ভালোবাসি বলে দাও পর্ব -১৬+১৭

#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

16.

ঘুম আসছে না কোনরকম। আমার মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘কে ওনার মায়াবতী? ‘

পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম সানা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমার চোখে ঘুম নেই আর সে দিব্যি ঘুমাচ্ছে সেটা দেখেও আমার বিরক্ত লাগছে। রাত একটা বাজে প্রায়। এ বাসার সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে। আচ্ছা আরিশ ভাইয়া কি এখনো জেগে আছেন? জেগে জেগে কি ওনার প্রেয়শীর সাথে কথা বলেছেন? নাকি পড়াশোনা করেছেন এখনো? ‘

কথাটা ভেবে উঠে পড়লাম আমি, নাহ আর ঘুম আসবে না আজ। এ বাসার ছাদটা আমার কাছে খুব অপরিচিত না হলেও কিন্তু বেশ অপরিচিত। তাই এতো রাতে ছাদে যাওয়ার সাহস দেখাবো না। কোন কিছু না ভেবে ফুপির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, দরজায় টোকা দেওয়ার আগ অবধি ভাবতে থাকলাম যে এতো রাতে ফুপিকে ডাকা উচিত হবে কি। কিন্তু আমার যে ঘুম আসছেনা!

যেই ভাবা সেই কাজ। দরজায় টোকা মারতে মারতে একটু হাক ছাড়লাম।
‘ফুপি একটু দরজাটা খোলো! ‘

আমি দুই বার ডাকা মাত্রই ফুপি দরজা খুলে দাঁড়ালেন। আমাকে এই মুহূর্তে দেখে যেন অবাক হলো না, ফুপির চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে তিনি এতোখন জেগে ছিলেন। আমাকে দেখে আমার হাত ধরে কোনরকম কোন প্রশ্ন না করে ঘরের ভিতরে টেনে দরজা বন্ধ করে প্রশ্ন করলেন,
‘ কি রে মা ঘুম আসেছেনা?’

যেখানে ফুপির অবাক হওয়ার কথা সেখানে আমি অবাক হলাম। মাথা নাড়িয়ে জানালাম যে না।
ফুপা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ফুপার বয়সী লোকেরা নাক ডেকে ঘুমান কিন্তু ফুপার সে স্বভাব নেই। আমার হাত ধরে ফুপি বিছানায় বসলেন আর আমাকে বললেন তার কোলে মাথা রাখতে। আমি আর দেরি না করে ফুপির কোলে মাথা রাখলাম। ফুপি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমরা দুজনেই চুপ। হঠাৎ আমি নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে উঠলাম,
‘ফুপি তুমি এতোখন জেগে ছিলে তাইনা? ‘

ফুপি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন ‘হ্যাঁ। ‘

টেবিলের ওপর থাকা আরিশ ভাইয়ার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমি বললাম,
‘আচ্ছা আরিশ ভাইয়া তোমার সাথে তার মনের সব কথা শেয়ার করে তাইনা? ‘

ফুপি মৌন সুরে জবাব দিলেন, ‘হমম। ‘

‘উনি হাতিরঝিল থেকে ফিরে তোমাকে এসে কিছু বলেছে? ‘

‘হ্যাঁ বলেছে তো। ‘

আমি এবার ফুপির দিকে তাকালাম, তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
‘জানো তো উনি কাওকে ভীষন ভালোবাসেন। আমি ওনার চোখে সে ভালোবাসা দেখেছি। ‘

ফুপি হাসতে হাসতে বললেন,
‘আরিশ ঠিকই বলে, তুই সেই ছোট্ট আরুটাই আছিস। কবে যে বড়ো হবি আর কবে তে সব বুঝবি। ‘

আমি মুখ গোমরা করে বললাম,
‘ ফুপি তুমিও? ‘

ফুপির বলা কথাতে আমি দমে গেলাম।

‘আরিশ যাকে ভালোবাসে সে একদম মায়াবতী। ‘

ফুপির মুখেও সে মেয়ের প্রশংসা শুনে আমার মোটেই ভালো লাগলো না, বিধায় বলে উঠলাম।
‘ঘুম পাচ্ছে আমার। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও আর নো মোর ওয়ার্ডস। ‘

কথাটা বলতেই ফুপি হাসলেন। আমি একটু রাগ দেখিয়ে বললাম,
‘তোমরা মা ছেলে দুজনেই ফাজিল। ‘

আমার এমন কথা শুনে ফুপি বেশ উচ্ছাসের সাথে হেসে বললেন,
‘ রাগ হচ্ছে? ‘

আমি ধমকের শুরে বললাম,
‘ বললাম না যে নো মোর ওয়ার্ডস, মানে আর কোন কথা না মানে না। ‘

