মন পাড়ায় পর্ব ২৩+২৪

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_২৩
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সৈকতের এমন মুগ্ধ নয়নে যেন ডুব দিলো সে।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। নামিয়ে নিলো। এক ঢোক গিলে আবার গালের দিকে দৃষ্টি আটকালো। গালে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সে আলতো করে উপরের জমা রক্ত পরিষ্কার করতে শুরু করলো। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে হলো এমনটা?”

সৈকত ঝিনুকের কাঁধে নিজের কপাল ঠেকাল। বলল, “তোমার তো আমার চিন্তা করাটা অনুচিত তাই না? আরও অনেক মানুষ আছে যাকে নিয়ে তুমি চিন্তা কর। তাই আমার জন্য এতটুকুও চিন্তা করে নিজের সময় ব্যয় কর না।”

ঝিনুক একপলক তাকালো সৈকতের দিকে। তার কথা সম্পূর্ণ মাথার উপর দিয়ে গেল তার। তবুও কিছু বলল না। নিজের কাজ করতে শুরু করল।

সৈকত আবারও বলল, “তোমাকে আমি কি বলেছি আমার সবচেয়ে বেশি রাগ উঠে যখন কেউ আমার মা কষ্ট পায়?”

ঝিনুক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। সৈকত আবারও বলল, “আমি কি বলেছি আমার দ্বিতীয় কারণে রাগ উঠে যখন আমাকে ছাড়া অন্যকোনো ছেলে তোমার প্রেমে পড়ে?”

ঝিনুক আচমকায় চোখ তুলে তাকালো সৈকতের চোখের দিকে। সে কি বলবে বুঝতে পারলো না তাই চোখ নামিয়ে সৈকতে ঠোঁটের কাঁটা সাথে প্রথমে শুকনো তুলা দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করল এরপর ডেটল লাগাতে নিবে তখনই সৈকত ঝিনুকের কোমর আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে বিছানায় বসালো।

তার দৃষ্টিতে না কথাতে ভয় পেল ঝিনুক, সে নিজেই বুঝল না। সে বসা অবস্থাতেই একটু পিছালো যতক্ষণ না পর্যন্ত তার বালিশে পিঠ ঠেকলো। সে যত পিছালো সৈকত ততই সামনে এলো। অবশেষে ঝিনুকের কাঁধে দুইপাশে হাত দিয়ে বলল, “একটা প্রশ্নের শুধু উওর দেও, তুমি কী আমাকে ছাড়া কখনো অন্যকাওকে ভালোবাসতে পারবে?”

এটা কেমন প্রশ্ন? এই প্রশ্নের অর্থটা কী ঝিনুক বুঝতে পারলো না। সে কখনো অন্যকাওকে ভালোবাসার চিন্তাও করে নি বা অন্যকাওকে ভালোবাসে নি তাহলে সে কীভাবে জানবে? তখনই ঝিনুকের মনে পড়ল আজকের সকালে কীভাবে সৈকত সম্পূর্ণ ক্যান্টিনের সামনে তার অপমান করেছিলো। তাই সে বলল, “হয়তো।”
সুখের পরিবর্তে সুখ ও কষ্টের পরিবর্তে কষ্ট- এই কথাটা ঝিনুক সবসময় মেনে চলে।

সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। ঝাঁজালো গলায় বলল, “হয়তো?”
ঝিনুকের চুলের পিছনে হাতে গুঁজে নিয়ে তার আরও কাছে গেল। চোখে চোখ রেখে আবারও বলল, “আবারও বলোতো, হয়তো।”

ঝিনুক এক ঢোক গিললো সৈকতের এমন রূপ দেখে। তার শব্দগুলো যেন গলায় এসে জমাট বেঁধেছে। সৈকত তার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিলো।
ঝিনুকের চোখজোড়া হঠাৎ বড় বড় হয়ে গেল। ঝিনুক সৈকতের বুকে হাত রেখে তাকে দূরে সরাতে চেষ্টা করল। আজকে তার ছোঁয়াটা প্রেমময়ী নয়। রূক্ষ। ভীষণ রূক্ষ।

সৈকত ঝিনুকের হাতদুটো এক হাতে ধরে তার পিঠে নিয়ে রাখল। আর ডুবে রইলো ঝিনুকের মাঝে।

যখন ঝিনুককে ছাড়লো তখন সে কাঁদছিল। তার গালে হাত ছোঁয়াতেই ঝিনুক সৈকতকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার থেকে দূরে সরে গিয়ে বলল, “তুমি এত নিচু হতে পার আমি ভাবতেও পারি নি। আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে তুমি ছোঁয়ার সাহস কোথায় পাও?”

