মধুবালা পর্ব ১১+১২

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১১

সারারাত জ্বরে ছটফট করে শেষরাতের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে মধুর। শরীরটা এখনো বেশ দুর্বল! হাতেপায়ে জোর নেই! হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কেউ যেন সমস্ত শরীটাকে ঝাঁজরা করে দিয়েছে। তাই ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও বেশকিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলো আরমান। মধুকে চোখবুজে শুয়ে থাকতে দেখে প্রায় নিঃশব্দেই ভেতরে ঢুকে চৌকি টেনে বসলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’গায়ে জ্বর আছে এখন?’

তাঁর গলার আওয়াজ পেয়ে সচেতন হলো মধু। ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলো সে। আরমান বাধা দিয়ে বললো,’উঠার দরকার নেই। শুয়ে থাকো। শরীর দুর্বল তোমার।’ তথাপি উঠে বসলো মধু। আধশোয়া হয়ে গায়ের ওপর কাঁথা মেলে দিয়ে বললো,’তুমি বেরোও নি এখনো?’

-‘এইতো বেরোবো। তোমাকে দেখতে এলাম।’

-‘আমি ভালো আছি। খাওয়াদাওয়া হয়েছে তোমার?’

আরমান হাসলো। অসুস্থ অবস্থায়ও মধুর তাঁর খাবারে কথা ভোলে নি ভেবে মনে মনে বেশ খুশিই হলো সে। আজকে এমনিতেও তাঁর খুশির দিন! সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই একটা ভালো খবর পেয়েছে সে! খবরটা আপাতত মধুকে দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই! তাই মুখের ভাবখানা নিতান্তই নিরস, নিরাসক্ত বানিয়ে নিরুৎসাহি গলায় বললো,’আমার খাবার দাবার নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমাকে খাবার দেবার লোকের অভাব নেই। তুমি নিজের কথা ভাবো। এভাবে বিছানায় পড়ে থাকলে চলবে না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। তুমি তো জানো, তোমাকে এভাবে দেখলে বড় কষ্ট হয় আমার। কাজে মন দিতে পারি না।’

জবাব দিলো না মধু। ডানহাতখানা ভাঁজ করে কপালের ওপর দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলো সে। গতকাল আশরাফির সাথে খারাপ ব্যবহার করার পর থেকেই মনটা কু ডাকছে তাঁর! খচখচ করছে!চিন্তায় সারারাত একফোঁটাও ঘুম হয় নি! সেই কথা মনে পড়তেই চোখে পানি চলে এলো। পাছে আরমান দেখে ফেলে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে ফেললো। আরমান উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি তাহলে আসি?’

-‘এসো।’

-‘ওষুধপত্র কিছু লাগবে?’

-‘না।’, সংক্ষেপে জবাব দিলো মধু।আরমানও আর বিরক্ত করলো না। পীড়িত মধুকে রেস্ট নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো সে।

আরমান বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই বিছানা ছেড়ে উঠলো মধু। বহুকষ্টে শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে স্নানের ঘরে ঢুকলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই নিচতলা থেকে তেরো, চৌদ্দ বছর বয়সী একটা মেয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’খবর শুনেছো মধু মা?’

গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতেই বেশ হেঁয়ালি করে জবাব দিলো মধু,’না তো। কেন কি হয়েছে?’

মধুর মুখ থেকে প্রশ্নের শোনার অপেক্ষাতেই ছিলো যেন মেয়েটা। প্রশ্ন শুনে আর একমুহূর্তও দেরী করলো না। হড়বড়িয়ে বলতে শুরু করলো,’ঐ যে তোমাকে যিনি ফোন করতো সেই আংকেলটা…’

মধু তখনো মেয়েটার কথার সূত্র ধরতে পারে নি। অভ্যাসবশতই জিজ্ঞেস করল,’হ্যাঁ! কি হয়েছে ঐ আংকেলটার?’