/

দুই দিন অনায়াসেই সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালাম। আরিশ ভাইয়ার ধমক খাওয়ার ভয় নেই এই কদিনে কারন উনিও কিছু বলবেন না এখন আর, এক্সাম শেষ। সকাল আটটা কি নয়টা বাজে হয়তো। এই কদিন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অপরাধে আম্মু আমাকে নাস্তা দেয় না। তাই না পেরে রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের জন্য কফি আর ব্রেডটা নিজেই রেডি করে নিতে হয়। আজকে ক্ষিধে পেয়েছে বেশ তাই কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতেই দেখলাম যে আম্মু কার সাথে যেন গল্প করছেন। উপর থেকে একটু ভালোমতো উঁকি মারতেই দেখলাম যে মামা আর মামী বসে আছেন। আম্মুর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যে কোন কিছু নিয়ে একটা কথা কাটাকাটি চলছে। তবে মামা আর মামীকে দেখে আমি খুশি হয়ে গেলাম। এক নিমেষেই দৌড়ে ছুটে গেলাম। আমাকে অমন ভাবে ছুটতে দেখে মামা বলে উঠলেন,
‘আরে আরু আস্তে নাম পড়ে যাবি। ‘

মামার কথার তোয়াক্কা করলাম না আমি, গিয়ে মামীকে জড়িয়ে ধরতেই মামী আমার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিলেন। আমি আসাতে আম্মু আর মামার কথার মাঝে যেন একটা অল্প সময়ের বিরতি ঘটলো। আমাকে দেখে মামু বলে উঠলেন,
‘ আরু মা তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, নাহলে দেরি হয়ে যাবে। ‘

আমি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম,
‘কেন কেন কেন? ‘

আম্মু মুখ গোমরা করে বললেন,
‘তোর নানা ভাই যেতে বলেছে। ‘

আমি আম্মু কে উদ্দেশ্যে করে বললাম,
‘কিন্তু আমি তো এখন যাবো না ভাবছিলাম। আমি তো মেডিকেল এর এক্সাম টা শেষ হওয়ার পর যাবো ভেবেছিলাম। আরিশ ভাইয়া তো কালকে কোচিং এ এডমিশনের জন্য নিয়ে যাবেন বললেন। আমি এখন কি করে যাবো? ‘

মামা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
‘তুই তো তোর নানাভাইকে চিনিস। সে যা বলে তা করা বাধ্যতামূলক। তাই না করিস না মা। এক দুদিনেরই তো ব্যাপার। ‘

আমার মন সাই দিচ্ছে না। আমি আম্মুর দিকে ব্যাথিত দৃষ্টিতে তাকাতেই আম্মু বলে উঠলেন,
‘আমি আরিশের সাথে কথা বলে নেবও। তুই গিয়ে রেডি হ। ‘

আমি দুমনা মন করে উঠে এলাম। যাওয়ার ইচ্ছে নেই তবুও যেতেই হবে ভেবে কেমন কেমন জানি লাগছে। আমি সেখান থেকে উঠে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেও যেন আমার পা চলছে না। আমি ধীমে ধীমে নিজের রুমে এসে দরজা লক করে কিছুখন বিছানার ওপর বসে রইলাম। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম প্রায় 25 টা মতো মিসড কল, আরিশ ভাইয়া দিয়েছেন। আমার বুকের ভিতর কেঁপে উঠলো। বাঁচতে চাইলে এক্ষুনি কল করতে হবে। ওনার কাছে ফোন ধরাতেই উনি এক চান্সের রিসিভ করলেন, আমার বুকের ভিতর ধুকধুক করছে।
উনি ফোন রিসিভ করতেই ধমক দিলেন,
‘কতোবার ফোন করেছি ডু ইউ নো? মন আর ফোন দুটোই কি মহাকাশে রেখে আসো নাকি স্টুপিড। ‘

আমি আমতা আমতা করে বললাম,
‘আমি তো নাস্তা করতে নীচে গেছিলাম। গিয়ে দেখি মামা আর মামী এসেছে তাই ওখানে গেছিলাম। এসে দেখলাম আপনার কল। ‘

উনি কঠিন স্বরে বললেন,
‘তারা কেন এসেছে হঠাৎ? ‘

‘ তারা আসবে না? তারা তো আমাদের নিজেরই লোক। ‘
উনি রেগেমেগে বললেন,
‘নিশ্চয়ই ওই জল্লাদ নানাভাই পাঠিয়েছে। ‘

আমি ওনার কথা শুনতে পেলাম। ওনার কথা শুনতে পেয়ে বললাম,
‘ আপনি এসব বলছেন কেন? নানা ভাই ই পাঠিয়েছে। দুদিনের জন্যই তো থাকবো। তারপর তো চলেই আসবো। ‘

কথাটা শুনে উনি রেগে গিয়ে বললেন,
‘তোমার নানাভাইকে বলবে তোমার বিদেশ ভ্রমন শেষ হলে মেডিকেল এর জন্য কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিতে। আর সরকারি তে চান্স না পেলে আবার বিদেশ পাঠাতে, তোমার নানার তো টাকার অভাব নেই। ‘

আমি ওনার কথা শুনে নরম ভাবে বললাম,
‘ দু দিনের ব্যাপার। তারপর তো চলেই আসবো। আর আমার নানাভাইকে বিনা এতোগুলো কথা শোনালেন কেন? ‘

‘ আমার সব জানা আছে। তোমার আম্মু আর বাবা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন, সেটা মানতে তোমার নানাভাইয়ের দশ বছর সময় লেগেছে। তাই সে এখন চাই তার পছন্দ মতো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হোক। আলহামদুলিল্লাহ তার ইচ্ছা পূরন হোক। যদি গিয়ে কোন ঝামেলায় পড়েছো তো তোমার খবর আছে আমার কাছে। ‘

