মন পাড়ায় পর্ব ১+২

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“তোর বিয়ে ভেঙে গেছে আর তুই আরামে বসে গান শুনছিস?”

“তো কী করব কেঁদে গঙ্গা যমুনা বানিয়ে ফেলব না’কি? বড় মা ও খালুরই দোষ তারা আগের থেকে বললেই হতো আমি তাদের আপন মেয়ে না। বড় মা’য়ের ছোট বোনের মেয়ে। যে বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হয়েছে আর সন্তান জন্ম দিয়ে নিজের সুসাইড করে বসে আছে। মৃত্যুর আগে এটাও ভাবে নি তার মেয়ের কী হবে!”

রুহানি ঝিনুকের পাশে বসে বলল, “ঝিনুক এইভাবে বলা উচিত না। তোর সত্যি কিছু আসে যায় না? মানে নাদিমের সাথে তোর বিয়ে—-”

ঝিনুক বলল, “আমি তো ওর প্রেমে পড়ে বসে আছি না যে আমার খারাপ লাগবে। আর এখন এ প্রেম ভালোবাসার মতো ফালতু জিনিসে আমার বিশ্বাসও নেই।”

রুহানি ঝিনুকের এক হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “এভাবে বলিস না ঝিনুক, অতীতে যা হয়েছে তা ভুলে যা। সবাই একরকম হয় না। অর্ক ভাইয়াকেই দেখ না, প্রভা আপু বিধবা হওয়া সত্ত্বেও তার সাথে বিয়ে করছে। আরও দুই বাচ্চার মা। তাও এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলে নি।”

তাচ্ছিল্য হাসলো ঝিনুক। বলল, “ভালোবেসে না, ওয়াদা রক্ষার্থে।”

“গতবারও কেউ তোকে ভালোবাসায় বিশ্বাস দিয়েছিল, আবারও কেউ আসবে যে তোকে আবার ভালোবাসতে শিখাবে।”

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুই যার কথা বলছিস, সেই আমার বিশ্বাস এমনভাবে ভেঙেছে যে এ মন পাড়ায় আর কারও কখনো জায়গা হবে না। শুধু বিশ্বাস না, আমার মনও ভেঙেছে।”

“ভুল করিস না ঝিনুক। ভালোবাসা জিনিসটা সুন্দর, শুধু ভালোবাসতে জানতে হয়।”

ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সুন্দর হলে আমার এত কাঁদতে হলো কেন? আমার মা’কে মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া হলো কেন? ভালোবাসা যদি সুন্দরই হয় তবে কেন আজ আমার মা বাবা কেউ আমার সাথে নেই? আজ পর্যন্ত ভালোবেসে কাউকে সুখে তো দেখলাম না, শুধু কষ্ট পেতে দেখেছি।”

“মিথ্যে বলিস নে ঝিনুক। তুইও জানিস ভালোবাসা কতটা সুন্দর। এর অনুভূতি তুই অনুভব করেছিস।”

“সাথে অনুভব করেছি দুঃখও। হাজারো দিনের দুঃখ এ কিছুদিনের সুখের কাছে তুচ্ছ। আমি যদি সময় পিছাতে পারতাম সে সুখকর অনুভূতিগুলো মিটিয়ে দিতাম যেন এই কষ্টগুলো ভোগ না করেই থাকতে পারি।”

রুহানি কিছু বলতে যাচ্ছিলো এর পূর্বেই দরজায় টোকা পরল। রুহানি উঠে দরজা খুলে দেখে বিনু এসেছে। বিনু প্রভার মেয়ে। বিনু ভিতরে ঢুকে বলল, “মিষ্টি’মা মিষ্টি’মা নানু না তোমায় ডেকেছে।”

ঝিনুক প্রশ্ন করল, “কেন?”

“জানি না তো। বলেছে তোমায় ও মা’কে ডাক দিতে ড্রইংরুমে। বিশেষ কথা আছে।”

“ঠিকাছে তুই যা, আমি আসছি।” বিনু যেতেই ঝিনুক চিন্তিত সুরে বলল, “আল্লাহ-ই জানে কী জন্যে ডেকেছে!”

“চিন্তার প্রয়োজন নেই সম্ভবত নাদিমের কথা বলার জন্য।”

“আমার ভয় হচ্ছে, যদি আমার জন্য প্রভা আপু আর অর্ক জিজুর বিয়েতে সমস্যা হয়?”

