ভালোবাসি প্রিয় পর্ব ৪১+৪২

#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৪১
#সুলতানা_সিমা

উপরে যেতে পা বাড়াচ্ছিলো অরিন। কাঁচ ভাঙার শব্দে পিছন ঘুরে ফ্লোরের দিকে তাকালো। পুরো ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটকে আছে কয়েকটা গিফট বক্স। কাঁচের পুতুল একটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। সামনেই পরে আছে বড় একটা টেডিবিয়ার। টেডিবিয়ারের সামনে এক জোড়া পা। অরিন পা থেকে মাথা পর্যন্ত্য তাকালো। চিরচেনা মুখটা চোখে পরতেই ৪৪০ ভোল্টের শকড খেল সে। আকাশ ভেঙে বাজ এসে যেন তাঁর মাথায় পরলো। চোখ কচলে আবার তাকালো অরিন। এখনো এই মানুষটা সে দেখছে। মূহুর্তেই গায়ের পশমগুলা দাঁড়িয়ে গেলো। নিশ্বাস ভারি হয়ে গেলো। খুব দ্রুত শ্বাস ফেলছে অরিন। থরথর করে কাঁপতে লাগল। মাথার ভেতর ভনভন করছে। নিজের চোখে দেখা মানুষটা তাঁর কাছে মিথ্যে মনে হচ্ছে। সামনে যাকে দেখছে আসলে কী সত্যি দেখছে?

আমাদের জীবনে মাঝেমাঝে এমন সময় আসে, যা আমরা সত্যি বলে মেনে নিতে পারিনা। আবার মনের গভীর থেকে চাই, এটাই যেন সত্যি হয়। সময়টা স্বপ্নের মতো লাগে, কখনো দুঃস্বপ্নের মতো,আবার কখনো সুখের স্বপ্নের মতো। তখন যেন চারদিকের সবকিছু আমাদের কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। দিহানের বিশ্বাস হচ্ছেনা তাঁর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। হোয়াইট গাউন পরা অরিনের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই ছয় বছর আগের সেই অরিনের। পা দুটো অবশ হয়ে এলো দিহানের। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো সে। অরিনের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। এ কান্না শুধু কষ্টের নয়, সুখেরও। কতো বছর পরে অরিনের দেখা পেলো। উপরওয়ালা মনে হয় এতোদিনে মুখ তোলে চাইলেন।

উপস্থিত সকলের দৃষ্টি দিহানের দিকে। শাওন এখনো শকডের উপর আছে। অরিনকে দেখছে বলে সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। দিহানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোর ধারা বৃষ্টি ঝরছে। অরিনের মামার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অরিন দু’পা এগুলো দিহানের দিকে। সাথে সাথে তাঁর চোখে ভেসে উঠল সেই দিনের দিহানের সেই নিষ্ঠুরতা। অরিন থেমে গেলো। দিহান উঠে এসে অরিনের সামনে দাঁড়ালো। এইটুকু সময় কেঁদেই তাঁর চোখ লাল হয়ে গেছে। অরিনের দিকে দিহানের হাত বাড়িয়ে দিল। তাঁর হাত কাঁপছে। অরিনের হাত ধরতেই তাঁর শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। সেই চেনা অনুভূতি তাঁর প্রতিটি অঙ্গে প্রতঙ্গে শিহরণ জাগিয়ে তুললো। হৃদকম্পন বেড়ে গেলো। অরিনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাটা গলায় বলল”

_অ অ অ অরি।” অরিন ঠোঁট কামড়ে কেঁদে যাচ্ছে। দিহানের হাতের ছোঁয়া পেয়ে সে একদম শীতল হয়ে গেছে। তাঁর শরীরে যেন এই শক্তি টুকু নেই যে দিহানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াবে। দিহান তাঁর দুহাত দিয়ে অরিনের মুখ তুলে ধরে বলল” ক্ক ক্কই হারিয়ে গেছিলো বলো? ক কতো খুঁজেছি তোমায়? এতই বড় ভুল ছিলো যে আমার থেকে নিজেকে আড়াল করে নিলে?” দিহানের কথা শুনে চট করে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল অরিনের। ধাক্কা দিয়ে দিহানকে দূরে সরিয়ে দিলো। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে নিয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল” মামা কে উনি? বের করে দিন উনাকে।” অরিনের কথায় দিহানের মাথায় বাজ পড়লো। অরিনের বাহু চেপে বলল” অরি কী বলছো তুমি? পাগল হয়ে গেছো? আমি তোমার দিহান।” দিহানের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে অরিন চিৎকার করে বলল”

_ কে দিহান? আমি কোনো দিহানকে চিনিনা। বের হয়ে যান আপনি এখান থেকে।
_খুব রাগ হচ্ছে তাইনা? খুব অভিমান জমে আছে?” অরিনের হাত নিয়ে তাঁর গালে আঘাত করতে করতে বলল”নাও মারো আমায়, ইচ্ছেমতো মারো। তবুও এমন করনা অরি। ছয় বছর পর তোমার দেখা পেয়েছি। পাগলের মতো খুঁজেছি তোমায়। কত বার মরতে গিয়েও ফিরে এসেছি, তুমি ফিরে আসবে ভেবে। ভাবতাম তুমি যদি ফিরে এসে আমায় পাওনা, তখন তুমি অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু তুমি আসনি অরি। একে একে ছয়টা বছর পার হয়েছে,শুধু তোমার পথ চেয়ে। ছোট একটা ভুল অরি, শুধু মাত্র ভুল বুঝাবুঝি। এই ভুলের এতোবড় সাজা? তাহলে তোমার কতটা সাজা হওয়া উচিত? তুমি যে আমাকে জেনে বুঝে কষ্ট দিয়েছো। আমার প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে পালিয়েছো। তোমার কতটা সাজা পাওয়া উচিত বল?
_ছা ছাড়ুন আমায় ছুঁবেন না আপনি। বেরিয়ে যান। দয়া করে বেরিয়ে যান এখান থেকে।” দিহান কান্নাভেজা চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। অরিনের মামা কিছুই বলছেন না। যা আন্দাজ করার তা উনি আন্দাজ করে ফেলছেন। উপস্থিত সকলও চুপ থাকলো। যেখানে অরিনের মামার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই সেখানে তাঁরা কী কথা বলবে? দিহান আবার অরিনের দুহাত ধরলো। অরিনের ইচ্ছে হলো কড়া কয়েকটা কথা শুনাতে, কিন্তু তাঁর স্বামীকে অপমান করতে চায়না সে। তাই সে চুপ থাকলো। তবে তাঁর মনে হচ্ছেনা সে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারবেনা। কয়েকটা কথা দিহানকে বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কথাগুলা ঠোঁটে এসে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু এখন যদি বলে তাহলে তাঁর স্বামী ছোট হবে। তার থেকে না হয় সে নিজেই ছোট হলো।

