#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat
10.
টেবিলে সবাই নাস্তা করতে বসেছে, সকাল আটটার মধ্যে নাস্তার টেবিল রেডি। ফুপি সকাল সকাল নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেছে। খাওয়ার টেবিলে সবাই উপস্থিত আমি বাদে। আমার মন মেজাজ কোনটাই ভালো নেই। দরজার খটখটানির আওয়াজে আমার ধ্যান ফিরতেই উঠে বসলাম আমি, সানা এসেছে। সানার দিক তাকাতেই বুঝলাম যে তার চোখে একরাশ কৌতূহল লুকিয়ে আছে। সে আমার থেকে কিছু জানতে চাই। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম,
‘কিছু বলবি? ‘
সানা জবাব দিলো না বরং আমার পাশে এসে বেশ আয়েশ করে বলল,
‘কিছু একটা তো হয়েছে আমাদের আরুপাখির। নাহলে সে এতো চুপচাপ। ‘
আমি বোঝার চেষ্টা করে বললাম,
‘কি আবার হবে, কিছু হয়নি।’
আমার কথা যে সানা এতো সহজে বিশ্বাস করবে না তা আমি জানতাম বেশ আর হলোও তাই। সানা আমাকে খোচা মেরে বলল,
‘ভাইয়া কিছু বলেছে? রাগ করে আছিস ভাইয়ার ওপর? ‘
আমি রাগ দেখানোর প্রবল চেষ্টা চালিয়ে বললাম,
‘ আচ্ছা আমি কি দু দন্ড চুপ করে থাকতেও পারবো না? সবকিছুতে ওনাকে কেন টানেন সবাই? ‘
আমার কথা শুনে সানা বেশ দমে গেল। ও বেশ আকুতি করে বলল,
‘সরি সরি ভাইয়ার আরুপাখি। আমি সেভাবে বলতে চাইনি। ‘
আমার কাধ থেকে সানার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলাম আমি। সানা এখনো যেন মুখ গোমরা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এতখন হাতে কা/টার মলম লাগিয়ে শুয়ে ছিলাম। আরিশ ভাইয়া নিশ্চয়ই খাওয়ার টেবিলে বসে আছেন তাই আমি খাবো না। ওনার সামনে যেতে আমার ভালো লাগছে না।
আমি ওয়াশরুম থেকে বার হলাম প্রায় দশ মিনিট পর। রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই সানার অনবরত পাইচারি দেখে থমকে গেলাম যেন যদিও এটা নতুন কিছু নয়। সানা কোন কথা ভুলে গেলে যতখন না পর্যন্ত সে সেই কথাটা তার পেট থেকে ওতরাতে না পারে ততখন তার এই পাইচারি থামে না। আর এই মুহূর্তে তার সেই ভুলে যাওয়া কথাটা যে সে আমাকেই বলবে তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমাকে দেখতেই সানা একপ্রকার হামলে পড়লো যেন। আমার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে নিজেও বিছানায় বসলো। আমি ওর দিক চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই ও ভুলসূচক একটা চাহনিতে চেয়ে বললো,
‘আমি এতোটাও ভুলোমন কি করে হতে পারি? কি করে এতো বড়ো কথাটা ভুলে যেতে পারি আমি? হাও স্টুপিড আই এম। ‘
এটা ছিল সানার সূচনা পর্ব, আর শিরোনাম আসতে যে কতো দেরি তা আমার বুঝতে বাকি নেই। তার দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললাম,
‘এত ভনিতা না করে আসল কথাটাও কিন্তু বলা যায়! ‘
সানা উচ্ছাসের সাথে বলল,
‘আরে ফারিন আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে কথাটা। তোকে না বললেই নয়। কালকে সন্ধ্যায় অনেক কিছু ঘটে গেছে যা তোর কাছে এখনো অজানা। ‘
একটা অজানা ধোঁয়াশার আভাস পাচ্ছি আমি, তাই না শুনলেই নয়। আমি এবার নরম হয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম,
‘ কি হয়েছে ওনাদের?’
