মন পাড়ায় পর্ব ৩+৪

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অর্ক হেসে বলল, “ওয়েলকাম টু হেল, সুইটহার্ট।”
প্রভা তাকালো অর্কর দিকে। সাথে সাথেই ছবি তোলা হলো।
.
বাড়ির নাম স্বপ্নপুরী। কিন্তু বাড়ির পরিবেশটা স্বপ্নলোকের মতো নয়। বাড়িটা বাহির থেকে একটি সুন্দর পরিবার দেখালেও চার দেয়ালের মাঝে বিষন্নতা ভরা। বাড়ির কর্তা মাহমুদ হাবিবুল। তার তিন ছেলে অর্ক, ভাদ্র ও সৈকত। অর্ক ও ভাদ্র তার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। অর্ক তার সবচেয়ে পছন্দের ছেলে। সেই তার সকল কাজে সহয়তা করে। পরিবারের দায়িত্ব পালনে যেমন গাফলতি নেই তেমনি অফিসের প্রতিটি কাজ সাফল্যের সাথে করে। অর্ককে তিনি অনেক আদর করলেও ভাদ্রের প্রতি তার যত্ন সবচেয়ে বেশি। কারণ সে অস্বাভাবিক। আল্লাহ তাকে প্রতিবন্ধী করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী অসুখে মারা যাবার দুই বছর পর তার বাচ্চাদের সামলানোর জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করে রোমার সাথে। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে তার সবচেয়ে ছোট সন্তান সৈকত। বিয়ে করলেও কখনো সে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী না মর্যাদা দিতে পেরেছে আর না সে ভালোবাসা। অর্কের মা’কে সে যে ভালোবাসা দিয়েছে তা অন্য কাউকে দিতে পারার কথা সে ভাবতেও পারে না। তাকে সঠিক মর্যাদা না দেওয়ার আরেকটি কারণ হলো তার ছোট ছেলে সৈকত। যেমন বেখেয়ালিপনা তেমন বেয়াদবি করে ছেলেটা। এইজন্য সৈকতের সাথে তার কথা তেমন হয় না। সৈকতের সাথে তার বাবা ও বড় ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো না হলেও ঘরের সবাই তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার দাদিমা, মা, ভাদ্র ভাইয়া। এমনকি অর্কও। একসময় অর্ককে সে মনে প্রাণে সম্মান করলে এক অজানা কারণে এখন আর অর্কের সাথে এখন তার ভালোমতো কথা বলে না। আর এ ঘরের সবচেয়ে বড় দাদিমা। যার কথা কেউ অমান্য করে না। এবং আজ আরও চারটি সদস্য যুক্ত হতে যাচ্ছে। এ ঘরের দুই বউ প্রভা ও ঝিনুক এবং প্রভার আগের ঘরের দুটো ছেলে-মেয়ে বিনু ও অদিন।

অনুষ্ঠান শেষে রাতে বাসায় এলো সবাই। ঘরে মানুষ ভর্তি। সবাই নতুন বউদের দেখতে ব্যস্ত। বিশেষ করে ঝিনুককে। কেননা সবাই শুনেছে মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর। দাদিমা পরে ঝিনুক ও প্রভাকে এক রুম দিলো আর ব্যবস্থা করে দিলো যেন সেখানে কেউ না যায়। তাদের সাথে তাদের এক খালাতো বোনের আসার কথা ছিলো শেষ মুহূর্তে এলো না। রুহানি অবশ্য এসেছে তবে সে বাহিরে।

ঝিনুক বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপি মানুষ কেন যে বিয়ে এত ধুমধাম করে করতে যেয়ে এত মানুষকে ডাকে। সবার সাথে হেসে কথা বলতে বলতে আমার চাপা ব্যাথা হয়ে গেছে। এর উপর এত ভারী লেহেঙ্গা মনে হচ্ছে লোহা দিয়ে তৈরি করে আনলো, ধ্যুর!”

প্রভা হেসে বিছানার পাশে সাইড বাক্সের উপর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঝিনুককে দিয়ে বলল, “পানি খেয়ে নে ভালো লাগবে।”

ঝিনুক তাই করলো। ক্লান্ত সুরে বলল, “আমার সেই ঘুম ধরেছে।”

“এইখানে ঘুমিয়ে পর।”

“একদম না। তোমার ও দুলাভাইয়ের আজ বাসররাত আমি কি নষ্ট করব না’কি?”
কথাটা শুনা মাত্র প্রভার মুখের হাসি মলিন হয়ে গেল।

ঝিনুক তা দেখে প্রভার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতের উপর হাত রেখে বলল, “আপি তুমি কী এখনো বিনয় ভাইয়ার কথা ভাবছ?”

প্রভা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে মাথা ডানে বামে নাড়ালো। ঝিনুক আবারও বলল, “মিথ্যে বলোনা আপু তোমার মুখ বলছে তুমি এখনো ভাবছ বিনয় ভাইয়ার কথা। আর কত আপু? দুই বছর হতে এসেছে তার মৃত্যুর। এখন সে নেই, তবে তাকে মনে রেখেছ কেন?”

