মন_কেমনের_বৃষ্টি পর্ব ২

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব২
#পুষ্পিতা_প্রিমা

চৌধুরী পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে দেখে ইশার মনে হলো তারা কোনো না কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। এ মানুষগুলোর আশেপাশে যে কেউ থাকলে আপনাআপনি সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবে। প্রত্যেকটা মানুষের চোখেমুখে কেমন যেন অহংকারী ভাব। সাদাসিধে ইশা সুতি শাড়ি পড়া অবস্থায় যখন নিচে নেমে আসল কাজের মেয়েটি তাকে ধমক দিল। মেয়েটির নাম সম্ভবত শানু। ইশা তা নিয়ে আর বেশি ভাবল না। তাকে ধমক দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে শানু বলে, রান্নাঘরে তালা মারা। কেউ যায় না ওদিকটাই। তুমি ও যাবে না।
ইশা অবাক হয়। জানতে চায়, কেন! রান্নাঘরে তালা মারা থাকলে রান্না হবে কিভাবে। খাবেনই বা কি? উনি কালকে প্যাকেটের খাবার কিচ্ছু খাইনি। উনার বোধহয় ভালো লাগে না।
শানু নাক মুখের একরকম অবস্থা করে বলল, বাহঃ আজ থেকেই তদারকি শুরু করে দিলে? আর কয়েকটা দিন যাক।
ইশা হেসে বলে,আমাকে তো তদারকি করার জন্যই আনা হয়েছে।
শানু একেবারে চেতে উঠে। বলে, এটুকুনি পিচ্চি একটা মেয়ে, মুখে মুখে কথা?
ইশা ত্যাড়ছা জবাব দেয়, পিচ্চি হলে কি এ বাড়ির বউ করে আনত? আঠার বছরের একটি মেয়েকে আপনার পিচ্চি মনে হচ্ছে?
শানু কিছু বলতে গিয়ে ও বলতে পারল না। এ মেয়েটা ঠোঁটকাটা হবে বেশ বুঝতে পারছে সে।
উপর থেকে পুরোটা সময় ধরে সব কথা শুনল মিসেস আলিয়া চৌধুরী। ইশা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মহিলাটি আজ ও ভারী শাড়ি আর গয়না পড়ে আছে। তারমানে ইনি সবমসময় এমনই থাকেন। ইশা এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আলিয়া তার সামনে এসে দাঁড়াল সে বুঝতেই পারল না। ইশার দিকে তাকিয়ে সে শান্তস্বরে জবাব দিল, এ বাড়িতে এসেছি আদির সেবাশুশ্রূষা করতে। বিয়ের শর্ত এমনই ছিল। বাড়ির কাজে মাথা ঘামাবে না। আমাদের বাড়িতে রান্না হয়না। আমাদের রেস্টুরেন্ট আছে সেখান থেকেই খাবার আনা হয়। আর সবাই তা তৃপ্তি সহকারে খায়। আদি ও এসব পছন্দ করে। বুঝেছ?