ঝিনুকের চিন্তা দেখে রুহানি বলল, “অর্ক ভাইয়া এমন না। উনি এই কথায় কখনো বিয়ে ভাঙবে না।”

“কিন্তু উনার পরিবার তো ভাঙতে পারে। দোয়া কর শুধু যেন কোনো সমস্যা না হয়।”
.
.
ঝিনুক ডাইনিংরুমে ঢুকত নিবে তখনই সৈকতের সাথে তার দেখা। সৈকতকে দেখে তার মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল। সে তাকে না দেখার ভান করে ভিতরে যেতে নিলেই সৈকত তার রাস্তা বন্ধ করে। বলে, “শুনলাম তোমার বর না’কি পালিয়েছে।”

ঝিনুক বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। বলল, “তাহলে তোমার এতো চুলকায় কেন?”

সৈকতের মেজাজ প্রথমে খারাপ হলেও পরে নিজেকে শান্ত করে বলে, “বেয়াইন হন আপনি আমার চুলকাবেই তো, বিয়ের দিন আপনার বর পালিয়ে গেছে। লজ্জাজনক ব্যাপার তো বটে।”

“তাইলে চুলকানির মলম লাগিয়ে বসে থাকেন। আমার মাথা খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন যাও এখান থেকে তোমার এখানে কাজ নেই।”

সৈকত দরজার উপর হাত রেখে বলল, “মেডাম আপনার রাজ্যে আমি আসি নি যে আপনার রাজত্ব চলবে।”

ঝিনুক হেসে নিজের হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে বলল, “আপনি আমার রাজত্বের এসেছেন। ভুলে যেয়েন না বাসাটা আমার, তোমার না। যেখানে সেখানে টৈ টৈ করতে করতে ঢুকে পড়ে। ফালতু একটা।”

সৈকত কেশে তার গলা পরিষ্কার করে তার হাত দরজা থেকে সরিয়ে বলল, “আমি নিজের থেকে আসি নি। দাদিমা ডেকেছে আমাকে।”

ঝিনুকের কপালে ভাঁজ পড়ল। তার বুক হঠাৎ কেঁপে উঠলো। সে বলল, “তোমাকে আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটারে কেন ডাকবে।”

প্রভা এলো তখনই। সে সৈকত ও ঝিনুককে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা ভিতরে না যেয়ে এখানে কী করছ?”

ঝিনুক তাকালো প্রভার দিকে। প্রভা বধূবেশে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। আবারও। গতবার যখন প্রভার বিয়ে হয়েছিলো তখন সে এগারো বছরের ছিলো। তার ঠিক মনেও নেই কেমন দেখাচ্ছিলো তাকে। ছবিতে দেখেছে। কিন্তু ছবিতে দেখা ও সামনা-সামনি দেখায় অনেক পার্থক্য। অসাধারণ লাগছে প্রভাকে। মানুষ বলে কালো বর্ণের মানুষকে গাড় রঙে মানায় না। এটা তার ভুল মনে হয়, কারণ প্রভাবে আজ লাল রঙে অসাধারণ লাগছে। হয়তো প্রভার আজ দ্বিতীয় বিয়ে তবুও ঝিনুকের মনে হয় সে প্রভাকে আজ থেকে বেশি সুন্দর আর কখনও লাগে নি।

ঝিনুক যেয়ে প্রভার হাত ধরে বলল, “আপি আপি আমাদের কীজন্য ডেকেছ জানো তুমি?”

“ভিতরে ডুকলেই জানতে পাব ময়না।”

ঝিনুক কাঁদোকাঁদো চেহেরায় বলল, “আমার না ভয় করছে আমার জন্য তোমার বিয়ে না ভেঙে যায়।”

সৈকত তার ভ্রু নাচিয়ে বলল, “মানুষ কীভাবে এত জলদি এক্সপ্রেশন পাল্টায় তা আজ লাইভ দেখলাম।”

ঝিনুক আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। বলল, “জুতার বাড়ি খেতে কেমন লাগে তা লাইভ অনুভব করবে?”

