ভিনদেশী পর্ব ১৮+১৯+২০

#ভিনদেশী
#পার্ট:১৮
#আদ্রিয়ানা নীলা

শ্রুতি এসব সহ্য করতে পারলো না। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কেনো হচ্ছে তার উত্তর শ্রুতির কাছে নেই। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে সে আরও বেশি কষ্ট পাবে। তাই সে দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের ক্যাম্পাসের ক্লাসে চলে গেল।

শ্রুতি আনমেন বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবণের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত সে। কষ্ট দূর করার জন্য এখানে এসেছে সে । সাদাফের জীবন থেকে সরে যেতে।যে চায় না তাকে তার জীবনে, সে তার কাছে থাকবে না। যা শ্রুতি সময়ের সাথে সাথে বুঝছে। কিন্তু এখন তার কেনো জ্যাকের জন্য কষ্ট হচ্ছে? জ্যাককে অন্য মেয়ের সাথে সে দেখতে পারছে না কেন?তাহলে সে কী জ্যাকের মায়ায় পড়েছে?নাকি এমনি। জীবনে একজনকে ভালোবেসে ধাক্কা খেয়ে আবার কী আরএকজনকে ভালোবাসা সম্ভব?

শ্রুতি আর ভাবতে পারল না হাত দিয়ে মাথার দুপাশ চেপে ধরল৷ কিছুই মাথায় আসছে না তার৷ কেমন যেন নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। শ্রুতি মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল,

–তোকে আরও কঠোর হতে হবে শ্রুতি। কারো মায়ায় নিজেকে জড়ানো যাবে না৷মায়া একটা মারাত্মক রোগ। যেটা একবার হলে সহজে ছাড়ে না৷ যে যে রকম আছে তাকে সে রকম থাকতে দে।জ্যাককে নিয়ে তুই আর ভাববি না। অতীতের ভুল তুই আর করবি না।

“অতীতকে চলে যেতে দাও তবে অতীতের শিক্ষা গুলোকে রেখে দেও যা তোমাকে শিখিয়ে গেছে ”

–হেই শ্রুতি মন খারাপ, বাইরে তাকিয়ে আছো কেন?

কারো কথা শ্রুতির কর্ণকুহর হতেই সে আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে পাশে থাকা ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে দেখল। লিলি তার পাশে বসে আছে।

–না ঠিক আছি৷ ভালো লাগছিল না , তাই একটু বাহিরে তাকিয়ে ছিলাম।তোমার এতো দেরি হলো কেন?

লিলি বিরক্তি মুখে বলে,

–রাস্তায় একটা ছেলে ডিস্টার্ব করছিল। তাই তার সাথে কতক্ষণ ঝগড়া করেছি৷ ছেলেটা অনেক খারাপ।

শ্রুতি আর কথা বাড়ালো না৷ আবার বাহিরের দিকে দৃষ্টি দিল। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সব কিছুই কেমন যেন অসহ্যকর লাগছে।

–শ্রুতি তুমি বাস্কেটবল ক্লাবে যাবা না। টাইম হয়ে গেছে তো,লিলি বলল।

–হুম চলো।

৩টা ক্লাস হয়ে গেছে। কিন্তু শ্রুতির ক্লাসের দিকে তেমন মনোযোগ ছিল না। এখন প্রাকটিস করতেও যেতে ইচ্ছা করছে না তার। কিন্তু সে চায় এসব চিন্তা বাদ দিতে। তাই একটু ভালো লাগার জন্য সে খেলতে যাচ্ছে।মনটা একটু ফ্রেশ হবে।

বাস্কেটবল কোর্টটা জ্যাকের ক্যাম্পাসের এক পাশের। শ্রুতি আর লিলি ড্রেসটা চেঞ্জ করে কোর্টের দিকে এগিয়ে গেল। এতোমধ্যে সবাই এসে গেছে। বাস্কেটবলের ট্রেইনার ও আছে। শ্রুতির বেশ ঠান্ডা লাগছে। সে নিজের হাতের তালু ঘষতে ঘষতে আশেপাশে তাকালো।ক্যাম্পাসের সামনের ফাঁকা জায়গায় একটা বেঞ্চে তার চোখ আটকে গেল। তার বুকটা মোচর দিয়ে উঠল৷তার মনে হচ্ছে কলিজাটা কেউ ছিড়ে নিচ্ছে। চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো। কই সাদাফ যেদিন তাকে বলেছিল যে সে তার সাথে বেইমানি করেছে? সে দিনেও তো তার এতো কষ্ট হয়নি। তাহলে আজকে কেনো হচ্ছে? শ্রুতি পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে আড়ালে নিজের চোখের পানিটা মুছে নিল। ক্যাম্পাসের ভিতরের একটা বেঞ্চে এলিশা, জ্যাক আর ওই অজ্ঞাত মেয়েটা বসে আছে। অজ্ঞাত মেয়েটা জ্যাকের একটা হাত জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে আছে।শ্রুতি তাদেরকে পিছন দিক দিয়ে দেখছে। তারা শ্রুতির থেকে কিছুটা দূরে।

