ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি,পর্ব:১

#ধাঁধার__থেকেও_জটিল_তুমি
( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র

<১>

আজ কলকাতায় মেঘ করেছে ভীষণ | চারিদিক কালো করে এসেছে সকাল থেকে | বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজটা কখনো ঝিরঝির তো কখনো টুপটাপ করে পরিবর্তন হচ্ছে ! তবে আকাশ অল্প বেশি সারাদিনই কাঁদছে | মেঘনা জানলার ধারে এক কাপ কফি হাতে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ | বৃষ্টি দেখছিলো মন দিয়ে | ভালো লাগে আসলে ভীষণ , ওর এই অঝোর ধারা | বৃষ্টির আওয়াজটা কেমন মিউজিকের মতন শোনায় ! আর মাঝে মাঝে জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতেও দারুন লাগে | এইসবই ভাবছিলো তখনই মোবাইলে টিং করে একটা শব্দ হলো | হোয়াটস এপ মেসেজে আসার | মেঘনা আনমনে বই এর টেবিলটা থেকে মোবাইলটা তুলে দেখতেই মুখে হাসি | নাম না জানা একটা নাম্বার থেকে কিছু শব্দ এসেছে ওর জন্য ,

———- ” প্রিয় মেঘনাদি ,

তোমার লেখা ‘শুধু বসন্ত’ বইটা পড়লাম কাল , সারা রাত জেগে | হঠাৎ মনে হলো হারানো অনেক কিছুকে ফিরে পেয়েছি , কল্পনায় | তোমার লেখা পড়ে আবার নতুন করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে জানো | এইভাবেই সব সময় লিখে যেও | আর খুব ভালো থেকো |

অনন্যা

হায়দ্রাবাদ

২১ শ্রাবন ”

শেষে তারিখটা পড়ে অদ্ভুত লাগলো এবার মেঘনার ! বাংলায় লেখা তারিখ ! কজন মনে রাখে আজকাল ! তবে মনে একটা আনন্দও হলো আবার | যারা ওকে চেনে না সামনাসামনি , তারা ওকে চেনে কিছু শব্দ দিয়ে | আর তারা এইভাবে ভালোবাসা পাঠায় কত দূর থেকে ! হ্যাঁ , অনেক বড়ো লেখিকা মেঘনা না ! নিউজ পেপারে ছবিও বেরোয়নি কখনো | তবে অনলাইনে ওয়েবসাইট , ফেসবুক পেজ এইসব জায়গায় লিখে কিছু মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে | তারাই ওর লেখাগুলোকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যায় | তারাই সময় খরচা করে ওর বই কেনে , পড়ে ! আর সেই জন্যই হয়তো , এই বাস্তবের পৃথিবীতে কল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে ও ! কেরিয়ার প্ল্যানিং না করেও ফ্রিলান্সিংটা পেশা হয়ে যায় ! কথাটা ভেবেই মেঘনা রিপ্লাইটা টাইপ করলো ,

———— ” থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ এতো মিষ্টি একটা চিঠি পাঠানোর জন্য | আর খুব ভালো লাগলো এটা দেখে, যে এই ফেসবুক হোয়াটস এপ এর যুগে কেউ চিঠির আঙ্গিককে মনে রেখেছে ! এইভাবেই কল্পনাদের সাথে থেকো | আর খুব ভালো থেকো |”

