ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ১৪

#ভ্রান্তির_অগোচরে
পর্ব ১৪
লেখা আশিকা জামান

পৃথিবীর সকলের ভাগ্য ঐ অদৃষ্টের হাতে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়তির কাছে কারো ছাড় নেই। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের ভুলের মাসুল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মিমকেও বইতে হবে। এটাই ওর ডেসটিনি। ব্যাগ গুছানো শেষ শুধু একটা জীনিসই নেয়া বাকী ছিল। বেড সাইড টেবিলের উপর রাখা সবুজের একটা ছবি। কিছুক্ষণ অক্ষিযুগল অশ্রু বিসর্জন এর খেলায় মেতে উঠলো। মনে হচ্ছে অক্ষিপটে এক নিপুণ প্রতিযোগিতা চলছে । কে কত দ্রুত অশ্রুবিসর্জন এর পালা শেষ করতে পারে। বাচ্চাটার কথা মাথায় আসতেই মিম নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করলো। ডিসিশন ফাইনাল ও আজকে এক্ষুনি এই রাতের আধারেই অনেক দূরে চলে যাবে। অন্তত এই বাড়ীতে আর এক মুহুর্ত ও না। মুখ ফুটেই সবসময় সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হয়না? কোন কোন সময় সবার নিশ্চুপতা, উদাসীনতা অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়।
মেঘকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা ছাড়া আরতো কিছু বলা হয়নি। ওকে এই কথাটা মুখ ফুটে বলা হয়নি ঠিকি ইঙ্গিততো সেদিকেই ধাবিত। সেদিনের পর থেকে কেউ ওর সাথে ঠিক করে কথাটাও বলেনি। যেন সমস্ত দোষ ওর। আংগুলটা ওর দিকেই উঠলো। আল্টিমেটলি সবাই মেঘকেই বিশ্বাস করলো। সবার অবিশ্বাস আর ঘৃনার পাত্রী হয়ে এই বাড়ীতে থাকা ওর কাছে নরকসম। একটা সময় ওর সন্তানের উপরো কলঙ্কের কালিমা লেপে যেতে বেশী সময় লাগবেনা। মা হিসেবে সন্তানের মঙ্গলের জন্য একটা সুন্দর পরিচ্ছন্ন পৃথিবী দেয়াটা ওর কর্তব্য। এ দায় ও এড়াতে পারেনা।
সবুজকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটা চিঠি কাপড়ের ভাজে বেশ সযত্নে রেখে দিলো মিম। হঠাৎ সবুজের দেয়া সেই আংটিতা দেখতে পেতেই বুকের ভেতরটা চিনচিনে ব্যাথায় ভরে গেলো। আংটিটা হাতে পরে মনে হতে লাগলো সবুজ ওর খুব কাছে। এতোটা ভালোবাসতে পারবে যদি ও জানতো তাহলে হয়তোবা সেদিনের সেই ভুলগুলো আর করা হতোনা। এখনই মোক্ষম সময় কেউ বাসায় নেই। মিম ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে । তবে প্রথমে রিমুর বাসায় উঠবে বলে ঠিক করে।

————————————

কারো স্পর্শে সবুজের আধাকাঁচা ঘুমটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। কচলাতে কচলাতে দুই চোখ মেলেই চমকে উঠলো। দু চোখের পাতা আবার বন্ধ করে ফেললো।
টোল পড়া গালের হি হি হাসির যন্ত্রনায় আবার চোখ মেললো ও..
” মিম!! তুমি এখানে কি করে?”