ওনার কথা শুনে হাসি পেলো। যেন আমি গেলেই নানা ভাই আমাকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন আর এমনটা যে উনি আমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছেন। আমি হি হি করে হেসে বললাম,
‘চিন্তা নেই অতো সহজে হারিয়ে যাচ্ছি না। ‘

কথাটা শুনতেই উনি ফোনটা কেটে দিলেন। আমি বোকা বনে গেলাম। ওনার রাগ ভাঙাতে দ্বিতীয়বার কল দিতে গেলেই উনি আর ধরলেন না। আমি রেগে গিয়ে বললাম,
‘ ব্যাটা সব রাগ খালি আমার ওপরেই দেখায়। বেয়াদপ ছ্যামড়া। ‘

কথাটা বলে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম।

গোছাগাছ শেষ করে রেডি হওয়ার শেষ পর্যায়ে গিয়ে মামা আর মামীর ডাক শুনতে পেলাম আমি। আমি ব্যাগটা নিয়ে নীচে নামতেই মামা আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললেন,
‘চল এখন। আপু আসছি, সাবধানে থেকো। আর আমি আরুকে পৌছে দিয়ে যাবো। ‘

আম্মু কোন কথা বলছে না, মুখ গোমরা করে আছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে যে অনেক কিছু হয়ে গেছে তা বুঝতে পারলাম কিন্তু কোন কুল কিনারা করে উঠতে পারলাম না যে কি হয়েছে কারন এরা আমার সামনে একটা বিন্দু মাত্র উচ্চারন করছে না। হাটতে হাটতে গেট এর কাছে এলাম। মামা ব্যাগটা গাড়িতে রাখতে গেলেন। মামী আম্মুর হাত ধরে বললেন,
‘ চিন্তা করো না ভাবী, আমি আছি তো। ‘

আমি মামীর মুখের দিকে তাকালাম। অনেক কিছু বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু ব্যার্থ হচ্ছি বারবার। আমি আম্মুকে বাই বলে গাড়িতে উঠতেই তাদের কথোপকথনের কিছু অংশ আমার কানে গেল। আম্মু কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
‘ আমি চাই না এরকম করে জোর জবরদস্তি করে বাবা আমার মেয়ের বিয়ে যার তার সাথে দিয়ে দিক। শুধুমাত্র নিজের জেদ পূরন করতে বাবা আরুর সাথে এমনটা করলে আমি নিজেই তোদের আছে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসবো বলে রাখলাম। আমার মেয়েকে তোর ওপর দায়িত্ব দিয়েছি তেমন দায়িত্ব সহকারে দিয়ে যাবি আমার কাছে। বাবা ওকে একপলক চোখে দেখার অযুহাতে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তো বিষয়টা ভালো হবে না। আরুর বাবা আরুর বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন তার বন্ধুর ছেলের সাথে। তাতে আমার অমত থাকলেও আমি কিছু বলতে পারিনি কিন্তু সবসময় আমি চুপ করে থাকবো না। ‘

আম্মুর এমন কথা শুনে আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। এই মুহূর্তে আরিশ ভাইয়ার বলা কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। ওনার মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিবো তার আগেই মামী এসে আমার পাশে বসে পড়লেন, গাড়ি ছেড়ে দিল আমি কিছু করতে পারলাম না।
#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

17.

নানাভাইয়ের সামনে বসে আছি বিগত এক ঘন্টা যাবৎ আর ওনার পাশে বসে আছেন ওনার বয়সী একজন মুরব্বী মানুষ। নানাভাই বসে আছে ঠিকই কিন্তু তার থেকে সামনের বয়সজেষ্ট মানুষটা প্রশ্ন করছেন বেশি। আমার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে ফ্যানের নীচে বসেও। ওনার এমন প্রশ্ন শুনে আমার এই মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আর আরিশ ভাইয়ার সামনে গিয়ে কান ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আপনার কথা আমি আর কখনো অমান্য করবো না। ‘

চাইলেও সে সুযোগ আমার কাছে নেই। মামী নাস্তাপানি রেখে গেছেন অনেক আগেই আর যাওয়ার আগে বলে গেছেন যে ভয়ের কোন কিছু নেই। তারা যে এভাবে মিথ্যা বলে আমাকে এখানে আনবে জানলে আমি কখনোই এখানে আসতাম না।

মুরব্বি মানুষটার প্রশ্ন গুলো শুনে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেমন-
‘রান্না বান্না কিছু পারো? ‘

‘অতিথি আপ্যায়ন? ‘

‘স্বামীর সেবা যত্ন? ‘

ওনার এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে আমার শ্বাস আটকে আসতে চাইলো, আমি মুখে হাত দিয়ে বমি করার মতো একটা ভাব করে বললাম,
‘ আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। ‘

আমার এমন কথা শুনে সত্যিই সেই মুরব্বী মানুষটা নাক মুখ কুঁচকে নিলেন, আমি ওঠার জন্য পা বাড়াতেই উনি বলে উঠলেন,
‘মাইয়া কি আদব কায়দা কিছু জানে না? এ কেমন নাতনি আপনার? ‘