-‘গতকাল রাতে অ্যাক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। আমি মাকে বলতে শুনেছি আর বোধহয় বাঁচবে না! হুজুর(আরমান) বারণ করে দিয়েছে তোমাকে বলার জন্য। কিন্তু আমি শুনে ফেলেছি।’

মেয়েটার পরের কথাগুলো ঠিকমত কানে গেলো না মধুর! আশরাফির অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনেই আকস্মিক পাণ্ডুবর্ণ, ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য হয়ে গেলো তাঁর রোগামুখখানা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। থর-থর করে সমস্ত শরীরে কাঁপনি দিয়ে উঠলো ! চোখমুখ অন্ধকার দেখলো সে! নির্বাক, নিস্তব্ধ চোখে ফ্যালফ্যাল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকাই মূর্ছা গেলো সে। মেয়েটা ‘মধুমা’ বলে চিৎকার দিয়ে ধরে ফেললো। তাঁর একহারা শরীরে মধুর ভার ঠেকানো গেলো না। ফলাফলস্বরূপ মধুকে নিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো সে!


ব্রোথেলেরই একটা মেয়ের বুকে মাথা রেখে দিশেহারা, উন্মাদের মত কাঁদছে মধু। আত্মগ্লানিতে নিজের ভেতরের ‘মেহেরটা’ সাপের মত দংশন করছে তাঁকে। তার ওপর জেদ করেই এই অঘটন ঘটিয়েছে আশরাফি! তাঁকে এত কষ্ট দেওয়া মোটেই উচিৎ হয় নি মধুর! তাঁর বোঝা উচিৎ ছিলো সেও একটা মানুষ! ধৈর্যের একটা সীমা আছে তাঁর! অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মধু! এসব কথা মনে পড়তেই পাগলের মত নিজেকে আঘাত করা শুরু করলো মধু! আশেপাশে মেয়েরা সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করলো তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে। কিন্তু কোনভাবেই শান্ত করা গেলো না মধুকে। বেশ অবাক হলো সবাই! কারণ ইতোপূর্বে মধুমাকে মানসিক ভাবে এতটা ভেঙ্গে পড়তে দেখে নি তাঁরা। নিজের স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে পাগলের মত বিলাপ করছেন মানুষটা। তাঁর কান্না দেখে সবারই চোখে পানি চলে এলো।

অনকক্ষণ যাবত মধুর ফোন থেকে সোহাগের নাম্বারে ডায়াল করা হচ্ছে। কিন্তু রিসিভ করছে না কেউ। ভয়ে আতংকে মধুর চিৎকার আরো বেড়ে গেলো। উন্মাদের মত, গায়ে মাথায় বুকে চাপড় মেরে বললো,’সব দোষ আমার। আমি একটা ডাইনী! আমার জন্যেই সব হয়েছে!’

দুইতিনজন মিলে হাত চেপে ধরলো মধুর। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’কিচ্ছু হয় নি মধুমা। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মধুর ক্লান্ত, অশ্রুসিক্ত ক্রন্দনে ভেঙে পড়লো! ভগ্ন কণ্ঠে বললো,’খোদা কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করতে চাইছেন বলতো? আমার দোষের সাজা কেন তিনি আরেকজনের মাথায় চাপিয়ে দিলেন?’ আমাকে কেন চোখে পড়লো না তাঁর?’ বোধকরি এই স্বীকারোক্তির পরে মধুর কষ্টের বর্ণণা দেওয়ার আর কোন প্রয়োজন নেই। আশরাফি যে তাঁর কতটা আপনার সেসব বর্ণণা দেওয়াও নিতান্তই অমূলক!


হস্পিটালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে অচেতন হয়ে পড়ে আছে আশরাফি। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো! মাথায়, হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ! ভোররাত থেকেই অর্থোপেডিক বিভাগে প্রায় চারঘণ্টা যাবত সার্জারি হয়েছে তাঁর। ডান পা, বাম হাত সহ মাথাসহ বেশ কিছু জায়গায় আঘাতটা বেশ গুরুতরই ছিলো! রক্ত দিতে হয়েছে দুই ব্যাগ। অপারেশন শেষ করে সাথে সাথেই আইসিউতে শিফট করা হয়েছে।

এদিকে ভোর চারটা থেকেই ইমার্জেন্সির বাইরে দাঁড়িয়ে আশরাফি জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে সোহাগ এবং নাঈম। হস্পিটাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অ্যাক্সিডেন্টের খবর শোনার পর হুঁশ ছিলো না দুজনের কারোরই। মাঝরাতে কাঁচা ঘুম থেকে উঠে কিসের ওপর দিয়ে ছুটে এসেছে নিজেরাও জানে না তাঁরা! পরনের পোশাকটাও চেইঞ্জ করার সময় নেয় নি। আধঘন্টার ভেতরে হস্পিটালে এসে হাজির হয়েছে! সেই থেকে এই অবধি এখনো হস্পিটালেই আছে!

