মাইন্ডগার্ড,পর্ব:২

“মিস. অরিত্রা, আপনি আমাকে কতটা চিনেন?”
অরিত্রা বিস্মিত হলো এ প্রশ্নে।
“জি? আমি? আমি… আপনাকে কিভাবে চিনবো?”
“না চিনেই বিয়েতে রাজি হলেন কেনো?”

“আমি তো বিয়েতে রাজি…” অরিত্রার কথা শেষ না হতেই অনুপম বললো, “রাজি হননি… তাইতো? আপনি জানেন আমার বয়স কতো?”
“জি না! আমি কিভাবে জানবো?” চোখ কপালে তুলে উত্তর দিলো অরিত্রা।

“তাও ধারণা করুন..”
“পঁচিশ?!!! নানা…. সাঁতাশ কিংবা আটাশ..”
অনুপম হাসলো… অরিত্রা মুগ্ধ হলো… ফর্সা কালো শার্ট পড়া ছেলেটির হাসি অত্যন্ত মার্জিত, সচ্ছ, সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর…

“হাসছেন যে?”
” আমার বয়স থার্টি এইট। জীবনের অনেকটা পথ ঘুরে এসেছি। কিন্তু তোমার মতো সবাই এ ভুলটিই করে। আমাকে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক ভাবে। অরিত্রা সত্যি সত্যি চমকালো!

“অরিত্রা, মানুষকে বাইরপ থেকে দেখে বিচার করা ঠিক না। তুমি এ বিয়েটা করার আগে একবার ভেবে দেখো। বিয়ে তোমার সারাজীবনের সবকিছুর উপর প্রভাব ফেলবে। তাই না ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নিওনা, তাতে তোমার এবং আমার দুজনারই ক্ষতিই হবে। আমি আজ আসি। তুমি ভেবে দেখো। পরে আবার কথা হবে। কয়েকমাস পর ডিসিশান নিয়ে আমায় জানিও। জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে ভেবে ডিসিশান নিতে হয়… তোমার থেকে বয়সে বেশ বড় তো, তাই একটু হলেও বুঝি”

অরিত্রা অবাক হলো। অনুপমের এসব কথা বলার কারণ কি! কেবলই কি বয়সের পার্থক্য, নাকি অন্যকিছু!

“অরিত্রা… বাবা-মার কথা সবাই ভাবে. কিন্তু শুধু তাদের সম্মানের কথা ভেবে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সারাজীবন তা বয়ে বেরাতে হবে। তাই… একটু ভেবে দেখো… ভালোর মাঝেও জঘন্য কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। তাইনা?
আচ্ছা, অনেক কিছু বললাম। ভেবোনা জ্ঞান দিলাম… আজ আসি, কেমন? ভালো থেকো…”

অরিত্রা কিছু বললোনা… অনুপমের দিকে তাকিয়ে থাকলো। দরজার কাছে যেতেই অনুপম পিছনে ঘুরে তাকালো,”অরিত্রা, আমি সত্যিই খুব সাধারণ। অসাধারণ, অসম্ভব শব্দগুলো আমার সাথে একেবারেই বেমানান লাগে। আর নিজেকে মহান প্রমাণের তেমন কোনো ইচ্ছে আমার নেই।” অনুপম হালকা হেসে চলে গেলো…

অনুপমের হাসিতে এবার ভয় হলো অরিত্রার… সে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো… ” অনুপম যাওয়ার আগের কথাগুলো কেনো বললো? আমি মনে মনে কি ভেবেছি তা অনুপম কিভাবে জানতে পারে? আমি কি তবে ভুল শুনলাম? এটা কি কেবলই কোয়েন্সিডেন্স? অনুপম কে? ওর কি কোনো আধ্যাত্নিক শক্তি আছে?”
কয়েক সেকেন্ড পরেই অরিত্রা আবার ফ্যাকাসে হেসে বললো, “ধুরর.. না.. তা কিভাবে হতে পারে? কি সব ভাবছি!” কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্ন অরিত্রাকে যেনো ঘিরে ধরলো….