কথাটা শুনে নানাভাই বললেন,
‘বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে গা।’

আমার চোখে জল টলটল করতে লাগলো, আমি মুখে হাত দিয়ে দৌড়ে ছুটলাম ওয়াশরুমের দিকে, আমার এখন সত্যিই খুব বমি পাচ্ছে। আমাকে দৌড়াতে দেখে মামী আমার পিছন পিছন এলেন। বেসিনে গিয়ে অনর্গল বমি করতে লাগলাম আমি। আমার শরীরে আর দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। বেসিন থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আয়নায় মামীর প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম। সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে চোখের সামনে। আমি মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলেই মামী আমার হাত ধরে আটকে নিলেন। মামীর মুখ ভয়ে লাল আভা ধারন করেছে, আমার সাথে উনিও কাপছেন। ওনার শাড়ীর আঁচল দিয়ে উনি আমার মুখটা মুখিয়ে দিয়ে কোনরকমে ওনার ঘর অবধি নিয়ে গেলেন আমাকে। মুরব্বী মানুষটা নাকি দুপুরে খাবেন তাই মামাকে একটা এলাহী বাজারের লিস্ট ধরিয়েছেন নানাভাই কারন লোকটা নাকি বরপক্ষ তাই তাদের আপ্যায়নের কোনরকম ক্রুটি চাইনা তিনি। এসে এবধি এইসব কথায় আমার কানের কাছে বাজছে, মামী নিজেও দু দন্ড বসার সুযোগ অবধি পাননি।

মামী আমাকে এনে বিছানায় আধশোয়া করে বসিয়ে আতঙ্কিত হয়ে বললেন,
‘ দাঁড়াও আমি তোমার মামাকে ফোন দিয়ে ডাক্তার আনতে বলি। ‘

আমি মামীর হাত ধরে আটকালাম, বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে কিছু একটা করতে হবে না হলে নানাভাইয়ের মতি গতির ঠিক নেই, পারলে উনি আজকেই আমার সাথে অন্য কারোর বিয়ে দিয়ে দেন। আমি মামীর হাত ধরে আধো আধো কন্ঠে বললাম,

‘মামী তুমি কাওকে কিছু বলো না, আমি ওনাদের সামনে একটু নার্ভাস হয়ে গেছিলাম। এমনিতেই উঠে আসায় লোকটা আমাকে বেয়াদপ ভেবেছেন তারপর এখন যদি শোনে যে অসুস্থ তাহলে তোমাদেরকেও অপমান করবে। তুমি শুধু আমার ফোনটা একটু এনে দাও প্লিজ। ‘

মামী প্রথমে ভয়ে কিন্তু কিন্তু করলেও পরে রাজী হলেন কারন উনিও চান না বিয়েটা হোক। উনি দ্রুত পাশের ঘর থেকে আমার ফোনটা আনলেন। ওনাকে দেখে নানাভাই হাক ছাড়লেন,
‘ কই তোমার ভাগ্নীকে জলদি আসতে কও! আর কতো দেরি লাগাইবো? ‘

কথাটা আমার কানে এলো, আমার বুকের ভিতর ধুকধুক করছে। খারাপ কিছু না হয়ে যায় সেই আশঙ্কায় আছি আমি। মামী ঘরে এসে আমার হাতে ফোন গুজে গিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘আরু তোমার মামা তোমার নানাভাইয়ের কথার খেলাফ করতে পারবে না, আমি ওনাকে ভালোভাবে চিনি। খারাপ কিছু হওয়ার আগে তুমি একবার বাসায় কল দিয়ে সব জানাও ততখন আমি দেখছি।’

আমার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে অনবরত। মামী চলে যেতে নিলেই আমি ওনার হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম,
‘ তোমরা জেনে শুনে কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলে মামী? কেন? ‘

মামীর হাত ধরে কাঁদতে লাগলাম, ওনারও গলা ধরে এলো। উনি আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
‘ আচ্ছা তুমি কাওকে ভালোবাসো আরু? ‘

আমি ফুঁপিয়ে উঠছি কান্নার তোড়ে, উনি আমার চোখ মুছিয়ে বললেন,
‘ না মানে এমন কেও যাকে তুমি পছন্দ করো, যাকে তুমি চাও। যদি তেমন কেও সত্যিই থাকে তাহলে ফোন করো আর বলো এখান থেকে তোমাকে অধিকার সহ নিয়ে যেতে নাহলে সারাটা জীবন আফশোষ থেকে যাবে তোমার এবং আমাদেরও। ‘

কথাটা বলে মামী চলে গেলেন। আমি এখনো কেঁপে কেঁপে উঠছি। মামীর কথা শুনে আমি কয়েক সেকেন্ড নিরব হয়ে গেলাম যেন। আমার তো আরিশ ভাইয়া ছাড়া তেমন কোন মানুষ জীবনে নেই। ছোট থেকে ওনার সাথেই আমার বড়ো হয়ে ওঠা এমনকি ওনার জন্য কখনো কোন ছেলের সাথে ঠিকভাবে কথাও বলতাম না। সেখানে উনি ছাড়া আমর জীবনে আর কে ই বা থাকবেন?

