#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৯
ফরেইনারদের সাথে মিটিংটা একদম মনমতো হয়েছে আশরাফিদের। মধুকে ঠিক যেভাবে বলেছিলো ঠিক সেইভাবেই মেয়েগুলোকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সে। কোনরকম গরমিল হয় নি। পার্টির সাথে ডিলও ফাইনাল। মিটিং শেষ হতেই তিনবন্ধ কোলাকুলি করলো একে অপরের সাথে। এই মিটিংটা তাদের কম্পানীর জন্য সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এখন আর কোন চিন্তা নেই। এবার নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে।
বকেয়া টাকার জন্য মিটিং রুমের বাইরে বসে ছিলো আরমান। সোহাগকে দিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দিলো আশরাফি। টাকা পেয়ে খুশিতে চোখমুখ চকচক করে উঠলো আরমানের। আর একমুহূর্তও দেরী করলো না সে। সঙ্গেই সঙ্গেই বিদায় জানিয়ে মেয়েগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।সেদিকে একবার তাকিয়ে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো আশরাফি। অথচ বাস্তবিক যাকে ঘৃণা করার কথা তাঁকে একফোঁটা ঘৃণা করতে পারলো না সে। উল্টো তাঁকে না পাওয়ার যন্ত্রনায় বোকার মত আরমানের সঙ্গে নিজের তুলনা খুঁজে বেড়ালো। বস্তুত মেহের কেন এমন নীচ, জঘন্য, নারী লোভী একটা জানোয়ারের সঙ্গে নিজেকে জড়ালো বুঝতে পারছিলো না সে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের চেয়ারে দুম ধরে বসে রইলো আশরাফি। সোহাগ এবং নাঈম দুজনেই বেশ অবাক হলো। এতবড় একটা খুশির খবরের তিনবন্ধু মিলে সেলিব্রেট করবে ভেবেছিলো তাঁরা। কিন্তু আশরাফিকে দেখে মনে হচ্ছে সেই আশা বৃথা। সোহাগ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি হয়েছে?’
জবাব দিলো না আশরাফি। না-সূচক মাথা দোলালো দুদিকে। নাঈম বিরক্ত কন্ঠে বললো,’আবার ঐ মেয়েটার কথা ভাবছিস তুই তাইনা?’
সোহাগের যদিও মেহেরের প্রতি যৎসামান্য সফট কর্ণার ছিলো কিন্তু নাঈম বরাবরই সহ্য করতে পারে না মেহেরকে। তাঁর ধারণা, শুধুমাত্র মেহেরের জন্যই তাঁর প্রাণ প্রিয় বন্ধুর এই দুর্গতি। অসভ্য মেয়েটা ভালোবাসার অভিনয় করে তাঁর বন্ধুকে ফাঁসিয়ে শেষমেশ বাপের কথায় নাচতে নাচতে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে নিলো! বিয়ে করেছে ভালো কথা! তাও শান্তি নেই। এখন আবার আশরাফিকে বাগে আনার জন্য নতুন গল্প ফেঁদেছে। যে যাই বলুক না কেন নাঈম ভালো করেই জানে মেয়েটা মেহেরের মত মেয়েরা কতটা লোভী, স্বার্থ হতে পারে। টাকাই এদের কাছে সব। নতুবা কোনো মেয়েই নিজের ইচ্ছেতে প্রস্টিটিউশন এর মত জঘন্য একটা কাজে নিজেকে জড়াবে না। যদি কেউ দুর্ভাগ্যক্রমে জড়িয়ে যায় সেটা আবার বুক ফুলিয়ে কারো সামনে বলার মত সাহস অন্তত কোন মেয়ের হবে না। কিন্তু মেহের তো দিব্যি বলে বেড়াচ্ছে সে নিজের ইচ্ছেতে আরমানকে বিয়ে করেছে। স্বেচ্ছায় এই পেশায় নেমেছে। এর পরেও কি করে আশরাফির রুচি হয় ঐ মেয়ের কাছে যেতে সেটাই বুঝতে পারে না নাঈম। অন্যকেউ হলে আরো আগেই ঐ মেয়ের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিতো। কিন্তু আফসোস হাজার চেষ্টা করেও কথাগুলো আশরাফিকে ফেরাতে পারে নি নাঈম। ঘুরেফিরে ঐ মেয়েটার পিছনেই পড়ে আছে সে। কি যে পেয়েছে ঐ মেয়েটার মাঝে আল্লাহই জানে।