শ্রুতি মনে মনে ভাবলো,

–সুস্হ হওয়ার পর আজকে ভার্সিটিতে আসলাম। আর জ্যাক একবারও আমার খোঁজ নিল না। এমনিতে তো ক্লাসে গিয়ে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে।
শ্রুতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো, নতুন কাউকে পেলে সবাই পুরাতনকে ভুলে যায়।
শ্রুতি নিজের মাথায় একটা চাটি মেরে বলল,
আরে আমি নতুন পুরাতনের কী হিসাব করলাম? জ্যাক কোথায় আর আমি কোথায়। লিলি ঠিকই বলেছিল।এইখানের মানুষ একটা ছাড়ে একটা ধরে।

১ঘন্টা প্রাকটিস করার পর শ্রুতি গিয়ে একটা বেঞ্চে বসল।হাতে থাকা রুমালটা দিয়ে কপালের ঘামটা মুছলো।লিলির কাছে পানির বোতলটা চাইল। লিলি পানি বোতলটা দিলে শ্রুতি লিলির হাত থেকে বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে কয়েক চুমুকে বোতলের পানিটা শেষ করে দিলো। শ্রুতির খুব টায়ার্ড লাগছে।দুর্বল শরীর নিয়ে খেলল। শ্রুতি চোখের কপাট দুটো বন্ধ করে বেঞ্চে গা এলিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ কেটে গেল।হঠাৎ শ্রুতি কারো ডাক শুনতে পেলে বুকটা কেপে উঠল। সে ফট করে চোখ খুলল। সামনে তিনজন ব্যক্তি দাড়িয়ে আছে।এলিশা, জ্যাক, ওই মেয়েটা। মেয়েটা এখনও জ্যাকের হাত ধরেই আছে। শ্রুতি একবার দুইজনার হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।কিন্তু তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। যে কষ্টের কোনো নাম নেই।
ততক্ষণাত্ জ্যাক জিজ্ঞেস করল,

–শ্রুতি তুমি যে আজকে ভার্সিটিতে?শরীর কী ঠিক হয়েছে তোমার?জ্বর কমেছে?

শ্রুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,

–জ্যাক আমার প্রতি তোমার আর এতো কেয়ার দেখানোর প্রয়োজন নেই। শুধু শুধু এতো কেয়ার দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করছো।

কিন্তু শ্রুতি মুখে কিছু বলল না। সে জ্যাকের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দয়ে বলল,

–হ্যাঁ ভালো আছি। শরীর ও আমার ঠিক আছে। তোমরা সবাই এখানে, আমাকে কী কোনো কারণে দরকার? দরকারি কিছু থাকলে বলো করে দিচ্ছি।

জ্যাক বলল,

–তুমি এই রকম ভাবে কথা বলছো কেন শ্রুতি? আমি কি কিছু করেছি?

–না জ্যাক কিছুই করোনি । আর আমি এই রকমই কথা বলি।

এর মধ্যেই এলিশা বলল,

–এই তোমরা থামো তো।

এলিশা হাসি মুখে জ্যাকের পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল,

–শ্রুতি ওর সাথে মিট কর। এ হচ্ছে জেসিকা৷ ও জ্যাকের বেস্ট ফ্রেন্ড। মেক্সিকোতে থাকে। প্রায়ই এইখানে আসে। এবার হ্যালোউইন উত্সব উপলক্ষে জ্যাকের বাসায় এসেছে তাই এই সুযোগে আমাদের সাথেও মিট করতে এসেছে।

জেসিকা মেয়েটি ততক্ষণাত্ বলে উঠল,

–এই মেয়েটিকে তো এইখানের মনে হয় না?

এলিশা বলল,

–ও এখানে ওর এক কাজিনের বাসায় থেকে পড়াশুনা করে। শ্রুতি তুমি যেন কোথা থেকে এসেছো বলোতো। আমার ঠিক মনে পড়ছে না?

শ্রুতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,

–বাংলাদেশ।

জেসিকা নামের মেয়েটি বলে উঠল,

–ব্যাঙলাদেশে?

শ্রুতি বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,

–হুম।

জেসিকা মেয়েটি ঘৃণিত দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,

–তোমরা দুইজন এই রকম একটা মেয়ের সাথে চল।ছি,ছি।

এলিশা বলে উঠল,

–কেন? কী হয়েছে?