“এখন বুঝবি না ময়না পাখি, কাউকে যখন ভালোবাসবি তখন বুঝবি।”

ঝিনুক ম্লান হাসলো। মনে মনে বলল, “তোমাকে যদি বলতে পারতাম এই ভালোবাসার বিষ আমিও পান করেছি — শুধু যদি বলতে পারতাম। কিন্তু তোমার ধাঁধার মতো জীবনটাকে আর পেঁচাতে চাই না। এত কষ্টের পর এক মুঠো সুখ পেয়েছ তার আবারও দুঃখে পরিণত করতে চাই না আপি।”

প্রভা ঝিনুকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় হারিয়ে গেলি?”

ঝিনুক তাকালো প্রভার দিকে। মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, কোথাও না।”

প্রভা ঝিনুকের গালে হাত রেখে বলল, “সৈকতের কথা ভাবছিস? চিন্তা করিস না, সৈকতের মাঝে হয়তো একটু বাচ্চামি আছে এখনো। বেখেয়ালিভাবে জীবন বাঁচে তবে মনের অনেক ভালো।”

“কচু ভালো। একদম একটা শয়তানের হাড্ডি।”

প্রভা হেসে বলল, “এভাবে বলতে নেই। আমরা সবসময় চোখের সামনে যা দেখি তা হওয়াটা জরুরি না।” পরক্ষণেই গম্ভীর মনোভাব নিয়ে আবারও বলল, “কখনো আমরা পাথরকে হিরা ভেবে তার যত্ন নিই আর হিরাকে পাথর ভেবে অবহেলা করি।”

“আমি কিছুই বুঝি নি আপি।”

“সহজ কথা। মানুষ বাহির থেকে যেমন দেখতে ভিতর থেকে তেমন হবে এমনটা প্রয়োজন নয়। অনেকসময় বেখেয়ালি দেখায় এমন মানুষও যত্নবান হয় আর অনেকসময় যত্নবান দেখায় এমন মানুষও অবহেলা করে।”

“জিরাফের মতো দামড়া। মাথা তুইলা তাকাইতে তাকাইতে আমার ঘাড় ব্যাথা হয়েছে।” ঝিনুক কথা বলার দরজা খুলে ঢুকলো অর্ক।

অর্ক ভিতরে ঢুকে বলল, “দুই বোনের কথা শেষ।”

প্রভা ও ঝিনুক অর্কের দিকে তাকাল। ঝিনুক অর্কের সামনে যেয়ে দুষ্টুমি করে বলল, “কেন জিজু আমাকে ভাগানোর তাড়া আছে না’কি?”

“দাঁড়াও চিন্তা করতে দাও।” অর্ক কিছু সেকেন্ড চিন্তার ভান করে সাথে সাথে বলল, “একদম।”

ঝিনুক হেসে বলল, “চিন্তা করেন না দুলাভাই, আমি সারারাত তো থেকে আপনাদের বাসররাত নষ্ট করব না। আমাকে মেহমানদের রুম দেখিয়ে দেন আমি চলে যাচ্ছি।”

“মেহমানদের রুম মানে! তুমি এ ঘরের বউ তুমি মেহমানদের রুমে কেন থাকবে? সৈকতের রুম সাজানো হচ্ছে। আমি আগেই ফোন করে বলে দিয়েছিলাম যেন ওর রুমটা সাজিয়ে দেয় আর তোমার জিনিস ওর রুমে রেখেও এসেছি।”

ঝিনুককে এতটা খুশি দেখাল না। সে মুখ মলিন করে বলল, “কিন্তু ভাইয়া আমি সৈকতের সাথে থাকতে চাই না।”

“তুমি না চাইলেও সৈকত তোমার স্বামী। আর এখন তোমার এটা মেনে নেওয়া উচিত।” অর্ক ঝিনুকের মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলল, “দেখো তুমি আমার ছোট বোনের মতো। সে ছোট থেকে তোমাকে দেখে আসছি। আমি তোমার জন্য খারাপ চাইব না। তোমার বিয়েতে যখন আমার মত দাদিমা চেয়েছিলেন আমি তখন ভেবে চিন্তেই হ্যাঁ বলেছি। সৈকতকে হয়তো বাহির থেকে বেখেয়ালি দেখায় কিন্তু ও সবাইকে অনেক ভালোবাসে। সবার যত্নও নেয়, শুধু দেখায় না।”

ঝিনুক তার হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে বলল, “বাহ ভাইয়া আপনার ও আপির চিন্তা ভাবনায় কত মিল। আপুও একটু আগে এই কথাই বলছিলো।”

অর্ক প্রভার দিকে একপলক তাকিয়ে ঝিনুককে বলল, “দাঁড়াও আমি রুহানিকে ডেকে দিই যে ও তোমাকে সৈকতের রুমে নিয়ে যায়। নতুন বউয়ের একা যাওয়া ঠিক দেখাবে না বোধহয়।”
ঝিনুক মৃদু হাসলো।