ঝিনুক ভেবেছিল অন্যান্য দিনের মতো আজও সৈকত নিজের ভুল মেনে চুপ থাকবে অথবা মাফ চাইবে। তার কথার উপর কথা তোলার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সৈকত বলল, “এক, তুমি আমার স্ত্রী। দুই, তুমি নিজে আমার কোলে এসে বসেছ। তিন, আমি তোমাকে কাছে টেনে নিয়েছি তুমি কিছু বলোনি, সেটা তোমার সম্মতি মানলে ভুল হয় না। চার, তুমি তোমার স্বামীর সামনে অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা বলছ। আমি তোমার স্বামী ঝিনুক। আমি চাইলেই তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্কও করতে পারি কিন্তু আমি এমন কিছু করছি না। কিন্তু তুমি দিন দিন আমার ধৈর্য ভেঙ্গে দিচ্ছ।”

“বাহ, ক্যান্টিনে তুমি সবার সামনে আমার অপমান করেছ আর এখন সব দোষ আমার?”

“আমি যা করছি শুধু তোমার জন্য করেছি।”

“আমাকে কষ্ট দিয়েছ আমার জন্য?”

সৈকত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এমনটাই কিছু ভেবে নেও।”

যেতে নিলেই ঝিনুক তার বাহুর শার্ট আলতো করে ধরে নিলো। ভেবেছিল মোটেও মানুষটার চিন্তা করবে না। প্রতিবারই ভাবে। ভেবেও অবশেষে তার চিন্তা না করে পারে না। কেন? কেন হয় তার সাথে এমনটা। এর কষ্ট পেয়েও কেন ভালোবাসে এই মানুষটাকেই?

সৈকত জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”

“আঘাতগুলোতে ডেটল লাগিয়ে দেই।”

“যদি আবারও কষ্ট দেই?”

“দিও। তবুও আসো।” মনে মনে বলল, “আমার তোমার ক্ষতগুলো দেখে বেশি ব্যাথা লাগছে যে, তার কী?”

সৈকত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে তাকালো ঝিনুকের দিকে। এক হাত ভরে দিলো ঝিনুকের খোলা চুলে। অন্যহাত দিয়ে তার চিবুকে হাত দুয়ে মুখ তুললো তার। আলতো করে চুমু খেল ঝিনুকের ঠোঁটে। ঝিনুক এইবার বাঁধা দিল। বিলিয়ে গেল সৈকতের ছোঁয়ায়। হারিয়ে গেল। এই ছোঁয়াটা রুক্ষ ছিলো না। মধুর ছিলো।
.
.
সারারাত প্রভা ঘুমালো না। না অর্ক ঘুমাতে পারল। প্রভা ভয় তার মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো অর্ক। যতই ওকে কষ্টে দেখছিল ততই তার বুক কেঁপে উঠছিল।
প্রভা সকালে আযান দেওয়ার পর অর্কের বুক থেকে সরে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন সে সবে বুঝতে পেরেছে যে সে এতক্ষণ ধরে অর্কের বুকের মাঝারে মাথা রেখেছিলো। লজ্জায় সে একটিবারও তাকায় নি অর্কের দিকে। তার গালদুটোয় সে কী গোলাপি আভা!

অর্ক সকাল আটটার দিকে ফোন দিলো বিনয়ের মা’কে। বিনয়ের মা ফোন ধরেই বলল, “আরে বাবা আজ হঠাৎ এত সকাল সকাল ফোন দিলে যে? কোনো দরকার ছিলো?”

“জ্বি খালা। কিছু জানার ছিলো।”

“হ্যাঁ, বাবা বলো।”

“খালা প্রভার কী কোনো সমস্যা ছিলো? মানে শুনলাম বিনয় না’কি ওকে ডাক্তার দেখাতো।” অর্ক প্রশ্ন করার সাথে সাথে বিনয়ের মা উওর দিলো, “আরে বাবা ও তো পাগল। বিনয় ওকে পাগলের ডাক্তার দেখাতো। তোমাকে না বলেছিলাম?”

