা রাস্তাটায়ই এগিয়ে গেলো ও |

<১১>

কিন্তু সেদিন অর্না আর নিজেকে সামলাতে পারেনি | বাসে উঠেই ও পরিণীতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রায় প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে | বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেছিলো ,

————- ” কি চলছে রে তোদের ? আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ! আমাকেই বলিস না কিছু ! এটা কি ঠিক ?”

কথাগুলো শুনে পরিণীতা বেশ অবাক হয়েই বলেছিলো , ———– ” কাদের কি চলছে ! কি বলিনি তোকে আমি ?”

অর্না এটা শুনে আরো উত্তেজিত হয়ে বলেছিলো , ———— ” কাদের মানে ! তোর আর অনির্বাণদার | ভাবা যায় ! ক্লাসের বাইরে পুরো কলেজের ক্রাশ অপেক্ষা করছে তোর জন্য ! সবাই তো পুরো হাঁ হয়ে গেছিলো আজ ! অনির্বাণদার ব্যাপারে শুনেছি বেশ সিরিয়াস টাইপের ছেলে না কি ! কত মেয়ে লাইন দেয় | কিন্তু অনির্বাণদা নিজের পড়াশোনা কাজ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না ! আমি তো শুনেছি ওদের ব্যাচের স্নেহা , বিশাল বিজনেসম্যানের মেয়ে , সে ও অনির্বাণদাকে ভীষণ লাইক করে | অনির্বাণদা তাকেও এড়িয়ে এড়িয়ে যায় | সে কি না তোর সাথে যেচে যেচে কথা বলতে আসে ! সেদিন গানের চান্সটাও করে দিলো তোর | আর এতকিছুর পর বলছিস কিছু চলছে না তোদের ? আর এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে !”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অর্না | পরিণীতা এর উত্তরে মাথায় হাত দিয়ে বললো , ————– ” সত্যি ! তুই পারিসও | সারাদিন রোম্যান্টিক সিনেমা দেখে দেখে , রোম্যান্টিক গল্পের বই পড়ে পড়ে এই হাল | সব জায়গায় প্রেম খুঁজিস | “, কথাগুলো বলে দু সেকেন্ড থেমে নিজেকে আর একটু গুছিয়ে নিয়ে পরিণীতা আবার বলে উঠলো ,

———— ” কিছু নেই আমার সঙ্গে অনির্বাণদার | আর ভাবলি কি করে কিছু হতে পারে ! আমার ফ্যামিলির কন্ডিশন তো তুই জানিস | আর অনির্বাণদার বাবার যে কত বড়ো বিজনেস , এটাও নিশ্চই শুনেছিস | এরপরও এইসব মাথায় আসে তোর ! আর কারোর সাথে দুটো কথা বললেই কি তার সাথে প্রেম হয়ে যায় ! অনির্বাণদার সেদিন আমার গান শুনে ভালো লেগেছিলো , তাই হয়তো দেখা হলে কথা বলে | যেরকম রাস্তায় ঘাটে আমরা চেনা মুখ দেখলে কথা বলি ! ব্যাস | আর আমি একটা জিনিস বুঝেছি , অতো বড়োলোক বাড়ির ছেলে হলেও কোনো অহংকার নেই ওর | সহজভাবে কথা বলে তাই | ”

কথাগুলো বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে গেলো পরিণীতা | কিন্তু অর্না এবার জোর হেসে ফেললো ওর সামনে | তারপর বেশ সুর করেই বললো ,

——— ” বাবা ! সুনাম করতেও শুরু করে দিয়েছিস ! আচ্ছা , তোর সব কথা মানলাম | তোর আর অনির্বাণদার মধ্যে কিচ্ছু নেই | আর কিছু হবেও না কখনো | কিন্তু একটা কথা সত্যি করে বল তো ? তুই পছন্দ করিস না অনির্বাণদাকে ? ভালো লাগে না তোর ওকে দেখলে ! ও কথা বলতে এলে ? একটুও স্পেশ্যাল ফিল হয় না ?”