সকাল আটটার দিকে নার্স এসে জানালো চব্বিশ ঘণ্টার ডেডলাইন দিয়েছে ডাক্তার! এর ভেতরে জ্ঞান না ফিরলে রিস্ক আছে। কথাটা শোনার পর দুই বন্ধুর কেউ মিনিটখানেকের জন্য কোন কথা বলতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল করে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো শুধু।
রাগে দুঃখে নাঈম দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’সব দোষ ঐ মেয়েটার। ঐ মেয়েটার জন্যই রাফির এই অবস্থা! ওকে সামনে পেলে খুন করবো আমি!’ কথা শেষ করে নিজের হাতের মুঠোয় সজোরে ঘুষি মারল সে।

সোহাগ জবাব দিলো না। মলিনমুখে চুপচাপ বসে রইলো। এইমুহূর্তে তাঁর যাবতীয় চিন্তা কেবল তাঁর অসুস্থ বন্ধুটিকে নিয়ে। মধু কি করেছে না করেছে সেসব পরে দেখা যাবে!
কিন্তু আশরাফি! আশরাফির যদি সত্যিই কোন ক্ষতি হয়ে যায়! আর ভাবতে পারলো না সে। বন্ধুপ্রীতিতে চোখজোড়া ছলছল হয়ে উঠলো তাঁর স্বভাবের দিক থেকে তাঁর এই বন্ধুটা কিছুটা রাগী হলেও ভেতরটা কিন্তু খুবই নরম! স্বচ্ছ জলের মত পরিষ্কার তাঁর মন! কখনো কারো খারাপ চায় নি! বারবার নিজে ঠকেছে কিন্তু একবারের জন্যেও নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ঠকানোর কথা ভাবে নি। অথচ সৃষ্টিকর্তা তাঁর কপালেই কিনা রাজ্যের সমস্ত দুঃখ দিয়ে ভরিয়ে দিলেন! টলমল করতে থাকা চোখের পানি নিয়ে আইসিউর ভেতরের অচেতন মানুষটার দিকে চাইলো সে!

এদিকে নাঈম বিবর্ণ মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। স্বভাবের দিকে থেকে যদিও খানিকটা শক্ত ধাঁচের যে কিন্তু আজকে উত্তেজনা চেপে রাখতে পারলো না! উপরন্তু সোহাগের কান্নারত মুখ দেখে আরো ভড়কে গেলো। আতংকিত কন্ঠে ধমক দিয়ে বললো,’কাঁদবি না খবরদার। কথায় কথায় মেয়েমানুষের মত কান্না কিসের? ও কি মরে গেছে নাকি? মোছ চোখের পানি! কিচ্ছু হবে না রাফির।’
প্রতিবাদ করলো না সোহগা। নিরবে চোখের পানি মুছে নিলো সে। পকেট থেকে ফোন বের করলো সময় দেখার জন্য। সুইচ অন করতেই দেখলো স্ক্রিনে চুয়ান্নটা মিসড কল ভেসে উঠেছে। তাও আবার একটা আননোন নাম্বার থেকে! যারপরনাই অবাক হলো সোহাগ! এত সকালে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কে ফোন করবে তাঁকে? সময় নষ্ট না করে নিজেই কল ব্যাক করলো সে!

সোহাগ হ্যালো বলতেই বাঁধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মধু। হাজার চেষ্টা করেও সবেগে বেরিয়ে আসা কান্না চেপে রাখতে পারলো না সে! এদিকে তাঁর ক্রন্দনরত মেয়েলি কন্ঠস্বরটা ঠিক চিনে উঠতে পারে নি সোহাগ। সে পূর্বের ‘হ্যালো, হ্যালো’ করে গেলো। মধু কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে বললো,’আপনার বন্ধু এখন কেমন আছে ভাইয়া?’