অর্ক যাওয়ার পর ঝিনুক প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু তুমি কত ভাগ্যবতী জিজুর মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছ বলে। জিজু তোমার অনেক যত্ন নিবে এবং অনেক ভালোবাসবে, দেখে নিও।”

প্রভা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। সে বিড়বিড় করে বলল, “যে মানুষ বেঁচে থাকাটা সহ্য করতে পারে না সে আবার ভালোবাসবে!”
প্রভা এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
.
ঝিনুককে সৈকতের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। রুহানির সাথে সৈকতের দুটো কাজিন ছিলো। তাকে রুমে দিয়ে খিলখিল করে হেসে দরজা লাগিয়ে চলে গেল। ঝিনুক দেখে রুমটা ফুল দিয়ে সাজানো। ঝিনুক পুরো রুমটা ঘুরে দেখল। তার চোখ যেয়ে আটকালো দেয়ালে লাগানো সৈকতের ছবির উপর। সাদা শার্টের উপর ব্রাউন রঙের জ্যাকেট পরা। তার মা’কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চোখ টিপ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিনুক মুচকি হাসলো। তার মনে পড়ে গেল সে তাদের প্রথম দেখা,

রুহানির বিয়ের ছিল সেদিন। রুহানি ও ঝিনুকের বান্ধবীদের সাথে ঝিনুক গেট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো মিষ্টি, শরবত এইসব নিয়ে। বরসহ ছেলেপক্ষ আসতেই ঝিনুক ও তার বান্ধবীরা মিষ্টি খাইয়ে বলে, ‘দুলাভাই এইবার বিশ হাজার বের করেন, নাহয় বিয়ে ভুলে যান।’

ভিড়ের মাঝেই একটা ছেলে বলল, ‘মিষ্টি বিশ টাকার হলে না, এই মিষ্টি খাইয়ে আসছে বিশ হাজারের ডিমান্ড করতে।’

ঝিনুক এক কোমড়ে হাত রেখে ভাব নিয়ে বলল, ‘ আমার অমূল্যবান বান্ধবীকে দিয়ে দিচ্ছি আর এইখানে বিশ হাজার টাকা দিতে এত কথা, লজ্জা লাগা উচিত।’

‘মেডাম আপনার জন্য জান দিতে রাজি আছি বিশ হাজার চাইছেন মাত্র।’ ঝিনুক তাকালো কালো রঙের পাঞ্জাবি পরা ছেলেটার উপর। সেই ছেলেটিই ছিলো সৈকত।

ঝিনুক বলল, ‘আপনার জান দিয়ে কী করব? আপনার জান দিয়ে তো আর শপিং করতে পারব না।’

সৈকত আরেকটা ছেলের কাঁধে হাত রেখে চোখ টিপ মেরে বলল, ‘আমার জান হয়ে গেলে ঠিকই করাতে পারব।’

ঝিনুকের তখন ছেলেটাকে এত আজব লাগলো যা বলার মতো না। সবার সামনে এমন কথা কীভাবে বলতে পারে?”

ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসার হলো। ঝিনুক ছবিটার দিকে তাকিয়েই রইল। হাত বাড়িয়ে ছবিটা ছুঁতে নিলেই দরজা খোলার শব্দ এলো। ঝিনুক পিছনে ফিরে দেখে সৈকতকে। সৈকত একটুখানি হেসে দরজা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা কর।”

ঝিনুক অসংশয়ভাবে বলল, “ভেবেছিলে? আমি তোমাকে ঘৃণা করি তা তোমার জানা উচিত।”

“তাহলে বিয়ের জন্য হ্যাঁ করলে কেন?”

“বাধ্য ছিলাম।”

“আমার ছবির দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন?”

“ছবিতে নিজের সর্বনাশ দেখছিলাম।”

সৈকত ঝিনুকের কাছে এলো। তার কোমর ধরে এক ঝটকায় তাকে কাছে টেনে নিলো। কপালে আলতোভাবে চুমু খেয়ে বলল, “তোমার চেহেরার ভঙ্গি অন্যকিছু বলছে।”

ঝিনুক আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। নড়ল না। অনুভব করলো শুধু সৈকতের স্পর্শকে। আজ এত বছর পর তাকে কাছে পেয়ে পৃথিবীটা ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সৈকতের করা বেইমানির দৃশ্য। সে সে চোখ দুটো খুলে সৈকতের হাত সরানোর চেষ্টা করলো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ছাড় বলছি, নাহয় ভালো হবে না।”

“এমনভাবে বলছে কেন যেন প্রথম এত কাছে এসেছি। আগেও হাজারোবার তোমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করেছি।”

ঝিনুক কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি সে হাজারোবারে অনুতাপ করি। যদি সে হাজারোবারটা ভুলতে পারতাম।”

