#মন_পাড়ায়
#পর্ব_২১
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না যে সৈকত এতটা ভালো হলে তার ও অন্যান্য এতজনের সাথে অন্যায় করলো কেন? আর সৈকতের কথামতো যদি সে ভুল হয় তাহলে সে প্রমাণ গুলোও কী ভুল যেগুলোর সাক্ষী সে নিজে?
ঝিনুক ক্লাসে যেয়েই অঞ্জলিকে পেয়ে গেল। সে রুমে একা বসে বসে পড়ছে। ঝিনুক যেয়ে তার পাশে বসলো আর বলল, “কখন এসেছ?”
অঞ্জলি তাকাল তার দিকে। হেসে বলল, “দশ মিনিট হবে।”
“ওহ সরি আমি দেরি করে ফেললাম।”
“অসুবিধা নেই। আমি অর্ণব ভাইয়া ও সাবেককে ডেকেছি। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে।” বলেই আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো অঞ্জলি। ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, “তোমার আর সাবেক ভাইয়ার রিলেশনের কয় মাস হলো?”
অঞ্জলি শব্দ করে হেসে উঠে বলল, “সাত বছর হবে সামনে।”
ঝিনুক চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, “সাত বছর!”
অঞ্জলি মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমরা এক এলাকার। উনি আমার এলাকার বড় ভাই ছিলেন। তারপর হয়ে গেল রিলেশন কোনো এক ভাবে। তোমার আগে কোনো রিলেশন ছিলো?”
ঝিনুক ম্লান হাসলো। চোখ নিচে নামিয়ে বলল, “সৈকতের সাথে ছিলো।”
অঞ্জলির চোখ দুটো ছানাবড়া। সে বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু উনার সাথে তো হঠাৎ করে বিয়ে হয় তোমার। তোমরা কি আগের থেকে প্লান…….” ঝিনুক অঞ্জলির কথা কেটে বলল, “না। আমাদের ব্রেকাপ হয়ে যায় আগেই।”
“ওহ রিলেশন কীভাবে হয়? তুমি উনাকে পছন্দ করেছিলে না সৈকত ভাইয়া তোমাকে?”
ঝিনুক একটু চিন্তা করে বলল, “ইট’স কমপ্লিকেটেড। উনি বিয়েতে আমাকে সাথে কতগুলো চিজি লাইন মেরে, আমার বাসায় এসে খালুর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে, আমার সাথে দুইদিন কথা বলে আমার বান্ধবীর নাম্বার চেয়েছে।”
“কী!” অঞ্জলি যেন আকাশ থেকে পড়লো কথাটা শুনে। নড়ে-চড়ে বসে আবার বলল, “ওই ছেলে জাত হয়ই খারাপ। মানে দুইদিন প্রেমালাপ করে বান্ধবীর নাম্বার চায় কীভাবে?”
“সব ছেলে তো খারাপ না যেমন অর্ক জিজু ভালো। আর বিনয় দুলাভাই তো অসম্ভব ভালো ছিলো। আর ও ঠিক প্রেমালাপ করে নি। এমনি কথা বলছিলো আর কি! আমার ফ্রেন্ডের নাম্বার চাওয়ার পর তো আমি ভীষণ রাগে ছিলাম। এইজন্য আর ফোনই ধরি নি কিন্তু দুইদিন পর দেখি ও আমার স্কুলের সামনে এসে হাজির। আর….” অঞ্জলি ঝিনুকের কথাটা কেটে দিয়ে বলল, “একমিনিট তুমি যদি ওকে পছন্দ না করতে তাহলে এত রাগ ছিলে কেন যখন জানলে উনি তোমার বান্ধবীর নাম্বার চেয়েছে তোমার না?”
ঝিনুক জোরপূর্বক একটু হাসলো। বলল, “আমিও একটু ক্রাশ খেয়েছিলাম আর কি! দেখতে এত হ্যান্ডসাম ছিলো যে ক্রাশ খাওয়াটা স্বাভাবিক।”
অঞ্জলি হেসে বলল, “তারপর?”