সানা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো, আর ঠিক কাটা জায়গাটার ওপর। এখন যদি আমি আ উ করি তো সে তার আসল কাজের কথায় ভুলে যাবে। আমি ব্যাথা সহ্য করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, সানা বলতে শুরু করলো।
‘ কালকে ভাইয়াকে জ্বর অবস্থায় ফারিন আপু ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঘোরাঘুরি করতে। অতঃপর ফেরার পর ভাইয়ার জ্বরটা বেড়ে যায়। ভাইয়া ওষুধ খাইনি ততখনেও। দুপুরে খাওয়ার পর ফারিন আপু ওনাকে ওষুধ দিয়েছিল। ভাইয়াকে জ্বরের ওষুধ না দিয়ে উনি ভুল করে মাথা ব্যাথার ওষুধ দিয়েছিল। ভাইয়া নিজেও আর চেক করে দেখেনি কিসের ওষুধ। তোরা যখন চলে আসিস ততখনে ভাইয়া ঘুমিয়ে গেছিল। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ বাজে। গায়ের জ্বরটা ততখনে অনেকটা বেড়ে গেছিল।
ভাইয়া রুম থেকে বেরিয়ে আসলো ফারিন আপুকে এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য যে সে ওষুধের পাতাটা কোথায় রেখেছে। আপু ভাইয়ার কথায় তোয়াক্কা না করে প্রশ্ন করে উঠলো,
‘তোমার ঘরে আর একটা বেলি ফুলের মালা দেখলাম, ওটা কার জন্য? ‘
আরিশ ভাইয়া আপুর কথাটাকে এড়ানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু উনি তো নাছোড়বান্দা। উনি সমান তালে জেদ নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন,
‘ ওটা আমার জন্য কিনলে তুমি আমাকে ওটা দাওনি কেন? ‘
একটা পর্যায়ে গিয়ে ভাইয়া বুঝলো যে এতো সহজে বিষয়টা থেকে তার মুক্তি নেই তাই না পেরে বলেই উঠলেন,
‘ওটা আরুপাখির। ‘
‘আরুপাখি’ নামটা শুনতেই ফারিন আপু রেগে গেলেন আর ধমকের শুরে জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন,
‘ ওই মেয়েটার জন্য তোমার এত কিসের দরদ? তাছাড়া তাকে তুমি এতো বছর যাবৎ পড়াচ্ছ, তোমার তো জানা উচিত যে সে ফুল পছন্দ করে না তারপরও তুমি কেন কিনেছ ওটা তার জন্য? ‘
আরিশ ভাইয়া রেগে গেল। তবুও নিজের রাগটাকে সংযত করে ফারিন আপুকে বললেন,
‘ ও বেলিফুল পছন্দ করে তাই এনেছি। এবার বলো ওষুধ টা কোথায় রেখেছো? আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। ‘
কথাটা শুনে ফারিন আপু ভাইয়ার ঘরের দিকে ছুটে গেলেন, আর ভাইয়ার রুমে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে মাথায় দেওয়ার বেলিফুলটা তখন নষ্ট করতে লাগলেন। ভাইয়া ততখনে রুমে গিয়ে দেখেন উনি একটা মালা নষ্ট করেছেন। ভাইয়া ওনাকে থামতে বললেও উনি থামেননি।
ফারিন আপু হাতের মালাটা নষ্ট করার জন্য উদ্যত হওয়ার সময় বললেন,
‘আমাদের বিয়ের পর ওই মেয়ের প্রতি তোমার এতো আদিক্ষেতা আমি কখনোই সহ্য করবো না। ওর জন্য শুধু তুমি এমন রাগী এমন গম্ভীর। তুমি আগে তো এমন ছিলে না। যবে থেকে ওই মেয়েটা এলো তবে থেকে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে। বেয়াদপ মেয়ে একটা। ‘
কথাটা বলা মাত্রই ভাইয়া ফারিন আপুর হাত ধরে ঘর থেকে বার করে দিলেন আর ফারিন আপুর হাত থেকে তোর হাতের জন্য কিনে আনা বেলিফুলের মালাটা কেড়ে দিয়ে একটা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ আমার মনে কখনো অযাচিত ভাবে ঢোকার চেষ্টা করলেও এই ভাবেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবো এই কথাটা মাথায় রেখো। আমার ওপর তোমার এসব সো কল্ড অধিকার খাটাতে আসলে নেক্টট টাইম আমি ভুলে যাবো তুমি আমার কাজিন। ‘
