মাইন্ডগার্ড,পর্ব:৩

“অরিত্রা, গতকাল রাতে বোধহয় কিছু বলতে ফোন করেছিলে? যাই হোক, তোমার প্রশ্নের উত্তরটা হলো আমার কোনো আধ্যাত্নিক শক্তি নেই, আমি আর সকলের মতোই স্বাভাবিক। কোন পরিস্থিতিতে কেউ কি ভাবতে পারে সেটা বুঝতে পারা খুব কঠিন কোনো বিষয় না।”

অনুপম তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছে… কিন্তু অরিত্রা তার উত্তর পায়নি.. সে কাল কেনো ফোন করেছিলো তা অনুপমের জানার কথা না। অরিত্রাকে অনুপম কালকেই প্রথম দেখেছে, চিনেছে। এত অল্পসময়ে কাউকেই বোঝা সম্ভব না..অরিত্রা কখন কি ভাবতে পারে তা এত সহজে অনুপমের বুঝতে পারাটা মোটেও স্বাভাবিক না..

সকালের মেসেজটা দেখার পর থেকেই অরিত্রা বিষন্ন মনে বসে ছিলো। বাসায় মন ভালো করার মতো কোনো উপকরণ না পেয়ে মাসুদকে ফোন করে বললো সে বাইরে বের হবে। তার মাঝেমাঝে খুব বিরক্ত লাগে সবজায়গায় মাসুদকে সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু কিছু করার নেই, বাবার করা নির্দেশ। কখনো একা একা কোথাও বেরিয়ে গেলে, বাড়ি ফিরে দেখা যাবে কোথায় গিয়েছি তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাবা প্রেসার বাড়িয়ে ফেলেছে!

আজকেও অরিত্রা নয়না টি স্টলের বাইরে বসে আছে। সবসময় এখানে একা আসতে ভালো লাগলেও আজ কেনো যেনো মনে হচ্ছে পাশে কেউ থাকলে মন্দ হতোনা। মাসুদকে সাথে আনা যেতো, কিন্তু মাসুদ এতক্ষণে গাড়ি নিয়ে ফিরে গিয়েছে।

আচমকা একটা কালো ফেরারি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে যিনি নেমে এলেন, তাকে এখানে দেখার জন্যে অরিত্রা ঠিক প্রস্তুত ছিলোনা। অনুপম অরিত্রা বরাবর এগিয়ে এসে হাসিমুখে ব্রেঞ্চে বসতে বসতে বললো, “মামা, দুকাপ চা। একটা চিনিছাড়া, আরেকটাতে তিন চামচ চিনি।”

অরিত্রা এতটাই বিস্মিত যে কি বলবে বুঝতে পারছেনা।
“আপনি এখানে?”
“বাসায় বসে বিরক্ত লাগছিল, তাই বের হলাম। তুমি ভার্সিটিতে যাওনি আজ?”
“না। ইচ্ছে হলোনা। আপনি চেম্বারে যাননি যে?”
“আজ তো শনিবার, আমার চেম্বার বন্ধ।”
“ও আচ্ছা। আমি চায়ে তিন চামচ চিনি খাই, আপনাকে কে বললো?”
“তুমিই তো বললে।”
“আমি! আমি কখন বললাম?”
“এই তো বেশি চিনি খেয়ে খেয়েই মিষ্টি চেহারা বানিয়েছ!”

অরিত্রা লজ্জামাখা চাহনি নিয়ে হালকা হাসলো। মনে মনে ভাবলো, “মশাই তো ভালো মেয়ে পটাতে জানেন দেখছি।”

“না না। আপনাকে পটাতে যাবো কেনো? সত্যি কথাই বললাম।”

অরিত্রার ঠোঁটের কোণা থেকে নিমেষেই হাসি মুছে গেলো। একরাশ ভয় নিয়ে অনুপমের দিকে তাকালো।
চায়ের দোকানদার চা দিয়ে গেছে। অনুপম শান্ত ভঙ্গিতে চা খাচ্ছে, তার দৃষ্টি দুরে রাস্তার পাশে হেঁটে যাওয়া দুটা কুকুরছানার দিকে। কুকুরছানা দুটা হাঁটতে গিয়ে একজন আরেকজনের উপর উঠার চেষ্টা করছে! এটা তাদের খুনশুটির অংশ নাকি মারামারির কে জানে!

