ভিনদেশী পর্ব ১২+১৩+১৪

,#ভিনদেশী
#পাট:১২
#আদ্রিয়ানা নিলা

সকালের সূর্যের মিষ্টি আলো উঁকি দিয়েছে সিয়াটল শহরে। প্রতিটা সকাল জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে শুরু হয় ব্যাস্ত জীবনের আরও একটি নতুন দিন। শ্রুতি বারান্দায় দাড়িয়ে সিয়াটল শহরের সকালের প্রকৃতিটাকে উপভোগ করছে। আমেরিকায় এসেছে প্রায় একমাস হয়ে গেছে। ভার্সিটি খোলার পর পুরোটা সময় তার বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততায় কেটেছে। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে ব্যায়াম করা, সকালের প্রকৃতিটাকে উপভোগ করা যেন তার অভ্যাস হয়ে গেছে। অবচেতন ভাবেই প্রকৃতির মায়া তাকে জড়িয়ে রেখেছে আদিম মমতায়।গ্রীষ্ম মৌসুম শেষে আমেরিকায় শীত মৌসুম প্রায় চলে এসেছে। গ্রীষ্মকাল রীতিমতো স্বর্গ হয়ে আসে এদেশের প্রকৃতিতে। মানুষ বের হয়ে আসে বাইরে। প্রকৃতিই হয়ে ওঠে তাদের আশ্রয়। প্রকৃতির নিবিড় মমতায় যতটা পাড়া যায়, ততটাই কাটাতে ভালোবাসে মানুষ। ছুটে যায় দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ভরে ওঠে পার্ক, বিচ আর বিনোদনকেন্দ্রগুলো। সরগরম হয়ে ওঠে চারপাশ।
শরতের শেষের দিকেই এইখানে হালকা হালকা শীত পরা শুরু করে। বদলে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের পাতা, বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। গাছেরা সাজছে নানা রঙে। গাছের পাতার রং সবুজ থেকে হলুদ, হলুদ থেকে লাল হচ্ছে, প্রকৃতি যেন সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়েছে। শ্রুতি মুগ্ধ হয়ে দেখে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য।
ফুল নয়, ফল নয়, শুধু পাতারা রং বদলায় এই সময়। একেকটা গাছ রঙিন হয়ে উঠে হলুদ আর লাল পাতার মিশ্রণে। হালকা হিমেল ঠান্ডা বাতাস দোলা দিয়ে যায় হলুদ, লাল পাতাদের মাঝে। যেন কানে কানে বলে যায়, তোদের সঙ্গে মিতালি করতে এসেছি।
দিনগুলোও ছোট হয়ে আসছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। পুবের আকাশে সূর্যটা উঠেই তাড়াহুড়ো করে ছুটতে থাকে কখন ডুব দেবে পশ্চিমে। দুপুর দ্রুত গড়িয়ে বিকেলের গায়ে পড়ে। পশ্চিমের আকাশে ডিমের কুসুমের মতো লাল ডুবন্ত সূর্যটা ডুব দিতে দিতে তার সৌন্দর্যের কিছুটা আভা দিয়ে যায় গাছের পাতাদের। এতে প্রকৃতি অদ্ভুত অন্যরকম একটা সৌন্দর্য বিলায়, যেন শিল্পীর আঁকা তুলি দিয়ে এঁকেছে এই দৃশ্য।
ঘুম ভেঙে ভোরে উঠে দেখে হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন করে সবুজ ঘাস, আর শিশির চিকচিক করে ঘাসের ওপর, গাছের হলুদ, লাল পাতাদের ওপর, আর পার্কিং লটে ঘুমিয়ে থাকা গাড়িগুলোর ওপর। শিশির কণারা সাজিয়ে দেয় চারপাশ। সূর্য জেগে উঠলে সকালের চিকচিক রোদের মধ্যে হারিয়ে যায় শিশির কণাগুলো একরাশ অভিমান নিয়ে। মানুষ কাজে যেতে শুরু করে। গাড়ি চলে সাঁই সাঁই করে, রাস্তার দুপাশে লাল–হলুদ পাতার গাছেরা যেন বিদায় জানায় কর্মব্যস্ত মানুষগুলোকে। কারও মন খারাপ থাকলেও প্রকৃতির এই দৃশ্য দেখে মন হারিয়ে যায় অন্য ভুবনে।শ্রুতির ও যখন বাবা মা, বোনের জন্য মন খারাপ হয় হলেও এই প্রকৃতির দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করে। কর্মব্যস্ত জীবনে যন্ত্রের মতো ছুটে চলা পথে প্রকৃতি দেয় অপরূপ সৌন্দর্য, যা দেখে মন ছুঁয়ে যায় তার । মাইলের পর মাইল এভাবে গাছেরা সারি সারি সাজে এই সময়ে।