শেষ প্রশ্নগুলো ওর চোখে চোখ রেখেই করলো অর্না | কিন্তু পরিণীতা এর ঠিক কোনো উত্তর দিতে পারলো না যেন | এতো প্রশ্নের কোনো মিথ্যে উত্তর হয় না আসলে | আর সত্যিটাও বলার নেই ঠিক ওর | বলার নেই যে অনির্বাণকে ওর প্রথম দিন থেকেই ভীষণ আলাদা লাগে ! থমকে থাকে ও যখন অনির্বাণ ওর কাছে আসে | ভালো লাগে যখন কথা বলে | কারণ এতো সত্যি যদি বলে তাহলে নিজের আড়ালটাই ভেঙে যাবে ! জোর করে নিজের মনকে বুঝিয়ে যেই দূরত্বটা বজায় রাখে ও ছেলেটার সঙ্গে , সেই দূরত্বটাও হয়তো কমে যাবে | তাই এইসবের কোনো উত্তর না দিয়েই পরিণীতা উঠে দাঁড়ালো | তারপর অর্নাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলে উঠলো , ———– ” আমি আজ রাসবিহারীর আগেই নামবো রে | কিছু কাজ আছে আমার | হঠাৎ মনে পড়লো | পরে কলেজে দেখা হবে |”

কথাটা বলেই ও অর্নাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নেমে পড়লো হঠাৎ বাস থেকে , অচেনা মুখের ভিড়ে ঠাসা একটা রাস্তায় |
তবে সেদিনের পর কয়েকটা দিন পার করে ছিল 5th সেপ্টেম্বর , টিচার্স ডে | আজ কলেজে একদম সাজো সাজো ব্যাপার প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টেই | সব রুম থেকেই গান নাচ আবৃত্তি এইসবের আওয়াজ আসছে যেন | সব ডিপার্টমেন্টে চলছে অনুষ্ঠান | এর ফাঁকেই পরিণীতা এসেছিলো ক্যান্টিনে | ওদের ডিপার্টমেন্টের ফাংশনের জন্য প্রফেসররা খাওয়াচ্ছে | তাই অর্ডার দিয়েছে কিছু খাবারের | সেটা রুমে নিয়ে যাওয়ার দ্বায়িত্বই পড়েছে পরিণীতার ওপর | এর আগে একটা গানও গেয়ে এসেছে ফাংশনে | তবে এইসব ছাড়াও পরিণীতার মনটা আজ বেশ খুশি | কারণ আজ ওর স্টুডেন্টসরা মিলেও সকালে বাড়িতে এসে ওকে উইশ করেছে , গিফ্ট দিয়েছে | সব ওই ক্লাস টু থ্রি এর ছোট ছোট স্টুডেন্টস | কিন্তু ওরা সাধ্য মতন চেষ্টা করেছে পরিণীতাকে খুশি করার | ওর দিনটাকে স্পেশ্যাল বানিয়ে দেয়ার | এটা ভেবেই বেশ ভালো লাগছিলো আজ সারাদিন ওর | তবে এইসব কথা কলেজে কাউকে বলেনি ! সবাই শুনলে হয়তো হাসবে | ছোট ছোট বাচ্চাদের টিউশন পড়ানোটাকে এখন কেউ অতো ইম্পর্টেন্ট কাজ ভাবে না ! তাই ওকেও টিচার হিসেবে কনসিডার করার কথা কেউ ভাববেও না হয়তো | এইসবই ভাবছিলো মনে মনে , তখনই হঠাৎ সেই চেনা গলার আওয়াজে ঘোরটা কাটলো |———- ” হ্যাপি টিচার্স ডে ..”

অনির্বাণ বিনা নোটিশে পরিণীতার সামনে এসে বলে উঠলো কথাটা | পরিণীতা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো যেন | আসলে এক সপ্তাহ পর দেখা হলো অনির্বাণের সাথে | যাইহোক , কথাটা শুনে ও কিন্তু একটু অবাক হয়েই বললো , ———— ” আমাকে হ্যাপি টিচার্স ডে ! কেন ?”

এর উত্তরে অনির্বাণ ওর সামনে চেয়ারটায় বসে অল্প হেসে বললো , ———– ” কারণ তুমিও তো অনেক টিউশন পড়াও | ছোট ছোট বাচ্চাদের | তাই তোমাকেও হ্যাপি টিচার্স ডে |”

কথাটায় পরিণীতা যেন স্থির হয়ে গেলো একটু | কিছুক্ষণের জন্য নিস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো অনির্বাণের দিকে | এভাবেও কেউ ভাবে ! এতো সহজভাবে কেউ কাউকে গুরুত্ব দিতে পারে , তার কাজের ইম্পর্টেন্সটা বুঝিয়ে দিতে পারে ! ভাবেনি আসলে | তবে এর মধ্যেই অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে উঠলো ,

————— ” টিচার্স ডে তে উইশ করেনি স্টুডেন্টসরা তোমাকে ? কার্ড দেয়নি ?”

