মন গহীনের গল্প পর্ব -০২

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২
#রূবাইবা_মেহউইশ
_________________
তিন মাসের দুধের বাচ্চা ফেলে পুরনো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে নীলিমা । ‘রিশাদ রায়হানের বউ বাচ্চা ফেলে পালিয়েছে’ এই কথাটা কোন ভাবেই কারো মুখে শুনতে চায় না রিশাদ। খালা মানে তার সৎমাকে সে পারলে কবেই খুন করে ফেলতো। শুধু রাইমা আর রিহানকে মা ছাড়া করতে চায় না বলেই করেনি। সে নিজে মা ছাড়া বড় হয়েছে এখন তার ছেলের অবস্থা নিয়ে এমনিতেই আতঙ্কিত তার ওপর যদি রাইমাদেরও মা ছাড়া করে! ভাবতে পারে না সে আর। খালা মানুষটা বড় বেশি কটূবাক্য বলে এছাড়া মহিলার আর কোন দোষ নেই৷

দুপুর বেলায় অফিসে বসে বাড়িতে কল দিলো রিশাদ। বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কাউকে না পেয়ে রাইমাকে ফোন দিলো। কলেজ থেকে ফেরার পথেই ছিলো সে। দাদাভাইয়ের কল মানেই ভয়ার্ত কোন ব্যাপার মনে করে রাইমা। কারণ, রিশাদ কখনোই বয়ংকর কিংবা মারাত্মক ঘটনা না ঘটলে তাকে কখনো ফোন দেয়নি। বাড়ির গাড়িতে করেই ফিরছিলো রাইমা সে ফোন রিসিভ করার আগে ড্রাইভার কি জিজ্ঞেস করলো, ‘বাড়ি থেকে আসার সময় কি কোন ঝামেলা দেখে এসেছেন রিয়াজ ভাই?’

খুব সাদাসিধা আর শান্ত স্বভাবের রাইমাকে বাড়ির প্রতিটি কাজের লোক ভীষণরকম ভালোবাসে, স্নেহ করে। রাইমার আচরণই এই ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে। ড্রাইভার রিয়াজও সেদিক দিয়ে তাকে অত্যাধিক স্নেহ করে। রাইমার ফোনের আওয়াজ এবং প্রশ্ন শুনে সে বুঝতে পারলো রিশাদ ফোন করেছে। রিয়াজ জবাব দিলো, ‘ভয়ের কোন কারণ তো টের পাই নাই আপামনি। রিশাদ ভাই অফিসে আছিলো আর খালাম্মাও দেখলাম নতুন বউরে নিয়া বাবুরে গোসল দিতাছে।’

ড্রাইভার রিয়াজের কথা শুনে রাইমা চোখ যেন কপালে উঠলো। ‘এ কি বলছেন রিয়াজ ভাই! নতুন বউ আর আম্মু একসাথে? অবিশ্বাস্য!’

‘আপামনি, অবিশ্বাস্য হইলেও এইডাই সত্যি। নীলিমা ভাবীরে দেখলে যেমন খালাম্মা দূর দূর করতো এ্যাই নতুন বউরে দেইখা তা করে না।’

কথা চলতে চলতে রিশাদের কল দুবার কেটেছে। রাইমা একবারও রিসিভ করেনি। জীবনে বোধহয় এই প্রথম সে তার দাদাভাইয়ের ফোন এভোয়েড করলো। বাড়ি ফিরতেই দেখলো বাড়ির গেইটে রিশাদের গাড়ি। তারমানে রিশাদ ফোন করতে করতে বাড়িতেই চলে এসেছে। আল্লাহ জানে রাইমাকে না কিছু বলে ফেলে! ভয়ে কিছু দোয়া কালাম পড়তে পড়তে বাড়ির ভেতরে গেল রাইমা।

