ভালোবাসি বলে দাও পর্ব -২২+২৩

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#লাইফ_প্যারাহীন
#Suraiya_Aayat

22.

বিছানার উপর আধাশোয়া হয়ে বসে আছেন উনি, ওনার থেকে একহাত দূরত্ব বজায় করে বসে আছি আমি, ঠান্ডায় গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে রাখা অবস্থায়।
উনি ওনার মোবাইলে মনোনিবেশ করেছেন আর আমি বইয়ের আড়ালে চুপিসারে মাঝে মাঝে ওনাকে লুকিয়ে দেখছি। অতঃপর একটা সময়ে ওনার কাছে ধরা খেতেই উনি ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন,
‘এভাবে লুকিয়ে দেখার কি আছে? তোমারই জামাই আমি। দেখতে হলে সরাসরি দেখো।’

আমি ওনার কথা শুনে বইটা নিজের মুখ এর সাথে একপ্রকার চেপে অকপট স্বীকারোক্তি করলাম,
‘আমি মোটেও আপনাকে দেখছি না। আর আপনাকে দেখার মতো কি ই বা আছে হু যে আমি দেখবো? ‘

উনি আমার কথা শুনে আমার মুখ এর সামনে থেকে বইটা টেনে বললেন,
‘তা মিসেস টুইটুই আপনি কি উল্টো বই ধরে উল্টোভাবে বই পড়া প্র্যাকটিস করছেন? ‘

আমি ওনার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম,
‘মোটেও নয়। আমি বই উল্টো ধরিনি। আপনি মিথ্যা বলছেন। ‘

উনি বইটা একপাশে রেখে আমার হাতটা টেনে ওনার কাছে টেনে আনলেন আর নেশাক্ত ধরালো কন্ঠে বললেন,
‘ টিচারকে কখনো মিথ্যা বলতে নেই, বললেই পানিশমেন্ট পেতে হয়। ‘

ওনার পানিশমেন্ট এর কথা শুনে আমার দুপুরের সব দৃশ্য চোখের সামনে শরিষার ফুলের মতো ভাসতে লাগলো। আমি চুপটি করে গুটিয়ে গেলাম নিমেষেই। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে সরল স্বীকারোক্তি করলাম,
‘আমার বারবার গোসল করতে ভালো লাগে না। প্লিজ মিস্টার অভদ্র জামাই একটু বোঝেন। ‘

উনি আমার কথা বুঝতে পেরে হো হো করে উচ্ছাসের সাথে হেসে উঠলেন। ওনার হাসির ধরন দেখে বুঝতে পারলাম উনি সেসব কিছুই মিন করতে চাননি যা আমি আমি ভেবে ইতিমধ্যে তা ওনাকে বলে ফেলেছি। উনি হাসির ঠেলায় রিতিমত গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আমি ওনাকে কখনো এতো হাসতে দেখিনি। আমি বুঝতে পারছি যে আমি ভুল কথা সঠিক মানুষের কাছে বলে ফেলেছি। আমি মুখ চেপে ধরলাম নিজের, বেফাসে অন্য কোন কথা না বার হয়ে যায় সেই ভয়ে। ওনার দৃষ্টির অগোচরে নামে নামে কেটে পড়ায় মঙ্গল। কথাটা ভেবে ধীরে ধীরে বিছানার থেকে নামতে গেলেই উনি আচমকাই আমার হাত ধরে বিছানায় টেনে শুইয়ে দিলেন। ওনার এমন হঠাৎ হঠাৎ উৎভব হওয়া রোমান্টিকতা গুলো আমার বুকের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্যই যথেষ্ট।

উনি আমার ওপর সম্পূর্ণ রুপে ঝুকে গেলেন। আমি রিতিমতো শিউরে উঠছি অজানা অনুভুতিতে। সম্ভবত শরীরে আ্যড্রিনালিনের প্রভাব বেশি ভাবে কাজ করছে, কিন্তু এ অনুভূতি তো সহজে দমে যাওয়ার নয়।

উনি বিড়বিড়িয়ে বললেন,
‘ হঠাৎ এই কথা তোমার মাথায় এলো কি করে আরু পাখি? তোমার মতো পিচ্চির ছোট্ট মস্তিষ্কে তো এসব কথা আসার কথা নয়। ‘