পরিণীতা এই প্রশ্নে আপনাআপনি হেসে ফেললো আনন্দে | তারপর বেশ উৎসাহ নিয়েই এই প্রথম বললো নিজে থেকে ,

————— ” হ্যাঁ দিয়েছে তো , সকাল সকাল এসে সবাই কত উইশ করলো ! নিজেদের হাতে বানানো কার্ড , ছবি এইসব গিফ্ট করেছে | দাঁড়াও , আমার ব্যাগেই আছে , দেখাচ্ছি তোমাকে |”

কথাটা বলেই ও ব্যাগ থেকে কতগুলো কার্ড , ছবি , পেন এইসব বার করে অনির্বাণের সামনে রাখলো | অনির্বাণ খেয়াল করলো পরিণীতার মুখের খুশিটা | কোনো দামি গিফ্ট না ! কোনো বড়োদের জিনিসও না ! এলোমেলো হাতে আঁকা কিছু ছবি , কিছু লেখা , সামান্য কয়েকটা পেন , এইসব পেয়েই পরিণীতা কি খুশি ! অনির্বাণের ব্যাপারটা দেখে আবার খুব অন্যরকম লাগলো মেয়েটাকে | মনে হলো শুধু ভালোবাসার দাম আজকাল কজন দিতে পারে ! সবাই তো আজকাল হিসেব করে খুশি হয় | দামি জিনিস , এক্সপেনসিভ গিফ্ট , এইসবের মধ্যেই তো লোকজন হারিয়ে যায় | কিন্তু পরিণীতা সেরকম না | ও বেহিসাবভাবে খুশি হতে জানে | সাধারণ কিছুর মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে পারে মেয়েটা | কথাটা ভেবেই অনির্বাণ বলে উঠলো ,

————– ” খুব মিষ্টি গিফ্ট গুলো তোমার | অনেকগুলো এতো কলরফুল ! খুব ভালো হয়েছে |”

পরিণীতা কথাটা শুনে হেসে উঠলো নিজের মনে | তখনই পাশ থেকে ক্যান্টিনের একজন লোক এসে বললো , ————- ” তোমার খাবারের প্যাকেটগুলো রেডি হয়ে গেছে | এসে নিয়ে যাও |”

না , এরপর আর পরিণীতা বসেনি সেদিন অনির্বাণের সামনে | তাড়াহুড়ো করে কার্ড ছবিগুলো নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে বলেছিলো , ———— ” আসি আজ | ডিপার্টমেন্টে টিচার্স ডের জন্য কিছু খাবার অর্ডার দেয়া আছে | সেগুলোই নিয়ে যেতে হবে |”

কথাটা শেষ করেই ও তারপর খাবারগুলো সমেত বেরিয়ে গিয়েছিলো ক্যান্টিন থেকে | তবে এইসব কিছুই আজ একজন একটু দূরে বসে দেখছিলো চুপচাপ | কিন্তু আজ সে আর চুপ করে বসে থাকতে পারলো না | স্নেহা পরিণীতা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনির্বাণের কাছে এসে হাজির হলো | ভেতরটা রাগে জ্বলে যাচ্ছিলো ওর এই মুহূর্তে | একই ক্যান্টিনে বসে থেকেও অনির্বাণ ওকে নোটিশই করলো না এতক্ষণ ! কথাটা ভেবেই স্নেহা বলে উঠলো , ———- ” নতুন বন্ধু হয়েছে এই মেয়েটা ? দেখি মাঝে মাঝে কথা বলতে ! ”

অনির্বাণ এরকম অকারণ প্রশ্ন ঠিক আশা করেনি এই মুহূর্তে | বুঝলো না ও কার সাথে বন্ধুত্ব করবে না করবে না সেই নিয়ে স্নেহার এতো কৌতূহল কিসের ! তাই অল্প কথায়ই বলে উঠলো ,

————— ” হ্যাঁ , বন্ধু আমার |”

তবে এরপরও স্নেহা থামলো না , আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো , ———— ” কি নাম মেয়েটার ? আমি যত দূর জানি ফার্স্ট ইয়ার |”

