#ভ্যাম্পায়ার_বর (সিজন ২)
#পর্ব_৪
#M_Sonali
— আচ্ছা আপু আমার ব্যাপারে তো আমি আপনাকে সবকিছুই খুলে বলেছি। কিন্তু আপনার ব্যাপারে তো আমার কিছুই জানা হলো না! এমনকি আমি আপনার নামটাও জানি না!
সামনে থাকা কফির মগটা তে চুমুক দিয়ে ওই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ওপরের কথাগুলো বলে উঠল চাঁদনী। ওর কথায় মুচকি হাসলো মেয়েটি। তারপর ছোট করে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করল,
— আমার নাম শ্রাবণী। আমার বাবা-মা নেই আমি অনাথ। আপাতত তোমার জন্য এতটুকুই জানা যথেষ্ট মনে করি। আর তুমি আমাকে তুমি করে বলতে পারো। আর শ্রাবণী আপু বলে ডাকতে পারো। তোমার মুখে এই আপনি আপনি ডাকটা একদমই ভালো ঠেকছে না আমার কাছে। ভেবে নাও আমি তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বড় আপু।
শ্রাবনীর কোথায় মৃদু হাসলো চাঁদনী। তারপর কফির মগে আরেকবার চুমুক দিয়ে বলে উঠলো,
— তোমার কোন ভাই বোন নেই আপু? তুমি কি একাই? আর তোমার বাবা-মা কারা ছিলেন তুমি কি তাদের দেখনি কখোনো? তুমি বড়’ই বা হয়েছ কোথায়?
ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো শ্রাবণী,
— আচ্ছা চাঁদনী তুমি আর কতদিন এভাবে চুপ চাপ বসে থাকবে বলো তো? তোমার কি মনে হয় না তোমার এখন একটা চাকরি বাকরি করা দরকার? আমি তোমাকে সারা জীবন থাকতে দিতে ও খাওয়াতে পারি। কিন্তু আমি তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষীহিসেবে চাই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও। নিজের একটা পরিচিতি তৈরি করো। যেহেতু আমিও তোমার মত এতিম তাই আমি চাই তুমিও আমার মত চাকরি করে নিজের পরিচয় তৈরি করো। তুমি যদি চাকরি করতে চাও তাহলে আমি তোমার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আশা করি তোমার পছন্দ হবে।
শ্রাবনীর কথায় বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইল চাঁদনী। তারপর মনে মনে ভাবতে লাগল হয়ত শ্রাবণী ওকে নিজের বোঝা মনে করছে। আর করবে না’ই বা কেন! আজকালের যুগে কে’ই বা আছে যে বিনা টাকা পয়সায় একজনকে নিজের ঘাড়ে বসিয়ে খাওয়াবে। তাই হয়তো শ্রাবণী ওকে চাকরি করার কথা বলছে। আর তাছাড়া ওর কথাটা তো খুব একটা ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। যেহেতু চাঁদনী অনেক পড়াশোনা জানে তাহলে ও তো চাকরী করতেই পারে।
— ঠিক আছে আপু, আমিও চাকরি করতে চাই। আমিও চাই তোমার মত আমার একটা নিজের পরিচিতি হোক। কিন্তু আমার কাছে তো কোন সার্টিফিকেট বা কোন দরকারি কাগজপত্র নেই। তাহলে আমি চাকরি করব কিভাবে? আমি যতদূর জানি চাকরি করতে হলে তো সবার আগে অনেক প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র লাগে। সেগুলো তো আমার কাছে কিছুই নেই। তাহলে আমার পক্ষে কি চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে?