আমি ওনার কথা বলার ভাব শুনে উপলব্ধি করলাম যে উনি অনেক কষ্টে নিজের হাসি সংযত করে কথাগুলো বলছেন যাতে আমার লজ্জার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে। আমি ওনার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিলাম।
‘ আপনার জন্য আমাকে ভর দুপুরে গোসল করতে হয়েছে। আমার ঠান্ডা লেগে গেলে আপনার দোষ। ‘

কথাটা শোনা মাত্রই উনি আমার কাধে নাক ঘষতে লাগলেই আমি ওনাকে শক্ত করে ধরলাম। উনার ঠোঁটের স্পর্শ গুলোও আমার কাধে বেশ ভালো ভাবে অনুভব করতে পারছি। উনি স্পর্শ দিতে দিতে বললেন,
‘ সবকিছুর অভ্যাস করে নাও কারন আমি মানুষটা তোমাকে কখনোই ছাড়ছি না। না চাইলেও আমার সাথেই সারাজীবন থাকতে হবে। তোমাকে বলেছিলাম না যে একবার সে হাত ধরলে আর কখনোই ছাড়বো না। ‘

কথাটা বলে উনি গভীরভাবে আমার কাধে একটা স্পর্শ দিয়ে সরে এলেন। আমি এবার ওনার দিকে তাকালাম। উনি সরে গেছেন আমার উপর থেকে তবুও ওনার শরীরের ঘ্রাণ যেন আমার শরীরের সাথে মিশে আছে অতোপ্রোত ভাবে আর আমি সে ঘ্রাণ পাচ্ছি। ওনার বলা কথা গুলো কানে ক্রমাগত বাজতে লাগলেই আমি লজ্জাবতী হয়ে গেলাম। এবার এ অনুভুতির সামাল কি করে দিই?

/

আজ তিনদিন হয়ে গেল ও বাসা থেকে এ বাসায় এসেছি। উনি সরা দিন ওনার কলেজে থাকেন আর আমি সানা আর ফুপি বাসায় তিনজনের আসর জমিয়ে রাখি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে কিন্তু ওনার সাথে ঝগড়াটা আর আগের মতো জমে উঠছে না। আমার তো মন চাইছে আজকে উনি বাসায় ফিরলে বলবো চলুন একটু ঝগড়া করি, কিন্তু এ কথা ওনাকে বললে যে আমার রক্ষে নেই আমি তা জানি। কথাটা ভেবে পায়ের ওপর পা তুলে বসে পা নাড়াতে লাগলাম। এটা আমার ভীষন বাজে রকমের অভ্যাস। বসে থাকলে বা বিছানায় শুয়ে থাকলেও পা আমার কখনো স্থির থাকে না। ছোটবেলায় এর দরুন আম্মুর কাছে অনেক বকা শুনেছি তবে এখন আর কেও বকা দেই না। আম্মু বলে যাদের মাঝে এই স্বভাব আছে তাদের মন নাকি খুব চঞ্চল হয়, কিন্তু আমি তো শান্তশিষ্ঠ। তাহলে আম্মুর কথা মিথ্যা🙄।

ফুপি ফুপার সাথে এক আত্মীয় বাসায় গেছেন। সানা আমার পাশে বসে বসে ঝিমোচ্ছে, তাকে বেবাগে ঝিমোতে দেখে আমার নিজেরই ঝিমুনি আসছে।
কথায় আছে সুখে থাকতে ভুতের কিলাই, আমি হলাম সানার এই ভূত, সানকে ঝিমোতে দেখে তাকে বেশ কয়েকটা চাপট মেরে ডাকতে লাগলাম।

‘এই মেয়ে, ঝিমাস কেন! ওঠ! ‘

আমার কথা শুনে সানা চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
‘ কি হলো ডাকিস ক্যান? ‘

আমি তার মিমিক্রি করে বললাম,
‘কি হলো ডাকিস ক্যান? ‘

সানা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কি হয়েছে বল। ‘

‘দোস্ত তোর কি মনে হয়না যে জীবনটা কেমন যেন নিরামিষ হয়ে গেছে! জীবনে ঝাকানাকা কিছু আনা দরকার।’