ভর দুপুরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বাচ্চাকে বারান্দায় নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো মেহউইশ। একদম রোবটের মত চলছে ফিরছে এই অর্ধদিন সে। তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি? বেঁচে থাকার কারণ কি কিছুই বুঝতে পারছে না। পরশু মধ্যরাত পর্যন্তও তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ছোট ভাইটাকে পড়াশোনা করিয়ে একটা গতি করে দেওয়া। মা আর ভাই যেন স্বচ্ছল জীবন কাটাতে পারে। আর এরপরই সে আর ইভান বিয়ে করে নিজেদের সুন্দর একটা সংসার গড়বে। রাতের শেষ ফোনালাপে ইভান তাকে ‘ভালোবাসি’ বলে ফোন কেটেছিলো। কথা ছিলো কাল হাসপাতালে গিয়ে ভালোবাসি’র জবাব দেবে। যেমনটা সে রোজ দেয়।কিন্তু হায়! কি করুণ দৈবদশা তার। ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলো আজ তার বিয়ে। মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বলল, ‘ চুপচাপ বিয়ের জন্য তৈরি হয়ে যা। কোন আচার অনুষ্ঠান নেই শুধু কালেমা পড়ে বিয়ে। আর দেনমোহর অগ্রিম একটা একতলা পাকা বাড়ি আমার নামে। ফিক্সড ডিপোজিট দশ লাখ টাকার মায়ের নামে। কি আশ্চর্যরকম এক ঘটনা ঘটলো একদিনেই। যেন আলাদিনের দৈত্য এসে প্রয়োজনগুলো সব এক নিমিষেই ফুরিয়ে দিলো। মাও কেমন বদলে গেল কয়েকঘন্টার ব্যবধানে। মা তো জানতো আমি ইভানকে ভালোবাসি। ‘অর্থ’ আসলেই ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল। অতগুলো টাকা দেখেই মা লোভে পড়ে গেছে। দুদিন আগ পর্যন্তও মা ইভান আর আমার সম্পর্ক নিয়ে খুশি ছিলো। মেহউইশ যখন নিজের ভাগ্য আর অর্থকে দোষারোপ করায় ব্যস্ত তখনি রিশাদ এলো ঘরে। দরজা খোলার শব্দেই ধ্যান ভেঙেছিলো মেহউইশের কিন্তু বারান্দা ছেড়ে ঘরে যাওয়ার সাহস হলো না। বাচ্চাটিকে দু হাতে বুকের কাছে চেপে মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে লাগলো। কাল রাত এবং সকালে রিশাদের সামনে থাকার যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তার হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা তৃতীয়বার চায় না সে। আজ সকালেই মেহউইশ যখন নিজেকে একটু ভদ্রস্ত করতে বাথরুমে গেল তখনও তার পরনে বিয়ের শাড়ী। ক্লান্ত শরীরের শক্তিহীন হাত চালিয়েই মুখ ধুয়ে গোসল সেরে শাড়ী বদলেছে। যখনি সে ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচাবে ঠিক তখনি রিশাদ বাথরুমের দরজা খুলল। তাকে দেখে প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলো, ‘তুমি?’

মেহউইশ ভয়ে জবাব দিতে না পারলেও কাঁপছিলো একটু একটু। রিশাদ দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতেই হাতের তোয়ালে নিচে ফেলে রিশাদকে দরজা থেকে ধাক্কা মেরেছে এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। বৃথা সেই চেষ্টায় রিশাদের ঘরটাও পার করতে পারেনি বেচারি। ফর্সা, মোটামুটি লম্বা,চিকন মেয়েটা তার কাঁপা পায়ে দৌড়াতে গিয়েই হোঁচট খেয়েছে ঘরের দরজায়। ততক্ষণে দৈত্যের মত রিশাদ পাকড়াও করে নিয়েছে মেহউইশকে এবং কোন প্রকার প্রশ্নত্তোর ছাড়াই কষে দুটো থাপ্পড় লাগিয়েছে পুনরায়। রাতে, দিনে মোট ছয় কি সাতটি থাপ্পড় মেহউইশের গালসহ দাঁত সব নড়বড়ে করে দিয়েছে। মেয়েটা সেই থেকে এখন অব্ধি রিশাদের নামটা মনে করতেই ভয়ে কাঁপছে। অফিসে যাওয়ার আগে রিশাদ তার স্বভাবসুলভ রাশভারী কন্ঠে বলে গেছে তার ছেলের জন্য এক সেকেন্ডের জন্যও কোন প্রকার কষ্ট, অযত্ন না হয়। আর এ বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা তো ভুল করেও করা যাবে না। মেহউইশ আর পালানোর কথা চিন্তা করেনি। বাচ্চাটারও নিজের পক্ষে যতোটা সম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করছে। সমস্যা একটাই সে রিশাদের মুখ মনে পড়লেই নিজের মধ্যে ভয়ের তুফান টের পাচ্ছে। এখন রিশাদ ঘরে এসেছে এখন কোথায় যাবে সে!