সৈকতের কিছুক্ষণ ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে ভেতর ঢুকে পড়লো।

ঝিনুক প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু বল না বিয়ে টিয়ে ভাঙবে না তো?”

প্রভা মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল, “অর্ক এই বিয়ে কখনো ভাঙতে দিবে না।”

ঝিনুকের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে এলো। প্রভা বলল, “এইবার ভিতরে চল।”

ঝিনুক ও প্রভা ভিতরে ঢুকে দেখে দুই পরিবার বসে আছে। পরিস্থিতি গম্ভীর। প্রভা আড়চোখে তাকালো অর্কের দিকে। অর্ক তার দিকে তাকাতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো।

ঝিনুক চিন্তায় ভুগছিল। তাকে কেন ডাকা হয়েছে তা সে ধরতে পারছে না। ঝিনুকের খালু গম্ভীর গলায় বলল, “কী ব্যাপার তুমি তোমার বউয়ের পোশাক কেন খুলেছ?”

ঝিনুক তার খালুকে ভীষণ ভয় পায়। তার সামনে সে বেশি কথা বলে না। সে মাথা নিচু করে বলল, “ঐ’যে–ঐ’যে খালু নাদিমের পরিবার বিয়ে ভে—ভেঙে দিয়েছে তাই।”

“তোমাকে আমি বা তোমার খালামণি একবারও বলেছে বিয়ে হবে না তাই পোশাক পরিবর্তন করে ফেলো।”

ঝিনুক উওর দিলো না। মুখ নিচু করে রাখল। অর্কের দাদি তখন বলল, “আরে আজিজুল চুপ কর তো। এত মিষ্টি মেয়েকে কেউ বকে না’কি? দেখি ঝিনুক দাদির কাছে এসে বস তো।”

ঝিনুক যেয়ে বসলো দাদিমার কাছে। দাদিমা বলল, “মন খারাপ করে না। চিন্তা কর না আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তোমার বড় মা ও খালু রাজি। তোমার অনুমতি লাগবে।”

ঝিনুক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো দাদিমায়ের দিকে। দাদিমা বলল, “তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি, তুমি আমার ছোট নাতির সাথে বিয়ে করবে?”

ঝিনুক দাঁড়িয়ে পরল। ঝিনুক ও সৈকত একসাথে বলল, “অসম্ভব।”

একে অপরের দিকে তাকালো দুইজন। সৈকত বলল, “দাদিমা তুমি আমাকে এই ঝগড়ালুর সাথে বিয়ে দিতে চাও? ও আমার ব্রেনের কিমা বানিয়ে দিবে।”

ঝিনুক হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে বলল, “ওহ প্লিজ। ব্রেনের কিমা বানানোর জন্য ব্রেনও থাকা লাগে।”

“ঝিনুক—” খালু ভারী ও রাগান্বিত স্বরে বলল। ঝিনুক সাথে সাথে তার হাতের ভাঁজ খুলে মাথা নিচু করে রইলো।

প্রভা অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনার সাথে কিছু কথা আছে একটু আমার সাথে আসবেন?”

প্রভা উওর না নিয়েই পিছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করল। অর্ক রুমের সকলের দিকে একবার তাকিয়ে প্রভার পিছনে গেল। প্রভা অর্ককে নিয়ে তার মা বাবার রুমে গেল। কেননা অন্য সব রুমে মেহমান আছে। দরজা ভেজিয়ে বলল, “আপনি কী ঝিনুক ও সৈকতের বিয়ের জন্য হ্যাঁ করেছেন?”

“না করার কী আছে?”

প্রভা অনুরোধের সুরে বলল, “আমি আপনার শর্ত মেনে আপনাকে বিয়ে করছি। আপনার আমার সাথে সমস্যা আমার বোনকে মাঝখানে টানছেন কেন?
আপনার রাগ আমার সাথে, প্রতিশোধ আমার উপর নিন। দয়া করে আমার পরিবারকে মাঝে টানবেন না।”
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_২
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

প্রভা অনুরোধের সুরে বলল, “আমি আপনার শর্ত মেনে আপনাকে বিয়ে করছি। আপনার আমার সাথে সমস্যা আমার বোনকে মাঝখানে টানছেন কেন?
আপনার রাগ আমার সাথে, প্রতিশোধ আমার উপর নিন। দয়া করে আমার পরিবারকে মাঝে টানবেন না।”

অর্ক হেসে বলল, “ওহ ডিয়ার এত চিন্তা কর না। এমনিতেই তো তোমার করণীয়গুলোর চিন্তা কম নেই তোমার। কীভাবে তুমি নিজের শাস্তি থেকে বাঁচবে এর মধ্যে এইসব? নো নো নো। আমার ওয়াইফকে এইসব চিন্তা করতে দেওয়া আমার উচিত না। তাই না?”