কথাটা শেষে করে সেন্ড বটনটা ক্লিক করে মোবাইলটা টেবিলের ওপর রাখলো মেঘনা | তারপর আবার মন দিলো বৃষ্টির দিকে | মেঘ ডাকতে শুরু করেছে এখন | রাস্তাঘাটটা জলে থৈ থৈ করছে | এর মধ্যে হঠাৎ এক টুকরো ভালো লাগা এসে ভিড় করলো মেঘনার মনে | এই ব্যস্ততার যুগে লোকে যখন দৌড়োচ্ছে সারাক্ষণ , তখন এমনও লোক আছে , যারা থমকে দাঁড়াতে জানে ! নিজের জীবন এর গল্প থেকে একটু সময় বার করে অন্য গল্পে মন দিতে জানে | বইয়ের পাতাগুলোকে ওল্টাতে ভালোবাসে ! সত্যি , যদি না লিখতো এ-কবছর , তাহলে হয়তো চেনাই হতো না এদের ! পরিচয় হতো না কখনো শব্দ দিয়ে ! এইসবই ভাবছিলো, তখনই আনমনে খেয়াল করলো ফ্ল্যাটের সামনে থাকা গ্যারেজটার দিকে মাথায় ফাইল গার্ড করে কোনোমতে দৌড়ে এগিয়ে গেলো আন্তরিক | তারপর প্রায় হাফ ভিজে তাড়াতাড়ি ওর লাল গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো | এরপর চোখের পলকে জল থৈ থৈ রাস্তা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো কোথাও ! প্রচন্ড বৃষ্টিতে আবছা হয়ে গেলো ছবিটা ! মেঘনা কিরকম দীর্ঘ্যশ্বাস ফেললো হঠাৎ ! সত্যি , এই ছেলেটার কি জীবনে কোনো একদিন কাজ থেকে ছুটি নেই ! মানছে প্রফেসর ! পোস্ট ডক্টরেট করার চেষ্টা করছে ! অনেক কাজের চাপ ! তবে এরকম মেশিনের মতন শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ননস্টপ কে কাজ করে ! একটা দিন তো লোকে রিল্যাক্স করেই ! আর তার ওপর আজ তো সকাল থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি | সিওর মেন্ রোডেও জল জমে গেছে | তার ওপরে রবিবার | সব ছুটি ! তার মধ্যেও মনে হয় এই বোটানির প্রফেসর গেছে কলেজের ল্যাবে ! পার্সোনাল কাজ করার জন্য | কাকুর মুখে তো সবই শোনে | পাশের ফ্ল্যাটেই তো থাকে | সত্যি ঐরকম হাসিখুশি , বকবক করতে ভালোবাসা বাবার যে কি করে এইরকম গম্ভীর , সিরিয়াস , কাজ পাগল একটা ছেলে হয়, কে জানে ! একটুও মিল নেই কাকুর সঙ্গে | কথাটা ভেবেই মনে মনে নমস্কার করলো আন্তরিককে | তারপরেই হঠাৎ খেয়াল হলো , এই বৃষ্টির দিনে একটু খিচুড়ি না হলে জমে না কি ! তাই আর দেরী না করে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলো মেঘনা । কিরকম যেনো গোবিন্দ ভোগ চালটা ওকে ডেকে উঠলো !