সানা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
‘ কি ঝাকানাকা? ‘

আমি হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললাম,
‘ আরে ঝাকানাকা মানে সেই সেই ওইরকম। ‘

সানা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কি রকম? ‘

আমি বলে উঠলাম,
‘ আরে এই সেই সেই রকম। ‘

সানা বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে নিলেই ওর হাত ধরে আমি পুনরায় বসিয়ে বললাম,
‘উঠছিস কেন বস! ‘

‘বুঝেছি তোর এখন সিরিয়ালের মতো বউ শাশুড়ির ঝগড়া লাগবে বা একজন ভিলেন লাগবে জীবনে যে রাতদিন একটা না একটা প্যাচাল বাধাবে আর ভাইয়া তাকে ঝাড়ি দেবে লাইক ফারিন আপু। ‘

সানার কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম। সানা “আজাইরা” কথাটা বলে বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। আমি হাসছি। সত্যিই কি ওরকম কিছু হলে জীবনটা থ্রিল হয় বুঝি? কিন্তু আমার শাশুড়িআম্মু ঝগড়া তো দূর, আমি ব্যাথা পেলেই উনি ছুটে আসেন। জীবন অতিরিক্ত প্যারালেস।

কথাটা ভেবে আমি বেরিয়ে এলাম বাসার বাইরে। আরিশ ভাইয়ার বাসায় আমাদের বাসার মতো অতো বাগান নেই ঠিকই কিন্তু আমার পছন্দের ফুলগুলো আছে। এ বাসায় কোন সিকিউরিটি গার্ড নেই তাই আমি হুঠহাঠ বেরিয়ে গেলেও কেও কিছু বলার নেই। বাইরে বের হতেই দেখলাম লাল কাঠগোলাপটা ফুটে আছে সেটা দেখতেই আমি থমকে গেলাম আর সেদিকে অপলক চেয়ে রইলাম বেশ কিছুখন। এতো সুন্দর ফুলটা ছিঁড়বো কি ভাবছি, ছিঁড়লেও আরিশ ভাইয়া কিছু বলবেন না তা আমি জানি। কথাটা ভেবে আমি ফুলটা এক সেকেন্ডে ছিঁড়ে দুই সেকেন্ড এ কানে গুজলাম। আমি খিলখিলিয়ে হাসছি একা একাই। নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে টুইটুই লাগছে ভেবে খুশি হলাম। পিছন ঘুরে তাকাতেই একটা ধাক্কা খেলাম ওনার বুকের সাথে। সর্বপ্রথম আমার নাকটা ওনার বুক লাগতেই আমি আমার নাকটা চেপে ধরে ওনার দিকে মুখ চুন করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই উনি পকেট থেকে ওনার ফোন বার করে একঝটকাই একটা ছবি তুলে নিলেন আমার কিছু ভাবার আগেই। আমি ওনার হাতে ঝাড়ি মেরে বললাম,

‘ এভাব খাম্বা পিলারের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন পিছে? আমার নাকটা যদি ভেঙে যেত তাহলে তার দায় আপনি নিতেন? আর ছবি তুললেন কেন হম? ‘

কথাটা বলে আমি নাক ছাড়লাম, নাকটা লাল হয়ে আছে নিশ্চয়ই। উনি কিছু বলছেন না চুপচাপ আমার মুখ এর দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি চুপ করে আছেন দেখে বললাম,
‘ এভাবে তাকিয়ে আছেন যে! সে সরি। ‘

উনি সরি বললেন না বরং উল্টে বললেন,
‘ ইউ সে সরি। আমার গাছ থেকে ফুল ছিঁড়েছ কেন? ‘

‘মোটেও ওটা আপনার একার গাছ না। আমারো গাছ। আর নিজের গাছ থেকে ফুল ছেড়া অন্যায় না। ‘

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ওহহ রিয়েলি? ‘

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘হমম হমম হমম। চাইলে আপনিও আমার গাছটা থেকে একটা ফুল নিয়ে কানে গুজতে পারেন, আফটার অল আমি আপনার মতো অতো হিংসুটে নয়। ‘

উনি নাকটা টেনে বললেন,
‘হিংসুটে না হলেও ঝগড়াটে বটে। তোমার সাথে ঝগড়া করার জন্য হলেও আমার ডাক্তারি না পড়ে ল নিয়ে পড়া উচিত ছিলো বাট আই মিসড দা অপরচুনিটি। ‘