পরের মুহূর্তেই তার হাসি মলিন হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রভার দিকে তাকিয়ে তার বাহু চেপে ধরল বলল, “তোমার করণীয় এর শাস্তি শুধু তুমি পাবে। আমার ভালোবাসার মানুষ ও প্রিয় বন্ধুকে ছিনিয়ে নেওয়ার শাস্তিটা তো তোমার পেতেই হবে। আমি তোমার মতো না যে কোনো নির্দোষকে শাস্তি দিব। ঝিনুকের বিয়ে যদি সৈকতের সাথে হয়ও তাও তোমার শাস্তি কখনো ও পাবে না। কারণ ও তোমার মতো নির্দয় না।”

প্রভা ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে নিলো। বলল, “ব্যাথা পাচ্ছি ছাড়ুন।”

অর্ক কঠিন গলায় বলল, “যখন অন্যকাওকে কষ্ট দিচ্ছিলে তখন এটা মাথায় আসে নি যে তাদেরও কষ্ট হয়? তোমার জন্য কতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেছে ধারণা আছে তোমার?”

প্রভার চোখে পানি এসে পরলো। সে বলল, “আমি আপনাকে কতবার বলব আমি কিছুই করি নি। দেড় বছর ধরে আপনাকে এটাই বুঝাচ্ছি।”

“প্রমাণ আছে?”

“আমরা যা সামনে দেখি তা সবসময় সত্যি হয় না।”

অর্ক তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কাছে অনেককিছু প্রমাণ তোমার কথার বিপক্ষে যায়। তুমি আমার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছ প্রভা। এখন শুধু অপেক্ষা কর তোমার জীবন মৃত্যুর থেকেও বদ করে দিব আমি।”

কিছুক্ষণ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে চলে গেল অর্ক।
.
.
ঝিনুকের বড় মা বলল, “খালাম্মা আপনি কিছু মনে না করলে আমি ও ওর খালু একটু ঝিনুকের সাথে আলাদা কথা বলি?”

“অবশ্যই। তোমরা যাও।”

ঝিনুক ও তার খালু, খালা ঝিনুকের রুমে এলো। তাদের দেখে রুহানি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ঝিনুকের বড় মা তার গালে হাত রেখে বলল, “ঝিনুক শুন, ওদের পরিবার অনেক ভালো তুই সুখে থাকবি। দেখ প্রভার বিয়ের জন্য যখন বলল তখন তুই সবার ব্যবহারে অনেক খুশি হয়েছিলি। আর এখন তুই সে পরিবারে যেতে পারবি, সমস্যা কোথায়?”

“কিন্তু বড়’মা ওই সৈকত—–”

ঝিনুকের কথা কেটে তার খালু বলল, “এইখানে কোনো কথা হবে না। এইখানে তোমার অনুমতি নেওয়ার জন্য ডাকা হয় নি। তুমি বিয়ে করছ তা বলার জন্য ডাকা হয়েছে। এমনিতেই তুমি ও তোমার মা আমাদের জীবনে অনেক সমস্যা করেছ। আর আজ বিয়ে ভাঙার পর আবার আমাদের পরিবারের অপমান হবে বা তোমার জন্য আরেকটা সম্মন্ধ খুঁজতে গিয়ে অপমান হবে এটা আমি আর সহ্য করব না। তাই চুপচাপ যেয়ে রেডি হও। তোমার বিয়ে আজ সৈকতের সাথেই হবে। এটা আমার শেষ সিদ্ধান্ত।”

তার বড় মা বলল, “মন খারাপ করিস না। তোর খালু একটু কড়া বললেও তোর ভালোর জন্যই বলছে। ঠিকাছে সৈকতের সাথে তোর ঝগড়া চলতে থাকে কিন্তু এর মানে তো এই না যে ও খারাপ। তাই না?”