দিহানের থেকে হাত ছাড়িয়ে, সকল মেহমানের উদ্দেশ্যে বলল” I’m really sorry! আপনাদের সবার মূল্যবান সময় নষ্ট করানোর জন্য আমি লজ্জিত। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আজ কোনো অনুষ্ঠান হবেনা আপনারা এবার আসতে পারেন।” শেষের কথাটা বলতে অরিনের গলা কেঁপে ওঠে। নিজেই দাওয়াত দিয়ে আবার নিজে তাড়িয়ে দিলো। বিষয়টা তাঁর নিজের কাছেও কেমন জানি লাগছে। একে একে সবাই চলে গেলো। দিহানের দিকে কঠিন চোখে তাকালো অরিন। দিহান তাঁর দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। দিহানের কান্নাভেজা চোখে অরিনকে দেখার তৃষ্ণা ফুটে ওঠছে। অরিনের চোখ শীতল হয়ে এলো। কঠিন কথাগুলা জিভে এসে আবার পেটে চলে গেলো।

দিহান অরিনকে বলল” আমার বাচ্চা কই অরি?” দিহানের প্রশ্নে জ্বলে ওঠল অরিন। এই কষ্ট তাঁকে সব ভুলে যেতে দেয়না, বাচ্চার কষ্ট। অরিন রাগে ফুঁসতে থাকলো। দিহান আবার জিজ্ঞেস করলো ” বলো অরি, কই আমার বাচ্চা?” অরিন শাওনকে উদ্দেশ্য করে বলল” ভাইয়া, আপনার ফ্রেন্ডকে নিয়ে এখান থেকে যান প্লিজ।

দিহান রাগে একটা ফুলের টব নিয়ে আছাড় মেরে ফেললো ফ্লোরে। আচমকা রেগে যায় দিহান, এটা অরিনের অজানা নয়। কিন্তু তাঁর রাগ যে এর থেকেও দিগুণ। দিহান অরিনকে চেঁচিয়ে বললো “জবাব দাওনা কেন,কই আমার বাচ্চা? ” দিহানের থেকে কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে অরিন বললো”

_গলা নিচু করে কথা বলুন মিষ্টার দিহান চৌধুরী। আপনার রাগ দেখতে আমি বসে নেই। আপনার বাচ্চা? আপনার? আপনার বাচ্চা না। শুধুমাত্র আমার বাচ্চা।
_শুধুমাত্র তোমার বাচ্চা? এ বাচ্চার উপর আমার কোনো অধিকার নেই?
_না নেই। কোনো অধিকার নেই আপনার।
_দেখো অরি আমি রাগ করতে চাইনা। আমার বাচ্চা কই?
_আজ কেন বাচ্চার খোঁজ নিতে এসেছেন? আপনার মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন আপনার বাচ্চা কই।
_আমার মাকে টানছো কেন? আমার বাচ্চা কোথায়?

_বাহ মাকে টানতে কলিজায় লাগছে তাইনা? আপনি জানেন আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম, এটা শুনে যে আমি প্রেগন্যান্ট? আমি আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম আমি। মনে মনে কত কত প্ল্যান করে ফেলছিলাম মূহুর্তেই। হ্যাঁ আপনাকে আগে শুনাবো ভাবলেও আগে আপনাকে শুনাতে পারিনি আমি। আগে শুনিয়েছিলাম আপনার মাকে। উনি আমায় কী বলেছিলেন জানেন? অ্যাবরশন করাতে। “দিহানের মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। তাঁর মা তাঁর বাচ্চাকে মেরে ফেলতে বলছিলো? অরিন আবার বলল” একটা মা হয়ে তাঁর সন্তানের অনাগত বাচ্চাকে কীভাবে মেরে ফেলতে বলে? আর এটা তো আপনার অস্তিত্ব ছিলো। আপনার ভালোবাসার চিহ্ন ছিলো এটা। উনি কীভাবে এটা বলতে পেরেছিলেন?”একটু থেমে লম্বা দম ছাড়লো অরিন তারপর আবার বললো” জানেন আমি তবুও উনার কথা কানে নেইনি, আমি ভাবলাম আমার স্বামী তো খুশি হবে, তাহলে কে কী বললো না বলল এসব কেন আমি খুঁজবো। কিন্তু না, আমার স্বামী নিজ হাতে আমায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করালো। একটাবার কী জিজ্ঞেস করতে পারতেন না আপনি,আমি খুন করেছি কিনা? চোখ বন্ধ করে যাকে বিশ্বাস করেন বলেছিলেন, তাঁকে চোখ খোলা রেখেই আসামি বানিয়ে দিয়েছিলেন। আপনি না-হয় জানতেন না আমার পেটে আপনার বাচ্চা ছিলো। কিন্তু আপনার মা তো জানতেন। কই, তিনি তো একবারও আমায় আটকানোর চেষ্টা করেননি। দুই দুইটা দিন আমি জেলে ছিলাম। কই,আপনারা কেউ তো একবারও আমায় গিয়ে দেখেন নি। আপনারা সবাই চেয়েছিলেন আমি যেন ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলি। আরে লুপা ওতো পারতো সবকিছু সমাধান করে দিতে,কিন্তু করেনি। আসলে কী জানেন? আপনারা কেউ কখনো আমায় মানুষ বলেই ভাবেন নি। সব সময় সবাই আমাকে নর্মদের কিট ভেবেছেন। আজ দেখুন মিষ্টার দিহান, আমি একজন সাফল্য ডক্টর। আজ কেউ বলতে পারবে না আমি অযোগ্য। বলুন আপনার মাকে এসে বলতে,আমি রাস্তার মেয়ে। কেউ পারবে না বলতে আর। আজ আমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত। না কোনো বস্তির মেয়ে আর কোনো রাস্তার মেয়ে।

অরিনের কথাগুলা শুনে দিহান বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। অরিনকে অনেককিছু বলার আছে। অনেক প্রশ্নের উত্তরও আছে কিন্তু সে বলতে পারছেনা। সব কথা গলায় এসে দলা পেকে গেছে। বার বার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছে তাঁর।

দিহান অরিনের সামনে হাত জোড় করে বসলো। তারপর ভেজা কণ্ঠে বললো” মায়ের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি অরি। আমি জানতাম না অরি বিশ্বাস করো। নয়তো ভুলে আমার মা হন। যে মা তাঁর সন্তানকে সন্তান হারা করতে চায় সে মা মা হয়না। আর আমি কীভাবে ক্ষমা চাইবো বলো। কীভাবে ক্ষমা চাইলে আমায় ক্ষমা করবা? ছয় বছর কম নয় অরি। অনেক অনেক যুগের সমান। এতটা দিন আমায় কষ্ট দিয়েছো, এবার ক্ষমা করে দাও প্লিজ। সেদিন যদি একবার পিছন ফিরে থাকাতে তাহলে তুমি দেখতে অরি। তোমার দিহান কুকুরের মতো ছুটাছুটি করছে। শুধুমাত্র তোমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। শুধু একটাবার পিছন ফিরে তাকালে তুমি দেখতে অরি দিহান তোমার অভাবে মেন্টাল হসপিটাল পর্যন্ত গিয়েছে। সব থমকে গিয়েছে অরি শুধু তুমি নাই বলে। এতোদিনে আজ তোমার দেখা পাবো আমি ভাবিনি অরি। প্লিজ আর দূরে ঠেলে দিওনা। একবার বেঁচে গেছি বলে বার বার বাঁচতে পারবোনা আমি অরি। প্লিজ অরি ফিরে আসো আমার জীবনে আবার। প্লিজ।” ডুকরে কেঁদে উঠল দিহান। অরিন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে তাঁর। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। দিহানের কান্না সয্য হচ্ছেনা তাঁর। জোড় হাতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে দিহান।

হঠাৎ অজনির গলা এসে কানে বিঁধল। মাম্মাম মাম্মাম বলে ডাকছে। দিহান চোখ তোলে তাকাল। অরিনের সাথে ম্যাচিং করে সেইম একটা হোয়াইট গাউন পরা। সাথের একটা ২০-২১বছরের একটা মেয়ে আছে। খুব চেনা চেনা লাগছে তাঁকে। অজনি দৌড়ে এসে অরিনের কোলে উঠে বলল”মাম্মাম দেখোনা খাম্মনি আমায় বকে। আমি সাজবো না গো মাম্মাম। খাম্মনি সাজতে বলে।” অজনির কথা শুনে দিহানের চেহারা জ্বলজ্বল করে উঠল। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখা ফুটে উঠলো। অজনি তাঁর মেয়ে?