বাংলাদেশেও এই সময়ে অল্প অল্প ঠান্ডা পড়তে শুরু করে।তবে এখানের শীত আর বাংলাদেশের শীত আলাদা৷ এইখানের কয়েকটি রাজ্য ছাড়া প্রায় সব রাজ্যেই তুষার পাত হয়। তবে তুষার শুরু হবে আরও পরে।
শ্রুতির মনে পড়ছে যখন বাংলাদেশে পুরো দমে শীত পড়তো তখন তার বাবা খেজুরের রশ নিয়ে আসতো। আর সে, তার মা, বোন সবাই মিলে এক সাথে পিঠা বানাতো। শ্রুতি সেই স্মৃতি গুলো মস্তিষ্কে এখন বিচরণ করছে। তবে এইখানে শহরে খেজুর গাছ নেই, নেই পিঠা খাওয়ার প্রস্তুতি, তবে আছে ম্যাপল গাছ। ম্যাপল গাছের রস দিয়ে সিরাপ বানিয়ে বাজারজাত করে, সেই সিরাপ দিয়ে পেন কেক খাই আমরা। যেমন, খেজুরের রস দিয়ে পিঠা খাওয়া হয়। দেশ কিংবা বিদেশ যেখানেই হোক না কেন, প্রকৃতি সময়ের সঙ্গে বদলায়। বদলায় আমাদের মনও।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ‘হ্যালোউইন’ উৎসব। কিন্তু এই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় তার অনেক আগে থেকেই । এই যেমন কেবল আজকে অক্টোবরের ১৫ তারিখ।এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ভূত-প্রেতের নানা সরঞ্জাম দিয়ে বাড়ি সাজানো, ভৌতিক পরিবেশ তৈরির জন্যে বিশেষভাবে আলোকসজ্জা করা হয়। মনোমুগ্ধকর এরকম সাজ এই সময়টাতেই থাকে। সময়ের সঙ্গে আবার হারিয়ে যায় এই সাজ, আবার ফিরে অন্যরকম সাজে।

শ্রুতি আর লুসি সকালের ব্রেকফাস্ট খেয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিল। শ্রুতি গাড়ির কাচটা নামিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছে। রাস্তার পাশের, দোকান, বাড়ি গুলো সাজানো হচ্ছে। তুষারপাতের দেশ হলেও এইদেশের মানুষ পুরো শীত কাল জুড়ে নানারকম উত্সবে মেতে থাকে।

ভার্সিটি শুরু হতে এখনো ১ঘন্টা বাকি। আজকে আগেভাগেই এসেছে। তাই শ্রুতি সময় কাটাচ্ছে জ্যাক, এলিশাদের সাথে।আলিশা এখনো আসেনি। মেয়েটা একটু অলস। ভার্সিটি শুরু হওয়ার আগে দৌড়াতে দৌড়াতে আসবে। আর লুসি আজকে ক্লাস করবে না৷ আরিচ এর সাথে টাইম স্পেন্ড করবে। তাই ভার্সিটির নাম করে বাসা থেকে শ্রুতির সাথে বের হয়েছে। আপাতত যারা আছে সবাই সবুজ ঘাসের উপর বসেছে। সূর্যের আলোর তাপ খুব কম। কিছুদিন পর হয়তো সূর্যই উঠবে না। জ্যাক, এলিশাদের সাথে শ্রুতির ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।এইখানে এসে ওদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বীচে ঘুরতে যাওয়া। যেখানেই গেছে না কেন, জ্যাক শ্রুতিকে সব সময় প্রটেকশন দিয়েছে।শ্রুতির অনেক কেয়ার করেছে। যা শ্রুতির খুব ভালো লেগেছে।জ্যাকের জন্য আলাদা একটা সফ্ট কর্ণার তৈরি হয়েছে শ্রুতির মনে। শ্রুতি জানে না, এটা কী মায়া নাকি অন্যকিছু?

এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছিল কিছুদিন আগে যেদিন ওরা বিচে ঘুরতে গিয়েছিল,

একটা ছেলে শ্রুতি হাত ধরেছিল, শ্রুতি অনেকক্ষণ ধরে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারে নি? তাই উপায়ন্তু না পেয়ে জ্যাক কে ডাক দিলো। জ্যাক, লুসি,বাকিরা তখন সামনে ছিল বলে শ্রুতির দিকে খেয়াল নেই। জ্যাক এসে কী মারাটাই না মেরেছে। কেউ থামাতে পারেনি ওকে। শেষমেষ শ্রুতি গিয়ে জ্যাক কে শান্ত করল।

–হানি তোমার কী মন খারাপ এইরকম বসে আছো? কোনো কথা বলছো না?

জ্যাকের কথায় শ্রুতি তার নিজের ভাবনা থেকে বের হলো।জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বলল,

–না, মন খারাপ না।

–তাহলে কথা বলছো না কেন?

–এমনি। বলো কী যেন বলতেছিলা তোমরা?

এলিশা উত্সাহী হয়ে বলল,

–আমরা এবার জ্যাকের বাড়িতে “হ্যালোউইন “উত্সব করবো। ওদের বাড়ওটা প্রচুর সুন্দর, আরও বিরাট জায়গা আছে সামনে পেছনে সবাই মিলে মজা হবে।

শ্রুতি মৃদু স্বরে বলল,

–ওহ

এলিশা আবার বলে উঠল,

–শ্রুতি তুমি যাবে না? লুসি তো যাবে।

–দেখি কী করা যায়।

জ্যাক এবার ক্ষেপে উঠে বলে,

–দেখি টেকি বুঝি না। তোমাকে যেত হবে মানে যেতেই হবে৷

শ্রুতি হেসে দিল। ছেলেটা পাগল ছাড়া আর কিছু না।

–আচ্ছা যাবো নে। হ্যালোউইন এখনও দেরি আছে৷ তার আগেই তোমরা এসব প্লান করেছো?

এলিশা বলে উঠল,

–হিম আমরা প্রত্যেক বছরই এইরকম করি।

–ওহ।

এরই মধ্যে আলিশা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে শ্রুতির পাশে বসতে বসতে বলল,

–আমি কী দের করে ফেলেছি নাকি? আর তোমরা এখানে বসে আছো কেন?

