ভালোবাসি বলে দাও পর্ব -১৮+১৯

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

18.

সারাটা রাস্তা আমি নিরবতা মেনে এলাম। উনিও আমার সাথে কথা বলেননি বিন্দুমাত্র। ওনার গাড়ি চালানোর গতি দেখে আমি বুঝলাম উনি রেগে আছেন ভীষনরকম। ওনার বাসার সামনে গাড়ি থামিয়ে উনি নিজে নামলেন। আমি গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে আছি, ভয়ে নামবো কি নামবোনা বুঝতে পারছি না। উনি আমার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ধমকের সুরে বললেন,
‘আপনাকে কি নিমন্ত্রণ করে গাড়ি থেকে নামাতে হবে?’

আমি ওনার কথা শুনে চটজলদি গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আমি গাড়ি থেকে নামা মাত্রই উনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাসার ভিতর নিয়ে যেতে লাগলেন। আমি হাতে বেশ ব্যাথা পাচ্ছি। তারওপর সারা দিন কিছু না খাওয়াই শরীরটা দূর্বল লাগছে। সেই সকাল এগারোটার দিকে একবার খেয়েছিলাম আর সেখান থেকে এখন ফিরতে ফিরতে এখন সাড়ে সাতটা বাজে প্রায়। আমি হাতে ব্যাথা পেলাম বেশ, মাঝ রাস্তায় আমি থেমে গেলাম। আমার চোখ এর কোনে বিন্দু বিন্দু জল জমে এলো। ধরা গলায় মিনতির সুরে ওনাকে বললাম,

‘আরিশ ভাইয়া হাতটা ছাড়ুন আমার লাগছে। ‘

আমার মুখে এমন কথা শুনে হাতটা ধরে ওনার কাছে আমাকে টেনে নিলেন, ওনার আর আমার মাঝের দূরত্ব টা মিটে গেল। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘বিয়ে করার যখন এতোই শখ ছিলো তখন আগেই বলতে বাল্য বিবাহ করিয়ে নিতাম তোমাকে। ‘

ওনার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি মাথা নীচু করে নিলাম। আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারছি না, আর কারনটাও জানতে পারছি না যে উনি আমার সাথে এমন ব্যাবহার করছেন কেন?

আমি চুপ করে গেলাম এক নিমেষেই। উনি আমাকে চুপ থাকতে দেখে এবার নিজেই আমার হাত ছেড়ে দিলেন আর নিজে হাটতে হাটতে চলে গেলেন বাসার ভিতরে। আমি চোখটা মুছে ওনাকে অনুসরন করলাম।

বাসায় ঢুকতেই ফুপি আর সানকে দেখলাম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, ওনাকে কোথাও দেখলাম না, গোটা বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধতায় ছমছম করছে। আমাকে গুটীগুটি পায়ে ঢুকতে দেখে ফুপি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ফুপি আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমি হাওহাউ করে কেঁদে দিলাম। ফুপি আমাকে শান্তনা দিতে লাগলেন। আমাকে নিয়ে সোফার বসাতেই সানা এক গ্লাস জল এনে আমার সামনে ধরে বললেন,
‘ এই নাও ভাবী তোমার পানি। ‘

সানার মুখে ভাবী ডাকটা শুনে আমি বেশ চমকে গেলাম। পাশ থেকে ফুপি যে মুখ চেপে হাসছেন তা আর বুঝতে বাকি রইলো না। তাদের মাঝে আমার নিজেকে এলিয়েন লাগছে। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম, আর কোন কথা না বলে জলটা খেয়ে নিতেই ফুপি বললেন,
‘ গালটা লাল হয়ে গেছে তো। আঙুলের ছাপ যে। আরিশ তোকে মেরেছে? ‘

আমি কিছু বললাম না, ফুপির কাছে আমি বরাবরই বড্ড আল্হাদী। ফুপির মুখে এমন কথা শুনে আমি কেঁদে উঠলাম আবার। পাশ থেকে সানা বলে উঠলো,
‘তোমার ছেলেটা এমন হিটলার কেন? বিয়ের প্রথম দিন কেও এভাবে মারে! আহারে আমার কিউট ভাবীটা। ‘