ইশা সব বুঝে ও বুঝল না বিয়ের শর্ত বলে কিছু একটা ছিল। বিয়েতে আবার শর্ত থাকে নাকি? সে তো কিছুই জানেনা।
আলিশা বেগম আবার বললেন, তোমার মামা মামিকে নগদ চারলক্ষ টাকা দিয়েছি হাতেনাতে। প্রমাণ ও আছে। তোমাকে আমরা কিনে নিয়েছি। বুঝতে পেরেছ? আদির রক্ষিতা হয়ে থাকবে তুমি। স্ত্রীর অধিকার নিয়ে যাবে না আদির কাছে । লোকদেখানো বিয়ে এটি। মনে থাকবে? আমার ছেলেকে ইমপ্রেস করার একদম চেষ্টা করবেনা। তারকাছে কিছু পাওয়ার আশা ও করবে না।
মেয়েটির পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। মৃত মা বাবার জায়গায় বসানো মামা মামি তার সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করল? এতবড়! শেষমেশ তাকে কিনা বিক্রি করে দিল? বিশ্বাস ভরসার মানুষগুলোর প্রতি উগলে উঠল ঘৃণা,ক্রোধ। মন ভেঙ্গে গেল তার। চোখ ফেটে কান্না বেরোলো। শাড়ির আচঁল দিয়ে মুখ চেপে ধরল সে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে উচ্চারণ করল,বিশ্বাসঘাতক।
দৌড়ে গিয়ে নিজের রুমে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল। রাগে,ঘৃণায় তার মুখ দিয়ে বেরোলো অদ্ভুত শব্দ। মিনির সাথে বকবক করা ছেলেটি হঠাৎ এমন উদ্ভট শব্দ শুনে আঁতকে উঠল। মিনিকে হাতের তালুতে নিয়ে হেঁটে আসতেই চোখ আটকে গেল বিছানার চাদর খামচে ধরে কান্নারত মেয়েটির দিকে । সে ভয় পেল। মিনিকে উড়িয়ে দিল। বোকা বোকা চাহনি নিয়ে এগিয়ে আসল মেয়েটির কাছে। খাটের উপর দুপা তুলে মুড়িয়ে বসে দুহাতে মুখ রেখে চেয়ে রইল মেয়েটির দিকে। তারপর খুব মিষ্টি করে ডাকল, মিষ্টি!
মেয়েটির সেই ডাকে সম্ভিৎ ফিরল। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল সে । চোখ মুছে নিয়ে বলে, জি।
ছেলেটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জানতে চাইল, তুমি কাঁদছ মিষ্টি?
ইশার হাসি পেল। বলল, না। কাঁদব কেন?
ছেলেটি কপালের একপাশে আঙুল দিয়ে কিছু ভাবতে চাইল। পরে বলল, মিষ্টি আমার মিনির খিদে পেয়েছে।
ইশা ছেলেটির মুখের দিকে তাকাল। বলল, আপনার ও পেয়েছে?
ছেলেটি উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,হ্যা। অসহায় বোকা বোকা মুখখানা দেখে ইশার কষ্ট লাগল। টেবিল থেকে খাবার নিয়ে সামনে দিতেই আদি মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল,আমি ওসব খাব না। রেখে দাও। তুমি যেগুলো খাবে সেগুলো খাব।
ইশা অবাক হয়ে বলল, আমি ও তো এসবই খাব। আদি না, না করে উঠল। বলল,আমি খাব না, খাব না। মিনি ও খাবেনা তাই মিষ্টি ও খাবে না। তুমি খাবেনা মিষ্টি।
” আচ্ছা, আচ্ছা খাব না।
ইশা সান্ত্বনা দিল। কিছু একটা ভেবে বলল, আপনি রোজ এভাবে না খেয়ে থাকতেন?
আদি চুপ করে ভাবনায় মশগুল। ইশা উত্তর না পেয়ে উঠে যেতে নেয়। হাতের টানে আবার সেই জায়গায় বসে। বড় বড় চোখ করে তাকায় আদির দিকে। বলে, কি?
আদি পিটপিট চোখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,তুমি কে মিষ্টি?
ইশা ভ্রুকুটি করে হাসে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে, আমি আপনার বউ।
‘ কিন্তু আমি কে? আদি প্রশ্ন করল।
ইশা আবার ও হাসল। বলল, আপনি আমার বর। ডক্টর বর।
আদি নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলে,আমি বর?