কথাটা বলে ভাইয়া মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।
এতো কিছুর পরও ফারিন আপু থেমে থাকলেন না। কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর সামনে খালামনির কাছে ফোন করলেন আসার জন্য।
সে নাকি ভাইয়া ছাড়া আর কাওকে মেনে নেবে না। আম্মু ফারিন আপুর কথাতে সায় দেইনি একটিবারও। খালামনি আর খালুমনি তারাও তাদের মেয়ের কথায় তাল দিতেই ভাইয়া পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে সে কখনো ফারিন আপুকে বিয়ে করবে না।কথাটা বলেই ভাইয়া বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে।
তারপর তো ভাইয়া এলো তোদের বাসায় আর তারপর কি হলো তো তুই জানিসই।
সানার কথা শুনে আমি শিউরে উঠলাম রিতিমতো। উনি ফারিন আপুকে সত্যিই এই কথাগুলো বলেছেন? সানার এতগুলো কথা শুনে নিজেকে ভুল প্রমাণিত হতে এক মিনিট ও দেরি করলাম না আমি। কেবল সানার দিকে একবার তাকিয়ে ওড়নার নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। দৌড়ে নীচে গিয়ে খাবার টেবিলের সামনে যেতেই দেখলাম উনি সহ বাবা আর আম্মু বসে আছেন টেবিলে। আমার নাম ধরে আম্মু ডাকতেই উনি কেবল একটা বার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় খাওয়াই মনোযোগ দিলেন। আমি ব্রেডটা কেটে কয়েক টুকরো করে ফেলেছি। ওনার দিক তাকিয়ে থাকলে নিজেকে নার্ভাস মনে হচ্ছে। উনি ওনার মতো খাচ্ছেন। সানা পাশে এসে বসলো। আমার এমন কাজে সে নিজেও বোধহয় অবাক। আমি এক টুকরো খাবার মুখ তুলিনি। ওনার দিকে তাকিয়ে একরাশ সাহস সঞ্চয় করে মিনমিন করে বললাম,
‘আরিশ ভাইয়া! ‘
উনি কেবল আমার দিকে তাকালেন, কোন উত্তর দিলেন না। আমি বুঝলাম যে উনি বাকি কথাটা বলতে বলছেন। আমি দেরি না করে বললাম,
‘আমার আপনার সাথে একটা কথা ছিল। খাওয়ার পর একটু রুমে আসবেন? ‘
উনি আমার কথায় সরাসরি নাচক করে বললেন,
‘যা বলার এখানেই বলো। ‘
আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো, আমি তবুও দমে গেলাম না। পুনরায় বললাম,
‘ আমার স্টাডি রিলেটেড।’
উনি আর কিছু বললেন না। বাবা আম্মু সহ উনি বেশ স্বাভাবিক, শুধু আমার নিজেকেই এমন অস্বাভাবিক লাগছে। আমি নিরবে খেতে লাগলাম। আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। শুধু মনে পড়ছে ওনাকে বলা শেষ কথাটা।
‘আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলুন। ‘
কথাটা মনে পড়তেই আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ওনার মুখের দিকে আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকাতে লাগলাম আমি।
‘আচ্ছা উনি কোনভাবেই আমার থেকে ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলছেন না তো! ‘
কথাটা ভাবতেই খাবার টেবিলে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আমি উঠে দাঁড়াতেই বাবা আম্মু সানা সকলেই চমকে গেল কিন্তু উনি আমার দিকে তাকালেন না বিন্দুমাত্র।
আমি কাওকে তোয়াক্কা না করে বললাম,
‘আরিশ ভাইয়া আপনার সাথে আমার কথা আছে। আমি কাঠগোলাপ গাছে জল দিতে যাচ্ছি। আপনি ওখানে চলে আসুন। ‘
কথাটা বলে না খেয়ে উঠে পড়তেই বাবা অবাক হয়ে বললেন,
‘ মাঝে মাঝে যে কি পাগলামো করে মেয়েটা। ‘
আরিশ ভাইয়া নিজেও আর কিছু মুখে তুললেন না, খাবার ছেড়ে উঠে শুধু বললেন,
‘মাঝে মাঝে না সবসময় পাগলামো করে। ‘
কথাটা আমার কান অবধি পৌছালো না।