সৈকত হেসে বলল, “আমি সে স্বভাবের মতো যাকে একবার ধারণ করলে না ভুলা যায় না ছাড়া যায়।”
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৪
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সৈকত হেসে বলল, “আমি সে স্বভাবের মতো যা ধারণ করলে ছাড়া যায় না।”

“আমি আমার যে কোনো স্বভাব সহজে ছাড়তে পারি।”

সৈকত হেসে বলল, “উফফ তোমার এই রাগেই তো আমি ফিদা।”

“আমার রাগ আপনার গালে চড় হিসেবে পড়বে জনাব। ডান গালে রাগ ঝরাতে চান না বাম গালে।”

“কিস দিলে যে কোনো গালে দিতে পারো।”

ঝিনুক ভ্রু নাচিয়ে বলল, “আমার জুতা আপনাকে কিস করতে পারে।”

“ইশশ জান, এমনভাবে বলছ যেন আগে আমাকে কিসই কর নি। তখন গার্লফ্রেন্ড ছিলে এখন ওয়াইফ। আজ আরও আমাদের বাসররাত একটু রোমেন্স না করলে হয়?”

সৈকত আবার ঝিনুককে কিস করতে নিলে ঝিনুক জোরে তার পায়ে লাথি মারে। সৈকত সাথে সাথে তাকে ছেড়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, “এমন জংলীর মতো ব্যবহার কর কেন?”

ঝিনুক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কাছে আসার চেষ্টা করলে এমন মারা মারব যে নিজের বংশের নাম ভুলে যাবে। আমি এখন যেয়ে এই ড্রেস পাল্টে আসছি ততক্ষণে মেঝেতে নিজের বিছানা করে নিন। আমি এসে এক ঘুম দিব। তখন লাইট জ্বালিয়ে রাখলে তোমার ফিউজ উড়িয়ে দিব।”

সৈকত বিছানায় বসে বলল, “আমি আমার রুমে আমি নিচে ঘুমাব? মাথা ঠিকাছে তোমার? আমি তোমার কথা কেন মেনে চলব?”

“না মানলে এখন বাহিরে যেয়ে তোমার ইতিহাস ঘরের সবার সামনে রেখে দিব এইজন্য।”

“ওহ প্লিজ এমন অভিনয় কর না যে আমি আগে কখনো তোমার কাছে আসি নি। আর এখন তো আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ সমস্যা কোথায়?”

ঝিনুক শব্দ করে হেসে উঠলো। বলল, “সমস্যা তুমি। এতগুলো মেয়ের সাথে রিলেশন করেছ যে কবে হঠাৎ করে একটা মেয়ে তোমার বাচ্চা নিয়ে হাজির হয় কে জানে? একচুয়ালি আমি ওই দিনেরই অপেক্ষা করছি। এই বাহানায় তোমার থেকে মুক্তি তো পাব।”

“ইউ রিয়ালি ডাস হেইট মি।”

“আই ডু। আই ডু। আই ডু।”

ঝিনুক তার ব্যাগ থেকে একজোড়া জামা বের করে ওয়াসরুমে গেল সোজা।
.
.
অর্ক এসে দেখে প্রভা কাপড় বদলে অলরেডি মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। সে নিজেও যেয়ে গোসল করে নিলো। বাথরুম থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল, “আমার সামনে ঢঙ করার প্রয়োজন নেই। উঠে বিছানায় শুয়ে পড়।”

প্রভা নড়ল না। অর্ক আবারও বলল, “আমি জানি তুমি ঘুমাও নি। উঠে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়। আমার যেন এই কথাটা আবার বলতে না হয়, নাহয় ভালো হবে না।”

প্রভা তবুও উঠলো না। অর্ক যেয়ে প্রভার সামনে দাঁড়িয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল, “উঠবে কি’না?”

প্রভা এইবারও না নড়ায় অর্ক তাকে কোলে তুলে নিলো এক ঝটকায়। প্রভা হতবাক। এমন কিছু হবে সে মোটেও আশা করে নি। প্রভা আতঙ্কিত স্বরে বলল, “কী করছেন? নিচে নামান আমাকে।”

অর্ক প্রভাকে বিছানায় বসিয়ে বলল, “আমার সামনে এত নাটক করার দরকার নেই। আমি তোমার সম্পর্কে সবই জানি।”

প্রভা বিছানা থেকে নেমে বলল, “আপনি এমন কী জানেন যা আমিও জানি না।”

“তুমি কোন ধরনের মেয়ে তা ভালো করেই জানি। বিনয় প্রায়ই বলত তোমার বিয়ের আগে অনেক ছেলের সাথে রিলেশন ছিলো যা তুমি ওকে কখনো বলোনি। তাদের সাথে তোমার ফিজিক্যাল রিলেশনও ছিলো। এমনকি বিয়ের পরও—-” অর্কের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই প্রভা অর্কের গালে কষিয়ে এক চড় মারল। তার চোখ দুটো ভিজে গেল। অর্ক শক্ত গাল চেপে ধরলো প্রভার। আর অন্যহাতে তার বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে বলল, “এখন তোর গা জ্বলছে? তুই যখন আমার নূহার নামে এ-সব বাজে কথা বলেছিলি আমাকে তখন ওর কেমন লেগেছে তা চিন্তা কর। ওর প্রতিটা কষ্টের শোধ তুই দিবি।”