অর্কের কাছে উওরটা বেশ বাজে মনে হলো। অন্তত শুনতে ভীষণ খারাপ লাগলো। সাধারণত অর্ক বিনয়ের মা’কে ফোন দিলে তার খোঁজ খবর নেয় আর কিছু প্রয়োজন আছে নাকি জিজ্ঞেস করে। আজ করল না। সে বলল, “আচ্ছা খালা এতটুকু জানার ছিলো। এখন রাখি।”

“বাবা শোনো, আমি জানি তোমাকে অনেক জ্বালাই আমরা কিন্তু ফাতেমার ভার্সিটির কিছু বেতন বাকি ছিলো। যদি তুমি…..” অর্ক তার কথা কেটে বলল, “আমি ঢাকা এসেই আপনাদের বাসায় আসছি খালা।”

“আচ্ছা বাবা আল্লাহ তোমাকে বাঁচায় রাখুক। আসো আসো। আমি তোমার পছন্দের কিছু রান্না করব নে।”

অর্ক ফোন রাখতেই দেখে প্রভা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক প্রশ্ন করল, “কিছু বলবে?”

প্রভা তাকাল না অর্কের দিকে। চোখ দুটো মেঝেতে আটকে রেখে বলল, “নাস্তা করার জন্য মা ডাকতে বলেছে।”
বলে সেখান থেকেই যেতে নিলে অর্ক বলল, “এদিকে আসো।”

প্রভা কুড়কুড় করে এসে হাজির হলো অর্কের সামনে। অর্ক আদেশের সুরে বলল, “বসো।”

প্রভা বসলো বিছানার ঠিক অপরদিকে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “তুমি অসুস্থ?”

আজ প্রভাত হতে প্রথম প্রভা অর্কের দিকে তাকালো। একপলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। আঙুল দিয়ে খেলতে শুরু করল। বলল, “আপনি বলেছিলেন আপনি আমার ব্যাপারে যা জানার সবই জানেন তাই এই ব্যাপারটা আলাদাভাবে বলি নি। আমি ভেবেছি আপনি জানেন।”

“আমার উওর এইটা না। তুমি অসুস্থ?”

“জানি না, এইটাকে অসুস্থ বলা হয় না’কি?”

“তুমি কোন ডাক্তার দেখাও?”

“দুইবছর ধরে দেখাই না। আগে দেখাতাম। সাইকিয়াস্ট্রিট
দীপ্তি চক্রবর্তী।” বলেই প্রভা ভীতিকর দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। সে ভেবেছিলো অর্ক রাগ করবে বা অন্যকিছু কিন্তু সে স্বাভাবিক। অর্ক আবারও জিজ্ঞেস করল, “তাহলে হঠাৎ বন্ধ করলে কেন?”

“ভালো লাগে না তাই।”

“গতরাতে যে ভীতিকর অবস্থায় ছিলে তা আমি দেখেছি। তোমাকে দেখে আমার…..” বলতে বলতেই থেমে গেল অর্ক। গলা পরিষ্কার করে আবারও বলল, “এই ভয়ের মধ্যে বাঁচতে ভালো লাগে। ডাক্তার দেখাতে না তাই না? ফাইজলামি কর আমার সাথে? আমরা ঢাকায় যেতেই উনার সাথে দেখা করছি।”

প্রভা ম্লান মুখে তাকালো অর্কের দিকে। বলল, “কিন্তু এইটা তো স্বাভাবিক ডাক্তার না। অর্থাৎ কোনো রোগের ডাক্তার না। গেলেও মানুষ নানারকম কথা বলে। আমি যাব না।”

“মানুষের কথায় কান নিয়ে নিজের শরীর খারাপ করছ তুমি?” অর্ক কথাটা এতটা জোরে বলল যে ভয়ে প্রভা দাঁড়িয়ে পড়ল। অর্ক আবারও রাগান্বিত স্বরে বলল, “দাঁড়িয়ে গেছ কেন? আমি দাঁড়াতে বলেছি তোমাকে?”