“তারপর আর কি? আমি যেয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। রাগে ছিলাম প্রচন্ড। হাত দুটো আড়াআড়ি ভাঁজ করে একগাদা ভাব নিয়ে বললাম, ‘আপনি এইখানে কেন এসেছেন? ভাববেন না যে আপনি যা বলেছেন করেছেন তা ভুলে গেছি। আমি আপনাকে একদম মাফ করব না।’
ওই আবালে বলে কী জানো? বলে, ‘সরি কিন্তু আমি তো তোমার জন্য আসি নি। তোমার বান্ধবীর জন্য এসেছি।’
আমার সারাজীবনের আফসোস কেন ওই ফাজিলটার সাথে সেধে সেধে কথা বলতে গিয়েছিলাম? সবার সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেছে।
আমার বান্ধবীরা একটু দূরত্বেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কথাটা শুনে একদম হেসে দিলো সবাই। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকানোতে চুপও হয়ে গেল। আমি রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি আমার বান্ধবীকে পছন্দ করলে সোজাসাপ্টা ওর সাথে কথা বললেই তো হতো। এমনিতেও একেকটা আপনার উপর লাট্টু হয়ে আছে। আমাকে মাঝখানে জ্বালিয়েছেন কেন?’
‘তুমি মনে হয় ভুল বুঝেছ। আমার না,’ তার পাশের ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওর তোমার বান্ধবী মিথিলাকে পছন্দ।’ আমি থ খেয়ে গেলাম। মুহূর্তে আমার রাগ ছুঁ মন্তর হয়ে গেল। আমি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অর্থাৎ আপনি কাওকে পছন্দ করেন না?’
ও হাসলো। উওর না দিয়ে আমার পাশ কাটিয়ে যায় তার বন্ধুর সাথে আমার বান্ধবী মিথিলার পরিচয় করিয়ে দিলো।
আমি তার সাহস দেখে অবাক। এমনভাবে দুইজনের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে যেন মিথিলাকে কত বছর ধরে চিনে। আর আমার একেকটা বান্ধবী, পিশাচিনীগুলো নিজের দুলাভাইয়ের সাথে কী লাইন মারছিল। নিলজ্জ একেকটা!”
অঞ্জলি শব্দ করে হাসতে শুরু করল। বলল, “দেখো আমি কিন্তু সৈকত ভাইয়াকে ভাই-ই মানলাম। আমার উপর এইসব শব্দ ব্যবহার কর না দয়া করে।”
ঝিনুক একটুখানি লজ্জা পেল। আবার নড়েচড়ে বসে বলল, “এমন কিছু না। তখন আমি বাচ্চা ছিলাম।”
অঞ্জলি বেঞ্চে কনুই রেখে গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “কোন ক্লাসে ছিলেন আপনি?”
ঝিনুক একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “তারপর একদিন ফট করে শুনি ওর বন্ধু ও মিথিলার রিলেশনশিপ হয়ে গেছে। ফোনে কথা বলতে বলতে তাদের প্রেম শুরু। এমন হয় না’কি?”
“একদম না। তুমিও তো শুধু ফোলে কথা বলে, ক্রাশ খেয়ে এইটা চিন্তা করেছিলে যে উনি তোমাকে পছন্দ করে আর প্রপোজ করতে পারে। প্রেম তো তুমি একদমই করতে না শুধু ভাবতে। তাই না?”
“ওইটাই। আজকালকার পোলপানরাও না….ধ্যুর যাই হোক। এখন মিথিলা দেখা করতে যাবে তো যাবে। কাকে নিয়ে যাবে গেস কর।”
অঞ্জলির কাছে ঝিনুকের কথাগুলো অনেক বেশি মজা লাগছে। তার কখনো বেশি বন্ধু ছিলো না। যারা ছিলো তারা শুধু তার কাছে তার নোট’স এর জন্য কথা বলে। অবশ্য তাদেরকে বন্ধু বলাটা বেমানান হবে। তাই না?
ঝিনুকের সঙ্গ তার ভীষণ ভালো লাগছে। সে একটু চিন্তিত হওয়ার ভাব নিয়ে বলল, “তোমাকে?”