আমি কিছু না ভেবে ওনাকে কল করতে গেলেই আমি পুনরায় ভাবলাম,
‘উনি কাওকে ভালোবাসেন, ওনার একজন মায়াবতী আছে। উনি তাহলে কেন আসবেন ? তার উপর উনি তো বলেছেন যে এখানে এসে কোনরকম কোন সমস্যা র মুখোমুখি হলে উনি কোনভাবে হেল্প করবেন না আমাকে। ‘

কথাটা ভাবতেই আমি কেঁদে উঠলাম। আজ হিংসা হচ্ছে ভীষনরকম সেই মেয়ের প্রতি যিনি ওনার মায়াবতী। আজ যদি আমি ওনার সেই মায়াবতী হতাম তাহলে উনি তো ঠিকই আসতেন।

কথায় বলে বিপদে বাবা মা ছাড়া কেও পাশে থাকে না। কথা গুলো অনবরত আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরালাম বাবার কাছে।
একবার কল ধরতেই আমি বাবাকে কম্পিত কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম,
‘ বাবা তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। এরা নাহলে আমাকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো। ‘

কথাটুকু বলতে না বলতেই মামী কোনরকম দৌড়ে ঘরে ঢুকে বললেন,
‘আরু তোমার নানাভাই আসছে, জলদি কান্না থামাও। ‘

ফোনটা কাটলাম না আমি তার আগেই ফোনটা ভয়ে হাত থেকে পড়ে গেল। মামী আমার চোখ মুছিয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে দিলেন। নিজেকে কেমন পুতুল পুতুল লাগছে। ওপাশ থেকে কেও একজন আমার সাড়া শব্দ না পেয়ে ‘ এই মেয়ে’ বলে চিৎকার করছেন সেটা যদি আমার কান অবধি পৌছাতো তাহলে বোধহয় মনোবল পেতাম। সে সুযোগ টুকুও পেয়ে উঠলাম না আমি। নানাভাই ঘরে ঢোকার আগেই মামী আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে সেই লোকটার সামনে বসালেন। আমার শরীর কাঁপছে আর মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে। নানাভাইয়ের মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে তিনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট। উনি বলে উঠলেন,
‘ মোদের অন্নেক বড়ো পরিবার, পেরায় ১৭ জন মানুষ একসাথে থাকি। তুমি হইবা কি মোদের বড়ো বউ, বুঝতেই পারতেছো তোমার দায়িত্ব সবার সেবা যত্ন করা, আদর আপ্যায়ন করা। তোমার নানভাইয়ের কথা শুনে তো মোর ভালোই লাগসে যে তুমি একটা সংসারী মাইয়া। তা বেশ, তোমারে তো আমাদের পছন্দ হইছে। আমাদের ছেলে হলো কি এলাকার প্রধান।’

আমি নানাভাইয়ের দিক দূর্বল দৃষ্টিতে তাকালাম, তিনি পাকাকথা পেয়ে ভীষন খুশি মনে হচ্ছে। বয়স্ক লোকটা এবার আমাকে উঠে দাঁড়াতে বললেন আমার পায়ের পাতা দেখার জন্য। কথাটা শুনতেই আমি টলমল করে কেঁপে উঠলাম যেন। দূর থেকে মামী চোখ ছলছল করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার শরীর কাঁপছে। আমি উঠছিনা দেখে নানাভাই বলে উঠলেন,
‘আজকে সন্ধ্যায় তাহলে মোহিতোশের সাথে আরুর আংটি বদলটা কারালেই হয়।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, তাদের এই সমস্ত কথা শুনে আমার মাথার ভিতর চক্কর দিয়ে উঠলো। সামনে বসে থাকা দুটো মানুষকে ডবল ডবল অর্থাৎ চারজন হিসাবে দেখতে পেলাম আমি বুঝলাম আমার আর কিছু করার নেই। আমি জ্ঞান হারালাম তারপর আর কিছু মনে নেই।

কতখন পর আমার জ্ঞান ফিরলো আমি জানি না কিন্তু যখন চোখ খুললাম তখন কেঁপে উঠলাম খানিকটা। কারন আমার পরিবারের কাওকেই দেখলাম না আমি। ওরা এখনো এসে পৌছায়নি তাহলে? নাকি তারা অপমানিত হয়ে ফিরে গেছে। কিন্তু নাহ ওনারা আমাকে ফিরিয়ে না নিয়ে যাবেন না। মামী আমার মাথার কাছে বসে আছেন। আমি উঠতে গেলেই ডাক্তার আমাকে বলে উঠলেন,
‘ এই মাইয়া উঠো কিল্লাই, এই অবস্থায় এমন একটু আধটু হয়। ‘

ওনার কথাবাত্রা আর চালচলন দেখেই বুঝলাম যে উনি গ্ৰামের হাতুড়ে ডাক্তার। কিন্তু এই অবস্থায় মানে কোন অবস্থায় বোঝাচ্ছেন উনি? আমি অবাক হলাম, মামীর দিকে তাকাতেই দেখলাম যে তিনি মাথা নীচু করে বসে আছেন, নানাভাইকে ঘরের কোথাও দেখলাম না।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ এই অবস্থায় মানে? কি হয়েছে আমার? ‘