ফুপি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমার কান্না বন্ধ হতেই ফুপি আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ আজ আরিশের একদিন কি আমার একদিন। চল তো।’

ফুপি আমার হাত ধরে ওনার ঘরের দিকে নিয়ে যেতে নিলেই আমি ফুপিকে আটকালাম।
‘না ফুপি আমি ওনার ঘরে যাবো না। গেলে উনি আবার আমাকে মারবেন। ‘

ফুপি আশ্বাস দিয়ে বললেন,
‘আমার মেয়েকে মারে ওর সাহস কতো। তাছাড়া সে তার ঘরে যাওয়ার আগে বলে গেছে তোকে সোজা তার ঘরে পাঠাতে। তুই না গেলে ও আরও রেগে যাবে, চল আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি। ‘

ফুপির কথাতে আমি আর না করতে পারলাম না। ফুপি আমার হাত ধরে ওনার ঘরের সামনে নিয়ে গেলেন। আমি এখনো কিন্তু কিন্তু করছি, বুকের ভিতরটা কেমন টিমটিম করছে। উনি যদি এবারও কিছু বলেন।

ফুপি দরজা খুলতেই দেখলাম উনি রুমের মধ্যে নেই। যার অর্থ উনি শাওয়ার নিচ্ছেন। ফুপি আমাকে বিছানায় বসতে বলে ওনাকে ডাক দিলেন।
‘আরিশ তুই ওয়াশরুমে? ‘

উনি শুধু জবাব দিলেন ‘হমম। ‘

আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছি। ইশারায় ফুপিকে বলতে লাগলাম যেন আমাকে একা ফেলে সে না যায়। ফুপি আমার কথা রাখতে ওনাকে বললেন,
‘ আমি তাহলে আরুকে নিয়ে যায় এখন। ‘

উনি শুধু একটাই জবাব দিলেন,
‘তুমি খাবার বাড়ো টেবিলে, আমি ওকে নিয়ে আসছি। ‘

‘আমি ওকে নিয়ে আসছি’ কথাটা শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো, আমি মুখ কাঁচুমাচু করে ফুপিকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি এখানে থাকবো না কোনমতেই।
ফুপিও যে তার ছেলেকে ভয় পান একটু হলেও তা আমি বুঝি। ফুপি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে এলেন যার যাওয়ার আগে বলে গেলেন যেন উনি আর আমাকে কোন প্রকার বকা ঝকা না করেন, নাহলে ফুপি ওনার খবর খারাপ করে ছাড়বেন।

আমি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে পালানোর প্রস্তুতি নেবো এমনটা ভাবছি তখনই উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি ওনার দিকে ভুলেও তাকাবো না, করলাম ও তাই। আমি ওনার বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাত কাঁপছে, ওনার এমন রুপ সচরাচর দেখা যায় না। উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বললেন,
‘ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন তুমি? ‘

আমি ওনার এমন কথা শুনে গুটিগুটি পায়ে ওনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে কিছু একটা আনলেন আর কঠিন শব্দে বললেন,

‘দেখি, ডানদিকে ফেরো।’

উনি কি এবার বলে কয়ে চড় মারার পরিকল্পনা করছেন? কথাটা ভাবতেই আমি কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম, আমি ভয়ে বলে উঠলাম,
‘প্লিজ আমাকে আর চড় মারবেন না। আমার ব্যাথা লাগে। ‘

আমার কথা শোনার পর উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মুখটা ধরে সামন্য ঘুরিয়ে ডান গালে কিছু একটা ঠান্ডা জাতীয় ক্রিম লাগিয়ে ছিলেন। ভয়ে আমি চোখ মুখ কুঁচকে নিলাম। উনি মলম লাগাতে লাগাতে বললেন,
‘তোমাকে আমি বলেছিলাম না যেতে তারপরও তুমি আমার কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করোনি। আর আমার কানের কাছে সারাদিন রাগ দেখিয়ে এটা বলো ওটা বলো কই তারা যখন তোমার সাথে এমন একটা জোরজবরদস্তি করতে যাচ্ছিল তখন তুমি একটাবার ও প্রতিবাদ করোনি কেন? কি বিয়ে করার শখ জাগছিল খুব? সঠিক জায়গায় গলার জোর দেখাতে শেখো, নাহলে সবাই এমন ভাবে ব্যাভিচার করে চলে যাবে তুমি কিছ্ছু করতে পারবে না। ‘