ইশা হেসে বলে, জি মশাই।
মিনি উড়ে উড়ে বলতে লাগল,আদি বর,মিষ্টি বউ। আদি বর, মিষ্টি বউ।
ইশার লজ্জা পেল। সে মাথা নামিয়ে হেসে বলল,মিনি খুব দুষ্টু।
আদি দুহাতে মুখ রেখে ইশার লজ্জিত মুখটার দিকে চেয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর বেশ রয়ে সয়ে বলল,মিষ্টি তুমি খুব সুন্দর।
ইশা লজ্জায় এবার লাল,বেগুনী হতে থাকে। চট করে দাঁড়িয়ে হেঁটে যাওয়ার আগেই আদি তার হাত শক্ত করে টান দিয়ে ফেলে দেয় তাকে। ইশা বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে না উঠতেই তার মুখের উপর পড়ে বোকা বোকা চাহনীর ছেলেটির গরম নিঃশ্বাস। মেয়েটির নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসল । পাল্লা দিয়ে নেচে উঠল এক নতুন বধূর নতুন অনুভূতিরা। সে পরিচিত হলো স্বামী নামক মানুষটির স্পর্শের সাথে। পরিচিত হলো স্বামী নামক মানুষটির গরম নিঃশ্বাসের সাথে। পরিচিত হলো স্বামী নামক মানুষটির সেই মায়াময় চাহনীর সাথে। পরিচিত হলো এক নতুন অনুভূতিদের সাথে। বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলল সে। বিছানায় আর ও চেপে গেল। তখন ও ছেলেটি সেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মেয়েটি ভয় পেল। কে বলবে এই মানুষটি মানসিক রোগী। মনে হচ্ছে একজন সুস্থ,সবল,সুদর্শন একটি ছেলে। একজন স্বামী। মেয়েটি ছেলেটির দুই নয়নে তার দুই নয়ন মিলিয়ে জানতে চাইল,কি?
মেয়েটির নিজের উপর আবার রাগ লাগল। সে কেন কথা বলতে গেল। ছেলেটি মেয়েটির কথা শুনে যেন চমকাল। তার চাহনীর হঠাৎ বদল ঘটল। মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, সুন্দর কাকে বলে মিষ্টি?
মেয়েটি যেন হতাশ হলো। আশ্চর্য! এইটা জিজ্ঞেস করার জন্য এতকিছু? ছেলেটির বুকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতেই দু দফা চমকাল সে। বুকের ভেতর হৃৎস্পন্দন সে স্পষ্ট শুনতে পেল। চট করে হাত সরিয়ে নিল। বলল, ডক্টর সরুন। ছেলেটি বড় বড় চোখ করে তাকাল মেয়েটির দিকে। বলল,কেন?
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল,আমি কি এভাবেই পড়ে থাকব নাকি? আপনার জন্য খাবার আনতে হবে না?
ছেলেটির আবার ও বোকা বোকা প্রশ্ন,
‘ আমি সরলেই তুমি উঠতে পারবে?
মেয়েটি মাথা নাড়াল। বলল ‘ হ্যা।
ছেলেটি জেদ ধরে বলল, তাহলে আমি সরব না। তুমি এভাবে থাকো। আমরা এভাবে থাকি।
ইশা চোখে বিস্ময় নিয়ে বলে, আপনি সত্যিই কি পাগল?
আদি চোখ পিটপিট করে তাকায়। ইশার চুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে, না আমি ডক্টর। মিষ্টির বর।

______________

রান্নাঘরের তালা খুলে দিল মেয়েটির জোরাজুরিতে। আলিয়া বেগম ছেলে খাচ্ছে না দেখে মেয়েটির কথায় রাজী হলো। রান্নাঘরে সব জিনিস মেয়েটি নিজ হাতে পরিষ্কার পরিপাটি করল। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ আড়চোখে দেখল মেয়েটির কাজ। মেয়েটি জানাল, আজ বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া হবে । বাড়ির কয়েকজন কাজের লোক তাকে আপন করে নিল। তার কাজে হাত লাগাল। তাকে বাজার করে এনে দিল। মেয়েটি কিছুমুহূর্তের জন্য ভুলে গেল এটি তার শ্বশুরবাড়ি। নিজের মতো করে সব রান্না করল। বলল, আজকে আমার বৌভাত হবে। তারকথায় কাজের লোক দুজন মিনু,সগির হাসল। শানু তাদের দিকে রাগী চোখে তাকাল। তারা পাত্তা দিল না। তার জা রাইনা তার কাজে হাত লাগানোর উদ্দেশ্যে বলল, আমি তোমার কাছ থেকে রান্না শিখব ইশা। শেখাবে?