আশরাফি নিরবে একবার নাঈমের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকটা নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত করেই বললো,’না রে। ওর কথা এখন আর ভাবি না আমি।’
-‘তাই নাকি?’ তিরস্কারসূচক চাহনী নাঈমের।
-‘হ্যাঁ। ভেবে লাভ কি বল? ও তো ভালোই আছে। বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। আরমান নাকি ভালোবাসা দিয়ে একেবারে ভরিয়ে দিয়ে রেখেছে ওকে। দিনরাত আমাকে সেই কথাই শুনাচ্ছে। তাই আমি ঠিক করে এখন ওর কথা আর ভাববো না।’ কথাগুলো বলার সময় অনেক বেশি মলিন শোনালো আশরাফির কণ্ঠস্বর। তার এই না-এর মাঝে কতটা হ্যাঁ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে নাঈম কিংবা সোহাগ দুজনের কারোরই তেমন কোন অসুবিধে হলো না। আশরাফির মনটা যে এখনো মেহেরেই আটকে আছে বেশ বুঝতে পারলো দুজনে। নিরবে একে অপরের মুখের দিকে চাইলো দুইবন্ধু। নাঈম অত্যাধিক নরম গলায় বললো,’একদম ঠিক ভেবেছিস। আমি তো সেই কবে থেকেই ঐ মেয়ের চিন্তা ছেড়ে দিতে বলেছি তোকে। তুই-ই তো কানে নিলি না। যাইহোক, যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। ঐ মেয়ের স্বভাব তো নিজের চোখেই দেখলি? বাজে, জঘন্য একটা মেয়ে। গোল্ড ডিগার। টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। যেই দেখলো আরমানের কাছে টাকা কাছে অমনি ঝুলে পড়লো তাঁর গোলায়। কেন প্রথম স্বামী মরে গিয়েছে তো কি হয়েছে বাপের বাড়িতে তো যেতে পারতো? নাহ! আরমানকেই বিয়ে করতে হয়েছে তাঁকে? কিন্তু তুই দেখিস, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ঐমেয়ে আরমানেও সঙ্গেও টিকবে না বেশিদিন। এসব মেয়েরা কোনদিন ভালো হয় না। হঠাৎ করে একদিন দেখবি আরমানের সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তখন না আবার তোর গলায় ঝুলে পড়ে আমি সেই চিন্তায়তেই আছি। তাই বলছি, সময় থাকতে নিজের কথা ভাব দোস্ত। বারবার তোকে বোকা বানানোর সুযোগ ঐ মেয়েটাকে আর দিস না। ওর মিষ্টি কথা শুনে বর্তে যাওয়ার স্বভাবটা একটু বদলা।’
আশরাফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তাঁর। বন্ধুরা যতই তাঁকে বোঝাক না কেন কিন্তু মনের ওপর তো কারো জোর চলে না! মেহের ছাড়া অন্যকাউকে নিজের জীবনে কল্পনাই করতে পারে না সে। কি করে পারবে? মেহের যে তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, সমস্ত সত্ত্বায় একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে। চোখবন্ধ করলেই এখনো মেহেরের মুখটাই ভেসে উঠে সবার আগে! কি করে তাঁকে ভুলবে আশরাফি?