ওর কথার উত্তরে শ্রাবণী ওর ডান হাতটা নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে মুচকি হেসে বলল,
–সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না! তুমি শুধু বলো তুমি চাকরি করতে চাও কিনা? বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আর আমি তোমাকে এমন চাকরি নিয়ে দেবো যে তুমি অনেক খুশি হবে। আর তোমাকে বেশি কাজও করতে হবে না। আমার চেনাজানা ভালো লোক আছে।
ঠিক আছে আপু তাহলে তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দাও। আমার আর একা একা এভাবে বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। সব সময় বাবার কথা মনে পড়ে মনটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। চাকরির ভিতর ডুবে থাকলে অন্তত মনটা একটু ভালো রাখার ট্রাই করতে পারব।
চাঁদনীর কথা শুনে মুচকি হাসলো শ্রাবণী। তারপর আরো বেশ কিছুক্ষন কথা বলে শ্রাবণী উঠে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল, বলল হাসপাতালে যাচ্ছে সে। সারাদিন বাসাতে একা একাই কাটায় চাঁদনী। শ্রাবণী সকালে বের হয়ে যায়, সারাদিন আর বাসায় আসে না। ফিরতে ফিরতে অনেক রাতে বাসায় ফেরে সে। তবে দুই একবার কথা বলে চাঁদনীর সাথে ফোনে। চাঁদনীকে নতুন ফোন কিনে দিয়েছে সে। ফোনের মাধ্যমে দুজন দুজনের সাথে কথা বলে এবং খোজ খবর নেয়। তবে কেন জানেনা চাঁদনী এ বাসায় আসার পর থেকেই ওর সব সময় মনে হয় ওর আশেপাশে কেউ আছে। যাকে ও গভীরভাবে অনুভব করতে পারে। কিন্তু দেখতে পায় না। সারাদিন একা একা বসে থাকলেও নিজেকে কখনোই একা মনে হয় না তার। মনে হয় দুটি চোখ সবসময় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে এই নজরটা কোন খারাপ নজর নয়। বরং ওকে যেন প্রটেক্ট করার জন্যই কেউ নজর রাখছে। চাঁদনী জানে না এটা একান্তই ওর মনের ভুল নাকি সত্যিই কেউ ওর ওপর নজর রাখছে। তবে এই অনুভুতিটা কেনো জানি ভীষন ভাললাগে। নিজেকে কখনো একা মনে হয়না।
———————-
রাত আট টা বিশ মিনিট,
কিচেনে নুডুলস তৈরি করার জন্য পেঁয়াজ-মরিচ কাটছে চাঁদনী। সারাদিন একা একা থাকতে থাকতে বোরিং হয়ে গেছে সে। এখন কেন জানিনা খুব নুডুলস খেতে ইচ্ছা করছে তার। তাই আর দেরি না করে কিচেনে চলে এসেছে। নুডুলস রান্না করার জন্য। পেয়াজ কাটার সময় অন্যমনস্ক হয়ে নিজের আঙ্গুল কেটে ফেলে চাঁদনী।সাথে সাথে কাটা স্থান থেকে ঝপঝপ করে রক্ত পড়তে থাকে। আঙ্গুল কেটে যাওয়ার যন্ত্রনায় আর এক হাত দিয়ে আঙ্গুল টা চেপে ধরে রাখে সে। এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার চোখ থেকে। এখন কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা! বাসায় একমাত্র ও ছাড়া আর কেউ নেই যে একটু সাহায্য করবে। এদিকে আঙ্গুল কেটে তার রক্ত দিয়ে পেঁয়াজগুলো সব মেখে গেছে। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে পেঁয়াজ কাটা বাদ দিয়ে সেখান থেকে সরে এসে ডেটল আর তুলা খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পাওয়ায় হতাশ হয়ে সোফার ওপর গিয়ে বসে পড়ল। ঠিক তখনই বাসার কারেন্ট চলে গেল। কারেন্ট চলে যাওয়ায় যেন আরো বেশি রাগ হতে লাগলো নিজের উপর চাঁদনীর। নিজেকে নিজে বকা দিয়ে বলতে লাগল। “কি দরকার ছিল নুডুলস খেতে যাওয়ার। এখন নুডুলস খেতে না গেলে হাতটা এভাবে কাটতো না। অসম্ভব জ্বালা করছে হাতটাতে। হাতটা না বাধলেও চলবে না। কারণ অনেক রক্ত পরছে। আবার কারেন্ট যাওয়ার কারনে একদম অন্ধকার রুমটা। এখান থেকে কোথাও যেতে গিয়ে কিছু পরে ভেঙে গেলে কেমন হবে? এমনিতেই আপুর ঘারে বসে খাচ্ছি।”
এসব কথা ভেবে ভেবে সোফাতেই চুপ করে বসে রইল চাঁদনী, কারেন্ট আসার অপেক্ষায়। তখনই ওর হঠাৎ অনুভব হতে লাগল যেন ওর পাশে কেউ আছে। স্পষ্ট বুঝতে পারল সে, যেন ওর পাশে কেউ বসে আছে। চাঁদনীর এবার অসম্ভব ভয় হতে লাগল। সারা শরীরের লোমগুলো ভয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। চাঁদনী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
— কে, কে আছে এখানে? কথা বলুন কে আপনি? আমি জানি এখানে কেউ আছেন বলুন কে আপনি?