<২>

মেঘনারা এই ফ্ল্যাটে আছে প্রায় পনের বছর হলো। ওর যখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ার , তখন আন্তরিক রা এসেছিল এই ফ্ল্যাটে । ওদের পাশের এপার্টমেন্ট টা রথীন কাকুরা বিক্রি করে দিয়েছিল আন্তরিক এর বাবাকে । রথিনকাকুরা তারপর পুরোপুরি ভাবেই আমেরিকা চলে যায় কলকাতা ছেড়ে । আর তার বদলে ওদের প্রতিবেশী হয়ে যায় আন্তরিক এর ওর বাবা সমর জেঠু । না, আন্তরিক এর মা নেই । খুব ছোটবেলায় মারা গেছিল । তারপর থেকেই না কি ছেলেটা এরকম চুপচাপ , ইন্ট্রোভার্ট হয়ে যায় । কথাগুলো আন্তরিক এর বাবার মুখেই শোনা । জেঠু আসলে এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই মেঘনার সাথে খুব ভাব । আর মেঘনা ও যেমন বকবক করতে ভালোবাসে , ওর সমর জেঠু ও তাই। সেই জন্য শুরু থেকেই মিল এত । ওদের ফ্ল্যাটে মেঘনার অবাধ যাতায়াত । তবে ওদের এখানে আসার ৭ বছর পরও আন্তরিক ছেলেটার সাথে মেঘনার কথা হয়েছে হাতে গুণে কয়েকবার । মেঘনার যখন সেকেন্ড ইয়ার ছিল , তখন আন্তরিক রিসার্চ করতে এক বছর হলো ঢুকেছে কলকাতা ইউনিভার্সিটি তে নেট দিয়ে । ওই তখন থেকে আজ অব্দি মেঘনা কে দেখে আলতো হাসি , এক একদিন ভদ্রতার দু এক লাইন , ” কেমন আছো ?” ” কি খবর ?” ছাড়া মনে হয় না আর বেশি বাক্য বিনিময় হয়েছে । মেঘনা ও তবে কখনো কথা বাড়াতে যায়নি নিজে থেকে । আসলে প্রথম প্রথম তো এই ছেলেটাকে দেখে বেশ অহংকারী টাইপের মনে হতো ! রিসার্চ করছে বলে হয়ত নাকটা একটু উঁচু ! কিন্তু এত বছর দেখতে দেখতে বুঝেছে , নাকের সাইজ নর্মালই । আসলে স্বভাবটাই এরকম , বোরিং টাইপের । নিজের বাবার সাথেও দরকারি কথা ছাড়া মনে হয় না কিছু বলে বেশি ! সব সময় নিজের কাজ ,নিজের জগতেই হারিয়ে থাকে । তবে মনটা কিন্তু খারাপ না আন্তরিক এর ! আজও ফার্স্ট স্যালারি তুলে নিজের জন্য কিছু কিনুক না কিনুক বাবার জন্য সব সময় নতুন কিছু একটা নিয়ে আসবে । কখনো ব্র্যান্ডেড শার্ট , তো কখনো ইলেকট্রনিক কোনো গ্যাজেট । এই লাস্ট মন্থই তো সমর জেঠুর মুখে শুনলো , আন্তরিক না কি একটা কাল একটা আইফোন কিনে এনেছে বাবার জন্য । যদিও এত দামী ফোনের ফিচার এপস এইসব কিছু ইউজ করতে শেখানোর সময় হয়নি ওনার । সেইসব কিছুই ধৈর্য ধরে শিখিয়েছে মেঘনা ওর সমর জেঠুকে । তবে আজকাল যেখানে বাবা মা ই ইউজ করার মতন একটা ক্রেডিট কার্ড হয়ে গেছে অনেক ছেলেমেয়ে দের কাছে , সেখানে আন্তরিক এর মতন ছেলেকে দেখলে আলাদা লাগে মেঘনার , যে কি না নিজে একটা সাত আট হাজার টাকার ফোন ইউজ করলেও বাবাকে আইফোন কিনে দেয় ! তবে আর একটা ব্যাপারও খেয়াল করেছে মেঘনা । এই ফ্ল্যাটের ওয়াচম্যান এর একটা ছেলে আছে। ছটু নাম । ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো হলেও টাকার জন্য ওর স্কুলে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল । সাহায্যের জন্য ওর বাবা এই ফ্ল্যাটের অনেককে বলেছে । মেঘনা শুনে ভেবেছিল বাবাকে বলে ছটুর স্কুলের ফিজটা দিয়ে দেবে । কিন্তু ও কথাটা ওয়াচম্যান দাদাকে গিয়ে বলতেই শুনলো যে ছ টুর স্কুলের ফিজ না কি দিয়ে দিয়েছে আন্তরিক । আর শুধু তাই না, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ওর পড়াশোনার খরচ আন্তরিক ই চালায়। এর জন্য আর ওর বাবাকে অন্য কারোর কাছে হাত পাততে হয় না । এত কিছু জানার পর মেঘনা আর কখনোই আন্তরিক কে আর যা ই ভাবুক , অহংকারী ভাবতে পারেনি । তবে ওকে দেখলে রাম গরুরের ছানা এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় । এই ভাবনাটা কে ঠিক কন্ট্রোল করতে পারে না মেঘনা । এই যেমন দু মাস আগের ঘটনা । পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে মেঘনাদের বাড়িতে লুচি আর আলুর দম হয়েছিল । তো ওই সকাল এগারোটার সময় ও দুটো প্লেট সাজিয়ে দিতে গেছিল সমর জেঠুদের ফ্ল্যাটে । জেঠু তো লুচি আলুর দম দেখেই কেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্লেটটায় । কিন্তু আন্তরিক ডাইনিং টেবলে বসে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে ওর দিকে তাকিয়ে এক পলক হেসেছিল শুধু । মেঘনা তখন ভদ্রতা করে ওর প্লেটটা ডাইনিং টেবিলে ল্যাপটপের পাশে রেখে বলেছিল , ——– ” খেয়ে নিও । মা পাঠিয়েছে ।”

আন্তরিক সেটা শুনে হাসির এক স্টেপ ওপরে উঠে বলেছিল , ——– ” হ্যাঁ নিশ্চয়ই , খাবো ।”

