ভুলনা আমায় পর্ব -০৩

#ভুলোনা_আমায়
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#৩য়_পর্ব
এরপর হঠাৎ একদিন কল্পর মা কল্পকে ফোন দেয়।
আর কল্প তার ফোন রিসিভ করতেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।
কল্প ডিউটিরত অবস্থায় ছিলো,আর তখন আম্মু(শাশুড়ী মা) ওকে ফোন দিয়ে বলেন,
_তোরা কিভাবে আমাদের কাছ থেকে এত বড় কথা টা লুকালি?
আমি তোর মা।আমার কি জানার কোন হক নেই?
আর সবার কথা না হয় বাদই দিলাম।কিন্তু আমাকে তো অন্তত একবার জানানো উচিৎ ছিলো।
_আসলে আম্মু,হয়েছে কি।
_থাক আর কিচ্ছু বলতে হবেনা,আমি কি আপন নাকি যে আমাকে বলা লাগবে।
আমি কে, যে আমার কাছে কিছু বলবি।
_আচ্ছা আম্মু,দ্রিতা তোমায় সব বলেছে না?
_না ও বল্লেও তো বুঝতাম।তুই বলিসনি,কিন্তু ও তো বলেছে।
কিন্তু না ও নিজেও কিছু বলেনি। বরং আমাদের থেকে লুকিয়ে রেখেছে।

আচ্ছা তোদের সন্তান কি আমাদের কিছুই না?
তোদের সন্তান আমাদের কি রক্ত না?
কেন লুকালি আমাদের থেকে এত বড় খুশির কথা?

_মানে?
কি বলছো তুমি?
_কি বলছি মানে?আমি যে দাদু হবো এটা কেন তোরা লুকালি আমার থেকে?
আমাদের সবার থেকে?
এত বড় খুশির কথা কেউ কখনো লুকায়?
আমি আজ তোর ছোট আপুকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম,দ্রিতাও আল্ট্রা সনোগ্রাফি করে বের হচ্ছিলো।
আর তখনই সব জানতে পারি।আমাদের ঘরে যে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।

এ কথা শোনা মাত্রই কল্প সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।
পরে ওর সাথে যারা কাজ করছিলো সবাই ওকে ধরাধরি করে নিয়ে বেডে শোয়ায় আর মাথায় পানি দেয়।
কিছু ক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরে।

ওর যখন জ্ঞান ফিরে তখন ও এক মিনিট ও দেরি না করে আমাকে ফোন দেয়।

আমি রিসিভ করতেই,

_দ্রিতা,কি শুনলাম আমি এটা?
_কি শুনেছো?
_তুমি নাকি মা হতে যাচ্ছো?
চুপ করে আছো কেন,উত্তর দাও।
_হ্যাঁ,আর তুমি বাবা।
_কিন্তু কিভাবে সম্ভব, আমাকে বলবে একটু?
তাহলে কি সেদিন তুমি..

_হ্যাঁ সেদিন আমি অপারেশন করিনি।
সেদিন যখন ডাক্তার আমাকে অপারেশন এর জন্য ডাকলেন,তখন আমি ডাক্তারকে মিনতি করে বললাম,আমি এই অপারেশন টা করতে চাইনা ম্যাম।
আমি মা হতে চাই।
এতে যদি আমার জীবন ও চলে যায় যাক।
তবুও আমি মরে শান্তি পাবো।
আর আজ যদি এই অপারেশন করি, তাহলে যত দিন বেঁচে থাকবো,প্রাণহীন বেঁচে থাকবো।
এভাবে আমি বাঁচতে চাইনা ম্যাম।

আমি আজ এখানে এসেছি শুধু মাত্র কল্পের জন্য।
আমার অপারেশনের কোন ইচ্ছে নেই ম্যাম।
আল্লাহ যদি চান তাহলে আমি এবারই মা হতে চাই।

আর প্লিজ একটা অনুরোধ।
আমি যে অপারেশন করিনি।।এ কথা যেন কল্প না জানে।

ডাক্তার প্রথমে এসবে রাজি হননি।
কিন্তু যখন আমি কান্না করে ডাক্তারের পা ধরতে যাই।
ডাক্তার তখন আমার কথায় সায় দেন।
আর বলেন,
আসলেই,মায়েরা সব পারে সন্তানের জন্য।
আজ প্রমাণ ও পেলাম।
আল্লাহ এমন কোন মিরাকেল করুন যাতে তুমি মা ও হতে পারো।
আর তোমার কোন ক্ষতিও না হয়।
দোয়া রইলো।
আর এও বললেন,যদি তুমি এবার মা না হতে পারো।
তাহলে কিন্তু অবশ্যই তোমার বর চলে যাবার পর তুমি আমার সাথে দেখা করবে।