আমি চোখ ছোট ছোট করে ওনার দিকে তাকালাম।

‘এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আমার জন্য কফি বানাও। আর ভুলেও চিনি দিলে খবর আছে। আগের দিনের মতো চিনি দিলে আবার তোমাকে দিয়ে বানাবো। ‘

কথাটা বলে উনি আমার হাত ধরে বাসার দিকে যেতে লাগলেই আমি বললাম,
‘ আপনার কফির মতো আপনিও তেঁতো। কোন মিষ্টতা নেই। নিমপাতা। ‘

উনি ওনার পাশে আমাকে টেনে এনে ওনার গলার স্টেথোস্কোপটা আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ প্রবলেম নেই, তুমি তো আছো আমার জন্য এজ আ সুইট। ‘

আমি ওনার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললাম,
‘ দেশের একজন ভালো মানুষ হয়ে আমার মতো মেয়েটার জীবনযাত্রা আসান করে দিন।’

উনি হেসে বললেন,
‘ কাভি নাহি! ‘

আমি ওনাকে ছাড়িয়ে কিচেনে গেলাম। উনি ুমে ঢুকে গেলেন উনি বিনা বাক্য ব্যায় করে।
কফি বানাতে বানাতে লক্ষ করলাম এখনো আমার গলায় ওনার স্টেথোস্কোপটা ঝুলে আছে, উনি বোধহয় নিতে ভুলে গেছেন। পরক্ষনেই মনে পড়ে গেল যে এটা তো আমারও উদ্দেশ্যে, তাহলে উনি কি ওনার হাজার ব্যা্স্ততার মাঝে এটাই আমাকে মনে করিয়ে দিতে চাইলেন?

কথাটা ভাবতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। আচ্ছা উনি এতো দিক সামলে কি করে চলেন?
#ভালোবাসি_বলে_দাও
#টিট_ফর_ট্যাট
#Suraiya_Aayat

23.

কোচিং থেকে ফেরার পথে ওনার একরাশ প্রশ্ন শুরু হলো আর তার সাথে আমাদের জবাবদিহিতাও।

‘পড়া কিছু বুঝতে প্রবলেম হয়েছে? না বুঝলে টিচারের থেকে ঠিক করে বুঝে নেবে, আর প্রবলেম হলে আমাকে বলবে। সানা তোকেও বলছি। ‘

ওনার কথা শুনে আমি আর সানা একে অপরের দিকে তাকালাম নির্বিকারে। সানা নির্বিকারে বলল,
‘খারাপ লাগছে না। ভালোই বাট টাফ আছে। ‘

উনি আমার দিকে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘আর আপনার? ‘

আমি ওনার কথাতে উত্তর দিলাম না, মুখ কাচুমাচু করে রইলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি আরও কিছুখন আমার দিকে পরখ করে রইলেন। তারপর উনিও কিছু বললেন না।

সারাটা রাস্তা চুপ করে রইলাম। বাসায় ঢুকেই আমি কাধ থেকে কোনরকম ব্যাগটা নামিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়তেই আরিশ ভাইয়া দরজা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক। আমি পিটপিট করে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাচ্ছি ওনার দিকে তা ওনার চোখকে ফাঁকি দিলো না। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। কিছুখন পর অনুভব করলাম যে উনি আমার খুব কাছেই রয়েছেন। চোখটা খুলে ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি আমার দিকে ড্যাপড্যাপ করে চেয়ে আছেন। উনি যদি ধমক দেন সেই ভয়ে আমি পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলাম। অনেকখন ধরে নিস্তব্ধতার এক দীর্ঘ প্রহর চলতে লাগতেই আমি এবার এক চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতেই দেখলাম উনিও এখনো আগের ন্যায় আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি এবার ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম, বিছানা থেকে নামতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেই উনি হাত ধরে আবার বিছানায় টেনে আনলেন।

আমি ওনার পাশে শুয়ে রইলাম। উনি আমার হাতটা ধরে ওনার কাছে খানিকটা টেনে এনে প্রশ্ন করলেন,
‘ কি হয়েছে? মন খারাপ? ‘