এতক্ষণে মধুকে চিনতে পারলো সোহাগ। নিমিষেই মুখ কালো করে ফেললো সে। তাঁর বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে নাঈম ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে?’

সোহাগ নিঃশব্দে মুখভঙ্গি করে বোঝালো মধু ফোন করেছে। তার নাম শুনতেই ফের খেপে গেলো নাঈম। সোহাগের কাছ থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে বললো,’তোমার সাহস তো কম নয়! এতকিছুর পরেও তুমি আবার ফোন করেছো! অসভ্য, নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে! তোমার নামে থানায় মামলা করবো আমি!

অপ্রত্যাশিত আক্রোমণে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো মধু! গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ তাঁর ব্যথায় পুনরায় আঘাত করলো নাঈম। তথাপি গায়ে মাখলো না সে! কান্নারত করুণ গলায় বললো,’আমি সব দোষ স্বীকার করছি ভাইয়া। আমার জন্যই আপনার বন্ধুর এই অবস্থা। আপনাদের যত ইচ্ছে আমাকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু আগে আমাকে হসপিটালের ঠিকানাটা দিন। আপনার বন্ধু সুস্থ হলে এসব নিয়ে কথা বলার অনেক সুযোগ পাবেন। কিন্তু এখন নয়! এখন আগে আপনার বন্ধুর সুস্থ হওয়াটা জরুরি।’

-‘সেই বিষয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না! তুমি নিজের চরকায় তেল দাও!’

মধুর অসহায়, নিঃসম্বল ভিখিরির মত করুণ আকুতি জানিয়ে বললো,’আমি আপনার পায়ে পড়ছি ভাইয়া।।’

-‘যত যাই করো না কেন হস্পিটালের ঠিকানা আমি তোমাকে দেবো না। তোমার এসব নাটকে আশরাফিকে বোকা বানাতে পারলেও আমাকে পারবে না। কারণ, অনেক আগেই তোমার সত্যিকারের রূপটা চিনে গেছি আমি। সুতরাং আমার সঙ্গে সব নাটক করে লাভ নেই!’

মধুর আকুতি,মিনতি, করুণ আহাজারি কোন কিছুতেই কোন কাজ হলো না। উল্টে নাঈমের একের ওপর এক অপামানে জর্জরিত তার ভেতরটাকে। বারবার করে অনুনয় বিনয় করার পরেও কিছুতেই মধুকে হাসপাতালের ঠিকানা দিতে রাজী হলো না নাঈম!
বাধ্য হয়ে অন্য পস্থা অবলম্বন করলো মধু! চোখ মুছে গম্ভীর গলায় বললো,’ভালোয় ভালোয় বলছি হস্পিটালের ঠিকানাটা দেবেন কি না?’

-‘না দেবো না। কি করবে তুমি?’

-‘ঠিকানাতো আমি জোগাড় করেই ছাড়বো! যেভাবেই হোক! কিন্তু আমার শুধু একটা কথা জানতে ইচ্ছ্র করছে আপনাদের বন্ধু অ্যাক্সিডেন্ট করে হাসপাতালাতে ভর্তি হওয়ার পরেও আপনারা আমাকে তাঁর কাছে যেতে দেন নি এটা জানার পর আপনাদের সাথে তাঁর সম্পর্কটা ভালো থাকবে তো? ভেবে বলছেন?’

-‘মানে?’

প্রথমে জবাব দিলো না মধু। তার ধারণা প্রশ্নটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে নাঈম। না বোঝার ভান করছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পুনরায় গম্ভীর, থমথমে গলায় বললো,’মানে কিছুই না। আমার যেটুকু বলার ছিলো আমি বলে দিয়েছি। বাকি আপনাদের মর্জি!

নাঈম মধুর কথার পুনরাবৃত্তি করে বললো,’কি বলতে চাইছো তুমি? তোমার জন্য রাফি আমাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে?’