শ্রুতি সহ সবাই হাসতে হাসতে বলল,

–হ্যাঁ, খুব দেরি করেছো। ভার্সিটি ছুটি দিয়েছে তাই বসে আছি।

আলিশা কাদো কাদো ফেস করে বলে,

–তোমরা আমার সাথে মিথ্যা বলছো কেন? হানি তুমি বলো। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি জানি তুমি মিথ্যা বলবে না।

শ্রুতি হাসি থামিয়ে বলে,

–আরে না, সবাই তোমার সাথে মজা করছিল।

–ওহ,

শ্রুতি ঘাস থেকে উঠে দাড়িয়ে আলিশাকে বললো,,

–আলিশা চলো। এখানে আর বসতে হবে না। ক্লাস শুরু হবে কিছুক্ষণ পর।

জ্যাক গোমড়া মুখে বলে উঠে,

–আর কিছুক্ষণ থাকো, প্লিজ।

–না, জ্যাক ছুটির পর। ক্লাস শুরু হবে।

বলেই আলিশার হাত ধরে নিজেদের ক্যাম্পাসে ঢুকল৷

____________________

ছুটির পর, নিজেদের ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে শ্রুতি আর আলিশা দেখে জ্যাক ও তার ফ্রেন্ডরা একটা বেঞ্চ এর উপরে বসে আসে। জ্যাক ও এলিশার সাথে কিছু ফ্রেন্ড আছে যাদের শ্রুতি চেনেনা। আগে দেখেছে, পরিচয় হয়েছিল তার পর আর কথা হয় নি। যার ফলে শ্রুতি ভুলে গেছে।

শ্রুতি গিয়ে জ্যাকের পাশে বসল। আলিশাও পিছন পিছন আসছে। জ্যাক একপলক শ্রুতির দিকে তাকিয়ে ভারাক্রান্ত মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে রইল। শ্রুতি তো অবাক। কারণ সে জানে, জ্যাক তো এরকম চুপ থাকার ছেলে না। তাহলে আজকে কী হলো?

শ্রুতি এক এক করে সবার দিকে তাকালো৷ সবাই মাথা নিচু করে কী যেন ভাবছে? এলিশাও চুপ করে মাথা নিচু করে আছে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল, শ্রুতি বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে শ্রুতির এবার বেশ বিরক্ত লাগছে৷
এরকম স্ট্যাচুর মতো মতো দাড়িয়ে, বসে কী ভাবছে শ্রুতির মাথায় ঢুকছে না। সমস্যাটা কী তাকে বলা যায় না? শ্রুতি মনে সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–কী হয়েছে তোমাদের বলো তো?এরকম সবাই মাথা নিচু করে এক ধ্যানে কী ভাবছো? কোনো সমস্যা হয়েছে?

এলিশা শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,

–তুমি তো জানো আমাদের একটা গানের গ্রুপ আছে। এই টা এই ভার্সিটির গানের যতগুলো গ্রুপ আছে তার ভিতরে বেস্ট।

–হুম আমি জানি তো। কিন্তু কী হয়েছে সেটা বলো?

–আসলে, আমাদের ওই গানের গ্রুপে একটা মেয়ে ছিল।নাম লরি। ও আর জ্যাক এক সাথে গান গাইতো, যে কোনো অনুষ্ঠানে । তুমি তাকে দেখোনি। ও খুব শান্ত শিষ্ট মেয়ে, বাট গানের গলাটা অসাধারণ। আমাদের গ্রুপে গান গাইতো৷ আমাদের সাথেই তেমন কথা বলে না, তাহলে তুমি বা চিনবে কীভাবে?
এলিশা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে,আবার বলতে শুরু করল,

–ভার্সিটি শুরু হওয়ার পর কিছুদিন এসেছিল ভার্সিটি। বাট আজকে আমরা জানতে পারি ও নাকি এই ভার্সিটিতে আর পড়বে না।ওর বাবার চাকরি নাকি অন্য জায়গায় টান্সফার হয়েছে। তাই ও এই ভার্সিটি থেকে চলে গেছে। ৷ আমাদের এই বিকালে একটা বড় প্রোগ্রাম আছে। ওকে কল দিয়েছিলাম । বাট ও বলেছে ও এই ভার্সিটি আর পড়বে না। তাও ওকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম প্রোগ্রামটায় অংশ নিতে তারপর নাহয় আমরা আর একজন ওমেন সিনগারকে খুঁজে নেবো। কিন্তু ও বলেছে আসতে পারবে না। বিকালে প্রোগ্রাম কীভাবে কী করবো মাথায় আসছে না ? আর এতো অল্প সময়ে আর একজন সিনগার ই বা পাবো কোথায়?

শ্রুতি এতোক্ষণ সব কথা মনোযোগ দিয়েই শুনেছিল। ওর খারাপ লাগছে।ও ভাবছে কী করা যায়?

–আচ্ছা, আমি কী গান গাওয়ার কথা বলবো?

শ্রুতি মনে মনে কথাটা আওড়াতে লাগলো। শেষমেশ উপায় না পেয়ে ঠিক করল যে সে গানগাওয়ার কথা বলবে। ওরা সবাই ওর বন্ধু। আর বন্ধুদের বিপদে পাশে না থাকা অমনুষ্যত্বের কাজ। শ্রুতি তা করবে না।

–আমি গান গাবো। কয়টায় তোমাদের প্রোগ্রাম?

শ্রুতি কথাটা বলার পর দেখে সবাই তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শ্রুতি বেশ অস্বস্তি বোধ করল।তারা কেউ জানে না যে শ্রুতি গান গেতে পারে। ইনফেক্ট শ্রুতিও তাদের কখনো বলে নি তাই এই রকম তাকিয়ে আছে। শ্রুতি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবার বলে উঠল,

–তোমরা সবাই এইরকম তাকিয়ে আছো কেন?আমি গান গেতে পারি।আমার কাছে গানের বড় বড় এওয়ার্ড আছে।বিশ্বাস না হলে লুসির কাছে ফোন দেও। সে তোমাদের বলবে আনে । আর ইংলিশ গান তো একটু প্রাকটিস করলেই হয়ে যাবে।

অবশেষে এলিশা শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

–তুমি সত্যিই গান গেতে পারো? আমরা তো আগে তোমার সামনে কত গান গেয়েছি, বলোনি তো কখনো?