– ‘এই ভর দুপুরে বারান্দায় কি?’

বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো রিশাদ।

‘ভিটামিন ডি ব বাচ্চা’ তোতলানো গলায় এর বেশি মেহউইশ আর উচ্চারণ করতে পারলো না। রিশাদ ভ্রু’জোড়া একটু বাঁকিয়ে মেহউইশের সামনে এসে দাঁড়ালো।

-কোন মূর্খের বাচ্চা বলছে এই ভরদুপুরের ঠাডা পড়া রোদে রাখতে আমার ছেলেকে?

রিশাদের মুখের কথা উচ্চারিত হতেই চোখমুখ খিঁচে নিলো মেহউইশ। এ কোন জমের দুয়ারে পড়েছে সে! লোকটা মুখ খুলেই শুধু বজ্রপাত ঘটায়। দেহের ভেতর আত্মাটা যারপরনাই পথ খুঁজে বেড়ায় পালিয়ে যেতে। তপ্ত দুপুরে ঘাম ঝরা সময়টাতে মেহউইশের ঘামগুলোও ভয়ে লোমথেকে কূপের ছিদ্রে চুপ মেরে আছে। চিলের মত ছোঁ মেরে নির্জনকে নিয়ে নিলো রিশাদ এবং ঠিক প্রথম দিনের মতো করেই এক হাতে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো বাচ্চাটাকে। মেহউইশ নিজের মনের ভয়েই আধমরা সেখানে এই বাচ্চাটাকে নিয়ে আতংক হওয়ার সুযোগ তার নেই।ঘরে ঢুকে গেল রিশাদ এবং যাওয়ার সময় বলে গেল পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার টেবিলে উপস্থিত হতে।

শরতের দুপুর এই রোদ্দুরে ঝলসে নিচ্ছে শহরটাকে এই কোথাও কালচে মেঘে ঢাকা পড়ছে শহরটা। রাইমা নিজের ঘরে ঘাপটি মেরেছে দাদাভাইয়ের ভয়ে। বাড়ি ফিরতেই গরমের কারণে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েছিলো৷ বাথরুম ত্যাগ করতেই হঠাৎ দমকা এক বাতাস জানালার পাল্লা খুলে শীতল করে দিলো তাকে। এ কেমন হাওয়া! এই ঋতুতে ঝড় হয় বুঝি? দ্রুত পায়ে জানালার কপাট লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আজ সে অনেক সময় নিয়ে চুল শুকাবে,লোশন মাখবে। ঘড়ির কাটা যখন তিন পেরুবে তখনই সে ঘর ছাড়বে। কারণ, দাদাভাই তিনটার ওপারে আর বাড়িতে থাকবে না। কি জানি আজ কি ঘটেছে তার জন্য তাকে কল দিয়েছিলো। দাদাভাইয়ের কল রিসিভ না করার যে দুঃসাহস দেখিয়েছে তার শাস্তি কি না কি থাকবে! সকাল ঘুম থেকে উঠেই আয়ার কাছে শুনেছে নতুন বউকে নাকি ভাইয়া অনেকগুলো থাপ্পড় মেরেছে। এত সুন্দর মিষ্টি মেয়েটাকে কি করে মারলো দাদাভাই! ইশ, নীলিমা ভাবীর ওপরের সব রাগ বুঝি নতুন বউয়ের ঝাড়লো।

– রাইমা আপা আপনারে ডাকে।

দরজার বাইরে থেকে কাজের মেয়ের ডাক শোনা গেল। রাইমা জিজ্ঞেস করলো, ‘কে ডাকে? আর দাদাভাই কি অফিসে চলে গেছে?’ নাহ ওপাশ থেকে কোন জবাব আসলো না তারমানে মেয়েটা তাকে ডেকেই চলে গেছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই নিচে গেল রাইমা।