–এলিশা শোনো , মিনিয়াম এক বছর আগের কথা। আমাদের বাসায় একটা মহিলাকে কাজ করতে নিয়ে এসেছিল ড্যাড। মহিলাটা ছিল ব্যাঙলাদেশি। কী বিশ্রী দেখতে?আমি একদম সহ্য করতে পারতাম না। ২দিন পর শুনি, ওই মহিলাটা আমাদের বাসার কিছু টাকা ও জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে গেছে। চোর কোথাকার। ওই সব থার্ড ক্লাস কান্ট্রির ছেলেমেয়েদের সাথে তোমরা মেশো । দেখো তোমাদের কিছু চুরি করে নিয়ে যায় নাকি।

শ্রুতি এতক্ষণ জেসিকার সব কথাই শুনেছে। অন্য সব মেয়েদের মতো তার এসব কথা শুনে কান্না আসছে না। তার রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। শ্রুতি সব সময় মনে করে, ওর নিজের আত্মমর্যাদা আছে, নিজের সম্মান আছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদ করে। ওর সামনে একটা মেয়ে ওর দেশ সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলবে, আর ও চুপ করে চোখের জল ফেলার মেয়ে নয়। শ্রুতি জেসিকার মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো। শ্রুতি মন চাচ্ছে জেসিকাকে কষে একটা চড় মারতে। কিন্তু পারছে না। জেসিকা মেয়েটা শ্রুতির চোখ মুখ দেখে আঁতকে উঠল। শ্রুতি রাগান্বিত স্বরে বলল,

–তুমি আমার দেশ সম্পর্কে কতোটুকো জানো একটু বলতো?

জেসিকা কোনো কথা না বলে জ্যাকের হাত আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।

–কোনো উত্তর দিলা না। তার মানে তুমি কিছুই জানো না। তোমার বাসায় কোন মহিলা এসে কাজ করেছে, কী চুরি করেছে না করেছে, সেটা আমি তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই নি। এখানে আমি এসেছি আমার বাবার টাকা দিয়ে তোমার না। তাহলে তুমি আমাকে চোর বলার সাহস পাও কোথা থেকে আমি বুঝছি না। জ্যাক আর এলিশা তোমাদের যদি আমার সাথে চলতে সমস্যা হয়, আমাকে বলে দিও তোমরা। আমিও তোমাদের পিছে ঘোরবো না, তোমরাও না। আর একটা কথা আমার দেশকে থার্ড ক্লাস কান্ট্রির বলার আগে নিজের দিকটা একটু বিবেচনা করো। তুমি কোন ক্লাস?

শ্রুতি একটি থামলো, জেসিকাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মুচকি হেসে বলল,

–আমার কিন্তু তোমাকে থার্ড ক্লাসের থেকে কম লাগে না। তোমার ব্যবহারই বলে দেই তুমি কোন ক্লাস।

জ্যাক বলল,

–শ্রুতি থামো অনেক হয়েছে। ও আমার ফ্রেন্ড। তুমি ওকে এভাবে অপমান করতে পারো না।

শ্রুতি অবাক নয়নে জ্যাকের দিকে তাকালো। এতক্ষণ জেসিকার কথায় যে কষ্ট পেয়েছিল তার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট পেল জ্যাকের কথায়। ও এই মেয়েটার পক্ষে কথা বলছে। শ্রুতি সিক্ত কন্ঠে জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বলল,

–জ্যাক প্রথমে শুরু করল কে বলোতো?

শ্রুতি বাঁকা হেসে বলল,

–নিশ্চিতই বলবা শ্রুতি তুমি শুরু করেছে?রাইট? ও যখন আমাকে এতো গুলো কথা শোনালো, আমাদের দেশের নামে আজেবাজে কথা শোনালো, তুমি তখন কিছুই বললে না৷ যখনই আমি প্রতিবাদ করলাম তখনই তুমি আমাকে বারণ করলা।

শ্রুতি নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতে বলল,

–ও তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি তো কিছুই না। তাই বারণ তো করবাই।

জ্যাকের দিকে তর্জনী আঙ্গুল উঠিয়ে বলল,

–ফারদার আমার আশেপাশে তোমাকে যেন না দেখি।

শ্রুতি আর এক মুহূর্ত ওয়েট না করে যত দ্রুত সম্ভব ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গেলো।

জ্যাক পিছন থেকে শ্রুতিকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু শ্রুতিকে পেলো না। এদিকে এলিশা আর লিলি পাশে বসে এতোক্ষণ সব শুনছিল। শ্রুতি যে এই রকম রেগে যাবে বা যেতে পারে তাদের কোনো ধারণা ছিল না।

জ্যাক জেসিকার কাছে গিয়ে বলল,

–তুমি এইরকম না বললেই পারতে জেসিকা।

জেসিকা ন্যাকা কান্না করতে করতে বলল,,

–মেয়েটাকে আমি ঠিক কথাই বলেছি। তুমি ওর জন্য আমাকে বকছো?