মেয়েটি হেসে মাথা নাড়ল। রাইনা খুশি হলো।মেয়েটি ইশারা করল মিনুকে, ডক্টরকে যাতে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসে। সারাদিন খালি একরুমে বসে থাকে!
মিনুকে যেতে হলোনা। ডক্টর নিজেই নেমে এল। ডাকল, মিষ্টি, মিষ্টি। তারসাথে তাল মিলিয়ে মিনি ও ডেকে উঠল, মিষ্টি, মিষ্টি।
ছেলেটি থেমে গেল আলিয়ার সামনে এসে। ইশা এগিয়ে আসতেই খেয়াল হলো আলিয়ার চোখে ভরে উঠেছে জল। ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে বলল, আদি ব্যাটা। কখন সুস্থ হবে তুমি। কখন আবার মা বলে ডাকবে আমায়?
আদি ছুড়ে ফেলে দিল আলিয়ার হাত। চেঁচিয়ে ডাকল,মিষ্টি!
সবাই তার আওয়াজে ভড়কে গেল। ইশা লুকিয়ে পড়ল। খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে এগোনোর আগে রেগেমেগে আগুন হলো আদি। রুমের জিনিসপত্র ভাংচুর শুরু করল। ইশা প্রচন্ড অবাক হলো। টেবিলে খাবার রেখে লাইটটি খুঁজতে লাগল। পেল না। কোথায় রেখেছে কে জানে? আদির পাগলামি বেড়ে গেল দ্বিগুণ। ইশা আর কোনো উপায় দেখল না। অনেক চেষ্টা করে ও থামাতে পারল না আদিকে। দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল কয়েকজন। তারা আদির পাগলামি দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাসি-খুশি, শান্ত-শিষ্ট, গম্ভীর,চাপা-রাগ দেখানো ছেলেটার কি রূপ? কি বাহার?
মেয়েটি দৌড়ে গেল। ছেলেটিকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল, আর না ডক্টর। প্লিজ স্টপ।
নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে ছেলেটি থমকে গেল। হাত দুটোর দিকে একবার চেয়ে তারপর পিছু ফিরল ।
মেয়েটি ভয়ে কান্নারত অবস্থায় চোখ তুলে তাকাল ছেলেটির দিকে। পুরো মুখে,কপালে ঘাম জমে উঠেছে ছেলেটির। ইশা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল,কি হয়েছে? আপনি কেন এমন করছেন?
আদি রেগে জবাব দিল, ওই মহিলা আমাকে ছুঁয়েছে কেন?
গালে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,এখানে মুছে দাও। আমায় এখানে ছুঁয়েছে।
ইশা অবাক হয়ে বলল, উনি আপনার মা ডক্টর।
আদি এবার ইশার হাত ছুড়ে ফেলল। বলল, এখানে মুছে দাও নয়ত চলে যাও।
ইশা ভড়কে গেল আদির কথায়। চট করে আলতো করে মুছে দিল। আদির দিকে তাকাল না। অন্যদিকে ফিরে বলল, বসুন,খাবেন।
আদি ইশার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ভালো ছেলের মত করে বসল। মিনি উড়ে এসে আদির হাতে বসল। বলল, আদি ব্যাড বয়। ব্যাড বয়।
ইশা খাবার নিয়ে এসে আদির পাশে রাখল। বলল,খেয়ে নিন। আমি ওইখানে আছি।
আদি মাথা হেলিয়ে ইশাকে দেখার চেষ্টা করল। কিছু বলতে চেয়ে ও বলল না। ইশা বিছানার এককোণে বসে রইল। আদি খাবারের প্লেট ইশার সামনে রেখে বলল, আমি খাব না মিষ্টি।
ইশা জোরে আওয়াজ করে জানতে চাইল, কেন?