“একদম।” ঝিনুক বেঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে হাইবেঞ্চে বসে পড়লো। তারপর তালি মেরে বলল, “আর রিয়াজ ভাই মানে সৈকতের বন্ধুর সাথে কে এসেছে গেস কর। আচ্ছা থাক করা লাগবে না। শুধু শুধু বেশি চিন্তা করলে বুদ্ধি ক্ষয় হয়ে যাবে। সৈকত এসেছিলো।”
“আল্লাহ তাই? এইটা গেস করলে গেলে তো আমার মাথায় আর বুদ্ধিই থাকতো না। তারপর?”
“তারপর সেখানে যেয়ে দুইজনে কথা-বার্তা বলল কিছুক্ষণ। তারপর না’কি তাদের একাকিত্ব সময় লাগবে। আর তারা চলে গেলে সেখানে শুধু কে থাকে, আমি আর সৈকত। এখন তারা যাওয়ার পর সে আমার খোঁজ খবর এমনভাবে নিচ্ছিলো যেন সে কিছু করেই নি। আমিও কম না, আমিও একটা প্রশ্নেরও উওর দেই নি। অবশেষে সে যখন বলল, ‘আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে রাগ করেছ?’
‘আপনার এখনো মনে হচ্ছে?’
ও হেসে বলল, ‘ওকে, কেন রাগ করেছ জানতে পারি?’
আমি রাগান্বিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। উঁচু স্বরে বললাম, ‘মানে আপনি এমন ব্যবহার করেছেন যে আপনি আমার জন্য এতকিছু করছেন। এত বড় রিস্ক নিয়ে খালুর কাছ থেকে নাম্বার নিয়েছেন, দুইরাত ভরে আবার সাথে কথা বলেছে শুধুমাত্র আপনার বন্ধুর জন্য আমার বান্ধবীর নাম্বার নেওয়ার জন্য?’
ও হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে বলল,’অর্থাৎ তোমার ইচ্ছা ছিলো যেন আমি তোমাকে পছন্দ করি?’
আমি অন্যদুকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি এমনটা বলি নি।’
‘তোমার কথাগুলো তো এমনই শোনাচ্ছে।’
আমি ভেংচি কেটে সামনে হাঁটতে শুরু করলা। আমরা এক ব্রিজের ওপর ছিলাম। ও দৌড়ে এসে আমার পাশে হাঁটতে শুরু করল। এক হাত নিজের পকেটে রেখে অন্যহাতের আঙুল দিয়ে নিজের চুল আঁচড়ে বলল, ‘তুমি কিউট আছো বটে কিন্তু আমার টাইপের না।’
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। রাগে আমার শরীর জ্বলছিল। আমি বললাম, ‘নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়েন। গতরাতে একটা হোরার ফিল্ম দেখেছিলাম সেখানের ভূতটাও আপনার থেকে বেশি সুন্দর ছিলো।'”
ঝিনুক অঞ্জলির হাসি দেখে থেমে গেল। অঞ্জলি বলল, “তুমি জানো ভাইয়ার উপর কতজনের ক্রাশ আছে আর তাকে তুমি ভূত বলেছ।”
“ক্রাশ আছে মানে? তুমি আমাকে দেখাবে কোন মেয়েদের ওর উপর ক্রাশ আছে।”
“কেন?”
“কেন মানে? একটু তাদের শিক্ষা দিতে হবে না যে যার তার উপর ক্রাশ খেতে নেই। আমিও বুঝি না এ-সব আলতু-ফালতু পোলাপাইনরা এত হ্যান্ডসাম হয় কেন যে মেয়েরা ক্রাশ খেয়ে বসে থাকে?”