-‘সেটা আপনিই ভালো জানেন। আপনাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝখানে আমি ঢুকতে চাইছি না। কিন্তু আমার ধারণা আপনি খুব ভালো করেই চেনেন আপনার বন্ধুকে। সেই হিসেবে আপনার বন্ধু আমার জন্য কি করতে পারে, কতদূর যেতে পারে সেটাও আপনার অজানা থাকার কথা নয়? তবু কথাগুলো আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলাম আপনাকে।’

মধুর কথাগুলো একবর্ণও মিথ্যে নয়! বাস্তবিকই আশরাফিকে ভালো করে চেনে তাঁর বন্ধুরা। এবং এ-ও জানে এতকিছুর পরেএ এই মেয়ে যা বলবে তাই মুখ বুঝে মেনে নেবে আশরাফি! সত্যিমিথ্যা কোনকিছু যাচাইয়ের প্রয়োজন মনে করবে না।
হুমকিতে কাজে হলো। নরম হয়ে এলো নাঈমের গলা। এই মেয়ের বিশ্বাস নেই! আশরাফির কানে সত্যিমিথ্যা কি প্যাচ লাগাবে কে জানে? শেষে বন্ধুর ভালো করতে গিয়ে উলটে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে হতাশ কন্ঠে বললো,’ঠিক আছে। হস্পিটালের ঠিকানা মেসেজ করছি তোমাকে। তবে এখানে এসে কোনরকম ঝামেলা করলে কিন্তু খবর আছে!’

এতসহজে নাঈম রাজি হয়ে যাবে মধু ভাবতে পারে নি। কান্নার মাঝেও মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর! নাইমের কথার জবাবে বাধা দিয়ে বললো,’মেসেজ করার দরকার নেই। আপনি মুখে বললেই হবে। আমি লিখে নিতে পারবো।’

অগত্যা বাধ্য হয়েই মধুকে ঠিকানাটা দিতে হলো নাঈমের। মনে মনে আশরাফির ওপর খুব বিরক্ত হলো সে! তাঁর মূর্খামির জন্য মাথায় উঠেছে এই মেয়েটা!
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২

বৃদ্ধ দারোয়ান আনিসুলের হাতে পায়ে ধরে অনেক কষ্টে তাঁকে রাজি করিয়েছে মধু। কিন্তু সমস্যা হলো আনিসুল শর্ত দিয়েছে দুঘণ্টার ভেতরে ফিরতে হবে। কারণ আরমান যদি কোনভাবে জানতে পারে মধু তাকে না জানিয়ে আশরাফিকে দেখতে গেছে ভয়ানক খেপে যাবে সে। তাছাড়া এখানকার কোন মেয়েরই আরমানের অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। সেই ভয়ে আনিসুল প্র‍থমে যেতে দিতে রাজি হচ্ছিলো না মধুকে। কিন্তু অনেকদিন যাবত মধুর সঙ্গে চেনাজানা আছে তাই শেষমেশ একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাজি হতে হলো তাঁকে। মধুও অনুনয় বিনয়ের আর কোন কসুর রাখে নি!

আনিসুল রাজি হওয়ার ওপর আর একমুহূর্তও দেরী করলো না মধু। আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢেকে সঙ্গে সঙ্গেই হস্পিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো সে। যাওয়ার সময় আনিসুলকে বুদ্ধি দিয়ে গেলো যদি কোনভাবে তাঁর ফেরার আগে আরমান চলে আসে তবে আনিসুল যেন অবশ্যই একটা ফোন করে খবর দেয় মধুকে। আনিসুলও মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।


হস্পিটালে যেতে যেতেই প্রায় একঘণ্টার মত লেগে গেলো মধুর। এমনিতেই জ্বরে কাহিল দুর্বল শরীর তাঁর। তারওপর লাগাতর ক্রন্দনে শরীরের সব শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। চোখ কোটরে নেমে গেছে। হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে মনে হলো এক্ষুনি বুঝি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে সে। বহু কষ্টে একটা একটা করে মোট চারতলার সিঁড়িগুলো সব পার করলো। শরীরের কোন বাঁধাই মানলো না।
হাঁপাতে হাঁপাতে ইমার্জেন্সির দিকে এগোতেই দেখলো সোহাগ এবং নাঈম দুজনেই বাইরে বসে অপেক্ষা করছে।কাছে গিয়ে বোরখার নেকাব তুলে দিলো মধু। সারা গা ঘামে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেছে তাঁর। বেশকয়েকবার জোরে জোরে দম নিয়ে সোহাগকে উদ্দেশ্য করে রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে মুখে বললো,’এখনো জ্ঞান ফেরেনি?’