যদি তখন তোমার অবস্থার আরো অবনতি দেখি,তাহলে আমি তখনই অপারেশন করবো।
আমি তোমার কথা রাখলাম,তবে আমার কথাও তোমার রাখতে হবে।

আমি তখন ডাক্তারের কথায় সায় দিলাম।

কিন্তু আল্লাহ চাইলে কিনা পারেন বলো,
আল্লাহর রহমতে তুমি চলে যাবার দুইদিন আগেই আমি জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি।

তোমার মনে আছে?
ওই যে আমি একদিন তোমার শার্টটা বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিলাম।
আর তুমি হঠাৎ করে এসেই আমাকে কাঁদতে দেখে বলেছিলে,
আমি চলে যাচ্ছি বলে কাঁদছো?
এরপরের বার একবারে চলে আসবো তোমার কাছে।
তখন আর এই ভাবে কাঁদতে হবেনা আমার লক্ষী বউ এর।

আসলে সেদিন আমি, তুমি চলে যাবে বলে কাঁদছিলাম না,
আমি কাঁদছিলাম,
সেদিন আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম আমি মা হতে যাচ্ছি।
সেদিন প্রেগন্যান্সির টেস্ট কিটে দুটো লাল দাগ উঠেছিলো।
কিন্তু আমি এই খুশির সংবাদ টা তোমায় দিতে পারিনি।
তাই কাঁদছিলাম।

কারণ আমি তোমায় যদি বলতাম আমি প্রেগন্যান্ট।
তাহলে তুমি হয়তো,
কষ্ট হলেও আমাদের বাচ্চাটাকে রাখতে দিতেনা আমাকে,
আমাকে হারানোর ভয়ে।
তাই হয়তো আমাকে Abortion ও করতে বলতে।

আর আমি মা হয়ে তা কোন দিনও পারতাম না।
কারণ আমার কাছে আমার জীবনের চেয়ে ওর জীবনের মূল্য টাই বেশি।
তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ।

আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি।
ক্ষমা করে দাও আমায়।

_কেন করলে তুমি এমন?
এখন যদি তোমার কিছু হয়ে যায় আমি কি নিয়ে বাঁচবো?

কেন এত বড় একটা সিদ্ধান্ত একা একা নিতে গেলে তুমি?
তুমি জানো,আম্মুর মুখে এই নিউজ শুনে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
শুধু মাত্র এটা ভাবতে ভাবতে,যদি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলি।
আমি কিভাবে বাঁচবো?

_কি অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা তাইনা কল্প?
যেখানে তোমার আজ খুশিতে আত্মহারা হবার কথা সেখানে তুমি কাঁদছো।

শোনো,কান্না করোনা হুম।
আমি তোমায় অতি শীঘ্র একটা ছোট্ট কল্প নয়তো ছোট্ট দ্রিতা উপহার দিবো।

আমার কথা শুনে কল্প আরো জোরে জোরে কান্না করছে।

_শোনো,ডাক্তার কি বলেছে তোমাকে হুম?
কোন সমস্যা হচ্ছে তোমার?
কষ্ট হয়?

_ডাক্তার রেগুলার চেকাপে রেখেছেন।
কষ্ট তেমন একটা হয়না,মাঝে মাঝে সামান্য পেটে ব্যথা হয় আরকি।
ও কিছুনা।
আমি ঠিক আছি।
তুমি একদম চিন্তা করোনা হুম।

_আচ্ছা ঠিক আছে একটু রেস্ট করো তাহলে।

_আচ্ছা তুমিও সাবধানে থেকো কেমন?
_আচ্ছা।

আমি একা আনমনে ভাবতে থাকি।
আমি কত ভাগ্যবতী।
এমন বর পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার।
কল্প আমাকে কত ভালবাসে।
আমার শশুরবাড়ীর লোকজনও ভীষণ ভালো।
তারাও আমাকে অনেক ভালবাসেন।
বিশেষ করে আম্মু,(শাশুড়ী মা)
আর ছোট ভাই(দেবর)

আমি প্রেগন্যান্ট জানার পর থেকে তারা আমাকে খুব যত্ন করেন।
আম্মু আমাকে কিছুই করতে দেন না এখন।