মাঝে মাঝে নিজের ওপর রাগ হয় আশরাফির। আত্মসম্মানহীন, কাপুরুষ মনে হয় নিজেকে।নতুবা যেই মেয়েটা তাঁকে এত কষ্ট দিলো, আঘাতের পর আঘাত জর্জরিত করে দিলো তাঁর হৃদয়টাকে, তাঁর পাহাড়সম ভালোবাসাকে ছোট করে শুধুমাত্র টাকার জন্য অন্য একটা লোকের সাথে ঘর বাঁধলো সেই মেয়েটাকেই কেন মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসে আশরাফি! কেন? কেন এখনো আশরাফির প্রতিটা সকাল শুরু হয় মেহেরকে নামক যন্ত্রনাকে কাছে পাওয়ার প্রতিক্ষায়? কেন এখনো তাঁর প্রতিটা রাত কাটে মেহেরকে না পাওয়ার যন্ত্রণায়? এই কেনটার জবাব নিজেও জানে না আশরাফি! কিন্তু মেহেরকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না সে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিই যে এতকিছুর পরেও খনো মেহেরকে পাগলের মত ভালোবাসে সে।
কিন্তু মেহের তো এখন পরস্ত্রী! আরমান যতই খারাপ হোক না কেন সে যে মেহেরের স্বামী এই কথাটা তো কোনদিন অস্বীকার করতে পারবে না আশরাফি! প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক নাহয় অস্বীকার করা যায়! কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক? এই সম্পর্ক কখনো অস্বীকার করা যায় না। এই সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী দুজনেই সারাজীবনের জন্য অটুট এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় পরস্পরের সাথে। চাইলেই তখন আর এই বন্ধন ছিন্ন করে বেরয়ে আসতে পারে না কেউ। মেহেরও পারবে না।
চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলো আশরাফি। কেন তাঁর জীবনটা এমন হলো? কেন মেহের তাঁর হলো না? কেন এতভালোবাসার পরেও মেহেরকে নিজের করে পেলো না সে। আরমান সত্যিই মেহেরকে ভালোবাসে কি না আশরাফি জানে না। কিন্তু মেহেরকে ফিরে পাওয়ার আর কোন পথ নেই! মেহের সারাজীবনের জন্য হারিয়ে গেছে আশরাফির জীবন থেকে। এই কথাটা যতবার মনে পড়ে ততবার হাহাকার করে উঠে তাঁর বুকের ভেতরটা। বিভীষিকাময় লাগে পুরো পৃথিবী।
★
দুদিন পরের ঘটনা। রাত নয়টা কিংবা দশটা বাজে তখন। রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু ফাইল রেডি করছিলো আশরাফি। হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠলো তাঁর। আকস্মিক মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো সে। ভ্রু জোড়া অটোমেটিক কুচকে গেলো।
অনিচ্ছাসত্ত্বে রিসিভ করতে গিয়ে দেখলো মেহেরের নাম্বার। মিনিটখানেকের জন্য থমকে গেলো সে। বলাবাহুল্য, এইমুহূর্তে মেহেরের ফোন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত তাঁর জন্য। তথাপি রিসিভ করতে গিয়েও করলো না সে। কেটে দিলো।
নাহ! আর কোনভাবেই নিজেকে মেহেরের সঙ্গে জড়াতে চায় না আশরাফি! অনেক হয়েছে ঘাত, প্রতিঘাতের দ্বন্দ্ব! এবার নিজের মত করে বাঁচা উচিৎ! নিজেকে সময় দেওয়া উচিৎ। মেহেরকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ, তাঁর প্রতিক্ষায় থেমে নেই আশরাফি জীবন। নিজের মত করে আশরাফিও ভালো থাকতে জানে!