সোহাগ হতবাক চোখে চেয়ে রইলো মধুর বিধ্বস্ত মুখখানার দিকে। একি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার? ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য, চোখের নিচে কালি, শীর্ণ দেহ! সবমিলিয়ে অনেক বেশি রোগা আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে মধুকে। প্রথম দিনের মধু আর এই মধুর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। একদম আলাদা! চেয়ার ছেড়ে উঠে মধুকে বসার জায়গা করে দিলো সে। মধুর কথার জবাবে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,’পানি খাবে?’

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো মধু। শ্বাসকষ্টের রোগীর মত থেমে থেমে শ্বাস নিয়ে বললো,’ডাক্তার কি বলেছে?’

-‘জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।চব্বিশঘণ্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে।’

আপনাআপনি গড়িয়ে পড়লো মধুর চোখের পানি। সেটা লুকানোর জন্যই মাথা নিচু করে ফেললো সে। চেয়ারের হাতল চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতকিছুর পরে কি আর অশ্রু বাঁধ মানে? সুযোগ পেয়ে হতভাগা অশ্রু যেন দুচোখের নদীতে ভরাডুবি লাগিয়ে দিলো! কান্নার দমকে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠলো মধুর রোগা ছিপছিপে ক্লান্ত দেহখানা!

অদূরে দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনাই পর্যবেক্ষণ করছিলো নাঈম। যদিও মধু এলেই তাঁকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো কিন্তু অসহায়, বিধ্বস্ত মধুর কান্নারত করুণ মুখখানা দেখে তার ভেতরে মনুষত্ববোধ কিছুতেই নিজেকে সায় দিলো না মধুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য। সোহাগের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে।

চোখ মুছে ক্ষীণ পায়ে ইমার্জেন্সির বাইরে ছোট কাচের জানালার দিকে এগিয়ে গেলো মধু। সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসছে তাঁর! হাতে পায়ে জোর নেই! বহু কষ্টে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলো সে! অনুতপ্ত চোখে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখলো বেডের ওপর অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে আশরাফির নিথর দেহখানা। বুকের ওপর অসংখ্য যন্ত্র বসানো। হাতে ক্যানুলা ফিট করা। কান্নায় মধুর সারা শরীর ভেঙ্গে আসতে চাইলো মধুর। অসহায় চাতকের মত দেওয়াল ধরে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। সমস্ত দায়ভার আপন মাথায় তুলে নিয়ে শতকোটিবার অভিসম্পাত করলো নিজেকে। অসংখ্যবার মৃত্যু কামনা করলো নিজের। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,’কেন তুমি আমাকে মেরে ফেললে না। কেন নিজের এত বড় সর্বনাশ করলে? কত দুঃখে যে তোমাকে ছেড়েছি কেন তুমি সেই কথাটা একবারও বোঝার চেষ্টা করলে না?..কেন?’ দূরে দাঁড়ানো সোহাগ এবং নাঈম চকিত চোখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কান্না দেখে গেলো কেবল!


ঘণ্টাখানেক বাদে ইমার্জেন্সি থেকে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলেন মাঝবয়সী একজন ডিউটি ডাক্তার। মধু, সোহাগ, নাঈম তিনজনেই ছুটে গেলো তাঁর দিকে। অভিজ্ঞ ডাক্তার সপ্রতিভ হেসে বললেন,’আপনাদের রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। হি ইজ নাউ অ্যাবসলিউটলি আউট অফ ডেইঞ্জার। আর কোন ভয় নেই! আমরা খুব শীঘ্রই উনাকে কেবিনে শিফট করার ব্যবস্থা করছি।’

সস্তির নিশ্বাস ফেললো একসঙ্গে উন্মুখ হয়ে থাকা তিনটে মুখ। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো তিনজনেই।

সোহাগ উৎসাহিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’আমরা কি একটু দেখা করতে পারি ওর সঙ্গে?’