দিহান শাওনকে বলল “শা শা শাওন অ অ অজনি আমার মে মেয়ে।” খুশিতে গলায় কথা আটকে গেছে দিহানের। এতো বেশি খুশি লাগছে যে চোখ দিয়ে টুপ করে খুশির অশ্রু ঝরে পরলো। কষ্ট খুশির জল একাকার হয়ে তাঁরাও যেন হাসছে। ভেজা গাল চিকচিক করছে তাঁর। অজনি দিহানকে দেখে বিশ্বজয়ী হাসি দেয়। দিহানের কাছে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই অরি থামিয়ে দেয়। চোখ গরম করে মেয়ের দিকে থাকায়। অজনি চুপসে গেলো। সে তাঁর মাকে খুব মানে। দিহান অরিনকে ধমক দিয়ে বলল”

_ অরিন তুমি আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে রাখতে পারো না।
_আমি আমার মেয়েকে কোথায় রাখবো না রাখবো সেটা আমি জানি। এবার আপনি আসতে পারেন।
_বাড়াবাড়ি করছো অরি,যা মোটেও আমার পছন্দ না।
_হ্যাঁ করছি বাড়াবাড়ি তো কী করবেন আপনি? চিনিয়ে নিবেন? তাহলে নিন। ও যদি আপনার কাছে যায় তাহলে নিয়ে নিন।” অরিন অজনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। অরিনের মামা এগিয়ে অজনিকে নিতে চাইলেন কিন্তু অরিন হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। তাঁর পুরো বিশ্বাস আছে তাঁর মেয়ের উপর। সে জানে আর যাইহোক তাঁর মেয়ে তাঁর হুকুম ছাড়া একটুও নড়বেনা। ছোট হোক তাতে কী তাঁর মেয়ে যথেষ্ট বুঝদার। মায়ের কথার অবাধ্য কখনোই হয়না সে। মা চোখ রাঙিয়েছে, মানে মা নিষেধ করছে এটা তাঁর ছোট মাথায় ঢুকে গেছে।

দিহান অজনির সামনে বসলো। অজনির দুগাল ছোঁয়ে স্নেহমাখা চোখে তাকিয়ে থাকলো। এই এঞ্জেলটা তাঁর? কত্ত কিউট একটা বাচ্চার বাবা সে। বিশ্বাস হচ্ছেনা দিহানের। স্বপ্নের মতো লাগছে সব। মেয়ের গালে কপালে অসংখ্য চুমু এঁকে দিলো। যেন সাত রাজার ধন পেয়েছে সে। অজনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চোখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে দিহানের কোলে উঠতে চায়। দিহান অজনিকে কাঁপা কোমল গলায় বলল” পা পা পাপা আমি তোমার। তো তো তোমার পাপা। একবার পাপা বলে ডাকবা?” অজনি অরিনের দিকে তাকাল। অরিন ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দিহান আবার বললো “প্লিজ,একবার পাপা বলে ডাক দাও। তুমি যা চাইবে তাই এনে দিবো আমি। প্লিজ একবার পাপা বলে ডাকো।” দিহানের গলা কাতর। কাকুতি স্বর। অজনি এবারও চুপ। দিহান বলল” ঠিক আছে ডাকতে হবেনা পাপার সাথে চলো। পাপার সাথে থাকবে তুমি।” অজনি নড়লো না। শুধু শূন্য চোখে দিহানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। দিহান অনেকবার বলেও কোনো লাভ হলোনা। অরিন অজনিকে কোলে নিয়ে বলল” এবার যান।

_যাবোনা। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো।
_আমি দিবো না। ও যদি যায় তাহলে আপনি নিতে পারেন। কিন্তু আপনি চেষ্টা করেও ওকে নিতে পারেন নি। তাই দয়া করে এবার যান। ” দিহান কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো। তারপর বলল”
_হুম যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার আসবো। আমার সন্তান আমি আমার কাছে নিবোই নিবো। সাথে বউকেও।”

অরিনের কোলে রাখা অজনির গালে একটা চুমু খেল। মাথা নিচু করে চুমু দেওয়ায় দিহানের চুল অরিনের গাল ছুঁয়ে গেল। দিহানের একটা হাতে অজনিকে ধরছে। সেই হাতটাও কিছুটা ঘষা লাগে তাঁর হাতে। কেমন জানি একটা শিহরণে কেঁপে ওঠল অরিন। অজনির গাল থেকে মুখ তোলে অরিনের দিকে তাকালো দিহান। দুজনের চোখে চোখ পরতেই অরিন চোখ নামিয়ে নিলো। খুব কাছাকাছি আছে দুজন। দুজনের নিশ্বাসের তীর দুজনের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেটা জেনো গা ছুঁয়ে কলিজায় গিয়ে বিঁধছে। জেগে উঠছে মনের পুরনো অনুভূতি। ভারি নিশ্বাসের শিহরণ। অরিন আবার চোখ তোলে তাকালো। দিহান এখনো তাকিয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিলো সে। দিহান আর দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে।

শাওন এগিয়ে এসে অরিনকে বলল” কেমন আছো অরিন?” অরিন জবাব দিলোনা। শাওন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল” অতীত ভুলে যেতে শিখো অরিন। নয়তো জীবনে যতই এগিয়ে যাবে তোমার এক পা পিছনে থেকেই যাবে। যেটা তোমাকে সামনে এগুতে দিবেনা। অতীতের দুঃসময়গুলো যত মনে করবে, ততই তুমি পোড়বে আর ততই তোমার মনে জাগবে ক্ষোভ। আর সেই ক্ষোভ নিয়ে চলতে গিয়ে হারিয়ে ফেলবে তুমি তোমার জীবনের সুন্দর মূহুর্তগুলা। যা অবশেষে আফসোস হয়ে সামনে দাঁড়াবে। তাই অতীতকে ছুঁড়ে ফেলে বাঁচতে শিখো। দেখবে সব কিছুই সুন্দর। আসছি আজ। বাই।
#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৪২
#সুলতানা_সিমা