এরপর প্রায় দু ঘন্টা বাদে মেঘনা আবার এসেছিল ওদের ফ্ল্যাটে। সমর জেঠু কে একটা বই ফেরৎ দিতে । কিন্তু এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মেঘনা । ডাইনিং টেবিলে লুচির থালাটা যেরকম রেখেছিল সেইরকমই পরে আছে , আর তার পাশে আন্তরিক কানে হেডফোন লাগিয়ে নিজের মনে ল্যাপটপে তাকিয়ে কাজ করে যাচ্ছে । দৃশ্যটা দেখে মেঘনা জেঠুর দিকে তাকিয়েছিল । সমর জেঠু ওর দিকে একটা কিরকম হতাশ মার্কা এক্সপ্রেশন ফিরিয়ে দিয়েছিল , যেনো এটা রোজকার ঘটনা ! এই মুহূর্তে মেঘনা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি । সোজা আন্তরিক এর সামনে গিয়ে ওকে ডেকে উঠেছিল । তবে হেডফোন কানে থাকায় আন্তরিক ওর আওয়াজ শোনেনি । তাই মেঘনা ওর পিঠে হাত দিয়ে ওকে ডেকে উঠেছিল । এবার যেনো আন্তরিক এর সম্ভিত ফিরলো । ও অবাক চোখেই হেডফোন খুলে মেঘনার দিকে তাকিয়ে বলল ,

———– ” কি হয়েছে ? ”

মেঘনা একটু নিরাশ মুখে লুচির প্লেটের দিকে আঙ্গুল টা দেখিয়ে বললো ,

_———— ” লুচিটা ! ঠান্ডা তো অলরেডি হয়েই গেছে ! এরপর শক্ত হয়ে পাঁপড় ভাজা না হয়ে যায় !”

কথাটা শুনে আন্তরিকের যেন সম্ভিত ফিরলো | ও একটু ইতঃস্তত হয়েই একবার লুচির প্লেটের দিকে তাকালো , তারপর মেঘনার দিকে ! তারপর নিজের মনেই বলে উঠলো ,

————- ” ওহ , লুচি ! তাই তো ! হ্যাঁ খাচ্ছি এক্ষুনি |”

মেঘনা এই সময় চোখ দুটো গোলগোল করেই কয়েক সেকেন্ড ওকে দেখেছিলো ! এই ছেলেটার কি কাজ থাকলে খিদেটাও ঠিকভাবে ফিল হয় না ! কি অদ্ভুত ! যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছে !

কথাটা ভেবেই মেঘনা আর কথা বাড়ালো না | দরজার দিকে এগোলো নিজে | তবে আড়চোখে খেয়াল করলো সেই মুহূর্তে , আন্তরিক লুচির প্লেটটা নিয়ে আল্টিমেটলি বসেছে এবার | যাক , দেখেও শান্তি | কথাটা ভেবেই ও চলে এসেছিলো নিজের ফ্ল্যাটে |

