ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি,পর্ব:২

#ধাঁধার_থেকেও_জটিল_তুমি
( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৪>

সেদিনের পর দুটো অচেনা মানুষের মধ্যেকার দেয়াল অল্প অল্প করে ভাঙতে শুরু করেছিল দুজনেরই অজান্তে | মেঘনার সাথে এখন আন্তরিকের দেখা হলে টুকটাক কথা হয় | শুধু ‘কেমন আছো?’ ‘ভালো আছি’র ঊর্ধ্যে কিছু কথা | এই যেমন সেদিন রবিবার মেঘনা একটা বই দিতে গেছিলো আন্তরিকদের ফ্ল্যাটে | সমরজেঠু আসলে গল্পের বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে | মেঘনা তাই কোনো ভালো বই লাইব্রেরি থেকে তুললে সমরজেঠুকে দিয়ে আসে মনে করে | আবার সমরজেঠুও উল্টোটা করে ! নিজের বুক সেলফে নতুন কোনো বই কিনে ঢোকালেই সেটা মেঘনাকে পড়তে দেয় | এইভাবে বইয়ের আদান প্রদান বছরের পর বছর ধরে চলছে দুজনের | যাইহোক , এই আদানপ্রদানের মাঝেই মেঘনা সেদিন ফ্ল্যাটের বেলটা বাজিয়েছিল আন্তরিকদের , আর দরজা খুলেছিলো সেই সিরিয়াস ছেলেটা | মেঘনা তখন ওকে দেখে একটু থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠেছিল , ————- ” সমরজেঠু নেই ? একটা বই দিতে এসেছিলাম |”

এর উত্তরে আগে হলে আন্তরিক হয়তো বেশি কথা বাড়াতো না ! ‘না. বাবা নেই ,’ বলে নিজে বইটা রেখে দিতো | কিন্তু আজ ও ভদ্রতার দু লেভেল বাড়িয়ে উত্তর দিলো ,

—————- ” না বাবা একটু বেড়িয়েছে | চলে আসবে কিছুক্ষণে | তুমি ভেতরে এসে বসো | একটু ওয়েট করো , চলে আসবে |”

কথাটা বলেই ও দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো | মেঘনা এবার ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না ! তবে আন্তরিকের ভদ্রতার লেভেলটা যে বেড়েছে সেটা ও স্পষ্ট খেয়াল করলো | তাই আলতো হেসে ভেতরে এলো | কিন্তু ড্রইং রুমে আসতেই পা-টা থমকে গেলো | উল্টোদিকের সোফায় কতগুলো এলোমেলো ফাইল হাতে একজন বেশ সুন্দরী মেয়ে বসে | ফর্সা গায়ের রং , চোখ নাক ভীষণ তীক্ষ্ণ , সঙ্গে স্কাই ব্লু রঙের চুড়িদার যেন আরো বেশি করে সাজিয়ে তুলেছে মেয়েটাকে | মেঘনা ওকে দেখে আন্তরিকের দিকে একটু প্রশ্ন চিহ্নের মতন মুখ করে তাকালো যেন | আন্তরিক ওর মনের কথাটা বুঝতে পেরে নিজে থেকেই উত্তর দিলো , ———– ” আলাপ করিয়ে দিই , ও আরাত্রিকা ভট্টাচারিয়া | আমাদের কলেজে ইংলিশের প্রফেসর | ” তারপর আরাত্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো,———–” আর ও হলো মেঘনা , আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে | আমার বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড |”

কথাটা শুনে আরাত্রিকা সামান্য হেসে মেঘনাকে বললো এবার , ———- ” হ্যালো .. ”

মেঘনা এর ঠিক কোনো উত্তর না দিয়ে অল্প হাসলো | আন্তরিক এবার মেঘনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলো ,

———— ” আরে তুমি দাঁড়িয়ে কেন ? বসো | ”

মেঘনা কথাটা শুনে একটু ইতঃস্তত হয়েই বসলো এবার | আসলে ওর মনে হচ্ছে সমরজেঠুকে কল করে আসলেই বোধ হয় ভালো হতো ! সামনে ফাইলপত্তর ছড়ানো , ল্যাপটপ খোলা , উল্টোদিকে বসে থাকা আরাত্রিকা মেয়েটার হাতেও দুটো ফাইল ধরা , বোঝাই যাচ্ছে ওরা মনে হয় কোনো দরকার অফিশিয়াল কাজ করছিলো | তার মাঝে মেঘনার হঠাৎ করে হাজির হওয়াটা কি ঠিক হলো ! কথাগুলো ভাবতেই দেখলো আন্তরিক আরাত্রিকাকে বলে উঠছে , ———— ” তাহলে তোমাকে রাতে আমি ফোল্ডারগুলো মেল্ করে দেব | ডকুমেন্টসগুলো কলেজের তো সব আমার কাছেই আছে | ইউ ডোন্ট ওরি ..”