কাঠগোলাপ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গাছটায় সাদা ফুলে ফুলে ভর্তি। আমি চঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ওনাকে অনেক কিছু বলার আছে।
হঠাৎ পিছনে কারোর উপস্থিতি অনুভব করতেই ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আরিশ ভাইয়া, আই এম সরি। ‘
উনি গম্ভীরতার মাঝেও একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
‘আমাকে সরি বলার মতো কিছু নেই। আমি কারোর কেও নই। যাই হোক। কালকে থেকে আমার ডিউটি আছে। আমি আর পড়াতে আসতে পারছি না। আর ফুপাকেও বলে দিয়েছি তোমার জন্য নতুন টিচার দেখতে। তোমার আপত্তি থাকার কথাও না। যাই হোক তোমার এইচএসসি র জন্য অগ্ৰিম অল দা বেস্ট। ‘
ওনার এমন কথা শুনে আমার বুক এর ভিতর ধুকধুক করতে লাগলো, সব কথা তালগোল পাকিয়ে গেল আর চোখ ছাপিয়ে চোখ থেকে অনবরত টপটপ করে জল গড়াতে লাগলো। উনি আমার দিক একবার তাকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। অন্য সময় ওনার সামনে কখনো কাঁদলে উনি ধমক দিয়ে কান্না থামিয়ে নিজেই চোখ মুছিয়ে দেন, আজ তার ব্যাতিক্রম। উনি দেখেও না দেখার ভান করতে লাগলেন।
উনি নিরবে চলে যেতে নিলেই আমি ওনার হাত ধারলাম আঁকড়ে। উনি পিছু ঘুরে তাকিয়ে ভ্রু উচিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলেন যে কি হয়েছে।
আমার চোখ থেকে এখনো জল গড়াচ্ছে। আমি ওনার হাতটা শক্ত করে ধরে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ আমার আপনাকেই লাগবে। আমার জীবনের শেষ সময় অবধিই আরিশ খান নামক টিচারটাই লাগবে। ‘
উনি হাত ছাড়িয়ে নিলেন কিছু বললেন না। আমি ওনার পাশে গিয়ে ওনার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে বললাম,
‘ডিসটেন্স মেইনটেইন করতে বলেছি বলেই ডিসটেন্স মেইনটেইন করতে হবে? এতোটা ভালো মানুষ ও আপনাকে হতে বলিনি তে আমার অন্যায় আবদার গুলোও আপনাকে মানতে হবে। আর হ্যা কালকে সকালে আমার মক টেস্ট আছে আপনার কাছে। সকাল সকাল যেন আমার বাসায় আপনাকে দেখি না হলে আপনার খবর আছে। ‘
কথাটা বলে চলে যেতে লাগলাম। আর কিছু একটা মনে পড়তেই দাঁড়িয়ে গেলাম আর ওনার দিকে ঘুরে চোখ পিটপিটিয়ে বললাম,
‘আর হ্যাঁ নো মোর ওয়ার্ডস।’
কথাটা শুনে উনি কোন পতিক্রিয়া দিলেন না। আমিও চেয়ে থাকবো গোটা একটা দিন ওনার অপেক্ষায়। উনি কি সত্যিই আমাকে ফিরিয়ে দেবেন?
#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat
11.
পুরো একটা দিন পার হয়ে গেল তবুও আরিশ ভাইয়া কোন খোঁজ খবরই নিলেন না। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুখন আগে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। অন্য দিনের মতো আজকে আর ভিজতে ইচ্ছে করছে না কারন আজকে তো আর আমাকে কেও বৃষ্টিতে না ভেজার জন্য থ্রে/ড দিচ্ছেন না। যে বৃষ্টিতে ভিজতে ওনার থেকে পারমিশন নিয়ে হাজারো ধমক সহ্য করে ভিজতে হয় সেই বৃষ্টিতে ভিজতে আমার আনন্দ লাগে। আজ বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু ভিজতে যাবো তার পারমিশন দেওয়ার জন্য উনি নেই। আমার বিছানাটা জানালার ধারে তাই বৃষ্টি পড়লেই জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে সহজেই বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করা যায়।
সামনে বই খাতা খুলে বসে আছি আমি। আজকে আমার প্রি টেস্ট এক্সাম দেওয়ার কথা ছিল ওনার কাছে। উনি কি সত্যিই আসবেন না?
আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে মেইন গেটের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। উনি আসলেই আমি অতি সহজেই ওনাকে দেখতো পাবো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার আম্মু এসে উঁকি মেরে গেছে যে ঘরে আছি নাকি বৃষ্টিতে ভিজছি তা দেখার জন্য। কিন্তু বারবার এসে উঁকি দেওয়াতে আমাকে রুমে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে আম্মুর কেবল একটাই রিয়েকশান,
‘কিরে শরীর টরীর ঠিক আছে তো? ‘
আমি সহজ ভাবে বললাম হ্যাঁ ঠিক আছি। কিছুখন পর পুনরায় এসে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘বৃষ্টি হচ্ছে, আরিশ নেই তবুও ভিজতে গেলি না যে। ‘
আমি তখন রাগী চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম
‘মশকরা করছো আমার সাথে? ‘
আম্মু মুখ টিপে হেসে চলে গেল আর যাওয়ার আগে বলে গেল,
‘আচ্ছা একটা শাস্তি হয়েছে তোর, ছেলেটাকে জ্বালানোর। ‘
কথাটা বলে হেসে চলে গেল। আমার চারিপাশের জগত আর সেই জগতের মানুষগুলো দিনকে দিন তিলে তিলে আমাকে আত্মনির্ভর না হয়ে ওনার ওপর নির্ভর হতে শেখাচ্ছে আর তাতে আমার এক মস্ত অভিযোগ।
হাতে থাকা পেনসিলটা নিয়ে জানালার গ্ৰিলে অন্যমনস্ক হয়ে টঙটঙ করে আওয়াজ করছি। চারিপাশে কি হচ্ছে তাতে যেন আমার ধ্যান জ্ঞান নেই। জানালার দিকে থেকেও দৃষ্টি টা সরে গেল।
কিছুখন পর আরিশ ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনতেই আমি চমকে উঠলাম আর খানিকটা শিওরেও উঠলাম। ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি চুলটা হাত দিয়ে ঝাড়া দিয়ে জল ঝাড়ছেন। ওনাকে এরুপ অবস্থায় দেখে আমি থ হয়ে রইলাম কিছুখন। আমি ওনার দিকে অনবরত তাকিয়ে আছি। কেন জানি না ওনার এমন সাধারন কাজকর্ম দেখতেও যেন আমার ভালো লাগছে। উনি আমাকে এভাবে লক্ষ করেও কিছু বললেন না। উনি আমার চোখের সামনে থেকে সরে গেলেন আর আমার সামনে এসে বসতেই আমার ঘোর কাটলো। বাইরের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখতেই দেখলাম আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। উনিও ভিজে গেছেন বেশ অনেকটা। আমি তা ভেবে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলাম,
‘ভাইয়া আপনি তো ভিজে গেছেন। ওয়েট আমি আম্মুর কাছ থেকে আপনার জন্য পোশাক নিয়ে আসি। ‘
উনি আমার কথাতে সাই দিলেন না যেন ওনার এভাবেই বসে থাকতে ভালো লাগছে। উনি আমার প্রি টেস্ট এর প্রশ্নটা আমার সামনে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘জলদি শেষ করো। টাইম এক ঘন্টা। ‘
প্রশ্নটা দেখতেই এবার যেন আর চোখ এর সামনে শরিশার ফুল দেখলাম না। সবকিছুর উত্তর যেন আমার চোখে ভাসছে। অন্যবারের থেকে এইবার এমন ব্যাতিক্রম কেন?
উত্তর লেখার জন্য কাগজে পেন ঠিকিয়ে ওনার দিকে একটা বার তাকালাম আমি তারপর আর কিছু না ভেবে লিখতে শুরু করলাম। ওনার কাছে এক ঘন্টা মানে কেবল এক ঘন্টায়। এক সেকেন্ড বেশি বা কম নয়।
সময় চলছে আর আমার হাতের গতি বাড়ছে। সবকিছু র উত্তর কতো অনায়াসেই দিয়ে ফেলছি আমি। অন্যবার এমনটা হয় না। অন্যবার এক একটা প্রশ্নের উত্তর ভাবতেই আমি এক দুই মিনিট কাটিয়ে দিই। একঘন্টার আগেই খাতাটা ওনার সামনে জমা দিলাম। অন্যবার উত্তর শেষ হয়না তাই আমার খাতা দিতেও মন চাইনা। তবে এবারও উনি অবাক হলেন না।
উনি খাতা চেক করছেন আর আমি কেবল একবার খাতার দিকে আর একবার ওনার তাকাচ্ছি। ওনার গলার নীচের তিলটার দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম আমি। পুরুষ মানুষের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য মেয়েদেরকে বড্ড আকৃষ্ট করে আর তার মধ্যে একটি হলো তিল। আমি বাইরের মুষলধারা বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইলাম। এবার আমার ভিষনরকম ভিজতে ইচ্ছা করছে, ভীষনরকম মানে ভীষনরকম। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম সেই সময়ে উনি আমার সামনে খাতাটা রেখে বললেন,
‘চেক ইট! ‘
আমি দেখলাম যে উনি খাতা দিয়েছেন আর কতো পেয়েছি। কিন্তু তার থেকেও বেশি আগ্ৰহ জাগলো বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে। আমি খাতার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম না বিন্দুমাত্র। উনার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম,
‘আরিশ ভাইয়া একটু ভিজি?’
