মন গহীনের গল্প পর্ব -০৮

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৮
#রূবাইবা_মেহউইশ
__________________
জড়সড় হয়ে বসে আছে মেহউইশ রিশাদের পাশে৷ তার কোলে নির্জন ঘুমুচ্ছে। রিশাদ ড্রাইভ করছে রাগে তার মুখ এখনও থমথমে। চোয়াল শক্ত হয়ে যেন মুখের ভেতর দাঁতগুলো ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। বাড়ি থেকে প্রায় কুঁড়ি মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতেই গাড়ি বাঁক নিলো মেইন রোড ছেড়ে৷ কৌতূহল তো অনেক হচ্ছে কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না তারা যাচ্ছে কোথায়। একটা গলি পেরিয়ে সুন্দর একটি গেইটের সামনে এসে হর্ন দিতেইভেতর থেকে দাড়োয়ান গেইট খুলে দিলো। গাড়ি ভেতরে গিয়ে থামতেই নির্জন জেগে গেল৷ মেহউইশ আশ্চর্য হলো, এতটুকু বাচ্চাও কি টের পেল গাড়ি থেমেছে! রিশাদ আগে নামলো তারপর অপর পাশের গেইট খুলে মেহউইশের কোল থেকে নির্জনকে নিয়ে নিলো৷ মেহউইশ গাড়ি থেকে নেমে শাড়িটা একটু ঠিক করে নিলো। কোথায় এসেছে, কার বাড়িতে তা জানে না৷মেহউইশ খুব ভালো করে খেয়াল করলো বাড়িটা একতলা আর দারুণ। সামনেই গাড়ি বারান্দা এবং দু’পাশে কিছু ফুলগাছ লাগানো। বাড়ির পেছন দিক থেকে দু তিনটা নারকেল গাছের পাতা চোখে পড়ছে। হয়তো গাছ আছে পেছনে। সামনের লনটুকু আবার ছোট ছোট সবুজ ঘাসভর্তি। এত গোছানো বাড়ি মেহউইশ খুব কমই দেখেছে। প্রথমবার সে রিশাদদের বাড়ি দেখলো অত বড় আর অত সাজসজ্জায় ভরপুর৷ আর এই বাড়িটা ওই বাড়ির তুলনায় অনেক ছোট কিন্তু সাজানো। রিশাদ নির্জনকে নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একজন লোক বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। হাতে কিছু যন্ত্রপাতি আর একটা ব্যাগ। বোঝা গেল লোকটা কোন মিস্ত্রি হবে কিছু ঠিক করেছে।রিশাদকে দেখেই লেকটা সালাম দিলো।

-কলিংবেল লাগানো হয়ে গেছে?

-জ্বি স্যার।

ভেতরের ঘরের কি কি যেন বাকি ছিলো?

স্যার, সবকিছু কাল রাতেই আমি দুজন ছেলেকে নিয়ে এসেছিলাম সব ঠিক করা হয়েছে।

-তোমার টাকা পয়সা ক্লিয়ার না?

‘জ্বি স্যার’ বলতেই রিশাদ চলে গেলো ভেতরে। মেহউইশের মনে হলো এই বাড়িটা হয়তো রিশাদেরই আর আজ এখানে আসবে বলেই সব ঠিকঠাক করিয়েছে। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিশাদ ডাকলো, ‘ মেবিশ! পায়ে কি সমস্যা?’

-‘কোন সমস্যা নেই ‘ ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো মেহউইশ।

‘তো এমন পিঁপড়া সেজে হাঁটা হচ্ছে কি জন্য শুনি?’ ব্যঙ্গাত্বক সুরেই বলল রিশাদ তারপরই কলিং বেল টিপলো।ওপাশ থেকে মাইমুনা দরজা খুললেন। রিশাদ কোন কথা না বলেই ভেতরে চলে গেল আর মা মেয়ে দুজনেই দুজনকে দেখে বিষ্মিত। মাইমুনা ভাবেনি রিশাদ আজ মেহউইশকে আনবে। আর মেহউইশ ভাবছে মায়ের সাথে রাগ করা উচিত কিনা। অভিমান তো তার আগেই হয়েছিলো এবার কি রাগটাও হচ্ছে কিনা সে বুঝতে পারছে না। পরিস্থিতি তাদের বাকহীন করে দিয়েছে। মাইমুনা ছলছল চোখে মেহউইশের দিকে এগিয়ে এলে মেহউইশ পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেল। অভিমানে মায়ের দিকে তাকানোটাও কষ্টকর মনে হলো।