-‘জি অবশ্যই পারবেন। কিন্তু এখন না। আগে পেশেন্টিকে কেবিনে শিফট করা হোক। তারপর আপনারা সবাই দেখা করতে পারবেন।’, কথা শেষ করে প্রস্থান করলেন ডাক্তার।


ইমার্জেন্সির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো সবাই। স্ট্রেচারে করে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আশরাফিকে। এনেস্থিসিয়ার প্রভাবে তখনো ঘুমাচ্ছে সে। ঘুমের জন্য চোখ খুলতে পারছিলো না।

সবার প্রথমে দেখা করলো নাঈম। মধুকে সবার আগে ঢুকতে দিতে রাজি হলো না সে। কি জানি আশরাফি কেমন রিয়েক্ট করে! তাই সবার প্রথমে সেই গেলো। মধুর মুখটা মলিন হয়ে গেলো! ফ্যালফ্যাল করে নাঈমের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। এবং স্পষ্ট বুঝতে পারলো সুস্থ আশরাফির ওপর সমস্ত অধিকার তাঁর থাকলেও এই অসুস্থ আশরাফিটার ওপর তাঁর বন্ধুদের অধিকারই বেশি।চোখভর্তি পানি নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে।

নাঈম ভেতরে যাওয়ার পর এক ফাঁকে দারোয়ানের নাম্বারে ফোন করে নিলো মধু। উদ্দেশ্য আরমান ফিরেছে কিনা সেই খবর জানা। কিন্তু ভাগ্য ভালো তাঁর। আরমান এখনো ফেরে নি। দুপুরের আগে ফেরার আর কোন সম্ভাবনা নেই তাঁর। দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো মধু। আরমান যদি একবার জানতে পারে তাহলে দারোয়ানের তো খবর আছেই সেই সাথে ওখানকার বাকি মেয়েগুলো বিপদে পড়তে পারে।

নাঈম বেরিয়ে আসার পর ভেতরে ঢুকলো সোহাগ। অস্থির লাগছিলো মধু! ক্রমেই ভেতরে ঢোকার ছটফটানি বেড়ে গেলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না! অসহায় চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি সে! নাঈমের কথা অনুযায়ী সোহাগ বেরোলে তারপর ভেতরে যেতে দেওয়া হবে তাঁকে। ডাক্তারের নিষেধ আছে একসঙ্গে বেশি লোক ভেতরে যাওয়া যাবে না। যাই যতক্ষণ না সোহাগ বেরোয় ততক্ষন বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে মধুকে।

সোহাগ ভেতরে ঢুকে দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দিলো। হাতে পায়ে প্লাস্টার করা আশরাফির।গলায় কলার কাপ বাধা। ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না সে। একটুখানি সজাগ হয়ে ফের চোখ বন্ধ করে ফেলছে। সোহাগ বেশকিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে শেষে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’আর কত ঘুমাবি? এবার ওঠ। মেহের এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য।’

কথাগুলো অস্পষ্ট শোনানো আশরাফির কানে। তথাপি মেহেরের নামটা কানে যেতেই জোরপূর্বক সচেতন হওয়ার চেষ্টা করলো সে। বহুকষ্টে একবার চোখ মেলে আবার বন্ধ করে ফেললো। সোহাগ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আশরাফিকে সত্যিই অবাক লাগে তাঁর! কি করে কেউ কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে?
বাইরে মধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন সোহাগ বেরোবে আর কখন ভেতরে ঢুলতে পারবে সে। সেই কথা মনে পড়তেই ঘুমন্ত বন্ধুর মুখের দিকে আরেকবার ভালো করে চেয়ে উঠে দাঁড়ালো সোহাগ।

দরজায় বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো মধু। সোহাগ বেরোতেই কালক্ষেপণ না করে দ্রুত ঢুকে পড়লো। পাছে নাঈম ভেতরে ঢুকতে বারণ করে দেয় তাই এই তাড়াহুড়ো! সোহাগ চট করে একবার নাঈমের মুখের দিকে চাইলো। নাঈম হাড়ির মত মুখ করে বসে আছে। মধুর চরিত্রটা বুঝে উঠতে পারছে না সে। মেয়েটার মুখ দিকে তাকালে কিছুতেই বিশ্বাস করতে মন চায় না এই মেয়েটাই এত কষ্ট দিয়েছে আশরাফিকে। সোহাগ বন্ধুর চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো!