প্রভা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে অর্ককে সরানোর চেষ্টা করল। অর্ককে এক ইঞ্চিও নাড়াতে পারে নি সে। উল্টো অর্ক ধাক্কা দিয়ে প্রভাকে সরিয়ে দিলো। নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে যেয়ে পরল সে। অর্কের সেদিকে খেয়াল নেই। সে যেয়ে বাতি বন্ধ করে শুয়ে পরলো।

প্রভা সেখানেই পড়ে রইলো। তার হাতে ও হাঁটুতে ব্যাথা পেয়েছে প্রচুর। সে শুধু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনি আমার উপর অজস্র আরোপ লাগিয়েছেন, আমি কিছু বলি নি। আপনার কারণ ছিলো, আমি বুঝেছি। কিন্তু না জেনে আমার সম্মানে মিথ্যে আরোপ লাগিয়ে ঠিক করেন নি। শুধু আল্লাহ জানে আমি কখনো কোনো পাপ কাজ করি নি। আপনার জীবনে এমন এক দিন আসবে যখন আপনি আপনার এইসব ব্যবহারে অনুতাপ করবেন। আর সেদিন অনুতাপ করেও লাভ হবে না।”

অর্ক উত্তর দিলো না। প্রভা সেখানেই বসে হাঁটু গুঁজে মুখে হাত দিয়ে নৈশব্দে কাঁদতে শুরু করল। অন্য হাত দিয়ে খাঁমচে ধরলো তার পা। সারাটা জীবন সে এই বিষাদে কাটিয়েছে। তার ভাগ্যে কী সুখ নামক পাখি সারা দিতে পারে না? শুধু একটিবারের জন্য?

দরজায় টোকা পরল। অর্ক উঠে প্রভার সামনের থেকেই নিচে ঝুঁকল, পড়ে থাকা বালিশ ও বিছনার চাদর উঠানোর জন্য। একপলক তাকালো প্রভার দিকে। রূপালী চাঁদের জ্যোৎস্না আলোয় তার কান্নামাখা মুখটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য তার বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠল।
প্রভা সাথে সাথে সেখান থেকে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে পরল।

অর্ক বালিশ ও বিছানার চাদর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে কখনো কাওকে ইচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট দেয় নি। আর আজ জেনে বুঝে একটি মেয়ের জীবন শেষ করে দিচ্ছে। পরক্ষণেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার ভালোবাসা নূহার চেহেরা। না, সে যা করছে তা একদম ঠিক। শী ডিসার্ভস ইট। ও যা করেছে তার জন্য এই শাস্তি তুচ্ছ।

দরজায় আবারও টোকা পরল। অর্ক বিছানায় তার হাতের জিনিসগুলো রেখে দরজাটা যেয়ে খুলে দেখে অদিন দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটি বানরের পুতুল। সে ড্যাবড্যাব করে অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, “আংকেল আংকেল অদিন মাম্মার কাছে ঘুমুবে। অদিন মাম্মা ছাড়া ঘুমায় না।”

অর্ক হেসে অদিনকে কোলে নিলো। তার ফোলা ফোলা গাল দুটোয় চুমু খেয়ে বলল, “অফকোর্স মাই লিটেল চ্যাম্প। আজ অর্ক আমাদের সাথে ঘুমাবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

“কী আংকেল?”

“আমাকে আংকেল না বাবা বলতে হবে।”

অদিন তার গালে এক আঙুল রেখে কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করে বলল, “ওকিই বাবাই।” আর দাঁত বের করে হাসলো।

অর্ক অদিনের গালে একখানা চুমু খেয়ে তাকে বিছানায় বসালো। আর নিজে গেল দরজা বন্ধ করতে।
প্রভা মুখ ধুঁয়ে এসে দেখে অদিন বিছানায় বসে আছে। অদিন প্রভাকে দেখেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে তার ডান পাশের বিছানায় বাড়ি দিয়ে বলল, “মাম্মা মাম্মা এইখানে। অদিন গল্প শুনবে।”

প্রভা না চাওয়া সত্ত্বেও বিছনায় যেতে শুতে হলো। অদিন আবার বলল, “মাম্মা গল্প—”

প্রভা মৃদু হেসে অদিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “শুনাচ্ছি সোনা।”

অর্কও এসে অন্যপাশে শুয়ে পরলো। প্রভা একবার অর্কের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে বলল, “একটি ক্যান্ডির রাজ্য ছিলো। যেখানে সব ক্যান্ডি ও চকোলেট দিয়ে তৈরি ছিলো। এমনকি নদীর পানিও চকোলেটের ছিলো। সেখানে মিষ্টি খাবার ছাড়া কিছু পাওয়াই যেত না। সেখানে একটি রাণী ছিলো। রাণীর নাম—-”

