মন_কেমনের_বৃষ্টি পর্ব ২১+২২

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২১
#পুষ্পিতা_প্রিমা

তার পরের দিনই হসপিটাল থেকে ইশাকে রিলিজ দেওয়া হলো। খানিকটা সুস্থ হলে ও হাত নড়াচড়া করতে তার বেগ পেতে হলো। তার অসুস্থতার কথা শুনে নীরা আর অর্পি দেখতে এল তাকে। যদি ও নীরা বড্ড লাজুক। সে রিপের সামনে পড়তেই চায়না। তারপরে ও রিপের সামনে কয়েকবার পড়তে হলো। লজ্জা, আড়ষ্টতা তাকে ঘিরে ধরল। রিপকে দেখে মনে হচ্ছেনা সে তাদেরকে পাত্তা দিচ্ছে। দিনশেষে রাত এল। ইশা একা রুমে বসে বসে যখনি মিনুমাকে ফোন দিতে যাবে। প্লেট হাতে ডুকে পড়ল রিপ তার রুমে। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, খেয়ে নে।
ইশা নাকমুখ কুঁচকে বলল, পরীর সাথে খেয়েছি। ভাবী দুজনকে একসাথে খাইয়ে দিয়েছে। আর খাব না। খিদে নেই।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। রিপ কথা বাড়াল না। ছোট ছোট করে ভাত মেখে ইশার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, হা কর তো। ন্যাকামি ভালো লাগেনা।
ইশা মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে লাগল। চোখে পানি টলমল।

রিপ তার ছলছলে চোখ দেখে নিঃশব্দে হাসল। বলল,সবগুলো খাবি চুপচাপ।

ইশা ফুঁপিয়ে উঠল। কিন্তু রিপ বুঝে উঠার সাথে সাথে আবার চুপ হয়ে গেল। রিপ খাইয়ে দিল। ইশার তেষ্টা পেলে ও পানি খেল না। ঝাল লাগায় দাঁতে দাঁত চেপে রাখল। তারপর ও পানি খেলনা। রিপ ধমক দিয়ে বলল, পানি খাচ্ছিস না কেন?

ইশা এবার নীরবে কাঁদল না।

হু হু করে কেঁদে দিল। হিঁচকি তুলে কাঁদল। কিন্তু কিছু বলল না। রিপ এমন কান্ডকারখানায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল,
‘ আমি এভাবে কাঁদার মতো কি বলেছি। চুপ কর।
ইশা মাথা নামিয়ে আর ও বেশি করে কাঁদল।
তারমধ্যেই পরী উঁকি দিল রুমে। লুকোচুরি খেলার মতো দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ডাকল, রিইইইই নাই নাই।
রিপ পরীর কান্ড দেখে কিছু বলল না। কোনো আওয়াজ না পেয়ে পরী বুঝে গেল কিছু একটা হয়েছে।
রিপ ইশাকে বলল, তুই তো পরীর চাইতে ছোট বাচ্চা। আমি তো তোর ভালোর জন্যই বলেছি। তুই নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছিস। শুটকি হয়ে যাচ্ছিস শুকিয়ে শুকিয়ে। ডক্টরের প্রেসক্রিপশনে তোর খাওয়ার কথা স্পেশাল ভাবে বলা আছে। তোর শরীর খুব দুর্বল। না খেলে তো আর ও দুর্বল হয়ে পড়বে । কিসের এত টেনশন তোর?
তুই যাতে ভালো থাকিস তার জন্য আমি কি করিনি,কি করছিনা? কিন্তু তারপর ও তোর কিন্তু উন্নতি দেখতে পাচ্ছি না। দিনদিন অবনতি।
ইশার কান্না থামল না। সে থামাতে চেয়ে ও থামতে পারছেনা। আসলেই তো এমনটা কেন হয়?
যারা একটু বেশিই ভালোবাসে তাদের আদর,স্নেহ,মায়া,মমতা হাতপুড়ে নিলে ও তাদের একটুখানি বকা আমরা সইতে পারিনা। চোখ গলে সমুদ্র নেমে আসে। ইশা হিঁচকি তুলে তুলে কাঁদল। পরী গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল খাটের কাছাকাছি। কোমড়ে হাত দিল বিজ্ঞদের মতো। চোখ ছোট ছোট করে গলা কাত করে ইশার মুখ দেখার চেষ্টা করল। তারপর আবার রিপের মুখ দেখার চেষ্টা করল। এভাবে তাকে তাকাতে দেখে রিপ নীরবে হাসল। কান্নারত মেয়েটির দিকে একটিবার তাকাল। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এগিয়ে দিল মেয়েটির দিকে। নরম কন্ঠে বলল, কান্না থামা। আমার দেখতে ভালো লাগছেনা।
সাথে সাথে কান্না থেমে গেল ইশার। চোখ মুছে নিয়ে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেয়ে নিল। রিপ প্লেট রেখে আসল। ইশার পাশে বসে নিজ হাতে সব ঔষধ খাওয়াল। পরী চুপচাপ দেখল। পরে ডাকল। রিইইই ফিপপি দুক্কু?
রিপ হেসে মাথা নাড়াল। বলল, হ্যা, ফিপপি ছোট্ট বাচ্চা। তাই দুক্কু পেয়েছে।
ইশা মাথা নিচু করে বসে রইল। রিপ বলল, এভাবে বসে আছিস কেন? মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে রেখেছিস। হাস।
ইশা হাসার বদলে শুধু দুইবার হিঁচকি তুলল। রিপ অসহায় হয়ে তাকাল। ইশার চোখের পানি মুছে দিল। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে,আর কখনো ওভাবে বলব না। এবার কান্না বন্ধ কর।
ইশা তাকাল রিপের দিকে। কিচ্ছুটি বলল না। রিপ শুধু দেখল তার গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। সে আবার মুছে দিল সেই জল। গালের একপাশে হাতের চার আঙুল দিয়ে আলতোকরে টোকা দিয়ে বলে,
‘ আমার একটুখানি রাগ যেমন তোর কান্নার কারণ। আমার ধমক যেমন তুই সহ্য করতে পারিস না! তেমন আমি ও তোর দেওয়া আঘাত,যন্ত্রণা সইতে পারব না। আমি তো তোর মতো কাঁদতে ও পারব না। তাই ভুলে ও আমাকে আঘাত দিবি না।
কথাটিতে যে কি মেশানো ছিল ইশা জানেনা। সে আওয়াজ করে কেঁদে দিল। রিপ দাঁড়াল না। বেরিয়ে পড়ল। সে যতক্ষণ থাকবে মেয়েটি ততক্ষণ কাঁদবে।
পরী মোড়া এনে নিচে রাখল। মোড়া বেয়ে ইশার গায়ের উপর উঠে বসল। হাতের মুঠো দিয়ে ইশার দুইগাল আঁকড়ে ধরল। কাঁদোকাঁদো কন্ঠে ডাকল,আমমমমা……..
ইশা চুপ হয়ে গেল। বলল, কি?
পরী কিচ্ছু বলল না। ইশার গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। ঢলে পড়ল ইশার উপর। ইশা ঘুমন্ত মেয়েটির কপালের চুল সরিয়ে চুমু আঁকল। পুরো মুখে আদর দিল। তারপর তার পাশে শুইয়ে রেখে নিজে ও শুয়ে পড়ল। নরম তুলতুলে গায়ে হাত দিয়ে চোখ বুজতেই ঘুম নেমে এল চোখে। কিন্তু তা ছুটে গেল মুনা এসেই পরীকে কোলে নিয়ে নেওয়ায়। ইশা বহুদিন পর একটু অন্যায় আবদার করল।

‘ আজ ও আমার সাথে ঘুমোক না ভাবী?

মুনা অপ্রস্তুত হাসল। বলল, ওর মাঝরাতে খিদে পায়।
ইশা বলল,’ আমি ফিডার খাওয়াতে পারি। খাইয়েছি কয়েকবার। দাও না একবার। পারব। সত্যি।
মুনা একবার দরজার দিকে তাকাল। মলিন হেসে বলল,
‘ তোর বড়দা ? আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করে আসি।
ইশা বিছানা থেকে নেমে এল। ধরা কন্ঠে বলল,
‘ না না বড়দার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। নিয়ে যাও। আমি তো এমনিই বলছিলাম। নিয়ে যাও।
মুনা সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। দাঁড়ায় না। ইশা অশ্রুসজল নয়নে হাসল। কাঁদতে কাদঁতে হাসল। যে কেউ দেখলে বলবে, মেয়েটি নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু এই কাঁদাহাসা একত্রে আর বেশিক্ষণ ঠিকল না। তার কান্নায় ভারী হলো পুরো রুম। তবে সে কান্না আওয়াজ করে নয়। গুনগুনিয়ে। কেউ দেখল ও না। কেউ শুনল ও না। চারদেয়ালের ভেতরেই আটকে রইল কান্নার আওয়াজ। চোখমুখ মুছে সে বিছানার কাছে গিয়ে বসল। বালিশ তার জায়গা থেকে সরালেই উন্মুক্ত হয় সেই সাদা পান্জাবীর ঘ্রাণ। অন্যদিন হলে এই পান্জাবী দেখলে তার শান্তি লাগে, ডক্টর তো নেই,ডক্টরের এই পান্জাবীটা তো আছে। ডক্টরের স্মৃতি হিসেবে। ডক্টরের স্পর্শ হিসেবে।
কিন্তু আজ কেন জানি তার এই পান্জাবীটাকেই অসহ্য লাগছে। কেটে কুটিকুটি করতে ইচ্ছে করছে। সে ঠিক সেটাই করল। ড্রেসিং টেবিল থেকে কাঁচি নিয়ে কেটে কুচিকুচি করল পান্জাবীটাকে। নিজের এই রাগ ঝেড়ে নিল পান্জাবীটার উপর। যখনি নিজের সম্ভিৎ ফিরল,নিজের কাজেই সে নিজেই অবাক হলো। পান্জাবীর টুকরো টুকরো অংশগুলো নিজ হাতে ছুঁয়ে সে হু হু করে কেঁদে দিল। ডুকরে উঠে আবোলতাবোল বকতে লাগল। ছেঁড়া অংশগুলো হাতে নিয়ে বলল,
‘ আমার নিজের সন্তানকে আমি নিজের কাছে রাখতে পারিনা ডক্টর, শুধু আপনার জন্য। আদর করতে ও সীমা লাগে।

তাকে কোলে নিতে ও ভাবতে হয়। তাকে নিজের হাতে খাওয়াতে পারিনা আমি। শুধু আপনার জন্য। তাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে পারিনা আমি, শুধুই আপনার জন্য।
তাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে পারিনা শুধু আপনার জন্য।
আপনি আজ আমার পাশে থাকলে এতকিছু হতো না ডক্টর। আমাদের ছোট্ট একটি সংসার হতো। আপনি তো এটা ও জানেন না যে আপনার একটা মেয়ে আছে। আপনি জানেন না। অনুভব ও করতে পারেন না। আপনি আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা নিয়ে ব্যস্ত। আপনি নতুন করে সংসার সাজানোর কাজে ব্যস্ত। কিন্তু মাঝখানে আমি সব কষ্ট পাচ্ছি। সব কষ্ট আমাকেই কেন পেতে হয়। সব কষ্ট আমি কেন পাই? সন্তানটা তো আপনার ও। অন্যকে মা ডাকছে,বাবা ডাকছে। আপনার তো কষ্ট হয়না ডক্টর। আপনি প্রেসক্রিপশনে কত সুন্দর করে লিখলেন নিজের সন্তানের বাবা মায়ের নাম। কত সুন্দর সেই লেখা। আপনার তাতে ও কষ্ট হলোনা। হওয়ার যে কথা নয়। তবে এবার থেকে আমি আর কষ্ট পাব না। কষ্ট এবার আপনি পাবেন। আমি কখনো আপনাকে পরীকে ছুঁতে দেব না। আপনার কাছে পরীকে কখনো যেতে দেবনা। কখনো না। আমি যেই কষ্ট পাচ্ছি তার দ্বিগুণ দেব। তার হাজারগুণ বেশি দেব।