<৩>

তবে এইসবের কিছুদিন পর একটা ঘটনা ঘটেছিলো হঠাৎ | মেঘনা সেদিন ফ্ল্যাটে একাই ছিল | মা বাবা জামশেদপুরে একটা বিয়েবাড়িতে গেছে | ওর কিছু লেখার কাজ ছিল বলে যাওয়া হয়নি আর | যাইহোক , সেদিন সন্ধ্যেবেলা কিছু দোকান করে ফিরছিলো ফ্ল্যাটে , কিন্তু লিফ্ট খুলে ওদের ফ্লোরটা আসতেই চোখটা থমকে যায় ! সময় জেঠু ওদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে কিরকম সেন্সলেস হয়ে পরে আছে | আসলে ওদের এই ফ্লোরে শুধু মুখোমুখি দুটোই ফ্ল্যাট | আর সবাই লিফ্ট ইউজ করে ওপর নিচ করে , তাই হয়তো সিঁড়ি থেকে কেউ যায়নি ! দেখেনি লোকটাকে এইভাবে পরে থাকতে কেউ ! কথাটা ভেবেই মেঘনা প্রায় দৌড়ে গেলো | সময় জেঠুর ফ্ল্যাটের চাবিটা পকেটে নেই | জানে না , কোথায় ঠিক রাখা থাকে চাবিটা ! তবে এইভাবে চাবি খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করলে তো চলবে না ! তাই ও নিজের ফ্ল্যাটটা খুলে কোনোমতে সময় জেঠুকে নিয়ে ড্রইং রুমের সোফাটার মধ্যে শোয়ালো | এরপর নিচের সিকিউরিটিকে সঙ্গে সঙ্গে কল করে ডাক্তার ডাকার কথা বলেছিলো | ওর ফোনেও যদিও একজন ফ্যামিলি ডাক্তারের নাম্বার সেভ করা আছে ! তবে উনি এখন আউট অফ টাউন । তাই কোন অচেনা ডাক্তারের ওপরই ভরসা করতে হবে । কথাটা ভেবেই ও এক গ্লাস জল এনে সমর জেঠুর চোখে মুখে বার বার ছিটাতে শুরু করলো । হাতের চেটো টা নিজের হাতের সঙ্গে ঘষতে লাগলো । যদি ডাক্তার আসার আগে কোন ভাবে জ্ঞান ফেরানো যায় ! তবে এই সময়ে ও আন্তরিক কে অনেকবার ফোন করেছে । সমর জেঠু এইভাবে সেন্সলেস হয়ে আছে , এটা তো সবার আগে ছেলেরই জানার কথা ! এমনকি সমর জেঠুর কোন মেডিক্যাল প্রব্লেম আছে কি না ; কোনো প্রেশারের প্রব্লেম , বা অন্য কিছু ! সেটাও তো আন্তরিকই বলতে পারবে ! কথাগুলো ভেবেই ও বার বার আন্তরিক এর নাম্বারটা ডায়েল করলো । কিন্তু প্রত্যেকবারই রিং হয়ে হয়ে ফোনটা কেটে গেলো ওর ! এখন কিরকম অধৈর্য্য লাগছিল মেঘনার । সত্যি ! মোবাইলটা রেখেছে কি করতে ! একবার যদি কল ই না রিসিভ করে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই এবার দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো । মেঘনা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো সিকিউরিটি গার্ড একজন ডাক্তার নিয়ে হাজির । ওর যেন দেখে একটু স্বস্তি লাগলো এবার । তারপর প্রায় দু ঘন্টা কেটে গেলো চিন্তার মধ্যে , মুখ অন্ধকার করে । আসলে সমর জেঠুর প্রেশার ফল করেই এরকম আচমকা সেন্সলেস হয়ে গেছে । কিন্তু ছেলে নেই বলে মেঘনা হসপিটালাইজ ও করতে পারেনি ওনাকে । বাড়িতেই তাই স্যালাইনের ব্যাবস্থা করলো ডাক্তারকে বলে । রাস্তার উল্টো দিকের মেডিকেল শপটা থেকে প্রেসকিপশন দেখে কিছু ওষুধ ইনজেকশনও নিয়ে আসলো এরপর ।

না, ইনজেকশন দুটো পরার পর , আর স্যালাইন শুরু হওয়ার জন্য আর অবস্থা খারাপ হয়নি মেঘনার সময় জেঠুর। জ্ঞানও ফিরেছিল কিছুক্ষণ পরে । তবে ডাক্তার রেস্টের জন্য একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে ওনাকে ।

এইসব এর পর মোটামুটি রাত দশটার সময় মেঘনাদের ফ্ল্যাটের কলিংবেলটা আবার বাজলো । ও দরজা খুলতেই কিরকম চিন্তায় ভরা মুখে আন্তরিক কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো নিজের সামনে । ও কিরকম উদভ্রান্তের মতন জিজ্ঞেস করলো মেঘনা কে ,

————- ” কি হয়েছে বাবার ? কোথায় বাবা ?”

মেঘনা এর উত্তরে প্রথমে কিছু না বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো, ওকে ভেতরে আসতে দেয়ার জন্য । তারপর শান্ত গলায় বললো ,

———- ” পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে । ঠিক আছে । দেখে এসো ।”

কথাটা বলেই ও আন্তরিক কে পাশের ঘরটায় নিয়ে গেল নিঃস্তব্ধে । আন্তরিক এবার যেন থমকে গেল কেমন ! বাবার হাতে স্যালাইনের চ্যানেল করা । ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখটা । অঘোর ঘুমে যেন আচ্ছন্ন ! এই দৃশ্য দেখে আন্তরিক স্থির হয়ে গেল হঠাৎ । খুব কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয় এসে জড়ো হলো মনে । তখনি মেঘনা বলে উঠলো,