আদি বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল,মিষ্টি খাইয়ে দেবে?
ইশা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল আদির দিকে। ছেলেটার প্রত্যেকটা কাজে,কথায় কি মায়া জড়ানো। সে জড়িয়ে গেছে এই অল্পমুহূর্তে ছেলেটির সাথে। ছেলেটার কথার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার বোকা বোকা চাহনীতে সে হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার প্রত্যেকটা শ্বাসপ্রশ্বাস তার হৃদয়ে ছন্দ তুলে নাচছে। এই ছেলেটি তার স্বামী। কত কত আশা থাকে মেয়েদের এই স্বামী সংসার নিয়ে। ইশার ও তো ছিল। কিন্তু তারবেলা অন্যরকম কেন হলো?
ইশা প্লেট হাতে নিয়ে চুপচাপ খাইয়ে দিল। কোনোকথা বলল না। আদি খেতে খেতে তাকাল। বলল, মিষ্টি খাবে না?
ইশা কোনোকথা না বলে তারপর ও খাইয়ে দিতে লাগল। আদি এবার খুব অসহায় হয়ে ডাকল, মিষ্টি!
ইশা চোখ তুলে তাকাল। গলার স্বর উঁচু করে বলল,
‘ কি হয়েছে?
আদি কেঁপে উঠল। আর না খেয়ে চলে গেল। ইশার রাগ উঠল খুব। রাগ না ভাঙিয়ে নিজেই রাগ করে চলে গেল। বাহঃ!
প্লেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই হঠাৎ তার মনে হলো। ডক্টরের তো সেন্স নেই। উনি কি বুঝে নাকি কিসে রাগ হয়? রাগ কি করে ভাঙাতে হয়?
মেয়েটি দৌড়ে আবার রুমে চলে গেল। প্লেট রেখে ছেলেটির কাছাকাছি গিয়ে ডাকল’ ডক্টর শুনছেন?
ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। বলল, মিষ্টি তুমি আমার সাথে আগের মতো কথা বলছ না কেন?
ইশা চমকে উঠল। ছেলেটির ছলছল চোখ দেখে সে ভড়কে গেল। আপনাআপনি তার নিজের দুচোখ টলমল করে উঠল। আদি আবার ও ডাকল , মিষ্টি!
ইশা চোখ নামিয়ে আবার ও চোখ তুলে তাকাল। ছেলেটির নাক টিপে দিয়ে বলল, আমি আপনার কে হয় যে আমি রাগলে আপনার কষ্ট হবে?
আদি এতবড় প্রশ্ন শুনে মিষ্টির দিকে অসহায় হয়ে তাকাল। ভেবে বলল, মিষ্টি আমার বউ। আমি তার বর।
চোখে জমে থাকা অশ্রুজল ইশার গড়গড় করে গড়িয়ে পড়ে। এ প্রথম,,,,একদম এই প্রথম সে তার স্বামী নামক মানুষটাকে জাপটে জড়িয়ে ধরল। আদির সুড়সুড়ি লাগল। কিন্তু সে তারপর ও কিছু বলল না। মিষ্টি যদি আবার কথা বলা বন্ধ করে দেয়?
বেশখানিক্ষণ পর ইশা ছেড়ে দিল আদিকে। নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হলো। দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ডক্টরের ডাকে ফিরে ও তাকাল না।

______________

ফোন কাঁপিয়ে কল এল। মেয়েটি দৌড়ে ফোন হাতে নেওয়ার পর দেখতে পেল ফোনের ওয়ালে একটি নাম, রিপদা। মেয়েটি চিন্তায় পড়ে গেল। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ভেসে এল উৎকন্ঠিত কন্ঠস্বর। ” ইশু কাল থেকে ফোনে পাচ্ছি না তোকে। কি হয়েছে রে?