প্রভা কাঁদোকাঁদো চেহেরা নিয়ে মাথা ডানে বামে নাড়ল। অর্ক আগের মতো রাগান্বিত স্বরে বলল, “এদিকে আমার কাছে আসো।”

প্রভা নড়ল না। সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। অর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো প্রভার দিকে। আবারও বলল, “কানে কথা যাচ্ছে না? এদিকে আসো।”

প্রভা কুড়কুড় করে অর্কের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। অর্ক বলল, “এইটা কোন ধরনের অস্বাভাবিক রোগ তোমার মনে হয়? তোমার জ্বর বা অন্যকোনো অসুখ হলে তুমি যেমন ডাক্তার কাছে যাও তেমনি এইটাও একটা রোগ। মানসিক অশান্তির কারণে অনেকের বাঁচাটাও দুষ্কর হয়ে পড়ে একসময়। শরীর এক রোগ শুধু এক অংশকে ক্ষত করে অথচ মানসিক অশান্তি সম্পূর্ণ তোমাকে ক্ষত করে দেয়। আমি বুঝি না আজকাল নিজের চিন্তাভাবনা পাল্টাচ্ছে অথচ এইসব দিকে সবার চিন্তাভাবনা পাল্টাতে সমস্যা। তুমি আমার সাথে যাচ্ছ, বুঝেছ?”

প্রভা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। অর্ক উওর না পেয়ে আবারও ধমকের সুরে বলল, “কী কানে যায় নি কথা?”

প্রভা কেঁপে উঠলো। দ্রুত গতিতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। অর্ক বলল, “গুড। এখন যাও আমি কিছু মিনিটে আসছি নাস্তা করার জন্য।”

অর্ক নিজের ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। প্রভা সুযোগ পেয়ে একপ্রকার বাচ্চাদের মতো দৌড়ে চলে গেল। অর্ক আড়চোখে প্রভার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। মেয়েটা এভাবে ভয় পেলে বোধহয় একটু বেশিই কিউট লাগে তাকে।
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_২৪
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সৈকত ইকবাল ও নীরার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। নীরা সামনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওর আবার কী হইসে?”

সৈকত পিছনে তাকিয়ে দেখে নিহিন তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। নিহিন এসে হাঁপাতে শুরু করল। নীরা খোঁচা মেরে বলল, “কী’রে বাপু তোর পিছে কী তোর গার্লফ্রেন্ড চাকু নিয়ে ঘুরতাছে না’কি?”

“হুদাই ফালতু কথা কইবি না তো।” সৈকতের দিকে তাকিয়ে নিহান আবার বলল, “ওই জ্যোতি ঝিনুককে ধরছে।”

সৈকত এক গাছের নিচে বসে ছিলো। কথাটা শুনতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাথে নীরা ও ইকবালও। সৈকত চিন্তিত সুরে বলল, “হোয়াট দ্যা হেল! কী হইছে ঠিক জানিস?”

“আমি যেয়ে দেখি ভিড়। ভাবলাম উঁকি মেরে দেখি ইন্টারেস্টিং কিছু হয় না’কি? দেখি ঝিনুক ও জ্যোতি ঝগড়া করছে। ঝিনুকের বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করায় বলে তেমন কিছুই হয় নি, ওরা দুইজন যাচ্ছিল কথা বলতে বলতে। কখন জ্যোতির সাথে ধাক্কা খেল বুঝতে পারে নি। সরিও বলেছে ঝিনুক। তারপরও না’কি জ্যোতি ইচ্ছা করে কথা বাড়াচ্ছে।”

নীরা বিরক্তির সুরে বলল, “এই মাইয়া আমাদের আর জীবনে শান্তি দিব না। আমি কইসিলাম আমি কয়টা মাইরা টাইরা হাস্পাতাল পৌঁছায় দেই। তোরা তো সাধুগিরি করার লাইগা করতে দিলি না। একেকটা আবাইল্লা।”

সৈকত আড়চোখে একবার নীরার দিকে তাকিয়ে নিহানকে বলল, “কোথায় কান্ডটা ঘটছে?”

“ঝিনুকের ক্লাসের সামনেই।”
.
.
অন্যদিকে, ঝিনুক নিজেকে শান্ত রাখার জন্য দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার কথা শুনুন, এইখানে তো এত চিল্লাচিল্লি করার কিছু নেই। আমি বলেছি তো আমার ভুল হয়ে গেছে আমি ক্ষমা চাইছি এরজন্য।”

“মানে তুমি এখন এমন দেখাচ্ছ যে আমি ভুল করছি? যেখানে তুমি ইচ্ছা করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফালিয়ে দিয়েছ।”

“আজব তো আমি আপনাকে চিনি না জানি না আপনার সাথে আমি এমন কেন করব?”