অঞ্জলি মাথা নাড়িয়ে নিজের ফোনের দিকে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাকি গল্প পরে শুনব। সাবেক মেসেজ দিয়েছে। তারা আসছে। আর অফকোর্স সে তার প্রথম ভালোবাসার কাছে সবার আগে যাবে। চলো আমরা ক্যান্টিনে যাই।”
ক্যান্টিনে যেয়ে ঝিনুক দেখে একটা টেবিলে বসে আছে সৈকত ও তার বন্ধুরা। এর মধ্যে পার্বতী আপু ও নীরা আপুকেও দেখতে পারছে সে। নীরা আপু সৈকতদের বন্ধুদের মাঝে তার প্রিয় ছিলো। আপু অনেক স্বাধীন মনোভাবের মেয়ে। একটু গুন্ডা টাইপের যার জন্য তাকে অতিরিক্ত ভালো লাগে ঝিনুকের। সে দৌড়ে গেল সেখানে। দূর থেকে নীরাকে ডাক দিলো। নীরাও ঝিনুককে দেখে উঠে দাঁড়ালো। বেশ খুশি দেখালো তাকে। ঝিনুক নীরাকে জড়িয়ে ধরতে যাবে তখনই সৈকত টেবিলে জোরে এক ঘুষি মেরে উঠে দাঁড়ালো। ভীষণ রাগান্বিত দেখাল তাকে। ঝিনুক থতমত খেয়ে গেল। কিছুইক্ষণ আগেও সৈকত হাসিখুশি ছিলো। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে না বলেছি আমাদের আশেপাশে আসবে না, কথা কী কানে যায় না না’কি?”
ঝিনুক হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। আশেপাশে তাকালো। অনেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে লজ্জায়, অস্বস্তিতে মাথা নামিয়ে নিলো। মৃদু কন্ঠে বলল, “আমি তো শুধু নীরা আপুকে……”
“এখনও দাঁড়িয়ে আছো এইখানে। হ্যাঁ, অনেক মেয়েরাই ব্রেকাপের পর এমন বাহানায় আবার কথা বলতে আসে আমার সাথে। যাও তো এইখান থেকে।” সৈকত উঁচু স্বরে বলল। ঝিনুকের কান্নাও আসছিলো আবার রাগও উঠছিলো। সে কাঁদোকাঁদো ও রাগান্বিত চেহেরায় তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। টেবিল থেকে একটা সসের বোতল উঠিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে মারলো। উঁচু স্বরে বলল, “আমি বলেছি না আমি নীরা আপুর সাথে দেখা করতে এসেছি তাহলে তুমি গাঁধার মতো চিল্লাচ্ছ কেন?”
সে সৈকতের দিকে আর না তাকিয়ে নীরার কাছে যেয়ে এক সেকেন্ডের জন্য তাকে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে বলল, “আপু মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তোমার সাথে পরে কথা হবে। কিছু ফালতু মানুষের শান্তি নেই।”
নীরার কথা না শুনেই সে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো। একটি খালি টেবিলে বসে পড়ল। অঞ্জলি এসে তার পাশে বসে বলল, “তুমি ঠিকাছ?”
“এই লোকটার ব্যাপারে আমি যখনই একটু ভালো ভাবতে শুরু করি তখনই তার এমন কিছু না কিছু করতে হবে যা দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। আই হেইট হিম, আই হেইট হিম সো মাচ।” ঝিনুক রাগে ফুঁপিয়ে বলল।
অঞ্জলি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “শান্ত হও।”
ঝিনুক কতগুলো বিড়বিড় করে গালি দিয়ে বলল, “শয়তানটা নিজেকে কী ভাবে! হ্যান্ডসাম দেখে বেঁচে গেছে একদম ঘি ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতাম।”
“হোয়াট ঘি ঢেলে….আর হ্যান্ডসাম মানে? তুমি কয়েক সেকেন্ড আগে বললে তুমি উনাকে ঘৃণা কর।”
“তো করিই তো। আই হেইট হিম বাট হি ইজ হ্যান্ডসাম। এখন এইটা ফ্যাক্ট। আমি এইখানে কী করতে পারি?”
অঞ্জলি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “বাহ কী থিউরি!”