ডক্টর তার ব্যাগটা গোছাতে গোছাতে বললেন,
‘ অল্প বয়সে এসব অকাল কাম না করলেও তো পারতা। পরিবরের মান সম্মান, তোমার নানার মান সম্মান ডাও তো আর রাখলা না। এই কথা যদি বাইরে পাঁচ কান হয় তো তোমার নানাভাইয়ের সম্মান কোথায় যাইবো জানো? ‘

আমি মামীর দিকে তাকিয়ে ওনাকে ডেকে বললাম,
‘ মামী উনি কি বলছেন এসব। ‘

মামী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ডাক্তার বললেন,
‘ তুমি তো দুই মাসের পোয়াতি সেই কথা কি তোমাকে আবার মনে করাইতে হইবো? ‘

আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন, উনি এসব কি কথা বলছেন। আমি রেগে গিয়ে উঠে বসে ওনার জামার কলার ধরে বললাম,
‘ থাপড়িয়ে আপনার গাল লাল করে দেবো আমি। কি যা তা বলছেন এসব।’

উনি কলার ছাড়িয়ে রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘ কার সাথে অকাল কুকাম কইরা এখন আইসে সতী সাজতে। সমস্যা নাই তোমাকে আমি মাইনা নিবো আমর লগে, কাওকে কিছু জানতেইও দিব না।’

আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল যেন, ইচ্ছে করলো ওনাকে এখানেই শে/ষ করে দিই।
#ভালোবাসি_বলে_দাও
#আরিশ❤আরু
#Suraiya_Aayat

Bonus part.

ওনার কথা শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল যেন, ইচ্ছে করলো ওনাকে এখানেই শে/ষ করে দিই। কিসের ভিত্তিতে উনি বলেন আমি প্রেগন্যান্ট?
ওনার কথা শুনতেই আমি মামীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘মামী উনি এসব কি বলছেন? তুমি ওনাকে কিছু বলো। ‘
আমি ওনাকে এতো কিছু বলার পরও দেখি মামী চুপ করে আছেন কোন কথা বলছেন না। না পেরে আমি এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
‘ মামী তুমি ওনাকে কিছু বলছো না কেন? তোমরা তো জানো যে ডক্টর বলেছে আমার বেবি হওয়া না হওয়ার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা। আর আমি কার সাথে কি করেছি যে উনি এই অপবাদ দিচ্ছেন। ‘

আমার কথা শুনে ডাক্তার বললেন,
‘পোয়াতি হয়ে এসব কথা কেমন বলো যে বাচ্চা হবে না! ‘

ওনার এমন লজিকলেস কথা শুনে আমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম। ডাক্তারের এমন উস্কানিমূলক কথাবাত্রায় মামী যেন আরও আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, উনি নির্বিকারে আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন।
মামীর পাশাপাশি ডাক্তার ও বেরিয়ে গেলেন। আমি সেখানেই থ হয়ে বসে রইলাম। মাথাটা শক্ত করে ধরে রইলাম আমি। আমার আগে যতোটা না মাথা ঘুর ছিলো তাদের এমন কাজকর্মে আমার মাথা ব্যাথা আরও বেড়ে গেল।
ইতিমধ্যে বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। বাবা আর আম্মুর চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, সমান তালে নানাভাই ও চেঁচিয়ে চলেছেন আর ডাক্তারের কন্ঠস্বর ও শুনতে পেলাম মাঝেমাঝে।

আমি খাট থেকে পা নামার জন্য প্রস্তুতি নিতে গেলেই নানাভাইয়ের কথায় দমে গেলাম, আমার পা আর নামতে চাইলো না।

‘ তোর মতো তোর মাইয়াও যে এমন কুলাঙ্গার হইবো সেটা আমি আন্দাজ করবার পারছিলাম। নিজের আম্মা যেখানে তার বাপের অমতে বিয়ে করসে সেখানে তোর মাইয়ার থেকে এসব আশা করবার পারছি। কি ভাবো শহরে থাকো বলে এসব কিছু জানাজানি হইবো না? আর তোর ননদের ছেলের সাথেও তো তার ঢলাঢলি কম না। না জানি তার সাথে কি করবার পারছে। ‘

নানাভাইয়ের এমন কথা শুনে আমি কুঁকড়ে গেলাম একনিমেশেই। একটা মানুষ কতোটা খারাপ ধারনা পোষন করতে পারে তা হয়তো আজ নিজে এই পরিস্থিতিতে না দাঁড়ালে জানতেই পারতাম না। নিজেকে বিনা দোষে এভাবে কলঙ্কিত হতে দেখে আমার চোখ ফেটে জল গড়াতে লাগলো। শুধু আমাকে নয়, আমার আর আরিশ ভাইয়ার নামটা জুড়ে তাদের এমন নোংরা কথা শুনতে হচ্ছে।

বাবা চেঁচিয়ে বললেন,
‘আমার মেয়ে আর ভাগ্নার নামে আর একটাও বাজে কথা বললে আমি ভুলে যাবো যে আপনি মুরব্বি একজন মানুষ। আপনি নিজেই তো আপনার মেয়েকে সম্মান করতে পারেন না সেখানে আমার মেয়েকে আপনি কিভাবে সম্মান দেবেন। আর যাকে নিয়ে বলছেন সে এতো ছোট মনের মানুষ না। ‘