–এমনি বলেনি।

–ওকে প্রোগ্রাম সন্ধ্যা ৬টায়। আমরা তোমাকে ড্রপ করতে আসবো ।রেডি হয়ে থেকো। আর তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

শ্রুতি আর একবার সবার দিকে তাকালো। সবাই এখন প্রায় হাসিখুশি৷

অতঃপর শ্রুতি সবার কাছ থেকে বিদায় ভার্সিটি থেকে বের হয়।
শ্রুতি অনেকক্ষণ ধরে ভার্সিটির সামনে দাড়িয়ে আছে। বাট একটাও গাড়ি পাচ্ছে। আলিশাও নেই। আগেই চলে গেছে। হঠাৎ শ্রুতির সামনে একটা গাড়ি থামলো। শ্রুতি ভয় পেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো। আর একটু হলেই সোজা উপরে চলে যেত। সে বুকে থু থু দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে জ্যাক গাড়ির কাচ নামিয়ে হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রুতি অবাক হয়ে বলল,

–জ্যাক

জ্যাক হাসিমুখে উত্তর দিল,

-হানি তুমি এখানে দাড়িয়ে কী করছো ?

শ্রুতি অসহায় কন্ঠে বলল,

-গাড়ি পাচ্ছি না জ্যাক। তুমি একটু ড্রপ করে দিবে?

–ওকে আসো।

শ্রুতি গাড়িতে বসে নিজের সিটবেল্ট টা বাধার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। সে একবার জ্যাকের দিকে তাকিয়ে তারপর আবার চেষ্টা করতে লাগলো। তার মধ্যে ঘটলো এক বিপত্তি । জ্যাক হুট করে শ্রুতির গালে একটা কিস করলো। শ্রুতির হাত ওই সিটবেল্ট বাধার স্হানেই থেমে গেল। শ্রুতি চোখ বড় বড় করে জ্যাকের দিকে তাকালো। জ্যাক তার দিকে তাকিয়েই মিটিমিটি হাসছে।জ্যাক শ্রুতির কাছে গিয়ে সিটবেল্টা বেঁধে দিলো৷ শ্রুতি চোখ বন্ধ করল।কিছু সময় পার হওয়ার পর, কোনো কিছুর অস্তিত্ব না পেয়ে শ্রুতি চোখ খুলল। জ্যাক ড্রাইভিং সিটে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রুতি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো। জ্যাক শ্রুতির গাল দুটো টেনে বলে,

–তুমি লজ্জা পেলে তোমাকে আরও বেশি কিউট লাগে।

শ্রুতির লজ্জায় কিছুই বলতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে মাটির নিচে ঢুকে যেতে।
জ্যাক একপলক শ্রুতির দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।
#ভিনদেশী
#পার্ট:১৩
#আদ্রিয়ানা নীলা

জ্যাক শ্রুতির গাল দুটো টেনে বলে,

–তুমি লজ্জা পেলে তোমাকে আরও বেশি কিউট লাগে।

শ্রুতির লজ্জায় কিছুই বলতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে মাটির নিচে ঢুকে যেতে।
জ্যাক একপলক শ্রুতির দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

লুসি কাপড় খুজতেছে, আর শ্রুতি বিছানায় বসে নখ কামড়াচ্ছে। পুরো বিছানায় কাপড়ের ছড়াছড়ি। তবুও, একটাও শ্রুতি চুজ করতে পারছে না।শ্রুতির হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। বাসায় থাকলে আপু ড্রেস পছন্দ করে দিতো। এখন কী করবে? লুসি ওর জন্য কত গুলো ড্রেস নিয়ে এসে ছিলো। শ্রুতি না দেখেই বলে দিছে সে ওসব সর্ট ফর্ট ড্রেস পড়বে না।

–এরকম নখ কামড়াচ্ছো কেন শ্রুতি? এরকম কামড়ালে হাতে তো কোনো নখই থাকবে না৷

–তো কী আর করবো?একটা ড্রেস ও ভালো না আমার। আমি এখন কী পরে যাবো।

লুসি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

–দেখো শ্রুতি এই ব্লাক শার্ট টা অনেক সুন্দর। তোমার গায়ে ভালো মানাবে। এটা পরে আসো। তারপর না হয় একদিন মার্কেটে গিয়ে দুজন একসাথে শপিং করে আনবো। আপাতত এটা পরে যাও।

শ্রুতি কোনো কথা না বলে শার্ট টা, আর একটা ব্লাক জিন্স নিয়ে নিয়ে গেল চেঞ্জ করার জন্য। এটা পড়া আর কোনো উপায় নেই তার।

শ্রুতি ড্রেসিংটেবিলের সামনে গেল। নিজের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখতে পেলো। শার্টের সামন দিয়ে একটু কাজ করা। ভালোই লাগছে তাকে দেখতে। শ্রুতি লুসির সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,

–আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?

লুসি শ্রুতির গালটা টেনে বলে,

–হুম অনেক সুন্দর লাগতেছে তোমাকে।

শ্রুতি গালে হাত দিয়ে ঘোষতে ঘোষতে বলে,

–তোমরা সবাই আমার গালটা টানো কেন? আমার গাল কী তোমাদের জন্য ফ্রী নাকি? যে দেখে সেই গাল টানে।

লুসি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

–আমি তো শুধু আজকেই টানলাম। আর কে কে টানে?