“কারণ তুমি তোমার বোনের মতো সাইকো।”

ঝিনুকের কপাল কুঁচকে গেল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমার বোনকে না চিনে উল্টাপাল্টা কথা বলছেন।”

“ওহ প্লিজ, আমার তোমাদেরকে চেনা আছে। বিশেষ করে তোমার বোনকে। শী ইজ মেন্টালি সিক। আর মজার কথা হলো তার স্বামী মৃত্যুর দুইবছরের মধ্যে স্বামীর বন্ধুকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে। বাহ! আর তুমিও তো কম না। বোনের দেবরের সাথে একসময় রিলেশন ছিলো। ব্রেকাপ হওয়ার পর ছেড়েই না দিবে কিন্তু না তার পিছু পিছু ঘুরছ আবার তাকে ফাঁসানোর জন্য। এর জন্য এই ভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছ তাই না? ওয়েট, তুমি তো বেহায়ার মতো তোমার বোনের শশুড়বাড়িতে থাক তাই না? তুমি আর তোমার বোন দুইজনই নিলজ্জ।”

ঝিনুক নিজের চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। হলো না। নিজের কথা তাও সে সহ্য করে নিবে কিন্তু তার বোনকে কীভাবে কেউ কিছু বলতে পারে? তার মনে হচ্ছে তার হচ্ছে দেহের ভিতরে বয়ে যাওয়া রক্ত টগবগ করে ফুটছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে সে মেয়েটার গালে জোরে একটা থাপ্পড় মারল। মেয়েটার মুখের সামনে আঙুল তুলে বলল, “খবরদার আমার আপির ব্যাপারে একটা কিছু বললে এইখানে মেরে কবর দিয়ে দিব।”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “এইতো নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দিলে। তুমিও তো তোমার বোনের মতো। তুমি তো তাও ধমক দিচ্ছো তোমার বোন তো…..” হঠাৎ সৈকতের কন্ঠে থেমে গেল জ্যোতি। সৈকত এসে দুইজনের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “এইখানে দুইজন কী তামাশা শুরু করেছ? মানুষ দেখছে।”

ঝিনুক নালিশে সুরে বলল, “ও আপির ব্যাপারে কত আজেবাজে বকছে জানো? আমার আর আপির ব্যাপারে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে।”

“তোমার বোন আমার পরিবারের সাথে কী করেছে তা জানো? কতগুলো জীবন নষ্ট……” সৈকত জ্যোতির কথা কেটে নরম সুরে বলল, “জ্যোতি তোমাকে না বলেছিলাম ভার্সিটিতে আসবে না। তুমি না অসুস্থ? চল তোমায় বাসায় দিয়ে আসছি।”

ঝিনুক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার কথাগুলো যেন গলায় জমাট বেঁধেছে। সে বলেছে যে মেয়েটা তার ও প্রভা আপির ব্যাপারে খারাপ কথা বলেছে তাও সে এত সুন্দর ভাবে কথা বলছে মেয়েটার সাথে?

জ্যোতি সৈকতের বাহু আঁকড়ে ধরলো। বলল, “তুমি জানো ও আমাকে প্রথমে ধাক্কা দিয়েছে। আমি হাঁটুতে ব্যাথা পেয়েছি তারপর থাপ্পড়ও দিয়েছে। আমি শিউর জান আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড দেখে ও এমনটা করছে। ও আবার তোমাকে পেতে চায় তাই আমার সাথে এমন করছে।”

গার্লফ্রেন্ড? মেয়েটা সৈকতের গার্লফ্রেন্ড? ঝিনুকের হঠাৎ মনে হলো তার শরীরে সকল শক্তি মুহূর্তে হাওয়ায় মিশে গেছে। অবশ লাগছে নিজেকে। সে চোখ নামিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেললো। সে বুঝছে তার চোখ দিয়ে জল বয়ে যাওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে।

এমন না যে সে জানতোনা যে সৈকত এমন। তার কতগুলো গার্লফ্রেন্ড ছিলো সে জানতো। তার চরিত্র ভালো না তাও জানত, এইজন্য এককালে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু সে এতদিনে বুঝেছিল ও পাল্টেছে। তাকে বিশ্বাস দিয়েছিল যে সৈকত তাকে ভালোবাসে। এত ভালো অভিনয় কীভাবে করতে পারে কেউ?