মিহাদ খুব একটা খুশি হলো না রিশাদকে দেখে। মাইমুনার হাত পা চলছে না কোন এক অজানা ভয়ে । নিয়মানুসারে বিয়ের দ্বিতীয় দিনই মেয়ে আর জামাইকে আনতে হয় মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু রিশাদ যেভাবে বিয়ে করেছে তাতে কোন প্রকারই নিয়ম মানা হয়নি। জোরজবরদস্তির এক বিয়ে এটা যার মূল্য হয়তো কারো কাছেই নেই। রিশাদের নিজের কাছেও নেই। নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মানুষের অসহাত্বকে কাজে লাগানোটা কখনোই মহৎ কাজ হতে পারে না আর তার ফলও কখনও উত্তম হয় না।আর এই নিয়মনীতিহীন বিয়ে নিয়ে আলাদাভাবে কিছু করারও স্বাদ হলো না মাইমুনার। মেয়ে এসেছে তা ভেবে কিছু আলাদা না করলেও পেটের চাহিদা পূরণে রান্না করতেই হবে তাই তিনি রান্নাঘরে ঢুকলেন। এখানেও রিশাদের রাজত্ব।রান্নাঘর ভর্তি রান্নার সামগ্রী,বাজার সদাই সবই রিশাদ পাঠিয়েছিলো লোক দিয়ে। কৃত্রিম হাসির ফোয়ারা ঠোঁটে এনে রান্নার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন তিনি।

মেহউইশ এক পলকে বসারঘরটা দেখে নিলো। তাদের আগে দু কামরার ফ্ল্যাটে কোন আলাদা করে বসার ঘর ছিলো না। সরু একটু জায়গা যা দু ঘর, বাথরুম আর ছোটো রান্নঘরটায় ঢোকার দরজার জন্য ছিলো। এছাড়া বারান্দা কিংবা বসার ঘরের জায়গা ছিলোই না। আর এই বসার ঘরটা ওই দু ঘরের সমান৷ আর দরজা দেখে মনে হচ্ছে এখানে তিনটা বেডরুমও আছে একটা রান্নাঘর আরেকটা বাথরুম৷ তারমানে এই লোক আমাকে কিনেছে বিয়ের নাম করে! চোখ পড়লো সোফার ওপর। এখানে দারুণ সোফাসেটও আছে। সেখানেই বসে আছে রিশাদ আর তার কোলে নির্জন। মনের যত বিতৃষ্ণা মূহুর্তেই গিয়ে জমা হলো ওই ছোট্ট কোমল মুখটির ওপর। গত দুদিনে প্রচণ্ড মায়া লাগতো এই ভেবে, বেচারা মা থাকতেও মা হারা। কোটি কোটি টাকার উত্তরাধিকারী হয়েও এ বয়সে তার মায়ের স্নেহের অভাব। মায়ের বুকে লুকিয়ে উষ্ণ,মোলায়েম স্পর্শ পাওয়ার জায়গায় বাবার শক্ত,কঠিন বুকে থাকতে হচ্ছে । বড্ড খারাপ লেগেছিলো বাচ্চাটার জন্য এখন সেই খারাপ লাগা রাগে পরিণত হচ্ছে । শুধুমাত্র এই বাচ্চার মায়ের অভাব ঘোচাতেই রিশাদ তাকে জোর করে বিয়ে করেছে।

‘ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? ঘর চেক করো খালি কোনটা আছে নির্জন ঘুমিয়ে পড়বে।’

রিশাদের কথায় ঘোর কাটে মেহউইশের। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নির্জনের উপর থেকে। তিনটা ঘরের প্রথমে যে ঘরে ঢোকে সে ঘরে বসে আছে মিহাদ। মেহউইশ ঘরে ঢুকেই মিহাদ বলে ডাকলো। হাতের মুঠোয় ছোট্ট একটা কৌটা তার। মেহউইশের ডাকে কৌটোটা দ্রুত পকেটে ঢুকিয়ে বোনের দিকে তাকালো। এই প্রথম একসাথে তিনদিন পর দেখলো দু’ ভাই বোন দুজনকে৷ বুঝোার বয়স হওয়ার পর তারা কখনো কোথাও দূরে যায়নি কেউ কাউকে রেখে। মেহউইশ নার্সিং এ ঢোকার পর কখনও কখনও হাসপাতালে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও কাজ করেছে কিন্তু তখনও তাদের দেখা হয়েছে। মিহাদ তার জন্য খাবার নিয়ে যেত হাসপাতালে কিন্তু এবার সবটা অন্যরকম৷ ডুকরে কেঁদে উঠলো মিহাদ । মেহউইশ দু পা এগিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। নিজেও কান্না করে দিলো এবার। কিছুসময় কান্নার মাঝে কাটলো এরপর মিহাদই প্রথমে কথা বলল, ‘ ইভান ভাইয়া তোমার খোঁজ করছিলো।’

‘ইভান এসেছিলো এখানে?’

‘সে খবর না হয় আমি দিচ্ছি? আপাতত আমার ছেলের জন্য বিছানা ঠিক করে কৃতার্থ হবো বেগম সাহেবা।’ দরজায় দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গ করেই বলল রিশাদ। মেহউইশ নিজের চোখমুখ মুছে বের হলো মিহাদের ঘর থেকে আর তার পাশের ঘরটাতে বিছানা ঠিক করলো। সমস্যায় পড়লো এখানে ছোট ছোট বালিশ নেই যা নির্জনের মাথা রাখার জন্য উপযোগী হবে। রিশাদ নিজেও বুঝলো ভুল হয়েছে এভাবে চলে আসা। মেহউইশ পুরো ঘরে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ মেজাজ খারাপ হলো রিশাদের, কোথায় একটা বালিশের ব্যবস্থা করাবে তা না! দু মিনিট পর আবার ফিরে এলো মেহউইশ হাতে তার গোল করে ওড়না পেঁচিয়ে রাখা।

কি এটা!