কথাটা শুনে আরাত্রিকা এবার আন্তরিককের হাতটা ধরেই বললো , ————- ” থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ .. আসলে আমি ভাবিনি ন্যাক এর দ্বায়িত্বটা আমার ওপর এসে পড়বে ! কলেজের রেটিং এর ব্যাপার আছে ! ভালোভাবে সব কিছু প্রেজেন্ট না করলে ফান্ড পাবে না কলেজ ! আর জানোই তো আমাদের টিম মেম্বার্সরা কেমন ! একটা কেউ ঠিকভাবে কাজ করে না | ভাগ্যিস তুমি হেল্প করলে ! নইলে আমি যে কি করতাম ! ”

কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো মেয়েটা | কিন্তু এই মুহূর্তে মেঘনা খেয়াল করলো আন্তরিক আস্তে করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো আরাত্রিকার থেকে | তারপর সেই মাপা ভদ্রতা দেখিয়েই যেন বললো , ———– ” ইট’স ফাইন.. থ্যাঙ্কস এর কিছু নেই | তোমাকে রাত নটার মধ্যে আমি সব মেল্ করে দেব |”

আরাত্রিকাও এবার ঠিক কথা বাড়ানোর মতন কিছু খুঁজে পেলো না মনে হয় | আসলে আন্তরিকের মধ্যে অদ্ভুত একটা পার্সোনালিটি আছে | ওর সাথে খুব সহজে গল্প জুড়ে দেয়া যায় না | কেমন যেন মাপা দূরত্ব রেখে চলে ছেলেটা সবার সাথে | মেঘনা আজও সেই ব্যাপারটা খেয়াল করলো | আসলে অনেক বছর ধরে দেখছে তো ছেলেটাকে ! ওর এই স্বভাবটা জানে | তাই দেখলো আরাত্রিকাও ঠিক কি বলবে আর বুঝতে না পেরে একটু এলোমেলোভাবে বলে উঠলো , ———— ” ঠিক আছে , আসি তাহলে আজ | কাল কলেজে দেখা হবে |”

কথাটার উত্তরে আন্তরিকও আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বললো , —————- ” হ্যাঁ , এসো | কাল দেখা হবে | ”

আরাত্রিকা এটা শুনে ফাইলগুলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো | তারপর যাওয়ার আগে মেঘনার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলো একবার | মেঘনাও ঘাড় দুলিয়ে হাসিটা ফেরত দিলো ওকে | তারপর ড্রইংরুমটা ফাঁকা করে আরাত্রিকা চলে গেলো নিঃশব্দে | মেঘনার এবার আরো অদ্ভুত লাগছে ! এই ছেলের সাথে তো কোনো কথা বিশেষ আসে না ! হ্যাঁ , সমরজেঠু যেদিন অসুস্থ ছিল সেদিন কথা হয়েছিল | তারপর টুকটাক রাস্তায় , ফ্ল্যাটের করিডোরে দেখা হলে টুকটাক কথা হয় ! কিন্তু সে তো এক দু মিনিটের | কিন্তু এইভাবে সামনাসামনি বসে আর কি বলবে ! এইসবই ভাবছিলো তখন আন্তরিক ওর সামনে এসে বলে উঠলো , ————- ” কফি ? এক সেকেন্ড , নিয়ে আসছি |”

কথাটা বলতেই মেঘনা একটু জোর দিয়ে বলে উঠলো , ————– ” না না | কফির দরকার নেই | আমি বুঝতে পারছি , তুমি মনে হয় কিছু ইম্পর্টেন্ট কাজ করছো | আমি বরং বইটা তোমাকে দিয়ে যাই | আমি সমরজেঠুর সাথে ফোন এ কথা বলে নেবো পরে |”

কথাটা বলেই ও বইটা দিতে যাচ্ছিলো আন্তরিককে , কিন্তু আন্তরিক ওকে থামিয়ে দিয়েই বললো ,

————- ” কাজ করছিলাম এতক্ষণ ধরে | কিন্তু এখন সেটা শেষ | আর কফি আমার নিজেরও একটু দরকার | তুমি বসো , আমি আনছি |”