ওনার চাহনি দেখেও ওনার মনের খবর জানতে পারলাম না যে উনি হ্যাঁ বলছেন নাকি না। আমি পুনরায় চোখ মুখ কাচুমাচু করে ওনার দিকে বাচ্চাদের মতো ইশারা করে বললাম,
‘একটুই ভিজবো সত্যি বলছি! ‘
হঠাৎ ওনার মনের মাঝে কি পির আউলিয়ার মতো আমার প্রতি দরদ উতলে পড়লো আমার জানা নেই তবে উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘হমম। ‘
শুনে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বিছানা থেকে ঝটপট করে নেমে বললাম,
‘আপনি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছেন? ‘
উনি জবাব দিলেন না, সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন আর যাওয়ার আগে বললেন ওনার পিছন পিছন আসতে। আমি কৌতুহলী হয়ে ওনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম। উনি দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে যাচ্ছেন। ছাদের দরজার মুখোমুখি যেতেই উনি হাত দিয়ে আমাকে ইশারা করলেন যাওয়ার জন্য। আমি দ্রুত পা ফেলে ছাদে গিয়ে ভিজতে লাগলাম। দু বাহু প্রসারিত করে বৃষ্টির প্রত্যেকটা বিন্দু উপভোগ করছি। আমার শরীরের মাঝে এক ভালোলাগার শিহরন বয়ে যাচ্ছে। গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছা করছে ওই গানটা,
‘এক গুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোমার সাথে। ‘
কিন্তু উনি কি আদতেও আমার সাথে ভিজবেন? কথাটা ভাবতে ভাবতে ওনার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম।
বৃষ্টির মাঝে ওনার দিকে তাকালাম, সবকিছু বেশ ঘোলাটে লাগছে বৃষ্টির ছটায়। উনি দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। আমি বৃষ্টি ছেড়ে ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমার উপস্থিতিকেও যেন গুরুত্ব দিলেন না, আমি বেশ ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম শীতে। আমার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে শিতে।কম্পিত কন্ঠে ওনাকে প্রশ্ন করলাম,
‘আরিশ ভাইয়া আমি কতো পেয়েছি বললেন না তো। ‘
উনি বৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করে বললেন,
‘দেখার জন্য খাতা চেক করতে দিয়েছিলাম তোমাকে। ‘
আমি বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম আর ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনি কি আজ প্রশ্ন সোজা করেছেন নাকি আমি ভালো করে পড়াশোনা করেছি বলে সব পেরেছি সেটা নিয়েই ভাবছি আমি। ‘
উনি আমার দিকে এবার তাকালেন। ওনার দৃষ্টি শান্ত শীতল আর হয়তো ওনার শরীরটাও। উনি আচমকা আমার থুতনিতে থাকা তিলটা আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন। আমি কেঁপে উঠলাম তাতে। উনি উত্তর দিলেন না। নিজে চলে গেলেন ছাদের মাঝে। বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে গেল ওনার শরীর। আমার ভীষন রকম হিংসা হলো বৃষ্টির ফোঁটা গুলোর ওপর। আজ যদি আমিও বৃষ্টির বিন্দু হতাম তাহলে কতো সহজেই ওনাকে ছুঁয়ে দিতাম আর চাইলেও উনি আমাকে ধমক দিয়ে ওনাকে ছোঁয়া থেকে আটকাতে পারতেন না। আমি ওনার পাশে গিয়ে নিরবে দাঁড়াতেই উনি বলে উঠলেন,
‘পঞ্চাশে সাড়ে উনপঞ্চাশ পেয়েছো। ‘
আমি অবাক আর খুশি দুইয় হলাম তবে ওনার কথাতে তোয়াক্কা না করে বললাম,