জর্জেটের শাড়ী কোনকালেই মেহউইশের মায়ের ছিলো না। ভদ্রমহিলা সেলোয়ার কামিজ পরেন সবসময় বেড়াতে গেলে যা পরেন তা সুতির মধ্যে শাড়ী আর মেহউইশও কখনো কোথাও শাড়ী পরে যায়নি। অথচ কাল রাতে বিয়ে উপলক্ষে কোটিপতি নবাবজাদা দিলো তো দিলো একটা ভারী বেনারসি আর আট কি দশ ভরি হবে গয়না৷ তাও আবার সব সোনার গয়না না পাথরের মা তো বলল ওগুলোই নাকি হীরা৷ কে জানে আসল হীরা নাকি নকল ধরিয়ে দিয়েছে! রাতভর সেই সব জঞ্জাল গায়ে দিয়ে পার করলো আর সকালে কোন কাপড়চোপড় না দিয়েই বলল ভদ্র হতে। মেহউইশ কোন কিছু বুঝতে না পেরে ঘরেই বসেছিলো। পালানোর চেষ্টায় পাওয়া শাস্তিতে বসে বসে কাঁদছিলো তখন রিশাদ নিজেই একটা শাড়ি দিয়ে বলল আলমারীর পাশেই আরেকটা আলাদা কেবিনেট আছে। তাতে মেয়েলি পোশাক সব আছে সে যেন কিছু একটা পরে নেয়। ভয়ে আধমরা মেয়ে মেহউইশ দিক্বিদিকশূন্য হয়ে কাপড় খুঁজে এই পরে নিয়েছিলো। তখন অত খেয়াল ছিলো না এই জর্জেট শাড়ি,লুস ব্লাউজ এবং তার উচ্চাতায় বড় এক পেটিকোট পরে সে কোন বিপাকে পড়বে। এখন দোতলা থেকে নিচ তলায় নামতে গিয়েই টের পেল মারাত্মক এক ভুল করেছে সে। এখন হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে এই বুঝি পেটিকোটে পা বেঁধে হোঁচট খাবে। এই বুঝি শাড়িটা কোমর থেকে খুলে মানসম্মান হারাবে সে। নাহ্ তেমন কিছুই হয় নি। সময় লাগলেও কাপড়চোপড় ঠিক রেখেই টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছে সে।

‘বিয়ের মেন্দী কি সব পায়েই লাগাইছেন? নাকি ফ্যাশনে নাম লিখছেন কত লেট করে হাঁটা দেখানো যায়?’ মুখ খিঁচিয়ে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করলো রিশাদ। মেহউইশ কোন কথাই বলতে পারলো না। তবে সেখানে উপস্থিত থাকা জেবুন্নেসা সুযোগে বললেন, ‘ নতুন বউ চলা ফেরায় একটু তো লজ্জা থাকবেই। তার তো আর অন্যদের মত আগে থেকেই বিয়ের অভিজ্ঞতা নেই যার জন্য সকল লাজ লজ্জা লজ্জা ধুয়েমুছে ফেলবে।’

ঝনাৎ করে আওয়াজ হলো খুব জোরে। চেয়ার ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছেন জেবুন্নেসা। টেবিলের কাছ থেকে সরে গেছে মেহউইশ এবং সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকা রাইমাও থেকে গেছে সিঁড়িতেই৷ এবং তখনি খুব জোরে আরো একটি আওয়াজ হলো টেবিলের আড়াই ইঞ্চ পুরো কাঁচের ওপর। রিশাদ প্রথমে টেবিলক্লথ খাবার, থালা বাসনসমেত হিঁচড়ে ফেলেছে এবং তৎক্ষনাৎ টেবিলের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে ঘুষিও মেরেছে। জেবুন্নেসার কথার বাঁকা যে অর্থ তা রিশাদ এবং তার বাবাকে উদ্দেশ্য করেই তা সে বুঝতে পেরেছিলো। নাকের ডগায় রাগ লেগে থাকা ছেলেটাকে কটুবাক্য শোনালে এমন হওয়াটা একদমই বেমানান কোন ঘটনা নয়। তবে এসব কিছু খুবই নতুন মেহউইশের জন্য ঃ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো নির্জনের। এত শোরগোলে বাচ্চাটা ভয় পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে । মেহউইশ আঁড়চোখে খুবই ভয়ে ভয়ে রিশাদের মুখটা একবার দেখলো। সে মুখের অভিব্যক্তি কিছুই বুঝে আসছে না বলে মেহউইশ এগিয়ে গেল আয়ার কাছে। সে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো যেন, রিশাদ এই আদর দেখেই তাকে কিছু বলবে না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here