কথাটা শেষ করেই ও আর কোনো অপেক্ষা করলো না | সোজা মেঘনার সামনেই রান্নাঘরে চলে গেলো | মেঘনা এই মুহূর্তে একটু অবাক না হয়ে পারলো না ! হঠাৎ কি পরিবর্তন ছেলেটার ! দশ বছর হলো ওরা সামনাসামনি ফ্ল্যাটে আছে , কিন্তু কোনোদিন তো ‘হ্যাঁ’ ;’হুম’ এর বেশি কথা বাড়ায়নি ! সমরজেঠুর অসুস্থ হওয়ার পর এতটা কি করে চেঞ্জ হয়ে গেলো ! ঠিক ভেবে পেলো না মেঘনা | তবে খারাপও লাগলো না ব্যাপারটা | একটু গম্ভীর , সিরিয়াস হলেও ছেলেটা ভদ্র | কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতেই আবার আন্তরিক হাজির , দু কাপ কফি হাতে |

মেঘনা এই সময়ও ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলো না , তখন আন্তরিকই বলে উঠলো ,

————– ” আচ্ছা , তুমি কি করো ? মানে স্টাডি তো মনে হয় শেষ ! কোথাও চাকরির জন্য এপ্লাই করেছো ?”

আন্তরিকের এই প্রশ্নে মেঘনা সত্যি আকাশ থেকে পড়লো | এতো বছর ওরা সামনাসামনি ফ্ল্যাটে থাকে , কিন্তু ছেলেটা ওর ব্যাপারে বেসিক ইনফরমেশন টুকুও জানে না ! কথাটা ভেবেই ও বলে উঠলো , —————— ” আমি ফ্রিল্যান্স রাইটার … এটাই প্রফেশন | কিছু বই বেড়িয়েছে কলকাতা বই মেলায় | আর অনলাইন ওয়েবসাইট , ম্যাগাজিন এসবে লিখি রেগুলার | বেশিরভাগই ই-রিডার্স আমার |”

আন্তরিক কথাটা শুনে যেন একটু নতুনভাবে তাকালো মেঘনার দিকে | তারপর বেশ সারপ্রাইজড হয়েই বললো ,

————– ” তুমি রাইটার জানতাম না তো ! কি বই আছে তোমার ? সব কি ফিকশন ?”

কথাটা শুনে মেঘনা এবার অল্প কথায় বলে উঠলো , —————- ” হ্যাঁ ফিকশন | সমরজেঠুর কাছে জিজ্ঞেস কোরো সময় হলে | আমার লেখা সব কটা বই জেঠুর কালেকশনে আছে | ”

কথাটার উত্তরে আন্তরিক সঙ্গে সঙ্গেই বললো , —————– ” হ্যাঁ , নিশ্চই জিজ্ঞেস করবো | এখনকার যুগে এটা একদম ইউনিক প্রফেশন ! সত্যি |”

আন্তরিকের কাছ থেকে এই কথাটা শুনে মেঘনারও কিরকম নতুন লাগলো যেন ছেলেটাকে | মানে আন্তরিক যেই রকম কেরিয়ারিস্টিক , ওর কাছ থেকে লেখা নিয়ে এইরকম রিয়্যাকশন ঠিক আশা করেনি মেঘনা ! ভেবেছিলো হয়তো বলবে , এটা কোনো কাজ না কি ! চাকরির চেষ্টা করো ! ফ্রিল্যান্সিং করে কতটুকুই বা ইনকাম করবে !

যাইহোক , ওর এইসব ভাবনার ভিড়েই মেঘনা কথা ঘোরানোর জন্য বলে উঠলো , —————— ” ওই তোমাদের কলেজের প্রফেসর যিনি এসেছিলেন , আরাত্রিকা ! ওকে কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে | আর দেখে মনে হলো তোমার মতনই , কাজ পাগল |”

আন্তরিক এই কথার উত্তরে সামান্য হেসে বললো , ————— ” হ্যাঁ , এমনিতে খুব এফিশিয়েন্ট | ভালো মেয়ে | আমাদের কলেজে বেশ ফেমাস | স্টুডেন্টসদের মধ্যে , আবার কলিগসদের মধ্যেও | লুকস ওয়াইজ , পার্সোনালিটি ওয়াইজ .. ”

কথাটা শুনে মেঘনা এবার নিজের মনেই বলে উঠলো , ———– ” হ্যাঁ , একদম পারফেক্ট ম্যাচ !”