নানাভাই কিছু বলতে যাবে তখনই আম্মু মামীকে ধরে বললেন,
‘তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে এসো ভাবী। আমি ওকে নিয়ে এক্ষুনি চলে যাবো। শুধু তোমাদের জোরাজুরিতে আমি তাকে পাঠিয়েছি। এর পর তোমাদের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখবো না আমি।’

নানাভাই বলে উঠলেন,
‘ কেও কোথাও যাবে না যতখন না এই ছেড়ি স্বীকার করবে এই বাচ্চা কার। ‘

আম্মু বাবাকে রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘ আরিশকে একটা ফোন করো না দেখো না ছেলেটা কতদূর আছে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না এসব। ‘

বাবা আম্মুকে আশস্ত করে বললেন,
‘ এক্ষুনি চলে আসবে। পুলিশের কাছে গেছে একটু সময় তো লাগবেই। ‘

পুলিশের নাম শুনে ডক্টর হঠাৎ করে বলে উঠলেন,
‘ দেখেন মহিব সাহেব, বিয়ের আগেই একটা মেয়ের পোয়াতী হওয়া মোটেই ভাল কথা না। আপনার নাতনি যখন স্বীকার করতেসে না যে সেটা কার বাচ্চা তখন আপনাদের মান সম্মান রাখতে আমি এ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে রাজী। ‘

ডক্তারের এমন কথা শুনে আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। যত নষ্টের মূল সে।

ডাক্তারের এমন কথা শুনে নানাভাই বললেন,
‘এই ডাক্তারের সাথেই তোর মেয়ের বিয়ে হবে। ‘

ডক্টর শুনে খুশিতে লাফাতে লাগলেন যেন। আমি দরজার পাশে থাকা একটা মোটা লাঠি হাতে নিলাম, আজকেই আমার হাতে তার শেষ দিন। চোয়াল শক্ত করে আমি তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি সবে উঠানে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমাকে দেখে ডাক্তার বলে উঠলেন,
‘তোমার ওই বাচ্চা আজ থেকে আমার। ‘

বাবা ওনার কলার ধরে বললেন,
‘মুখ সামনে কথা বল, তোরে তো আমি জেলে দিব মিথ্যা দায়ের অপরাধে, আর আমার মেয়ের সিদ্ধান্ত আমি নিবো আপনি না( নানাভাই কে উদ্দেশ্যে করে) । আর আরু নিজেই বাচ্চা আর ও কি করেইবা কি! আপনার কি এসব বলতে মুখে আটকাই না,মুরব্বী তো আপনি। ‘

ডাক্তার বললেন,
‘ আমার কলার ছাড়েন আর আপনার মেয়েকে প্রশ্ন করেন যে আপনার মেয়ে বাচ্চা আনলো ক্যামনে। ‘

ডক্টর এর এমন কথা বলতে বলতে আমি দেখলাম আরিশ ভাইয়া একজন লোককে নিয়ে বাসায় ঢুকছেন। ওনাকে দেখে আমি যেন মরুভূমিতে জল সন্ধান পেলাম। ওনাকে দেখা মাত্রই হাত থেকে লাঠিটা ফেলে ছুটে গিয়ে ওনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলাম আমি। ওনাকে এমন ভাবে ধরেছি যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবেন। উনি একহাতে আমাকে আগলে নিলেন।

আমাকে ওনার সাথে দেখে ডক্টর বললেন,
‘ এই ছেলের লগে কি তার লটরপটর চলে নাকি?

আমি ওনাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। সবকিছু কেমন কল্পনার মতো লাগছে। আম্মু আমার কাছে ছুটে এলেন। আরিশ ভাইয়া একহাতে আমার চোখ মুছিয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ ওটা আমার বাচ্চা আর আমিই ওর জামাই, ওর সাথেই আমার লটরপটর, ওর সাথেই আমার সব। আপনাদের কোন সমস্যা? ‘

ওনার কথা শুনে আমার হৃদগতি থেমে আসতে নিলো, তড়িৎ গতিতে ওনাকে ছেড়ে সরে এলাম, ওনায় জড়িয়ে ধরায় কি উনি এমনটা বললেন? আমি ওনার দিকে ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আধো আধো স্বরে বললাম,
‘ আপনি এসব কি বলছেন আরিশ ভাই? আপনি ওদেরকে বলেন যে এসব মিথ্যা।’

উনি আমার হাতটা ধরে বললেন,
‘ নো মোর ওয়ার্ডস। আজ মিথ্যে করে বলছে তো একদিন না একদিন সত্যিই আমাদের বাচ্চা হবে। আসো। ‘

কথাটা বলে উনি আমার হাত ধরে কাজিকে আসার ইশারা করতেই আমি আউলিয়ে গেলাম। ওনার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আমি ভাবলাম উনি হয়তো ওই ডাক্তারের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। আমি সপাটে বললাম,
‘ আমি ওই বুড়ো কে বিয়ে করবোনা। ‘

