মন_কেমনের_বৃষ্টি পর্ব ১

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আকাশে ঘন কালো মেঘ। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে গুডুম গুডুম। বিদ্যুৎ ও চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। মেয়েটি কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। তার মুখের উপর জল পড়ছে ছেলেটির মুখ থেকে চুয়ে চুয়ে। এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে মেয়েটি তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। সে যে ছেলেটির হাতের বাঁধনে কখন আটকা পড়েছে বুঝতেই পারল না। বহুদিন পর তার ঠোঁটের কোণায় একটু হাসির দেখা মিলল। বহুদিন পর। তার এত কাছাকাছি থাকা ছেলেটা একসময় তার স্বামী ছিল। তার রোগী। যদি ও সে ডক্টর নয়। ছেলেটি নিজেই ডক্টর। ছেলেটার মৃদু মৃদু প্রত্যেকটা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সে পরিচিত। খুব করে পরিচিত। ছেলেটার স্পর্শ তাকে নতুন করে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। যদি ও স্পর্শগুলোর সাথে সে খুব পরিচিত। ছেলেটার তাকানো,চাহনিগুলোর মাঝে খুব পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে তার স্পর্শগুলোতে ও। আগে তার স্পর্শে মেশানো থাকত নির্ভরশীলতা হয়ত ভালোবাসা ও। কিন্তু এখন তার স্পর্শগুলো একদম অপরিচিত। সে স্পর্শ করেছে খুব অপরিচিত একজনকে। চেনাজানার গন্ডিটা যদি ও খুবই সীমিত। সেহেতু অচেনাই বলা যায়। ছেলেটি কপালে ভাঁজ ফেলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। ছেলেটি আগে মেয়েটিকে মিষ্টি করে ডাকত, মিষ্টি। কিন্তু এ মুহূর্ত সে ডাক শোনার কোনো সম্ভাবনা না থাকলে ও তার খুব করে ইচ্ছে হলো একটিবার, শুধু একটিবার মিষ্টি ডাকটি শুনতে। কিন্তু তার ভাবনার সুতো ছিড়ে দিয়ে ছেলেটি তাকে হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিল। বলল, বৃষ্টির দিনে রাস্তায় এভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেন? আজকে যদি গাড়ির নিচে চাপা পড়তেন? দোষটা আমার হতো। অসহ্য।
ছেলেটার কন্ঠে ঝড়ে পড়ল বিরক্তি। মেয়েটার খুব ভালো লাগল। খুব ভালো লাগল ছেলেটার কন্ঠে বিরক্তি দেখে। খুব ভালো লাগল ছেলেটির এত বিস্তর পরিবর্তন দেখে। খুব ভালো লাগল ছেলেটির এমন গম্ভীর রূপ দেখে। সে তো এটাই চেয়েছিল। ছেলেটির মেয়েটির মুখ থেকে কোনো কথা বেরোতে না দেখে দ্বিগুণ বিরক্ত লাগল। এই মেয়েটা এতদিন পর কোথা থেকে উড়ে আসল। তারসাথে সবসময় কেন মন কেমন করা বৃষ্টির সময় দেখা হয়? কেন?
মেয়েটির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল বৃষ্টিজলে মিশে একাকার হয়ে গেল। ছেলেটি দেখল না। টের ও পেল না। মেয়েটির উপর বিরক্ত হয়ে গটগট পায়ে হেঁটে গাড়ির কাছে চলে যায়। মেয়েটিকে একা দাঁড় করিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। মেয়েটির দিকে তাকায়না। গাড়িতে থাকা টিয়ে পাখিটি আচমকা ডানা ঝাপটানো শুরু করে। ডেকে উঠে, মিষ্টি, মিষ্টি।
ছেলেটি অবাক হয়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি হঠাৎ চমকে উঠে। ছেলেটির চোখ আপনাআপনি মেয়েটির দিকে চলে যায়। দুজনই আবার চোখাচোখি হয়। টিয়ে পাখিটি দ্বিগুণ হারে ডানা ঝাপটানো শুরু করে। ছেলেটি ধমক দিয়ে বলে, মিনি স্টপ, স্টপ। কে মিষ্টি?