———– ” প্রেশার খুব লো হয়ে গেছিল । তাই সেন্স ছিল না । স্যালাইন দিতে হয়ছে। এখন চিন্তার কিছু নেই । ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে । ঘুমোচ্ছে । ”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল ও। আন্তরিক তখন ঠিক কি উত্তর দেবে ! কিভাবে থ্যাঙ্ক ইউ বলবে বুঝে উঠতে পারলো না ! তাও কিছু কথা সাজিয়ে বললো ,

———– ” আমি আসলে একটা সেমিনারে ছিলাম । ফোনটা ব্যাগে ছিল । দেখিনি তাই ! সত্যি ! তুমি যেটা আজ করলে ! আমি ভুলবো না কখনো।”

মেঘনার এর উত্তরে একটু দৃঢ় গলায় বললো , ———— ” আমি এমন কিছুই করিনি | আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এটাই করতো | কিন্তু আমার তোমাকে একটা কথা বলার আছে | জানি , এইসব বলার কোনো রাইট নেই আমার | আমি একটা বাইরের লোক | তাও বলছি | ”

কথাগুলো শুনে আন্তরিক এবার একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো মেঘনাকে , ———— ” কি কথা ?”

মেঘনা এর উত্তরেও আগের মতন দৃঢ় গলায় বললো , ————– ” সমরজেঠুকে শুধু আইফোন না , একটু সময়ও দিও | ওটা বেশি দরকার | কাজ তো জীবনে থাকবেই ! কিন্তু নিজের মানুষগুলোকে কাছে রাখাটা বেশি ইম্পরট্যান্ট | আর এই বয়সে লোকজন নিজের ব্যাপারে কেয়ারলেস হয়ে যায় | তাই একটা করে মান্থলি চেক আপ পারলে করিয়ে নিও বাবার | ”

কথাগুলো বলেই মেঘনা আর দাঁড়ালো না | ঘরটা খালি করে দিয়ে চলে গেলো সেই মুহূর্তে | তবে আন্তরিকের প্রথম নিজেকে খুব ভুল লাগলো হঠাৎ | কথাগুলো যেন ভেতরে কোথাও একটা গিয়ে খুব জোর লাগলো আজ | সত্যি বাবা কি আজ সকালেও বেশ ক্লান্ত ছিল না ! আন্তরিক তো খেয়াল করেছিল বাবার বসে যাওয়া চোখ মুখ , ফ্যাকাসে শরীরটা | কিন্তু কনফারেন্সের প্রেজেন্টেশন নিয়ে এতো বিজি ছিল যে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি তখন | ভেবেছিলো হয়তো রাতে ঘুম হয়নি , সেই জন্য এরকম লাগছে | একটু ঘুমিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে | আর তারপর তো বাবাকে একবারও ফোনও করা হয়নি আন্তরিকের | কথাগুলো ভেবে নিজের চোখ দুটো আপনাআপনিই নিচে নেমে গেলো কেমন | সত্যি , বাবা ছাড়া তো আর কেউ নেই ওর কাছে ! মা মারা গিয়েছিলো যখন ওর ক্লাস ফাইভ | তারপর থেকে বাবা তো শুধু ওকেই আঁকড়ে থেকে বেঁচে আছে | কিন্তু আন্তরিক , সেই মানুষটার ঠিকভাবে খোঁজও নেয় না রোজ ! একই বাড়িতে থেকেও জানতে পারে না যে বাবার শরীর এরকম খারাপ ভেতরে ভেতরে ! কথাগুলো যেন নিজেকেই বলে উঠলো ও | এই সময় চোখটাও ভিজে এলো কেমন আনমনে | আন্তরিক আর এরপর অপেক্ষা না করে বাবার হাতটা গিয়ে ধরলো এখন | হাতের মধ্যে স্যালাইনের চ্যানেল করা | সবটাই ওর জন্য | যদি সকালে একবার জিজ্ঞেস করতো বাবাকে শরীরের ব্যাপারে , একবার কোনো ডাক্তারকে কল করে বাড়িতে আসতে বলতো চেক আপের জন্য ! তাহলে এইভাবে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকতো না মানুষটা | কথাগুলো ভেবে খারাপ লাগলো ভীষণ আন্তরিকের | একটা হালকা রাগও এসে জমা হলো নিজের ওপর | তবে এইসব ভাবনার ভিড়ে আরেকবার মেঘনা এসে হাজির বিনা নোটিশে | আন্তরিক যদিও প্রথমে খেয়াল করেনি | ও বাবার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসেছিল নিজের মনে | মেঘনা সেই মুহূর্তে দরজা দিয়ে আলতো পা এ ঢুকে একটু আস্তে গলায় জিজ্ঞেস করলো , ———— ” তুমি ডিনার করেছো ? খেয়েছো কিছু ?”