জ্যাকের এসব ভালো লাগছে না এখন। সে বলল,

–হয়েছে আর কাঁদতে হবে না। চলো বাসায় চলো।
#ভিনদেশী
#পার্ট:১৯
#আদ্রিয়ানা নীলা

আকাশের চাদর অবমুক্ত করে কুয়াশার ধূম্রজাল ছড়িয়ে আছে চারপাশ। প্রকৃতির সব কিছুকে ঝাপসা ঝাপসা লাগছে কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত থাকার কারণে।শ্রুতির মনটাও চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। কিন্তু প্রকৃতির সাথে পার্থক্য শুধু একটায়। শ্রুতির মনটা আচ্ছাদিত হয়ে আছে বিষন্নতার চাদরে যেটা দেখা বা বোঝার মতো তার কেউ নেই৷ কিন্তু প্রকৃতি যে চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে আছে তা সবাই দেখে।শ্রুতির মনে হয় সে নিজের প্রতি নিজেই বর্বরতা করছে। নিজের মনটাকে এতটা কোমল করার জন্যই মনে সে কষ্ট পায়।মানুষের সামান্য কেয়ার দেখলেই মনটা গলে যায়। কেন গলে তার মন? একটু ভালোবাসার জন্য? কিন্তু মানুষরা যে বড়ই নিষ্ঠুর৷ কোনো কিছুই সহজে পেতে দেয় না। মানুষের সাথে প্রকৃতিটাও নিষ্ঠুরতার খেলায় মেতে ওঠে। তাই কোনো কিছু পেতে হলে কত বাধাকেই না অতিক্রম করে সামনে যেতে হয়। মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়।

শ্রুতির মায়ের জন্য মনটা কেমন ছটফট করছে। বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে। নিদ্রা নেই তার দু চোখে। এক একটা মুহূর্তকে কয়েকটা বছর মনে হচ্ছে তার। কি করলে তার মনটা হালকা হবে সে ভাবছে? কোথায় হারিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। যেখানে কেউ ওকে ধরতে পারবে না। কেউ ওকে কিছুতে বারণ করতে পারবে না।

আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে দেশ ছেড়ে আসাটাই ভুল হয়েছে। কেন আস্তে গেল? সাদাফের সামনে থাকলে প্রতিমুহূর্ত কষ্ট পেয়ে আরও নিজেকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারত। মন খারাপ থাকলে মায়ের কোলে মাথা রাখতো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কষ্ট তুলনায় সুখ পেতো বেশি ।যা কষ্ট গুলোকে ভুলিয়ে দিতো। তার ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু সে তো অনেক দূরে। হাজার হাজার মাইল।

কুয়াশার চাদরের বুক চিরে সূর্য নিজেকে জানান দেয়ার অপেক্ষায়। কোমল সূর্যরশ্মিতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো মুক্তোদানার মতো ঝলমল করে। কিন্তু আমেরিকায় শীতকালে সূর্যের দেখা মেলে না। কুয়াশা আর তুষারের চাদর পরিধেয় করে থাকে এখানকার প্রকৃতি। শ্রুতি এই প্রথম প্রবাসে একটা নিদ্রাহীন রাত কাটালো। কীভাবে যে রাতের প্রহর গুলো চলে গেল সে বুঝলোই না।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে শ্রুতি কিছু বিষয় চিন্তা করতে লাগলো। একদিন হয়েছে ভার্সিটি যায় নি, খাওয়া দাওয়ায় ঠিক মতো করে নি । ভার্সিটিতে যেতে ইচ্ছা করে নি তার। কিন্তু তাই বলে নিস্তার পায় নি। খালা,লুসি এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। কী হয়েছে না হয়েছে। শ্রুতি একটা প্রশ্নেরও ঠিক ভাবে উত্তর দেয় নি। শ্রুতির কেন জানি তাদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। একা থাকতে চায় সে। শ্রুতি ফোনটা হাতে নিও। কালকের সারাদিনেও ফোন খোলে নি বন্ধ করে রেখেদিয়েছিল। ফোনটা খুলতেই ফোনে টংটুং টুংটাং ধ্বনি হতে লাগলো। শ্রুতির ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখল ।এই ধ্বনি গুলোও তার কাছে বিরক্ত লাগছে। চোখটা বন্ধ রেখে কিছুক্ষণ পর ফোনটা আবার খুলল। একগাদা মেসেজ এসে সামনে হাজির। সবই জ্যাকের মেসেজ।

–ভার্সিটিতে আসো নি কেন? রাগ করেছো?সরি।আর করবো না।

এইরকম আর অনেক। শ্রুতি সব ই পড়লো কিন্তু মন গললো না। বরং একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নাম্বারটা ব্লক করে রেখ দিল।

ফোনের স্ক্রিনে হাত দিয়ে একবার লক খুললো আর একবার বন্ধ করলো৷ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না?

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে আপু নামটা ভেসে উঠলো। শ্রুতির চোখটা ছলছল করে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলে উঠলো,

–“হ্যালো ভিনদেশী? ”

শ্রুতি নামটা শুনে হেসে দিল। তার চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা পানি পরে গালটা ভিজে যাচ্ছে। শ্রুতি হেসে উত্তর দিলো,

–আপু, তুমি কেমন আছো?

–আমি ভালোই আছি। কিন্তু তোর কন্ঠ এরকম শোনাচ্ছে কেন?জ্বর কী পুরোপুরি ভালো হয়নি।

–হয়েছে আপু। কিন্তু কিছুই ভালোলাগছে না। কী করবো বলো?