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানাতেই উনি আমার নাকটা ধরে টেনে বললেন,
‘ তা মন খারাপ কেন শুনি? আজকে সারাদিন এ একবার ও ঝগড়া করতে পারেনি সেই কারনে কি? ‘

আমি পুনরায় মাথা নাড়িয়ে না জানালাম।

‘ তাহলে কি কারনে? ‘

আমি চুপ করে রইলাম, কোন জবাব দিলাম না। তা দেখে উনি বললেন,
‘পড়া বুঝতে প্রবলেম হচ্ছে? ‘

আমি পুনরায় মাথা নাড়িয়ে না জানালাম। এবার উনি আর কোন প্রশ্ন করলেন না, উনিও চুপ করে রইলেন। কিছুখন পর আমি নিজেই সহজ স্বিকারউক্তি করলাম,
‘কোচিং এর সবাই আপনাকে চেনে, আপনার সূত্রে আমাকেও চেনে। সবাই বলে যে মিডিকেল এ চান্স পেতে গেলে দিনরাত এক করে পড়াশোনা করতে হয়। আপনি তো দিনরাত পড়তেন তাই আপনি ঢাকা মেডিকেল এ পেয়েছেন কিন্তু আমি তো আপনার মতো অতো পড়াশোনা করিও না আর করতে ভালোও লাগে না। আর যদি চান্স না পাই তাহলে কি হবে! ‘

আমার কথা শুনে উনি হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার কান্না চলে এলো ওনার হাসি দেখে। আমি ওআর দিকে ছলছল চোখে তাকাতেই উনি আমাকে ওনার বুকের মাঝে টেনে নিয়ে বললেন,
‘ তুমি যতটুকু পড়ো ততোটুকু এনাফ। আর কিছু বুঝতে প্রবলেম হলে আমি বাসায় ফিরলে আমাকে বলবে কেমন? ‘

আমি মাথা নাড়ালাম। আসলে উনি ছাড়া কোন কারোর কাছে পড়তে যে আমার ভালো লাগে না সেটা ওনাকে কি করে বোঝাই।

/

রাত সাড়ে এগারোটা বাজে উনি এখনো বাসায় ফেরেননি, সাথে ফুপাও। ফুপা বললেন যে ফেরার পথে আরিশ ভাইয়াকে নিয়ে ফিরবেন। ফুপি কাচ্চি বানিয়েছে আর সেই কাচ্চির গন্ধে সারা ঘর বাড়ি মো মো করছে। আমি ডাইনিং টেবিলে হাতে হাত গুটিয়ে বসে আছি। ফুপি সালাদের শশা কাটছে আর সানা পেঁয়াজ। মাঝে মাঝে আমার নিজেকে দেখে নিজেরই প্রশ্ন জাগে যে আমি কি আসলেই এ বাড়ির বউ? আমার জানামতে বিয়ে করলেই মানুষ বউ হয়ে যায় তারপর সংসারের সব কাজ করা লাগে যেমনটা আমার ফুপি আর আম্মু আর আম্মুকে দেখে আসছি। কিন্তু আমি তো কিছুই করি না। তাহলে আমি কি?

আমি ফুপির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘ফুপি আমি কিছু হেল্প করি? রায়তাটা আমি বানিয়ে দেই। ‘

ফুপি ধমক দিয়ে বলল,
‘ নাহ আপনার কিছু করা লাগতো না। আপনি শান্ত হয়ে বসেন তারপর হাত পা কাটলে আপনার জামাই আর আমাকে কথা শোনাতে ছাড়তো না আম্মা। ‘

ফুপির কথা শুনে মুখ কাচুমাচু হয়ে গেল আমার। সানা ঠোঁট চেপে হাসছে। আমার গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে,
‘তোমরা কেও ভালা না।’

কথাটা নিজের মাঝেই দমিয়ে নিয়ে চুপ করে রইলাম।

এভাবে আরও কিছুখন অপেক্ষা করার পর কলিংবেল বেজে উঠতেই আমি ফুপির দিক তাকিয়ে বললাম,
‘এবার যাই? ‘