আন্তরিক কথাটা শুনে ফিরে তাকালো | তারপর একটু থমকে থাকা গলায় বললো , ————- ” না , আমাদের কনফারেন্স এ খাবার ব্যবস্থা থাকে | খেয়েই ফিরেছি | ”

মেঘনা কথাটা শুনে আর কথা বাড়ালো না | “আচ্ছা ” বলে ঘরটা খালি করে দিয়ে বেরিয়ে এলো ড্রইং রুমে | আসলে এই ছেলেটার ওপর হালকা রাগ আছে ওর | সারাক্ষন এতো কাজ পাগল হলে হয় ! বাবাটাকে একটু সময় দেবে না ! এতটা হিসাবি হলে জীবন চলে ! সত্যি | আজকালকার এই এতো কেরিয়ারিস্টিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে মেঘনা ঠিক মেলাতে পারে না নিজেকে | সব সময় এতো দৌড়োনোর কি আছে কে জানে ! যেন চারিদিকে অদৃশ্য একটা কম্পিটিশন চলছে | সবাইকে যেখানে ফার্স্ট হতেই হবে | আর এই কম্পিটিশনে জেতার জন্য কেউ যেন আর থমকে দাঁড়াতেই জানে না জীবনে ! একবার নিজের লোকের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই কারোর | কথাগুলো ভেবেই ঘরে চলে এলো | ওর আর নিজেরও ঠিক খেতে ইচ্ছে করছে না এখন | আসলে সমরজেঠু মানুষটা এতো হাসিখুশি | ওনাকে এইভাবে পরে থাকতে দেখে ভালো লাগছে না ঠিক মেঘনার | মনে হচ্ছে কতক্ষণে মানুষটা চোখ খুলবে ! আগের মতন কথা বলবে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেইদিন ঘুম জরিয়ে এলো মেঘনার চোখে | এরপর হঠাৎ ভোর সাড়ে চারটে পাঁচটার দিকেই ঘুমটা ভেঙে গেলো হঠাৎ জল তেষ্টায় | মেঘনা আলতো চোখে পাশের টেবিলটা হাতড়াতে দেখলো বোতলটা খালি | তাই ঘুম চোখেই উঠতে হলো বিছানা থেকে | আধখোলা চোখেই তারপর ও ড্রইং রুমে এলো | ডাইনিং টেবিলে জলের বোতলগুলো সাজানো | সেখান থেকে একটা বোতল তুলে কয়েক ঢোক জল খেতে খেতেই ফিরে যাচ্ছিলো নিজের ঘরে , কিন্তু পাশের ঘরটার সামনে এসে চোখটা থমকে গেলো হঠাৎ | খোলা দরজার ওপারের দৃশ্যটা দেখে | আন্তরিক চুপচাপ জেগে বসে আছে বাবার মাথার কাছে | একটা হাত দিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাবার মাথায় | আর একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে বাবার হাতের সঙ্গে | মেঘনা সত্যি এই সময় অবাক না হয়ে পারলো না ! এই ছেলেটাকে বোঝা দ্বায় ! একবার মনে হয় খুব হিসাবি | আরেকবার মনে হয় যা ভেবেছিলো সেটা ভুল | হিসাবের বাইরেও চলতে জানে এ | হয়তো অন্যদের থেকে বেশিই জানে একটু ! নইলে সারা রাত এইভাবে জেগে কাটিয়ে দিতে পারতো না ! বাবাকে খুব মন থেকে ভালো না বাসলে , এইভাবে সারাদিন এতো কাজের পর এখানে কনস্ট্যান্ট বসে থাকা সম্ভব না | কথাগুলো ভেবেই মেঘনা এবার ভেতরে ঢুকলো ঘরের | না , আর ঠিক রাগ হচ্ছে না এখন আন্তরিকের ওপর | বরং একটু খারাপই লাগছে | হয়তো একটু বেশিই ভুল বুঝেছে ছেলেটাকে ! কথাটা ভেবেই ও পেছন থেকে বলে উঠলো , ————– ” তুমি চাইলে এখন একটু গিয়ে রেস্ট নিতে পারো বাড়িতে | জেঠুর সঙ্গে আমি আছি | তুমি তো সারা রাত বসেছিলে !”