শ্রুতির কথা শুনে সোহা বেশ অবাক হলো। শ্রুতি কখনো তাকে ভালো লাগা, বা খারাপ লাগার কথা বলে না।কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলবে না। বন্ড চাপা স্বভাবের।ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাবে তবুও কাউকে কিছু বলবে না৷ কিন্তু এরকম কিছু বলায় সোহা বেশ অবাক হলো৷তার চোখটাও ভিজে উঠল। মন বলছে তার বোন ভালো নেই ওখানে।

–কিছু হয়েছে তোর শ্রুতি?

শ্রুতি এবার কেঁদেই দিলো। সোহা শ্রুতিকে এরকম কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। বুঝতে পারলো কী তো হয়েছে। এমনি এমনি তো কাদার মেয়ে তো শ্রুতি না। আর কাদলেও তো প্রকাশ্যে কখনো দেখিনি সোহা নিজের বোনেকে। সোহা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,

–কি হয়েছে শ্রুতি? তুই কাদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?

শ্রুতি চোখটা মুছে বললো,

–না আপু তোমাদের খুব মনে পড়ছে।

–আরে বোকা মেয়ে এর জন্য কেউ কাঁদে নাকি? আমরা তাড়াতাড়ি তোকে দেখতে আসবো। কিছুদিন অপেক্ষা কর।

শ্রুতি কোনো উত্তর দিলো না। সে চায় তারা এখনই আসুক।কিন্তু তা তো আর সম্ভব না। কমপক্ষে আসতে ১দিন লাগবে।

শ্রুতিকে এরকম চুপ থাকতে দেখে সোহা আবার বললো,

–মন কী বেশি খারাপ শ্রুতি ?

–হুম৷

–তাহলে যা কোথায় গিয়ে ঘুরে আয় মন ঠিক হয়ে যাবে।লুসি তো আছেই।

শ্রুতি মৃদু স্বরে বলল,

–হুম, রাখি এখন।

শ্রুতি বিছানায় আরও কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। সে কারো কথা ভাবছে না। সে ভাবছে নিজের কথা। নিজের মন কীভাবে ভালো করবে? মনটাকে আরও কঠোর করবে।এই খানে থাকলে তা হবে না। সারাদিন ঘরে থাকার কারণে লুসি সন্দেহ করে। আর কালকে ভার্সিটি থেকে এসেই শ্রুতির পাশে বসে জ্যাকের সাথে কী হইছে না হইছে একবারে তালগালের গোড়া থেকে শুরু করছে।জ্যাক কলও দিয়েছিল লুসির ফোনে তার সাথে কথা বলার জন্য। শ্রুতি দরজাই খোলে নি। চুপ করে শুয়ে ছিল। কথা বললেই এটা হইছে তো ওটা হইছে বলবে। শ্রুতি প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছে তাতে। একা একটু থাকার শান্তি পাচ্ছে না সে। একাকিত্বের স্বাদটা সে পেতে চায়। তাই মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল সে। মিথ্যা কথা যদি বলতে হয় তাও বলবে।

প্রায় কয়েকদিন হয়ে গেল শ্রুতি ভার্সিটিতে গেলো না। সারাদিন রুমেই কাটয়েছে। কোনো দরকার ছাড়া বাহিরে বের হয় নি।পড়াশুনায় ও মনোযোগ দিতে পারছিলো না। সব সময় মাথার ভিতরে তার চিন্তা ঘুরপাক খায়।ফোনটাও সুইচ অফ করে রেখেছে।

পরেরদিন সকাল,

শ্রুতি তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হলো। আজকে সে ভার্সিটিতে যাবে। আজকে মনটা একটু প্রফুল্ল। নিজের জীবনের একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছে সে। শ্রুতি নিজের ব্যাক প্যাক গুছিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নামলো। শ্রুতি গিয়ে লুসির পাশে চেয়ারে বসে বলল,

–খালামণি, আমাকে খাবার দেও।

লুসি শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,

–আজকে ভার্সিটিতে যাচ্ছো তুমি?

–হুম।

শ্রুতি গাড়িতে বসে ফেসবুকিং করছে।অনেকদিন ফেসবুকে ঢোকা হয় নি। হঠাৎ লুসি বলল,

–শ্রুতি তুমি এইকয়দিন ভার্সিটিতেও যাও নি, ঘর থেকেও বের হওনি,কেমন মনমরা হয়ে থাকো কিছু হয়েছে তোমার?

শ্রুতি লুসির দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দিকে তাকিয়ে বলল,

–তেমন কিছু না। শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তাই।

শ্রুতি গাড়িতে বসে মুখের মাস্কটা পরে নিল। কেউ যাতে না চেনে। কারো কাছে ধরা দিতে চায় না। নিজের মতো থাকতে চায় সে।
ভার্সিটি ঢুকেই শ্রুতি যত দ্রুত সম্ভব তত দ্রুত নিজের ক্লাসে গেল। পুরোটা সময় সে মাথা নিচু করেই হেঁটেছে। ক্লাসে ঢুকে শ্রুতি আলিশাকে দেখতে পেল৷ সে গিয়ে আলিশার পাশে বসলো।

–হেই আলিশা।

আলিশা শ্রুতির দিকে তাকালো। সে এতক্ষণ একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল।

–তুমি কী শ্রুতি নাকি?