ফোন হাতে নিয়ে এসবই ভাবছিলো সে। এদিকে ফোন কেটে গিয়ে আবার রিং হলো। পুনরায় কেটে দিতে গিয়ে থেমে গেলো আশরাফি। নাহ! রিসিভ করে কথাগুলো মেহেরকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। আর ছাড় দেওয়া যাবে না তাঁকে। এবার থেকে ইটের জবাব পাটকেলে দেবে আশরাফি।ফোন রিসিভ করে যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় হ্যালো বললো সে।
সঙ্গে সঙ্গেই ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে বারো তেরো বছর বয়সী একটা কিশোরী মেয়ের ক্রন্দনরত কন্ঠস্বর শোনা গেলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,’মধুমা খুব অসুস্থ স্যার। আজকে দুদিন যাবত বিছানায় পড়ে আছে। খাওয়াদাওয়াও ঠিক মতন করছে না। জ্বরের ঘরে কেবল আপনার নাম করছে। আপনি একবার আসুন না স্যার। আপনি এলে মধুমা ঠিক ভালো হয়ে যাবে।আমরা সবাই খুব চিন্তায় আছি।’
মেহের অসুস্থ! ব্যস! খবরটা শুনার সাথে সাথেই ফের দিশেহারা হয়ে পড়লো আশরাফি। একটু আগের করা প্রতিজ্ঞাটা বেমালুম ভুলে গেলো সে। ব্যকুল বিগলিত চিত্তে, তড়িঘড়ি করে বলল,’কি হয়েছে মেহেরের? ও ঠিক আছে তো।’
জবাবে মেয়েটার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’কি হয়েছে আমি জানি না। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেছেন তবুও সারছে না। খুব কষ্ট পাচ্ছে মধুমা। আপনি আসবেন তো মাকে দেখতে?’
-‘তুমি ফোন রাখো। আমি এক্ষুনি আসছি!’
-‘ঠিক আছে।’
মেয়েটা ফোন রাখতেই আর দেরী করলো না আশরাফি। ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। টেবিলের ওপর থেকে ওয়ালেট আর গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মেহেরের উদ্দেশ্যে। ভুলে গেলো সে সমস্ত মান, অভিমান।
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
#পর্বঃ১০
জ্ঞান ফিরতেই সচেতন হলো মধু। এইমাত্রই গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর নেমেছে তাঁর। এদিক ওদিক চোখ মেলে একপলক চাইলো সবার দিকে। তারপর ঘরের বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে যেতে বললো সবাইকে। অসুস্থ শরীরে ঘরে এত ভীড় ভালো লাগছে না তাঁর। সামান্য একটু জ্বরে মেয়েগুলো সব ভীড় করে বসে আছে তাঁকে ঘিরে। অসহ্য লাগছে মধুর! পুনরায় বিরক্তমুখে বেরিয়ে যেতে বললো সবাইকে।
ইতোপূর্বে যেই মেয়েটা মধুর অসুস্থতার খবর আশরাফিকে জানিয়েছিলো সে ভয়ে ভয়ে মধুর কাছে এগিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ কাচুমাচু করে ভীত কন্ঠে আশরাফির আসার খবরটা জানালো মধুকে। খবরটা শোনার পর হতবাক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো মধু। মুহূর্তেই তার রোগা মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেলো। রাগত গলায় বললো,’কে বলেছে তোকে কারবারি করতে? কেন তাঁকে ফোন করতে গেলি তুই? এটা কি ভদ্রলোকের জায়গা? তাঁর কোন সম্মান নেই?’
মেয়েটা জবাব না দিয়ে নতমুখে বসে রইলো।আশরাফির আসার খবর শুনে মধুমা এত খেপেছে কেন সেটাই বুঝতে পারছে না সে! মধুমার তো খুশি হওয়া উচিৎ। মানুষটা তাঁর অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে আসছে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য! এমন কপাল কয়জনের হয়? কই তাদের সঙ্গে তো কেউ দেখা করতে আসে না? তাঁরা মরে গেলেও খোঁজ নেওয়ার মত কেউ নেই! যারা আসে তাঁরা কেবল শরীরের লোভে আসে! কিন্তু মানুষটা তো সেরকম নয়? মধুমা কিছু না বুঝেই বিনাকারণে তাঁকে বকছে! জ্বরের ঘোরে তো ঠিকই মানুষটার নাম করছিলো, এখন আসতে বলাতে যত দোষ!