রাত তিনটা বেজে তেরো মিনিট। অরিত্রা গত কয়েক ঘণ্টা যাবৎ প্রচন্ড মাথাব্যথায় ঘুমাতে পারেনি। মাথাব্যথার কারণ স্পষ্ট। অনুপম যাওয়ার মুহূর্তে তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে অনুপমের সাথে তার যোগাযোগ করা প্রয়োজন। অনুপম যাওয়ার আগে তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে গেছে। সেখান থেকে নাম্বার নিয়ে অরিত্রা ফোনে ডায়াল করলো। এতরাতে কাউকে অকারণ ফোন করা অভদ্রতার লক্ষণ। অরিত্রা তা জেনেও ফোন করলো। একবার রিং হতেই অনুপম ফোন ধরলো। অরিত্রার মনে হলো যেনো অনুপম জানতো সে ফোন করবে। তাই ফোন হাতের কাছে নিয়ে রেখেছিলো! এখন কল পেতেই সাথেসাথে ধরলো!

“হ্যালো… কে? অরিত্রা?”
“জি!”
“হঠাৎ এতোরাতে? কোনো দরকার?”
“দরকার ছাড়া ফোন দেওয়া যাবে না?”
“নানা… আমি তা বোঝাতে চাইনি। যাইহোক, কি খবর? কেমন আছো?”
“ভালোনা… মাথাব্যথা। আপনি কেমন আছেন?”
“মাথাব্যথা কেনো হঠাৎ? এতরাতে জেগে থাকা একদম ঠিক হয়নি তোমার। এখন তুমি একটা প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা…”
“আচ্ছা আমি এখন রাখি। আর কিছু কি বলবে?”
“হ্যাঁ.. আপনি কি খেয়াল করেছেন, আপনি আমাকে “তুমি” করে বলছেন এখন?”
“ওহ… স্যরি স্যরি.. আসলেই খেয়াল করিনি.”
“ইটস ওকে… কিন্তু তুমিটাই বোধহয় ভালো শোনায়..”
“হতে পারে। আচ্ছা… রাখি! তুমি ঘুমোও এখন!”

অনুপম ফোন কেটে দিয়েছে।

অরিত্রার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। এই হাসির কারণ সে জানেনা! অকস্মাৎ তার মনে পরলো সে যেকারণে অনুপমকে ফোন করেছিলো তাইতো বলা হয়নি. আরো বিস্মিত হলো যখন বুঝতে পারলো তার মাথাব্যথাটা এখন আর নেই! তাহলে কি অনুপম তাকে কোনো মায়ায় জড়ানোর চেষ্টা করছে? কিন্তু তাহলে তো এত তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে দেয়ার কথা না!

কপালে কারো হাতের স্পর্শে অরিত্রার ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে দেখলো মোতাহার আহমেদ তার কপালে হাত রেখে বিছানার পাশে বসে আছে। অরিত্রা অবাক হলো! তার বাবা তো কখনো এভাবে এসে তার পাশে বসেনি। অজানা কোনো বিপদের আশঙ্কায় অরিত্রার বুক কেঁপে উঠলো।
“কি হয়েছে, বাবা? তুমি এখানে কেনো?”
“তুমি এখনো ঘুম থেকে উঠোনি শুনলাম। তাই চিন্তা হচ্ছিলো। তুমি তো কখনো এতো সময় নিয়ে ঘুমাওনা!”
“কয়টা বাজে এখন?” বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললো অরিত্রা…
“সাড়ে এগারোটা”
“কি! সত্যি?”
“কাল রাতে ঘুমাওনি বুঝি?”
“না…আসলে একটা বই পড়ছিলাম… পড়া শেষ করতে করতে অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিলো।”
মোতাহার আহমেদ বিছানার পাশের সাইডটেবিলের দিকে তাকালো। অরিত্রা মাঝেমাঝে রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়। সকালে বইটা হয়, অরিত্রার কোলে অথবা বিছানায় আর নয়তো সাইডটেবিলে উপুড় করে রাখা পাওয়া যায়। আজ আশেপাশে কোথাও কোনো বই রাখা নেই।
মোতাহার আহমেদ খুব সাবধানে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

“রাত জাগবেনা বেশি..”
“আচ্ছা”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ মোতাহার আহমেদ বললেন, “মা… তুমি কি কোনো বিষয়ে চিন্তিত? তুমি আমাকে নির্ভয়ে জানাতে পারো।”
অরিত্রা খানিকটা চমকালো..
“নাতো, বাবা। তুমি একথা বলছো কেনো হঠাৎ?”
মোতাহার আহমেদ এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।