–এলিশা তারপর জ্যাক

লুসি হেসে দেয়,

–তুমি অনেক কিউট। আর গাল গুলো স্ট্রবেরির মতো। তাই সবাই টানে।

শ্রুতি কাঁদো কাঁদো ফেস করে বলে,

–মোটেও এটা ঠিক না। আমার গাল গুলো তো এরকম টানলে বড়ো হয়ে যাবে।

–হয়েছে হয়েছে আর ন্যাকা কান্না করতে হবে না। আমি সবাইকে মানা করে দিবো নি। এখন তাড়াতাড়ি বসো এইখানে। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।

শ্রুতিকে হালকা একটু সাজিয়ে দিলো লুসি। আর চুল একপাশে সিঁথি করে খোলাই রাখলো। শ্রুতির চুলগুলো বেশি বড়ো না। কাঁধের একটু নিচে । বেশি বড়ো চুল শ্রুতির পছন্দ না তাই একটু বড়ো হলেই আবার কেটে আগের মতো করে । হঠাৎ শ্রুতির ফোনে কল আসলো। শ্রুতি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে জ্যাক কল দিয়েছে। শ্রুতি ফোনটা রিভিভ করলে ওই পাশ থেকে জ্যাক বলল,

–শ্রুতি তুমি কোথায়? আমরা নিচে আছি। তাড়াতাড়ি আসো।

–হ্যাঁ জ্যাক দাড়াও আমি আসছি।

লুসি শ্রুতিকে বলল,

–ঠিক ভাবে যেও৷ আমি জ্যাকের সাথে কথা বলে নিবো। কোনো সমস্যা হলে আমাকে কল করো। আমার কিছু কাজ আছে। নাহলে তোমার সাথে যেতাম।

শ্রুতি নিজের কালো কটিটা পরতে পরতে বললো ,

–চিন্তা করো না। তাড়াতাড়ি চলে আসবো।

শ্রুতি নিজের ফোনটা নিয়ে দিল দৌড়৷ তাকে পুরো ব্লাক কুইন লাগছে।

একদৌড় গাড়িতে এসে বসলো। পাশে ফিরে দেখে এলিশা। আর সামনে জ্যাক। গাড়ির ভিতরে ছোট একটা লাইট জ্বলছে। শ্রুতি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

–দেরি করে ফেললাম না তো।

–না দেরি করোনি।

–ওহ

বলেই শ্রুতি নিজের ছিটে গা এলিয়ে দিলো।

এদিকে জ্যাক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–তোমরা কী আমাকে ড্রাইভার পেয়েছো? দুইজনই পিছনে বসেছো কেন? হানি সামনে এসো।

শ্রুতি জ্যাকের কথা শুনে চোখ খুলল। তার জ্যাকের পাশে বসার সাহস হচ্ছে না। আবার কী না কী করে বসে, সেই ভয় হচ্ছে। শ্রুতি এলিশাকে বলল,

–এলিশা তুমি যাও। আমি পিছনে বসি।

এলিশা কিছু বলতে নেবে তার আগেই জ্যাক পেছনে ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

–তোমাকে আমি সামনে আসতে বলেছি৷ এলিশাকে না।

শ্রুতি একটা ঢোক গিলে,জ্যাকের পাশে এসে বসলো।
জ্যাক শ্রুতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল ।

গাড়িটা একটা গ্যাটের সামনে থামলো। শ্রুতি আর এলিশা বের হলো। শ্রুতি চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলো। চারপাশে প্রচুর মানুষের সমাগম। শ্রুতি আর এলিশা ভিতরে ঢুকল।ভিতরে ঢুকে শ্রুতির যেটা সবার আগে নজরে পড়লো সেটা হলো স্টেজটা। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এলিশা শ্রুতির হাত ধরে এক পাশে নিয়ে এসে কাকে যেনো ফোন করল। শ্রুতি চারপাশ দেখছে৷ অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয় নি।তাই চেচামেচির জন্য কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কথা বলা শেষ হলে, এলিশা আবার শ্রুতির হাত ধরে কোথায় যেনো নিয়ে যেতে লাগলো। শ্রুতি এলিশাকে জিজ্ঞেস করল,

–কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

এলিশা কথার কোনো উত্তর দিলো। শ্রুতি ভাবলো হয়তো শুনতে পায়নি।
এলিশা শ্রুতির হাত ধরে স্টেজের পিছনের একটা রুমে নিয়ে আসলো। শ্রুতি রুমের ভিতর প্রতিযোগীদের দেখতে পেল। কেউ কেউ সাজছে, কেউ কেউ বসে আছে। কেউ কেউ প্রাকটিস করছে। পুরোই রমরমা পরিবেশ।এলিশা শ্রুতিকে ওদের গ্রুপের বাকি মেমবারদের কাছে নিয়ে আসলো। কেউ কেউ গল্প করছে , আর কেউ গিটারে টুংটাং শব্দ বাজাচ্ছে। জ্যাক নেই।শ্রুতি তার চারপাশে সব কিছুকে আর একবার পর্যবেক্ষণ করলো। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। এলিশা একটা চেয়ার এনে শ্রুতিকে বসতে বলল। শ্রুতিও নির্দ্বিধায় সেখানে বসল।

শ্রুতি আর জ্যাক স্টেজের উপর দাড়িয়ে আছি । কিছুক্ষণ আগেই তাদের নাম এনাউন্স করা হয়েছে। বিশাল অডিটোরিয়াম। পুরো অডিটোরিয়াম ঘুরে হয়তো কমসেকম ২০মিনিট লাগবে।চারপাশে নানাধরণের লাইটিং । স্টেজের সামনের সারিতে বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গরা বসে আছে। শ্রুতি এদের বেশিরভাগকেই চেনে না। আবার কিছু কিছু জনকে চেনে। জ্যাক গিটারের সুর তুলছে, শ্রুতি একটা মুচকি হাসি দিল। পুরো অডিটোরিয়াম সমস্ত লাইট এক এক করে বন্ধ হয়ে গেল আর অবশেষে স্টেজের উপরের রঙবেরঙের লাইট গুলো জ্বলে উঠলো। কেউ কেউ জ্যাক জ্যাক বলে চিত্কার করছে।জ্যাক গিটার নিয়ে বসে আছে। আর শ্রুতি দাঁড়িয়ে । জ্যাক আর শ্রুতির সামনে একটি করে মাইক। জ্যাক শ্রুতি দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বললো, প্রস্তুত কিনা। শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসি দিল। গিটারে টুংটাং শব্দ হতেই আশেপাশে সমস্ত শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো।