অদিন তখনই চেঁচিয়ে বলল, “বিনু আপু।”

প্রভা হেসে বলল, “রাণীর নাম ছিলো বিনু তার মিষ্টি খাবার খেতে খেতে আর ভালো লাগতো না। সে সারা রাজ্যে ঘোষণা করিয়ে দিলো যে তাকে মিষ্টি খাবার বাদে কিছু এনে দিবে তাকে সে ধনী করে দিবে। কিন্তু তা ছিলো বড্ড কষ্টকর। এই রাজ্য থেকে বের হতে গেলে পাড় হতে হয় পাঁচটি ক্ষতিকর পরিস্থিতি থেকে। আজ পর্যন্ত কেউ তা করতে পারে নি। তাই কেউ রাজি হলো একটি বীর সাহসী ছাড়া। সে রাজ্যেরই এক কিশোর বীর ছেলে। যে তার বাবার দোকানে সাহায্য করতো। তার নাম ছিলো অদিন।”

অদিন আবার লাফিয়ে উঠলো। বল, “ইয়েএ অদিন। বাবাই দেখেছ অদিন বীর সাহসী।”

অদিনের মুখে বাবাই কথাটা শুনে প্রভা বিস্ময় নিয়ে তাকালো অর্কের দিকে। অর্ক অদিনের গাল টেনে বলল, “অফকোর্স, মাই লিটেল চ্যাম্প।”

অদিন তার বাবাই ও মাম্মার দুইজনের হাত নিজের হাতে নিয়ে তার বুকের উপর প্রথমে তার মাম্মার হাত রাখলো তারপর বাবাইয়ের। এর উপর নিজের। প্রভা অর্কের হাতের স্পর্শে চমকে গেল। সে সরাতে নিলেই অদিন কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল, “মাম্মা সরায় না।”

প্রভা তাকালো অর্কের দিকে। তার অস্বস্তিটা ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছে।
.
.
ঝিনুকের যখন ঘুম ভাঙে সে নিজেকে আবিষ্কার করে সৈকতের বুকে। কিন্তু সে তো বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলো তো নিচে এলো কীভাবে? এরপর উপর সৈকত তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। উঠতেও পারছে না। সৈকতকে ধাক্কা দিচ্ছে কাজ হচ্ছে না। ডাকছে, কিন্তু সেই নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছে সৈকত। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। অবশেষে ঝিনুক উপায় না পেয়ে সৈকতের বাহুতে জোরে এক চিমটি কাটলো।

লাফিয়ে উঠে বসল সৈকত। নিজের বাম হাতের বাহুতে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, “তুমি কি আসলে মানুষ না’কি?
একজন মাসুম ঘুমন্ত মানুষকে তুমি এইভাবে কীভাবে উঠাতে পার? পেত্নী একটা।”

ঝিনুক উঠে বিছানায় বসে বলল, “আগে তুমি বলো আমি তো বিছনায় ঘুমাচ্ছিলাম তাহলে নিচে কীভাবে এলাম?”

“আমি কীভাবে জানি?” পরক্ষণে সে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো ঝিনুকের দিকে। বলল, “আল্লাহ তোমার উল্টা পাল্টা কোনো ইনটেনশন ছিলো না তো?”

“জুতার বারি চিনো?” পরে আবার ভেবে মাথা চুলকে সে বলল, “সম্ভবত গড়িয়ে নিচে পরে গিয়েছিলাম আগেও তো এমন হয়েছে। যাই হোক আমি গোসল করতে যাই।”

“একদম না আমি ভার্সিটিতে যাব। আমি আগে যাচ্ছি।”

“জ্বি না আমি যাব।” ঝিনুক উঠে নিজের নিজের ব্যাগ থেকে জামা বের করতে নিয়েছিল এর আগেই সৈকত ঢুকে পরল ওয়াশরুমে।

ঝিনুক উঁচু স্বরে বলল, “চিটার একটা।”

“যে আগে ঢুকবে বাথরুম তার। এখন আলমারি থেকে গেঞ্জি আর টাউজার বের করে দরজার সামনে রাখ।”

“রাখব না। একদম রাখব না। মরো তুমি।”

“ঠিকাছে আমি এমনিই বের হয়ে যাব। আই ডোন্ট কেয়ার।”

ঝিনুকের মনটা চাচ্ছিল মাথা ফাটিয়ে দেক ছেলেটার। ফাজিল একটা৷ রাগে মেঝেতে লাথি মেরে আলমারি থেকে কাপড় বের করে রাখল দরজার সামনে। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পরল। দরজা খুলে দেখে প্রভা এসে দাঁড়িয়ে আছে। প্রভা ঝিনুককে দেখে বলল, “তুই এখনো রেডিই হলি না?”