সাবেক পাঁচ মিনিট পর। ঝিনুককে রাগান্বিত দেখে সে সামনের চেয়ার টেনে অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
অঞ্জলি সবটা খুলে বলল। সে জানতো না যে অর্ণব ঠিক তার পিছনে দাঁড়ানো। অর্ণব কথাগুলো শুনেই রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “ওই সৈকত ঠিক হবে না। ওকে একটা শিক্ষা না দিলেই নয়।”
অঞ্জলি পিছনে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো সাবেকের দিকে। বলল, “তুমি বলবে না যে অর্ণব ভাইয়া আমার পিছনে দাঁড়ানো?” উঠে আবার দাঁড়িয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি উনাকে থামাও, নাহয় বড়সড় একটা তামাশা হয়ে যাবে।”
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_২২
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
অঞ্জলি পিছনে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো সাবেকের দিকে। বলল, “তুমি বলবে না যে অর্ণব ভাইয়া আমার পিছনে দাঁড়ানো?” উঠে আবার দাঁড়িয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি উনাকে থামাও, নাহয় বড়সড় একটা তামাশা হয়ে যাবে।”
সাবেক অঞ্জলির হাত ধরে বলল, “আরে দরকার কী? একটু তামাশা হোক, আমরা সিঙ্গারা অর্ডার দেই। ফ্রী’তে মজার একটা সিনেমা দেখা হয়ে যাবে।”
অঞ্জলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সাবেকের দিকে। সাবেক আবারও বলল, “কয়টা সিঙ্গারা অর্ডার দেই?”
অঞ্জলি বিরক্ত হয়ে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঝিনুক তুমি কিছু একটা কর।”
“আমি তো ফুসকা খেতাম। সিঙ্গারার সাথে ফুসকা অর্ডার দেই?”
অঞ্জলি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। বিরক্তি নিয়ে বলল, “ঝগড়া থামানোর জন্য কিছু কর।”
“ধ্যুর কয়টা মেরে আসুক কার কী?”
“ঝিনুক এইটা মজার সময় না। অনেক বড় একটা তামাশা হয়ে যাবে। এমনিতেই অর্ণব ভাইয়া ও সৈকত ভাইয়া একে অপরের চরম শত্রু। কি না কি হয়ে যায় কে জানে? গতবার প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে খবর পৌঁছে গেছিলো। এইবারও যদি জানে একটা মেয়ের কারণে এইসব করছে দুইজনকে সাসপেন্সও করে দিতে পারে।”
ঝিনুক কিছুক্ষণ চোখ দুটো ছোট ছোট করে অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর উঠে গেল।
ইকবাল বলল, “দেখ অর্ণব আসছে। রাগে মনে হচ্ছে ওকে।”
নীরা বিরক্তি নিয়ে বলল, “নট আগেইন। ওর একবছর পুরনো আশিকী এখনো যায় নি? আবার একখানে একটা সিন ক্রিয়েট করতে এসেছে?”
“সম্ভবত না। সৈকতে ওর পছন্দের মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়েছিল, পরিবর্তে অর্ণব আমাদের সৈকতের বউকে মন দিয়ে দিয়েছেন।”
“হোয়াট দ্যা হেল! আমাদের ঝিনুককে এই আবালে পছন্দ করে?”
“মনে তো হয়।”
নীরা তার হাতটা মুঠোবন্দী করে তা বলে বলল, “দাঁড়া আমি মজা দেখিয়ে আসছি। আর কখনো ঝিনুকের উপর নজরও দিবে না।”
সৈকত ইকবাল ও নীরার কথোপকথনে কিছুই বলছিল না। সে শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সামনের দিকে। তার চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো। অর্ণব তাদের টেবিলের সামনে আসতেই সে উঠে দাঁড়ালো। প্রস্তুতি নিতে শুরু করল এক বিরাট ঝামেলার।
অর্ণব তার সামনে আসার পূর্বেই ঝিনুক তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, “আমার জন্য এত ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই।”
“ঝিনুক ও তোমার সাথে বাজে ব্যবহার….. ” ঝিনুক অর্ণবের কথা কেটে বলল, “আমি বলেছি আমার জন্য এ-সব ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই। ওর কথায় আমার কিছু আসে যায় না। চলুন আমার সাথে।” ঝিনুক অর্ণবের হাত ধরে তাদের টেবিলের দিকে ফেরত নিয়ে গেল। সৈকত কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে দৃশ্যের দিকে।
নীরা একটু কেশে বলল, “বুঝলি মামা কেউ তো জ্বইলা পুইড়া ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে।”
সৈকত সে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো নীরার দিকে। নীরা হাই তুলে বলল, “আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে লাভ নাই আমি এইসবে ভয় পাই না। এইবার বল ভার্সিটির পর কী বিশেষ প্লান আছে?”