শ্রুতি মাইকের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গান শুরু করল,

I used to believe
We were burning on the edge of something beautiful
Something beautiful
Selling a dream
Smoke and mirrors keep us waiting on a miracle
on a miracle (শ্রুতি নিজের এক পা নাড়াচ্ছে গানের তালে তালে [যেমন আমাদের গানের সুর শুনলেই পায়ের তালু নাড়াই] তারপর নিজের হাতটা চারপাশ ছড়িয়ে দিল , আবার একহাত কিছু চিন্তা করার ভঙ্গি করলো,)

Say, go through the darkest of days
Heaven’s a heartbreak away
Never let you go, never let me down(জ্যাক গাইলো)
Oh, it’s been a hell of a ride
Driving the edge of a knife
Never let you go, never let me down(শ্রুতি গাইলো)

Don’t you give up, nah-nah-nah
I won’t give up, nah-nah-nah(জ্যাক গাইলো)
Let me love you
Let me love you
Don’t you give up, nah-nah-nah
I won’t give up, nah-nah-nah
Let me love you
Let me love you
Oh, baby, baby(শ্রুতি আর জ্যাক এক সাথে গাইল)
Don’t fall asleep
At the wheel, we’ve got a million miles ahead of us
Miles ahead of us
All that we need
Is a rude awakening to know we’re good enough
Know we’re good enough(শ্রুতি নিজের চুল গুলো একহাত দিয়ে পিছনে ঠেললো, তারপর অন্যহাত দিয়ে কিছু চিন্তা করার ভঙ্গি করল)
Say, go through the darkest of days
Heaven’s a heartbreak away
Never let you go, never let me down(জ্যাক গাইল)
Oh, it’s been a hell of a ride
Driving the edge of a knife
Never let you go, never let me down(শ্রুতি গাইলো, দুই হাত দিয়ে “না “না “অঙ্গভঙ্গি করলো)
Don’t you give up, nah-nah-nah
I won’t give up, nah-nah-nah
Let me love you
Let me love you

Don’t you give up, nah-nah-nah
I won’t give up, nah-nah-nah
Let me love you
Let me love you
Oh, baby, baby(শ্রুতি আর জ্যাক একসাথে গাইল)

গান শেষ করার সাথে সাথে অজস্র করতালির শব্দ শুনতে পেলো শ্রুতি। হলের সব লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। জ্যাক শ্রুতির হাত ধরে নিচে নামলো। আর বাকিরাও সরঞ্জাম গুলো নিয়ে আসতে আসতে নিচে নামতে লাগলো।

জ্যাক শ্রুতিকে স্টেজ থেকে নামিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসলো। জায়গা তেমন অন্ধকার না। তেমন মানুষের আনাগোনা নেই। শ্রুতি একটা ঢোক গিলে জ্যাক কে জিজ্ঞেস করল,
–জ্যাক এটা কোথায় নিয়ে এসেছো আমাকে?

জ্যাক শ্রুতিকে ঝাপটে ধরে বলল,

–থ্যাংক ইউ হানি। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

শ্রুতি জ্যাকের এইরকম আক্রমনে একদম প্রস্তুত ছিলো না৷ হুটহাট জড়িয়ে ধরা তার একদম পছন্দ না। শ্রুতি জ্যাক বলল,

–জ্যাক ছাড়ো৷ কেউ দেখে ফেলবে৷

জ্যাক শ্রুতিকে ছেড়ে দিল। শ্রুতি মনে মনে ভাবলো,

যদি এটা বাংলাদেশ হতো, আর কেউ যদি এরকম কোনো ছেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরা দেখতো, মেয়েটার গায়ে কলঙ্ক লাগাতে আর দেরি করতো না।

শ্রুতি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সামনে রুমের দিকে গেলো।
#ভিনদেশী
#পার্ট:১৪
#আদ্রিয়ানা নীলা

ওয়াশিংটন ভার্সিটিতে পড়ার সুবাদে শ্রুতির নিজের ক্লাসের আরও বেশ কিছু ছেলে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। এর মধ্যে আছে লিলি, লরি, কার্ল, জুলিয়া।

এরমধ্যে জুলিয়াকে শ্রুতির একটু স্বার্থপর মনে হয়। নিজের কাজ ছাড়া সে কিছুই বুঝে না। তবুও কোনো কিছুর ব্যাপারে সাহায্য চাইলে পাওয়া যায়। সে নাকি সাইকেল চালাতে চ্যাম্পিয়ন। শ্রুতির ইচ্ছা আছে জুলিয়ার কাছ থেকে সাইকেল শেখাটা আয়ত্ত করার।

এর মধ্যে লিলির সাথে পরিচয় হয়েছে কিছুদিন আগে। বাস্কেটবল খেলার সুবাদে। শ্রুতির কয়েকদিন আগে ভার্সিটির ওমেন বাস্কেটবল টিমে জয়েন করেছে। লিলি আগে থেকেই ছিল সেই টিমে।প্রতিদিন বাস্কেটবল ক্লাবে দুজনের কথা হওয়ার কারণে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে।