বালিশ।

ফাইজলামি করা হচ্ছে আমার সাথে?

মোটেই না। মা এটাকে পেঁচিয়ে দিয়েছে। এভাবেও নাকি বাচ্চাদের শোয়ানো যায়। মাথার সাইজও নাকি ঠিক থাকে এতে করে বাচ্চাদের।

মেহউইশের কথাটা এবার সত্যিই ফাইজলামি মনে হলো রিশাদের । মাথার সাইজ ঠিক হবে এই পেঁচানো কাপড়ে ঘুমিয়ে! তাহলে ডাক্তাররাই বলে দিতো বাচ্চাকে এভাবে শোয়াতে। যত্তসব লো ক্লাস ধ্যান,ধারণা। বিড়বিড় করতে লাগলো রিশাদ ততক্ষণে মেহউইশ বিছানার মাঝখানে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা রেখে দিলো। রিশাদের কোল থেকে নির্জনকে নিয়ে সেখানেই শুইয়ে দুটো বালিশে নির্জনের দু পাশে ঘেরা দিলো। যেন দু পাশে দুটো দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে তাকে নিরাপদে রাখতে। গাড়িতে কাপড়ের ব্যাগ রয়েছে দুটো৷ একটা নির্জনের প্রয়োজনীয় সকল জিনিস অন্যটাতে রিশাদের। মেহউইশের কোন কিছু নিয়ে আসেনি। রিশাদ ইচ্ছে করেই দেয়নি কিছু নিতে। অযথা সময় নষ্ট করবে এমনিতেই এই মেয়ে যা কচ্ছপের গতিতে চলে! তার বাড়িতে নিশ্চয়ই কাপড়চোপড় আছে নিজের সেগুলোই পড়তে পারবে৷ রিশাদ টের পাচ্ছে তার রাগ এখন যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে। তাই এই ঠিক মুডেই থাকতে চায় বলে মেহউইশকে সুন্দর করে বলল, ‘গাড়িতে পেছনের সিটে আমাদের ব্যাগ আছে নিয়ে আসো তো জলদি। আমি ফ্রেশ হবো।’ মেহউইশ বোকার মত তাকিয়ে রইলো রিশাদের দিকে। ব্যাগ বলতে রিশাদ যা বোঝাচ্ছে তা মেহউইশের জন্য মোটেও ব্যাগ নয় সে দুটো ট্রলি ব্যাগ। আর ওই দুটোর মধ্যে ছোট যেটা সেটা নির্জনের আর তার ওজন মেহউইশ উঠাতে গেলে কাত হয়ে পড়বে। আর বলে কিনা রিশাদেরটাও আনতে!

কি হলো? হা করে আছো কেন! যাও জলদি আনো।

‘জ্বি’ বলেই মেহউইশ বেরিয়ে গেল। রিশাদ আসার সময় ভি নেক টি শার্টের ওপর একটা ব্লেজার চাপিয়ে চলে এসেছিলো। এখন ব্লেজারটা খুলে বিছানার ওপর রেখে প্যান্টের পকেটে হাত দিলো গাড়ির চাবি বের করতে। তখন খেয়াল হলো চাবি ছাড়া মেহউইশ গাড়ি খু্লবে কি করে! ধ্যাৎ বলে নিজের ওপরই বিরক্তি প্রকাশ করে সেও বের হলো ঘর থেকে। গাড়ির কাছে গিয়ে চারপাশে তাকালো, মেহউইশ নেই সেখানে। হঠাৎ চোখে পড়লো গেইটের সামনে দাড়োয়ানও নেই। কেন যেন তার একটু সন্দেহ হলো। গাড়ি না খুলে সে গেইটের দিকে এগোলো। গেইট পেরিয়ে রাস্তায় তাকাতেই চিত্ত জ্বলে উঠল। যা সে চাইছিলো না তাই হলো। তীক্ষ্ণ নজরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সতর্ক করতে লাগলো, ‘নো রিশাদ নো।’

রগচটা মানুষ যতোটাই চেষ্টা করুক না কেন উত্তেজনা তাদের অতো সহজে ছাড় দেয় না। রিশাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। রাস্তার বিপরীত পাশের ব্যক্তিকে দেখতেই মাথায় খুন চড়ে বসলো। মেহউইশের নজরও গেইটে পড়ায় সে দেখতে পেল রিশাদকে। ভয়ে তারও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে রিশাদের চোখ, মুখের কাঠিন্যতা টের পেতেই। সাঁই করে সামনে দিয়ে একটা মাইক্রো চলে যেতেই রিশাদ দ্রুতবেগে রাস্তা পার হলো এবং তৎক্ষনাৎ মেহউইশের সামনে থাকা ব্যক্তিটির গলা চেপে ধরলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here