আজ শামুরা ইন্ডিয়া ব্যাক করবে। তাঁর চাচাদের পরিবার জানেনা তাঁর বিয়ের কথা,সবাইকে তো জানাতে হবে। আর তাছাড়া,শামুর মায়েরও কিছু টাকা দরকার। বিয়ে নীলদের এখানে হলেও, উনাকে ওতো ছোট করে একটা আয়োজন করতে হবে। সন্ধ্যায় রওনা দিবেন উনারা। এখন দুপুর ১১টা বাজে। নীলের মা চান টুকটাক শপিং এখনই করে ফেলতে। তাই সকালে নাস্তার টেবিলে বসে তিনি নীলকে বললেন শামুকে নিয়ে যেন শপিংয়ে যায়। নীল কোনো জবাব দেয়নি,চলে যায় তাঁর রুমে। রাগে তাঁর মাথা ফেটে যাচ্ছে। তাঁর মায়ের এমন বারাবাড়ি তাঁর অসয্য লাগছে। কিছুক্ষণ পরে নীলের মনে হলো এভাবে চুপ থেকে কোনো কিছুই হবেনা। তাঁর মায়ের সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে। উনাকে বুঝিয়ে বললে অবশ্যই বুঝবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। নীল উঠে তাঁর মায়ের রুমে গেলো।

নীলের মা আলমারিতে কী একটা খুঁজছিলেন যেন। নীলকে দেখে বললেন “আরে নীল। আয় বস এসে।” নীল খাটে গিয়ে বসলো। উনি এখনো খুঁজাখুঁজি করছেন। নীল মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো। কথাটা তাকে বলতেই হবে। এভাবে চুপ করে থাকলে বিয়েটা হয়েই যাবে। শামুরা ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে বিয়ে ভেঙে দিতে হবে। নয়তো বিষয়টা বড় হয়ে যাবে। সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়ে যাবে, শামুদের সবাই বিয়ের কথা জেনে যাবে। তখন বিয়ে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হবেনা। আর এখন যদি হয়, তাহলে তাঁদের নিজেরাই বিষয়টা মিটমাট করে নিবে।

নীলের মা এসে নিলের সামনে বসে ফোঁস করে দম ছাড়লেন। শান্তির দম যাকে বলে। মনে হয় যা খুঁজেছিলেন পেয়ে গেছেন। নীলের মা নীলকে বললেন “আমি এখনি তোর কাছে যেতাম। বল কী বলবি?” নীল হাত বাড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে গ্লাসটা নিয়ে পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলো। তারপর গলা কিঞ্চিৎ ঝেড়ে বলল ” আম্মু আমি এ বিয়ে করবো না।” নীলের মায়ের কপাল কুঁচকে গেলো। স্বাভাবিক স্বরেই বললেন “কেন রে, তোর কোনো মেয়ের সাথে রিলেশন আছে?”নীল বলল” আম্মু তা নয় আসলে আমি এ বিয়েটা করতে পারবো না। দেখো আম্মু শামুর সাথে আমার যায় না। ওঁর চলাফেরা একটু অন্য রকম যা আমার পছন্দ না।” নীলের মা মৃদু হাসলেন। নীলের গালে হাত রেখে বললেন” সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।

_আম্মু প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো। মনের উপর জোর করে কিছু হয়না আম্মু। যা হয় তা কখনো মনে সুখ দেয়না।
_তোকে একটা গল্প বলি আগে। তোর মায়ের গল্প। জানিস,তোর বাবা যখন আমায় বিয়ে করে আনে,তখন সে বিয়েতে রাজি ছিলোনা। কারণ আমি স্কুলের টিচার ছিলাম। তোর বাবার মন্তব্য ছিলো, আমি একা একা চলাফেরা করেছি,আমি পুরুষের সাথে কথা বলেছি,তারমানে আমি চরিত্রহীন। বিয়ের দুদিন পর সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো। ফিরে আসলো ৬মাস পরে। আমার সাথে অনেক খারাপ আচরণ করতো। শুধুমাত্র এজন্য যেন আমি চলে যাই বাড়ি ছেড়ে। বিয়ের দুবছর পর যখন আমার পেটে এলি। তোর বাবা তখন অন্যরকম হয়ে গেলো। আমার যত্ন সে নিজ হাতে করতো। কোল আলো করে যখন তুই এলি। তখন সে একদম বদলে গেলো। আমার সাথে তোর চাচিরা দাদী দূর্ব্যবহার করতো বলে আমায় নিয়ে পরিবারে কথা কাটাকাটি করে আলাদাও হয়ে গেছিলো। তখন তোর বাবা আমাকে বলতো, সে জীবনে অনেক বড় ভুল করেছিলো আমাকে না চিনে।

এইটুকু বলে গলা ধরে এলো নীলের মায়ের। একটু চুপ থেকে আবার বললেন” জানিস নীল। তোর বাবার ভালোবাসা আমার কপালে বেশিদিন টিকেনি। তুই হাঁটতে শিখিসনি তখনই তোর বাবা মারা যায়। একা একটা ঘরে তোকে নিয়ে থাকাটা ছিলো অনেক বিপদজনক। কতশত কালো হাত ছিলো তোর মায়ের দিকে বাড়ানো। কী আর করতাম, লাজ লজ্জা ভুলে আবার তোর চাচাদের পরিবারে গিয়ে উঠি। উনারা আমাকে আশ্রয় দেয় ঠিকি, কিন্তু অনেক কথা শুনায়। তারপর আমি হয়ে যাই তোর চাচাদের বাড়ির বুয়া। একটা বিধবা নারীর জীবন কতটা কষ্টের হয় আমি হারে হারে টের পেতাম। এত কষ্ট পাওয়ার পরে দিন শেষে মনের দুঃখগুলো কাউকে বলতে পারতাম না। ছোট তোর সাথে এসে বলতাম। তুই ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতি। তোর নানু ভাই আমায় বলতো আমি যেন সব ফেলে চলে যাই। কিন্তু তোর মামারা বলতো তোকে না নিতে। তোকে ছাড়া আমি কেমনে যেতাম। আল্লাহ যে আমায় একটা বাচ্চা নয় একটা চাঁদ দিছে। তোর বয়স পাঁচ বছর। তখন তোর ছোট চাচ্চুকে বিয়ে করাতে মেয়ে দেখছিলো। সে ঘরে জানায় সে আমাকে বিয়ে করবে। কথাটা শুনে ওইদিনই আমি তোর ফুপিকে খবর পাঠাই। পরিবারে এই একটা মানুষ ছিলো যে আমায় বুঝতো। তোর ফুপি আমায় বলে পালিয়ে যেতে। একটা ঠিকানা দেয় আমায়। বলে ওইখানে গিয়ে উঠতে। আমিও কথামতো পালিয়ে যাই। তারপর গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পরে আমি কোনো পুরুষের সাথে পালিয়ে গেছি। আমার তাতেও দুঃখ হয়নি। আমি যে তোর বাবার স্থান অন্য কাউকে দেইনি এটাই আমার কাছে অনেক ছিলো। তোর ফুপি আমায় নিয়ে কুমিল্লা আসে। এখান থেকে তোর নানুভাই এসে আমায় নিয়ে যায়। ওখানেও তোর মামিরা অনেক জ্বালাতো আমায়। কিন্তু কিছু বলতাম না তোর মুখ দেখে দেখে সব কষ্ট মুছে দিতাম। তারপর পাইমারি স্কুলে একটা চাকরি পাই আমি। আস্তে আস্তে দিন বদলাতে থাকে আমার। এতো কষ্টের পরেও আমি ভাবতাম আমার ছেলে একদিন বড় হবে, আমার সব কষ্ট দূর করে দিবে। দেখ আজ তুই বড় হয়েছিস। আমার আর কোনো কষ্ট নেই।