মেয়েটি চোখ মুছে নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটি হাতে নিয়ে আবার উল্টো পথে দৌড়াতে থাকে। ছেলেটির দিকে আর পিছু ফিরে তাকায়না। মিনির ডাক ও শোনে না। তার ধরা দিলে চলবে না। ছেলেটি অবাক হয়ে বলে, কি আশ্চর্য!
মিনি ডানা ঝাপটানো ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়। মেয়েটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সামান্য আওয়াজ করে আবার বলে , মিষ্টি!
ছেলেটি মিনির উপর চরম বিরক্ত হয়। বলে, মিনি তোমাকে এসব কে শিখিয়েছে? শুধু আমার নাম ডাকবে। আদি, আদি। শুধু আদি ডাকবে। ওকে!
মিনি এবার শেষবার ডানা ঝাপটায়। ডাকে, আদি মিষ্টি। মিষ্টি আদি।
আদি এবার গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে ঘুষি মারে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে, কে মিষ্টি? কে? মিনি চুপ হয়ে যায় আদির রাগ দেখে। মাথা নিচু করে পায়ে ঠোকা দিতে থাকেে ঠোঁট দিয়ে।

মেয়েটি বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই হামলে পড়ল কারো বুকে। ছেলেটি দু পা পিছিয়ে গেল। বলল,কি হয়েছে ইশু, কাঁদছিস কেন? মেয়েটি কিছুক্ষণ কান্না করে। তারপর মাথা তুলে বলে,রিপদা আমি দেখেছি।
রিপ অবাক হয়ে জানতে চায়, কাকে দেখেছিস? কি দেখেছিস?
ইশা উত্তর দেয়না। শুধু ছেলেটির বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে অবিরত। রিপ কিছুই বুঝেনা। মেয়েটির স্পর্শে তার অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। সে ভালোবাসা এই ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটাকে। বড্ড বেশি ভালোবাসে।

অতীত____________

এক মন কেমনের বৃষ্টির দিনে মেয়েটি বউ হয়ে আসল চৌধুরী পরিবারের ছোট ছেলের বউ হয়ে। নাম তার ইশা। বাইরে তখন ঘোর অন্ধকার। মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর মনে হলো বাইরের চাইতে ও চৌধুরী বাড়িতে অন্ধকার আর ও বেশি। থমথমে পরিবেশ চারিদিকে। চৌধুরী বাড়ির একটা মানুষের মুখে ও নেই সামান্যতম হাসি। মনে হচ্ছেনা কোনো বিয়ে বাড়ি। ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়েছে। মেয়েটি তার বরের ছবি দেখেছিল শুধু। ছবি দেখে সে অবাক হয়েছিল কারণ এই ছেলেটির সাথে তার কয়েকবার দেখা হয়েছিল। তা ও মন কেমনের বৃষ্টির সময়। ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন শুনে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল। কষ্টকর হলে ও সত্যিটা সত্যিই। মাতৃপিতৃহীন মেয়ে সে। বেড়ে উঠা মামার বাড়িতে । স্বনামধন্য, বিশাল মালিকানার অধিকারী আখিল চৌধুরীর ছোট ছেলের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ আসায় মেয়েটির মামা জহির মিয়া লোভ সামলাতে পারল না। ছেলেটি নাকি পেশায় ডক্টর ও। স্ত্রী তালহার বুদ্ধিতে রাজী হয়ে গেলেন জহির মিয়া । যখন শুনলেন ছেলেটি পাগল তখন জহির মিয়া বেঁকে বসলেন। বললেন,এ বিয়েটা সম্ভব না। পাগল ছেলের সাথে বিয়েতে রাজী হবে না ইশা। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তে জল ঢেলে দিল মেয়েটি নিজেই। বলল, বিয়েটা আমি করব। মেয়েটির অমন সিদ্ধান্তে সবার খটকা লাগল। একটা পাগলকে বিয়ে করার জন্য মেয়েটি রাজী হয়ে গেল? সবার ধারণা হলো মেয়েটি বিত্তশালী দেখে রাজী হয়ে গিয়েছে। মেয়েটি তাদের কথায় কর্ণপাত করল না। সে তার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকল। মেয়েটিকে শুধু বউ সাজিয়ে পেপারে সাইন নিয়ে গাড়ি করে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু বরের দেখা মিলল না কোথাও। ছেলেটির বড় ভাইয়ের বউ, মেয়েটির জা রায়না ছাড়া আর কেউ মেয়েটির সাথে কথা ও বলল না। এমনকি কাজের লোক ও না। ছেলেটির মাকে দেখা গেল। দামী শাড়ি, অলংকার গায়ে জড়ানো অবস্থায়। কি অহংকার তার কথার ভাঁজে। বাবাটা তো প্রচন্ড পরিমাণে দাম্ভিক আর রাগী। বড় ভাইটা ও ঠিক তাই। মেয়েটির মনে হলো সে জাহান্নামে পা দিয়েছে। বরটা ও নিশ্চয় তেমনই হবে তাতে আর সন্দেহ রইল না। সে নিজেকে নিজ হাতেই জবাই করল তা আর বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু তারপর ও কোথাও একটা সুপ্ত আশা থেকে যায়। যা নিয়েই তার এগিয়ে চলা।
ভারী শাড়ি আর অলংকার তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হলো। কয়েকটা সুতির শাড়ি দেওয়া হলো তাকে। বাইরে থেকে আনা খাবারের প্যাকেট ছুড়ে দেওয়া হলো তাকে। খিদের চোটে কোনোমতে গোগ্রাসে গিলল সে সেই খাবার। সুন্দর সাজানো গোছানো একটি রুমে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো । বিছানা আসবাবপত্র গুলোতে আভিজাত্যের ছোঁয়া। রুমে ডুকতে না ডুকতেই কাজের লোকের মেয়েটির ধমক, এই মেয়ে দরজা বন্ধ করে দাও।
ইশা বেশ অবাক হলো। কথামত দরজা বন্ধ করে দিল। বিছানার এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর গুনগুন আওয়াজ পেয়ে সে বিছানা থেকে নেমে বসে রইল। তার কানে বেজে উঠল একটি টিয়ে পাখির ডাক। আদি,আদি,আদি।
মেয়েটি ধীরপায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল ধবধবে সাদা পান্জাবী পড়া একটি ছেলের সাথে। ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে আবার টিয়ে পাখির দিকে মনোযোগ দিল। মেয়েটি খেয়াল করল,ছেলেটির কপালে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা চুলগুলো বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। কাঁধের দিকে ভিজে যাচ্ছে পান্জাবীর কলার। অন্যদিকে কপাল বেয়ে পানি চুয়ে চুয়ে পড়ছে। মেয়েটির হাসি পেল। এই তাহলে তার পাগল বর? মেয়েটি বসে পড়ল ছেলেটির পাশে। ছেলেটির তারপর ও ভাবাবেগ হলো না। উঠে গিয়ে খাবারের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে আবার টিয়ে পাখির পাশে বসে পড়ল। বলল,মিনি তোমার খিদে পেয়েছে? খাইয়ে দেব?
ইশা অবাক হলো। পাশে একটি মেয়ে বসে আছে কিন্তু ছেলেটির সেদিকে খেয়াল নেই। সে ধীরেসুস্থে ডাকল, শুনছেন ডক্টর!