লরি আবার অন্যপ্রকৃতির মেয়ে। ও মিশুক।সবার সাথে মিশে। সুন্দর করে কথা বলে কিন্তু প্রচুর অলস। মানুষকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কাজ হাসিল করে নেয়। মেয়েটার বিএফও আছে। ক্লাসে টাইম পেলেই তার সাথে কথা বলে।

কার্ল বন্ড পড়ুয়া ছেলে। সব সময়ই বইয়ে মুখ গুজে থাকে। বেশি কারো সাথে মিশতে পারে না৷ আলিশার কারণে ওর সাথে পরিচয় হয়েছে। আগে নাকি ওরা এক হাইস্কুলেই পড়তো। কিন্তু ছেলেটার একটা দোষ আছে। একটু হলেই সবার সাথে ঝগড়া। প্রচুর ঝগড়াটে। আর মুখে সব সময় বিরক্তিকর ভাব। কেউ তার পড়ায় ডিস্টার্ব করলে তাকে এক লাথি দিয়ে মঙ্গলে পাঠিয়ে দিতেও বোধ হয় দ্বিধা বোধ করবে না। যার কারণে শ্রুতি কার্ল এর সাথে বেশি কথা বলে না। বেশি পক পক করলে তাকেও কিনা হাসপাতালে কয়দিন ভর্তি হয়ে থাকতে হয়।

শ্রুতি আজকে ক্যাম্পাসে ঢোকার সাথে সাথে দেখতে পেল কার্ল কান ধরে দাড়িয়ে আছে,হলের সামনে ফাঁকা জায়গাটায়।সবাই মজা নিচ্ছে। কার্ল মাথা নিচু করে আছে। শ্রুতির বিষয়টা বেশ খারাপ লাগলো। সে তাড়াতাড়ি নিজের সেন্টারে গেল। কিন্তু জুলিয়া, লিলি, কাউকে দেখতে পেলো না।
অবশেষে শ্রুতি সবাইকে ক্যাফে পেলো। শ্রুতি গিয়ে একটা চেয়ার টেনে তাদের পাশে বসল৷ লরি বলল,

–Hi Hunny, Good morning!

–আরে রাখো তোমার গুড মনিং। আগে বলো কার্ল ওরকম কান ধরে দাড়িয়ে আছে কেন?

লিলি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,

–যে যে রকম কাজ করে ফল তো ওরকমই পাবে।

–বুঝলাম না ঠিল। খুলে বলো।

লিলি বলল,

–শোনো আমি বলতিছি। ও একটা সিনিয়র আপুর সাথে ঝগড়া করছে। যেটা পুরোপুরি একটা ব্যাদপি কাজ। তাই সেই আপু ওকে ১ঘন্টা কান ধরে দাড়িয়ে থাকার শাস্তি দিয়েছ।

জুলিয়া বলল,,

–ভালোই হয়েছে। সবসময় ঝগড়া করে। এখন একটু শুধরাবে।

শ্রুতি চুপ করে রইল। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।তার মনটা আজ এক অজানা কারণেই খারাপ। মাঝে মাঝেই এই এইরকম হয় তার। কখনো মন খুব ভালো থাকে আবার কখনো খুব খারাপ। কেন এরকম হয় তা শ্রুতি জানে না? সে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিল।

তিনটা ক্লাস করে, সবাই ঠিক ঠিক করল আর ক্লাস করবে না। সবার বোরিং লাগছে। আর শ্রুতি আর লিলির আর একটু পর আবার বাস্কেটবল ক্লাবে যেতে হবে।
শ্রুতি,লরি, জুলিয়া, লিলি, সবাই ক্যাম্পাসের পিছনের ঘাসের উপর বসল। শ্রুতি ফোন প্রেস করছিল। লরি বয়ফ্রেন্ড সাথে কথা বলছে, আর পাশে জুলিয়া আর লিলি মুখ টিপি হাসতেছে।

হঠাৎ লিলি বলল,

–শুতি শোনো, লুসির সাথে একটা ছেলে থাকে না? কী যেনো নাম?

–লুসির সাথে তো ওর অনেক ফ্রেন্ডই থাকে তুমি কার কথা বলছো?

–আরে J দিয়ে যার নাম। নাকটা একটু লম্বাটে।

শ্রুতি ভাবতে লাগলো, জে দিয়ে কার নাম যে লুসির সাথে থাকে?
লরি লাজুক দৃষ্টিতে বলে উঠল,

–আরে তুমি জ্যাক কথা বলছো তাই না? ও আমার ক্রাশ। ওর দিকে নজর দিবা না৷

লিলি ভংচি কেটে বলল,

–হুম তোমার ক্রাশ তো সবাই। বয়ফ্রেন্ড লাগে ভুরি ভুরি , ক্রাশ আছে শত শত , জামাই লাগবে কয়শ?

লিলির কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এদিকে লরি লিলির দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। লিলির কোনো ভাবান্তর নেই।

লিলি আবার বলতে শুরু করল,

–হুম, জ্যাকের কথাই বলছিলাম৷ শ্রুতি তুমি তো ওদের গানের গ্রুপে আছো, তাই না?

শ্রুতি এতক্ষণ ওদের সব কথোপকথন শুনে হেসেছিল ৷ জ্যাক লিলির ক্রাশ শুনে তার কেনো যেনো অজানা একটা কারণে রাগ লাগলো। তবুও মোবাইল দিকে দৃষ্টি নিবন্ধিত করে বললো,

–হুম তো?

–ছেলেটা দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম। আর কত সুন্দর গানের গলা? জানো বাবাও নাকি একজন বিলিয়নিয়ার। এই আমেরিকা জুড়ে তার প্রচুর নাম ডাক। গুড লুক, বাবার টাকার জন্য সব মেয়েরা ওর পিছে পরে থাকে। আর ও মেয়েদের সাথে ফুর্তি করে। কতগুলো গার্লফ্রেন্ডও আছে৷

লরি বললো,

–তুমি এসব জানলে কীভাবে?