–হুম, আমি শ্রুতি। কেন চিনতে পারছো না?

–হুম, তেমন চেনা যাচ্ছে না।হুডি জ্যাকেট পরেছো। মাস্ক পরেছো। বেশি ঠান্ডা লাগছে নাকি?

শ্রুতি মাস্ক টা খুলে হালকা হাসল।

–হুম একটু একটু লাগছে। আজকে ক্লাসে তো তেমন স্টুডেন্ট আসে নি কেন?

–আজকে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নেই। আচ্ছা তুমি এতোদিন আসোনি কেন? তোমার ফোনে কয়েকবার কলও দিয়েছি। তুমি ধরোও নি।

–ফোন সুইচঅফ করা ছিলো। আচ্ছা এতোদিন যা পড়েছি তা কী নোট করেছো তুমি?

–হুম আছে তো,।

আলিশা ব্যাগ থেকে নোটটা বের করে শ্রুতিকে দিল। শ্রুতি নোটটা হাতে নিয়ে বলল,

–আমি নোট করে কয়েকদিন পরে তোমাকে দিবো আনে।

–ওকে।

শ্রুতি আর আলিশা ক্যান্টিনে দিকে যাচ্ছে। আলিশার নাকি খিদে লেগেছে। সকালে কিছু খাইনি৷ হঠাৎ করে কে যেন শ্রুতির মুখটা চেপে ধরলো। শ্রুতি বুঝলো না কে তার মুখ চেপে ধরেছে। শ্রুতি সব কিছু অন্ধকার দেখছিলো। শ্রুতি চিত্কার করতে চাইলো কিন্তু মুখ দিয়ে ইম ইম শব্দ ছাড়া কিছুই বের হলো না। লোকটা তাকে টেনে হিঁচড়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা শ্রুতি বুঝতেছে না। হঠাৎ লোকটি পা দিয়ে সজোরে কিছুতে ধাক্কা মারলো৷ শ্রুতি খুব ভয় লাগছে। বুকের ভিত ধুকপুক শব্দ হচ্ছে৷ডুকরে কান্না আসছিল তার। কিন্তু ব্যক্তিটি তাকে এমন ভাবে ধরেছে যে কান্না করারও সুযোগ নেই। হঠাৎ ব্যাক্তিটি তাকে সজোরে ধাক্কা মারলো৷ শ্রুতি মেঝেতে পরে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলো ব্যাক্তিটি তাকে ছাঁদে নিয়ে এসেছে। শ্রুতির আরও ভয় হতে লাগলো। তাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে?তাকে কী এই মেরে ফেলবে? কিন্তু কারো সাথে তো তার শত্রুতা নেই।
#ভিনদেশী
#পার্ট:২০
#আদ্রিয়ানা নীলা

জ্যাকের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস শ্রুতির কাঁধে আঁচড়ে পড়ছে। শ্রুতি ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। তার হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে৷ মনে হয় এখনি বের হয়ে আসবে। শ্রুতি পিটপিট করে চোখ খুলল। জ্যাকের এক হাত শ্রুতির কোমড়ে আর এক হাত দিয়ে শ্রুতিকে দেয়ালে সাথে চেপে ধরে রেখেছে। এসব দেখে শ্রুতির হাত পা কাঁপছে । শ্রুতি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

–জ্যা,ক, কী, কর,ছো, ছা,ড়ো?

জ্যাক জবাব বিহীন দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রুতি জ্যাকের চোখের দিকে তাকালো।চোখ দুটো দেখে সে কেঁপে উঠল। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। জ্যাকের দৃষ্টিতে তার দিকে নিবন্ধ। শ্রুতির খুব অস্বস্তি লাগল। সে এদিক তাকাতে তাকাতে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আবার বললো,

–জ্যাক কী করছো? জ্যাক ছাড়ো।

জ্যাকের এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া পেলো না শ্রুতি। তার এখন খুব রাগ লাগছে। এরকম ধরে রাখার মানে কী?তাও আবার কথা বলছে না।ভীমরতি ধরেছে নাকি? শ্রুতি এবার চেচিয়ে বলল,

–জ্যাক ছাড়ো।

জ্যাক শ্রুতির এরকম চেচানো শুনে থতমত খেয়ে গেল। শ্রুতিকে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। সে এতক্ষণ ঘোরের ভিতরে ছিলো।

জ্যাক শ্রুতির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিক্ত কন্ঠে বলল,

–শ্রুতি তোমার ফোনটা একটু দেও তো?

–কেন?

জ্যাক শ্রুতির দিকে আবার এগিয়ে এলো।শ্রুতির দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকানো৷ শ্রুতি ভীতি কন্ঠে বলল,

–জ্যাক, তুমি এগোচ্ছো কেন?