অরিত্রা-অনুপম দুজনেই চুপচাপ বসে আছে।

নিরবতা ভেঙে হঠাৎ অনুপম বলে উঠলো,

“মিনু আমার নিজের বোন না। মিনুর মা আমাদের বাসায় কাজ করতেন। আমি খালা বলে ডাকতাম ওনাকে। মিনুর জন্মের সময় খালা মারা যান। তখন আমি মেডিকেলে সেকেন্ড ইয়ারে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বাসায় মাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য খালাই ছিলো। খালা যখন মারা যায় তখন আমি পড়াশুনা, টিউশনির কাজে ব্যস্ত সারাদিন। মা বাসায় একা হয়ে গিয়েছিলো, আমার আর কোনো ভাইবোনও নেই। বিধায় মা তাই মা মিনুকে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই থেকে মিনু আমার ছোট্ট বোন। একথা কেউ জানেনা। তোমার মনে হয়তো এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলো, তাই জানালাম।”

“ওহ”
“তুমি এখানে প্রায়ই আসো নাকি?”
“মন খারাপ হলে আসি”
“আজ কি কারণে মন খারাপ?”
“জানি না!”

“হাহা। কোনোকিছু না বলতে চাওয়ার সহজ মাধ্যম হলো, জানিনা বলা।”
“আমি সত্যিই জানিনা।”
“আচ্ছা বিশ্বাস করলাম তোমাকে। দুপুর হয়ে এসেছে। তোমার বডিগার্ড লোকটা বোধহয় তোমাকে নিতে এসে গেছে। তুমি বাসায় যাও এখন।”

“জি। আপনি যাবেন না?”
“না। আরো কিছুক্ষণ থাকবো এখানে। একটু পরে যাবো।”
অরিত্রা গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে ভাবলো, আজ দেখা হয়ে যাওয়াটা আসলেই কি কেবল কাকতালীয় ছিলো!

অনুপমের সাথে বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার প্রায় একমাস হতে চললো। মোতাহার আহমেদ অরিত্রাকে বারবার বুঝিয়েই যাচ্ছেন বিয়েটা করার জন্য। কিন্তু অরিত্রা কোনো মতামত জানাচ্ছেনা। শুধু বলেছে, “বাবা যা ঠিক করবেন, তাই হবে। তার নিজের কোনো মত নেই!” অদ্ভুত হলেও এ একমাসে কাকতালীয়ভাবে অনুপমের সাথে বারবার দেখা হয়েছে অরিত্রার। কখনো লাইব্রেরিতে, কখনো বন্ধুদের সাথে রেস্তোরায় খেতে গিয়ে, আবার কখনো বা শপিং করতে গিয়ে…

অরিত্রা শেষপর্যন্ত বিয়েতে রাজি হয়েছে। শুধুমাত্র বাবার কথা রাখতে যে বিয়েটা করছে সে, তাও সম্পূর্ণ সঠিক না। এ কয়দিনে অনুপম নামের ছেলেটি অরিত্রাকে ঘিরে যেনো কোনো মায়ার বৃত্ত এঁকে দিয়েছে। দুদিন আগে অনুপমের মা অরিত্রাদের বাসায় এসেছিলেন। অরিত্রা এতো সুন্দর মহিলা খুব কমই দেখেছে। ফর্সা ধবধবে ভদ্রমহিলার চেহারা খসে মমতা, রূপ, লাবণ্য সব চুয়ে চুয়ে পড়ছে যেনো। যদিও চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু বয়স তাঁর লাবণ্যকে যেনো নষ্ট করতে পারেনি। অনুপমের মা অরিত্রাকে পছন্দ করেছেন। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে গিয়েছেন। সামনে মাসের শেষ সপ্তাহে অরিত্রার বিয়ে। অনুপম এ বিয়েতে যে খুশি, তার কোনো আলামত অরিত্রা তার চোখেমুখে খুঁজে পায়নি। যেনো সে এ বিয়ে নিয়ে উদাসীন। আজ সকালেও অনুপম অরিত্রাকে বিয়ের ব্যাপারে আরেকবার ভেবে দেখতে বলেছে। অরিত্রা কিছুতেই বুঝতে পাচ্ছেনা, কেনো অনুপম এতোবার ভাবতে বলছে। এভাবে বারবার তাকে রাজি হতে বাঁধা দেয়ার কারণেই হয়তো অরিত্রার বিয়েটা করার প্রতি জেদটা বেড়ে গেছে। অরিত্রা অনেকবার প্রশ্ন করেছে কেনো অনুপম বারবার তাকে ভাবতে বলছে.. অনুপম এর কোনো উত্তর দেয়নি।