.
.
ঝিনুক ভার্সিটির ক্লাস শেষে আসলো দুপুর আড়াইটায়। এসে ভীষণ ক্লান্ত ছিলো তাই গোসল করে ঘুম দিলো একটা। ঘুম থেকে উঠালো সৈকতের মা। ঝিনুক ঘুমের তালে ছিলো বিধায় নিজ হাত খাইয়ে দিলো তারপর অনেকক্ষণ গল্প করলো তার সাথে আবার গল্প করলো দাদীমা’য়ের সাথে। মানুষ বলে বিয়ের পর জীবনটা পরিবর্তন হয়ে যায় খারাপ দিকে। অথচ তার ভালোই লাগছে এই বাসায়। অবশ্য ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না দাদীমা পড়ার জন্য বকা দিয়ে পাঠালো তাকে রুমে। বই দেখলেই তার মাথা ঘুরানো শুরু করে। ছোট বেলায় ভাবতো বিয়ের পর সে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে। অথচ যে লাউ সেই কদু। পড়া বোধহয় জীবনেও পিছু ছাড়বে না।
ঝিনুক বই খুলে দেখে আজ ক্লাসে যা পড়েছিল সব তার মাথা থেকে ছুঁ মন্তর হয়ে গেছে। তবুও কিছুক্ষণ পড়ার ভান করা শেষে সে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। সৈকত তখনও এলো না। মা এক প্লেট খাবার তাদের রুমে দিয়ে গেছে। ঝিনুক ভেবেছিল সে ঘুমিয়ে পড়বে, ওই লোকটার অপেক্ষা করে কে? তবুও কী বুঝে অপেক্ষা করল। বিছানায় বসে বসে মোবাইল টিপছিল আর একটু পর পর তাকাচ্ছিল দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। তবুও সৈকত আসছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সামনে তাকাতেই দেখে সৈকত রুমে ডুকছে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে, গালে রক্ত জমে আছে হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সৈকত সোজা ওয়াশরুমে যেতে নিলেই ঝিনুক ডাক দিলো তাকে। সৈকত ফিরে তাকালো। ঝিনুক বিছানার উপরই দাঁড়িয়ে দুই কোমরে হাত রেখে বলল, “এইদিকে আসো।”
সৈকত ঝিনুকের দিকে গেলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
ঝিনুক ঝুঁকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে পর্যবেক্ষণ করল সৈকতের মুখখানি। জিজ্ঞেস করল, “এইসব কোথা থেকে করে এসেছ?”
“কোনসব?”
ঝিনুক সৈকতের গালে রক্তজমা স্থানে খোঁচা মেরে বলল, “এইসব।”
সৈকত তার গালে হাত দিয়ে বলল, “এইভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে হৃদয়হীনা নারী। আর তোমার কী? তুমি তো অন্যকারো চিন্তায় মরে যাচ্ছিলে, তার চিন্তাই কর। আমার চিন্তা করার কী প্রয়োজন?”
সৈকত ফেরত যেতে নিলেই ঝিনুক বিছানা থেকে নেমে তার দৌড়ে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। বলল, “এহ আসছে নিজে আমাকে সম্পূর্ণ ক্যান্টিনের সামনে অপমান করেছে তার কিছু না। আর এখন আমি স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি তুমি চুপচাপ বসবে।”
“কোনো প্রয়োজন নেই তোমার সেবা যত্নের।”
বলেই সে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে ঝিনুক ফার্স্ট এইড বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকত তার কাটিয়ে যেয়ে বিছানায় বসতেই ঝিনুক একটু তুলায় স্যাভলন নিয়ে ঝুঁকতেই সৈকত উঠে দাঁড়ালো। ঝিনুক তার কাঁধে হাত দিয়ে আবার বসায় আবারও উঠে দাঁড়ালো। ঝিনুক রেগে মেগে বলল, “সমস্যা কী তোমার?”
“আমি তোমার হাতে কিছু লাগাবো না।”
“কেন আমার হাতে কী কাঁটা লাগানো?”