‘আপনি এখনো আমার ওপর রেগে আছেন? ‘
উনি আকস্মিক ভাবে বললেন,
‘তুমিই আমার বৃষ্টিবিলাসী। ‘
আমি কেঁপে উঠলাম ওনার এমন কথাতে। আচমকা চোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম উনি সত্যিই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজছেন আর কল্পনায় মত্ত ছিলাম আমি।
আজকাল উনি আমার কল্পনাতেও ছেয়ে গেছেন।
আচমকা ওনাকে আমি আর দেখলাম না তবে পায়ে শীতল কিছুর ছোঁয়া পেতেই শিউরে উঠলাম। উনি আমার পায়ে কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছেন যেন। উনি পায়ে হাত দিচ্ছেন দেখে সরে আসতে নিলেই এক পায়ের নূপুর ঝমঝম করে বেজে উঠলো আর উনি রাসভারী কন্ঠে ডেকে উঠলেন,
‘এই মেয়ে! এতো চঞ্চল কেন তুমি?একবিন্দু কি চুপ করে দাঁড়ানো যায় না? ‘
আমি থমকে গেলাম। উনি আর এক পায়ে নূপূর পরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আর রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘ এতোখন ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিলে? কতবার ডেকেছি ডু ইউ নো? ‘
আমি থতমত খেয়ে বললাম,
‘ আমি তো! ‘
উনি আমাকে থামিয়ে দিলেন।
‘নো মোর ওয়ার্ডস। আর ইউ হ্যাপি নাও? ‘
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘কেন? ‘
উনি কপালে টোকা মেরে বললেন,
‘স্টুপিড। ‘
কথাটা বলে উনি চলে যেতে নিলেই আমি দৌড়ে ওনার পিছু নিতে গেলেই পায়ে নূপূরের ঝমঝম আওয়াজ হতেই থেমে গেলাম আমি, জোর গলায় ওনাকে ডেকে উঠলাম,
‘আরিশ ভাই! ‘
‘কি হয়েছে মিস ড্রামা কুইন? পছন্দ হয়নি?
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম।
‘আপনার মনে আছে এটার কথা? ‘
উনি ফিরে এলেন, আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
‘ মনে না থাকলে তো কুরুক্ষেত্র বাধাতে তাই মনে রাখাই ইজি চয়েজ দ্যান ওয়ার। ‘
আমি ওনার সামনেই পা নাচিয়ে ঝমঝম আওয়াজ করে বললাম।
‘আমি বলেছিলাম যে যেদিন আমি প্রি টেস্ট এ ফুল মার্কস পাবো সেদিন আপনি নুপুর কিনে দেবেন। এই জন্যই তো আপনাকে আমার আলাদিন বলি হাহ!’
উনি কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই আমি পিছু ডেকে বললাম,
‘আপনি সত্যিই রেগে নেই তো? রেগে থাকলেও কিন্তু আমি রাগ ভাঙাতে পারবো না হুহ! ‘
উনি পিছন ফিরে তাকিয়ে বললেন,
‘ নীচে গিয়ে যদি কফি না পাই তো তোমার খবর আছে বলে রাখলাম। জলদি নাচানাচি কমপ্লিট করে নীচে এসে কফি দিয়ে যা খুশি করো। আর আনলিমিটেড ভেজার প্ল্যান করলে তা মাথা থেকে বাদ দাও আর যদি জ্বর আসে তো প্যারাসিটামল এর সাথে দুটো থা/প্পড় ফ্রি! আর উইথআউট ড্রামা। বাই। ‘
কথাটা বলে উনি নীচে নেমে গেলেন। আমার সব মন খারাপ যেন বৃষ্টির সাথে মুছে গেল। কল্পনার থেকেও বাস্তবও যে এতো সুখের আর আনন্দের হতে পারে তা আজকের দিনটা না এলে হয়তো আমি কখনো জানতেই পারতাম না।
আকাশের দিকে তাকিয়ে উপরওয়ালাকে স্বরন করে বললাম,
‘তোমাকে অনেক অনেক শুকরিয়া এরকম একটা অভদ্র আর আলাদীনকে আমার জীবনে পাঠানোর জন্য। ‘
নুপূর টা পরে বেশ কয়েকবার ঝমঝম করতেই নীচ থেকে ডাক এলো,
‘এই মেয়ে জলদি আসো নয়তো থা/প্পড় খাবে উইথ এক্সট্রা বকাঝকা। ‘
ওনার এই ধমক শুনে আর নাচানাচি করা যায়! অভদ্র একটা!😒
#চলবে,,,,
#চলবে,,,