কথা শুনে ডাক্তার টা বললেন,
‘ বেহায়া মেয়ে তুমি বুড়ো বলো কাকে হ্যাঁ? ‘

আরিশ ভাইয়া আমার হাতটা ধরে একটা টান দিয়ে ডক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ওনার দাঁত বরাবর একটা ঘুষি দিতেই উনি সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন।
‘ আরুপাখির নামে আর একটাও নোংরা কথা বললে আপনার জ্বিভ আমি টেনে ছিড়ে দেবো। ‘

কথাটা বলে উনি সাথে থাকা পুলিশকে বললেন,
‘অফিসার আপনি ওনাকে নিয়ে যান আর এটাও জেনে নিবেন যে উনি কোথা থেকে ডাক্তারি পাশ করেছেন যে পেশেন্ট দেখলেই বুঝতে পারেন যে সে প্রেগন্যান্ট।’

উনি কাজী কে ডাকলেন। নানাভাই এখন নিরব দর্শক এর ভূমিকা পালন করছেন, আর পুলিশ দেখে উনি দমে গেছেন।

মামী আমাদেরকে সোফায় বসতে বললেন, মামীর দিকে তাকাতেও আমার লজ্জা লাগছে, উনি আমার অসময়ে আমার পাশে ছিলেন না এবং সবার মতো উনিও আমাকে অবিশ্বাস করেছেন। আরিশ ভাইয়া আমাকে নিয়ে বসলেন। আমি আব্বু আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মুকে দেখে ভীষনরকম খুশি মনে হচ্ছে তবে বাবা হয়তো একটু কিন্তু কিন্তু করছেন কারন তিনি তার বন্ধুকে একপ্রকার কথা দিয়েছিলেন যে তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে হবে।
আমি দৃষ্টি নত করলাম। কেমন ভয় ভয় আর অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। আরিশ ভাইয়া কতো দায়িত্ব সহকারে আমার হাতটা শক্ত করে মুঠিবদ্ধ করে বসে আছেন। উনি বললেন,
‘ কাজী সাহেব আপনি বিয়ে পড়ান। আর সাক্ষী হিসাবে মেয়ের বাবা, মা, তার মামী, আর একজন উপস্থিত মানুষ সে আমাদের জন্য মৃত। ‘

কথাটা শুনতেই নানাভাই বলে উঠলেন,
‘ বেয়াদপ সবাই। ‘

আরিশ ভাইয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। আমি এখনো কাঁপছি। সবকিছু আমর মাথার ওপর দিয়ে গেলেও বুঝতে পারছি যে ওনার আর আমার বিয়ে হতে চলেছে এই মুহূর্তে। তাহলে ওনার মায়াবতী? আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি, কিন্তু উনি আমর দিকে তাকাচ্ছেন না বিন্দুমাত্র। উনি যে রেগে আছেন আমি বুঝতে পারছি। ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম উনি তিনবার কবুল বলে ফেললেন, আমি ওনার দিকে তাকিয়ে কবুল বলতেই আর সই করতেই আমি ওনার হয়ে গেলাম এক নিমেষেই। উনি আমার দিকে একবার তাকালেন। আমি ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। আমি হাত ছাড়াতে নিলেও উনি ছাড়লেন না বরং আরও শক্ত করে ধরলেন। আমার ওনার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল।
‘একবার পেলে আর সারাজীবনের মতো ছাড়ছি না।’ কথাটা আমার হৃদয়ে গিয়ে আটকে গেল।

পুনরায় ওনার দিকে আমি তাকাতেই দেখলাম উনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন রাগী দৃষ্টিতে। এরপর যে উনি আমাকে কোন কথা শোনাতেই ছাড়বেন না তা বুঝলাম আমি।
চোখ নামিয়ে নিলাম ওনার থেকে।
বিয়ে শেষ হতেই আর কোন কথা বাড়ালেন না উনি। সেদিনই শেষ হয়ে গেল সে বাড়ির সবার সাথে আমাদের সম্পর্ক।

উনি আমাকে টানতে টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে এলেন। আমি মাথা নত করে আছি। এখন যে আমি বিবাহিত সেটা ভাবলেই কেমন লাগছে।
উনি গাড়িতে উঠলেন, আর আমি কল্পনার জগতে হারিয়ে গেছি, গাড়িতে ওঠার কথা মনে নেই দেখে উনি একটা ধমক দিতেই আমি চমকে উঠলাম। গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট পরলাম। এখন আমার মাথায় কেবল একটাই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। কথাটা গলা অবধি এসে আটকে আছে। আমি এবার আর সাত পাঁচ না ভেবে বললাম,

‘ আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন? এখন আপনার মায়াবতীর কি হবে? ‘

প্রশ্নটা করা মাত্রই কানের পাশে শো শো আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি, বুঝলাম যে উনি সপাটে একটা চড় মারলেন আমাকে। আমি গালে হাত দিয়ে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। আমার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
আচ্ছা বিয়ের প্রথম দিনই এই হিটলারী থাপ্পড়টা আমার প্রাপ্য ছিল? আমি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে কাঁদতে লাগলাম আর মনকে বোঝাতে লাগলাম যে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে যে বাস্তবে একটা হিটলার কিন্তু আমার আলাদিন ও বটে।

#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here