একা একাই এতগুলো কথা বলে থামল চাঁদনী। তারপর অন্ধকারের মাঝে হাতরিয়ে হাতরিয়ে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু না কাউকে খুঁজে পেল না সে। হঠাৎ করে ওর মনে হলো ওর হাতের কাটা অংশটা কেউ নিজের হাতে চেপে ধরে পিছন দিকে ঘুরিয়ে ধরেছে। যার কারণে আর কোন দিকে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না ও। চাঁদনী যখনই ভাবলো ও চিৎকার দিবে সেই মুহূর্তেই দেখলো হঠাৎ করেই রুমটা কেমন আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। তবে নীল রঙের আলো। যার দরুন রুমের মাঝে ভালোভাবে কিছু দেখা না গেলেও অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। চাঁদনী নিজের হাতটাকে ঘুরিয়ে পিছন দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখলো হুডিওয়ালা একটি ছেলে ওর কাটা হাতটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যার চোখ দুটো গাঢ় নীল রঙের। তবে চেহারা টা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
চাঁদনী শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। সাথে সাথে পুরো রুম আলোকিত হয়ে গেল। ও আশেপাশে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল রুমের মাঝে কেউ নেই। ও একাই দাঁড়িয়ে আছে। আর কারেন্টও চলে এসেছে। অবাক হয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগল সেই নীল চোখের হুডিওয়ালা ছেলেটিকে। কিন্তু না পুরো বাসায় ও ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে কে ছিল এতক্ষণ ওর সামনে? যে ওর হাত চেপে ধরেছিল এতক্ষণ? হাতের কথা মনে পড়তেই নিজের হাতের দিকে ফিরে তাকাল চাঁদনী। তাকিয়ে যেন অবাক এর শীর্ষে পৌঁছে গেল সে। কেননা ওর হাতে কোন কাটা নেই। এমনকি এক ফোঁটা রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। এটা কিভাবে সম্ভব? একটু আগেই তো হাতটা ক্ষতবিক্ষত ছিল কেটে গিয়ে! তাহলে এখন সেটা কোথায় গেল?
এসব নিয়ে যখন আকাশ পাতাল ভাবছিলো চাঁদনী তখনই ওর বাসার কলিং বেলটা বেজে উঠলো। ও আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিল। দেখল শ্রাবণী দাঁড়িয়ে আছে মুচকি হাসি মুখে নিয়ে। ওর হাত ধরে রুমে ডেকে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে চাঁদনী উত্তেজিত গলায় বলল,
— আপু, আপু আমার সাথে এখন কিছু একটা হয়েছে! আমি বুঝতে পারছি না এটা কি হলো কি করে হলো! এটা কি আমার মনের ভুল নাকি সত্যি ছিল? নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। এটা তো সত্যিই ছিল এটা কোন মনের ভুল নয়। আর আমি ঘুমিয়েও ছিলাম না যে আমি কোনো স্বপ্ন দেখেছি।
— চাঁদনী, চাঁদনী শান্ত হও আমার কথা শোনো। তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? কুল ডাউন চাঁদনী কুল ডাউন। একটু শান্ত হয়ে তারপরে সবকিছু খুলে বল, আমি শুনছি। এভাবে অস্থির হইও না।
চাঁদনীর দুই গালে হাত রেখে কথাগুলো বলল শ্রাবণী। ওর কথা শুনে নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত করল চাঁদনী। তারপর কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা খুলে বললো ওকে। সবকিছু শুনে শ্রাবণী মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল,