আন্তরিকের কথাটা খুব আস্তে করে কানে গেলো যেন মেঘনার | ও একটু অবাক হয়েই বলে উঠলো , ———– ” কি ! কি বললে ? পারফেক্ট ম্যাচ !”

মেঘনা এই মুহূর্তে একটু ইতঃস্তত হয়ে একটু কথা সাজিয়ে বললো , ————– ” না ! মানে ! পারফেক্ট ম্যাচ বলিনি তো ! বললাম মেয়েটা খুব পারফেক্ট | ভালো দেখতে , ভালো পড়াশোনায় , ভালো চাকরি , সবটা মিলিয়ে |”

এর উত্তরে আন্তরিক প্রথম একটু অন্য কথা বলে উঠলো , যেটা মেঘনা কখনো আন্তরিকের কাছ থেকে ঠিক আশা করেনি | ও কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো ,

———— ” কেউই ইম্পারফেক্ট না | আমার মনে হয় সবাই নিজের নিজের মতন করে পারফেক্ট | পারফেকশনের কোনো স্পেসিফিক ডেফিনেশন হয় না !”

কথাটায় মেঘনা যেন স্থির হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড | যেই ছেলেটাকে সব সময় ওয়ার্কোহলিক ভেবেছে , যে শুধু কম্পিটিশনে এগিয়ে থাকতে চায় , কাজ ছাড়া যে আর কখনই কিছু বোঝে না , সে যে পারফেকশনের এতো সুন্দর একটা মানে বোঝে , এটা জানা ছিল না ! এইসবই ভাবছিলো , তখনই দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ | সমরজেঠু হাজির অবশেষে | মেঘনা আর দেরি না করে বইটা সমরজেঠুর হাতে দিয়ে বলে উঠলো , ———– ” নহন্যতে | বলেছিলে না তুমি স্কুল লাইফে পড়েছো সেই | তারপর আর বইটা পাওনি | কাল লাইব্রেরিতে চোখে পরে গেলো | ভাবলাম তোমার জন্য নিয়ে নিই |”

কথাটা শুনে সমরজেঠুর মুখে হাসি | বাজারের ব্যাগটা টেবিলে রেখে বইটা হাতে ধরে কিরকম আনমনেই বলে উঠলো ,

————— ” এইসব ছোট ছোট কথা শুধু তুইই মনে রাখতে পারিস | সত্যি |”

কথাটার উত্তরে মেঘনা আলতো হেসে বললো , ————– ” পড়ো বইটা তাহলে | যাইহোক , আসলাম আমি | পরে দেখা হবে |”

কথাটা বলেই আন্তরিকের দিকে তাকিয়ে একটা লাইনে বলে উঠেছিল , ———– ” আসলাম | আর কফিটা ভালো খেতে হয়েছিল |” , তারপর আর অপেক্ষা না করে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলো মেঘনা | তবে আন্তরিক এই মুহূর্তে ওর বাবাকে একটু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলো , ————– ” মেঘনা মেয়েটা বেশ আলাদা তাই না ? সবার থেকে ! অদ্ভুত ! এতদিন খেয়ালই করিনি !”

কথাটা শুনে সমরবাবু একটু হতাশ হয়েই উত্তর দিলো , ————— ” কাজ , পড়াশোনা , এইসব ছাড়া আর কি কখনো কিছুর দিকে তাকিয়েছিস যে আলাদা করে নোটিশ করবি ! মেঘনা সত্যি সবার থেকে আলাদা | নইলে আমার মতন একটা বুড়ো জেঠু ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয় ! ”

কথাটা শুনে আন্তরিক এবার একটু জোর দিয়ে বললো , ————–” কিন্তু তুমি খুব অদ্ভুত বাবা ! তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড এতো লেখালেখি করে ! বই বেরিয়েছে ওর ! আর সেইসব কিছুই তুমি বলোনি আমাকে ! আজ কথায় কথায় আমি জিজ্ঞেস করলাম বলে জানতে পারলাম | ইশ , কি ভাবলো আমার ব্যাপারে কে জানে ! যে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেও বেসিক ইনফরমেশন টুকু জানি না ওর ব্যাপারে !”

এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো আন্তরিক কথাগুলো | ওর বাবা সত্যি এবার আকাশ থেকে পড়লো যেন ! চোখ দুটো গোল গোল করেই বললো ,

—————- ” আমি কথায় কথায় অনেকবারই বলেছি মেঘনা লেখে , বই বেরিয়েছে | কিন্তু তোর যদি কাজ ছাড়া অন্য কোনো কথা কানে না ঢোকে তাহলে তো আমার কিছু করার নেই ! তবে তোর হঠাৎ কি হলো ! মেঘনা কি ভাববে এই নিয়ে তোর কবে থেকে এতো ভাবনা শুরু হলো আবার ?”