আমি কেঁদে দিলাম ওনার কথাগুলো শুনে। উনি গালে মলম লাগাচ্ছেন, আমার চোখের জল গড়িয়ে ওনার আঙুলকে স্পর্শ করছে। আমি বুঝতে পারলাম উনি কিসের জন্য আমাকে চড় মারলেন।
আসলে ভুলটা যে আমারই তা আমি অস্বীকার করতে চাইছিলাম এতখন। সত্যিই তো আমি চাইলেই প্রতিবাদ করতে পারতাম কিন্তু সে মুহূর্তে আমি কিছু বলিনি। আর ওনার না প্রকাশ করা অভিমানটাও আমি ধরতে পারলাম নিমেষেই। আমি ওনাকে একটি বারের জন্য ফোন করে জানায়নি বলে বোধহয় উনি আরও বেশি রেগে গেছেন। উনি মলম লাগিয়ে সরে গেলেন। আমি চোখটা মুছে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। উনি আর একটাও কথা বাড়ালেন না, কিছু না বলেই নীচে চলে গেলেন। আমি সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুখন আর সবকিছু ভাবতে লাগলাম পুনরায়।
ওনার কাছে কি এখন আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত?

/

উনি ডিনার করে নিজের ঘরে চলে এসেছেন। টেবিলে বসে পুরোনো কোন কথা উনি আলোচনা করেননি। তবে সানা আর ফুপির থেকে জানতে পারলাম যে আমি নানা ভাইয়ের বাসায় চলে যাওয়ার পরপরই উনি আর ফুপি আমার বাসায় গিয়েছিলেন। গিয়ে বাবাকে সরাসরি জানান যে উনি আমাকে বিয়ে করতে চান। বিষয়টা আমার হজম না হলেও তা সত্য।
উনি বাবাকে বলে উঠলেন,
‘ মামা আমি আরুপাখিকে বিয়ে করতে চাই। আশা করি আপনাদের কোন অমত নেই। ‘

ওনার কথা শুনে আম্মু সম্মতি দিয়ে বললেন,
‘ আমার কোন অমত নেই। আমি আর অনিকা দুজনেই সেই তোমাদের ছোট বেলা থেকে চায় যে তোমাদের দুজনের বিয়ে হোক, আর আমাদের মাঝের সম্পর্কটা আরও মজবুত হোক। ‘

বাবা কিন্তু কিন্তু করে বললেন,
‘ কিন্তু দেখো আরিশ যেভাবে ভাবছো এই সম্পর্ক টা নিয়ে , আমি কখনোই সেভাবে ভাবিনি। আমি তো আমার বন্ধুর ছেলের সাথে। ‘

বাবার কথা থামিয়ে ফুপি বললেন,
‘ ভাইয়া আমি চাই না আরু অন্য কারোর বাসায় বউ হয়ে যাক। আমি নিজেও ওকে সানার মতোই ভালোবাসি। ‘

ফুপির কথা থামিয়ে উনি কথার মাঝে বলে উঠলেন,
‘আমি আরুকে ভালোবাসি। ‘

খাওয়ার টেবিলে এই কথাটা শোনামাত্রই আমি যে কতো বার বিষম খেয়েছি বলার মতো না। না পেরে ফুপি সব কিছু বর্ননা করায় বন্ধ করে দিয়েছে। ফুপি বলেছে যে বাকিটা অন্যদিন বলবেন। এমনিতেও এটুকু কথা হজম করতে যে আমার কবছর সময় লাগবে হিসাব নেই।।
ফুপা আজ বাসায় নেই তবে খবরটা শোনার পর থেকে কতো বার যে কল করেছেন হিসাব নেই। আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি আর এসব ভাবছি। তাহলে ওনার মায়াবতী টা কি আমিই?
কথাটা ভাবতে গেলেও আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে মন মানতে চাইছে না। ফুপিও এখনো ঘুমাননি, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়তেই ফুপি বলে উঠলো ‘কে?’