______________________

বিছানায় যত্নসহকারে সাজানো সব শাড়ি গহনা। আইমি বালিশ নিচে দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। ফোনের ওপাশের ছেলেটিকে বলল,
‘ আদি তোমার যেটা পছন্দ হবে আমি সেই শাড়িটাই পড়ব। আমার তো সব সুন্দর লাগছে। তোমার চয়জ কিন্তু ফাটাফাটি।

আদি নীরব হয়ে শুনল আইমির প্রত্যেকটি কথা। বলল,
‘ আমার ও সব পছন্দ, তোমার যেটা ইচ্ছে সেটাই পড়তে পারো।
আইমির কষ্ট লাগল। বলল,

‘ যেকোনো একটা বলো আদি। তুমি যেটা বলবে সেটাই ফাইনাল।

আদি ভেবে বলল,

‘ যেটা বেশি লাল টকটকে সেটাই পড়ো।

আইমি উঠে বসল। শাড়িটা হাতে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। লালটা নিলাম।
আদি হাসল। কিন্তু কিছু বলল না। আইমি তাকে এত চুপ দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি ভাবছ?
আদি ভ্যাবাচ্যাকা খেল, বলল,
‘ না তেমন কিছুনা। ভাবছিলাম শাড়িটাতে তোমাকে কেমন লাগবে?
‘ আচ্ছা! তাহলে বলো কেমন লাগবে?
আদি হাঁটতে হাঁটতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। বলল,
‘ সামনাসামনি দেখলে বলতে পারতাম। এখন বলতে পারছিনা।
আইমি চুপ থাকল। খানিকক্ষণ পর বলল,
‘ আচ্ছা।
আদি জানতে চাইল রাগ করেছ?
‘ না, না রাগ কেন করব? আমি কি সবসময় তোমার সাথে রাগ করি আদি?
আদি খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,

‘ সন্দেহ করো। রাগ নয়। সরি মিস্টেক।

আইমির কন্ঠের ধরণ পাল্টাল, বলল,

‘ তুমি এখনো রেগে আছ আদি? আমার তখন মাথা ঠিক ছিল না।

আদি প্রত্যুত্তরে হাসল। বলল,

‘ ডক্টরের শার্টে রক্ত লাগতেই পারে। আর মাতাল অবস্থায় মানুষ অনেক কিছু বলে। এসব কিছু তুমি সিরিয়াসলি নিয়েছ ইমি। আমাকে সন্দেহের চোখে দেখেছ। আদি কি ইমির কাছ থেকে এসব আশা করেছিল কখনো?
আইমির কন্ঠ ধরে আসে। অভিমানে চোখ চকচক করে। বলে,
‘ তুমি এখনো এসব মনে রেখে দিয়েছ আদি?
আমি তো মজার ছলে বলেছিলাম। সেটা বলেছি ও।
আদি দরজা ঠেলে নিজের রুমের ডুকল। বলল,
‘ মন খারাপ করোনা ইমি। আমি ও মজা করছি। টিট ফর ট্যাট।
আইমি স্বস্তি পেল। বলল,
‘ তুমি এরকম বাজে ইয়ার্কি আমার সাথে করবে না আদি। আমি রোম্যান্টিক মুডে ছিলাম। তুমি সব শেষ করে দিলে।
আদি হো হো করে হাসল। বলল,
‘ রোম্যান্টিক মুড আবার কি ইমি?
আইমি হাসল। ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ আহারে বাবুটা কিছু জানেনা।
আদি পুরো রুম কাঁপিয়ে হাসল। বলল,
‘ হোয়াট এ সিলি ল্যাঙ্গুয়েজ ইমি?
আইমি দাঁত বের করে হাসল। বলল,
‘ বাবু বলাই যায়।
‘ আদির সাথে কখনোই যায় না ইমি। আদি শুধু বাবু নয়, আদি ডাক্তারবাবু। বাবুর আগে ডাক্তার বসালে বলাই যায়। আটকাচ্ছে কে?
দুজনই একসাথে হাসল।
আদি রুমের চারপাশে চোখ বুলাল। বলল,ইমি আমি মিনিকে খুব মিস করছি। মিনি কখন ফিরবে আমার কাছে।
আইমি চিন্তিত হয়ে বলল,
‘ মিনি কেন শুধু শুধু একটা মেয়ের সাথে চলে যাবে আদি? এটা তো রহস্যজনক।
আদি শান্ত গলায় বলল,
‘ মিনি মিষ্টির কাছে গিয়েছে ইমি। মিনি মিষ্টিকে চেনে।
আইমি এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে ভড়কে গেল। বলল,
‘ আদি কে মিষ্টি? কার কথা বলছ?
আদি হাসল। বলল, সরি ইমি তুমি আমাকে বলোনি। তাই আমি ও তোমাকে সত্যিটা জানাতে বিলম্ব করলাম। তবে বলে দিয়েছি। তোমার মতো লুকিয়ে রাখিনি।
অজানা অচেনা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল আইমির। বলল,
‘ মিষ্টি নামের কেউ নেই আদি। কেউ ছিলনা তোমার জীবনে।
আদি প্রত্যুত্তরে বলল,
‘ মিথ্যে ইমি। মিষ্টি ছিল। কিন্তু এখন নেই। সে হয়ত এখন বিবাহিত। কিন্তু তখন বিবাহিত ছিলনা। একজন বিবাহিত মেয়ে কখনো অন্য একটা পরপুরুষের দেখাশোনার দায়িত্ব নেবেনা। কেন সবাই আমাকে মিথ্যে বলছে আমি জানিনা ইমি। তুমি ও মিথ্যে বলছ। কিন্তু কেন ইমি?
আইমির ফুঁপানোর আওয়াজ টের পায় আদি। বলে,
‘ কান্নার কি বললাম ইমি?
আইমি রাগ হয়। বলে,
‘ তুমি কেন মিষ্টিকে খুঁজছ আদি? কেন?
আদি নিজে ও জানেনা এর উত্তর। সে নিজে ও এমন প্রশ্নে চমকাল। আনমনা হয়ে বলল,
‘ মিষ্টি বোধহয় ডক্টরকে ভালোবাসে ইমি। মিথ্যে হতেই পারেনা।
আইমি গলার আওয়াজ বড় হলো ।
‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি না আদি? কে মিষ্টি? কে ডক্টর? সব মিথ্যে আদি। তোমার জীবনে শুধু আমিই সত্যি।
আদি শান্ত গলায় জবাব দেয়।
‘ আমাদের বিয়ের আগে আমি সব রহস্য বের করে আনব আইমি। তোমাকে কাঁদার সুযোগ দেব না। তোমার আমার মাঝে যত লুকোচুরি চলছে সব আমি খুঁজে বের করব। কিন্তু আই প্রমিজ ইমি। আমি তোমাকে একটু ও কষ্ট দেব না ইমি। তোমাকে সত্যিই খুব ভালো রাখব।

‘ কিন্তু তুমি? তুমি ভালো থাকবেনা আদি?

আইমির প্রশ্নের জবাবে সে শুধু বলে,

‘ যদি চায়? তুমি বা সে? তবেই তো ভালো থাকব। তার আগে কি করে ইমি?

_______________________

আজিজ চৌধুরী খাবার টেবিলের প্লেট ছুড়ে মারল দূরে। রাইনা,মিনু,শানু ভয়ে কুঁকিয়ে উঠল। আজিজ চৌধুরী গর্জন করে বলল,
‘ এখানে চিঠি আসে কার হাত দিয়ে? বলো?
সবাই চুপ থাকে। আজিজ চেঁচিয়ে ডাকে,
‘ রাইনা?
রাইনা কেঁপে উঠে। মিনমিনে গলায় বলে
‘ বাবা আমি এই ওই কাজ করতে সময় ও পায়না। মা তো জানে। আমি কি করে ওসব?
আজিজ চৌধুরী মিনু আর শানুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। প্লেট তাদের দিকে ছুড়ে মেরে বললেন,
‘ তোমরা দুজন থেকে কেউ একজন হবে। শানু তো দেখতেই পারতনা ওই মেয়েকে। নিশ্চয় এই কাজ মিনুর। তাই না?

মিনু মাথা নামানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকল। জবাব দিল না।
আলিয়া ধমক দিয়ে বললেন।
‘ সত্যিটা বলো। যদি কোনোসময় ধরা পড়ো জীবিত ফিরতে পারবে না। চৌধুরী বাড়ি থেকেই তোমার লাশ বেরোবে।
মিনু কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
‘ আমি কিচ্ছু জানিনা। চিঠিগুলো ইশা নিজেই লিখে গিয়েছে। আর ও চিঠি এ কারণেই পাঠিয়েছে,ওই চিঠিগুলো আদি বাবার চোখে পড়ার আগেই যাতে সরিয়ে ফেলা হয়। আমি তাই করেছি। এর বেশি কিছুনা।
আজিজ চৌধুরী কিছু বলতে পারলেন না। কিন্তু মনে মনে স্বস্তি পেলেন। যাক মেয়েটা অন্তত তাকে ভয় পেয়েছে। আদি আইমির বিয়েটা এবার হওয়া বাকি। তাদের এব্রোড পাঠিয়ে দিতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। যে মরার মরুক । যে বাঁচার বাঁচুক।
আজিজ চৌধুরী শান্ত হয়ে সোফায় বসার আগেই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন পায়। ফোনটি ইমির।
আদি তো আজ বাসায় নেই। ইমির ফোন কেন?
ফোন রিসিভ করে সে কথা বলল। আর ও একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। এবার আর কাঁচা গুটি চালবে না আজিজ চৌধুরী। এবার পাকা গুটি চালতে হবে। বিয়েটা হওয়ার আগ পর্যন্ত আদিকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।

আজিজ চৌধুরী চেয়ার টেনে চেয়ারে বসার আগেই দেখতে পায় পকেটে হাত পুড়ে তীক্ষ্ণাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছেলেটিকে। ছেলেটির চোয়াল শক্ত। চোখে একরাশ অবিশ্বাস, সন্দেহ। দরজার কাছাকাছি দাঁড়ানো। কখন এল আদি? আলিয়া এগিয়ে গেল। ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হলো। আদি কোনোকিছু শোনেনি তো?
আদি আলিয়া বেগমের হাত নামিয়ে নিলেন মুখ থেকে। আজিজ চৌধুরীর দিকে একবার তাকিয়ে বেশ শান্ত গলায় বলল,
‘ মিষ্টি আমার ওয়াইফ ছিল মা? এখন? এখন কি সে অন্যের ওয়াইফ? তোমরা সবাই, ইমি ও মিথ্যে বলেছ আমায়? কিন্তু কেন মা?