ছেলেটি চোখ পিটপিট করে তাকায় তার দিকে। আচমকা দূরে সরে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে। বলে, কে আপনি? বলতে না বলতে ফুলদানি ছুড়ে মারে। টিভির রিমোট ছুড়ে মারে। অস্ফুটভাবে কি যেন বলতে থাকে। তারমধ্যেই শব্দ হয় দরজা ধাক্কানোর। মেয়েটি ছুটে যায়। কাজের লোক তাকে হাতে টর্চ জাতীয় কিছু ধরিয়ে দিয়ে বলে, বেশি পাগলামো করলে এটির লাইট অন করে আদির চোখে মারবে।
মেয়েটি এটি কি,কেন জিজ্ঞেস করার আগেই কাজের লোক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চলে গেল। ইশা দৌড়ে গিয়ে ছেলেটির চোখের উপর লাইটটি মারল। সাথে সাথে ছেলেটির চোখ বন্ধ হয়ে গেল। দেয়াল ঘেষে শান্ত হয়ে বসে পড়ল। মিনি ডানা ঝাপটে ঝাপটে ডাকল,আদি,আদি।
ইশা লাইটটি রেখে ছেলেটির কাছে দৌড়ে গেল। ছেলেটি তাকে আসতে দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিল। বলল, আমাকে মারবেন না। মারবেন না।
ইশা অভয় দিয়ে বলল, মারব না। আপনি শান্ত হোন প্লিজ। দেখুন আমি ইশা। আপনার ওয়াইফ। মানে বউ।
ছেলেটি শান্ত হয়ে গেল। বোকা বোকা চাহনী দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাল। বলল, মিনি কোথায়?
ইশা হতাশ হলো। বলল, আপনি উঠুন। বিছানায় বসুন। আমি আপনার চুলগুলো মুছে দিই। মিনি আছে।
ছেলেটি মাথা নাড়ল। বলল, না যাব না। মিনি কোথায়?
মিনি ডেকে উঠল,আদি, আদি।
আদি উঠে চলে আসল। মিনির কাছে এসে বলল, মিনি ওই দেখ আরেকটা মিনি এসেছে। মিনি চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, মিনি,মিনি।
ইশার মনে হলো মিনি রেগে এভাবে বলছে। আরেকটা মিনি কোথা থেকে এল এই মিনির রাগের কারণ। ইশা হেসে এগিয়ে গেল। ছেলেটির পাশে বসে বলল, আমি মিনি নই আমি ইশা।
ছেলেটি অদ্ভুতভাবে তাকাল মেয়েটির দিকে। বলল, তুমি খুব মিষ্টি দেখতে, তোমার নাম মিষ্টি। মিনি ডেকে উঠল,মিষ্টি, মিষ্টি।
ইশা মাথা নামিয়ে হাসল। বলল, সত্যিই আমি খুব মিষ্টি দেখতে ডক্টর?
ছেলেটি মাথার উপর নিচ করে বলল, খুব মিষ্টি।
ইশা সেই সুযোগে তোয়ালে নিয়ে আসল। ছেলেটির মাথায় হাত দেওয়ার সাথে সাথে মনে হলো তার হাত কেঁপে উঠেছে। প্রথম কোনো পুরুষমানুষকে সে স্পর্শ করল। না এই ছেলেটি তো তার স্বামী হয়। চুলগুলো মুছে দিয়ে তোয়ালে সরিয়ে নিতেই সে আবিষ্কার করল দুটো পিটপিট করে তাকানো চোখ। ছেলেটি খপ করে তার হাত ধরল। অদ্ভুত চাহনী নিয়ে তাকাল। হুট করে একদলা লজ্জা তার কোথা থেকে ভর করল। ছেলেটি ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে আবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, কি?
ছেলেটি দু তিনবার চোখের পলক ফেলে বলল, মিষ্টি কাকে বলে মিষ্টি ??
মেয়েটি হাসে। হেসে বলে, ডক্টর আপনি আজ থেকে আমার পেশেন্ট। আমি আপনার ডক্টর। আপনার মনে আছে? আমাদের প্রথম দেখা কখন হয়েছিল?
ছেলেটি কিছুই বুঝেনা। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, কখন মিষ্টি??
ইশা হেসে ফিসফিস করে বলে, এক মন কেমনের বৃষ্টির সময়।
ছেলেটি ও তার মত করে তার কানের কাছে এসে বলে, মিষ্টি মন কেমনের বৃষ্টি কাকে বলে?
ইশা নড়তেচড়তে ভুলে যায়। ছেলেটির নিঃশ্বাস পড়ে তার কানের কাছে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারেনা। মন কেমন করা অনুভূতিগুলো নেচে উঠে। তার কেন এমন লাগছে? মনটা কেন এমন করছে? অনুভূতি গুলো কেমন যেন?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here