ওপাশ থেকে উনি উত্তর দিতেই আমি জড়ো হয়ে গেলাম। ফুপি গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম উনি একটা সাদা পাঞ্জাবী পরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওনাকে দেখে ঘুমের ভান করতেই হাতে নাতে ধরা খেলাম। উনি আমার নাম ধরে ডেকে বললেন,
‘ উঠে এসো।’

ফুপি প্রশ্ন করলেন,
‘কেন কি হয়েছে? থাক না ঘুমাক এখানেই। ‘

উনি ইশারা করে আসতে বললেন আমাকে। আমি আর কিছু বললাম না, ফুপিও ইশারা করলেন আসার জন্য। আমি ওনার পাশে এসে দাঁড়াতে উনি ফুপিকে বললেন,
‘ও আজ থেকে আমার সাথে থাকবে। ‘

কথাটা শুনতেই আমি ঘরে ঢুকে যেতে নিলেই উনি হাত ধরে নিলেন আমার। ওনার কথা শুনে ফুপি আনন্দে আত্মহারা। উনি আমার হাত ধরে ওনার রুমে এনে দাঁড় করিয়ে দরজা লক করতেই আমি বললাম,
‘ দরজাটা খোলা রাখেন না, বাতাস আসবে ভালো। ‘

উনি কথা না বাড়িয়ে এসির পয়েন্ট টা বাড়িয়ে দিলেন। উনি বললেন যে ওযু করে আসতে, দুজন একসাথে নফল নামাজ পড়বো। আমি অবাক হলাম। আসলেই তো বিয়ের রাতে স্বামী স্ত্রীর নফল নামাজ পড়া উচিত। তবে উনিও যে এটা মনে করে পালন করবেন বিষয়টা আমি মাথাতেও আনিনি। আমরা দুজনেই নামাজের পাটিতে দাঁড়ালাম, এখন আর ভয় লাগছে না আমার মনের মাঝে প্রশান্তি ছেয়ে যাচ্ছে। নামাজ শেষ করে আমি জায়নামাজ রেখে গুটিগুটি পায়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে নিলেই উনি ধমক দিলেন,
‘ এই মেয়ে ও দিকে কোথায় যাচ্ছো? বিছানা কি এদিকে? ‘

ওনার কথা শুনে আমি বিছানায় ঝটপট করে শুয়ে পড়লাম। গরমেও গায়ে কম্বল টেনে নিলাম। উনি এসে আমার পাশে বসলেন আর একনিমেষে আমার গা থেকে কম্বলটা ফেলে দিলেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘ এটা যেন আর ভাল্লুকের মতো গায়ে জড়াতে না দেখি। ‘

আমি মাথা নাড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উনি এবার রেগে গিয়ে বললেন,
‘এদিকে ঘোরো।’

আমি ওনার দিকে না তাকিয়ে বললাম,
‘ আমার দেওয়ালের দিকে না তাকালে ঘুম আসে না। ‘

আমার এমন লজিকলেস কথা শুনে উনি ধমক দিয়ে বললেন,
‘ তাহলে আমিই এমন কিছু করি যাতে তুমি সারারাত ঘুমাতে না পারো, এখন তো সবকিছুই জায়েজ তাই না। ‘

ওনার মুখে এসব কথা শুনে আমি তিড়িং করে উঠে বসলাম। ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ এই না না, আমার ঘুম আসে। খুব ঘুম আসে। আপনার কিছু করার দরকার নাই। ‘

উনি আর কথা বাড়ালেন না। আমি শুয়ে পড়লাম, আর উনিও। আমাদের মাঝে প্রায় একহাত সমান দূরত্ব। আমি চোখ বন্ধ করলাম। উনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না তবুও আমার অসস্তি লাগছে। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। একটা সময় আমার চোখে ঘুম ঢলে এলো তারপর শুরু হলো আরিশ ভাইয়ার নিদ্রাহীনতা আর তার নিদ্রা হরনকারী তার আরুপাখি। উনি যে সারারাত আমার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে ছিলেন তা হয়তো আমি কখনোই জানতেও পারবো না।
ওনার মায়াবতীকে দেখার তৃষ্ণা ওনার কখনোই মিটবে না, কখনোই না।
#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

19.