আজিজ চৌধুরী চাইলেন আদির সাথে কথা বলতে। কিন্তু আদি হাত দেখিয়ে বলতে বারণ করল। উগ্রস্বরে বলল,
‘ আমি থাকব না এ বাড়িতে।
ব্যস এতটুকুই। আজিজ আর আলিয়াকে কিছু বলতে দিল না সে। মিনু রাইনা নীরবে,নিঃশব্দে হাসল।
প্রায় আধ-ঘন্টা পর আদি নেমে আসল স্যুটকেস সমেত। বলল, আমি এ বাসায় থাকব না। অন্য ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। এমন বিশ্রী মনমানসিকতার মানুষের সাথে থাকতে ইচ্ছে করছেনা। বিবেকে বাঁধছে। যেদিন মনে হবে,সত্যিটা আমাকে বলতে পারবে। সেদিন আমি এ বাসায় ফিরব।
আজিজ চৌধুরী এগিয়ে গেলেন। বললেন,
‘ তোমার খারাপ চেয়েছি এটাই বলতে চাইছ তুমি?
আদি হাসল। বলল, ভালো চেয়েছ। জানিনা আমার ভালোর জন্য আর কত কি করেছ তুমি? কতজনকে আঘাত করেছ? কতজনকে কষ্টে রেখেছ? ভালোমন্দ শিক্ষাটা তোমরাই আমাকে দেবে, সেখানে আমাকেই দিতে ইচ্ছে। দাভাইকে বা কি বলা যায়? তোমরাই তো তাকে সেই শিক্ষা দিয়েছ। ও তাই শিখেছে। এখন সব তার দোষ। যদি আমি হতাম তার মতো। দোষ কাকে দিতে মা? নিশ্চয় নিজেদের দিতে না? কপালকে দিতে। ভাগ্যকে দায়ী করতে। নয়ত নিজেরা গর্ব করতে। আমার কি মনে হয় জানো,আমি এমন হওয়ায় তোমরা অসন্তুষ্ট। আমার তো মাঝেমাঝে সন্দেহ হয় পালিত সন্তান কি সত্যিই দাভাই নাকি আমি?
আলিয়ার দুচোখ জলে টলমল করে উঠে। বলে, কি উল্টাপাল্টা বলছ আদি?
আদি এতক্ষণে চেপে রাখা রাগ দেখিয়ে দেয়। গর্জে বলে,
‘ দাভাই তোমাদের কারণেই এমন হয়েছে। তোমরাই ওকে অবহেলা করেছ। ওকে অবজ্ঞা করেছ। তাই সে এমন হয়েছে। তোমরা ওকে শেখাওনি কোনটা ভালো কোনটা খারাপ? ওকে ওর মতো চলতে দিয়েছ। ওর প্রত্যেকটা খারাপ কাজে সাপোর্ট করেছ। আমার মতো ওকে সারাক্ষণ পড়তে বলোনি। খেলতে শেখাওনি। আমার মতো ওকে ও আদর যত্ন করোনি। আমি তোমাদের সব অন্যায় দেখি বাবা। সব বুঝি। শুধু এমন একটা সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। আজ আর আমি চুপ থাকব না। থাকব না আমি এই বাড়িতে। এক মুহূর্ত ও না।

কেউ আটকাতে পারেনা আদিকে। আজিজ চৌধুরী হাজার অনুরোধ করে ও লাভ হয়না। আলিয়া চৌধুরী কাঁদতে থাকে। আজিজ চৌধুরীর সব রাগ গিয়ে পড়ে ওই একটি মেয়ের উপর। ওই মায়াবিনীর উপর। এবার এর শেষ দেখে ছাড়বে আজিজ চৌধুরী। বামন হয়ে চাঁদে যাওয়ার শখ একেবারে মিটিয়ে দেবে।

__________________________

পুরোবাড়ি মুখোরিত হলো পরীর খিলখিল হাসির আওয়াজে। ইশার দুচোখে পট্টি বাঁধা দেখে সে আবার ও খিলখিল করে হাসল। রিক আর জহির মিয়া কথা বলছে। রিপ পরীর সাথে মিলে ইশার সাথে কানামাছি খেলছে। রিপ পরীকে বলল, মা বলো কানামাছি ভোঁ ভোঁ।
পরী হাতের তালুতে তালু দিতে দিতে বলল,
‘ ভোবভো,ফিপপপি ভোবভো।
ইশা হাসল। বলল।
‘ আমি দেখতে পাচ্ছি রিপদা। ওখানে পরী।পরীর পাশে তুমি।
রিপ উঠে গেল। ইশার চোখের পট্টি খুলে আর ও শক্ত করে বাঁধতে গিয়ে ইশা তার হাত ধরে ফেলল। বলল, এত শক্ত করে বেঁধোনা রিপদা । ব্যাথা পায়।
রিপ চুপ থাকল কিছুক্ষণ। ইশার হাত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
‘ এভাবে ছুঁবিনা। ছাড়।
ইশা ভ্রুকুঞ্চন করে দাঁড়িয়ে থাকে। আশ্চর্য!
পরী ডাকে, ফিপপপি ভোবভো।
ইশা হাসে। বলে, এখন পরী কে ও দেখতে পাচ্ছি না। রিপদা তোমাকে ও দেখতে পাচ্ছি না।
রিপ বিড়বিড় করে বলল, তুই আমাকে এমনিতে ও দেখতে পাস না।
ইশা বলল, কিছু বললে?
রিপ বলে,
‘ না বলিনি। তবে বলব শীঘ্রই।
পরী ডাক দিল। রিইইইইই ভোবভো…….
রিক আর জহির মিয়া হাসল। রিক ডাক দিল, পরী মা…..কি করছ?
পরী হাসল গা নাড়িয়ে। বলল, পাপপা ভোবভো….
তারা হাসার আগেই পরী নিজেই নিজেই হাসতে মেঝেতে বসে পড়ল। তালহাকে হাত দেখিয়ে ডেকে বলে, দাদ্দাআ ভোবভো…….
ইশা ও পরীর সাথে তাল মিলিয়ে হাসল। মেঝেতে হাতের ভর দিয়ে উঠে বসল পরী । তারপর রিপের পেছনে গিয়ে ইশাকে ডাকল, ফিপফি ভোবভো। মিনি উড়ে এল। ডাকল, মিষ্টি ভো ভো।
পরী মিনিকে দেখে হাসল। হাতের তালুতে ঠোঁটে লাগিয়ে মিনির দিকে ছুড়ে মারল ফ্লাইং কিস। বলল, মিনননি আমমমমাহ।
রিক হাসল। বলল, এটা কি মা?
রিপ হাসল। বলল, দাভাই এটা আমি শিখিয়েছি। মিনিকে ফ্লাইং কিস পাঠাচ্ছে। পরী রিকের কাছাকাছি চলে আসল। বলল, পাপপা আমমমাহ।
ইশা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
‘ ঠিক আছে আমি দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে এইভাবে?
রিপ পরীকে নিয়ে গেল। বলল, না খেলা এখন থেকে শুরু। কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ।
পরী হাসি থামতে পারল না। ইশা বহুদূরে থাকা স্বত্বে ও রিকের কোলে এসে লুকিয়ে পড়ল। তালহার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। মুনার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল। রিপ গিয়ে সোফার এককোণায় চুপিসারে বসে থাকল। ইশা ডাকল পরী কোথায় তুমি? রিইইই কোথায়? পরী?
মুনা বলল,পরী গিয়েছে সেদিকে।
রিক বলল, পরী মায়ের কাছে গিয়েছে।
তালহা বলল,পরী রিপের কাছে। ইশা চোখ খুলে ফেলল সাথে সাথে। চিৎকার করে বলল, কোথায় পরী?
রিক উঠে গেল। বলল, এখন তো হাসছিল। সোফার পেছনে গিয়েছিল।
রিপ বলল, এখন আমার সামনেই ছিল।
ইশা ডাক দিল, পরী কোথায় তুমি? পরী মা..
রিক গর্জে উঠল। একটা ছোট্ট মেয়ে কোথায় যাচ্ছে কেউ দেখবে না। আশ্চর্য!
ইশার বুক ধ্বক করে উঠল। সে চেঁচিয়ে ডাকল,পরী?
রিক ডাকল। মুনা ডাকল। রিপ ডাকল। তালহা কাঁদাকাঁদি শুরু করে দিল। জহির মিয়া বললেন, পরী দাদুমণি কোথায় তুমি? পরী….
আশপাশ সবাই তন্নতন্ন করে খুঁজল। রিক দিশেহারা হয়ে পড়ল। মুুনা এগিয়ে এল, রিক মুনার কথায় কান দিল না। হাত দিয়ে বারণ করল কথা না বলতে।
পরী,পরী আওয়াজে ভরপুর হলো পরিবেশ। ইশা তো কেঁদেই দিল। কিন্তু তা একজন ছাড়া কেউ দেখল না। ইশা কান্নামাখা কন্ঠে ডাকল, পরী। কোথায় তুমি। পরী,,,
সবাই পাগলের মতো খু্ঁজল পরীকে। কিন্তু কেউ দেখল না।
ইশা বাইরে বের হয়ে আসল। দেখল গেইট বন্ধ। কেঁদে কেঁদে এদিকওদিক তাকাতেই দেখতে পেল হাতে কতগুলো চকলেট নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে পরী। একবার হোঁচট খেয়ে পড়ল। আবার উঠল ইশাকে চকলেট দেখিয়ে বলল, ফিপপি চককো….
ইশা দৌড়ে গেল । চকলেট কেড়ে নিয়ে চড় বসাল পরীর গালে। পরী পড়ে গেল। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। ইশা চকলেট গুলো দূরে ফেলে দিয়ে পরীকে কোলে তুলে নিল। আদর করে দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। বলল, এসব তোমাকে কে দিয়েছে পরী? তুমি কেন বাসা থেকে বের হয়েছ? কেঁদোনা মা।
পরী কাঁদতে লাগল। ইশাকে হাত পা ছুড়ে মারল। কামড় বসাল কাঁধে। চুল টেনে ধরল।
রিক,মুনা,রিপ সবাই ছুটে আসল। রিক দৌড়ে আসল। পরীকে কোলে নিল এক ঝটকায়। শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি পাপাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছ পরী।
পরী কাঁদতে কাঁদতে দেখিয়ে দেয় ইশাকে। রিক পরীকে মুনার কাছে দিয়ে দেয়। রিপ মুনার পেছন পেছন পরীকে শান্ত করতে করতে চলে যায়। রিক ভয়ার্ত চোখে তাকায় ইশার দিকে। ইশা কাঁদে নীরবে। অসহায় হয়ে তাকায় রিকের দিকে। রিক ভয় নিয়ে বলে, ইশু তুই কেড়ে নিস না পরীকে। তুই তো আজীবনের জন্য দিয়ে দিয়েছিস। এ কথার নড়চড় করিস না ইশু। পরীকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিস না।
ইশা কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে রিককে। বলে, দাভাই আমি শুধু তোমাদের ইশু হয়ে থাকতে চায়। আর কিছুনা। আমাকে কখনো অবিশ্বাস করোনা।
রিক স্বস্তি পায়। ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, মেরেছিস পরীকে? মেরে কি লাভ হলো? নিজেই তো ব্যাথা পেলি।
ইশা মাথা তুলে তাকায় রিকের দিকে। আবদার করে বসে, একটা দিন পরীকে আমাকে দিয়ে দেবে? শুধু একদিনের জন্য। আর কক্ষনো চাইব না।
রিক হাসল। মাথায় হাত রাখল ইশার। বলল,
‘ আচ্ছা। রাখিস তোর কাছে। কিন্তু দেখিস আমাকে আবার ফিরিয়ে দিবি। কেড়ে নিস না রে ইশু। একেবারে নিয়ে নিস না। ইশা খুশি হয়ে গেল। খুশিতে জড়িয়ে ধরল আবার রিককে। বলল, থ্যাংকস বড়দা।