মেয়েটি শুকনো ঢোক গিলে বলল, কই কিছু তো হয়নি! তুমি কেমন আছ?
ওপাশ থেকে উত্তর এল,
‘ তুই আমাকে চিন্তায় রেখে এখন জানতে চাইছিস কেমন আছি?
মেয়েটি হাসল। বেশখানিক্ষণ কথা বলল। ওপাশ থেকে খানিকক্ষণ পর উত্তর এল, মাকে দে তো। মায়ের ফোনে কল যাচ্ছে না।
মেয়েটির এবার কলিজা শুকিয়ে গেল। রিপদা তো বিয়ের কথা জানেনা। এখন মামিকে কোথায় পাবে সে?
সে মিথ্যে বলল। রিপদা আমি বাইরে এসেছি, মামিকে বলব তোমাকে ফোন দিতে।
ছেলেটি তাকে জেরা করল। বলল,বাইরে কেন? বড়দা নেই বাসায়?
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল,তুমি আমাকে বেশি বেশি প্রশ্ন করো। আমি কি এখন ছোট আছি? বড় হয়ে গেছি না?
ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ আসে। বলে, আমি দেশে ফিরব খুব তাড়াতাড়ি। তোকে বেশি বেশি প্রশ্ন করার দায়িত্ব নেব। কত বড় হয়েছিস দেখে নেব।
ইশা হাসে। হাসির সাথে তার কান্না ও আসে। এই একমাত্র মানুষ যে তাকে খুব করে বুঝে। খুব বেশি ভালোবাসে। ইশা ও একজন ভাইয়ের চাইতে ও বেশি ভালোবাসে তার রিপদাকে। এই মানুষটার জন্যই সে এতদূর লেখাপড়া করতে পেরেছে। সেই মানুষটা তো জানলই না যে তার ইশুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ইশু বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যদি জানতে পারে?
ইশা ফোন রেখে পিছু ফিরতেই দেখে ডক্টর দাঁড়িয়ে আছে। ইশা মুখ বাড়িয়ে বলল, কি ?
আদি উত্তর দিল না। চুপচাপ রুমে চলে গেল। ইশা পিছুপিছু গেল। আদি মুখ কালো করে চুপচাপ সোফায় বসে রইল। ইশা পাশে গিয়ে বসতেই ইশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ইশার দিকে তাকাল না। মুখটা ইশার কোলে গুজে দিল। ইশা কেঁপে উঠল। নিগূঢ় অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তার মনপ্রাণ। আবার ও এক নতুন অনুভূতিদের সাথে পরিচিত হলো সে। তার হঠাৎ মনে হলো এই মানুষটা খানিকক্ষণের জন্য তার জীবনে এল। খুব অল্প সময়ের জন্য এল। আবার চলে যাবে। সে স্ত্রী নয়। সে রক্ষিতা। ছেলেটি যখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে তখন তার স্থান কি থাকবে এই বাড়িতে? নাকি এই ছেলেটার মনে? কোথাও কি থাকবে? তাকে ভুলে যাবে না তো? ছেলেটির মাথার চুল সে খামচে ধরল। অস্ফুটভাবে উচ্চারণ করল, না ডক্টর শুধু আমার। আমি ডক্টরকে ছেড়ে কোথাও যাব না। কোথাও না। আমি ডক্টরের সাথে থাকব।
আদি খেয়াল করল মেয়েটির হালকা হালকা কাঁপুনির সাথে কান্না। বহুক্ষণ পর আদি চোখ তুলে তাকাল মেয়েটির দিকে। মেয়েটির কান্নার কারণ জানতে চাইল না। মেয়েটি চোখ নামিয়ে তাকাতেই চোখাচোখি হয় চারটি চোখ। মেয়েটি একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, কি?