কথাগুলো কিরকম এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো মেঘনা | আন্তরিক তখন পেছনে ফিরে তাকালো ওর দিকে | তারপর একটু কথা সাজিয়ে বললো ,

—————- ” না , সে কিছু না | আমার কোনো প্রব্লেম হচ্ছে না | রাত জাগার অভ্যাস আছে | তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পর |”

কথাগুলো যেন স্থির গলায় বললো আন্তরিক | তবে এই সময় ওর ক্লান্ত মুখটা দেখে মেঘনার কেন জানে না মনে হলো আন্তরিকের হয়তো খিদে পেয়েছে | কিন্তু ছেলেটা চাপা স্বভাবের বলে বলছে না | তাই মেঘনা নিজেই বললো , ———— ” আচ্ছা ঠিক আছে | তবে আমার আর একটা কথা কিন্তু শুনতে হবে এখন | একটু ডাইনিং টেবিলে চলো | কিছু খেয়ে নাও |”

আন্তরিক কথাটা উত্তরে একটু জোর দিয়েই বললো , ————- ” না না | কিছু খাবো না | কোনো খিদে নেই এখন |”

কথাটা শুনে হিয়া একটু দিদিমনির মতন মুখ করে উত্তর দিলো , ————– ” সে আমি বুঝবো | তুমি চলো এখন |”

কথাটা বলেই ও আন্তরিকের হাতটা ধরে ওকে প্রায় টেনে নিয়ে এসে বসালো টেবিলে | তারপর ফ্রিজ থেকে রুটি তরকারি বার করে গরম করে দিলো ছেলেটাকে | তবে আন্তরিক আর এই মুহূর্তে না বললো না মেঘনাকে | খাবারটা আসতেই এক মনে খেতে শুরু করলো | মেঘনা এবার আলতো হেসে ফেললো নিজের মনে | তারপর আন্তরিকের সামনে বসে জিজ্ঞেস করলো সোজাসুজি ,

—————– ” তুমি এতো চাপা কেন বলো তো ? সব সময় এতো চুপ থাকতে ভালো লাগে ?”

আন্তরিক কথাটা শুনে এবার হেসে ফেললো নিজে | আসলে এইভাবে ডিরেক্টলি ওকে কেউ কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি | তারপর একটু কথা সাজিয়ে বললো ,

—————– ” না , কোথায় ! বলি তো কথা | ”

মেঘনা এবার হেসেই বলে উঠলো , ———– ” ঠিকই ! সারাদিনে একটা কি দুটো ওয়ার্ড ! আচ্ছা তুমি পড়াও কি করে ? মানে এক দু ঘন্টার লেকচার কি করে দাও স্টুডেন্টসদের ? তোমার মতন এক দুটো শব্দের লোকের জন্য তো খুবই ডিফিকাল্ট … ”

কথাটা শুনে এবার আন্তরিক একটু জোরেই হেসে ফেললো | তারপর একটু ভেবে বললো , ———— ” পড়ানোটা তো একটা কাজ | আর কাজের কথা আমার লিমিটলেস আসে | ওটাতে কোনো প্রব্লেম নেই | কিন্তু ডেইলি লাইফে দু চারটে ওয়ার্ডেই কাজ চলে যায় সারাদিনে | এর বেশি দরকার হয় না |”

কথাটা শুনে মেঘনাও এবার একটু বোঝার মতন মুখ করে বললো , ————- ” বুঝলাম | ভালোই | ভোকাল কর্ড এ চাপটা কম পরে | গুড ফর হেলথ |”

না আন্তরিক আর এর উত্তর দিতে পারলো না ঠিক | তবে হঠাৎ মনে হলো , মেয়েটা বেশ ভালো চিনেছে তো ওকে ! ডেস্ক্রিপশনটা একেবারে পারফেক্ট |

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here