সকাল সকাল নীচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ কানে আসতেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ খুলে তাকাতেই ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো প্রথমে। ঘড়ির অবস্থান দেখে মনে হলো যে উনি বোধহয় ইচ্ছা করেই ঘড়িটা সে জায়গায় রেখেছেন যাতে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার খাতিরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় বেলা দশটা এগারোটা দেখে মানুষ হার্ট অ্যাটাক করে। কিন্তু উনি তো সবসময় তাড়াতাড়ি ওঠেন। ওনার মতিগতি আমি বুঝি না। নিম পাতার ফ্যাক্টরি উনি, যা খুশি তাই করতে পারেন তা অবশ্যই এমন তেঁতো তেঁতো কাজ। কথাটা ভেবে আমি বিছানা ছাড়লাম জলদি। নীচে বোধহয় কেও জোরে জোরে চিৎকার করে ঝগড়া করছে, আর আমার ঝগড়া শুনতে পুরো টুইটুই লাগে। কথাটা মনে আসতেই আমি দরজার বাইরে থেকে নীচে উঁকি মারার চেষ্টা করলাম যে কে এতো সকাল সকাল ঝগড়া করছে। নীচে তাকাতেই আমার মেজাজ বিগড়ালো খানিকটা। ফারিন আপু আর তার মা, ফুপির সাথে ঝগড়া করছেন। এ ঝগড়া শোনার ইচ্ছাশক্তি আমার বিন্দুমাত্র না থাকলেও আমি শুনবো কারন আরিশ ভাইয়া ফারিন আপুকে কি জবাব দেন আমি জানতে চাই, সত্যিই যদি আমিই ওনার মায়াবতী হয়। আমি নীচে উঁকি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কেবল কথাগুলো শুনতে লাগলাম। ফারিন আপুর মা ফুপিকে বললেন,

‘আজ আমি তোমার নিজের বোন না, আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই বলে তুমি আমার মেয়ের সাথে এমনটা করতে পারো না। ‘

উত্তরে ফুপি রেগেমেগে বললেন,
‘আশ্চর্য রেনু, তুই এমনভাবে বলছিস যেন বিয়েটা আমার সাথে হয়েছে। আরিশ বিয়ে করেছে ওর পছন্দ অনুযায়ী। তাছাড়া আরিশ তো ফারিনকে সরাসরি জানিয়েছিল যে সে তাকে পছন্দ করে না। ব্যাস। ‘

কথার মাঝে ফারিন আপু বললেন,
‘ব্যাস ট্যাস কিছু না। মানছি আরিশ আমাকে বলেছে যে সে বিয়ে করতে পারবে না কিন্তু সে এই কথাগুলো আমাকে আগে কেন বলেনি? আর বললেই বা এরকম একটা পর্যায়ে এসে কেন বলবে যেখানে আমি ওর প্রতি দূর্বল। ও তো জানতো যে আমি ওকে পছন্দ করি। শুধু ও কেন, ওর সাথে তোমরাও তো জানতে তাইনা। আর এটা সে ঠিক করে নাই। এখন আবার ওই পিচ্চি কটকটি মেয়েটার সাথে বিয়েও করে নিল। বাহ! ‘