অনির্বাণের এবার একটু বিরক্তই লাগলো | তাও উত্তর দেয়ার ইচ্ছা না থাকলেও বললো শুধু , ——— ” পরিণীতা |”

না , স্নেহা এবার নিজের রাগটাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না যেন | গলাটাকে বেশ তীক্ষ্ণ করেই বলে উঠলো ও , ———- ” বুঝলাম | তবে একটা কথা ! মেয়েটা তোমার স্ট্যান্ডার্ডের নয় | তবে এইসব মেয়েরা ছেলেদের নিজের কাছে এট্র্যাক্ট করার জন্য অনেক কিছুই করতে পারে ! তাই একটু সাবধানে থেকো | ফেঁসে যেও না আবার কোনোভাবে | আফটার অল ক্লাসটা ম্যাটার করে !”

কথাগুলো একসঙ্গে বলে গেলো স্নেহা | তবে অনির্বাণও এইসব শুনে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে | হাত দুটো মুঠো হয়ে এসেছে ওর রাগে | তাই আর নিজেকে না সামলে চোয়াল শক্ত করে বললো ও , ————– ” শাট আপ … জাস্ট শাট আপ … পরিণীতার স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে কথা বলার আগে নিজের স্ট্যান্ডার্ড কি সেটা ভেবে দ্যাখো | শুধু বাবার অনেক পয়সা থাকলেই স্ট্যান্ডার্ড হাই হয়ে যায় না | চিন্তাধারাটাকেও একটু উঁচু রাখতে হয় | এতো ছোট মন নিয়ে সব কিছু দেখলে কোনোদিনও লাইফে এগোতে পারবে না | আর পরিণীতাকে নিয়ে কিছু বলার আগে নিজের এই ছোট মেন্টালিটিটাকে একটু চেঞ্জ করো | আর হ্যাঁ , এরপর আমার সঙ্গে যদি কথা বলতে আসো , তাহলে একটু ভেবে চিন্তে কথা বলবে | আর সেই সেন্সটা যদি কাজ না করে , তাহলে কথা বলবে না |”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অনির্বাণ ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে গেলো ক্যান্টিন থেকে চোখের পলকে | কিন্তু স্নেহা যেন অপমানে এগোতে পারলো না এক পা ও | অনির্বাণ যে ওর সঙ্গে এইভাবে কথা বলবে ! এই ভাবে মুখের ওপর ইনসাল্ট করে চলে যাবে , এটা আসলে ভাবতে পারেনি স্নেহা | তাই রাগে , জ্বালায় , যন্ত্রণায় টুকরো টুকরো হয়ে গেলো ও | চোখে জল এসে জমলো এখন | তবে এর মধ্যেই পরিণীতার ওপর খারাপ লাগাটা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেলো যেন আজ স্নেহার | মনে হলো যার জন্য আজ অনির্বাণের কাছে ওকে এতো কথা শুনতে হয়েছে , তাকে একটা উত্তর স্নেহা দেবেই | খুব তাড়াতাড়ি দেবে | পরিণীতাকে নিজের জায়গাটা বুঝিয়েই ও ছাড়বে | কথাটা আজ নিজের মনেই বলে উঠলো হঠাৎ |

<১২>

শরতের রং কি সুন্দর হয় না ! সোনালী রোদের রং | নীল মেঘের রং | হালকা সাদা তুলোর মতন কাশফুলের রং ! সবটা মিলিয়ে বছরের সেরা সময় লাগে পরিণীতার এই শরৎকালকে | মনে হয় এই দিনগুলোকে যদি ধরে রাখা যেত সারা বছর ! যদি এই শহরের চারিদিকের সাজ সাজ ভাব , মায়ের জন্য দিন গোণা , সবার হাসি মুখ , পুজো নিয়ে উৎসাহ , ভালো কিছু হওয়ার আশা , এই সব কিছুই যদি মাত্র এই একটা মাসের জন্য না থেকে সারা বছরের জন্য থাকতো ! তাহলে কি ভালোই না হতো ! ও ছোটবেলায় বাবাকে বলতো মাঝে মাঝে এই কথাগুলো ! এখনো মনে আছে ! এইসব শুনে কি হাসতো বাবা ! তারপর বলতো , ———– ” সারা বছর ধরে যদি শরৎকাল থাকে , তাহলে শরৎকালকে আর এতো ভালো লাগবে না কারোর ! কম সময়ের জন্য থাকে বলেই সবাই এই সময়টা পাওয়ার চেষ্টা করে | এতো অপেক্ষা করে | আসলে এটাই নিয়ম , সহজে পাওয়া জিনিস , সময় , মানুষ , কোনো কিছুরই দাম থাকে না বেশি | যার জন্য অপেক্ষা করতে হয় , সে-ই দামি হয় | বুঝলি |”