রাত দশটা। ফোনকলের আওয়াজে আদির ঘুম ভাঙলে ও আদি সেই ফোন তুলল না। বিরক্ত হয়ে কেটে দিল। আবার ও ফোন এল। এবার ও সে সত্যি সত্যি কেটে দিল ফোন। আবার ও এল। আবার ও সে কাটল। শেষবার চারবারে সে ফোন তুলল। ফোন কানে দেওয়ার সাথে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ এল। আদি বলল, আমি ব্যস্ত আছি ইমি। পরে কথা বলছি।
আইমিকে কিছু বলতে না দিয়ে আদি ফোন কেটে দেয়।
আইমি কিছু বলার সুযোগ পায়না। আদি সুযোগ দেয় না।
ডক্টর ইমদাদকে ফোন দেয় আদি। ওনি দশটায় ফ্রি হবেন বলেছিলেন। ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ডক্টর ইমদাদ ফোন তুলেন। কুশলসংবাদ জানাজানির পর কাজের কথায় ফিরল দুজন। আদি জানতে চাইল,
‘ সবকিছু কি আর কখনোই মনে পড়া সম্ভব নয় স্যার ?
আদি প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন,
‘ সম্ভব। তবে যদি তোমার ব্রেনের হেমোক্যাম্পাস পুরোপুরি স্ট্রং হয়। কারণ সেসব মনে করতে গিয়ে যদি তোমার মস্তিষ্কে আবার আঘাত লাগে তাহলে চিরজীবনের জন্য তোমার স্মৃতি চলে যাবে আদি। তাই সেসব মনে না করাটাই বেটার তোমার জন্য।
আদি উৎসুক হয়ে বলল,
‘ আই থিংক আমার হেমোক্যাম্পাস পুরোপুরি স্ট্রং। এখন কি মনে করার চেষ্টা করতে পারব?
ডক্টর ইমদাদ বললেন,
‘ হ্যা। পারবে। তবে সেসব কথা তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে। অনুভব করিয়ে দিতে হবে। তুমি এক কাজ করো। তোমার স্ত্রীর সাহায্য নিতে পারো। সে কেমন আছে আদি?
ভারী মিষ্টি মেয়েটা। তুমি তাকে মিষ্টি ডাকতে রাইট?
আদি থমকাল। চমকাল। বলল
‘ স্ত্রী?
মিষ্টি?
সে আমার কাছে নেই স্যার । আমি তাকে চিনিনা। কে সে? কোথায় তার বাস? আপনি চেনেন?
ডক্টর ইমদাদ হাসল। বলল,
‘ মিষ্টি ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিল। ঠিক তাই হলো। এত ভালোবেসেছিলে মেয়েটাকে। ভুলে গেলে? কি করে আদি? এমন ও হয়?
#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২২
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রিপ গায়ের সামনে একেকটা পান্জাবী দিয়ে দেখছে। তাকে দেখতে কেমন লাগছে? একটা ও তার পছন্দ হচ্ছে না। সে চেঁচিয়ে ডাকল,
‘ এই ইশু। আমি কোনটা পড়ব? তাড়াতাড়ি আয়। দেখিয়ে দে।

রিপের ডাক শুনে মুনা চলে আসল। হাসল। বলল,
‘ সে রেডি হচ্ছে। তুই ডাকলে আসবে নাকি?
রিপ হতাশ হয়ে বসে পড়ল বিছানায়। বলল,
আমি কোনটা পড়ব?
মুনা হাসল। বলল, এই তোর প্ল্যানটা কি বলতো?
রিপ মাথা চুলকাল। বলল, আজ সেই দিনটা। সুযোগ পেলে আজ সত্যি সত্যি বলে দেব। তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি।
মুনা হা করে তাকাল রিপের দিকে। রিপের পাশে ধপ করে বসে বলল, ও আল্লাহ! তুই এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছিস?
রিপ হাসল। বলল, আমি বলেছি নাকি? ইশু নিজেই বলেছে সে ঘুরতে যাবে।
মুনা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
‘ তাহলে সেখানে পরী গিয়ে কি করবে?
রিপ ভাবল। ভেবে বলল, পরীর জন্যই তো যাচ্ছে ইশু। বড়দা নাকি পারমিশন দিয়েছে।
মুনা হো হো করে হেসে উঠল। বলল,
‘ আমার মেয়েকে কেন থার্ড পারসন বানাচ্ছিস ভাই। তোরা একা যাহ।
রিপ মুনার দিকে ফিরে বসল। বলল,
‘ সত্যি! কিন্তু ইশু তো পরীকে ছাড়া যাবে না।
মুনা বলল,
‘ আমি চেষ্টা করে দেখি।
দুজনের কথা শেষ করতে না করতেই হাজির হলো ইশা। কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়ল। মাথার লম্বা চুলগুলো পিঠে পড়ে আছে। মুখে দীপ্তিময় হাসি। হাতের চুড়িগুলো টুংটাং আওয়াজ তুলছে। ইশাকে দেখে মুনা হাসল। রিপ দেখেনি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে লাগল কোন পান্জাবীটা পড়বে। ইশা কোমরে হাত দিয়ে নাক ফুলিয়ে তাকাল।
বলল, ‘ রিপুদা তুমি এখনো শার্ট পড়ে আছ?
মুনা বলল, পরী মা কোথায় দেখে আসি। তোরা ঝগড়া কর।
ইশা কোমরে হাত দিয়ে বলল,
‘ কিছু বলছ না কেন?
রিপ পান্জাবী হাতে নিতে নিতে বলল,
‘ কোনটা পড়ব বুঝতে পারছিনা।
ইশা এগিয়ে গেল। রিপের হাত থেকে গাঢ় সোনালি রঙের পান্জাবীটা কেড়ে নিল। রিপের গায়ে দেওয়ার মত করে দিয়ে বর্ণনা দিতে লাগল। এই দেখো কেমন মানিয়েছে? কেমন সুন্দর লাগছে? খাপে খাপ মিলেছে। এ রঙের পান্জাবী পড়বে তুমি। কি সুন্দর মানিয়েছে তোমায়। এটাই পড়বে তুমি। এটাই পড়ো।
মেয়েটি যদি একটিবার চোখ তুলে দেখত তাহলে দেখতে পেত সুন্দর ছেলেটি তার সৌন্দর্যের এত বর্ণনা একটু ও শুনছেনা। সে তো বিমোহিত। সে মগ্ন তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির মুখশ্রীতে। মেয়েটির নতুন রূপে। কিন্তু আফসোস মেয়েটি খেয়াল করল না। চোখ তুলে দেখল না। পরীর ডাকে হুশ ফিরল রিপের। কি কি করতে করতে সে সরে পড়ল ইশার সামনে থেকে। ছিঃ কি নির্লজ্জ সে?
এভাবে কি কেউ তাকিয়ে থাকে? ইশু কি ভাবল কে জানে? তার রিপুদা এত খারাপ?

পরীর পড়নে সাদা গোলাপি মিশেল ফ্রক। হাতে ও অন্য রঙের দুইটা ফ্রক। ইশার দিকে তাকিয়ে ফ্রক দুইটা দেখিয়ে বলল,
‘ ফিফপপপি এতততো….
ইশা পরীকে দেখে হাসল। ফিসফিস করে বলল, আমার মা।
পরী তার কথার জবাবে হাসল। বলল
‘ এততো।
ইশা আবার ডাকল, এই মা।
পরী হেসে ইশার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল বলল, এমমমমাহ।
ইশা তার মুখ দুহাতে আগলে ধরে গুলুমুলু দুইগালে আদর দিয়ে বলল, আম্মা ডাকো।
পরী ইশার মতো করে ইশার দুইগাল আঁকড়ে ধরে। ইশার দুই গালে লালা লাগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ আমমমমাহ।
খুশিতে ইশার চোখে পানি চলে আসে। সে তা আড়াল করে। পরীর কপালে চুমো দেয়। বলে
‘ তুমি জানো আমিই তোমার মা। ফিপি নয়। আর তোমার বাবা। ডক্টর…….

রিক আর মুনা ছুটে এল। রিক বলল,
‘ দেখেছিস ইশু, তিনটাই পড়বে নাকি?
ইশা হাসল। পরীর হাত থেকে ফ্রক দুইটি নেওয়ার জন্য বলল,
‘ আমাকে দাও মা। সবগুলো কিভাবে পড়বে?
পরী দিল না। ডাকল, রিইইইই মিননননি।
মিনি উড়ে এল। ডাকল, যাব। যাব।
ইশা হাসল। বলল,
‘ যাবে ঠিক আছে। এখন পরীর হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে রেখে এসো পরীর ঘরে।
মিনি তাই করল। পরী হাত থেকে ঠোঁট দিয়ে কেঁড়ে নিল ফ্রকদুটো। উড়ে চলে গেল। পরী মিনির পিছু পিছু দৌড়ে গেল। ডাকল, মিননননি নান নান না।
রিক আর মুনা হাসতে হাসতে দৌড়ে গেল পরীর পিছু পিছু। পরী ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে কেঁদে দৌড়াল মিনির পিছু পিছু।
রিপ যখন বের হয়ে এল রেডি হয়ে। ইশার হঠাৎ মনে হলো। আজ যদি ডক্টর থাকত তাদের সাথে?
রিপ বলল, কেমন লাগছে?
ইশা হাসল। রিপের পান্জাবীর কলার ঠিক করে দিয়ে বলল, সেই লাগছে। ফটো তুলে পাঠাতে হবে নীরার কাছে। বেচারি ক্রাশের উপর ক্রাশ খাবে।
রিপ রেগে তাকাল ইশার দিকে। ইশা হাসতে হাসতে চোখ বন্ধ করে নিল। আর রিপ সেই হাসির মায়াজালে আবার, হ্যা আবার ও আটকা পড়ল। কখন ছাড়া পাবে কে জানে?

_________________

পরী রিকের কোলে চড়ে নেমে এল নিচে। জহির মিয়াকে দেখার সাথে সাথে রিকের কোল থেকে নেমে এল। জহির মিয়ার সামনে তাকিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। দেখাতে চাইল সে নতুন জামা পড়েছে। কিন্তু জহির মিয়ার চোখের সামনে পত্রিকা। তাই পরী রাগ করল। চোখে টলমলে পানি নিয়ে রিকের দিকে তাকাল। রিক হেসে বলল, বাবা পত্রিকা সরাও। আমার মেয়েকে দেখো। বলো,সুন্দর লাগছে।
জহির মিয়া পত্রিকা সরাতেই হেসে উঠল পরী। গালের দুপাশে হাত দিয়ে এদিকওদিক ঢলতে ঢলতে বলল, দাদদদা ওয়াহ?
রিপ পান্জাবীর হাতা গুটিয়ে নিচে নামতে নামতে বলল, ওয়াহ মানে ওয়াও। আমি শিখিয়েছি।
পরী হাসল। রিপের দিকে ফিরে বলল। রিইইইইই ওয়াহ।
সবাই হাসল।
পরী দৌড়ে গেল তালহার কাছে। নিজেকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল, দাদ্দা ওয়াহ না?
তালহা বেগম হাসল। বলল, হ্যা আমার দাদুমণি অনেক সুন্দর। পরী তালহাকে আদর দিয়ে চলে আসল।
মুনার কাছে গিয়ে ও একই কাজ করল। মুনার পুরো গাল লালা দিয়ে ভরিয়ে দিল। ইশা যখনি নিচে নেমে আসে। পরী তার কাছে দৌড়ে যায়। বলে
‘ ফিপপি ওয়াহ।
ইশা হাসল। ফিসফিস করে বলল, আমার মা তো খুব সুন্দর। খুব কিউট।
পরী কিউট উচ্চারণ করতে চাইল। পারল না। ইশা খিলখিল করে হাসল পরীর কান্ড দেখে। যে হাসির মাঝে একজনের চোরা দৃষ্টি বারংবার ঘুরপাক খাচ্ছে। অবিরত।
রিপ চেঁচিয়ে ডাকল ইশাকে। আর কতক্ষণ। তাড়াতাড়ি আয়। মুনা এগিয়ে আসল।বলল, পরী না যাক। তোরা যাহ।
সাথে সাথে ইশার মুখ কালো হয়ে গেল। রিক তা দেখল। এগিয়ে আসল সে। মুনাকে বলল, না পরী যাক। আমি বলেছি। ইশু,, যাবে পরী।
ইশা অসহায় চোখে মুনার দিকে তাকাল। মুনা হেসে দিল। বলল, মজা করছিলাম। যাহ।
ইশা কোলে তুলে নিল পরীকে। বলল, সবাইকে টা টা দাও মা।
পরী চুপ থাকল। কাউকে টা টা দিল না। ইশা যখন দরজার কাছাকাছি আসল পরী তার কোল থেকে নামার জন্য জোরাজুরি লাগাল। ইশা অবাক হয়ে নামিয়ে দিল পরীকে। পরী দৌড়ে গেল রিকের দিকে। রিক তাকে দৌড়ে যেতে দেখে হাঁটুভেঙ্গে মেঝেতে বসে হাত বাড়িয়ে দিল। পরী শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরল রিকের। মিনমিন করে ডাকল, পাপপা…….
শক্তপোক্ত ব্যাক্তিত্বের রিক আজ কান্নাহাসিতে একাকার হলো। অনেকসময় প্রায় অনেকসময় পার হলে ও বাবা মেয়ের ছাড়াছাড়ি নেই। পুরো বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য খুশির জল ফেলল ফোঁটা ফোঁটা।
ইশা তো দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অমন দৃশ্য দেখে হাসল। ফোনে কয়েকটা ছবি ও নিল।
পরী রিকের পুরো মুখ আদর দিতে দিতে লালা লাগিয়ে দিল। রিক ও দিল। বলল, মা টা কবে ফিরবে? একা লাগবে খুব।
পরী কাঁদতে কাঁদতে হাসল। বলল, এতততততো আমমমাহ।
রিক ও পরীর মতো করে ফ্লাইং কিস ছুড়ে বলল, আমমমমাহ।
রিপ কোলে তুলে নিল পরীকে। বলল, তোমার মেয়ে কি শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছে? আশ্চর্য!
রিক বলল, তাড়াতাড়ি ফিরিস। সাবধানে থাকিস।
পরী সবাইকে হাত দেখিয়ে বলল, তা, তা, তা।
মিনি খাঁচার ভেতর ডানা ঝাপটাল। বলল, তা,তা,তা।