ফুপি হেসে ফেললেন আমার কথা শুনে। আর হেসে বললেন,
‘যা। ‘

আমি দৌড়ে দরজার দিকে ছুটে গেলাম। এক নিমেষে দরজা খুলতেই দেখলাম ফুপা একা দাঁড়িয়ে আছেন, ওনাকে আশেপাশে না দেখে আমার মুখটা চুন হয়ে গেল এক নিমেষেই। আমি ফুপার আশেপাশে খানিকটা উঁকি দিতেই দেখলাম যে উনি আছেন কি না। আমার এমন উঁকিঝুঁকি দেখে ফুপা বলে উঠলেন,
‘আরিশ আসেনি আরু মা। ওর কলেজে কি একটু কাজ আছে তাই আসেনি। চলে আসবে কিছুখনের মধ্যেই। ‘

আমি ফুপার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
‘এতো রাতে ওনার আবার কি কাজ। ‘

ফুপা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ তা তো আমি বলতে পারবো না। তবে আমাকে ফোন করে বললো যে তার নাকি ফিরতে লেট হবে। ‘

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ওনার প্রতি একরাশ রাগ আর অভিমান দুই ই জমা হয়ে এলো। কই ওনাকে যখন ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম তখন তো উনি কিছু বলেননি।
আমি আর কথা বাড়ালাম না, আরিশ ভাইয়ার এমন কাজে বোধহয় ফুপিও রেগে গেছেন বেশ তা ফুপির কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। ফুপি ওনাকে বেশ ঝাড়ি দিচ্ছেন। আমি চুপচাপ গিয়ে টেবিলে বসলাম। সানা সম্ভবত আরিশ ভাইয়াকে কল করার চেষ্টা করছে কিন্তু উনি ধরছেন না।
আমাকে উদ্দেশ্যে করে ফুপি বললেন,
‘ছেলেটা যে কবে এমন বেপরোয়া হলো কে জানে। আসতে যখন দেরি হবে তখন সেটা জানালেই হতো। আরু মা তুই খেয়ে নে। ওর খাবারটা আমি প্লেটে বেড়ে দেবো সেটা ঘরে নিয়ে যাস। ‘

আমি ভাবলাম ওনার জন্য যদি আর একটু অপেক্ষা করা যায় আর তারমধ্যে যদি উনি চলে আসেন, সেই কথা ভেবে আমি বললাম,
‘ফুপা ফ্রেশ হয়ে আসুক না হয় তারপর খাবো সবাই একসাথে। ‘

ফুপি আমার কথা শুনে ফুপাকে হুমকি দিয়ে বলল,
‘জলদি ফ্রেশ হয়ে এসো, তোমাদের জন্য কিন্তু আমার দুই মেয়ে না খেয়ে আছে এখনো। ‘

‘ যাচ্ছি যাচ্ছি। হুমকি দাও কেন? ‘

কথাটা বলে ফুপা চলে গেলেন। আমি আর সানা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেওয়ার উপক্রম।
ফুপা আর ফুপি চিরকাল এমনই, হাওয়াইমিঠাইয়ের মতো, সহজেই গলে যান আর তার জন্য তাদের প্রতি আমাদের এক আকাশ ভালোবাসা।

/

আমার সেট আপ সম্পূর্ণ রেডি, এসির পয়েন্ট বাড়িয়ে গায়ে মোটা একটা ব্ল্যাঙ্কেট ফেলে শুয়ে আছি বলা যাই না উনি এসে কখন মিসাইল বর্ষন শুরু করেন ওনার কল না তোলার জন্য।
ডিনার করে রুমে ফেরার পর যখন ফোনটা হাতে নিলাম তখন দেখি ৪০+ মিসডকল। আমি ফোনটা ওপরে সাইলেন্ট করে রেখে নীচে মজায় মজায় কাচ্চি খাওয়ার জন্য ছুটেছিলাম, উল্টে উনি দেরি করে বাসায় ফিরছেন দেখে ফুপি বিনা কারনে কয়েকটা ঝাড়িও দিলেন। কয়েকটা এসএম এস করেছেন তা না বললেই নয়,