নিস্তেজ গলায় বিড়বিড় করে বেশ কিছুক্ষণ মেয়েটাকে বকাবকি করলো মধু। মেয়েটার কথা অনুযায়ী অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়েছে আশরাফি। পৌঁছাতে হয়ত আর বেশিক্ষণ লাগবে না। তার আগেই তাঁকে ফোন করে বারণ করে দিতে হবে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে আশরাফি নাম্বারে ফোন করলো মধু।
★
মাঝরাস্তায় আবার ফোন বেজে উঠলো আশরাফির। মধুর নাম্বার থেকেই এসেছে। গাড়ির স্পিড স্লো করে ফোনটা রিসিভ করলো সে। রিসিভ করার পর গলা শুনে বুঝতে পারলো ফোনটা মধুই করেছে। সে হ্যালো বলার পূর্বেই ওপাশ থেকে মধু রুগ্ন কণ্ঠে তড়িঘড়ি করে বললো,’হ্যাঁ, হ্যালো। আমি মধু বলছি।’
মধুর গলার স্বর শুনে আশরাফি মনে হলো হঠাৎ করেই বুকের ওপর থেকে মস্ত বড় পাথরটা নেমে গেছে তাঁর। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে।
মধুর অসুখের কথা শোনার পর থেকেই নানারকম আজেবাজে চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো মাথার ভেতর। অজানা আশংকায় বুকটা বারবার কেঁপে উঠছিলো তাঁর। কেবলই মনে হচ্ছিলো, মধুর সাথে সেদিন এতটা খারাপ ব্যবহারে করে আসা মোটেই উচিৎ হয় নি। মধুকে বুঝতে নিশ্চয়ই কোন ভুল হয়েছে তাঁর। মধু কখনো খারাপ হতে পারে না! সব দোষ আশরাফির! সে-ই বিনা কারণে মধুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। ভালোবাসার মানুষের দেওয়া আঘাত যদি সহ্যই করতে না পারে তবে কিসের প্রেমিক সে? এমনি করে মধুর ভাগের সমস্ত দোষ মনে মনে নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলো সে। মধুর কথার জবাবে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললো,’যাক! জ্বর তাহলে নেমেছে?’
নিজেকে শক্ত রাখার সবরকম প্রস্তুতি নিয়েই ফোনটা করেছিলো মধু। কিন্তু আশরাফির কোমল, স্নেহপূর্ণ গলা শুনে থমকে গেলো সে। কতদিন তাঁর সঙ্গে এভাবে কথা বলে আশরাফি! জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো মধু। আশরাফি ভাবলো অভিমান করেছে হয়ত! পুনরায় কোমল কন্ঠে বললো,’অসুস্থ শরীর নিয়ে ফোন করার কি দরকার ছিলো? আমি তো আসছিই।’
চোখের পানি নিঃশব্দে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো মধুর। ফুঁপিয়ে কান্না ঠেকাতে গিয়ে নিচের ঠোঁটটা সজোরে কামড়ে ধরলো সে। তথাপি কান্না ঠেকানো গেলো না। দলা পাকিয়ে হাউমাউ করে বেরিয়ে আসতে চাইলো! গলা দিয়ে কান্নার শব্দ বেরোনোর পূর্বেই হাত দিয়ে ফোনের স্পিকার চেপে ধরলো সে।
আশরাফি কেন তাঁকে এমন অন্তর্দাহে পোড়াচ্ছে? কেন এখনো এতটা অবুঝ সে? এই জায়গাটা যে ভালো নয় সে কি জানে না? মধুর নাহয় মানসম্মানের বালাই নেই! সমাজের কাছে পতিতা সে! কিন্তু আশরাফি? তাঁকে তো সমাজের আর দশটা লোকের সঙ্গে চলাফেরা করতে হবে? কেন সে নিজের সম্মানের কথা ভাবছে না?
কান্না থামিয়ে থমথমে,কঠিন গলায় বললো,’আসার দরকার নেই তোমার। আমি ভালো আছি।’
স্নেহের বিপরীতে মধুর কাছ থেকে এমন রুক্ষ ব্যবহার আশা করে নি আশরাফি। দ্বিধান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো সে,’মানে?’
-‘মানে তোমাকে আসতে বারণ করছি আমি।’
-‘কিন্তু তুমি যে অসুস্থ? জ্বরের ঘোরে নাকি আমার নাম করছিলে?’