–আমরা আগে এক ক্লাসে পড়েছি৷ কিন্তু আমার মাঝখানে আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল৷ যার কারণে এক ক্লাস পিছনে পরেছিলাম।

শ্রুতির সব কথাই শুনেছে। কেনো জানি জ্যাকের এসব ব্যাড হ্যাবিটস শুনে খারাপ লাগছে? কিন্তু শ্রুতির এই কেনোর উত্তর নেই। সে কী জ্যাকের মায়ায় পরে গেলো নাকি? শ্রুতি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো।কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল৷ সে এসব কী ভাবছে?জীবণে একবার ধাক্কা খেয়েছে সে। আবার কারো মায়ায় জড়িয়ে কষ্ট পাওয়ার ইচ্ছা নেই। মায়া জিনিসটায় একবার জড়ালে সহজে কাটে না আরও বাড়ে৷ তাই আগেই কাটিয়ে ফেলা ভালো।

–আরে দেখো, যার কথা বলছিলাম সেই আসতেছে? লিলি বলে উঠো।

লিলির কথা কর্ণগোচর হতেই শ্রুতি নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। শ্রুতি পিছনে তাকিয়ে দেখলো, জ্যাক আসতেছে৷ অতিরিক্ত ফর্সা মুখ মন্ডলের উপর বাদামী রঙের চুল গুলো ছড়িয়ে আছে। নীল চোখজোড়া দিয়ে কী যেন অস্হির হয়ে খুজছে। এক কানে হীরার রিং রোদের আলোয় চিক চিক করছে। ঠোঁট দুটো মনে হচ্ছে পান খেয়ে লাল লিপস্টিক দিয়েছে। রোলেক্স ঘড়ি পরিহিত হাত দিয়ে বার বার কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিচ্ছে। আর বার বার সরিয়ে দিচ্ছে বিরক্তি নিয়ে।

শ্রুতি জ্যাককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। এই পর্যন্ত কয়বার যে এরকম করে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে তার হিসাব নেই। জ্যাকে দিকে যতবারই তাকায় মনে হয় সেই স্বচ্ছ নীল দুটোতে সে হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ শ্রুতির জ্যাকের সাথে চোখাচোখি হলো। জ্যাক একটা মিষ্টি হাসি দিল,,যেন এতক্ষণের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি সে পেয়েছে। শ্রুতি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে ফোনের দিকে মনোযোগ দিল৷ তার হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। সে নিজেই শুনতে পারছে। শ্রুতি জ্যাকের উপর যেমন রাগ হচ্ছে তেমনি নিজের উপর উপর ও হচ্ছে। আগেও তার জ্যাকের সাথে অনেকবার চোখাচোখি হলেও আজকে তার কেন জানি খুব রাগ লাগছে? এই ইডিয়েট ছেলেটার দিকে সে তাকিয়ে ছিল? ওর বন্ধু গুলো কী ভাবছে? হয়তো তাকেও ওই সব ছ্যাঁচড়া মেয়েদের মতো ভাবছে? শ্রুতি নিজের জিভটা দিয়ে নিজের ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিল।

জ্যাক এসে শ্রুতির পাশে বসল। কিন্তু শ্রুতির এমন ভাব করছে যেন জ্যাককে সে দেখেই নি।তার পূর্ণ দৃষ্টি মোবাইলে নিহিত। জ্যাক শ্রুতির মিষ্টি মুখে জিজ্ঞেস করলো,

–Hi, Huuny, How are you?

শ্রুতি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।তাই জ্যাক এবার একটু জোরে বলল,

—হানিইই

শ্রুতি এবার ও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালো না। এই মূহুর্তে তার জ্যাকের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই।তাই সে উঠে সেখান থেকে নিজের ক্লাসে আসলো । ক্লাবে যেতে হবে তার। শ্রুতি নিজের ক্লাসে এসে ব্যাগ নিয়ে ক্লাবের দিকে গেলো। হঠাত্ শ্রুতি তার হাতে টান অনুভব করলো। শ্রুতি পিছনে ফিরে দেখে জ্যাক তার ধরেছে। শ্রুতি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। জ্যাক শ্রুতি দিকে আবার আসতে নিলে, শ্রুতি এক হাত দিয়ে ইশিরায় থামিয়ে বললো,

–পেছনেই থাকো। আমাকে টাচ করবে না।

জ্যাক শ্রুতির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

–কী হয়েছে হানি? তুমি আমার সাথে এরকম করছো কেন? কিছু হয়েছে?

শ্রুতি নিজেও জানে না কেন এরকম করছে? এখন তার জ্যাকের সাথে কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। নিজেকে সামলে বললো,

–জ্যাক, আমার হুটহাট জড়িয়ে ধরা বা হাত ধরা, ঘেঁষাঘেঁষি করা একদম পছন্দ না। এটা তোমাদের দেশের কালচার হতে পারে, তুমি এতে অভ্যস্ত।কিন্তু আমি না।আমার কাছে এটা দৃষ্টি কটু।

জ্যাক চোখ ছোট ছোট করে শ্রুতির দিকে তাকালো৷ সে এখনও বুঝতে পারছে না যে শ্রুতি কী কারণে রেগে আছে? হুটহাট জড়িয়ে ধরা নাকি অন্যকিছু? কই আগে তো এরকম করে নি।জ্যাক নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করছে।
শ্রুতি জ্যাকের উত্তরের অপেক্ষা না করে ক্লাবের ভিতর ঢুকলো। জ্যাক শ্রুতির যাওয়ার পানেই তাকিয়ে রইল।

,,(চলবে)
,,(চলবে)
,,(চলবে কী? কেমন হয়েছে জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here