ফারিন আপুর মুখে এমন কথা শুনে রাগ হলো না, বরং হাসি পেল। উনি এবার কাঁদতে শুরু করলেন। আমি লক্ষ করলাম যে সবাই একে অপরের আছে কথা কাটি করছেন, আমি আরিশ ভাইয়া উনি নিশ্চিন্তে টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। উনি এমনভাবে খেতে লাগলেন যেন কোন কিছু ওনার কাছে যাচ্ছেন না। আমি এই মুহূর্তে খুব করে চাইছি যে আরিশ ভাইয়া ফারিন আপুকে কিছু বলুক। উনি উনি তো কিছু বলছেন না। ঝগড়ায় ক্লাইম্যাক্স আসছে না দেখে আমার বিরক্ত লাগতেই আমি রুমের দিকে চলে আসতে নিলেই হঠাৎ কিছু ভাঙার আওয়াজ পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি আবার দেখার জন্য ছুটে গেলাম। আমি তাকিয়ে দেখলাম ফারিন আপু আরিশ ভাইয়ার ব্রেকফাস্টের প্লেটটা ফেলে দিয়েছেন, আরিশ ভাইয়া এখনো শান্ত হয়ে রয়েছেন তবে ওনার চোখে রাগ বিদ্যমান। ফারিন আপু চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন,
‘পিচ্চি একটা মেয়েকে বিয়ে শাদী করে তুমি রিল্যাক্স! তুমি যদি তাকেই বিয়ে করবা তাহলে আমাকে এতোদিন ধরে আশা দেওয়ার মানে কি? সেদিন আমার বাসায় গিয়ে ওভাবে আমার সাথে নরম ভাবে কথা বলার মানে কি যদি তুমি ভালোই না বাসো। ‘

ফারিন আপুর কথাতে যুক্তি বিন্দু মাত্র নেই, ওনার মুখ যা আসছে উনি তা ই বলে চলেছেন। আরিশ ভাইয়া এবার রেগে গেলেন।
‘তা না হলে কি করতাম! তোমার সাথে কি তাহলে রাস্তার কুকুরের মতো ব্যাবহার করার দরকার ছিল আমার? ‘

ফারিন আপু কাঁদতে লাগলেন এবার। আরিশ ভাইয়া আর কথা বাড়ালেন না, শুধু বললেন,
‘তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে, ভালো ফিউচার আছে, ইউ ডিজার্ভ বেটার। এসব প্রেম ভালোবাসার পিছনে সময় নষ্ট করোনা। ‘

কথাটা বলে উনি চলে আসতে নিলেই ফারিন আপু বললেন,
‘ খালামনি ওই মেয়ে তোমার ছেলেকে বশ করেছে। আজ ওকে বশ করেছে কাল আরিশ কে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে নেবে তুমি দেখে নিও। ‘

ফুপি রেগে গেলেন বেশ, ওনার কথা শুনে আমারও রাগ হয়ে গেল। ফুপি বলতে লাগলেন,
‘না জেনে শুনে কথা বলো কেন? আর তাছাড়া আরু আমার আর এক মেয়ে। ওর সমন্ধে বাজে কথা বললে আমি সবসময় তা সহ্য করবো না কিন্তু। ‘

ফুপির এই কথাটুকু শুনে আমি রুমে চলে এলাম আমার রাগ হচ্ছে ভীষনরকম। আরিশ ভাইয়া ওনাকে আর কিছু বললেন না কেন। আমি ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ করছি ক্রমাগত, তখনই আরিশ ভাইয়া রুমে ঢুকলেন। ওনাকে দেখে আমি ওনার দিকে ছুটলাম আর ঝাঁঝালো কন্ঠে বললাম,
‘ আপনি ওনাকে কিছু বলেননি কেন হ্যাঁ? ‘

আরিশ ভাইয়া অবাক হওয়ার ভান করে বললেন,
‘ কাকে কি বলিনি? ‘

আমার ওনার এই না জানতে পারার মিথ্যা অভিনয়টা একদম ভালো লাগে না, আমি রেগে গেলাম আরও।

‘ কাকে আবার ফারিন আপুকে। ওনাকে কেন আপনি চড় থাপ্পড় মারলেন না। কই আমাকে মারতে গিয়ে তো কখনো দুবার ভাবেন না সপাটে গালে ঠুসঠাস বসিয়ে দেন আর তার বেলায় সাত খুন মাফ হ্যাঁ? ‘

উনি ভ্রু নাঁচিয়ে বললেন,
‘ তাহলে আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছিলেন সব? ‘

‘ তা শুনবো না কেন হ্যাঁ? ওনার সাহস দেয় কে আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলার। যান আপনি ওনাকে চড় মেরে আসুন। যান। এক্ষুনি। ‘