“তোমার দেবর বাথরুমে যেয়ে ডান্স বাংলাদেশ ডান্সের জন্য নাগিন ডান্সের প্রাক্টিস করছে যে তাই তার এত সময় লাগছে।”

প্রভা হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে তৈরি হয়ে নেয়। বাহিরে অনেক মেহমান আছে তাই একটা সুন্দর শাড়ি পরে নিস।”

“মহারাজের নাগিন ডান্স শেষ হলে বের হোক আগে।”
.
.
সৈকত রেডি হয়ে যখন ভার্সিটির জন্য বের হতে যাচ্ছিল তখন দাদি তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

“দাদিমা ভার্সিটিতে। ঠিকাছে আমি জানি তুমি বলবে বিয়ের পরদিনই ভার্সিটি যেতে নেই কিন্তু এখন তো কেউ জানে না আমার বিয়ে হয়েছে তাই—-”

দাদিমা তার কথা কেটে বলল, “আরে আরে থাম দাদুভাই। আমি তো যেতে মানা করিছি না।”

সৈকত চোখ মুখ কুঁচকে বলল, “কী!”

“তুই যা শুধু ঝিনুককে সাথে নিয়ে যা।”

“ওকে কেন নিয়ে যাব?”

“ওকে তোদের ভার্সিটিতে ভর্তি করাব তাই। তোমার ভাইয়া কথা বলে নিয়েছে। যেহেতু ক্লাস আগেই শুরু হয়ে গেছে সমস্যা হবে। কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে আর তা আজই করতে হবে। তোমার ভাইয়া গতরাতেই প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেছে। আর তুমি তোর বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে নিবি। বিয়েতে আসে নি তো কি হয়েছে বৌভাতে আসবে।”

সৈকত অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের ভার্সিটিতে কেন দাদিমা? অন্য ভার্সিটিও তো আছে।”

“এই নিয়ে কোনো কথা হবে না দাদুভাই।”

“কিন্তু —-” সৈকতের কথা না শুনেই দাদিমা গম্ভীর গলায় বলল, “এই নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। আমি ঝিনুককে বলে আসছি। তুমি অপেক্ষা কর। যেহেতু মেহমান বেশি সবার সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসব।”

সৈকত প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছে তবুও ঝিনুকের আসার নাম নেই। অবশেষে যখন দাদিমা এলো সে বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করল, “আর কত দাদিমা? কারও এতক্ষণ লাগে রেডি হতে?”

“আচ্ছা আচ্ছা চল। মেয়েটা এত রোদে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।”

সৈকত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “মানে আমাকে একঘন্টা ধরে বসিয়ে রাখসে তার হিসেব নেই ও একমিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তোমার কষ্ট হচ্ছে। হায়রে দুনিয়া ছেলেদের কষ্টের মূল্যই নাই।”

“ঢঙ শেষ হলে এবার আসবি?”

সৈকত দাদিমার পিছনে যায়। দরজা দিয়ে বের হতেই থেমে যায়। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। ঝিনুক গাড় কমলা রঙের একটি শাড়ি পরে আছে। চুলগুলো ভিজা, আউলিয়ে আছে। চোখে কাজলমাখা, ঠোঁটে কমলা রঙের লিপস্টিপ দেওয়া। তার ফর্সা ত্বকে কমলা রঙটি যেন ফুটে আছে। সৈকত সেদিকে তাকিয়ে পা বাড়াতেই সিঁড়ি পিছলে পড়ে গেল।

সৈকতকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে ঝিনুক ফিক করে হেসে উঠলো। সৈকত মেঝেতে বসেও শুধু ঝিনুকের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তার খিলখিল হাসির শব্দ গানের সুরের মতো তার কানে বাজছে। তার হাসিমাখা চেহেরা থেকে যেন চোখ ফেরানো দায়। হাসলে যেন তার নরম তুলতুলে ফর্সা গালদুটো গোলাপি হয়ে উঠে।

দাদিমা চিন্তিত সুরে বলল, “কিরে মনা, ঠিক আছো তো?”

সৈকতের ঘোর ভাঙতেই সে উঠে দাঁড়ালো। ঝিনুক হেসেই বলল, “মনা তুমি ঠিক মতো হাঁটতেও পারো না?”

সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এইটা পরে তুমি আমার সাথে ভার্সিটিতে যাবে?”

“কেন কী সমস্যা?”

“সমস্যা আছে। এখনই যেয়ে শাড়ি পাল্টে সেলোয়ার-কামিজ পরে নেও। আর এই কাজল লিপস্টিক মুছে চুল হেয়ার ড্রেয়ার দিয়ে শুকিয়ে নেও। একদম জোকার লাগছে। মানুষ এভাবে কোনো জোকারকে আমার পিছনে দেখলে কী ভাববে।”

ঝিনুক রাগান্বিত স্বরে বলল, “আমি এভাবেই যাব।”

“আমি তাহলে ভার্সিটিতেই নিয়ে যাব না। যাক তোর পড়াশোনা নালাতে আমার কী?”