অরিত্রা ঠিক করেছে বিয়ের কেনাকাটা দুইপক্ষেরই একসাথে হবে। তাহলে তাদের দুজনের পছন্দেই দুজনের কেনাকাটা হবে। আজ সকাল থেকে মার্কেটেই ঘুরোঘুরি করছে অরিত্রা-অনুপম। অনুপমের মা আর মিনুও এসেছে। আজ প্রথম যেনো অরিত্রা বডিগার্ড ছাড়া বাইরে বের হলো.. মোতাহার আহমেদও আসতে চেয়েছিলেন… কিন্তু তার কিছু কাজ পরে যাওয়ায় তিনি আসতে পারলেন না। অরিত্রা বারবার অনুপমের দিকে তাকাচ্ছে। সাধারণত কোনো ছেলেই বেশিক্ষণ কেনাকাটা করতে পছন্দ করেনা। অরিত্রা বিয়ের শাড়ি কেনার জন্য এতক্ষণে সাতটা দোকান ঘুরে এসেছে। পঞ্চাশোর্ধ শাড়ি দেখার পরেও একটা শাড়িও তা পছন্দ হয়নি। এখন শাড়ির চিন্তা বাদ দিয়ে গয়না দেখছে সে। তারা সকাল এগারোটায় বের হয়েছে। এখন বাজছে সাড়ে চারটা। অথচ অনুপমের চেহারায় বিরক্তির কোনো ছাপ নেই। হাসিমুখে যেনো আরো উৎসুক হয়ে অরিত্রাকে পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে মতামত দিচ্ছে। মিনু বেশ আনন্দিত। এ কয়দিনে অরিত্রার সাথে বেশ ভাবও হয়ে গেছে তার। ভাবীর কেনাকাটায় তার আগ্রহই যেনো সবচেয়ে বেশি…

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। রাতে ঘুমানোর সময় অরিত্রা যা যা কিনলো তা দেখার সময় হঠাৎ দেখলো, অনুপমের নতুন কেনা ঘড়িটা তার কেনাকাটার সাথে চলে এসেছে। অনুপম হয়তো বাসায় গিয়ে খুঁজবে ভেবে অরিত্রা অনুপমকে ফোন করলো, ঘড়িটা যে ওর কাছেই আছে সেটা জানানোর জন্য.. অনুপম ফোন ধরলোনা। অরিত্রা একটু অবাক হলো। অন্যসময় ফোন করলে এক-দুবার রিং হতেই ফোন ধরে অনুপম, আর আজ তিন-চার বার ফোন করেও অরিত্রা ওকে ফোনে পেলোনা। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছে হয়তো, বিকালের দিকে অনুপমের শরীরটাও ভালো মনে হচ্ছিলোনা। তাই আর ফোন করে অনুপমকে বিরক্ত করলোনা অরিত্রা..

পরদিন সকালে অনুপমকে ফোন করলো অরিত্রা বেশ কয়েকবার। কিন্তু গতকাল রাতের মতোই আনরিচেবল অনুপমের ফোন। অরিত্রা সারাদিন অপেক্ষা করলো। কিন্তু অনুপমকে কোনোভাবেই ফোনে পেলোনা। কাল থেকে ফেসবুকেও এক্টিভ হয়নি সে। দুশ্চিন্তায় পরে গেলো অরিত্রা… রাতে বাধ্য হয়ে অনুপমদের ল্যান্ডলাইনে ফোন দিলো.. মিনু ধরলো…

“মিনু, তোমার ভাইয়াকে ফোনে পাচ্ছিনা.. কিছু হয়েছে নাকি?”
“ভাইয়ার শরীরটা একটু খারাপ তো… তাই..”
“কি হয়েছে ওর? খুব অসুস্থ কি?”
“না.. জ্বর আসছে সামান্য”
“জ্বর কত এখন?”
“১০৪˚”
“কি বলো? এটা সামান্য?”
“এতো জ্বর কিভাবে এলো? আচ্ছা, তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলা যাবে?”
“না.. ভাইয়া ঘুমাচ্ছে…”
“আচ্ছা, ঠিক আছে…”
মিনু টেলিফোন রেখে দিলো..
অরিত্রার কেমন যেনো অপরাধবোধ হতে লাগলো। বারবার মনে হতে লাগলো তার জন্য অনুপম অসুস্থ হয়ে পড়লো। সে আজ বেচারাকে নিয়ে অত ঘুরাঘুরি না করলেও পারতো!