কথাটার উত্তরে আন্তরিক একটু এলোমেলো হয়েই বলে উঠলো গম্ভীরভাবে , ————- ” কি যে বলো না বাবা ! এমনি জাস্ট বললাম | কথার কথা | আমার কোনো ভাবনায় শুরু হয়নি কাউকে নিয়ে | যাইহোক , আমি ঘরে যাচ্ছি | কিছু মেল্ করতে হবে |”

কথাটা বলেই ও আর দাঁড়ালো না বাবার সামনে | তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে এলো | সামনে থাকলে আরো কি কি যে প্রশ্ন শুরু করবে কে জানে ! তবে এই মুহূর্তে বাবার ওই প্রশ্নটাকে একেবারে অর্থহীন বলে মনে হলো না যদিও আন্তরিকের ! সত্যি তো , ও কবে থেকে এই পাশের বাড়ির মেয়েটা কি ভাববে , এই নিয়ে ভাবতে শুরু করলো ! কিন্তু আরেকটা কথাও মনে হচ্ছে হঠাৎ আন্তরিকের ! যে মেঘনা তো বাবার সাথে কত সুন্দর সহজভাবে কথা বলে সব সময় | তাহলে ওকে দেখলেই ওরকম মেপে চলে কেন ! নিজে থেকে আলাপ জমানো তো দূরেই থাক ! না কি ভাবে ও যেই সব টপিক নিয়ে কথা বলে , যেমন গল্পের বই , গান , কবিতা , এইসব নিয়ে আন্তরিক কিছু বুঝতে পারবে না , বলতে পারবে না | তাই হয়তো মেপেই চলে | কথাটা ভেবেই আরেকবার নিজের ওপর অবাক হলো আন্তরিক | ও হঠাৎ কেউ কথা বলছে কি বলছে না , সেইসব নিয়ে ভাবতে যাচ্ছে কেন ! ও তো নিজেই বেশিরভাগ সময় লোকজনের সঙ্গে ডিসটেন্স রেখে চলে | কম কথা বলা তো ওর নিজেরই স্বভাব | নেচারটাই ইন্ট্রোভার্ট সেই স্কুল লাইফ থেকে | তাহলে আলাদা করে কারোর সঙ্গে কথা বলা , আলাপ জমানোর কথা ভাবছে কেন !

না , এর ঠিক উত্তর আন্তরিক এই মুহূর্তে খুঁজে পেলো না নিজে | আর বেশি ভাবারও চেষ্টা করলো না | মাইন্ডটাকে ডাইভার্ট করার জন্য আরেকবার ল্যাপটপটা খুলে বসলো তাই | তারপর হারিয়ে গেলো নিজের কাজে |

<৫>

এইসব এর আরো সাতদিন বাদে আবার মেঘনা আর আন্তরিক মুখোমুখি । সেদিন মেঘনা ওর ছোটবেলার বন্ধু নয়নের সাথে দেখা করার জন্য বেড়িয়েছিল আসলে । নয়নরা প্রায় দু সপ্তাহ বাদে শহরে ফিরলো লম্বা একটা ছুটি কাটিয়ে । ওর বাবা আসলে ঘুরতে খুব ভালোবাসে । এবার ওরা সাউথ ইন্ডিয়া ট্রিপে গেছিল । তাই নয়ন এর বকবক কে কদিন বেশ মিস করেছে মেঘনা । যাইহোক আজ সব সুদে আসলে উসুল করে নেবে । এসবই ভাবছিল আনমনে ফ্ল্যাটের উল্টোদিকে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । কিন্তু হঠাৎ ওর সব ভাবনা থমকে দিয়ে একটা লাল রঙের ইন্ডিকা এসে দাঁড়ালো ওর সামনে । আন্তরিক এর গাড়ি না ! কথাটা মনে আসতেই ড্রাইভিং সিটের কাঁচটা নামিয়ে সেই ছেলেটা ওর সামনে আরেকবার এসে হাজির । মেঘনা এই মুহূর্তে কিছু বলার আগেই আন্তরিক বলে উঠলো ,

————– ” গুড মর্নিং । কোথায় যাচ্ছ এখন ?”