ঝিনুক কিছুক্ষণ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। তারপর রেগেমেগে চলে গেল। দাদিমা হেসে বলল, “বুঝলি মনা, তুইও একদম তোর দাদা মতো হয়েছিস, আমাকে যেদিন সুন্দর দেখাতো উনি সেদিন আমাকে বাহিরে নিয়ে যেত না।”

সৈকত একটু হকচকিয়ে বলল, “কী যে বল দাদিমা তোমাকে তো সবসময়ই মিস ওয়ার্ল্ড লাগে। ওই মেয়ে আর তুমি কি এক না’কি?”
দাদিমা কিছু বললেন না। হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
.
.
সৈকত ভার্সিটির সামনে বাইক থামিয়ে বলল, “এখানেই নেমে পড়।”

“ভার্সিটির ভিতরে নিয়ে নামাও। আমার ভার্সিটির অফিসে তো কাজও আছে।”

“নিজের কাজ নিজে করে নেও। আর পুরো ভার্সিটিকে জানাতে হবে যে না তুমি আমার ওয়াইফ? ভুলেও না। কাউকে ভুলেও বলবে না যে তুমি আমার কী হও। আমার একটা রেপুটেশন আছে ভার্সিটিতে।”

ঝিনুক একটু ভাব নিয়ে বলল, “ওহ প্লিজ, আমি এই কথাটা মাইকে এনাউন্সমেন্ট করতে ইচ্ছুক না যে আমি তোমার বউ হই। ভার্সিটিতে তো একদমই না। আমি চাই না দু’মিনিট পর পর মেয়েরা এসে আমাকে এটা বলুক তোমার বর তো আমার এক্স-বয়ফ্রেন্ড ছিল।”

“গুড। মহাদয়া একটু নামার কষ্ট করবেন?”

ঝিনুক বিরক্তি নিয়ে নামলো বাইক থেকে। সাথে সাথে সৈকত এত জোরে বাইক চালিয়ে নিলো যে ভয়ে ঝিনুকের হাতের ব্যাগ পরে গেল। সাথে ব্যাগ থেকে তার জিনিসপত্রও। ঝিনুকের সৈকতের উপর এত রাগ উঠছে যা বলার বাহিরে। সে বিরক্তি নিয়ে ঝুঁকে তার ব্যাগ উঠাতে শুরু করল। তখনই একটি ভারী কন্ঠ শুনতে পেল সে, “আমি আপনার সাহায্য করতে পারি?”

ঝিনুক চোখ তুলে তাকালো। একটি চেক শার্ট পরা ছেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো সামান্য কোঁকড়া, তবে বেশি নয়। তার ঠোঁটে হাসি ছিলো যা হঠাৎ করে পরিবর্তন হলো বিস্ময়ের রুপে। ঝিনুক সামান্য হেসে বলল, “প্রয়োজন নেই।”

ঝিনুক ব্যাগ উঠিয়ে চলে যেতে নিলেই ছেলেটা আবার ডাকল, “একটু কথা ছিলো।”

ঝিনুক পিছনে ফিরল, “বলুন।”

“আপনি যে ছেলেটার সাথে ছিলেন তাকে আপনি কীভাবে চিনেন?”

“কেন?”

“কিছু মনে করবেন না ওর সাথে না ঘুরাটা আপনার জন্য ভালো নয়। ভার্সিটির প্লে বয় বলে পরিচিত। তাই ওর সাথে আপনাকে দেখে জানানো উচিত মনে হল।”

ঝিনুক এইসব সম্পর্কে আগের থেকেই জানে। তাই সে অবাক হলো না। যেহেতু সৈকত বলেছে তাদের সম্পর্ক সম্পর্কে কেউ না জানে তাই সে বলল, “আমার আপুর দেবর শুধু। ভার্সিটিতে নতুন এডমিশন নিব তাই ওর সাথে এসেছি। তবুও আপনাকে ধন্যবাদ বলার জন্য, নাহয় সবাই ভাবে যার লাইফ সে ভাবুক কেন অন্যের চিন্তা নিজের কাঁধে নিব।”

ছেলেটা হেসে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি অর্ণব। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই জানাবেন।”

ঝিনুকও হাসি মুখে ছেলেটার সাথে হাত মিলিয়ে বলল, “আমার নাম ঝিনুক। এখন যাই, দেরি হচ্ছে।”

ঝিনুক হাঁটতে শুরু করল। অর্ণব তাকিয়ে রইলো তার দিকে। একটি ছেলে এসে তার কাঁধে মেরে বলল, “শালা আমি ভার্সিটিতে ঢুকে আশেপাশে তোকে খুঁইজ্জাই পাই না। এখানে কি করোস?”

অর্ণব ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে এক হাত পকেটে ভরে ঝিনুকের দিকেই তাকিয়ে বলল, “সবে এক হুরপরীর দর্শন করলাম। যদি হুরপরীটা স্বপ্নে এসে থাকে তাহলে আমি এই স্বপ্ন থেকে আর জাগতে চাই না। এত সুন্দর স্বপ্ন আর কখনো দেখা হবে কি’না কে জানে?”

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here