ঝিনুক মৃদু হাসলো। তার আর কিছু বলার রইল না। খালু যেহেতু বলেছে সেহেতু তার বিয়েটা করতেই হবেই।

অন্যদিকে সৈকতের মা তাকে বারান্দায় নিয়ে মৃদু কন্ঠে বললেন, “বাবা বিয়েটা করে নে।”

“কিন্তু মা—”

মা তার কথা কেটে বলল, “বাবা দেখ আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি। তুই জানি এ পরিবারের সবাই এমনিতেই তোর উপর বিরক্ত। বিশেষ করে তোর বাবা। আর তোর উপর অনেক রাগও তিনি। সে যদি দেখে তুই তোর দাদিমার কথার বিরোধ করছিস তাহলে আরও রেগে উঠবেন। ঠিকাছে তোর দাদিমা তোকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু উনিও রাগ করতে পারে।”

সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মা আমি মাত্র ভার্সিটিতে পড়ি। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে—মা আমার এইটা ঠিক মনে হয় না।”

“তোর বাবা ও দাদিমা কিছু চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাবা আমার জন্য বিয়েটা করে নেয় আমি তোর মা, তোর ভালোই চাই। প্লিজ বাবা।”

মা’য়ের এত অনুরোধ দেখে সৈকত বলল, “ঠিকাছে ঠিকাছে যদি ঝিনুক হ্যাঁ করে তাহলে আমিও রাজি। এইবার তুমি শান্ত হও। আমার মা’য়ের ঠোঁটে হাসি না থাকলে আমার ভালো লাগে না।”

মা হাসলো। সৈকতে গালে হাত রেখে বলল, “এইতো আমার ভালো ছেলে। আল্লাহ তোকে সুখে রাখুক।”

তারা বের হয়ে দেখে প্রভার মা-বাবা এসে পড়েছে। দাদিমা বললেন, ” ঝিনুক বিয়ের জন্য হ্যাঁ করে দিয়েছে।”

সৈকত অনেকটা অবাক হলো। সে ভাবে নি যে ঝিনুক বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলবে। কিন্তু কিছু বলল না। সৈকতের বাবা বলল, “ভাইসাব এখানে কোনো শেরোয়ানির দোকান আছে যেখানে রেডিমেড শেরোয়ানি পাওয়া যাবে?”

অর্ক দরজায় দাঁড়িয়ে কথাটি শুনে বলল, “আমি চিনি বাবা। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি নিয়ে যাচ্ছি সৈকতকে।”

অর্ক যেয়ে সৈকতের সামনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখলো। এক গাল হেসে বলল, “আয় তোকে নিয়ে যাই।”

সৈকত তার দিকে তাকালো না। নিচে তাকিয়েই রুক্ষ গলায় বলল, “প্রয়োজন নেই। আমার কাজ আমি করতে পারব। মা আমি গাড়িতে বসে আছি তুমি আমার সাথে আসো।”

বলেই সৈকত চলে গেল। সৈকতের বাবা তার মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ছেলেকে সামলাও। দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। বড় ভাইয়ার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও ভুলে গেছে।”

অর্ক হেসে বলল, “না বাবা সৈকত তো আমার চিন্তাই করছিল। যেন আমার কষ্ট না হয়।” আবার সৈকতের মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আন্টি আপনি সৈকতের সাথে যান। আমি আপনাকে একটা দোকানের এড্রেস মেসেজ করে দিচ্ছি সেখানে শেরোয়ানি পেয়ে যাবে। আর আমার কথা বললেই হবে আমি টাকা পরে পাঠিয়ে দিব।”

সৈকতের মা চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ঝিনুকের রুমে উঁকি মেরে গেল। ঝিনুক আয়নার সামনে বসে গয়না পরছিল।

রুহানি ঝিনুককে চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছিলো। রুহানি বলল, “দেখলি তো আমায় কথায় সাজগোজ না মুছে ভালো করলি না?”

ঝিনুক উওর দিলো না। রুহানি আবার বলল, “ঝিনুক নিয়তির লেখা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। হাজারো দূরে থাকার চেষ্টা করা সত্ত্বেও অবশেষে নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছেই যাচ্ছিস।”

“তুই বুঝি খুশি রুহু?”