ছেলেটি একরাশ অভিমান নিয়ে বলে, মিষ্টি তোমার কি আর ও একটা আদি আছে?
ইশা অবাক হয়। কন্ঠে নম্রতা এনে বলে, আদি তো একটাই হয়।

______________

আজিজ চৌধুরী এলেন ছেলের সাথে দেখা করতে। আদি আজিজকে দেখে কুঁকড়ে গেল। খাটের এককোণায় চুপিসারে বসে রইল। আজিজ চৌধুরী ইশাকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিল। ফোন এগিয়ে দিল আদির দিকে। বলল, আদি ব্যাটা দেখো কে ফোন করেছে? আইমি ফোন করেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।
আদি না,না বলে উঠল। বিছানার কোণায় হাত পা গুটিয়ে বসে রইল। ইশা বলল, বাবা উনাকে উত্তেজিত করে তুলবেন না। আমাকে দিন, আমি দিচ্ছি।
আজিজ ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। বলল, চুপ থাকো মেয়ে। বাবা ডাকবে না। স্যার ডাকবে। মনে থাকবে?
ইশার কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সাহসে কুলোলো না। এ কেমন অবিচার তার সাথে?
আজিজ জোরাজুরি করলেন। কিন্তু আদির সাথে পারলেন না। শেষমেশ ফোনের ওপাশের মেয়েটিকে বলল,আইমি আদি কাউকে চিনতে পারছে না। তোমাকে ও চিনতে পারবে না। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।
ইশা স্পষ্ট শুনল ফোনের ওপাশের মেয়েটির কান্না। মেয়েটির কথাগুলো ও শুনতে পেল। ‘ আদি আমাকে ভুলে যেতে পারেনা আন্কেল। আদি আমাকে ভালোবাসে। আদি কথা বলবে আমার সাথে, আপনি ফোনটা দিন প্লিজ।
ইশা চোখ তুলে তাকাল বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ছেলেটির দিকে। খাটের পাশে আয়নায় চোখ রাখতেই সে দেখল তার দুচোখ ভর্তি হয়ে উঠেছে জলে। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে তা গড়িয়ে পড়ল। তারকানে বেজে উঠল, আদি আমাকে ভালোবাসে!
ইশা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, ভালোবাসা কি? ডক্টর ভালোবাসতে ও জানে? ডক্টর কি আমায় শেখাবে কি করে ভালোবাসতে হয়?
আজিজ চৌধুরী ছেলেকে একপলক দেখে চলে গেল। ইশাকে বোধহয় রোবট মনে করল। সত্যিই সে কেউ নয় এ বাড়ির। ওই ছেলেটার ও কেউ নয়।
সে দৌড়ে গেল আজিজ চৌধুরীর পিছু পিছু। বলল,ফোনটা আমায় দিন,আমি কথা বলিয়ে দেব। আজিজ চৌধুরী চমকালেন না। দিয়ে দিলেন ফোন।
কি আশ্চর্য! ইশার কষ্ট হচ্ছে। কেন কষ্ট হচ্ছে এত?
ইশা ফোনটা হাতে নিয়ে পাশে বসল ডক্টরের। আদি এতক্ষণ পর নিশ্চিন্তে বসল। ডাকল,মিষ্টি! ওই বাজে লোকদের তুমি এখানে আসতে দেবে না।
ইশার চোখ জলে ভরপুর। তারপর ও হেসে বলল,আচ্ছা দেব না।
আদি হাসে। বাচ্চাদের মত কি সুন্দর হাসি। ইশা অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে নিল। অনেকক্ষণ পর বেশ রয়ে সয়ে বলল,ডক্টর, আইমিকে ভালোবাসেন আপনি?