নীলের মা চোখের পানিটা মুছে নিলেন। নীল বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। তাঁর মায়ের জীবনটা এতো কষ্টের ছিলো যা তাঁর নিজের চোখে দেখা। এজন্যই সে এই হতভাগী মাকে কষ্ট দিতে পারেনা। কীভাবে এখন সে তাঁর কথাটা মুখ ফুটে বলবে। নীলের মা আবার বললেন” তোর ডাইরিতে আমি দেখলাম তুই দিহানের চাচাতো বোন লুপাকে ভালোবাসতি। লুপাকে আমি কখনো দেখিনি। দিহানের মাকে ফোন দিলাম, উনি জানালেন লুপারা আলাদা হয়ে গেছে। তাঁদের এতো সুন্দর পরিবার ভেঙে যাওয়ার পিছনে এই লুপার হাত আছে। সবকিছু শুনার পরে আমি হতবাক হয়ে গেছিলাম। এইটুকু মেয়ে কী করে এমনটা করে। তারপর খেয়াল করলাম এই মেয়েটা প্রতিদিন আমাদের বাসার নিচে আসে। আমি ভাবলাম তোকে নিষেধ করবো মেয়ের সামনে না যেতে। যদিও তুই যেতিনা। হঠাৎ একদিন তুই বাসাটাই চেঞ্জ করে দিলি। মনে মনে খুশি হলাম। যাক এমন মেয়ের থেকে তুই নিজে থেকেই দূরে গেলি। আমি কখনো এই মেয়েকে মেনে নিতে পারতাম না। “মেনে নিতে পারতাম না কথাটা তাঁর বুকে এসে বিষাক্ত তীরের মতো গাঁথল। নীল শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করল। নীলের মা আবার বললেন” তুই ইন্ডিয়াতে যাওয়ার আগে তোর পছন্দ কেউ আছে কিনা জানতে চাইলে তুই না বলিস। খুশিতে তো আমি আত্মহারা হয়ে যাই। শামু মেয়েটা অনেক মিষ্টি। মেয়েটাকে আমার অনেক ভালো লাগে। হ্যাঁ একটু অন্য রকম চলাফেরা করে। বাট এসব ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ বাহির থেকে যেমনই হোক নীল, ভেতর থেকে সে অন্যরকম হয়। বাহির দেখে কখনো ভেতর চেনা যায়না। ভিতর চিনতে একসাথে থাকতে হয়। তোর বাবার মতো তোরও মনে হচ্ছে শামু মেয়েটা খারাপ। কিন্তু দেখবি একসাথে থাকতে থাকতে ও তোর মনের মতো হয়ে যাবে। শামু মেয়েটা অনেক ভালো রে, তোর জন্য সে নিজেকে বদলে দিবে দেখিস। যা এবার মেয়েটা কে নিয়ে শপিংয়ে যা।

নীলের বুকটা ভারি লাগছে। বুকের উপর যেন কেউ পাথর চেপে রাখছে। নিশ্বাস নিতেও তাঁর কষ্ট হচ্ছে। মায়ের মুখে এসব শুনেও কী করে সে আবার বলবে, মা আমি করবো না এ বিয়ে। আমি ভালোবাসি লুপাকে। নিজে সুখে থাকার জন্য কী করে মাকে কষ্ট দিবে? নীলের চোখ দিয়ে মনে হয় এখনই অশ্রুবর্ষণ হবে। আর বসে থাকলো না, বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো নিজের রুমে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে তাঁর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

অনেকক্ষণ পরে শামুকে নিয়ে শপিংয়ে গেলো। শামু একটা শাড়ি পরেছে সিলভার কালার। শামুকে ভালোই মানিয়েছে শাড়িটাতে, কিন্তু নীলের কাছে মোটেও তা লাগছে না। কেন জানি তাঁর চোখে ছ’বছর আগের লুপার সেই শাড়ি পড়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠল। কত সুন্দর লেগেছিলো লুপাকে। একদম পরিদের মতো। শপিংমলে এসে গাড়ি থেকে নামলো নীল। নেমেই তাঁর সামনে পড়ে গেলো লুপা। দুজন দুজনকে দেখে থমকে গেলো। লুপা অপলক দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে নীলের দিকে। নীল চোখ সরিয়ে নিলো। শামু গাড়ি থেকে নেমে এসে নীলের সামনে দাঁড়াতেই বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে লুপার। শামু লুপাকে দেখে বলল”
_ আরে লুপা।” লুপা ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা টানলো কিছুই বললো না। শামু লুপার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল”
_কেমন আছো লুপা?
_জ্বি আপু ভালো।
_তুমি আমাকে আপু ডাকো কেন? আমরা তো সেইম এজ।
_হুম।” লুপা আড়চোখে একবার নীলের দিকে তাকালো। নীল তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে তাকাতেই নীল চট করে নিজের চোখ সরিয়ে ফেলল। লুপার চোখে সাংঘাতিক মায়া জড়ানো। এই চোখে চেয়ে থাকলে সে আটকে যাবে লুপার নেশায়। শামু লুপাকে বলল”

_তুমি কী কিছু কিনতে এসেছিলে?
_হুম। আসছি আমি। বাই।
_আরে কই যাবে আমাদের সাথে তুমিও আসো।” লুপা নীলের দিকে তাকাল। এবারও নীল তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলো।
_আমার হাতে সময় নেই। হসপিটাল যেতে হবে।
_একটু দেরি হলে তেমন কিছু হবেনা। আর হ্যাঁ তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি এই মাসের পঁচিশ তারিখ আমার আর নীলের বিয়ে। তোমার দাওয়াত রইলো কিন্তু। “লুপা অবাক হলো। তাহলে সে ভুল ধরেছিলো যে নীল বিয়ে করে ফেলছে। তারমানে এখনো বিয়ে হয়নি? লুপার মনের ঘরে এককোণে যেন আশার আলো জ্বলে ওঠল। নীলের দম বন্ধ হয়ে আসছে। লুপার সামনে থাকলে তাঁর ফিলিংস গুলা কই থেকে এসে যেন তাঁকে ঝেকে ধরে। নীল শামুকে তাড়া দিয়ে বলল” শামু চলো। আমার দেরি হচ্ছে।
_হ্যাঁ এইতো। চলনা লুপা প্লিজ। তুমি আমাকে চুজ করে দিবে শুধু প্লিজ।
_হুম।”