রুহানি উদাসীন গলায় বলল, “জানি না। তুই ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পেয়েছিস বলে খুশি হব না দুঃখী হব যে সে মানুষটা তোর ভালোবাসার যোগ্যই না।”

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভালোবাসার মানুষের সাথে থেকে তার দেওয়া কষ্ট মনে করা থেকে ভালোবাসাবিহীন থাকাটা হাজারোগুণ ভালো।”
.
.
দুটো বিয়েই সম্পন্ন হয়েছে। তারা স্টেজে বসে আছে। ঝিনুক সামনে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হেসে বিড়বিড় করে বলল, “কোন কুকুরে কামড় দিয়েছিল বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিলে?”

“নিশ্চিত পাগল কুকুরই ছিলো। কয়দিন আগে হাতে কামড় দিয়েছিলো।”

সৈকতের কথা শুনে ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। কয়দিন আগে সেই সৈকতের হাতে কামড় দিয়েছিল। অর্থাৎ সৈকত তার কথাই বলছে। ঝিনুক রাগান্বিত স্বরে বলল, “তোমাকে আমি—–”

তখনই ক্যামেরাম্যান বলে উঠলো, “আপনারা একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান। দেখে ওদিকে তারা কত সুন্দর ছবি তুলছে।”

ঝিনুক বিড়বিড় করে বলল, “ওদিকে আমার বোন একটা রাজকুমারের সাথে দাঁড়িয়ে আছে আর এদিকে আমি এক ছাগলের সাথে দাঁড়িয়ে আছি। পার্থক্য তো থাকবেই।”

সৈকত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আর আমি এক ভূতনির সাথে। উপ’স সরি ভূতনিও দেখতে তোমার থেকে সুন্দর হবে।”

“তোমাকে আমি—-” ঝিনুকের কথা কেটে সৈকত বলল,
“বাই দ্যা ওয়ে, তুমি না কোনো কিছুতেই আমার সাথে বিয়ে করবে না? কী যেন বলেছিলে? ওহ হ্যাঁ, আমি নিজেকে মেরে ফেলব কিন্তু তোমার সাথে বিয়ে করব না ব্লা ব্লা ব্লা। কোথায় গেল সে কথা?”

“আমার শখের বশে আপনাকে বিয়ে করি নি। খালু আদেশ করেছে, উনার কথার পিঠে আমি কথা বলতে পারি না।”

“তবে ভালোই হলো, দুই বছর হয়ে গেল তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি না, তোমাকে চুমু খাই না আর—-”

ঝিনুক রাগী কন্ঠে বলল, “মানুষ কতটা বেহায়া হলে এমন জায়গায় এ-সব বলতে পারে।”

“শুধু বলা? আমি করতেও পারব। করি?”

সৈকত তার দিকে ফিরতেই ঝিনুক বলল, “খুন করে ফেলব একদম।”

প্রভা ঝিনুককে বলল, “ময়না এইসব কী হচ্ছে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলো। এইখানে এ-সব মানায় না।”

প্রভা সামনে তাকাতে জ্যোতি অর্কের কোল থেকে নেমে বলল, “আংকেল আপনারা এখন ছবি তুলুন। আমি যেয়ে অদিনকে দেখে আসি।”

অর্ক ঝুঁকে জ্যোতির লাগ টেনে বলল, “আপনি নিজেই বাচ্চা কিন্তু নিচের ছোট ভাইয়ের কত খেয়াল রাখন! সো প্রাউড অফ ইউ।”

জ্যোতি এক গাল হেসে মাথা কাত করে বলল, “থ্যাঙ্কিউ আংকেল।”

জ্যোতি স্টেজ থেকে নিচে নামতেই ফটোগ্রাফার অর্ককে বলল, “স্যার মেডামে কাছে এসে কাঁধে হাত রাখেন একটু। ছবি তুলবো।”

অর্ক প্রভার কাছে যেয়ে অন্যপাশের কাঁধ হাত রাখল। কাঁধটা শক্ত করে ধরতে প্রভা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে কিন্তু টু শব্দও করে না। অর্ক হেসে বলল, “ওয়েলকাম টু হেল, সুইটহার্ট।”
প্রভা তাকালো অর্কর দিকে। সাথে সাথেই ছবি তোলা হলো।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here