জ্যাক আবার শ্রুতির একদম কাছে এসে দাড়ালো। শ্রুতি চোখ খিচে বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইল টা দিল।

জ্যাক ফোনটা নিয়ে কী কী যেন করলো। কিন্তু শ্রুতি কিছুই দেখতো পেলো না।কিছুক্ষণ জ্যাক মোবাইলটা শ্রুতির হাতে দিলো। শ্রুতি মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললো,

–কী করেছো তুমি আমার ফোনে?

জ্যাক শ্রুতির কোমড়ে হাত রেখে হেচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসল। শ্রুতি আকস্মিক এই আক্রমণে কিছুই বুঝতে পারলো না। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জ্যাক আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। জ্যাক রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

–একদম ছাড়ানোর চেষ্টা করবা না।

শ্রুতি জ্যাকের এই রকম রাগান্বিত কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠল। জ্যাক শ্রুতিকে ছেড়ে দিয়ে শ্রুতির দু গালে হাত রেখে নিজের মুখের সামনে এনে বলল,

–তুমি আমাকে এই কয়দিন ইগনোর করেছো কেন? আমার ম্যাসেজ, কল এর রিপ্লাই দেও নি কেন।ভার্সিটিতেও আসো নি। আমার উপর কী রাগ করে আছো?

শ্রুতি এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল। জ্যাক এই প্রশ্ন শুনে শ্রুতির সেদিনের কথা মনে পড়ল। এখন রাগ টা তার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সে এক ঝটকায় নিজের গাল থেকে জ্যাকের হাত সরিয়ে নিল। অতঃপর বলল,

–জ্যাক তোমাকে আমি বলছিনা, আমার আশেপাশে তোমাকে যেন না দেখি?তারপর তুমি আমাকে এই ছাদে নিয়ে এসেছো কেন? আর আমার ইচ্ছা আমি ভার্সিটিতে আসিনি। তোমার সমস্যা কী?

জ্যাক আবার শ্রুতির দিকে এগিয়ে আসতে নিলে শ্রুতি এক হাত দিয়ে থামিয়ে বলল,

–আমার কাছে আসার চেষ্টা করো না। যা বলার ওই খান থেকেই বলো।

জ্যাক থেমে গেলো। ওই খান থেকেই করুণ কন্ঠে বলল,

–শ্রুতি তুমি এখনও সেই দিনের জন্য আমার উপর রেগে আছো।সেই জন্যই ভার্সিটিতে আসোনি, আমার নাম্বারটাও ব্লক করে রেখেছো।

শ্রুতি জ্যাক কথার কোনো উত্তর দিলো না। সে এদিক ওদিক চোখ ঘুরাচ্ছে। যেন জ্যাকের কথাই শোনে নি। জ্যাক আবার বলল,

— আমি সেদিন যদি তোমাকে কিছু নাই বলতাম তাহলে জেসিকা গিয়ে ওর বাবার কাছে গিয়ে বলতো। আর উনি তোমার ক্ষতি করতো।যদি উনি শুনতো তুমি জেসিকাকে ওইসব বলছো তাহলে তোমাকে আস্ত রাখতো না।

শ্রুতি এবার জ্যাকের দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

–ও মা, উনি আমাকে মেরে ফেলবে৷ তো আমার পরিবারের সবাইকে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চোসবে। ওনার মেয়ে আমার সাথে যে রকম ব্যবহার করেছে আমিও সে রকম করেছি।

অতঃপর শ্রুতি আবার তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল,

–উনি আমাকে মেরে ফেললে ফেলুক। কিন্তু তাতে তোমার কী?

জ্যাক একবার শ্রুতির দিকে তাকালো। শ্রুতি উত্তরের অপেক্ষা করছে।

জ্যাক মাথানিচু করে উত্তর দিলো,

–Sruti, I love you.

জ্যাকের উত্তর শুনে শ্রুতি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইল। নিজের কানকেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। সে নিজের হাতে একটা চিপটি কাটল।না সে তো স্বপ্ন দেখছে না। জ্যাক এবার হাত উঠিয়ে চিত্কার করে বলল,

–Sruti, I love you. Love you very much.

শ্রুতি এখনও ঠায় হয়ে দাড়িয়ে আছে। আশেপাশের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জ্যাকের কথা।শ্রুতি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। জ্যাক শ্রুতির সামনে এসে কাঁধে হাত রাখল। শ্রুতি জ্যাকের দিকে তাকালো । জ্যাকের চোখে শ্রুতি একরাশ আকুলতা দেখতে পেলো। এই চোখের দিকে তাকালেই সে হারিয়ে যায়। জ্যাক উত্তরের অপেক্ষা করছে। পরক্ষণেই শ্রুতির এলিশার কথা গুলো মনে পড়ল৷ মনে মনে আওড়াতে লাগলো,