কথাটা শুনে সত্যি এবার মেঘনা অবাক হলো । কারণ বিগত দশ বছরে এরকম গাড়ি নিয়ে , তার আগে স্কুটি নিয়ে , তার আগে সাইকেল নিয়ে অনেকবার আন্তরিক ওর সামনে থেকে রাস্তা দিয়ে গেছে , এসেছে । কিন্তু কোনদিন এইভাবে দাঁড়িয়ে ও কোথায় যাবে , এইসব জিজ্ঞেস করেনি ! এমনকি বেশ কয়েকববার তো বাস স্ট্যান্ডে ওর সঙ্গেই দাঁড়িয়ে থেকেছে ছেলেটা । কিন্তু একটা ভদ্রতার হাসি ছাড়া কোন শব্দ বিশেষ খরচা করেনি আন্তরিক । মনে মনে এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই বলে উঠলো মেঘনা ,

————- ” ওই বড়বাজারের কাছে । একটা বন্ধুর বাড়ি যাবো । এনিওয়েজ গুড মর্নিং .. ”

কথাটা শুনে আন্তরিক দু সেকেন্ড ভেবেই বলে উঠলো ,

———– ” তাই ! আমিও তো কলেজ স্ট্রিট যাচ্ছি ।কিছু বই কেনার আছে । তুমিও চলো | বড়বাজারে নামিয়ে দেব | ”

কথাগুলো আন্তরিক এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো | মেঘনার সত্যি এই সময় একটু যেন ধাক্কা লাগলো | আন্তরিকের জ্বর টর হলো না কি ! হঠাৎ করে এইরকম লেভেলের ঊর্ধ্যে ভদ্রতা কেন করছে ছেলেটা ! মেলাতে পারছে না ঠিক মেঘনা | কথাগুলো ভেবেই ও কিছু কথা সাজিয়ে বললো ,

—————- ” না না , দরকার নেই | তোমার দেরি হয়ে যাবে কলেজ যেতে ! আমি চলে যাবো বাসে | প্রব্লেম নেই |”

এর উত্তরে আন্তরিক এবার বেশ জোর দেখিয়েই বললো ,

—————– ” দেরি হবে না | আজ ১২টার পর প্র্যাকটিকাল | ইজিলি চলে যাবো | তুমি গাড়িতে ওঠো |”

না , এতো কথা শুনে তো মেঘনা ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | তাই চুপচাপ গাড়িতেই উঠে বসলো | এরপর শহর কলকাতার ভিড় রাস্তা পেরিয়ে গাড়িটা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো বড়বাজারের দিকে | এই সময় মেঘনার ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো | রিংটোন এ লগ্নজিতার ‘হৃদয়ের রং জানে না’ গানটা | আন্তরিক আনমনে গানটা খেয়াল করলো এই মুহূর্তে | তার মাঝেই মেঘনা ফোনটা ধরে একটু অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো ————- ” আরে বাবা দাঁড়া ! আসছি | তুই কোল্ড কফিটা রেডি রাখিস | গিয়ে একেবারে জমিয়ে বসবো | বাই |”

কথাগুলো একসঙ্গে বলে মেঘনা আর কোনো প্রত্তুত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিলো এক সেকেন্ডে | আন্তরিক এবার একটু প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন মুখটা করে বললো ,

—————— ” বেস্ট ফ্রেন্ড ? কি নাম ?”

মেঘনা এর উত্তরে হেসেই বললো , ————— ” নয়ন | একদম স্কুল লাইফ থেকে বন্ধু | দু সপ্তাহ ছিল না কলকাতায় | সাউথ ইন্ডিয়া ঘুরতে গেছিলো | এখন ফিরে এসে অনেক গল্প জমে গেছে |”

আন্তরিক কথাটা শুনে হাসলো | কিন্তু এরপর ও একটা অন্য প্রশ্ন করে উঠলো হঠাৎ | যেটা শুনে মেঘনার চোখগুলোও গোলগোল হয়ে গেলো বিনা নোটিশে | আন্তরিক বেশ কিউরিয়াস মুখ করেই জিজ্ঞাসা করলো মেঘনাকে , ————- ” আচ্ছা , কি গান ছিল ওটা তোমার রিংটোন এ ? কি হৃদয় না রং কি যেন ? রবীন্দ্রসংগীত ? মিউজিকটা বেশ ভালো |”

কথাটা শুনে মেঘনা এবার বিষুম খেলো হঠাৎ | তারপর একটু নিজেকে সামলে কথা সাজিয়ে বললো , ————– ” কথাটা ‘ওরা হৃদয়ের রং জানে না | ওরা মনের গোপন চেনে না |” আর এটা কোনো রবীন্দ্রসংগীত না | অনুপম রায় এর সুর | লগ্নজিতার গান | খুব ফেমাস | তুমি শোনোনি ? কিন্তু তুমি যে হেডফোন লাগিয়ে কাজ করো অনেক দেখেছি !”