‘আরু পাখি ফোনটা পিক করো। ‘

‘হারি আপ, আই এম বিজি। ‘

‘বাসায় আসতে লেট হবে। কিছু কাজে আটকে গেছি। ‘

‘ এই মেয়ে। কি হলো? ‘

‘ কথা কানে যায় না তোমার? ‘

‘কতোবার কল করেছি ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? ‘

‘বাসায় গেলে তোমার খবর আছে। ‘

‘ওয়েট এন্ড সি। ‘

এস এম এস গুলো দেখে আমার গলা শুকিয়ে এলো। তাই তার অগ্ৰিম প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। অনেক ঘুমানোর চেষ্টা করলাম তবুও ঘুম আসতে চাইলো না। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনতেই আমি চুপসে গেলাম।
উনি রাগী কন্ঠে ডেকে উঠলেন,
‘ এই মেয়ে ওঠো। ‘

আমি বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করলাম না আর উত্তরও দিলাম না যেন উনি মনে করেন আমি কুম্ভকর্নের নাতনি। আমার জবাব না দেওয়াই উনি এবার একটানে গা থেকে কম্বল পা ফেলে দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে তুললেন। আমি এখনো চোখ খুলে ওনার দিকে তাকাইনি, এমন একটা ভাব নিলাম যে উনি হাত ছাড়লে আবার বিছানায় পড়ে যাবো এতোটাই ঘুমের ঘোরে কাতর।
আমি তাকানোর কোন নাম নেই দেখে উনি এবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
‘ জলদি ওঠো নাহলে এক্ষুনি ঠান্ডা জলের শাওয়ারে পাঠাবো বলে রাখলাম। ‘

কথাটা শুনতেই আমি চোখ খুলে ওনার দিকে তাকালাম। আমি চোখ খুলতেই উনি উনি ধমক দিয়ে বললেন,
‘ ডাকলে কথা কানে যায় না? ফোন করলে ফোনটা ধরা যায় না? ম্যাসেজ দিলে সেটা দেখা যায় না? ‘

আমি ওনার দিকে কাচুমাচু করে তাকিয়ে বললাম
‘সরি আমি তখন রুমে ছিলাম না। ‘

‘ তা রুমে আসার পর কল ব্যাক করা যায় না? ‘

আমি কিছু বললাম না, চুপ করে রইলাম। উনি আমার হাতটা ছেড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলেন। আমি ওনার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। উনি এতো সহজে ছেড়ে দিলেন? উইথ আউট বকা ঝকা! বিষয়টা আমার হজম না হলেও বিষয়টা ভালোই। কথাটা ভেবে মনে মনে খুলি হলাম বেশ।

কিছুখন পর উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই আমি খাবার নিয়ে ওনার সামনে গিয়ে বললাম,
‘কাচ্চি। খেয়ে নেন। ‘

উনি চোখ বাকা করে প্রশ্ন করলেন,
‘ আপনার খাওয়া হয়েছে? ‘

‘হমম। আপনার আর ফুপার জন্য আমরা পৌনে বারোটা অবধি বসে ছিলাম। আপনি আসেননি দেখে ফুপি খেয়ে নিতে জোর করলো। ‘

‘এভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করে না খেতে থাকবে না, যদি শুনেছি যে না খেয়ে আছো তো খবর আছে। খাইয়ে দাও আমাকে, আই এম টায়ার্ড এনাফ। ‘

আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ আমি কেন! আপনার হাত আছে তো। ‘

উনি ধমকে বললেন,
‘ আমার হাত আছে আমিও জানি স্টুপিড। বেশি কথা না্ বলে খাইয়ে দাও। ‘

আমি চুপচাপ বসে গেলাম, ওনার ধমক শোনার থেকে ওনাকে খাইয়ে দেওয়া ভালো।

কিছুখন পর হাতের দিকে তকিয়ে দেখলাম হাতটা লাল হয়ে গেছে, আমি হাতটা ওনার সামলে মেলিয়ে ধরে বললাম
‘ কতগুলো কামড় দিসেন হিসাব আছে? ‘

উনি ফোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ কতগুলো কল দিয়েছিলাম হিসাব আছে? ‘

‘ তাই বলে আপনি এভাবে হাতে কামড় দিবেন? ‘

উনিও আমার কপি করে বললেন,
‘ তাই বলে আপনিও আমার কল রিসিভ করবেন না? ‘

আমার রাগ উঠলো ওনার কথাতে,
‘অভদ্র! ‘

উনিও বললেন,
‘ আরু পাখি। ‘

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here