আমাকে শুধু বলেন,আমি যেন সাবধানে হাঁটাচলা করি।

আর আমাকে অভিমান করে বলেন,
আমাকেও জানালেনা তুমি।
খুব কষ্ট পেয়েছি আমি।

আমি জড়িয়ে ধরে আম্মুকে বলি,
আমি তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম আম্মু।
ভেবেছিলাম আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে এসেই জানাবো।
কিন্তু তার আর সুযোগ পেলাম কই।
জেনেই গেলেন একা একা।

আম্মুও আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন,এবারের মত মাফ করে দিলাম।
পরের বার যেন এমন ভুল না হয়।

_পরের বার আমিই হয়তো আর থাকবোনা আম্মু।

_মানে?
_ধ্যাত! কি বলতে কি যে বলি আম্মু।মাথা টাই একদম গেছে আমার।
_দ্রিতা!বেয়াইন রা জানেন কিছু?
_না আম্মু,কেউ কিছু জানেননা।
_আচ্ছা তোমার ফোন টা আনো দেখি।
_কেন আম্মু?
_আরে আনো তো।
_এই যে আনলাম।
_এবার তোমার মাকে কল দিয়ে আমার কাছে ফোন টা দাও।
_এই যে নিন আম্মু।

আমি কল দিয়ে দেই।
আম্মু ফোন রিসিভ করতেই এই পাশ থেকে আমার এই আম্মু বলেন,

_আসসালামু আলাইকুম বেয়াইন আপা।
কেমন আছেন?
_জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
আপনি কেমন আছেন?
_ভালো আর থাকতে দিলেন কই,
_কেন আপা?কি হয়েছে?
_যে মেয়ে পাঠিয়েছেন আমার ঘরে।
এই মেয়ের জন্য ভালো থাকা যায়?
_কি বলেন আপা,দ্রিতা কিছু করেছে?
_কি করেনি তাই বলেন।
_কি হয়েছে আপা খুলে বলুন তো।
_আপনি বাসার সবাইকে নিয়ে এখনই আমাদের বাসায় আসুন।
যা বলার সামনাসামনি বলবো।
_আপা কি হয়েছে এখনই বলুন না।
দ্রিতা কোন অন্যায় করেছে?
করে থাকলে ছোট মানুষ মাফ করে দিন না আপা।সবাইকে নিয়ে আসা লাগবেনা।
আমি ওকে পরে বুঝিয়ে বলবো।
দ্রিতা কে একটু ফোন টা দেয়া যাবে?

_না দেয়া যাবেনা।আমি কিছু জানিনা,এখনই আসবেন আপনারা আমাদের বাসায়।যা বলার সামনাসামনি বলবো আমি।
ফোন রাখছি আমি এখন।

এই বলে আম্মু ফোন রেখে দেন।

_এটা কি করলেন আম্মু?এবার তো সবাই ভয় পেয়ে যাবে।
ভাব্বে,না জানি করেছি আমি।
_আরে কিছু হবেনা।
দেখোনা,উনারা কত দিন যাবত আসেন না।এভাবে না বল্লে আসতেন না।
আজ সবাই ঠিকই আসবেন দেখো।

তুমি একটু রেস্ট নাও।
আমি সবার জন্য রান্নার ব্যবস্থা করি।
আজ সবাই মিলে এক সাথে খাবো।

কত ভালো আম্মু।
কত খুশি।
আমাদের বাসার সবাইও কতই না খুশি হবে আজ।
আমার সবাই কে নিয়ে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে।
খুব।

কিছুক্ষণ পরই আমার বাসার সবাই চলে আসেন।
ভয়ে তারা দৌড়ে আমার কাছে আসেন।
কি করেছি জানতে।

পরে আম্মু (শাশুড়ী মা) সবাইকে বলেন,
দ্রিতা মা হতে যাচ্ছে।
আর বলেন,ক্ষমা চাচ্ছি সবাইকে এইভাবে আসতে বলায়।
নয়তো কখনোই আসতেন না আজ আপনারা।

তারপর সবাই ভয় কাটিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।
সবাই অনেক খুশি।
আর বকাও দেয় আমায় সবাই।
কেন আমি কাউকে বলিনি।

সবাই মিলে এক সাথে হাসাহাসি করছে।
কত্ত খুশি সবাই।
এর মধ্যেই হঠাৎ করে কলিং বেলের আওয়াজ।
আমি গিয়ে গেইট খুলতেই দেখি…

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here