লুপাও শামুদের সাথে আবার শপিংমলে ঢুকলো। তাঁর মূল উদ্দেশ্য নীলের সাথে কথা বলা। কিন্তু নীলের খুব অস্বস্তি লাগছে। এভাবে লুপার সামনে থেকে ও তাঁর সাথে কোনো কথা না বলে থাকাটা অনেক কষ্টকর। শামু লুপাকে সাথে আনলেও তিনটা শাড়ি কিনে ফেলেছে লুপাকে জিজ্ঞেসই করেনি শাড়িটা কেমন হবে। অনেক ঘুরাঘুরি করেও শামুর আর কিছুই পছন্দ হচ্ছেনা। থার্ডফ্লোরে গিয়ে একটা শাড়িতে চোখ আটকে গেলো নীলের। লুপা যদি শাড়িটি পরে তাহলে কতটা সুন্দর লাগবে চোখ বন্ধ করে ভেবে নিলো নীল। তাঁর কল্পনায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে লুপাকে। লাল রংয়ের শাড়ি পরে লুপা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে,তাঁর হাত ভর্তি লাল চুড়ি আলতা দিয়ে দুহাত রাঙানো পায়েও আলতা পরেছে লুপা। হঠাৎ একটা ধমকা হাওয়া এসে লুপার পেটের উপর থেকে শাড়ি সরে গেলো। ধবধবে সাদা পেট এসে নীলের চোখে লাগতেই চোখ খুলে ফেললো নীল। নিজে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো সে। লুপার জন্য শাড়িটা নিয়ে নিলো সে। কখনো সুযোগ পেলে দিয়ে দিবে। শামু শাড়ি দেখতে দেখতে একটু দূরে চলে গেলো। তাঁর কোনো খেয়াল নেই অন্যদিকে। নীল যেখানে আছে এখানে কেউ নেই। লুপা নীলের হাত ধরে একটু সাইডে নিয়ে এসে চট করে নীলকে জড়িয়ে ধরলো। নীলের শরীরে যেন কারেন্ট শকড লাগলো। হার্টবিট বেড়ে গেলো তাঁর। বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসার অতিক্রম। কপালে বিন্দু ঘাম জমে গেলো।

লুপা নীলকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। নীল লুপাকে ছাড়াতে চাইলো লুপা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরল নীলকে। খামচি দিয়ে ধরায় নীলের পিঠে লুপার নক গুলা যেন গেঁথে গেলো। নীল আহহহহ বলে আর্তনাদ করে উঠতেই হাত সরিয়ে ফেলল লুপা, তবুও ছেড়ে দিলোনা নীলকে। যেন ছেড়ে দিলেই নীল হারিয়ে যাবে সে। নীল নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল” ছাড়ো লুপা। মানুষজন দেখবে।” লুপা কাঁদতে কাঁদতে কাটা গলায় বলল ” বিয়েটা করবেন না প্লিজ। এখনো অনেক সময় আছে, প্লিজ বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি পারছিনা আপনায় ভুলে যেতে। খুব ভালোবাসি আপনাকে। খুব বেশি ভালোবাসি বিশ্বাস করুন। প্লিজ বিয়েটা ভেঙে দিন প্লিজ।
_বিয়ে করে নাও ঠিক হয়ে যাবে।
_আপনাকে ভুলতে পারছিনা যে কী করবো বলুন।
_ভুলার চেষ্টা করো পারবে।
_অনেক চেষ্টা করেছি পারিনি। আর পারবোও না। প্লিজ বিয়েটা ভেঙে দিন।
_আমি শামুকে ভালোবাসি।” লুপার হাতের বাঁধন হালকা হয়ে আসলো। নীলকে ছেড়ে দিয়ে নীলের চোখের দিকে তাকালো লুপা। লুপার কান্নাভেজা চোখ দেখে নীলের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। এই চোখের পানি দেখার মতো সাহস তাঁর নেই। লুপা কাতর গলায় বললো ”
_আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?” নীল কোনো জবাব দিলোনা। লুপা আবার বলল” কী হলো বলুন,ভালোবাসেন না আমায়?”
_না।
_মিথ্যে কেন বলছেন? আপনি আমায় ভালোবাসেন।
_কখনো সেটা বলেছি?” গম্ভীর গলায় বললো নীল। লুপার জবান দিয়ে আর কথা বের হলোনা। সত্যিই তো, কখনো তো নীল তাকে বলেনি নীল তাঁকে ভালোবাসে। তাহলে কেন সে শুধু এটা ভাবছে, নীল তাঁকে ভালোবাসে। নীল বলল”
_পাগলামি করছো তুমি লুপা। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। আর আম্মুও তোমাকে মেনে নিবেনা। কারণ তুমি তোমার সুন্দর পরিবারকে নিজ হাতে ধ্বংস করে দিয়েছ। সেখানে কীভাবে কোনো মা রাজি হবে তাঁর ছেলের জন্য তোমাকে নিতে। তুমি বিয়ে করে নাও লুপা সব ঠিক হয়ে যাবে।” কথাগুলা বলে নীল চলে গেলো এখান থেকে। কথাটাগুলা অনেক কষ্ট করে বলেছে সে,গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না তাঁর। কিন্তু এগুলা না বললে লুপা আরও পাগলামি করতো। অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে কনট্রোল করেছে। আর কিছুক্ষণ গেলে নীল কোনো একটা ভুল করেই ফেলতো। যাকে বিয়ে করতে পারবেনা তাঁকে বুকে আঁকড়ে ধরে কী লাভ?

চোখের পানিটা মুছে লুপা চলে গেলো। কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে। নীল কী সত্যি তাকে ভালোবাসে না। সে কী সত্যিই খুব খারাপ? নিজের শাস্তিও সে পেয়ে। নিজের পরিবার আলাদা হয়ে যাওয়া। সবাই তাকে কথায় কথায় বেইমান বলে গালি দেওয়া। সব বন্ধুরা তাঁর সঙ্গ ছেড়ে দেওয়া। সবার কাছে খারাপ হওয়া। সব তো হয়েছে তাঁর সাথে। তারপরও কী তাঁর শাস্তি শেষ হয়নি?

___________________________

কলিংবেল বেজে উঠতেই হাতের বইটা রেখে টাইমটা দেখে নিলেন অরিনের মামা। বিকেল 4টা বাজে। এ সময় আবার কে এলো। দরজা খোলে দিহানকে দেখে অবাক হলেন তিনি। উঁকি দিয়ে দেখলেন সাথে কেউ আছে কিনা। কেউ নেই শুধু দিহান। দিহান উনাকে সালাম দিলো। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন” ভিতরে আসো।” দিহান ভিতরে ঢুকেই বলল”
_অজনি কই?
_ওঁর আছে।
_কোন রুমটা?” অরিনের মামা আঙুলের ইশারায় রুম দেখিয়ে দিলেন। দিহান চলে গেলো উপরে। দরজা খুলে রুমে ঢুকতেই চোখে পরলো তাঁর দুইটা নীল পরীকে। নীল রংয়ের জামা পরে মা মেয়ে কত সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে। দিহানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। দরজাটা বেজিয়ে অজনির পাশে বসে তাঁর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে অরিনের পাশে গেলো। অরিনের কপালে চুমু দিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালো। সরু নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে । কিছু চুল কপাল থেকে এসে গাল ছড়িয়ে আছে। পাতলা গোলাপি ঠোঁটে দু’একটা চুল এসে পড়েছে। দিহান আলতো হাতে চুল সরিয়ে দিল। অরিন কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল। অপরূপ সৌন্দর্য্যের ভিতর ঢুকে গেছে দিহান। কী মায়াবী তাঁর এই পরীটা। যেন হাজার বছর দেখলেও চোখের তৃষ্ণা মিটবে না। কে বলেছে শুধু ফর্সাতেই সুন্দর্য আছে। সুন্দর তো লুকিয়ে আছে তাঁর এই শ্যামবতীর মাঝে। অরিনের পাশে শুয়ে পরলো দিহান। অরিনকে জড়িয়ে ধরতেই তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। কেউ তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে দেখে কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। দিহানের একটা হাত অরিনের পেটে লাগতেই”আহহহহহহহ”বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। দিহানকে দেখে এক ঝাটকা খেল অরিন। অরিনের চিৎকারে অজনিও উঠে গেলো। অরিন তৎক্ষণাৎ অজনির চোখ ধরে ফেলল। দিহানকে অজনি তাঁর বেডে দেখলে কী লজ্জায় না সে পড়বে। মেয়ে যতই ছোট হোক, এটুকুতো বুঝে তাঁদের মাঝে কোনো পুরুষ তাঁকেনা। অরিন অজনির চোখে হাত রেখে দিহানকে চেঁচিয়ে বলল”
_আপনিইইইইইইইইই।
_হ্যাঁ আমি। কেন? আসতে পারিনা বুঝি?
_আপনি এখানে কেন এসেছেন? যান এখান থেকে।
_আমি তো কাল বলে গেলাম আমি আসবো।
_আমি জানতাম আপনি আসবেন। কারণ আপনার যে আমায় কষ্ট দিতে আরো বাকি আছে।
_বাহ বাহ কী বুদ্ধিমতী তুমি। আমি আসবো তা জানিতে? এজন্যই বুঝি আজ হসপিটাল যাওনি,যদি আমি এসে মেয়েকে নিয়ে যাই।”