“এমনই ভেবে নেও।” ঝিনুক কথাটা শুনে আবারও সৈকতকে বসিয়ে তার কোলে বসে পড়লো। সৈকত হতবাক। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। ঝিনুক বলল, “তাইলে কাঁটাই সহ্য কর।”
ঝিনুক আলতো করে ফুঁ দিলো সৈকতের গালে। আর স্যাভলন লাগিয়ে দিলো তার আঘাতের স্থানে। সৈকত ব্যাথা চোখ বন্ধ করে আবারও খুলল। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। আলতো করে তার কোমরে হাত আবদ্ধ করতেই কেঁপে উঠলো ঝিনুক। তাকাল সৈকতে দিকে। সৈকতের এমন মুগ্ধ নয়নে যেন ডুব দিলো সে।
.
.
ভীষণ অন্ধকার। চারদিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না শুধু আঁধার আর আঁধার। এক জঙ্গলের মাঝে আছে সে। চারদিকে কেউ নেই। সে দৌড়াচ্ছে গাছ পালার মাঝে। কিসের থেকে?
সে জানে না। জানে সে শুধু না পালালে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক বিকৃতি এক প্রাণী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশাল কালো এক ধূম্র দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ধূম্রটার বিশাল দুই চোখ, চোখ ও দুই হাত। সে হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠলো।
চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠতেই দেখে অর্ক তার সামনে বসা। তার দুই গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “প্রভা….., প্রভা তুমি ঠিক আছ? দুঃস্বপ্ন দেখেছ?”
প্রভা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে শুরু করল। বিস্মিত দৃষ্টিতে অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই’যে ওইটা……”
“কিছু নেই। তুমি স্বপ্ন দেখেছ শুধু।”
“কিন্তু…… ” প্রভা আর কিছু বলার পূর্বেই অর্ক তাকে বুকে টেনে নিলো। প্রভা আর কিছু বলল না। প্রভা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিল শুধু। অর্কের গেঞ্জিটা আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে।
প্রভার মা দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করল। আর বলল, “প্রভা…মা দরজা খুল….”
অর্ক প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমি বসো আমি দরজা খুলে আসছি।”
অর্ক উঠতে নিলেই খেয়াল করল প্রভা তার গেঞ্জিটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে, ছাড়ছেই সে। তার চোখে মুখে ভয়। অর্ক প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমি দুই মিনিটে আসছি।”
প্রভা অসহায় কন্ঠে বলল, “দয়া করে যেও না।”
অর্ক প্রভার মাথায় একটা চুমু খেয়ে তাকে বিশ্বাস দিয়ে বলল, “আমি ফিরে আসছি। চিন্তা কর না।”
প্রভা তাকে ছেড়ে হাঁটু দুটো গুঁজে নিলো। তার থুতনিটা হাঁটুর উপর রাখল।
অর্ক দরজা খুলে প্রভার মা’কে দেখে বলল, “ও বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছে।”
“না না বাবা দুঃস্বপ্ন না। ওর সাথে প্রায়ই এমন হয়। এই স্বপ্নই দেখে বারবার। ওই বিনয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কয়েকমাস আগের থেকে। বিনয় ওকে ডাক্তারকেও দেখিয়েছিল। এই স্বপ্ন দেখলে দুইদিন খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে দেয়। কিছু করতে পারে না। তুমি যেয়ে ঘুমাও বাবা, আমি রাতে ওর সাথে থাকছি।”
“না আন্টি আপনি যেয়ে ঘুমান। ও আমার স্ত্রী আমি ওকে সামলে নিব।”
“কিন্তু…..” অর্ক প্রভার মা’কে থামিয়ে দিয়ে তাকে জোর করে নিজের রুমে পাঠিয়ে দিলো।
রুমে যেয়ে দেখে প্রভা সে অবস্থাতেই বসে আছে। প্রভার সামনে বসে তার হাতের উপর হাত রেখে বলল, “ভয় পেও না। আমি আছি তোমার সাথে।”
প্রভা চোখ তুলে তাকালো অর্কের দিকে। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অর্কের বুকে মুখ গুঁজে নিলো।
অর্ক শক্ত করে প্রভাকে বুকে আঁকড়ে ধরলো।
চলবে……
[