না , কথাগুলোর মানে সেদিন না বুঝলেও আজকাল বোঝে পরিণীতা একটু একটু | এই যেমন অনির্বাণ ! ও এতো দূরের বলেই হয়তো ওর হঠাৎ হঠাৎ কাছে আসাটা ভালো লাগে পরিণীতার | মনে হয় যদি সত্যি ওদের কোনো গল্প সম্ভব হতো ! যদি মাঝের এই দেয়ালটা না থাকতো ! যদি অনির্বাণ এতো বড়োলোক , এতো অধরা না হয়ে ওর মতন সাধারণ কেউ হতো ! তাহলে হয়তো জোর করে এইভাবে মনকে ঘুরিয়ে রাখতে হতো না | চাপা দিতে হতো না এই ফিলিংসগুলোকে | কিন্তু এইসব ভাবনার ভিড়ে আবার এটাও মনে হয় , যদি অনির্বাণ এতটা দূরের না হয়ে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে হতো , তাহলে কি এই টানটা থাকতো পরিণীতার ! তাহলে কি আলাদা করে অনির্বাণের জন্য মন কেমন করতো ! না কি বাবার কথা অনুযায়ী দাম কমে যেত ছেলেটার !

আজ এই শরতের নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করতে করতে পরিণীতার এইসবই মনে হচ্ছিলো কেমন | আজ চতুর্থী | কলেজের ছুটি পড়লো আজ | আবার এক মাস বাদে দেখা হবে এই ক্লাসরুমগুলোর সঙ্গে | তবে শুধুই কি ক্লাসরুম ! এক মাসের জন্য তো অনির্বাণও দূরে থাকবে ওর থেকে | ছেলেটার ওই হঠাৎ হঠাৎ কাছে আসা , টুকরো টুকরো কথা , কিছুই থাকবে না এই এক মাসে ! কথাটা ভেবে আনমনে একটা মন খারাপ এসে জমলো যেন মনে | কিন্তু তখনই পরিণীতাকে অবাক করে ওর সামনে অনির্বাণ এসে হাজির | ওর ডিপার্টমেন্টের সবাই যদিও আজ ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে | কিন্তু অনির্বাণ ইচ্ছে করেই যায়নি | ও জানতো পরিণীতার ক্লাস কটায় শেষ হবে আজ | তাই সময় মতন বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছে | কিন্তু পরিণীতা এরকম হঠাৎ অনির্বাণকে দেখে নিজের আনন্দটাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না কিছুতেই ! দুটো উজ্বল চোখ নিয়েই বললো ,

————— ” তুমি ! তোমার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে ? ”

কথাটা শুনে অনির্বাণ ওর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বললো , ———- ” না হয়নি | কিন্তু আমি আজ একটা ক্লাস না করেই বেরিয়ে এলাম |”

এটা শুনে পরিণীতা একটু প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন মুখ করেই বললো , ———– ” ওহ , কেন ?”

অনির্বাণ এই প্রশ্ন শুনে একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বললো , ————- ” আছে কারণ একজন ! আজ থাক , অন্য একদিন বলবো | কিন্তু তোমার সেই বন্ধুটা নেই আজ ? সে তো দেখি সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে !”

কথাটায় পরিণীতা একটু মুখটা অন্ধকার করেই বললো , ———— ” অর্না ! ও তো ওর মামারবাড়িতে | বর্ধমানে | পুরো পুজোটা ওখানে থাকবে | আমি যে কি করবো একা একা !”

এটার উত্তরে অনির্বাণ ওকে অন্য একটা প্রশ্ন করে উঠলো হঠাৎ , ———– ” কেন ? তুমি ঠাকুর দেখতে বেরোও না কোথাও ?”