অরিন থমথমথমে হয়ে গেলো তারপর চেঁচিয়ে বলল”
_আপনি এই মূহুর্তে বেরিয়ে যান।
_আরে আস্তে,চেঁচামেচি করছো কেন? আর আমার মেয়ের চোখ ছাড়ো। ওঁর চোখ ধরে আছো কেন?
_আমার মেয়েকে আমি যা খুশি তাই করবো। তাতে আপনার কী? যান বের হোন।
_তো, শুধু চোখ ঢেকে রাখলে তো হবেনা, কানও বন্ধ করো। কান দিয়ে তো সব শুনছে, তাইনা?” অরিনের মনে হলো, আসলেই তো কান দিয়ে সব শুনে ফেলছে। চোখ ছেড়ে সে কান চেপে ধরলো। অজনি খুলে তাকিয়ে দিহানকে দেখে বলল”মাম্মাম, এ আমাদের বেডে কেন?” দিহানের হাসি আটকাতে পারলোনা অরিন দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো। “বলোনা মাম্মাম এ এখানে কেনো?” অরিন অজনিকে নিয়ে খাট থেকে নামতে গেলে দিহান অরিনের দুহাত চেপে ধরে। অজনি একটু দূরে সরে যায়। ভয়ার্ত চোখে দিহানের দিকে তাকায়। তাঁর মনে হচ্ছে দিহান এখন তাঁদের মারবে। দিহান অজনিকে বলল” যাও তোমার নানুভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো,আমি এখানে কেন।” অজনি নড়লো না। অরিন নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করছে। অজনি ঠোঁট উল্টে কাঁদোকাঁদো হয়ে তাকিয়ে আছে। তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর মাকে বুঝি এই মেরে ফেলবে। দিহান অজনিকে বলল” অজনি যাও তোমার নানুভাইয়ের কাছে। না গেলে কিন্তু তোমার মাম্মাকে মারবো।” অজনি ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। দুহাতে চোখ কচলে কান্না করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরিন মেয়ের কান্না দেখে আরও রেগে গেলো। দিহানকে রাগান্বিত স্বরে বলল ”
_আমার মেয়েকে ধমক দেওয়ার সাহস আপনায় কে দিলো?
দিহান উল্টো ধমক দিয়ে বলল”
_আমার মেয়েকে আমি ধমক দিয়েছি এখানে বকার দেওয়ার তুমি কে?” অরিন দিহানকে বলল “শুধু জন্ম দিলে বাবা হওয়া যায়না। আমার মেয়ের এমন ফালতু বাবার কোনো দরকার নেই।” বলেই ধাক্কা দিয়ে দিহানকে ফেলে খাট থেকে নেমে গেলো। দিহান অরিনের হাতে হেঁচকা টান দিয়ে আবার খাটে এনে ফেললো। অরিন আবার দিহানকে ফেলে উঠে গেলো। দিহান অরিনকে খাটে ছিৎ করে ফেলে পেটের উপর বসে হাত দুটো খাটে চেপে ধরলো। অরিন আর নড়তে পারছেনা।

দিহান বলল” এবার ছুটে যাও। কী বলছিলে? আমি ফালতু? বলো। আমি ফালতু?” অরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল”
_হাতি কোথাকার উঠেন।
_আগে বলো আমায় ফালতু বললা কেন?
_আপনি যেটা সেটাই বলছি। ছাড়ুন আমায়, নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে।
_ছেড়ে দিবো একটা শর্তে।
_আমি আপনার কোনো শর্ত মানতে পারবো না। ছাড়ুন।
_ঠিক আছে তাহলে আমিও ছাড়বো না।
অরিন আবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল”
_কী শর্ত আপনার? বলে আমাকে উদ্ধার করুন।
_আমার সাথে ঘুরতে যেতে হবে।
_আমি কোথাও যেতে পারবো না।
_তাহলে আমিও ছাড়ছিনা।
_ওকে ফাইন দয়া করে আপনার ৮০কেজি শরীরটা নিয়ে উঠেন।” দিহান অরিনকে ছেড়ে দিল। তারপর বলল যাও রেডি হও। অরিন রুমের বাইরে গিয়েই টাস করে দরজা লাগিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

তানভী অজনিকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু অজনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করেই যাচ্ছে। অরিন এসে তানভীর রুমে ঢুকলো। অজনির বার্থতে এসেছে সে। এসেছে থেকে এই রুমে আছে। অরিন এসেছে দেখেই অজনি কান্না থামিয়ে দেয়। অরিন মেয়েকে কোলে নিতে নিতে তানভীকে বলল” আমি মিনুদের বাসায় যাচ্ছি, দিহান রুমে আছে। আমি ওখানে গিয়ে তোকে কল করবো, তুই দিহানকে তখন দরজা খুলে দিবি। যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে, বলবি আমি অজনিকে নিয়ে কই গেছি তুই জানিস না।
_আচ্ছা ঠিক আছে আমিও ওকে কিছু বলবো না।” দিহানের গলা কানে আসতেই পিছনে তাকিয়ে এক ধাক্কা খেলো অরিন। দিহান রাগি লুকে তাকিয়ে আছে। সে তো দরজা বন্ধ করে এসেছে, এটা আবার কে খোলে দিলো। দিহান রুমে ঢুকে অরিনের হাত চেপে ধরে তানভীকে বলল”এইজন্যই তো বলি তোমাকে এতো চেনা চেনা লাগলো কেন। যাইহোক কেমন আছো জিজ্ঞেস করবো না, বোনের কাছে আছো মানে ভালোই আছো। তোমার ডাইনি মা কেমন আছে নিশ্চয়ই ভালো?
_সম্মান দিয়ে কথা বলুন মিস্টার দিহান চৌধুরী।
_আপনার এতো তেজ কবে থেকে হলো মিসেস চৌধুরী? আগে তো ছিলোনা। বাই দ্যা ওয়ে শালিকা। আজ রাতে তোমার বোন ফিরবে না, আমার ওখানে থাকবে। ভালো থেকো। বাই।