_________________________

প্রকৃতিতে শীতল বাতাস। মৃদুমধুর হাওয়ায় উড়ছে মেয়েটির চুল। শাড়ি আঁচল স্থির, ভারী হওয়ায়। তার কিছুটা দূরে ছোট্ট মেয়েটি খেলা করছে আর দুইটা বাচ্চার সাথে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে তা দেখছে। আর হাসছে।

দূর থেকে দাঁড়িয়ে কেউ একজন মেয়েটিকে খুব ভালোভাবে দেখছে। মনভরে দেখছে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে এভাবে দেখা কি আদৌ সম্ভব? ভাই নামক এক অদৃশ্য বেড়াজালে সে আটকা। এই বেড়াজাল কখন ছিড়বে। আজ তো ছেঁড়ার কথা। ইশু তো তারই ছিল। যখন সে বুঝতে শিখেছে ভালোবাসা কি? সেই দশ বছর বয়স থেকেই। ইশু তো তখন কত পিচ্চি ছিল? সারাক্ষণ রিপুদা রিপুদা বলে ঘুরে বেড়াত। এই মেয়েটাকে সে তখন থেকেই ভালোবাসে। জীবনের এই সাতাশ আটাশ বছর বয়সে এসে সে এখন ও ঠিক সেভাবেই ভালোবাসে ওই পিচ্চি ইশুকে। যদি ও ইশু পিচ্চি নেই। ইশু অনেক বড় হয়েছে। সব বুঝতে শিখেছে। হয়ত বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুঝে। বেশি বুঝলে ও যেটা বুঝা দরকার সেটাই বুঝেনা। তার চোখে পড়েনা কোনোকিছু। সে বুঝতে চায়না কোনোকিছু।
রিপ বেলুন বিক্রেতা থেকে একগুচ্ছ বেলুন নিল। পরী তখন ছোট্ট দুইটা বাচ্চার সাথে খেলায় মত্ত। খিলখিল করে করে হাসছে। আর বকবক করে কি কি সব বলছে তার ভাষায়। ইশা ঘুরেফিরে দেখছে পরীর কান্ড। রিপুদাটা কোথায় গেল?
রিপ বেলুন হাতে নিয়ে ডাকল পরীকে। পরী মা নিয়ে যাও। দেখো কি এনেছি। পরী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। হাতের মুঠি দিয়ে কপালের চুল সরাল ঠিক ডক্টর আদি চৌধুরী যেভাবে কপালের একপাশ হাত বুলায়। ইশা অবাক হলো। এই বাজে অভ্যাসটা কখন শিখল পরী? ডক্টর আদি চৌধুরীর সন্তান বলতে কিচ্ছু হয়না। কিচ্ছু না।
রিপ ইশার দিকে তাকাল। বলল, তোর জন্য কিনিনি। আমার মায়ের জন্য কিনেছি।
ইশা হাসল। বলল,
‘ হ্যা এখন আমাকে কি দরকার? তোমাদের তো মা একটা আছে।
পরী দৌড়ে এল। রিপের পান্জাবী টেনে ধরে বলল, রিইইইই ওততো।
রিপ পরীকে কোলে তুলে নিয়ে বেলুনের গুচ্ছ হাতে ধরিয়ে দিল। পরী খুশি হয়ে রিপের গালে গাল লাগিয়ে আদুরে কন্ঠে ডাকল রিইইই।
মুখ ফুলিয়ে তাকানো ইশার দিকে তাকিয়ে রিপ বলল,দেখেছিস আমাকে পাম দিচ্ছে।
ইশা কথা বলল না। আর এই রাগী মুখশ্রীতে স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করল রিপ। ইশা ছোট ছোট চোখ করে তাকাল রিপের দিকে। রিপ হু বলে আওয়াজ করল কিন্তু চোখ সরাল না। ইশা বলল, কি হয়েছে।
রিপ কাঁপাকাঁপা হাতে একটি কাঠগোলাপ বাড়িয়ে দিল ইশার দিকে। ইশা আচমকা হেসে দিল। বলল, এটা কোথায় পেলে।
রিপ চমকাল। আমতাআমতা করতে করতে বলল,
‘ ওই ওখানে একটা গাছ ছিল। ছিড়ে নিয়েছি। তোর জন্য। নিবিনা?
ইশা কেড়ে নিল। বলল, কেন নেব না? কিন্তু ছেঁড়াটা ঠিক হয়নি।
রিপ মাথা চুলকাল। পরী ইশার হাত থেকে ফুলটা কেড়ে নিতে চাইল। ইশা দিল না। পরী জোরে আওয়াজ করে ডাকল, ফিপপি?
রিপ বলল,দেখেছিস কি ধমক?
ইশা হাসতে হাসতে বলল, দেব না তোমাকে। এটা আমার।
পরী রিপের কোল থেকে ঝাপ দিতে চাইল ইশার কোলে। ইশা দৌড়ে সরে গেল। বলল, উহুম দেব না। খুব খুব মারব তোমাকে।
পরী কাঁদার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারমধ্যেই পরীর সামনে কাঠগোলাপ এনে দিল আদি। ইশা দেখেছিল কিছুআগেই। সে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, রিপদা আমি ওখানেই আছি।
রিপ অবাক হয়ে তাকাল আদির দিকে। পরী কেড়ে নিল কাঠগোলাপ আদির হাত থেকে। ফ্লাইং কিস ছুড়ে মেরে বলল, আমমমাহ…..
আদি হাসল। বলল,বাহঃ তুমি ফ্লাইং কিস ও ছুড়তে জানো?
পরী জবাব দিলনা। কানে গুজার জন্য কানের কাছে ফুলটা নিয়ে গেল। ডাকল রিইইইইই……
রিপ বলল,কানে কিভাবে দেবে মা?
আদি হাসল। বলল, এখানে হঠাৎ। এনি অকেশন?
রিপ বলল, তুই এখানে কেন শালা? আমার কত বড় ক্ষতি করলি তুই জানিস?
আদি কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল,’ কি করলাম আমি?
রিপ জবাব দিলনা। পরীকে নিয়ে চলে গেল। আদি সাথে সাথে পিছু ফিরে তাকাল মেয়েটার দিকে। ইশা পা ফেলতে ফেলতে চলল। কোনো বোধদয় নেই তার। অনুভব হালকা। আদি তার পিছু নিল। ডাকল,
‘ শুনছেন। কথা ছিল।
ইশা থমকাল। কিন্তু পিছু ফিরল না।
আদি দৌড়ে গেল। ইশার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে থাকল। যখনি ইশা আড়চোখে তাকাল,তখনি সরাসরি চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। অনেকক্ষণ কাটল নীরবতায়। বহুসময় পার হয়ে যাওয়ার পর আদি জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছেন?
ইশার হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে প্রচন্ড হাসি পেল। কতগুলো দিনপর সে এমন প্রশ্ন শুনল নিজের স্বামীর মুখে। অদ্ভুত ব্যাপার। ইশা হাসল তবে তা দেখাল না। বলল,
‘ ডক্টরদের বলতে হয়না কেমন আছি। তারা তো চেহারা দেখলেই বুঝে যেতে পারে কেমন আছি। কেমন আছে।
আদি প্রত্যুত্তরে হাসল না। বলল,
‘ শরীর কেমন আছে তা বুঝা যায়। বুঝতে পারি। কিন্তু মন কেমন আছে সেটা তো বুঝতে পারিনা।
ইশা অবাক হয়ে ঠোঁট গোল করে বলল, ওহহ! আপনি মনের কথা বলছেন?.
আদি বলল, হ্যা।
ইশা বিশেষ পাত্তা দিল না আদিকে। আদি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ শাড়ির রংটা আপনাকে মানায়নি। কেউ বলেনি?
ইশা অবাক হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, বলেছে। তবে আমি কারো কথাকে পাত্তা দিইনা। প্রয়োজন মনে করিনা।
আদি ও ইশার মতো করে ঠোঁট করে বলল, ওহহহহ। আচ্ছা।
ইশা জবাব দিল না। তার রাগ লাগল খুব।
অদ্ভুত সুন্দর নির্মল বাতাস বয়ে গেল হঠাৎ। গাছের পাতা,ফুল নড়ে উঠল।
আদি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বলল, আপনার কাছ থেকে কিছু চাইতে পারি? বেশি কিছুনা।
ইশা এবার অবাক হলো। বুক তার ধ্বক করে উঠল। গলা উঁচিয়ে দেখল রিপ আর পরীকে। কোথাও দেখা গেলনা। সে ছুটল সেদিকে। কিন্তু বেশিদূর এগোলো না । তার শাড়ির আঁচলে টান অনুভব হলো। ঠিক কয়েকবছর আগের মতো। ঠিক তিনবছর আগে ও ডক্টর যেভাবে শাড়ির আঁচল ধরে রাখত তার। ঠিক সেইরকম। এ মুহূর্তে সে রাগ করার মতো কিছু খুঁজে ও পেলনা। সাথে সাথে পিছু ফিরে তাকালে আদি ফেলে দিল তার শাড়ির আঁচল। বলল, সরি, সরি, আমার ভুল হয়ে…..
ইশা কিছু বলল না। আদি এগিয়ে এল। ইশার দিকে তাকিয়ে অনুনয় নিয়ে বলল,
‘ আমি জানি আপনার আমার পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনার কাছ থেকে আমার চাওয়ার কিছুই নেই। থাকলে ও এখন সেই সুযোগ নেই। না আপনার। না আমার। আপনি অন্য কারো স্ত্রী। আর আমি ও অন্যকারো স্বামী।
আই প্রমিজ আমি জানতে চাইবা না কে আপনার স্বামী। কি করে। কোথায় থাকে। কোনো প্রশ্ন করব না। শুধু একটি হেল্প লাগবে আমার। আমার মনে হয় সেটি আপনিই পারবেন।
ইশার দুশ্চিন্তা বাড়ল। মিনি যদি দেখে ফেলে ডক্টরকে। খাঁচার ভেতর থেকে যদি ডাক দেয়?
আদি প্রশ্ন করল। আপনি কি বিরক্ত?
ইশা বলল,
‘ না। বলুন।
আদি তার সামনে এসে দাঁড়াল। কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল,
‘ আপনি মিষ্টি নামের কাউকে চেনেন?
ইশার বুক কেঁপে উঠল। সাথে তার পুরো শরীর। সে প্রশ্নের মর্মার্থ না বুঝল না প্রথমে। মিষ্টি ডাকটি শুনে সে চমকাল। খুশি হলো। চোখে জল টলমল করে উঠল। কিন্তু যখনি বিষয়টি বোধগম্য হলো তখন সে সাথে সাথে পিছু ফিরল। চোখাচোখি সামনাসামনি হয়ে গেল আবার ও। ইশা বিড়বিড় করে জানতে চাইল,
‘ মিষ্টি?
আদি মাথা নাড়ল। বলল, হ্যা মিষ্টি। আমার ওয়াইফের নাম মিষ্টি।
ইশা চুপ থাকল। মুগ্ধ হয়ে শুনল সেই কথা।
‘ আমার ওয়াইফের নাম মিষ্টি। বাজতে লাগল সেই শব্দ কানে। আমার ওয়াইফের নাম মিষ্টি। আমার ওয়াইফের নাম মিষ্টি। ইশা যেন অন্য এক জগতে পা রাখল। ঠোঁট বিস্তৃত করে হাসল সে।
আদি অবাক হলোনা। কষ্ট পেল শুধু। যে কষ্ট পরিমাপ করা যায় না। দেখা যায় না। শোনা যায় না। সে তো এই মেয়েটির ছলছলে চোখ দেখতে চেয়েছিল। মেয়েটার ঠোঁটের হাসি নয়। কান্না দেখতে চেয়েছিল। হিংসে দেখতে চেয়েছিল। অভিমান দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি কি দেখাল তাকে? হাসি? তার হাসি পাচ্ছে?
আদি নিজের সব রাগ, অভিমান, কষ্ট লুকালো। সে জানে অনর্থক তার এসব অভিমান। তারপর ও কেন জানি অভিমান জমে গেল বুকে। এই অভিমান কখনো প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ কি আসবে? সুযোগ চলে যাওয়ার পর হঠাৎ এমন ভাবনা আসা কি হাস্যকর নয়?
ইশা নীরবে হেসে বলল, মিঃ আদি। আপনি মিষ্টির হাজবেন্ড হয়ে তাকে চিনেন না! আর আমি কি করে চিনব? ব্যাপারটা হাস্যকর না?