— তুমি হয়তো ঘুমিয়ে ছিলে তাই কোন স্বপ্ন দেখেছো! তাছাড়া এটা কি করে সম্ভব বলতো? তুমি তো বাসায় একদমই একা ছিলে। আর তাছাড়া দরজা-জানালা সব ভেতর থেকে লাগানো। তাহলে বাসার মধ্যে কেউ আসবে কিভাবে? একমাত্র আমি আসতে পারি কারণ আমার কাছে দরজার ডুপ্লিকেট চাবি আছে। কিন্তু আমিও তো আসিনি। হয়তো তুমি কোন কিছু ভুল দেখেছো তোমার কল্পনা ছিল এটা।
— না আপু এটা আমার কল্পনা হতেই পারে না। আমি যা দেখেছি বাস্তবে সত্যি দেখেছি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস না করলে আমার সাথে আসো আমি এখনই তোমাকে প্রমান দেখাচ্ছি। তোমায় কিচেনে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছি সেখানে আমার হাত কেটে রক্ত লেগে থাকা পেঁয়াজ কাটা আছে। চলো এখনই দেখাচ্ছি তোমায়!
কথাটি বলে শ্রাবণীর হাত ধরে নিয়ে কিচেনে গেল চাঁদনী। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলো কোন পেঁয়াজ কাটা নেই। কিচেন একদম আগের মতোই রয়েছে। কোথাও কোনো পেঁয়াজ কাটা বা রক্তের ছিটে ফোটাও নেই। এটা দেখে যেন আরো বেশি অবাক হয়ে গেল চাঁদনী। এবার বুঝতে পারছে না কোনটা বিশ্বাস করবে সে! যেটা নিজের সাথে ঘটে গেল সেটা, নাকি যেটা এখন চোখের সামনে দেখছে সেটা? সবকিছুই যেন মাথার মধ্যে গুলিয়ে যেতে লাগল ওর। ওকে এত উত্তেজিত হয়ে ভাবতে দেখে ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শ্রাবণী বলল,
— চাঁদনী নিজেকে সংযত করো। এত হাইপার হওয়া তোমার জন্য ভালো নয়। তুমি কেবল’ই সুস্থ হয়েছো। তাই এতোটা ভেবো না। তবে একটা কথা মনে রেখ তোমার সাথে যেটা হয় সেটা অবশ্যই তোমার ভালোর জন্য হয়। তাই এত কিছু ভেবে নিজের শরীরটা খারাপ করবেনা। এখন চলো একটু বিশ্রাম নেবে তাহলে নিজেকে একটু বেটার লাগবে।
শ্রাবনীর কথার কোন উত্তর দিল না চাঁদনী। ওর কথা মতো ওর সাথে গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর ভাবতে লাগলো কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে। কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সবকিছু সে।
#ভ্যাম্পায়ার_বর (সিজন ২)
#পার্ট_৫
#M_Sonali
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে, প্রয়োজনীয় সব কাজ শেষ করে শপিংমলে যাওয়ার জন্য রেডী হচ্ছে চাঁদনী আর শ্রাবণী। গতকালকে শ্রাবণী ওর জন্যে একটি ভালো চাকরি কনফার্ম করে এসেছে। যেখানে আগামি কাল থেকেই জয়েন হতে হবে ওর। তাই আজকে কিছু ড্রেস কেনার জন্য শ্রাবণীর সাথে শপিং মলে যাচ্ছে সে। সিলেট থেকে এখানে আসার পর শ্রাবণীর দেওয়া কিছু ড্রেস পড়েই কাটিয়েছে সে। তবে নতুন নতুন চাকরিতে জয়েন করতে হলে তাকে ভালো কাপড় চোপড় পড়তে হবে। তাই শপিংয়ে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছে দুজন।
দুজন একসাথে রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে একটি সিএনজি তে চড়ে শপিংমলের উদ্যেশে বেড়িয়ে পড়লো। ঢাকার সবচাইতে বড় শপিং মলের সামনে গিয়ে নামল তারা। এর আগে চাঁদনী কখনো বাইরের জগত সেভাবে দেখে নি। সবসময় ঘরের মধ্যে থেকে বড় হয়েছে সে। ওর বাবা ওকে কখনোই বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। সব সময় রুমের মাঝে রেখে বড় করেছে। এমনকি পড়াশোনাও বাসাতেই করিয়েছে। তাই বাইরের জগতটা কে এত কাছ থেকে দেখে মনের ভেতর কেমন একটা ভয় ভয় সৃষ্টি হয়েছে তার। কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে না। সে মনের ভয় মনে লুকিয়ে রেখে শ্রাবণীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— আপু এটা কোন জায়গা?আর এই এত বড় বাড়ির এখানে কে থাকে?