পরিণীতা এর উত্তরটাও একটু ম্লান হয়ে দিলো | কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো , ———— ” বাবা যখন বেঁচে ছিল তখন ঘুরতাম অনেক | কিন্তু তারপর ! অর্না থাকলে তাও যাই টুকটাক এদিকওদিক | কিন্তু ও না থাকলে একা একা ভালো লাগে না | আর মা ও আসলে বাবা চলে যাওয়ার পর এই পুজোর দিনগুলোতে বেরোতে চায় না ঠিক !”

কথাগুলো নিজের মনেই বলে গেলো সেদিন পরিণীতা | কিন্তু খেয়াল করলো অনির্বাণও চুপ হয়ে গেছে হঠাৎ এইসব শুনে | আর তখনই বাসটাও চলে এলো | ওরা আর অপেক্ষা না করে বাসে উঠে বসলো | এখন রাস্তায় বেশ ভিড় | পুজোর মার্কেটিং নিয়ে সবাই ব্যস্ত | চলন্ত কলকাতাকে দেখতে দেখতে পরিণীতা এইসবই ভাবছিলো | তখনই অনির্বাণ বলে উঠলো ,

————- ” তুমি আমার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোবে ? এইবার পুজোতে ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে বেশ অবাক হয়ে অনির্বাণের দিকে তাকালো এখন | কি বলছে ছেলেটা হঠাৎ ! কিছুই যেন বুঝলো না ঠিক পরিণীতা | মানে হ্যাঁ, ওদের মধ্যে এতদিন টুকটাক কথা হয় ঠিকই | কিন্তু অনির্বাণ কখনো ওর ফোন নাম্বারটা অব্দি চায়নি ! সে আজ একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা বলছে !

কথাগুলো ভাবতেই অনির্বাণ আবার বলে উঠলো , ————— ” কি হলো ? কি ভাবছো ? যাবে ?”

পরিণীতা কথাটা শুনে নিজের মনেই বললো , ———— ” আমি ! ঠাকুর দেখতে ! তোমার সঙ্গে ?”

অনির্বাণ এই প্রশ্নটা শুনে একটু দৃঢ় গলায়ই বললো , ————– ” কেন ? যাওয়া যায় না ? প্রব্লেম আছে কোনো ?”

পরিণীতা এর উত্তরে কিছুটা ভদ্রতা করেই বললো , ———– ” না না ! প্রব্লেম কিসের ! কিন্তু মানে আমার সঙ্গে তুমি কেন ঠাকুর দেখবে ? তোমার তো অনেক সার্কেল আছে বন্ধুদের , বাড়ির লোকের | তাদের সঙ্গে দ্যাখো | আমার সাথে ঠাকুর দেখতে গেলে অতটা মজা হবে না |”

অনির্বাণ এবার যেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলো নিজে | তারপর আলতো হেসে বললো , ————– ” তোমার সঙ্গে ঠাকুর দেখলে আমার ভালো লাগবে কি লাগবে না , সেটা তুমি নিজে বুঝবে না কি ! সেটা তো যে তোমার সঙ্গে যাচ্ছে সে বুঝবে | যাইহোক , তাহলে ওই কথাই রইলো | কবে কখন যাবো সেটা ফোন এ কথা বলে ডিসাইড করে নেয়া যাবে | তুমি আমার নাম্বারটা নাও |”

কথাটা বলেই অনির্বাণ পরিণীতার ফোন এ নিজের নাম্বারটা সেভ করালো সঙ্গে সঙ্গে | তবে ততক্ষণে রাসবিহারী চলে এসেছে | তাই রাস্তা আর কথা , দুটোই আজ এখানেই শেষ হলো দুজনের | কিন্তু পরিণীতার বাড়িতে এসেও ঠিক ঘোরটা কাটলো না | হঠাৎ অনির্বাণ ওর সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা বললো কেন ! ফোন নাম্বারও এক্সচেঞ্জ করলো ! ওই মাপা দূরত্বটাকে আজ ভাঙতে চেষ্টা করলো কেন অনির্বাণ ! কি কারণে এইভাবে কাছে এলো হঠাৎ ! তবে এইসব চিন্তার মধ্যেও মনে একটা আনন্দ না চাইতেও এসে জড়ো হচ্ছিলো ওর | ভেবেছিলো আবার এক মাস বাদে এই ছেলেটার সঙ্গে দেখা হবে হয়তো | কিন্তু ভাবনাটা মিললো না | অনির্বাণ নিজেই দূরত্বটা কমিয়ে দিলো |

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here