আদি কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। শুধু বলল,
‘ আপনি ও চেনেন না তাকে? তাহলে কে চেনে?
ইশা অদ্ভুত ভাবে প্রশ্ন করে বসল।
‘ প্রশ্নটা নিজের মনকে করুন। উত্তর পেয়ে যাবেন।
আদি সরাসরি চোখ তুলে তাকাল ইশার দিকে। চকচক করা চোখ চোখে পড়ল ইশার। হয়ত সে ভুল দেখল। আদি বলল,
‘ আমার মন কথা বলেনা বৃষ্টি। বলে না। যদি বলত তাহলে আজকে নিশ্চয় বৃষ্টি হতো। মন কেমনের বৃষ্টি।
ইশা শুধু নিঃশব্দে হাসল কিংবা কাঁদল। আওয়াজ করে বলল, মিঃ চৌধুরী বৃষ্টি ঠিকই এসেছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে আসেনি। আর এর কারণটা আমি আপনি নই কিন্তু। ভাগ্যের পরিহাস।
আদি পিছু হাঁটে দুই পা। বলে, আপনি সত্যি চেনেন না?
আপনার বয়সী কিংবা বড় কিংবা ছোট ও হতে পারে। কিন্তু চেনার কথা।
ইশার বলে দিতে ইচ্ছে হলো আপনার মিষ্টি আপনার সামনেই আছে। খুব কাছে আছে। আপনার পাশেই আছে। কিন্তু দেখছেন না। আপনি অন্ধ ডক্টর।
আদি চোখ নিচে নামিয়ে রাখে। এদিকওদিক তাকিয়ে বলে, দুঃখিত আপনাকে ডিস্টার্ব করায়।
ইশা বলল,
‘ কি জন্য খুঁজছেন তাকে?
আদি ইশার প্রশ্নে চমকাল। বলল, ‘অদ্ভুত প্রশ্ন। স্বামী তার স্ত্রীকে কেন খোঁজে?
ইশা মাথা নামিয়ে হাসল। বলল,
‘ হারাতে দিলেন কেন?
আদির কন্ঠে রাগ ধরা দিল। বলল,
‘ আমি হারাতে দেওয়ার কে? যদি সে নিজ থেকেই হারিয়ে যেতে চায়।
ইশা হাসল আওয়াজ করে। বলল,
‘ সে হারিয়ে গেল আর আপনি হারিয়ে যেতে দিলেন। যাইহোক এত কথা কেন বলছি আমি? আপনার সাথেই বা কেন কথা বলছি আমি? কে হন আপনি আমার?
আদির ভাবান্তর ঘটল একটি প্রশ্নে। কে হন আপনি আমার?
কথার বাণে ও কি কাউকে আঘাত করা যায়? যদি যায় তাহলে বলতেই হবে। ইশা মেয়েটি সেই কাজ খুব ভালোভাবে পারে। খুব সুনিপুণ ভাবে সে আঘাত করতে পারল আদিকে। আদি উত্তর দিল না সে প্রশ্নের। শুধু বলল,এই সামান্য কথা বলার জন্য কি কেউ হতে হয়?
ইশা উত্তর দিল না। হেঁটে এগিয়ে গেল। আদি তার পিছু পিছু হেঁটে গেল। বলল,
‘ মিষ্টি আপনার মতো দেখতে।
ইশা স্তব্ধ হয়ে গেল। আদি বলল, আমার মনে হয়। কারণ আমি যখন মিষ্টিকে ভাবার চেষ্টা করি তখন শুধু একটি চেহারা ভাসে। আর একটি দৃশ্য। বৃষ্টির দিনের। কেন এমন হয়?
ইশা চাপা গলায় গর্জে বলল,
‘ আপনি যান এখান থেকে।
আদি দুঃখিত গলায় বলল, আপনি বৃষ্টি, মিষ্টি নন। আর আমি মিষ্টিকেই খুঁজছি। বৃষ্টিকে নয়। তাই রাগার কোনো প্রশ্নই আসেনা। আপনি নিজেকে মিষ্টি ভাববেন না। সে মোটেও আপনার মতো স্বার্থপর নয়। সে ফিরবে আমার কাছে। কিন্তু আপনি তো……
ইশা চাপা গলায় বলল, যান। আমার সামনে আর আসবেন না। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছেনা। আপনাকে কোনো সাহায্য আমি করতে পারব না।
আদি পলকহীন তাকিয়ে থেকে শুনল ইশার কথা । বলল, যাচ্ছি। আর আসব না। কখনো আসব না। আপনি ও আমার সামনে পড়বেন না। কোথাও আসবেন না আপনিও। কল্পনায় ও না। পাষাণ।
নিজের মন পড়তে না পারা মানুষগুলো বোধহয় এমনই হয়। তারা বুঝে উঠতে পারেনা তারা আসলেই কি চায়?
কাকে চায়। আদি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল। ইশা এগিয়ে চলল সামনে। আজ তার খুশির দিন। তবে এই খুশির কারণে তার হাসতে ইচ্ছে করল না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করল পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো সে আজ ডক্টরকে শুনতে পেয়েছে। ডক্টর তার আছে। ডক্টর তাকে ভালোবেসেছে বৃষ্টিরূপে। আজ ও ভালোবাসে মিষ্টিরূপে। রূপ দুইটা কিন্তু মানুষ তো একটা।
আখিঁজলে ভেসে ভেসে ইশা পা বাড়ায়।
আদি ও পা বাড়ায় তার উল্টো দিকে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। দূরে দাঁড়ানো রিপ ইশার কাছে এগিয়ে এল। বলল, আদি কি বলছিল?
পড়নে নীল কূর্তি, আর সাদা সেলোয়ার ওড়না পড়া মেয়েটি গাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে নামল। আফাজ আহমেদ জিজ্ঞেস করল, আদি কি এখানেই? তুই সিউর ইমি? আমি কি চলে যাব?
আইমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জবাব দিল,লিয়া আন্টি তো বলেছে আদি এখানেই এসেছে। তুমি চলে যাও চিন্তা করোনা। আমি বাসায় ফিরব।
এলোমেলো পায়ে হেঁটে যখন আদি আর ও সামনে এগোলো মেয়েটাকে দেখার সাথে সাথে সে থমকে দাঁড়াল। একদৃষ্টে তাকাল।
আদিকে দেখার সাথে বুক চিরে যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল আইমি। আদির মলিন চেহারায় হাসির ছিটেফোঁটা ও না দেখতে পেয়ে আইমির মুখটাই মলিন হয়ে গেল। আদি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আইমি ধীর পায়ে এগোতে এগোতে আদির সামনে এসে জাপটে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে হুড়মুড় করে কেঁদে দিয়ে বলল, আই মিসড ইউ আদি। মিসড ইউ এ লট।
আদি যেভাবে আগে ছিল ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। চড়ল না। আইমি কাঁদতে কাঁদতে তার বুক ভিজিয়ে দিল। ভেজা ভেজা অনুভব হওয়ায় সে মুখ খুলল, ছাড়ো আইমি।
আইমি আর ও চেপে ধরল। বলল, আমি আগের আদিকে চাইনা। এই আদি আমার জন্য ঠিক আছে। তুমি এত চুপ কেন আদি। তুমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেছ। কোথায় খাচ্ছ? কি করছ আমি কিচ্ছু জানিনা। তুমি যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছ। কিন্তু কেন আদি?
আদি শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। আইমি তাকে ছেড়ে দেয়। আদি সামনে ঘুরে। দূরে ওই শাড়ি পড়া রমণী ও দেখা গেল তার দিকে তাকাল। মেয়েটির খুশিতে কিংবা দুঃখে চোখ চকচক করল। আদি বোধহয় ভুল দেখল। আইমি আদির সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, কেন এত চুপ আদি। আমার কষ্ট হচ্ছে আদি।
আদি তারপর ও চুপ। কি বলবে সে? কি বলা উচিত তার। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষগুলো বড্ড নিষ্ঠুর। কে ভেবেছে তার কথা? মা বাবা? ওই দূরে দাঁড়ানো মেয়েটি? যে চোখের আড়াল হওয়া মাত্রই অন্যের হাত ধরেছে। কে ভেবেছে তার কথা ওই চিরকুটের মালিকিন? মিষ্টি? যে তার নিজের দায়িত্ব শেষ করে চলে গিয়েছে। আদির কথা একবার ও ভাবেনি। আইমি তাকায় আদির মুখপানে। বলে, আদি তুমি কিছু খাওনি?
আদি শুকনো হাসি উপহার দেয় আইমিকে। বলে, খেয়েছি। কারো মুখের দু একটা কথায় এমন শক্তি থাকে পেট ভরে যায়। অন্যকিছু খাওয়া লাগেনা। আমি সরি ইমি,তোমাকে এতদূর নিয়ে আসলাম।
আইমি চোখের জল মুছে নেয়। বলে, চলো আমরা পাশের রেস্টুরেন্টে যাই। খেতে খেতে কথা বলি?
আদি নড়ে না। বলে,আমার খিদে নেই ইমি।
‘ তাহলে চলো বাসায় যাবে তোমাদের। আন্টি অসুস্থ আদি।
আদি হাত ছাড়িয়ে নিল। বলল, না। যাব না।
আইমি হতাশ হলো। বলল,
‘ কেন এমন করছ আদি?
আদি চুপ থাকল।
আইমি আবার ও বলল,
‘ আমাদের বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে আদি। তুমি খুশি ছিলে আদি। হঠাৎ এমন আচরণের কারণ কি?
আদি কোনোকথা বলেনা। কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়া মায়াবিনীর চলে যাওয়া দেখে সে। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, পাষাণ।
আইমি বলে, আদি আমরা কোথাও বসি?
আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? তোমার চেহারার কি অবস্থা দেখো আদি। তুমি নিজের খেয়াল রাখছ না?
এটা ওটা বলে যায় মেয়েটি অবিরত। কি আশ্চর্য! আদি আচমকা এক কাজ করে বসে। দূরের ওই মেয়েটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জাপটে জড়িয়ে ধরে আইমিকে। বলে,
‘ ইমি সবাই চলে যাক কিন্তু তুমি থেকো। সবাই স্বার্থপর ইমি তুমি এমনটা কখনো হইয়ো না। সবাই খানিকক্ষণের জন্য আমার জীবনে আসে ,আবার চলে যায়। আমি ছোঁয়ার আগে। ধরার আগে। কিছু বলার আগে। তুমি যেও না ইমি। আমি ভালোবেসে ঠকে গেছি ইমি। তুমি কখনো ঠকিওনা। কখনো না। আমি না বাসলে ও তুমি আমায় ভালোবেসো। আমি কষ্ট দিলে ও তুমি আমার পাশে থেকো। আমি ছুড়ে ফেললে ও তুমি আমায় আঁকড়ে ধরে রেখো। কখনো চোখের আড়াল হয়ে গেলে মনের আড়াল করোনা। কখনো আমায় ছেড়ে যেওনা ইমি। যে পরিস্থিতি আসুক আমাকে রেখে যেওনা। তোমার সাথে রেখে দিও। নয়ত নিয়ে যেও। কিন্তু একা ছেড়ে যেওনা ইমি। তুমি আমার বুকে আছ ইমি কিন্তু তারপর ও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কোথাও একটা শূন্যতা থেকে যাচ্ছে। এই শূন্যতা কেন পূরণ করতে পারছ না ইমি? কেন?
আইমি মুখ তুলে তাকায় আদির দিকে। বলে, আমি পূরণ করে দেব। কথা দিচ্ছি কখনো তোমায় ছেড়ে যাব না। তোমার সবরকম পরিস্থিতিতে আমি তোমার পাশে থাকব। তোমার মনমগজ,এই হৃদয়পিঞ্জরে শুধু ইমির বসবাস হবে। ইমিই থাকবে সেখানে। আর কেউ নয়।