ওর কথা শুনে মুচকি হাসল শ্রাবণী। তারপর ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
— আরে পাগলি এটা কোনো বাড়ি নয়। এটা একটা শপিং মল। যেখানে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে সবকিছু পাওয়া যায়। তোমার কাপড়চোপড় কিনতেই আমরা এখানে এসেছি। ভেতরে চলো তাহলেই সব বুঝতে পারবে।
শ্রাবনীর কথায় কোন উত্তর দিল না চাঁদনী। ওর সাথে ভিতরে গিয়ে চোখ বুলিয়ে চারপাশে দেখতে লাগলো। কেমন যেন সবকিছু ভীষণ অচেনা লাগছে তার কাছে। এর আগে কখনো বাইরের জগতটা এত কাছ থেকে দেখা হয়নি বলে সবকিছুই কেমন নতুন নতুন আর বড় মনে হচ্ছে। নিজেকে কেমন সকলের মাঝে অচেনা লাগছে তার। সে চারি দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো এত এত মানুষের ভিড় যেন কল্পনা করতে পারছেনা সে। সে নিজের বাবার সাথে বড় হয়েছে একটা বাসার মধ্যে। তাই সে বুঝতেই পারছেনা যে পৃথিবীতে এত মানুষ আছে। সব কিছু যেনো তার ধারনার বাইরে ছিল। এভাবে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ কয়েকটা লম্বা লম্বা মানুষের দিকে চোখ আটকে গেল চাঁদনীর। যার মাঝে দুটি লোক হুডিওয়ালা জ্যাকেট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশে দুটি মহিলা শাড়ি পড়ে। তাদের দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল চাঁদনী। ওর মনে পড়ে গেলো সেই কালো রাতের ওই হুডিওয়ালা জ্যাকেট পরা দুই ভ্যাম্পায়ারের কথা। ভয়ে সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল তার। সে দ্রুত শ্রাবণীর কাছে গিয়ে ওকে একহাতে জাপ্টে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় নিচের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আপু আমাকে বাঁচাও। আপু ওই লোক দুজন আমাকে মেরে ফেলবে। ওই দেখো ওই কালো হুডিওয়ালা জ্যাকেট পরা লোক দুটো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি বলেছিলাম না আমাকে দুটি লোক আক্রমণ করেছিল। যারা আমার বাবাকেও মেরে ফেলেছে। দেখো তারা এখানে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য। চলো আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাই।
কথাগুলো বলে কান্না করতে লাগলো চাঁদনী। ওর এমন আচরণে আশেপাশের অনেকেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ হাসাহাসিও শুরু করেছে। সকলের কাছে মনে হচ্ছে ও যেন একটা এলিয়েন। সকলের এমন আচরণে আরো বেশি ঘাবড়ে যাচ্ছে চাঁদনী। ওকে এমন ভয় পেতে দেখে শ্রাবণী যত দ্রুত সম্ভব সেখান থেকে ওকে টান দিয়ে নিয়ে একটি নিরিবিলি জায়গায় চলে গেল। সেখানে লোকজন থাকলেও বেশ দূরত্বে আছে তারা। ওদের আশে পাশে তেমন কেউই নেই। সেখানে নিয়ে গিয়ে চাঁদনীর মুখটা নিজের দিকে তুলে বলতে শুরু করল,
— দেখো চাঁদনী তুমি এখন বাইরের জগতে আছো। ছোটবেলা থেকে ঘরের মধ্যে বড় হয়েছ বলে তোমার জীবনে অনেক কিছুই অচেনা-অজানা। তাই তুমি এতটা ঘাবড়ে যাচ্ছ। এখন তোমাকে চাকরি করতে হলে বাইরের জগত সম্পর্কে সবকিছু জানতে হবে বুঝতে হবে। প্রতিটি পদে-পদে এভাবে ভয় পেলে চলবে না। সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। ভয় কে জয় করে বাঁচতে শিখতে হবে।