আরিশ ভাইয়া ধমক দিয়ে বললেন,
‘আর ইউ ইনসেন (পাগল)? আর কোন কথা না, জলদি রেডি হও। ‘

কোথায় যেতে হবে সেটা না শুনেই আমি বললাম,
‘ আমি কোথাও যাবো না আগে আপনি ওনাকে দু গালে দুটো চড় দিয়ে আসেন। তারপর যেখানে যেতে বলবেন আমি সেখানে যাবো।’

উনি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,
‘ ঘড়ির কাটা পাঁচ এর ঘরে আছে, ছয় এর ঘরে যাওয়ার মধ্যে যেন তোমাকে আমি রেডি হতে দেখি। ‘

আমি তবুও ঠাই বসে রইলাম সেখানে। উনি ঘড়ির দিক তাকিয়েই বললেন,
‘ টাইমের পর যদি আর একটুও লেট হয়েছে তো!’

আমি আমতা আমতা করে বললাম,
‘তো! তো কি হয়েছে? ‘

‘তাহলে আমি একাই শপিং করতে চলে যাবো একজনকে নিয়ে যাবো না। ‘

শপিং করার কথা শুনে আমি জলদি উঠে দাঁড়ালাম আর বললাম,
‘এই আমিও তো যাবো। আরিশ ভাইয়া ওয়েট আমি রেডি হয়ে আসি। তবে আপনাকে কিন্তু ওনাকে চড় মারতেই হবে। ‘

কথাটা বলে ওনার দিকে হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম আমি। ওনার টাকা নষ্ট করার জন্য হলেও আমার শপিং করা লাগবে।

আমি রেডি হতে সময় নিলাম কারন আমি চাই না নীচে গিয়ে ফারিন আপু আর ওনার মা কে দেখতে পেতে। আরিশ ভাইয়া বাইরে থেকে ডাকতে শুরু করলেন,
‘ আর কতখন? ‘

আমি ভিতর থেকে উত্তর দিলাম,
‘ এই তো আসছি আসছি। ‘

উনি ধমকের স্বরে বললেন,
‘ এটা নিয়ে পাঁচবার একই কথা বললে, আর না। তুমি আসবে নাকি আমি দরজা ভেঙে বাইরে নিয়ে আসবো টেনে কোনটা! ‘

ওনার ভাব গতি ভালো বুঝলাম না, দ্রুত বেরিয়ে আসলাম বাইরে, বেরিয়ে আসতেই দেখলাম উনি কটমট করে তাকিয়ে আছেন। আমি জানি আমি এখন ওনার সামনে হেসে ফেললে উনি আমাকে আর কিছু বলতে পারবেন নাহ, আর আমি আমার ট্রিকস অনুযায়ী হাসতেই দেখলাম সত্যিই উনি আর কিছু বললেন না। মাঝে মাঝে নিজের ওপরই নিজের গর্ব হয় আমার বুদ্ধির জন্য।
ফুপিকে বিদায় জানিয়ে আমি সানা আর আরিশ ভাইয়া বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। সানা আগে আগে গিয়ে গাড়িতে বসে আছে, আরিশ ভাইয়ার কাছে বকা খেতে খেতে আমি আর উনি একটু পিছিয়ে গেছি। মেইনগেটের দিকে যেতে নিলেই হঠাৎ আমার চক্ষুচড়ক গাছ। ওনার হাতটা একপ্রকার খামচি মেরে ধরে বললাম,
‘ আরিশ ভাইয়া দাঁড়ান। ‘

ওনাকে তোয়াক্কা না করে ওনার হাতটা ছেড়ে আমি দৌড় দিলাম কাঠগোলাপ গাছটার দিকে। ওমা সত্যিই দেখি আজকে গাছে একটা কুড়ি ধরেছে। আমি গাছটার দিকে অবাক হয়ে ঝুঁকে দেখছি। আরিশ ভাইয়া আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘ আবার কি ড্রামা। ‘

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,
‘এই দেখেন গাছে কুঁড়ি ধরেছে লাল রঙের। ‘

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘হ্যাঁ দেখলাম তো! তোমার জন্য জীবনে অনেক কাঠ গোলাপ দেখে ফেলেছি। উই মে গো নাও। ‘