দিহান অরিনকে নিয়ে চলে গেলো। একটা পার্কে গেলো দিহান। তাঁর মেয়ে গোমড়া মুখে বসে আছে, পার্কে গেলে অবশ্যই খুশিতে তাঁর মন খারাপ উঁড়ে যাবে। অজনি আসলেই খুশি হলো। কিন্তু মায়ের চোখ রাঙানো দেখে চুপচাপ বসে থাকলো। দিহান অজনিকে কোলে নিতে চাইলো অরিন দিলোনা কোলে। এমনকি একবারের জন্যেও তাঁর সাথে কথা বলেনি। দিহানের অবশ্য রাগ হলো। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। রাগ যখন করেছে রাগ তো ভাঙাতেই হবে। অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করে দিহানের ক্ষিধা লেগে গেলো। অরিনকে বলল” আমি দুপুরেও খাইনি ক্ষিধা লাগছে চলো ডিনার করে নেই।” অরিন না বলল না। ডিনার করতে তাঁদের নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে আসলো দিহান। দিহান খেয়াল করেনি এটা সেই রেস্টুরেন্ট যেটায় এসে সে বেজ্জত হয়ে ছিলো। মানে অরিনের রেস্টুরেন্ট। একজন ওয়েটার এসে অরিনকে বলল” মেডাম আপনি কষ্ট করে আসলেন কেন? আমাদের বললে আমরা বাসায় নিয়ে যেতাম।
_ও হ্যালো। আমার সাথে কথা বলো।” দিহান কথাটা বলতেই লোকটা দিহানের দিকে একবার তাকিয়ে পাত্তা না দিয়ে অরিনকে আবার বলল” মেডাম বলুন কী লাগবে।
_এই মিয়া সুন্দরী মেয়ে দেখলে শুধু কথা বলতে ইচ্ছে করে?” ধমক দিয়ে উঠে দিহান। ওয়েটার অরিনের দিকে জিজ্ঞাসুক চোখে তাকালো। অরিন ইশারায় বুঝালো। পাগল। ওয়েটার আর পাত্তাই দিলোনা। অরিনকে বলল”মেডাম আপনি কী ডিনার করবেন?
_ওই মিয়া শুধু মেয়ে মানুষের সাথে কথা বলো কেন। আমাকে দেখনা নাকি?
_আমরা ডিনার করতে এসেছি। “বলেই অরিন মেনুটা হাতে নিয়ে অর্ডার করলো।

কিছুক্ষণ পরে তাঁদের খাবার এলো। দিহান প্রথম লোকমা অরিনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। অরিন ভাবলেনহীন ভাবে বসে থাকলো। দিহান মৃদু স্বরে বলল” হাঁ করো বউ।” অরিনের কান্না চলে আসলো। এই মানুষটাকে একবার জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করতে তাঁর। এই মানুষটার ছুঁয়া পেয়ে তাঁর ঘুমন্ত অনুভূতি গুলা জেগে উঠেছে। কিন্তু অভিমানের পাহাড় ঠেলে সে পারছেনা সেই অনূভুতির সাগরে গিয়ে ডুব দিতে।একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। লাল বাতির আলো এসে পরছে তাঁদের উপর। সেই আলোতে অরিনের গালে গড়িয়ে যাওয়া জলটা চিকচিক করে উঠল। দিহানের বুকটা ধুক করে উঠল। আদুরে গলায় বলল “প্লিজ লক্ষীটি কেঁদোনা, কষ্ট হচ্ছে আমার। ভুল করেছি আমি। এই ছ’বছরে অনেক শাস্তি পেয়েছি। আর কতো শাস্তি দিবা বউ? দূরে ছিলা তাই মনকে বুঝাতে পেরেছি, এখন যে তাও পারিনা।” অরিন চোখের পানিটা মুছে অজনিকে খাওয়াতে লাগলো। কোনো কথা বলছে না দিহানের সাথে। বার বার পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। দিহান আবার লোকমা বাড়িয়ে দিয়ে বলল”প্লিজ হাঁ করো।
_আমি খাচ্ছি আপনি খান।” অরিনের অভিমানী স্বরে কান্না মিশে আছে। দিহানের ভিতরে সব কিছু দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। অসয্য বেদনায় চোখ ভিজে গেলো তাঁর। হাত প্লেটের উপর রেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকল। অরিনের সেদিকে খেয়াল নেই। অভিমানের পাহাড় যেন পাথরে পরিনত হয়ে গেছে। অজনিকে খাইয়ে সে মুখে খাবার তুলতে গিয়েও থেমে গেলো। দিহান হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতেছে। অন্যদিকে মুখ করে আছে তবুও বুঝা যাচ্ছে তাঁর চোখ ভরে আছে অশ্রুতে। প্লেটের খাবার যেমন ছিলো তেমনই আছে। এক লোকমাও মুখে তুলেনি। অরিনের কলিজাটা মুছড় দিয়ে উঠল। পার্কে থাকতে বলেছিলো তাঁর ক্ষিধে লাগছে। অরিন এক লোকমা ভাত নিয়ে দিহানের দিকে বাড়িয়ে দিলো। দিহান দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিলো। অরিন হাত সরিয়ে এনে আবার প্লেটে রাখলো। দিহান কান্নাজড়িত গলায় বলল”একবারও কথা বলবেনা আমার সাথে?” অরিন বুঝতে পারলো দিহানের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণটা। আবার দিহানের দিকে লোকমা তুলে দিয়ে বলল”খেয়ে নিন।” দিহান অরিনের হাত ধরে মুখে তুলে নিল। দিহানের চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে এসে অরিনের হাতে পড়লো। বুকটা ফেটে যাচ্ছে অরিনের। এই মানুষটা কতটা ভালোবাসে সে সেটা কেউ কখনো আন্দাজও করতে পারবে না। এই মানুষটার ছোঁয়াতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। তাঁর চোখের চাহনি এসে অরিনের কলিজায় গাঁথে। খুন হয়ে যায় সে এই চাহনিতে। দিহান অরিনের হাতে একটা চুমু খেলো। চোখে জল ঠোঁটে হাসি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাঁকে। অরিন চোখ নামিয়ে নিল। এই মানুষটা খুব পাষাণ খুব কাঁদিয়েছে তাঁকে, বিশ্বাস করেনি তাঁকে, খুব অভিমান জমে আছে মনে।

দিহান এক লোকমা ভাত অরিনকে দিয়ে বলল “এবার না খেলে কিন্তু মাইর দিবো।” অরিন মুখে তুলে নিলো। অজনি সব কিছুই দেখছে। তাঁর অবুজ মনে একটা প্রশ্ন চেপে রাখতে না পেরে, অরিনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো” মাম্মাম তুমি উনাকে খাওয়ালে কেনো?” মেয়ের প্রশ্নে অরিন থমথমে হয়ে গেলো। কী বলবে ভেবে পেলোনা। কিঞ্চিৎ লজ্জাও লাগছে। অরিন চুপ করে থাকলো। দিহান অরিনের দিকে তাকিয়ে আছে অরিন কী বলে শুনতে। অজনি আবার বলল “মাম্মাম বলনা, তুমি উনাকে খাওয়ালে কেনো?” দিহানের কাতর দুটি চোখ এখনো অরিনের দিকে চেয়ে আছে। অরিন দিহানের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল”
_উ উ উনি তোমার পা পা পাপা।

চলবে……।
চলবে….।

পর্ব ছোট হওয়ায় সরি।❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here