এর উত্তরে আন্তরিক একটু এলোমেলো হয়ে বললো , ———— ” না মানে আমি গানের কথা অতো মন দিয়ে শুনি না | তাই কিছু মনেও থাকে না | তুমি লেখিকা | তোমাকে দেখে মনে হলো তুমি রবীন্দ্রসংগীতই শুনবে নিশ্চয়ই ! তাই বললাম | আর আমি হেডফোনে অনলি ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিকই শুনি | যেটার কোনো কথা নেই | ”

কথাটা শুনে মেঘনা যেন আকাশ থেকে পড়লো ! ও একটু জোরেই বলে উঠলো এবার , ———— ” মানে ! তুমি গানের কথা শোনো না ! কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ! লোকজন তো গান শোনেই গানটাকে ফিল করার জন্য | গানের কথাগুলোকে ফিল করার জন্য | গান তো লিরিক্স ছাড়া ইনকমপ্লিট !”

কথাটার উত্তরে আন্তরিক একটু আস্তে গলায় বললো , ———— ” আমি অতো ফিল করার জন্য গান শুনি না | ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক শুনলে আমি একটা অন্য জোন এ চলে যাই | খুব ভালো কনসেনট্রেট করতে পারি যে কোনো কাজে ! তাই শুনি | তুমি চাইলে তোমাকেও হোয়াটস এপ এ লিংক পাঠাতে পারি | শুনে দেখো , ভালো লাগবে |”

না , এর আর কোনো প্রত্যুত্তর খুঁজে পায়নি এরপর মেঘনা | আসলে কিছু কিছু সময় মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় | আন্তরিক সেরকম একটা ছেলে | সবার থেকে একটু না , অনেক বেশি আলাদা | তবে ছেলেটাকে এইভাবে জেনে খারাপ লাগছে না মেঘনার ! বরং ইন্টারেষ্টিং লাগছে | মানে মনে হচ্ছে , যে এতো গুলো বছর ওর সামনে থেকেও অচেনা ছিল , সে আস্তে আস্তে চেনা হচ্ছে | তাই মেঘনা আলতো হেসে উত্তর দিলো , —————- ” হ্যাঁ , নিশ্চয়ই পাঠিয়ো | শুনবো | আর তোমাকেও একদিন আমি এই গানটার মানে ঠিক বুঝিয়ে ছাড়বো | সেদিন তুমিও ফিল করবে |”

কথাগুলো বলতে বলতেই ওরা দুজনেই বোঝেনি সেদিন ঠিক কখন ভিড় রাস্তা কাটিয়ে , জ্যাম , ট্র্যাফিক পেড়িয়ে ওরা বড়বাজারে এসে পৌঁছেছিল ! যাইহোক , আন্তরিক মেঘনাকে একেবারে নয়নদের বাড়ির সামনেই ছেড়ে দিয়েছিলো | ব্যাপারটা নয়ন ব্যালকনিতে বসে বসে খেয়াল করেছিল | আর কি ! মেঘনা ওর সামনে আসতেই তারপর কিরকম এবিপি আনন্দের রিপোর্টারের মতন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর | বেশ কিছু লাইন সাজিয়ে বলেছিলো ,

————— ” কে রে ছেলেটা ? দেখে তো বেশ হাইফাই মনে হলো ! চোখে আবার চশমাও আছে | তুই বলতিস না ,তোর ইন্টেলেকচুয়াল দেখতে ছেলে পছন্দ ! তাহলে কি এ ই সে ? আমার হবু জামাইবাবু ? এই দু সপ্তাহের মধ্যে তুই প্রেমও করে ফেললি আর আমাকে বলিও না !”