হি হি করে হাসতেই থাকলো মিম।
নাহ্ এইবার সবুজ সত্যিই বিরক্ত হচ্ছে।
” কি হলো কথা বলো?”
” তার আগে বলো, তুমি ভয় পেয়েছিলে না। ”
সবুজ সত্যই বোকা বনে গেলো। ওর বোকা বোকা মুখটা দেখে মিম আবার হৃদয়হরণ করা হাসিতে সবুজকে এক অদ্ভুত মাদকতায় ভরিয়ে দিলো।
মিম তার সাদা গাউনটা খানিকটা উপরে তোলায় নগ্ন পায়ের গোড়ালির ঐ তিলকটা ওকে গভীরতর সম্মোহনে কাছে টানতে লাগলো। সবুজ উদ্ভান্তের মতো উঠে ওর হাত ধরতে গেলেই..
মিম নিজেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে দৌড়ে পালাতে লাগলো।

” মিম, এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন? পড়ে যাবে আস্তে..
আস্তে…”

মিমের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আপনমনে দৌড়াতেই থাকলো। সবুজ ওর পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে দোতলার সিড়ি দিয়ে নিচের গার্ডেন পার হয়ে সমান্তরাল রাস্তায় এসে পৌছুলো। মিম পিছন ফিরে আবার হৃদয়হরণকারী হাসিতে মাতাল করে দিয়ে গেলো। ঘন বন- জঙ্গল পাড় হয়ে তরতরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে উঠে বিজয়ীর হাসি হাসতে লাগলো মিম।
চরম উৎকন্ঠায় সবুজের আপাদমস্তক ঘামতে লাগলো।
” মিম, নেমে এসো। পড়ে যাবা। ওখান থেকে পড়ে গেলো আমি তোমাকে কোথায় খুঁজে পাবো? নামো বলছি।”

মিমের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
সবুজ হাপাতে হাপাতে উঠে মিমকে যেই ধরতে যাবে
ওমনি মিম লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যায়। সমস্ত পাহাড় জুড়ে মিমের খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
সবুজ মিম বলে চিৎকার করে উঠে।
শরীর জোড়ে ঘামের স্রোত দরদর করে নিচের দিকে নামতে থাকে। বা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে অন্ধকার হাতড়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয়।
তার মানে ও এতোক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো। কিন্তু স্বপ্নটা এতোটাই বাস্তব যে ওর বর্তমানটাও দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে দিয়ে গেলো।
এই মুহুর্তে মিমের একটা খবর না পেলে ও অশান্তিতে মরেই যাবে। বুকের দু ইঞ্চি নিচে যেন কেউ শাবল দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে।
সবুজ মিমের নম্বর ডায়াল করলো ওটা সুইচড অফ বলছে।
বাবার নাম্বার বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর কেউ ফোনটা তুললোনা।
উফ্ দুশ্চিন্তায় নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।
ব্যালকনিতে এলোপাথাড়ি পায়চারীতে বাকী রাতটা পার করলো সবুজ।

——————
——————

” মিম, কোথায়? প্রশ্নের উত্তর দে চুপ করে আর বসে থাকিস না। সব যায়গায় খুঁজাখুঁজি শেষ। এইবার আমাকে একটু শান্তি দে। তোরা যা চাস তাই হবে।”
খালার করা প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে মেঘ অনেকটা চোরের মত মুখ করেই বসে থাকলো।
এইবার মনে হচ্ছে মুখটা খুলতেই হবে। কিন্তু কি বলবে ও। মিমটা যে এইভাবে বাড়ী ছেড়ে চলে গিয়ে ওকে ফাঁসিয়ে দিবে কে জানতো?
মিমের মতো চালচুলোহীন মেয়ে বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার দুঃসাহস কি করে দেখায়? এটা ওর মাথায় কিছুতেই আসেনা। বাবা ব্যাংকে কিছু টাকা রেখে গেছে তাই এত দুঃসাহস! ভাবা যায়। রাস্তায় কত কি হতে পারে এটা ওর জানা আছে কি? তার থেকে ওর প্রস্তাবে রাজী হলেই ওকে মেঘ বিয়ে করে নিতো। কিন্তু কালকে মিমের দেয়া থাপ্পড় ওর মাথাটা কেমন জানি বিগড়ে দেয়। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনি। কিন্তু কিছুতো একটা বলতেই হবে আর অবশ্যই নিজের সাফাই গাইতে হবে।

” কি হলো কথা বল। আর জ্বালাইস না আমাকে। আমার সহ্য ক্ষমতার একটা সীমা আছে।”