“অনুপমকে তোমার কেমন মনে হয়েছে?”
“কয়েক মিনিটে তো মানুষকে বোঝা যায়না, বাবা। তোমার কেমন লেগেছে? তুমি বলো।”

“অনুপমের বাবার সাথে আমার স্বল্প পরিচয় ছিলো। সেই সূত্রে অনুপমকে ছোট থেকেই চিনি আমি। বরাবর স্নেহই করতাম ওকে। বর্তমান সময়ে খুব কম ছেলের মধ্যেই আমি এত ভদ্রতা, সভ্যতা, ভক্তির ছোঁয়া দেখেছি। আর অল্পবয়সে রংপুরের নামকরা হার্টের ডাক্তার হিসেবে বেশ নামও করেছে অনুপম।”

অরিত্রা নিশ্চুপে বসে আছে…
“আমি জানি, তুমি বিরক্ত হচ্ছো. কারণ তোমার কাছে কারো নাম, যশ, ধন, সম্পত্তির কোনো মূল্য নেই। তুমি মানুষকে মনের চোখে দেখো, এসব দিয়ে বিচার করোনা। আমি তোমার মনের চোখের অর্থ খুঁজেই অনুপমকে তোমার জন্য নির্বাচন করেছি।”

অরিত্রা মুগ্ধতা নিয়ে বাবার দিকে তাকালো। মনের মধ্যে এক সুপ্ত আনন্দ দোলা দিচ্ছে। তার বাবাকে সে তাকে এতটা বুঝতে, এতটা সাজিয়ে কথা বলতে এই প্রথম খেয়াল করলো।
“অনুপমের যখন নয় বছর বয়স, তখন ওর বাবা মারা যান। অস্বাভাবিক মৃত্যু.. সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে অনুপমের বাবার সহায়-সম্পত্তি কম ছিলোনা। ওর মা ওকে একা বড় করেন। কারো দয়া, সাহায্য কখনোই গ্রহণ করতে চাননি তিনি। কারো সান্তনা, দয়া তাঁর কাছে অসহ্যকর হয়ে উঠেছিলো সেসময়!”

একটু থেমে আবার বললেন মোতাহার আহমেদ, “অনুপম ওর বাবাকে হারানোর ব্যথা প্রতিক্ষণে অনুভব করেছে, প্রতিটা মুহূর্তের কষ্টগুলোর সম্মুখীন হয়েছে.. আমার মনে হয়েছিলো, তোমরা হয়তো দুজনে দুজনার অপূর্ণতা, কষ্টগুলোকে বুঝতে পারবে.. অনুপম একজন বাবা পাবে, আর তুমি একজন মা পাবে…”

অরিত্রা চোখের কোণার জলের বিন্দু লুকাতে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালো।
মোতাহার আহমেদ ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন। অরিত্রা আচমকা পেছনে ফিরে বললো, “বাবা, তাহলে মিনু কে?”
“মিনু অনুপমের ছোট বোন! তোকে তো তখনই বললাম!”
“নিজের বোন?”
“হ্যাঁ..”

অরিত্রার ভ্রু কুঁচকে উঠলো…
“তোমার সাথে কি অনুপমের পরিবারের বরাবরই যোগাযোগ ছিলো?”

“না.. ওর বাবার মৃত্যুর পর আর সেভাবে যোগাযোগ ছিলোনা. আফজাল সাহেবের মাধ্যমে আবার সাক্ষাত হলো… কিন্তু, এ প্রশ্ন করলে কেনো?”

“এমনিতেই বাবা… আচ্ছা তুমি এখন যাও।”

মোতাহার আহমেদ বিচলিত মনে উঠে চলে গেলেন। অরিত্রা নিশ্চিত মিনু অনুপমের আপন বোন নয়। মোতাহার আহমেদ হয়তো জানেননা এসম্পর্কে!

অরিত্রা ক্ষুধার তাড়নায় ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলো। তারপর ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলো একটা আইডি থেকে মেসেজ রিকোয়েস্ট এসেছে। আইডির নাম “অনুপম চৌধুরী”।
মেসেজটি দেখে রীতিমতো বিস্মিত হলো অরিত্রা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো অদ্ভুত আতঙ্কে…

চলবে…..

Mindguard~মাইন্ডগার্ড
লেখিকাঃ জান্নাতুল মীম(নবনীতা)
পর্ব-২

#MindGuard
#মাইন্ডগার্ড

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here