–শ্রুতি তুই একটা পুওর কান্ট্রি থেকে এসে ছিস এখানে পড়াশোনা করতে। ভালো পড়ালেখা করে নিজের দেশ ও বাবা মার মুখ উজ্জ্বল করতে। জ্যাকের সাথে তোর কোনো দিন যাবে না। সে অন্য ধর্মের তুই অন্য ধর্মের।ওদের স্ট্যাটাস ও তোর স্ট্যাটাস আলাদা৷

শ্রুতি নিজের আবেগকে মনের এক কোনে রেখে দিল। নিজের কাঁধ থেকে জ্যাকের হাতটা সরিয়ে দিল। এতে জ্যাকের মুখটা মলিন হয়ে গেল৷ শ্রুতি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

–জ্যাক আমাদের মধ্যে সম্পর্ক কোনো দিনও সম্ভব নয়।তোমার ধর্ম আর আমার ধর্ম আলাদা৷ তোমরা বাবা বিশ্বের ভিতরে একজন ধনী মানুষ। কিন্তু আমরা তা না। সম্পর্ক হয় সমানে সমানে।

শ্রুতি এই টুকু বলতে অনেক কষ্ট হয়েছে।কথাগুলো কেমন গলার কাছে এসেই আটকে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা জল পরে গালটা ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ জ্যাক তার হাত টা ধরে সামনে ঘুরালো। শ্রুতি অশ্রু ভেজা চোখে জ্যাকের দিকে তাকালো। জ্যাকের চোখও টলমল করছে। শ্রুতি মাথানিচু করে নিলো। এই চোখে তাকানোর সাধ্য নেই তার৷

–এতোগুলো কথা বললা। একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতো তো৷ তাকাও বলছি।

শ্রুতি তাকালো না। জ্যাকের দিকে তাকিয়ে এই কথা গুলো বলা তার পক্ষে সম্ভব না৷

–আমি জানি তুমি বলতে পারবা না৷ কারণ তুমি আমার প্রতি দুর্বল। শ্রুতি ভালোবাসায় কোনো ধর্ম -বর্ণের ভেদ থাকে না। কোনো ধনী গরিবের ভেদ থাকে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটাতে আমি কোনো ধর্ম বর্নের হিসাব করি নি।

শ্রুতি অশ্রুসিক্ত নয়নে জ্যাকের থেকে এক পা একপা পিছনে সরতে সরতে বলল,

–তাও সম্ভব না জ্যাক।

–কেন সম্ভব না বলো? কেন? কেন?

জ্যাক এগিয়ে আসতে নিলে শ্রুতি দৌড় দিল। জ্যাক তার পিছন পিছন আসছে। শ্রুতি ক্লাস থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে আবার দৌড় দিল৷ ক্যাম্পাসের সকলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে শ্রুতির কিছু যায় আসে না। শ্রুতি দৌড়ে ক্যাম্পাসের সামনে গ্যাট দিয়ে বের হতে যাবে তখন জ্যাক চিত্কার করে বলে উঠল,

–আমার কাছ থেকে পালাচ্ছো? কতদিন পালাবা। একদিন তো ধরা দিতেই হবে। আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না তুমি যতই বলো।

শ্রুতি পিছন ফিরে জ্যাকের দিকে তাকালো। জ্যাক করিডোর থেকে কথা গুলো চিত্কার করে বলছে। শ্রুতি জ্যাকের দিকে তাকাতেই জ্যাক শ্রুতিকে ইশারায় একটা ফ্লাইং কিস করল। শ্রুতি আশেপাশে তাকালো ক্যাম্পাসের সকলে তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। শ্রুতির প্রচুর রাগ লাগছে।তার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিল। লজ্জা বলতে কিছুই নেই।

শ্রুতি আর এক মুহূর্ত থাকলো না। ভার্সিটি থেকে বের হয় একটা ক্যাব নিয়ে বাসায় গেল।

রাতে শ্রুতি বিছানায় শুয়ে আছে। তার ঘুম আসছে না । একবার এদিক একবার ওদিক করছে। তার কানে শুধু জ্যাকের কথা গুলো ভাসছে।হঠাৎ শ্রুতি ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে জ্যাক কল করেছে। শ্রুতি ঘরির দিকে তাকালো। রাত প্রায় ১২টা বেজেছে। শ্রুতি কল টা কেটে দিল। লাগাতার কল আসতে লাগল। একটার পর একটা। শ্রুতি ফোনটা সাইলেন্ট করে পাশের বালিশের উপর রেখে দিল।তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আসছে না। জ্যাক একের পর এক কল করছে৷ শ্রুতি মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে রইল। ফোনটা নিঃশব্দে বেজেই চলছে। একের পর এক কল কেটে গেল।হঠাৎ ফোনে ম্যাসেজ আসলো। শ্রুতি ম্যাসেজ টা পড়লো৷ ওকে থ্রেট দিয়ে জ্যাক লিখছে,

–আমি জানি তুমি জেগে আছো । কল ধরো। নাহলে বাসার ভিতরে চলে আসবো।

,, (চলবে)
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here