কথাগুলো শুনে মেঘনা একটা বড়ো দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বলেছিলো একটু ক্লান্ত স্বরে ,

—————- ” হয়েছে ? শেষ ? হ্যাঁ রে তুই ক্লান্ত হোস না ভেবে ভেবে ? মানে রাইটার তো আমি ! কিন্তু মনে মনে গল্প বানাস তুই ! আর শোন , ও হলো আন্তরিক | প্রফেসর | আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে | অনেক বছর হলো | ওর বাবার কথা তো আগেই শুনেছিস সমরজেঠু | তো কদিন আগে সমরজেঠুর শরীরটা খারাপ হয়েছিল বলে আমি ডাক্তার ডেকেছিলাম | দেখাশুনো করেছিলাম | সেই থেকেই আমার সাথে একটু ভদ্রতা করে হাই হ্যালোর বেশি কথা বলে | আর আজ কলেজ স্ট্রিট আসছিলো , আমাকে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিফ্ট দিলো , এই যা | এর মধ্যে কোনো লাভ স্টোরি , কমেডি স্টোরি , ট্র্যাজিক স্টোরি , কিছু নেই | ঠিক আছে ?”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে মেঘনা এবার দম নিলো | কিন্তু তখন নয়ন আর একটা প্রশ্ন করে উঠলো মাথা খাটিয়ে ,

————— ” কি বলিস ! লিফ্ট দিয়েছে নিজে থেকে ! এটা ডিরেক্ট লাইন | ছেলেটা সিওর তোকে পছন্দ করে | আর আমি যা দেখলাম , দেখতেও তো বেশ ভালো | যে কারোর দেখলে ক্রাশ হয়ে যাবে | তুই এরকম সিরিয়াস না থেকে প্রেমে পরে যা | বুঝলি |”

কথাটা শুনে মেঘনা এবার চোখটা বড়ো বড়ো করেই বললো , ————- ” প্রেম ! তুই পাগল হয়েছিস ! এই ছেলের সাথে ! পুরো অপোজিট আমার থেকে ! আমি উত্তরে গেলে আন্তরিক যাবে দক্ষিণে | ওয়ার্কোহলিক , ইন্ট্রোভার্ট , আর ইভেন গানের কথা শোনে না | অনলি মিউজিক শোনে | গানের কথা ফিল করতে পারে না না কি ! ভাবতে পারছিস তুই ?

শোন , আমার মতন ইমাজিনেটিভ , ভাব রাজ্যে বিচরণ করা একটা মেয়েকে কোনোভাবেই আন্তরিকের পছন্দ হওয়ার নয় | আর সেরকম আমারও | এতো রিয়ালিস্টিক , কাজপাগল ছেলেকে যত ভালোই দেখতে হোক রে , আমি প্রেমে পড়তে পারবো না কখনো | তাই এই টপিকটা এখানেই বন্ধ হলে ভালো হয় | কোল্ড কফিটা দে , নইলে তোর এই ভাট বকা শুনে এমনিতেই মাথাটা গরম হয়ে গেছে |”

শেষ কথাগুলো বেশ অর্ডারের সুরে বললো মেঘনা | এর উত্তরে নয়ন উঠে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে আস্তে গলায় বললো ,

————– ” গরিবের কথা বাঁশি হলে ফলে | দেখবি , এই প্রফেসরই তোর কপালে নাচছে | আর অপোজিট এট্রাক্টস বলে একটা কথাও আছে কিন্তু ডিকশনারিতে | ব্যাপারটা না তোদের ক্ষেত্রে সত্যি হয়ে যায় ! ”

কথাটার উত্তরে এবার মেঘনা নিজের ধৈর্য হারিয়ে একটু চেঁচিয়েই বললো , ———– ” তুই যাবি কোল্ড কফি আনতে ? না কি আমি যাবো ?”

না , আর নয়ন কথা বাড়ালো না এরপর এই টপিক নিয়ে | নইলে শনি নাচবে ওর কপালে | তাই তাড়াতাড়ি মেঘনার সামনে থেকে সরে গেলো কিছুক্ষণের জন্য কোল্ড কফি আনার অজুহাতে | তবে মেঘনা এরপর একলা ঘরে দু সেকেন্ড থমকে গেলো নয়নের ওই শেষ কথাটা ভেবে | অপোজিট এট্রাক্টস ! অনেক সিনেমায় ,উপন্যাসে দেখেছে যদিও এটা ! তবে বাস্তবে থোড়িই না হয় ! বাস্তবে তো প্রেম তার সাথেই হয় , যার সাথে মনের মিল থাকে , ভালো লাগাগুলো মিলে যায় একে অন্যের | তা না , কি সব অদ্ভুত থিওরি ! কথাটা ভেবেই ও আর ভাবনাটাকে বাড়ালো না নিজের | থামিয়ে দিলো মাঝরাস্তায় জোর করে | কারণ বেশি ভাবা মানেই বেশি জরিয়ে পরা | আর একটা অসম্ভব গল্পের মধ্যে নিজেকে জরাবেই বা কেন ও ! যেখানে উল্টোদিকের লোকটা ভীষণ দূরের , একেবারে অচেনা |

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here