ভীরু পায়ে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকলো মধু। ভেতরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে আশরাফি! মধু বেডের কাছে গিয়ে অনিমেষ চোখে চেয়ে রইলো তন্দ্রাচ্ছন্ন, রুগ্ন মানুষটার নিষ্পাপ মুখের দিকে। বিরূপ পৃথিবীর নিষ্ঠুর জ্বালাযন্ত্রণা সইতে না পেরে জাগতিক সমস্ত কিছুর দায়ভার থেকে বিমুখ হয়ে যেন একান্ত অভিমানে গাল ফুলিয়ে রেখেছে মানুষটা!
নাহ! এসব মধুর কল্পনাপ্রসূত চিন্তাভাবনা! নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আশরাফি! তেমনি শান্ত, স্নিগ্ধ,স্থির, কোমল মুখ। নিঃশব্দে তাঁর পাশে চেয়ার টেনে বসলো মধু।
নিজের ক্লান্ত মাথাটা আলতো করে আশরাফির বুকে এলিয়ে দিয়ে অসহায়ের মত ফুঁপিয়ে উঠলো সে। এই পৃথিবীকে আশরাফি ছাড়া তাঁকে বোঝার মত কেউ নেই! সবাই তাঁকে ঘৃণা করে! সবাই স্বার্থপর ভাবে! কিন্তু এই মানুষটাই মধুর সম্পূর্ণ নিজের! হাজার অভিমানেও কখনো মুখ ফিরিয়ে নেয় নি মধুর দিক থেকে! দুহাত ভরে ভালোবাসা বিলিয়ে গেছে মধুর প্রতি!
সে চলে গেলে কার কাছে নিজের যন্ত্রণার নিরাময় খুঁজবে মধু? দিনের পর দিন যেই অসহ্য অন্তরযন্ত্রণা সে ভোগ করে চলেছে কে দেবে তাঁকে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি?
নিঃস্ব, সহায়সম্বলহীনের মত একটু আশ্রয় পাওয়ার আশায় শক্ত করে আশরাফিকে আঁকড়ে ধরলো সে। আশরাফির পরনের হস্পিটালের দেওয়া ঢোলা টি-শার্টটা দুহাতে খামচে ধরে অশ্রুসিক্ত, অভিমানী কণ্ঠে বললো,’কেন তুমি আমার এত বড় সর্বনাশ করতে গিয়েছিলে? কেন তুমি নিজের ক্ষতি করার আগে একবারও আমার কথাটা ভাবলে না? তোমার কিছু হলে আমার কি হতো?’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে। বেশ কিছুক্ষন এভাবেই পড়ে থেকে অশ্রু বিসর্জন করলো।

আশরাফি তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে বলতেই পারবে না এতকালযাবত যেই ছলানাময়ী, কঠিনহৃদয়া নারীকে সে মনেপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে এসেছে সেই দুঃখিনী, সমাজ পরিত্যক্তা, সর্বশান্ত রমনী আজও তাঁরই আছে! আজও তাঁর জন্যই সমস্ত ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে, সবার সমস্ত অপমান মুখ বুঝে সহ্য করে দিশেহারা, উন্মাদের মত বুকভর্তি ভালোবাসা নিয়ে হস্পিটালে ছুটে এসেছে! শুধুমাত্র তাঁর জন্যই সমস্ত রজনী নির্ঘুম কাটিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।
আফসোস আকাঙ্ক্ষিত এই সত্যটা জানার সৌভাগ্য হলো না আশরাফির। এতসুখ তাঁর কপালে নেই বলেই বোধহয় জানার সুযোগ হলো না তাঁর! নতুবা মধুর বাঁধভাঙ্গা ক্রন্দনের পরেও কি করে সে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকতে পারে?

আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না! ঘড়িতে অলরেডি দেড়টা বেজে গেছে! চোখ মুছে উঠে দাড়ালো মধু! শেষবারের ওপর প্রাণভরে একবার দেখে নিয়ে ব্যান্ডেজের ওপর দিয়েই আশরাফির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে ফের চোখের পানি বিসর্জন করলো নিরবে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো সে।
.
.
.
চলবে
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here