” আসলে খালা। মিমের কথা আর কি বলবো?
ও প্রচন্ড লোভী একটা মেয়ে। কিছুদিন ধরে ওর মধ্যে একটা চেঞ্জ লক্ষ্য করছিলাম। তাই সেদিন রাতে ব্যাপারখানা বোঝার জন্য বাসায় এসেছিলাম। তাও ধরা পড়ে গেলাম। এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। সত্যিটা সামনে আসার দরকার ছিলো। আমার দিক থেকে আমি পরিষ্কার ছিলাম। কিন্তু মিম ওর এখন আর আমাকে পোষাচ্ছে না। তাই অন্য নাগরের সাথে ভেগে গেছে..।”
মেঘ আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু গালের উপড় পড়া ভারী হাতের একটা থাপ্পড়ে ও স্তব্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষনের জন্যে হলেও যেন বাকশক্তি লুপ পেয়ে যায়
নিজেকে সামলে নিয়ে কোনরকমে ধরা গলায় বলে উঠে,
” আংকল, আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন?”

” হ্যা, বেশ করেছি তোকে পুলিশে দেয়া দরকার। মিমের সম্পর্কে আর একটা বাজে কথা বললে কালকে যা করে উঠতে পারিনি আজকে তাই করবো।
কি ভেবেছিস যা নয় তাই বললেই আমি তোর কথা বিশ্বাস করে নিব। তোর খালা বিশ্বাস করেছে কিনা করেছে সেটা তোর খালার ব্যাপার।
আমি তোকে বলছি তুই এক্ষন বাড়ি ছেড়েচলে যা। ভবিষ্যৎ এ বাড়ীর ত্রিসীমানা পেরুনোর আগে তিনবার ভাববি। আই সে, গেট লস্ট। জরির মা, ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দে।”
সোহেল চৌধুরী প্রচন্ড রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে কথাগুলো বলে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। প্রেশার ফল করতে শুরু করেছে।
” খালা, তুমিও আমাকে অবিশ্বাস করলে?”
মেঘ বেয়ারার মতো ওর খালার মুখের দিকে তাকায়।
” তোর কি মনে হয় আমার এখনো তোকে বিশ্বাস করা উচিৎ। ভুলটাতো আমার আমি কেন কালকে তোকে বিশ্বাস করতে গেলাম। এই ভুলের মাসুল আজকে আমার মেয়েটাকে গুনতে হচ্ছে। আমি কেন মিমকে ভুল বুঝলাম তোর মত কুলাঙ্গারের জন্য।মেয়েটাকে আমি ছোট থেকে এই হাত দিয়ে মানুষ করেছি। খুব ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিলাম এতটুকু আচ লাগতে দেইনি। আজ আমাকে এভাবে কাদিয়ে তুই অভিমান করে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে পারলিরে মা। আমি তোকে কোথায় খুঁজবো? ”
শিউলি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
সোহেল চৌধুরী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।
” তোমার সমস্যা কি? প্লিজ একদম ন্যাকা কান্না কাদবা না। আজ যা কিছু হয়েছে তার জন্যই তুমি রেস্পন্সিবল। ”
সেন্টার টেবিলের উপর ফোনটা নিয়ে বন্ধু ডি. আই. জি রকীবুল বাশার এর নম্বর বের করতে করতে ওখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
মেঘ সুযোগ পেয়ে আরেকবার খালাকে কনভেন্স করার চেষ্টা করলো।
” খালা প্লিজ তুমি আমাকে অন্তত বিশ্বাস করো।”
কান্না থামিয়ে শিউলি পায়ের থেকে জুতো খুলে মেঘের দিকে ছুড়ে মারলেন। জুতোটা মেঘের ঠিক মুখের কাছটায় গিয়ে পড়লো।
” কুলাঙার তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস ছিঃ। শাখিরতো তোকে জন্মের সময়ই নুন খাইয়ে মেরে ফেলার দরকার ছিলো। আমি তোকে ছাড়ব না। এক্ষুনি তোর মা বাবাকে বিষয়টা জানাচ্ছি। দেখ তোর কি হাল করি?”
মেঘ খালার হাতে পায়ে ধরেও বোধ হয় এ যাত্রায় পার পেলোনা।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here