আদি চোখ পিটপিট করে তাকায়। মিনি ডানা ঝাপটে বলে উঠল, আইমি আইমি।
আদি মিনির থেকে চোখ সরিয়ে মিষ্টির দিকে তাকায়। বুঝে হোক না বুঝে মাথা নাড়ায়। ইশার শুকনো চোখ আবার জলে ভরে উঠে। বহুকষ্ট নিয়ে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,আপনার আইমি ফোন দিয়েছে আপনাকে,নিন কথা বলুন।
আদি ফোনটা হাতে নেয় ইশার দিকে তাকিয়ে। মিষ্টির চোখে, কন্ঠে কান্না দেখে সে নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিছুই বলতে পারেনা। ইশা আওয়াজ করে বলে, কথা বলুন, আইমি বলে ডাকুন। এভাবে কি দেখছেন?
আদি ফোনটা কানের পাশে চেপে ধরে। ইশার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ডাকে,আইমি?
ইশা চট করে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ডুকরে কেঁদে উঠে। দৌড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
আদি ফোন হাতে নিয়ে ইশার পিছু পিছু বের হয়। ডাকে,মিষ্টি দাঁড়াও!
ইশা ডাক শোনেনা। শানু,মিনু দেখে ইশার দৌড়ে ছাদে যাওয়া। আদি তাদের দেখে থেমে যায়। প্রচন্ড রাগসহিত ফোনটা ছুড়ে মারে তাদের দিকে। তারপর ইশার পিছু পিছু দৌড়ে ছাদে চলে যায়।
কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা চালায় ইশা। একবার থামে তো আরেকবার কোথা থেকে এসে ভর করে। ছাদের রেলিং ধরে অবিরত কান্নায় যখন সে নিমজ্জিত তখন তার পেছনে এসে দাঁড়ায় একটি ছেলে। মেয়েটি তার উপস্থিতি টের পেয়ে চট করে চোখ মুখে মুছে নেয়। অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। ছেলেটি কি বলবে খুঁজে পায়না। তার কানে বাজে, আইমি,আইমি। তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। কিন্তু সে বলেনা। শুধু অসহায় হয়ে ডাকে, মিষ্টি!
মিষ্টি তাকায় না তার দিকে। সে আবার ও ডাকে, মিষ্টি?
মিষ্টি তারপর ও ফিরে তাকায় না। সে তারপর বলে, মিষ্টি তুমি কাঁদছ? কেন কাঁদছ?
ইশা তার ফোলা ফোলা চোখমুখ নিয়ে আদির সামনাসামনি এসে বলে, কোথায় কাঁদছি? আপনার জন্য আমি কেন কাঁদব? আপনার জন্য তো আইমি কাঁদছে।
আদিকে চিন্তিত দেখা গেল। বলল, আইমি কেন কাঁদছে? মিষ্টি কি আমার মতো তার সাথে ও রাগ দেখিয়েছে।
বোকা বোকা কথা শুনে ইশার হাসি পেলে ও সে হাসল না। রাতের আলো আধাঁরিতে দেখা গেল একটুকরো চাঁদের ফালি। সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসল। কোথা থেকে বকুল ফুলের সুগন্ধ ভেসে উঠল। মেয়েটি তার পাশে বোকা বোকা চাহনী নিয়ে তাকানো ছেলেটির দিকে তাকাল। কাছাকাছি গিয়ে জানতে চাইল, আপনি আইমিকে ভালোবাসেন ডক্টর?
ছেলেটি চুপচাপ চেয়ে রইল মেয়েটির মুখপানে। চাঁদের আলোয় মেয়েটির মুখখানা খেয়াল করতে গিয়ে সে প্রশ্নটি ভুলে গেল। কন্ঠে এবার পরিবর্তন এনে,বেশ সিক্ত কন্ঠে জানতে চাইল,মিষ্টি ভালোবাসা কাকে বলে?

চলবে,

( আপনাদের অনুভূতি জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here