এতটুকু বলে থামল শ্রাবণী। ওকে থামতে দেখে চাঁদনী কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে উঠল,
— আমি বুঝেছি আপু। কিন্তু ঐ লোক দুটো তারাই যারা আমাকে সেদিন রাতে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। এখানেও হয়তো আমার পিছে পিছে চলে এসেছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য। চলনা আমরা এখান থেকে চলে যাই। কিনতে হবে না আমার কাপড় চোপড়।
ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে লোকদুটোর সামনে নিয়ে গেল শ্রাবনী। তারপর তাদের হাতের উপর চাঁদনীর হাত রেখে বলল,
— এই দেখো এটা কোনো মানুষ নয়। এটা একটা পুতুল। তুমি হয়তো পড়ে থাকবে যে শপিংমলগুলোতে এভাবে প্লাস্টিকের পুতুল সাজিয়ে রাখা হয়। যাদেরকে অবিকল মানুষের মতো দেখতে লাগে। তাদের গায়ে নতুন নতুন পোশাক পরিয়ে মানুষের মত দাড় করিয়ে রাখা হয়। এরা হলো সেরকম পুতুল। আর এই মেয়ে দুটোও তেমন পুতুল। বুঝেছো এবার? এদের দেখে ভয় পাওয়ার কোনো কিছু নেই। নিজেকে সামলাও চাঁদনী। নিজেকে তৈরী করো ভবিষ্যতের জন্য। ভবিষ্যতে তোমার সামনে এমন হাজারো ঘটনা ঘটবে। যেগুলো তোমার কল্পনাতেও নেই। তাই নিজেকে ভয় মুক্ত করে তৈরি করতে শেখো ভবিষৎ এর জন্যে।
ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে পুতুল দুটোকে বেশ ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল চাঁদনী। তারপর তাদের স্পর্শ করে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ও বুঝতে পারল সত্যিই এগুলো কোন মানুষ বা অন্য কিছু নয়, এগুলো শুধুই একটি প্লাস্টিকের পুতুল। যেটাকে অবিকল মানুষের মতই দেখতে। এদের দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। এবার নিজেকে নিজের কাছে ভীষণ জোকার জোকার লাগতে লাগল চাঁদনীর। নিজেকে সামলে নিয়ে শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে অপরাধী গলায় বলল,
— সরি আপু আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আসলে এর আগে কখনো এমন কোন জায়গায় আসেনি তো। তাই বুঝতে পারিনি এটা পুতুল। আমার জন্য তোমাকে অনেক সাফার করতে হলো প্লিজ তুমি রাগ করোনা। আই এম রিয়েলি সরি আপু।
ওর কথার উত্তরে শ্রাবণী কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুচকি হেসে দিয়ে ওর হাত ধরে নিয়ে একটি কাপড়ের দোকানে ঢুকলো। সেখানে বেশ কয়েকটা সুন্দর থ্রিপিচ আর দুটো গাউন কিনলো চাঁদনীর জন্য। তারপর জুতার দোকান থেকে কয়েক জোড়া জুতা, আরো বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলো। শপিং মল থেকে বের হয়ে গাড়ির জন্য রাস্তার সামনে দাঁড়াতেই হঠাৎ শ্রাবণীর মনে পড়ে গেল যে, ওরা একটি শপিং ব্যাগ কাপড়ের দোকানে ভুলে ফেলে রেখে চলে এসেছে। তাই শ্রাবণী ওকে লখ্য করে বললো,
— চাঁদনী তুমি এখানে দাড়াও আমি একটু ভেতর থেকে আসছি। এখান থেকে কোথাও যাবে না চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে কেমন!