অরিত্রা কয়েকদিন থেকে ফোন করে অনুপমের খোঁজ নিচ্ছে। তার জ্বর নাকি কমছেই না। অনুপমের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি এ কয়দিনে অরিত্রার। অরিত্রা মোতাহার আহমেদের সাথে অনুপমকে দেখতে গিয়েছিলো। দেখা হয়নি। অনুপম ঘুমাচ্ছিলো। মোতাহার আহমেদ অনেকক্ষণ বসার ঘরে বসে অনুপমের মায়ের সাথে কথা বললেন, তাকে বিয়ে বিয়ে দুশ্চিন্তা করতেও বারণ করলেন। বিয়ের তারিখটা নাহয় আরেকটু পিছিয়ে দেওয়া হবে।

এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো কিন্তু অনুপমের সাথে যোগাযোগ হয়নি অরিত্রার। আজ কলেজ থেকে ফিরার পথে মহীপুর ঘাটে গিয়েছিলো সে।বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার পর। বাসায় খালামণি এসেছে। বাড়িতে এসে মনে হলো যেনো কোনো বড় ধরণের ঝড় বয়ে গেছে বাসার ওপর দিয়ে। মোতাহার আহমেদ থমথমে মুখে তার রিডিং রুমে বসে আছে। খালামণিরও মেজাজ খারাপ মনে হচ্ছে। অরিত্রা কাউকে কিছু প্রশ্ন করার সাহস পেলোনা, তেমন কিছু হলে তাকে জানাবে নিশ্চয়ই সবাই। নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো অরিত্রা। ঘুমে চোখ বুজে আসছে ওর, গত কয়েকদিন রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার।

কিছুক্ষণ পর খালামণি ঘরে এসে অরিত্রার বিছানার পাশে বসলো। অরিত্রাকে মৃদুস্বরে ডাকতে ডাকতে বললো,
“অরিত্রা? মা, এমন অসময়ে ঘুমুচ্ছিস যে?”

অরিত্রা উঠে বসতে বসতে বললো, “কিছু হয়েছে, খালামণি?”
“তোর বিয়েটা দুলাভাই ভেঙ্গে দিয়েছে।”

অরিত্রার মাঝে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হলোনা। যপনো সে জানতোই এমন কিছুই তাকে বলা হবে! সে শান্তস্বরে বললো, “ও আচ্ছা!”
খালামণি ভ্রু কুঁচকে বললো, “তুই আগেই শুনেছিস নাকি খবর? কে বললো? মাসুদ?”

“না। কেউ কিছু বলেনি। বিয়ে ভাঙ্গলো কেনো?”

“আমাকে তো তোর বাবা সেভাবে কিছু বলেনি। কেবল শুনলাম…”
“কি শুনলে?”

“অরিত্রা তুই কি অনুপমকে পছন্দ করে ফেলেছিস?” হড়বড়িয়ে বললো খালামণি।

“কি শুনলে বলবেনা?”

“আসলে অরিত্রা, অনুপমের নাকি…”

খালামণি কথা শেষ করার আগেই নিচতলা থেকে কাজের মেয়েটার চিৎকার শুনে দুজনেই চমকে উঠলাম।
দুজনেই প্রায় ছুটে নিচে নেমে গেলাম। কাজের মেয়েটি মোতাহার আহমেদের রিডিং রুম থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করছে। “খালাম্মা… আপা…. তাড়াতাড়ি নিচে আসেন…”

((চলবে))

Mindguard~মাইন্ডগার্ড
লেখিকাঃ জান্নাতুল মীম (নবনীতা)

#মাইন্ডগার্ড
#Mindguard
তারিখ: ১ জুন, ২০১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here