__________________________

দেখতে দেখতে নেমে এল সন্ধ্যা। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বাইক আর একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। মেয়েটির বুকের উপর আধশোয়া হয়ে একটি ছোট্ট মেয়ে মেয়েটির মুখে আঁকিবুকি করে ডাকছে, আমমমা, আমমমাহ, রিইইইইই, মিননননি।
মানুষজন দৌড়ে এল। পড়ে থাকা একটি খাঁচায় একটি টিয়ে পাখি ডানা ঝাপটে বলল,
‘ রিইইই, মিষ্টি, প্রিন্সেস।
লোকজন জড়ো হলো। বেশি আঘাত পেয়েছে ছেলেটি। মেয়েটি কপালের পাশে সামান্য আঘাত পেয়েছে, হাতে,পিঠে পেয়েছে। ছেলেটি কপালে,নাকে,মুখে সবখানে আঘাত পেয়েছে। ভাগ্য ভালো প্রাণটা একেবারে যাইনি। লোকজনের কোলাহলে ইশার জ্ঞান ফিরল। দূরে পড়ে থাকা ছেলেটিকে দেখে সে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। পরী ও তার কান্না দেখে কেঁদে দিল। একজন মহিলা এসে কোলে নিল পরীকে। শান্ত করতে চাইল। ইশা দৌড়ে গেল রিপের কাছে।
‘ রিপের মাথা তার কোলে নিল। এলোমেলো ভাবে কাঁদার জন্য কথা বলতে ভুলে গেল। যখনি কথা স্পষ্ট হলো,তখন সে মুখ ধরে ডাকল,
‘ রিপদা উঠো। এই রিপদা। শুনতে পাচ্ছ আমায়। এই রিপদা। রিপদা। আমার জন্য সব হয়েছে রিপদা। ওই শয়তানগুলো আমাকে মারতে চেয়েছিল,তুমি আঘাত পেলে। আমি তোমাকে আর কত আঘাত দেব রিপদা? তুমি উঠো, এবার আমি তোমাকে সব বলে দেব। তুমি আমার পাশে থাকবে আমি জানি রিপদা। চুপ করে থেকোনা রিপদা। উঠো প্লিজ। এই দেখো ইশু কাঁদছে। তোমার জন্য কাঁদছে। তুমি চোখ খোলোনা? বন্ধ করে কেন রেখেছ? এই রিপদা।
তার কান্নার আওয়াজে ভারী হয় পরিবেশ। কয়েকজন এসে রিপকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার তাড়া করে। ইশার হাতে লেগে যায় রক্ত। সে সেই রক্ত দেখে রিপের সেই রক্তাক্ত চেহারা দেখে জোরে জোরে কাঁদে। কতবছর পর সে এভাবে কাঁদছে। কতবছর পর। সে রিপের যাওয়া দেখে। কেঁদে কেঁদে বলে, রিপদা আমি অপরাধী। আমি অন্যায় করেছি। তোমাকে না জানিয়ে আমি অনেক বড় ভুল কাজ করে ফেলেছি। ইশা দাঁড়াতে পারল না। কি আশ্চর্য! তার পা নাড়াতে পারল না। ব্যাথায় ঠনঠন করে উঠল। সে আবার কেঁদে দিল। পরী চেঁচিয়ে কাঁদল। ডাকল, আমমমাহ রিইইই………
ইশার কাছে কয়েকটা মহিলা এগিয়ে এল। বলল, তোমাকে ও হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। তোমার বাচ্চাটা ও কপালে সামান্য চোট পেয়েছে।
ইশা বলল, আমার ফোন কোথায়? রিপদার ফোন? ফোন পাওয়া গেল। কিন্তু ফোন তুলল না কেউ। রিপের ফোন ভেঙ্গে গেল। পরী আওয়াজ করে কাঁদল।
ইশা ভেবেচিন্তে বলল, আমার বাচ্চাটাকে একটু বাসায় পৌছে দিতে পারবেন। আপনি তো আমার মায়ের মতো। বাচ্চাটা আর এই পাখিটাকে এই ঠিকানায় পৌছে দিন দয়া করে। আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ।
মহিলাটি অভয় দিয়ে বলল, মা যখন ডেকেছ তখন আমি আমার কাজ করব। কিন্তু তোমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। অবস্থা করুন।
ইশা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা রিপকে দেখে আবার কেঁদে দিল। ডাকল, রিপদা উঠো। ইশুর কাছে ফিরে এসো। প্লিজ ফিরে এসো। এতবড় শাস্তি আমায় দিওনা। আমার আর কেউ নেই। আমাকে অত ভালোবেসে আগলে রাখার মতো কেউ নেই। আমাকে এতিম করে যেওনা। যাওয়ার কথা ভেবোনা। আমি অসহায় রিপদা। খুব অসহায়। তুমি ছাড়া আমি অসহায় রিপদা।

__________________

মানসিক অশান্তি তার উপর ডক্টর ইমদাদের দেওয়া প্রত্যেকটা টেস্টের জন্য ভীষণ ব্যস্ত আদি। সময়টা নিজেকে দিচ্ছে। কোনোকাজেই মন বসাতে পারছেনা। এত রোগীর লাইন পড়ে গেছে। অন্য ডক্টরদের উপর কাজের চাপ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। আদির অসুস্থতার কথা জানায় তাকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ সে নিজের একটি কাজের জন্য হসপিটালে আসল।
পুরো হসপিটাল বোধহয় ঝাড়ু দিচ্ছে মেয়েটির শাড়ির আঁচল। কপালে আর হাতে,পায়ে মেয়েটির ব্যান্ডেজ। ভালো করে হাঁটতে পারছেনা। তারপরে ও মেয়েটি দৌড়ানোর চেষ্টা করছে। আদির রাগ লাগল। সে শক্ত গলায় ডাক দিল, আর ইউ মেনটালি সিক? এভাবে কেউ কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে? হসপিটালের বদনাম রটানোর চেষ্টা?
কেন যেন মেয়েটির চেহারা সে দেখল না। কিন্তু চিনতে পারল। মেয়েটির সেদিকে হুশ নেই। সে ছুটে গেল। দুই জন নার্স তার পিছু নিল। মেয়েটি শুনল না কারো বারণ। ডুকে পড়ল অন্য একটি কেবিনে। জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বেডে শুয়ে থাকা ছেলেটিকে। ছেলেটির মুখের অক্সিজেন মাস্ক সরে গেল। মেয়েটি অনবরত কাঁদতে কাঁদতে ডাকল,
‘ রিপদা,,,,, উঠো না। আর কতক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকবে? আর কতক্ষণ? আমাকে আর কত কাঁদাবে। নার্স এসেই তাকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সরাতে পারছেনা। প্রায় অনেকক্ষণ পর যখন নার্স একজন বলল, ওনি মরে যাবে। এমন করলে?
ইশা তখনি চুপচাপ সরে গেল। এলোমেলো কন্ঠে বলল, না না রিপদা মরবে না। আমার জন্য রিপদাকে বাঁচতে হবে। আমাকে আগলে রাখার জন্য। আমাকে প্রটেক্ট করার জন্য।
কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করল আদি। ইশা দেখার আগেই চুপচাপ সরে পড়ল।
তালহা বেগম ছুটে এল। রিক ছুটে এল। মুনা ও ছুটে এল। তালহা বেগমের আহাজারিতে ভারী হলো পরিবেশ। সব দোষ ইশার? ওই মেয়েটা শেষ করল সব।
ইশা অসুস্থ শরীর নিয়ে বসে রইল হসপিটালের করিডোরে। সুনামধন্য ডক্টর আদি চৌধুরী শুধু লুকিয়ে দেখল মেয়েটিকে। সে তো সুস্থ, সবল দেখেছিল সবাইকে। কখন এতসব হলো?
আদি এগোনোর সাহস পেলনা।

বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।সময়টা মাঝরাত। রিপের জ্ঞান ফিরল। পিটপিট করে চোখ খুলতেই ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে তার দিকে ঝুঁকে পড়ল ইশা। কেঁদে ডাকল, রিপদা…..
রিপ ব্যান্ডেজে মোড়ানো ঠোঁট নেড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসার চেষ্টা করল। ইশা তার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ রিপদা সবাই ছিল এতক্ষণ। তুমি আরেকটু আগে জেগে উঠতে পারো নি?
রিপ অবশ কন্ঠে বলল,
‘ তুই আঘাত পেয়েছিস?
ইশা কেঁদে কেঁদে বলল, ‘ এখনো ও আমার কথা ভাবছ তুমি? নিজের কথা ভাবো।
‘ আমার জন্য তো তুই আছিস? এই কেঁদেছিস তুই? এভাবে?
ইশা মাথা নাড়ল কেঁদে কেঁদে। বলল,
‘ তুমি আমাকে কাঁদালে। আমি ও তোমায় কাঁদাব। যাইহোক,
এখন বলো তুমি কি খাবে?
রিপ চোখবন্ধ করে আবার খুলে ইশাকে বলল,
‘ কিচ্ছু খাব না। একটা আবদার আছে তোর কাছে। যদি কিছু চেয়ে বসি তুই দিবি? এই মুহূর্তে।
ইশা তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে নিল। বলল, বলো বলো কি চাও?
‘ দিবি? সত্যি?
ইশা মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ না দেওয়ার কি আছে। আমার প্রাণটা দিয়ে হলেও তোমার আবদার আমি পূরণ করব বলো কি চাও।
রিপ মুগ্ধ চোখে তাকাল ইশার দিকে ক্লান্ত দুর্বল চোখে। উত্তেজনায় ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে লাগল তার। কাঁপাকাঁপা হাত তুলে ছুয়ে দিল ইশার গালের একপাশ। সেই হাত দিয়ে ইশার একপাশ ধরল সে। বলল, তুই কি আমাকে মারবি তখন? আসলে আমি তোকে কিছু বলব। কিভাবে বলব?
ইশা কৌতূহল নিয়ে বলল, কি রিপদা। বলো?
রিপ তার কাঁপাকাঁপা হাত দিয়ে ধরল ইশার গালের আরেকপাশ। তার দিকে সামান্য টেনে এনে বলল,ইশু তুই তোর মন থেকে,হৃদয় থেকে ভেবে বল তো আমি তোর কে? তুই কে হস আমার? আমি কে হয় তোর?
ইশা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। প্রায় অনেকক্ষণ সময় পর রিপের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আবার তাকাল। বলল, তুমি আমার অনেককিছু। এই এতিম মেয়েটার অভিভাবক। তার মাথার উপরের ছাদ। তার ছায়া। তুমি আমার জন্য উপরওয়ালা প্রদত্ত নেয়ামত। তুমি আমার ভরসাস্থল। তুমি আমার মায়ের পেটের ভাই না হলে ও আমার ভাইয়ের চাইতে ও বেশি। তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব হয় রিপদা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি রিপদা। তোমার এই ইশুর কাছ থেকে কখনো তুমি মুখ ফিরিয়ে নিওনা রিপদা। কখনো দূরে ঠেলে দিওনা।
ইশা বকবক করতে করতে রিপের বুকে মাথা রাখে। বলে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠো। তোমার একটা ছোট্ট সাজানো সংসার আমি দেখতে চাই। তোমার সব আবদার আমি রাখব। তুমি ও রাখবে কিন্তু রিপদা। ছোটবোনের আবদার। বলোনা রাখবে তো? বলো? বলো?