-‘কে বলেছে তোমাকে এসব ফালতু কথা? আর বললেই বা তোমাকে আসতে হবে কেন? তোমার নিজের কোন বিবেক বুদ্ধি নেই? তুমি কি ডাক্তার না কবিরাজ যে তুমি এলেই আমি ভালো হয়ে যাবো? যতসব উদ্ভট কথাবার্তা। আমাকে দেখার জন্য আরমান আছে, এখানকার সব মেয়েরা আছে। তোমাকে এত মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি নিজের কাজে মন দাও। নিজের মানসম্মানের কথা ভাবো।’
-‘তুমি অসুস্থ মেহের। এইমুহূর্তে তোমার সঙ্গে কোনরকম ঝগড়া করার ইচ্ছে আমার নেই! তাই রিকোয়েস্ট করছি তোমাকে, দয়া করে আমার মাথা গরম করিও না প্লিজ।’
-‘আমি মোটেও তোমার মাথার গরম করছি না। যেটা সত্যি, যেটা ঠিক আমি শুধু সেটাই বলছি। তোমার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আগের কথা সব ভুলে গিয়েছি আমি। এখন আমার স্বামী আছে, আলাদা একটা জগৎ আছে। আরমানই যেমনই হোক না, ওর সঙ্গে আমি নিজের জগতে সুখে থাকতে চাই। দয়া করে তুমি আমাদের মাঝখানে ঢুকো না প্লিজ! আর পারলে আমার আশা ছেড়ে দিয়ে ভদ্রলোকের মত নিজের ভদ্রজগতে ভালো থাকার চেষ্টা করো, আমার লাইফটাকে হেল করার চেষ্টা করো না।’
অপমানে রক্তবর্ণ ধারণ করলো আশরাফির মুখ! এমনিতেই মধুকে না পাওয়ার যন্ত্রণা তার ভেতরটাকে জালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দিচ্ছিলো তারওপর মধুর অবজ্ঞামিশ্রিত কথাবার্তা! আত্মবিস্মৃত হলো সে! ভালোবাসার নিষ্ঠুর পরিহাস সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরিয়ে দিলো তাঁর। ক্রোধে, উন্মত্ত হয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,’স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, নির্লজ্জ! নিজেকে কি ভাবো তুমি? বিশ্বসুন্দরী? পৃথিবীর সব পুরুষ তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে? তোমাকে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে সবাই? সিরিয়াসলি? এখনো এসব মনে হয় তোমার? ভুল! আমি বলছি শোনো, তোমার মত মেয়ের বাজার দর কেবল ঐ একরাতের জন্যই! এর বেশি কেউ ফিরেও তাকাবে না। তাই তোমার এসব সস্তা, ভিত্তিহীন উপদেশ নিজের কাছেই রাখো তুমি। আমাকে সাথে জাহির করতে এসো না। আমার এখনো এতটা খারাপ দিন আসে নি যে তোমার মত মেয়ের কাছ থেকে উপদেশ ধার করে চলতে হবে আমাকে।’
রুগ্ন, বির্বণ ঠোঁটে মলিন হাসলো মধু! পৃথিবীর সকল পুরুষের কথা সে জানে না! জানতে চায়ও না। কিন্তু এই একটা মানুষ যে এখনো তাঁকে পাগলের মত ভালোবাসে এই কথাটা খুব ভালো করেই জানে সে। এখনো মানুষটার সমস্ত পৃথিবীর জুড়ে কেবল মধুর বসবাস! সেইজন্যেই তো মধুর এত দুঃখ হয়! মানুষটার বুক ভর্তি ভালোবাসা হাত বাড়িয়ে নেওয়ার অধিকার তাঁর নেই। ভাগ্যের কাছে কি নির্মমভাবে নিরুপায় ভালোবাসা!