সে নিজেকে সংযত করার প্রচুর চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না। কিছু বলতেই পারলো না। শুধু সৈকতের কথা শুনতে পেল, “আচ্ছা বাসায় চলো আমরা গাড়িতে বসে কথা বলছি। তোমার সবার সাথে কথা বলে নিজের মুড নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”

ঝিনুক চোখ তুলে তাকাতেই তার চোখের কোণে দিয়ে জল বেয়ে পরলো। সে দেখল মেয়েটা সৈকতের হাত জড়িয়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছে অন্য পথে।
সৈকত এক পিছনে ফিরে তাকাতেই ঝিনুকের চোখে চোখ পরলো। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো সে।
ঝিনুক তাকিয়ে রইলো তাদের যাওয়ার পথের দিকে। তার হৃদপিণ্ডে অসম্ভব পীড়ন হচ্ছে।
.
.
ভার্সিটির পিছিনের দিকে একটা বার্স্কেটবল কোর্ট আছে। সেখানে একপাশে আছে বড় মাপের সাদা তিন ধাপের সিঁড়ি আছে। কোর্টটা এই মুহূর্তে খালি। শুধু দেখা যাচ্ছে দুইজনকে। ঝিনুক মুখে হাত রেখে কাঁদছে ও অঞ্জলি তার পাশে বসে আছে চুপচাপ। এতক্ষণ ভরে অনেক সান্ত্বনা দেওয়া সত্ত্বেও বিশেষ লাভ হলো না তাই অবশেষে হাল ছাড়তে হলো তাকে। অর্ণব ও সাবেককে ফোন দিয়ে সবটা বলেছিল তারা আসছে না। আবারও যখন কল দিতে নিলো তখন এলো তারা।

অর্ণব ইশারা দিতেই অঞ্জলি উঠে গেল। অর্ণব এসে পাশে বসলো ঝিনুকের। ঝিনুকের মুখ থেকে আলতো করে এক হাত সরিয়ে দেখল তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। অর্ণব বিস্মিত কন্ঠে বলল, “তুমি নিজের এই কী অবস্থা করে নিয়েছ? তাও ওই সৈকতের জন্য? তোমার মনে হয় তোমার এই কান্না দিয়ে ওর কিছু হবে? ও কখনো ভালো হবে না। সবাইকে এইভাবে ব্যবহার করে ছেড়ে দিবে শুধু। অতীতেও তোমার সাথে এমন করেছে। এখনো করতে চাচ্ছে। তোমার ওর থেকে দূরত্ব বজায় রাখাটাই ভালো হবে।”

ঝিনুক তাকালো অর্ণবের দিকে। দেখল তারও মুখে আঘাতের চিহ্ন। জিজ্ঞেস করল, “গতকাল কী আপনার সাথে সৈকতের মারামারি হয়েছিল?”

অর্ণব মাথা নিচু করে নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “তোমাকে কেউ কষ্ট দিলে আমার সহ্য হয় না তাই।”

ঝিনুক তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে। ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে প্লিজ ঝামেলা করবেন না। আমি এইখানে কিছুদিনের মেহমান মাত্র। জলদি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব।”

ঝিনুক সিঁড়ির এক ধাপ নামতেই অর্ণব তার হাত ধরে ফেললো। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবে?”

ঝিনুক তার হাতটা ছাড়িয়ে বলল, “সময় আসলে জানবেন। আর আমার জন্য আপনার কিছু করার প্রয়োজন নেই। এইসব আমার অপছন্দ।”
ঝিনুক চলে গেল সেখানে থেকে। তার পিছনে গেল অঞ্জলিও।
.
.
অর্ক সারাটাদিনে দেখল না প্রভাকে। সম্ভবত সকালের কথাটায় ভীষণ ভয় পেয়েছে, নাহয় রাগ করেছে। সারাটা ঘরে খুঁজে পেল না প্রভাকে। সে সাধারণত সামলায় বিনু ও অদিনকে। কিন্তু তারা ঘুমায় এ সময়। এ সময়টায় সে কী করে অর্ক জানে না। অর্ক সারা ঘরে না পেয়ে ছাদে যেয়ে পেল প্রভাকে। সে দাঁড়িয়ে উদাসীন মনে তাকিয়ে ছিলো নিচে। অর্ক যেয়ে দাঁড়ালো তার পাশে। একপলক নিচে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখছ?”