আমি ওনাকে ধমক দিয়ে বললাম,
‘ আরে আপনি এতো নিরামিষ মানুষ কেন বলতে পারেন? ফুল হচ্ছে ভালোবাসা, ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে। তাছাড়া আপনি আমাকে কি বলেছিলেন মনে আছে? ‘

আমি জানি ওনার মনে আছে তবুও উনি না জানার ভান করে বললেন,
‘ কি বলেছিলাম? ‘

আমি পা উঁচু করে ওনার দিকে সমান সমান হওয়ার চেষ্টা করে ওনার মাথার চুলটা টেনে বললাম,
‘ আপনি যখন বড়ো হবেন তখন আপনি হবেন আমার মুরব্বী। আপনি মুরব্বী হয়ে আমি তো আপনার থেকে খালি মিথ্যা বলায় শিখবো দেখছি। আপনি কথায় কথায় জেনে শুনে মিথ্যা বলেন। ‘

উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
‘ তাহলে আমি কি ছোট? বিয়ে হয়ে গেল আজ কাল একটা বাচ্চা নিলেই হয় তা তুমি বলো আমি বাচ্চা। ‘

আমি যথাসম্ভব উঁচু হওয়ার চেষ্টা করে ওনার মুখ চেপে ধরে ভললাম,
‘চুপ। আপনি দিনদিন কেমন অশ্লীল হয়ে যাচ্ছেন। আমি আর আপনার আছে থাকবো না। ‘

উনি মুখ চাপা অবস্থায় বললেন, ‘ঠিক আছে দেখা যাবে। ‘

আমি ওনার কথা বলার সুযোগ না দেওয়ার জন্য বললাম,
‘ আপনি বলেছিলেন যেদিন আপনার বউ আসবে সেদিন এই গাছে ফুল ফুটবে। আপনার বউ হয়েছে তা এই কাঠ গোলাপ গাছ কি জানলো? নিশ্চয়ই এই গাছ আর আপনার মাঝে প্যাচাল আছে। ‘

উনি আমার কথা শুনে ৩৬০ ডিগ্ৰি ঘুরে আমার হাত ধরে হাটা দিলেন। আর বলতে লাগলেন,
‘ কি এক মেয়েকে বিয়ে করলাম যার কমন সেন্স নাই।রাস্তার মাঝে আজাইরা বকলে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিবো বলে রাখলাম।’

আমি মুখে আঙুল দিয়ে বললাম,
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। নো মোর ওয়ার্ডস মুডে চলে যাচ্ছি। ‘

উনি গাড়ি ছাড়লেন। সানা আর আমি দুজনেই বসে আছি। আরিশ ভাইয়া গাড়ি চালাচ্ছেন। প্রায় এক ঘন্টা পর পৌছালাম। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম একজন পিছন থেকে ডেকে উঠলেন,
‘আরুশি। ‘

আমি পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখলাম সেই ছেলেটা যার হাত ধরে দাঁড়ানোর জন্য উনি আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। আরিশ ভাইয়ার দিকে আমি তাকালাম, উনি আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি পুনরায় চড় খেতে চাই না। কথাটা ভেবে সানার হাত ধরে আরিশ ভাইয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছেলেটা আরিশ ভাইয়াকে দেখা মাত্রই পিছন হাটা শুরু করলো, আমার এবার হাসি পাচ্ছে। আমি বুঝলাম যে সেও এখানে এডমিশন নিতে এসেছে। ছেলেটা চলে যেতেই আমি ওনার হাত ধরে টানতে টানতে বললাম,
‘ কি রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনার কি তাকে ভালো লাগছে? আপনার ব্যাটা নজর খারাপ। ‘

আমার কথা শুনে উনিও বোধহয় ছ্যাকা খেলেন বেশ। তবে এতোটাও অবাক হননি কারন উনি জানেন যে কোন কথাকে তিল থেকে তার বানানোর মতো ক্ষমতা আমার আছে। সানা আহাম্মকের মতো চেয়ে রইলো, কিছুই বুঝছেনা সে। আমি ওদের দুজনকে নিয়ে হাটতে শুরু করলাম যেন আমি তাদেরকে এনেছি এডমিশন করাতে, এজ আ মুরব্বী মানুষ।

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here