ইশশ মেয়েটি যদি একবার,,
শুধু একবার ছেলেটির চোখের দিকে স্থির হয়ে দেখত তবে দেখতে পেত তার চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়েছে। অশান্তিতে মাথার রগ দপদপ করছে। গরম গরম দুফোঁটা চোখের জল কানের কাছে গড়িয়ে পড়েছে। মেয়েটি দেখল না। ছেলেটি আজ আবার ও হেরে গেল। আজ আবার তার একবুক অব্যক্ত ভালোবাসারা প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেলনা। বলা হলোনা আর। জানানো হলোনা। মেয়েটি ও বুঝল না।
ফোনকলের আওয়াজে দুজনের হুশ ফিরল। ইশা ফোন রিসিভ করল। সাথে সাথে ভেসে এল পুরুষালী কন্ঠে একটি ভয়ানক বার্তা। মেয়েটি বড়দা বলে ডাকার আগেই। শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের বড়দার কন্ঠে কান্নার আভাস পাওয়া গেল।
ইশা দুরুদুরু বুক নিয়ে আবার জানতে চাইল।
‘ কি হয়েছে বড়দা? আমার পরী মা……..
রিক অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ ইশুরে পরীকে নিয়ে গেল দুজন বোরকা পড়া ডাকাত। গুলি দেখিয়ে বলল তারা নাকি মেরে ফেলবে আমার মাকে। পুলিশকে না জানাতে বলেছে। কোথায় নিয়ে গেল পরীকে। কোথায়?
ইশার হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। সে আবার কুড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগাল। রিপ কিছু বুঝতে পারল না। ঘুমের ঔষধ দেওয়ায় তার ঘুম ভর করল দুচোখের পাতায়। চোখ বন্ধ করার সাথে একফোঁটা জল গড়াল কানের কাছে। সাদা স্বচ্ছ শুভ্র ভালোবাসারা প্রকাশিত না হওয়ার খুশির জল। কি সুন্দর!

ইশা ছুটে গেল কাঁপাকাঁপা পায়ে। ফোন বাজল তার। ওপাশ থেকে আওয়াজ এল হাসির। ইশা বুঝে গেল সব। চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, মারবেন না। মারবেন না। আমার পরীকে মারবেন না। সব দোষ আমার।
আমার কলিজাটাকে মারবেন না।
আজিজ চৌধুরী হো হো করে হাসলেন। বলল,যতদিন না আদি আর আইমির বিয়েটা কমপ্লিট হচ্ছে ততদিন এই মেয়েটা আমার কাছে থাকবে। তোমাকে নাচানোর সুতো এই মেয়েটা। পরীর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে । সে আওয়াজে ভয় মেশানো। মনে হয় তাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
ইশা গর্জে উঠে।
‘ আমার পরীকে আলোতে রাখুন। আঁধার ভয় পায় ও। ওকে খেলতে দিন। আমার মা টা ব্যাথা পেয়েছে কপালে। ওর আদর,যত্ন দরকার। একটা বাচ্চাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন। কেন? আমি তো সরে গিয়েছি। তাহলে কেন এত অবিচার? কেন?
ইশা অন্ধকারে ছুটে চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্য। সে ভুলে গিয়েছে চৌধুরী বাড়ি বহুদূর। দৌড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে তারপর ও দৌড়াতে থাকল। ঝড়বৃষ্টির মাঝে একটা মেয়ে নির্জন রাস্তায়।
পায়ে কাঁটা বিধল। সারা শরীর ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল। কিন্তু তারপর ও সে দৌড় থামাল না। কারো কারো গলার আওয়াজ ও ভেসে এল পেছন থেকে। কিন্তু সে তোয়াক্কা করল না। এগিয়ে চলল।
আচমকা কারো হাতের টানে সে আর এগোতে পারল না। থেমে গেল। একরাশ ঘৃণা বিরক্তি ক্রোধ ক্ষোভ নিয়ে তাকাল পুরুষটির দিকে।
আদি তার দুইবাহু ধরে ঝাকিয়ে বলল, এভাবে কেউ দৌড়াই? কোথায় যাচ্ছেন এমন সময়? কি হয়েছে?
আদির গায়ের ধূসর রঙের শার্ট গায়ে লেপ্টানো। চুলগুলো চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে। উদভ্রান্তের মতো আচরণ করল ইশা। আদি শার্ট সর্বশক্তি দিয়ে টান দিল। দূরে ছুড়ে মারল আদিকে। আদি অবাক হলো। নিজের বুকের কাছে তাকাতেই দেখল খসে পড়েছে কয়েকটা বোতাম। সে তারপর ও ইশার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? কি করছেন এসব? কেন করছেন?এই ঝড়বৃষ্টির মাঝে এতরাতে কেউ এভাবে বের হয়? আর ইউ মেনটালি সিক?
ইশা আর চুপ থাকতে পারল না। সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসাল আদির গালে। কিন্তু তার পরপরই সে ঢলে পড়ল আদির দিকে । আদি অবাক হওয়ার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেখতে পেল মেয়েটি এবার গুনগুন করে কাঁদছে। বসে পড়েছে রাস্তায়।
ইশা যে হাতে চড় মেরেছে আদিকে সে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাঁদল। কোনোকথা বেরোলো না। আদির দিকে আর তাকাল না। শুধু ডাকল, আমার মা। পরী।
আদি বসে পড়ল ইশার সামনে। অনেকক্ষণ বসে বসে কাঁদল ইশা। আদি ও ততক্ষণ বসে রইল। ইশা অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে দেখল আদিকে। আদি তার দিকে ততক্ষণে চেয়ে আছে। মুখটা ক্লান্ত, অবসন্ন, আঘাতপ্রাপ্ত। ইশা দাঁড়িয়ে পড়ল। দৌড়ে দৌড়ে এগোতে লাগল। পায়ের ব্যাথাকে পাত্তা দিল না। আদি বুঝে উঠতে পারল না কি হয়েছে মেয়েটার?
আদি এবার দৌড়ে গেল মেয়েটির পিছু পিছু। শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। তার হাতে পেঁচিয়ে নিল। মাথায় তার যন্ত্রণা লাগল। হাতে শাড়ি পেঁচাতে পেঁচাতে ইশাকে নিয়ে আসল তার কাছে। তার বুকের কাছে। ইশা আটকে গেল তার কাছে এসে। ঘৃণাসূচক শব্দ বের করল মুখ দিয়ে, নির্লজ্জ।
আদি ইশার কথায় কান দিলনা। শাড়ি হাতে পেঁচিয়ে দেখাল ইশাকে। বলল, আপনি মিষ্টি হতেই পারেন না। মিষ্টি আমি হাতে শাড়ি পেঁচালে লজ্জা পেত। আমি কি করে আবার একই ভুল করলাম ?
মাথায় হাত দিয়ে আহঃ শব্দ বের করে বলল, আপনি মিষ্টি নন। কখনো না।
ইশা আর পারল না। নিজের ভার ছেড়ে দিল আদির গায়ের উপর। মিনমিন করে বলল, ডক্টর ফিরিয়ে দিন। আমার মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।

আদি কিছুই বুঝলনা। বৃষ্টিজল ভেসে নিয়ে গেল সেই মিনমিন করে বলা কথা। আদির বুকের কাছে এসে মুখ ঠেকল ইশার। সে চেতন হারাল। চেতন হারানোর আগেই বিড়বিড় করে বলল, মা আমার। পরী?
চোখে ভাসল ছোট্ট মেয়েটার আদুরে মুখ। কানে বাজল একটি ডাক, ‘ আমমমমমমা।
আদি তার বুক থেকে একহাত দিয়ে ইশার মুখ তুলল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ঝড়বৃষ্টি বাদলের এক মন কেমনের রাতে আবার দেখা,সাক্ষাত, আঘাত,তার জীবনের প্রথম বৃষ্টির সাথে। চেয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্যায় বাসনা মনে জাগল আকস্মিক। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি জল জমা মেয়েটার কপালটা দেখে।
ঠোঁট কাঁপল তরতর করে। কিন্তু ছুঁয়ে দেওয়া হলোনা। এই অন্যায় বাসনা নিমেষেই নিভু নিভু হয়ে এল একটি ভাবনায়, মেয়েটি বিবাহিত। অন্যের স্ত্রী।
আদি চৌধুরী ভালোবাসতে জানে। সে চরিত্রহীন নয়। তার বৃষ্টিকে চায়না আর। বৃষ্টি নেই আর তার। তার মিষ্টিকেই চায়। যেমন সত্যি সে বৃষ্টিকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসেছে একসময়। বলা হয়ে উঠেনি। বলার সুযোগ আসেনি।
ঠিক তেমন সে এখন মিষ্টিকে ভালোবাসে। মিষ্টিকেই চায়। তার বর্তমান মিষ্টি। ভবিষ্যৎটা ও তাকে ঘিরেই হবে। সে থাকুক বা না থাকুক। সে থেকে যাবে ডক্টরের মনে মিষ্টি হয়ে ।
আর এই মেয়েটি থাকবে হঠাৎ করে,আচমকা,আকস্মিক এক মন কেমনের সকাল,সন্ধ্যা,দুপুর,রাত হয়ে। এক মন কেমনের রোদ হয়ে। এক মন কেমনের ব্যাথা হয়ে। এক মন কেমনের হাসি হয়ে। এক মন কেমনের স্মৃতি হয়ে। এক মন কেমনের বৃষ্টি হয়ে। থেকে যাবে। চিরকাল।
আদি মন থেকে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে। আমাকে ছাড়া দুজনই ভালো থাকুক। তারা ভালো থাকত না আমার সাথে। থাকত না।
বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজের তালে তালে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দূরে কোথাও আওয়াজ করে বজ্রপাত হলো। আদির সেদিকে খেয়াল নেই।
সে বিড়বিড় করে বলল,
‘ কিন্তু আমি ভালো থাকতাম বৃষ্টির সাথে। না বৃষ্টি নয় মিষ্টির সাথে। হ্যা হ্যা মিষ্টির সাথে। কারণ মিষ্টি আমার অর্ধাঙ্গিনী। জীবনসঙ্গী।

চলবে,
( আপনাদের মতামত জানাবেন)
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here