প্রভা অর্ককে দেখে চমকে গেল। মুহূর্তে তার গতরাতের কথা মনে পড়ল। তার গালদুটো লজ্জার লালিমায় রঙে গেল। প্রভা একটু পিছিয়ে ছাদের বর্ডার থেকে একটি শুকনো পাতা হাতে নিয়ে ঠোঁটের কোণে এক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “বসন্ত আগমন দিচ্ছে তা দেখছি।”

“তুমি ভয় পাচ্ছ আজ সকালের বকায়?”

প্রভা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, এমন কিছু না।”

“তাহলে সকাল থেকে আমার থেকে পালাচ্ছো কেন?”

প্রভা খোঁপা করা ছিলো। তার সামনের কিছু চুল হয়েছিল এলোমেলো। সে মাথা নামিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল, “গতরাতের জন্য।”

“তুমি ভয় পেয়েছিলে তাই?”

প্রশ্নটার উওর প্রভা দিলো না। তার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। অথচ তার অস্বস্তি দেখেই অর্ক তার উওর পেয়ে গেল। সে প্রভার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো।
প্রভা যখন অর্ককে তার সামনে দেখলো তখন পিছাতে চাইলো একটু পারলো না। আর কোনো জায়গা খালি নেই যে পিছনে। সে মৃদুস্বরে বলল, “আমার কিছু কাজ আছে আসছি।” বলে যেতে নিলেই অর্ক তার দুই হাত প্রভার দুইপাশের বর্ডারে রেখে তাকে আটকালো।
প্রভা লজ্জায় ও অস্বস্তিতেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে।

অর্ক জিজ্ঞেস করল, “গতকাল আমি তোমাকে বুকে নিয়েছিলাম তাই?”

প্রভা চোখ তুলে তাকাতেই অর্কের চোখে চোখ পরল। সাথে সাথে তার চোখ নামিয়ে নিলো। তার গালদুটো ভারী ভারী লাগছে। সে কী লজ্জা পাচ্ছে? না অন্যকোনো কারণে এমন হচ্ছে।

অর্ক তার আরেকটু সামনে এলো। এতটা কাছে এলো যে তার নিশ্বাসের উষ্ণতা তার মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার কেমন যেন লাগছে এই উষ্ণ ছোঁয়ায়। তার মনে হচ্ছে তার দমটা গলায় আটকে গেছে। এর থেকে বেশি লজ্জা অর্কের জন্য পাবে তা সে কখনো ভাবে নি কিন্তু পেল সে। যখন অর্ক তার খোঁপার কাঁটা খুলে দিলো। বসন্ত আগমনের হাওয়া বইছিল সে মুহূর্তে। সাথে বইছিল তা ঘন কালো কেশগুলো। তার একপাশ থেকে হাত সরানো হয়েছে। সে চাইলেই পালাতে পারতো এই বিদঘুটে পরিস্থিতি থেকে। কিন্তু পারলো না। তার মনে হচ্ছে সে চেয়েও নড়তে পারছে না।

প্রভা চোখ তুলে তাকাতেই আরেকদফা দৃষ্টিমিলন ঘটলো। অর্ক সে কেশের একটুখানি অংশ তার হাতে নিলো সে খোলা চুলে আলতো করে চুমু খেল।

প্রভার ত্বকে্র কোনো অংশে অর্কের ঠোঁটে ছোঁয়া লাগলো না। তবুও সে কেঁপে উঠলো। তার বুকের ভেতরটাও কেঁপে উঠলো।

অর্ক বোধহয় আজ তাকে এই লজ্জায় শেষ করার জন্য কোনো পরিকল্পনা করে এসেছে। সে তার কানের কাছে এসে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘কুয়াশাময় সকাল ভোরে
তোমায় দেখেছিলাম নয়ন ভরে,
কোকিলের সুরে, ফুলের সুরভীর ভিড়ে
উপস্থিত হলো প্রিয় বসন্তিকা।’

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here