এদিকে আশরাফি তখনো ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছিলো। তাঁর বিরতিহীন চিৎকারে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম মধুর। কান থেকে ফোন সরিয়ে নিলো সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো,’যা বলছো সেটা মনে থাকলেই হয়। বেহায়ার মত আবার সত্যিই চলে এসো না যেন।’
কথাটা শোনার পর পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন রাগে দিশেহারা হয়ে পড়লো আশরাফি! দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’কি বললে তুমি? আমি বেহায়া? বেহায়া আমি? বেহায়া? বাহ! একেই বলে চোরের মায়ের বড় গলা।’
-‘এত চিৎকার করার মত কিছু হয় নি। আস্তে কথা বলো।’
-‘শোনো, কপাল ভালো তোমার আমার সামনে নেই তুমি। নইলে এইমুহূর্তে গলা টিপে মেরে ফেলতাম আমি। অসভ্য! বেয়াদব মেয়ে! নাঈম ঠিকই বলেছিলো তোমার মত মেয়ে কখনো ভালো হতে পারে না। আমারই ভুল! এতকিছুর পরেও আমার শিক্ষা হয় নি। সব জেনে শুনেও পাগলের মত তোমার পেছনে ছুটেছি!’
আশরাফির সাথে তর্ক করার মত শক্তি মধুর নেই। শরীরটা আবার ভেঙ্গে আসছে তাঁর। কাঁপুনি দিয়ে ফের জ্বর আসছে। ক্লান্ত স্বরে বললো,’একদম ঠিক বলেছো। ভুল টা তোমারই। তোমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো যেই মেয়ে রোজ রাতে একটা করে পুরুষের বিছানায় যায় সে কখনো ভালো হতে পারে না।’
থমকে গেলো আশরাফি! আকস্মিক অপরপক্ষের আত্মসমর্পণ মেনে নিতে পারছিলো না সে! স্পষ্ট বুঝতে পারলো তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই ইচ্ছে করে কথাগুলো বলছে মধু। তাঁর কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা দিচ্ছে! সমস্ত রাগ,অভিমান এবার অনুতাপ হয়ে জমা হলো কণ্ঠস্বরে। মলিন, ক্লান্ত গলায় বললো,’আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে এমন করছো তাই না? কেন মেহের? কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার? কেন তুমি আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছো?’
-‘তোমার যা খুশি ভাবো। আমার তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। আমার যেটা বলার ছিলো আমি বলে দিয়েছি, ব্যস। নিজের লাইফ নিয়ে সুখি থাকতে চাই আমি। তুমিও তোমার লাইফ নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করো।’
কথা শেষ করে আশরাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলো মধু। রাগ আবার মাথায় চড়ে বসলো আশরাফির। মধুর কাছ থেকে একের পর এক প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারছিলো না সে। অত্যাধিক রাগে ফোনটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেললো। মুখ দিয়ে বেরলো কুৎসিত ধরনের একটা গালি। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পাগলের মত নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম।
ভালোবাসার যন্ত্রণা সত্যিই বোধহয় মৃত্যুর যন্ত্রণার চাইতেও বেশি ভয়ানক, বেশি পীড়াদায়ক! নতুবা অপমানে, অপমানে মধুকে জর্জরিত করে দেওয়ার পরেও কেন মধুর সামান্য উপেক্ষাটুকু সহ্য করতে পারছে না আশরাফি। মধুর প্রত্যাখ্যান কেন তাঁর সারা শরীরেবিষের মত জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে?
অন্তরের নিবিড় জ্বালা মেটাতে মধুকে অনেকগুলো খারাপ কথা শুনিয়েছে সে ঠিকই,কিন্তু তাঁর চাইতে বেশি অন্তরযন্ত্রনায় ভুগছে সে নিজে! হতাশায়,শূন্যতায় বুকের ভেতরটা অসহায় চাতকের মত আর্তনাদ করছে তাঁর! অসহ্য যন্ত্রনায় সারা শরীর অবস হয়ে আসছে। ফলশ্রুতিতে, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো বিষাক্ত, জ্বালাময়ী তপ্ত অশ্রু। রাগ, অভিমান সামলাতে না পেরে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে হাইওয়ে ধরে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালানো শুরু করে দিলো সে। আজকে হয় মরবে, নাহয় মারবে! কিন্তু এভাবে আর বেঁচে থাকা যায় না!
.
.
.
চলবে
.
চলবে