— কিন্তু তুমি এখন কোথায় যাবে আপু?
— ভুলে তোমার জন্যে কেনা গাউন এর শপিং ব্যাগটা দোকানেই ফেলে এসেছি। সেটা নিয়ে আমি এখনি আসছি তুমি এখানেই দাড়াও কোথাও যাবে না।
কথাগুলো বলে চাঁদনীকে রেখে শপিং মল এর মধ্যে চলে গেল শ্রাবণী। ওকে চলে যেতে দেখে ভীষণ অসহায় লাগছে চাঁদনীর। ও রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থেকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগল। রাস্তার অপজিটে বেশ কয়েকটা ছেলে কেমন বিচ্ছিরি ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও এর আগে কখনো রাস্তায় এভাবে বের না হওয়ায় নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। চারিদিকে এত মানুষ আর গাড়ি-ঘোড়া দেখে ভীষণ অস্বস্তি ফিল হচ্ছে ওর। সেইসাথে ঐ ছেলেগুলোর এমন বিচ্ছ্রি চাহনিতে যেন আরো বেশি বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ চাঁদনী খেয়াল করল একটি ছোট্ট ছেলে বল নিয়ে খেলতে খেলতে মায়ের সাথে শপিং মল থেকে বাইরে বের হচ্ছে। আর বলটা ছেলেটার হাত থেকে ফসকে রাস্তার মাঝখানে চলে গেছে। ছেলেটার মা তখন মোবাইলে কথা বলতে ব্যস্ত। ছেলেটা তখন সেই বলটা ধরার জন্য দৌড়ে রাস্তার মাঝখানে চলে গেছে। এদিকে চারপাশ থেকে কত শত গাড়ি এগিয়ে আসছে ছেলেটির দিকে।চাঁদনী কোন কিছু না ভেবেই ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেল। রাস্তার আশেপাশে সকল মানুষ তখন ওদের দিকেই তাকিয়ে থেকে চেঁচামেচি শুরু করেছে। চাঁদনী ছেলেটিকে গিয়ে ধরার সাথে সাথে পাশ থেকে একটি বিশাল আকারের ট্রাক একদম সোজা এসে মেরে দিল ওদের। আশেপাশের সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু একটু পর সবাই নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেননা সবার চোখের সামনে যেন একটা ম্যাজিক ঘটে গেছে। যে ম্যাজিক টা হয়তো সবার কল্পনার বাইরে ছিল। কেউই কোনো কিছু বুঝতে পারছেনা। শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদনীর দিকে। কারণ ট্রাক টা ওদের মেরে দিয়েছিল ঠিকই, তবে ওদের দুজনের কারো কিচ্ছু হয়নি। বরং ওরা রাস্তার পাশে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। এত দ্রুত রাস্তার পাশে কিভাবে আসলো কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না কারো। এমনকি চাঁদনী নিজেও জানেনা এই মুহূর্তে ওর সাথে কি ঘটল। তবে ওর যতটুকু খেয়াল হচ্ছে, ওর মনে হয়েছে কেউ একজন খুব দ্রুত কোথাও থেকে ছুটে এসে নিজের বুক দিয়ে আগলে নিয়ে ওদের দুজনকে বাঁচিয়ে রাস্তার পাশে রেখে গেছে। কিন্তু এত দ্রুত কারো আশা কি আদৌ সম্ভব?
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আগামি পর্বে হবে হিরোর এন্ট্রি। আগামি পর্ব পরশুদিন রাতে দিবো ইনশাআল্লাহ। আর যদি সময় পাই তাহলে কালকে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
গত দুদিন হল বেশ অসুস্থ। বেশিক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চোখ জ্বালা করে চোখ থেকে পানি পরে। আর সেইসাথে কয়েকদিন হলো মনটাও ভীষণ খারাপ। তাই ঠিকমত গল্প দিতে পারিনি। এই গল্পটা আবার আগামি পরশু রাতে দিবো ইনশাআল্লাহ।